বাংলাদেশি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির বাজারমূল্য: একটি গল্প ও পরিসংখ্যান

1262
মোহাম্মদ নূরুজ্জামান

লিখেছেন। মোহাম্মদ নূরুজ্জামান

সিনেমা মানেই এলাহি কারবার। বিশাল পর্দা, বুক কাঁপানো শব্দ, লার্জার দ্যান লাইফ। বিনোদন দুনিয়ার সবচেয়ে বাণিজ্যবান্ধব শিল্পমাধ্যম। বিরাট আয়োজন, বারো রকমের মানুষ, বিরাট অংকের অর্থলগ্নী আর বিরাট মুনাফার হাতছানি।

সিনেমা একটি মোহ, সিনেমা একটি কূহক। ভক্তের হৃদয়ে ঝড় তুলে স্বপ্নের মানুষেরা অবলীলায় ছায়া হয়ে ঘুরে বেড়ান রূপালী পর্দায়। হাজার হাজার স্টার শত শত সুপারস্টার কিছু সংখ্যক মেগাস্টার আলোকিত করে রাখেন  চলচ্চিত্র দুনিয়ার মহাকাশ।

আমাদের দেশে চলচ্চিত্রের বহু আক্ষেপের সেই ‘সোনালী দিন’ আর না থাকলেও সিনেমার জৌলুসে ভাটা পড়েনি খুব একটা। সিনেমার মান নিয়ে প্রকাশ্যে গালমন্দ জারি রেখেই এখনো প্রিয় তারকাকে এক নজর দেখার আশায় দিনের পর দিন বিএফডিসির গেটে ভীড় করে থাকেন ভক্তকূল। নায়ক-নায়িকা হবার আশায় জীবন কোরবান করে দেওয়া তরুণ-তরুণীরা ‘কে হবে সুপার স্টার?’ জাতীয় রিয়্যালিটি শোগুলোতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। দুই সেকেন্ডের জন্যে হলেও অন্তত একবার বড়পর্দায় নিজের মুখ দেখানোর বাসনায় কেউ কেউ আজীবনের জন্য হয়ে যান এক্সট্রা আর্টিস্ট।


অনেক
বিপ্লবী আবার
চলচ্চিত্রকে ভাবছেন
সমাজ পরিবর্তনের সুনিপুণ
হাতিয়ার হিসেবে

আবার পর্দার নেপথ্যে কাজ করতে আগ্রহী মেধাবী মানুষের সংখ্যাও অগুণিত। এদেরকে সঠিকভাবে প্রশিক্ষিত করতে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে খোলা হয়েছে ‘ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ’ বিভাগ। সরকারি-বেসরকারি, এমনকি ব্যক্তিগত উদ্যোগে ফিল্ম সংক্রান্ত নানা বিষয়ে ওয়ার্কশপ-কোর্স-শর্ট কোর্স চলছে লাগাতার। অনেক তরুণ নির্মাতা টিভি নাটক বানিয়ে বানিয়ে হাত মকশো করছেন ভবিষ্যতে সিনেমা বানানোর স্বপ্ন নিয়ে। ফিল্ম সোসাইটি, স্টাডি সার্কেল থেকে শুরু করে বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফরমেও সরব ফিল্ম সচেতন মানুষেরা। অনেক বিপ্লবী আবার চলচ্চিত্রকে ভাবছেন সমাজ পরিবর্তনের সুনিপুণ হাতিয়ার হিসেবে। মোট কথা, ব্যাপক কর্মযজ্ঞ চলছে এই ইন্ডাস্ট্রি ঘিরে এবং ক্রমান্বয়ে তা বেড়েই চলেছে।

বাংলাদেশি সিনেমা হল

যাকে ঘিরে এত স্বপ্নের আনাগোনা, সেই বাংলাদেশি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির বাজার কতটা বিস্তৃত বা আরও খোলাসা করে বললে, শুধু সিনেমাকে আঁকড়ে ধরে এদেশে জীবিকা নির্বাহ করা যায় কি না সেটা ভাবছিলাম অনেকদিন ধরেই। প্রথমে একটা গল্প আর পরবর্তীকালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর একটা জরিপ এই ইন্ডাস্ট্রির অর্থনৈতিক চেহারা নিয়ে হাজির হয় আমার প্রশ্নের জবাব হিসেবে।

