লিখেছেন । শিবু কুমার শীল
ভারতের রাজস্তানের জয়পুরের ছেলে ইরফান খান বলিউডের দুর্দান্ত এবং বিরল অভিনেতা যিনি গত ২৯ এপ্রিল সকালে ধিরুভাই আম্বানী হাসপাতালে ইন্তেকাল করেছেন। আরও দুঃখের কথা এই যে, অল্প কদিন আগে তাঁর মায়েরও মৃত্যু হয়। এরকম পর পর দুটি মৃত্যু তাঁর স্বজনদের নিশ্চয়ই স্তম্ভিত করে দিয়েছে। ২০১৮ সাল থেকে বিরল ক্যানসারে ভোগা ইরফানের চলে যাওয়াকে আকস্মিক মৃত্যুই বলব; কারণ তিনি শেষ পর্যন্ত লড়ছিলেন।

ফিল্মমেকার। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী
আমাদের প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ডুব চলচ্চিত্রের মাধ্যমে আমাদের সাথে তাঁর একটা ক্ষুদ্র আত্মীয়তা ঘটে। ডুব সিনেমা ব্যবসাসফল হয়নি; তবে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে বিস্তর। ইরফান খান অভিনেতা হিসেবে কেমন ছিলেন তা কাউকে জিজ্ঞেস করা মাত্রই একটাই উত্তর আসবে যে তিনি ভালো অভিনেতা ছিলেন। বিশেষ করে বলিউডি চলচ্চিত্রের যে একটা ধারা দাঁড়িয়ে গেছে যা ঠিক আর্ট হাউজ না আবার ঝাকানাকা ‘কলসি কাঁখে সই সম্বলিত গানের’ ধারার ছবি না। একটু ফিউশন ধারা যেখানে আর্ট হাউজ ট্রিটমেন্ট আছে আবার কন্টেন্ট বেশ বাণিজ্যিক উপাদানে ভরপুর। সব মিলিয়ে যা মিডিল ক্লাস-বান্ধব। কারণ গরিবেরা এখনও ‘দেখা হ্যাঁয় পেহ্লি বার সাজেন কি আঁখো মে পেয়ার’ এখানেই আটকে আছে।

ফিল্মমেকার । বিশাল ভার্দরাজ
তো সেই ‘না আর্ট হাউজ না বাণিজ্যিক’ এমন ছবিগুলোতে ইরফান খানকে বেশি দেখেছি আমরা। লাইফ ইন অ্যা মেট্রো বোধহয় ব্রেক থ্রু ছিল তাঁর। বা তারও আগে মকবুল, মিরা নায়ারের সালাম বোম্বের গেস্ট অ্যাপিয়ারেন্স যেগুলো তাকে বলিউডে কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে উঠতে ভূমিকা রেখেছিল।
…
ননগ্লামারাস বাস্তববাদী
চরিত্রগুলোতেই
তাঁকে বেশি
মানিয়ে
যেত
…
ভারতীয় বাণিজ্যিক অ-বাণিজ্যিক ধারার উভয় ছবিতে কমেডি কেন্দ্রিক অভিনয়ের একটা চল ছিল একদা। যা এখন প্রায় বিলুপ্ত। কমল হাসান, শক্তি কাপুর, অনুপম খের, কাদের খান, পরেশ রাওয়ালের পর কিছুটা বোমানি ইরানি– যারা কমেডি ধারার অভিনয় করতেন এবং করেন এবং তাঁদের অভিনীত চরিত্রগুলো তাঁরা এতটাই ডমিনেট করতেন যে এই চরিত্রগুলো স্ক্রিপ্ট রাইটার প্রায় এঁদের কথা ভেবেই লিখতেন বলে অনুমান করি। কমেডির কথা তুললাম এ কারণে যে মেট্রোতে ইরফানের কমেডি নির্ভর অভিনয় দেখে আমার সেই পরম্পরার কথাই সবার আগে মনে হয়েছে। যেন একজন কমল হাসানের উত্তরসূরি পেলো ভারত। যদিও এটা ইরফানের স্টাইল ছিল না; বরং ননগ্লামারাস বাস্তববাদী চরিত্রগুলোতেই তাঁকে বেশি মানিয়ে যেত।