গল্পটা বলেছিলেন একজন শিশুসাহিত্যিক। আমার শিশুতোষ ছবি আম-কাঁঠালের ছুটি শুরু করার আগে টিমমেটদের নিয়ে যে ওয়ার্কশপ করি, সেখানে তিনি এসেছিলেন বক্তা হিসেবে। সিনেমার বাজেট প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়েই এ গল্পের অবতারণা। গল্পের কথক যদিও এটাকে বাস্তব ঘটনা বলেই উল্লেখ করেছেন, কিন্তু চরিত্রদের নাম না জানলেও গল্পের কিছু ক্ষতি-বৃদ্ধি হবে না বিবেচনায় কথকসহ সবার পরিচয় এখানে উহ্য রাখছি।

উচ্চ শিক্ষিত এক স্মার্ট তরুণ চিন্তা করলেন, তিনি সিনেমা বানাবেন। গতানুগতিক প্যাঁচপ্যাঁচে সিনেমা নয়, রীতিমত ফ্রেশ আইডিয়ার বিশ্বমানের বাণিজ্যিক ছবি। দুই বছর নিজে নিজে তিনি পড়াশোনা করলেন, ঢাকা শহরের চলচ্চিত্র বিষয়ক সমস্ত ওয়ার্কশপে অংশ নিতে থাকলেন, ইন্টারনেট ঘেঁটে বিশ্ব চলচ্চিত্রের সাম্প্রতিক প্রবণতার সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নিলেন। নিজেকে প্রস্তুত করার পর বুঝে-শুনে একটা গল্প নির্বাচন করলেন, চিত্রনাট্যকার-অভিনয়শিল্পী-কলাকুশলী থেকে শুরু করে মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি পর্যন্ত সবকিছু চুড়ান্ত করে ফেললেন।

এবার ঘোষণা দেবার পালা। নিজের জমানো টাকায় কুলাচ্ছে না দেখে বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে ধার-দেনা করে একটা পাঁচ তারা হোটেলে সিনেমার ‘শুভ মহরত’ অনুষ্ঠানের আয়োজনও করা হলো। জাঁক-জমকের কোনো ত্রুটি রাখা হলো না; কারণ এই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি তার এক চাচা, বিশিষ্ট শিল্পপতি হিসেবে দেশ-বিদেশে যার নাম আছে। মনে মনে এই চাচাকেই তার সিনেমার প্রডিউসার হিসেবে ঠিক করে রেখেছেন সেই তরুণ। ইমপ্রেস করতে পারলে সিনেমার জন্য দুই-চার কোটি টাকার চেক চোখ বুজেই সই করে দেওয়ার মতো হাত খোলা লোক এই চাচা।

বাংলাদেশি সিনেমা

চমৎকার আর স্মার্ট একটা মহরত অনুষ্ঠান হলো। মিডিয়ার লোকজন তাজ্জব বনে গেল সেই অনুষ্ঠানের অভিনবত্বে। আমন্ত্রিত সাংবাদিকেরা ‘দেশীয় চলচ্চিত্রে নতুন যুগের সূচনা’ শিরোনামে মহা উৎসাহে রিপোর্ট তৈরিতে লেগে গেলেন। তরুণের দেশ-বিদেশ চষে ফেলা শিল্পপতি চাচাও অনুষ্ঠান দেখে অভিভূত। এতটাই অভিভূত যে, অনুষ্ঠান শেষে ওই রাতেই একই পাঁচ তারা হোটেলে ভাতিজাকে ডিনার মিটিংয়ের আমন্ত্রণ জানিয়ে বসলেন তিনি।

তরুণ পরিচালককে তখন আর পায় কে? তার স্বপ্ন সত্যি হতে যাচ্ছে, প্রডিউসার পেয়ে গেছেন! থ্রি-পিস স্যুট পরে টাইয়ের নট ঠিক করতে করতে প্রডিউসার চাচার সাথে ডিনারে বসলেন তিনি। ভাতিজার  প্রশংসায় চাচা পঞ্চমুখ, নিজেদের বংশে তো বটেই, দেশেও এমন ক্রিয়েটিভ আর আধুনিক চিন্তার কাউকে তিনি দেখেননি বলে স্বীকার করতেও কার্পণ্য করলেন না। মওকা পেয়ে তরুণও সেই মুহূর্তেই চাচাকে তার সিনেমার প্রযোজক হওয়ার অফার করে বসলেন।

স্মার্ট তরুণের চাচাও স্মার্ট।

‘তুমি তো জানোই, নতুন নতুন সেক্টরে ইনভেস্ট করতে কখনোই আমার আগ্রহের কমতি নেই। হোক সেটা রাইস মিল কিংবা সিমেন্ট ফ্যাক্টরি। তোমার এই অনুষ্ঠান দেখে আই ফিল আই অ্যাম কিউরিয়াস অ্যাবাউট সিনেমা। তুমি যেহেতু এ সেক্টরে কাজ করতে চাও, ইনভেস্ট আমি করতেই পারি। তবে বিজনেস ফার্স্ট, ব্যবসাটা আমাকে বোঝাতে হবে।’

তরুণের চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

‘তাহলে আপনি আমার ছবি প্রোডিউস করছেন?’
‘ওই যে বললাম, ব্যবসাটা বোঝাতে হবে।’
‘ডিল?’
‘ডিল। এবার ব্যবসাটা বোঝাও।’

চাচা টোপ গিলেছে দেখে তরুণ খুশিতে ডগমগ। এই প্রডিউসারের বদৌলতে বাংলাদেশের সিনেমার ইতিহাস নতুন করে লিখে ফেলার সিরিজ স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন তিনি। ডিনার মিটিংটা শেষ করেই চাচার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ যে চলচ্চিত্রের দিন বদলে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে এগিয়ে আসছে, এই মর্মে একটা বড় ফিচার করার জন্য কোন পত্রিকার কোন বিনোদন সাংবাদিককে বলতে হবে, সেটা চিন্তা করতে থাকেন।

‘তোমার এই সিনেমা বানাতে কত খরচ হবে?’

স্বপ্ন থেকে বাস্তবে ফেরেন তরুণ পরিচালক, একটু সাবধানে খেলতে চান। তার হিসেব মতো, অপব্যয় না করলে এক কোটির মধ্যেই সিনেমাটা হয়ে যাবার কথা। তবে দেশের সুপার হিট তকমা লাগানো বাণিজ্যিক সিনেমাগুলো নাকি দুই কোটি টাকা বাজেটের হয়ে থাকে, তাই নিজের দাম বজায় রাখতে আর তিনি যা চাইবেন চাচা যদি তার চেয়ে কম টাকা দেন, তাহলে বিপদে পড়ে যাবেন ভেবে বাজেটটা বাড়িয়ে বলতে চাইলেন। টাকা উদ্বৃত্ত থাকলে ক্ষতি তো নেই, মার্কেটিংটা ভালোভাবে করা যাবে; এখানে তো ফিল্ম বানানোর পর পাবলিসিটির জন্য কারও হাতে নাকি টাকাই থাকে না! এক লাফে তাই বাজেট দ্বিগুণ করে ফেললেন।

‘দুই কোটি টাকা লাগবে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত।’
‘কি কি খাতে খরচ হবে এই টাকা?’

তরুণ নির্মাতা বেশ প্রফেশনালি বর্ণনা দিতে থাকেন। আর্টিস্ট পেমেন্ট, প্রি-প্রোডাকশন, শুটিং, লোকেশন এক্সপেন্স, পোস্ট প্রোডাকশন, মার্কেটিং, পাবলিসিটি কোনো সেক্টরের কোনো খুঁটিনাটি বাদ পড়ে না তার বর্ণনায়।

প্রডিউসার সাহেব বুঝমানের মতো মাথা নাড়েন।
‘তাহলে তো দেখা যাচ্ছে, ফিল্ম সেক্টরটা বেশ বড়ই।’

চাচার আগ্রহ দেখে আর নিজের কনভিন্স করার ক্ষমতায় তরুণ আপ্লুত হন।
‘এই জন্যই তো ফিল্মকে ইন্ডাস্ট্রি বলা হয়।’

আবারও মাথা নাড়েন চাচা।
‘হুম। তো বাংলাদেশের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে সব ছবিই কি দুই কোটি টাকা বাজেটের?’

তরুণ আরও সতর্ক হন। এত বড় একজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে নিগোসিয়েশন হচ্ছে, কোনো ভুলভাল কথা বলা যাবে না।

‘আরও বড় বাজেটের ছবি তো হয়ই আবার কমেও হয়, তবে দুই কোটিকে আপনি অ্যাভারেজ স্ট্যান্ডার্ড ধরতে পারেন।’

‘বছরে কতগুলো ছবি হয় এখানে?’

দেশে ইদানিং ছবির বড়ই আকাল, সিনেমা হলগুলো প্রতি সপ্তাহে নতুন ছবি পাচ্ছে না বলে অভিযোগ আছে। কিন্তু এসব জানিয়ে হবু প্রডিউসারকে হতাশ করা যাবে না, তাকে আশাবাদী করে তুলতে হবে।

‘বছরের বাহান্ন সপ্তাহের মধ্যে রোজার মাসে চার সপ্তাহ সিনেমা হল বন্ধ থাকে। এটা বাদ দিলে প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে একটা করে নতুন ছবি মুক্তি পায়, দুই ঈদে মুক্তি পায় একসাথে তিন-চারটা করে। সে হিসাবে বছরে অন্তত পঞ্চাশটা ছবি তো হয়ই।’

বাংলাদেশি সিনেমা হল

‘তাহলে, প্রতি ছবিতে দুই কোটি টাকা লগ্নি করা হলে বাংলাদেশি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে বছরে মোট কত টাকার লেনদেন হয়?’

তরুণ এই সহজ হিসাব বের করতে সময় নেন না।
‘দুই কোটি পুরণ পঞ্চাশ, একশ কোটি টাকা।’

খানিক্ষণ কি যেন চিন্তা করেন চাচা।
‘আচ্ছা, এই ইন্ডাস্ট্রির ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করে এমন মানুষের সংখ্যা কত?’

এই প্রশ্নের জন্য প্রস্তুতি না থাকলেও কিছুক্ষণ আগে সিনেমার বিভিন্ন পর্যায়ে নিয়োজিত লোকবলের যে ফিরিস্তি তিনি প্রডিউসারকে দিয়েছেন তা থেকে নিজেই একটা ধারণা পান তরুণ চিত্র পরিচালক।
‘এক্স্যাক্ট সংখ্যা বলা মুশকিল, আনুমানিক হাজার দশেক লোক তো হবেই।’

‘একশ কোটি ভাগ দশ হাজার কত হয়?’
একটু চিসময় নেন চাচা।
‘এক লক্ষ, তাই না?’
‘জ্বী, চাচা।’
‘তোমার ডেটা অনুযায়ী, বাংলাদেশি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির প্রতিটা লোকের এক বছরের গ্রস অ্যাভারেজ ইনকাম দাঁড়াচ্ছে তাহলে এক লাখ টাকা।’

চাচার কথাবার্তা কোন দিকে মোড় নিচ্ছে সেটা বোঝার জন্য তরুণ আরও মনোযোগী হন।

‘খেয়াল করো, আমি কিন্তু তোমার যন্ত্রপাতি বা আরও অন্যান্য কিছু বাবদ খরচ, যা এই ইন্ডাস্ট্রির ওপর নির্ভরশীল মানুষগুলোর পকেটে সরাসরি যায় না, সেগুলো হিসাব থেকে বাদ দেইনি। সেটা বাদ দিলে অংকটা আরও নেমে যায়। এবার হিসাব করো তো এই লোকগুলোর মাথাপিছু মাসিক ইনকাম কত?’

যন্ত্রচালিতের মতো মোবাইল ফোনের ক্যালকুলেটরে হিসাব করে তরুণ। ১,০০,০০০ ভাগ ১২।
‘আট হাজার তিনশ তেত্রিশ টাকা, তেত্রিশ পয়সা।’

চশমা খুলে টেবিলে রেখে তরুণের দিকে সরাসরি তাকান তার ব্যাবসায়ী চাচা।

‘নেভার মাইন্ড মাই ডিয়ার, আজকের দিনে একজন রিকশা চালকের মাসিক আয় কিংবা একজন গার্মেন্ট ওয়ার্কারের ন্যূনতম মাসিক মজুরিও কিন্তু আট হাজার তিনশ তেত্রিশ টাকা তেত্রিশ পয়সার চেয়ে বেশি।’

তরুণ নিষ্পলক তাকিয়ে থাকেন চাচার দিকে।


মোট
ট্র্যাঞ্জেকশনই
বলো আর অ্যাভারেজ
ইনকামই বলো, কোন বিবেচনায়
এই দেশের ফিল্ম সেক্টরকে
ইন্ডাস্ট্রি বলা
যায়?

‘জাস্ট থিঙ্ক ইট। মোট ট্র্যাঞ্জেকশনই বলো আর অ্যাভারেজ ইনকামই বলো, কোন বিবেচনায় এই দেশের ফিল্ম সেক্টরকে ইন্ডাস্ট্রি বলা যায়?’

মুহূর্তের মধ্যে স্মার্ট তরুণ হবু চলচ্চিত্র নির্মাতা বুঝে ফেলেন, তার আম-ছালা এমনকি আমগাছটিও হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। মাথায় শুধু একটা চিন্তাই ঘুরপাক খেতে থাকে, প্রডিউসারকে পটাতে পাঁচ তারা হোটেলে মহরত অনুষ্ঠানের জন্য নিজের সঞ্চয় বাদেও বন্ধুদের কাছ থেকে যে ধার-দেনা তিনি করেছেন, তা কীভাবে শোধ করবেন?

গল্পটার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও এর হিসাব-নিকাশের ধারাবাহিকতায় মুগ্ধ হয়ে যাই আর উপসংহারে বাংলাদেশের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির যে অর্থনৈতিক চিত্র এখানে পাই, তাতে আতঙ্কিত না হয়ে পারি না। তাই গল্পটা শোনার পর থেকেই বাংলাদেশের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সত্যিকারের বাজারমূল্য বিষয়ে প্রামাণ্য তথ্য উপাত্তের খোঁজ করতে থাকি। পেয়েও যাই একসময়।

২০১৩-১৪ অর্থ বছরে বাংলাদেশে বিনোদন খাতে মোট বিনিয়োগকৃত সম্পদের পরিমাণ এবং তা থেকে দেশের অর্থনীতিতে কি পরিমাণ মূল্য সংযোজিত হয়েছে সেই ব্যাপারে প্রথমবারের মতো এবং এ যাবত একমাত্র জরিপটি চালায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো [বিবিএস]। এই জরিপের ফল আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয় ২০১৬ সালের ২৮ জুন। ২৯ জুন, ২০১৬ দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় সেই জরিপের বিস্তারিত বিবরণ ছাপা হয়। বিনোদন জরিপে সিনেমা, নাটক, গান ও সাহিত্য এই চারটি সেক্টর অন্তর্ভুক্ত ছিল; প্রাসঙ্গিকতার কারণে এখানে কেবল চলচ্চিত্রের অংশটুকুই পত্রিকা থেকে হুবহু তুলে দিচ্ছি:

সিনেমা: বিবিএসের জরিপে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে একটি সিনেমা তৈরি করতে গড়ে ৯৬ লাখ ৭০ হাজার টাকা খরচ হয়। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে মোট সরকারি ও বেসরকারি অর্থায়নে ৬৮টি সিনেমা তৈরি হয়েছে। ওই বছর এসব সিনেমা বানাতে মোট ৬৫ কোটি ৭৭ লাখ টাকা লগ্নি করা হয়েছে। উল্লেখ্য, বলিউডের একটি গড়পড়তা ছবিতেই এর চেয়ে বেশি অর্থ বিনিয়োগ হয়। গত বছর বলিউডের জনপ্রিয় ছবি বাজিরাও মাস্তানি তৈরির পেছনে ব্যয় হয়েছিল ১২৫ কোটি রুপি প্রায় ১৫০ কোটি টাকা]।

বাংলাদেশি সিনেমা হল

বিবিএসের জরিপ বলছে, দেশের চলচ্চিত্রশিল্পে স্ক্রিপ্ট বা পাণ্ডুলিপি তৈরি থেকে শুরু করে শুটিং সেট নির্মাণ, চিত্রায়ণ, সম্পাদনা, পরিচালক, শিল্পী ও কলাকুশলীদের সম্মানীসহ প্রতিটি স্তরে মোট মূল্য সংযোজন হয়েছে ৩৪ কোটি ৬৬ লাখ টাকা।

বিবিএস বলছে, সম্মানী হিসেবে শিল্পী ও কলাকুশলীদের যে অর্থ দেওয়া হয়, তার ২৫ শতাংশ পান শুধু মুখ্য চরিত্র অর্থাৎ নায়ক-নায়িকারা।

বাস্তবের পরিসংখ্যান বরং গল্পের চেয়ে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির আরও করুণ চিত্রই হাজির করেছে। এত ছোট একটা বাজারকে কেন্দ্র করে হাজার হাজার মেধাবী মানুষ কি তাহলে অলীক স্বপ্ন বুনে যাচ্ছেন? ধরলাম তারা টাকার পেছনে ছুটছেন না; ছুটছেন নিজেদের শৈল্পিক তাড়নায়। শিল্পী সত্তাকে বিকশিত করতে নিজেকে বা পরিবারকে তারা সুখ-স্বাচ্ছন্দ থেকে বঞ্চিত করছেন। কিন্তু বছর বছর যে চলচ্চিত্রগুলো তৈরি হচ্ছে এ দেশে, তার ভেতর থেকে কয়টাকেই বা শিল্পমানে উত্তীর্ণ বলে দাবি করা যায়?

ফিল্মকে বলা হয় একইসঙ্গে আর্ট এবং ইন্ডাস্ট্রি। যে চলচ্চিত্র আর্টও হয়ে উঠতে পারছে না, আবার তার ইন্ডাস্ট্রিয়াল ভ্যালুও নেই– তাকে নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে।

এর পরেও নিরাশ হওয়ার কিছু নেই; আশাবাদী হওয়ার বহু পথ নাকি সবসময়ই খোলা থাকে। একান্তই কোনো পথ খুঁজে না পেলে মানসিক শান্তির জন্য পরিসংখ্যান নিয়ে সেই বিখ্যাত বাণীটা তো থাকছেই, ‘মিথ্যা তিন প্রকার। সাধারণ মিথ্যা, ডাহা মিথ্যা আর জঘণ্যতম মিথ্যা হচ্ছে পরিসংখ্যান।’


২০ এপ্রিল ২০২০
Print Friendly, PDF & Email
ফিল্মমেকার; আর্কিটেক্ট । বাংলাদেশ ।। ফিচার ফিল্ম : আম কাঁঠালের ছুটি [সম্পন্ন, মুক্তির অপেক্ষায়]; মাস্তুল [নির্মিতব্য] ।। শর্ট ফিল্ম : জংশন; যাত্রা ।। প্রতিষ্ঠাতা : সিনেস্কোপ [সিঙ্গেল স্ক্রিন সিনেমা থিয়েটার, নারায়ণগঞ্জ]

4 মন্তব্যগুলো

  1. লেখাটা ভালো হয়েছে। তবে কিছু শব্দের ব্যবহারে একটু ভুল আছে। বাজার মূল্য, বার্ষিক লেনদেন ও মূল্য সংযোজন বিষয় তিনটি এক করে ধরা হয়েছে। বাজার মূল্য বলতে ক্রেতা যে মূল্যে কোন শেয়ার ক্রয় করতে আগ্রহী গুনন মোট শেয়ার সংখ্যা বুঝায়। এখন এ মূহুর্তে যদি বাংলাদেশের সিনেমার সমগ্র বাজারটি কোন দেশী-বিদেশী ক্রেতার হাতে তুলে দেওয়া হয়, সে যে মূল্যে এ বাজারটি ক্রয় করবে, সে সংখ্যাটাকে সাধারন দৃষ্টিতে বাজার মূল্য বলা যাবে। যে কথাটি লেখক আসলে বলতে চেয়েছেন; তার অর্থ আসলে যা দাড়ায়; তা হলো এ শিল্পখাতটির অর্থ উপার্জনের বর্তমান যে সক্ষমতা এবং সামর্থ্য রয়েছে, তা তার বাজার এবং প্রকৃত মূল্যের তুলনায় শূণ্যের কাছাকাছি। লেখাটি এখন অনেকে সিনেমা প্রেমিকের দেওয়ালে রয়েছে। লেখাটির সমালোচনা কেউ শুরু করলে ( জেলাস বলে একটা বিষয় আমাদের ঐতিহ্য) সে আসলে শব্দের ভুল ব্যবহারকে নিয়ে ত্যানা প্যাচাবেন। লেখাটি ভালো হয়েছে, সুতরাং সংশোধনগুলো করে নিলে তা ভবিষ্যতে একটি রেফারেন্স হিসেবে গ্রহনযোগ্যতা পেতেও পারে।

  2. আমি অর্থনীতি কিংবা ব্যবসা শাস্ত্রের ছাত্র নই বলে লেখায় ব্যবহৃত শব্দগুলোর সঠিক পরিভাষা জানা নেই। যেহেতু উল্লেখিত শব্দগুলো দিয়ে আমি কী বোঝাতে চেয়েছি তা আপনি বুঝতে পেরেছেন তাই সেগুলোর সঠিক পরিভাষা জানালে কৃতজ্ঞ থাকব। যত দ্রুত সম্ভব এগুলো সংশোধনের ব্যবস্থা নিতে চাই, একটি শব্দেরও অপব্যাখ্যার অবকাশ রাখতে চাই না। ভালো থাকবেন।

  3. সাধু, সাধু৷
    অভিনন্দন রইলো ভাইজান

  4. জরুরী লেখা। অনেক ধন্যবাদ লেখাটার জন্য।

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here