ফিল্মমেকার । অনুরাগ বসু
ইরফানের পুর্বসুরী আর একজন অভিনেতার নাম উল্লেখ করা জরুরি, তিনি হচ্ছেন নানা পাটেকর। আমি যে পরম্পরার কথা বলছিলাম সেটা আরও বেশি স্পষ্ট হয় নানা পাটেকরের ক্ষেত্রে। এই দুই অভিনেতার মধ্যে কোথায় যেন একটা যোগসূত্র খুঁজে পাই। একটু ব্যাখ্যা করছি, যদিও ‘নানা’র একটা রাগী ভঙ্গী ছিল, যেটা অমিতাভ পরবর্তী সময়ের জাতীয়তাবাদী আদর্শিক বলিউডি সিনেমায় বেশ নজর কাড়ে দর্শকদের। মানে যাত্রার বিবেক বা জাতির বিবেক টাইপ চরিত্র। ভীষণ খ্যাপা এক চরিত্র। নানা বলিউডি ছবিতে এসে এক ধরনের বাস্তববাদী, সেকুলার, কিছুটা এনার্কি, দ্রোহ ইত্যাদি আছে এমন চরিত্রগুলোতে অভিনয় করতে থাকেন। কিন্তু তা দিন শেষে মাসালা এবং ‘অতঃপর সবাই সুখে শান্তিতে থাকারই’ গপ্পো।
…
ইরফান
এই ক্ষেত্রে নির্জলা
সহজ এবং অলংকারবিহীন
অভিনয় নিয়ে পর্দায় হাজির হন
…
নানার উপস্থিতি এংরি হিরো অমিতাভের মনোপলিকেই যেন আঘাত করল। বাকি সব আগের মতই চলল। এছাড়া নানা পাটেকরের আন নেসেসারি ডিটেইল শেষ পর্যন্ত যা অতি অভিনয়ে পর্যবসিত হয়। সেই সাথে আদর্শবাদ, প্রতিশোধের আগুন সব মিলিয়ে মেলোড্রামায় মাখামাখি। কিন্তু ইরফান এই ক্ষেত্রে নির্জলা সহজ এবং অলংকারবিহীন অভিনয় নিয়ে পর্দায় হাজির হন। দর্শককে যেন বিশ্বাস করতে বাধ্য করেন যে এই সে লোক যিনি হতে পারেন তার পাশের বাসার বাসিন্দা, কোন কলিগ, বা সাধারণ চাকুরে। তার ডিটেইল সব সময় ডিফোকাসড থাকে; ফলে তা দর্শক অনুভব করে। চোখের সামনে আঙুল দিয়ে কিছু বোঝাতে চান না তিনি।
অনেকটা ব্রেসোঁয়াইট (রোবের ব্রেসোঁর) অভিনয় রীতির মতো মরবিড আর এক্সপ্রেশনলেস থাকেন ইরফান। যাকে বলে নানার উল্টো। তাহলে যোগসূত্রটা কোথায়? দুজন একই কমিটমেন্ট নিয়ে আসেন; কিন্তু নানা যা শেষ পর্যন্ত যা পূরণ করতে পারেন না, ইরফান সেখানে প্রায় শতভাগ সফল। তবে নানা পাটেকরের মতো নন গ্লামারাস নন হিরোদের দর্শক গ্রহণ করেছিল বলেই ইরফান বা নাওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকিদের পথ পরবর্তীকালে প্রশস্ত হয়েছিল– এটা স্বীকার করতেই হবে।

ফিল্মমেকার । রিতেশ বাত্রা
ইরফান খানের নাম নেওয়ার আগে এই ঠিকুজি নিয়ে আলাপ পারতে হলো; কারণ ইরফান ধুম করে চলে আসেননি। শাহরুখ খানরাও যেমন বাজিগর আর ডর দিয়ে মাতিয়েছেন বটে, তবে তাদেরও থিয়েটার, আর্ট হাউজ… নানা ঘাটের পানি পান করেই ঘটনাটা ঘটেছে। শাহরুখ প্রসঙ্গে আর দু কথা না বললেই নয় যে, তাঁর আগমনটা এমন এক সময়ে, যখন মানুষ গোবিন্দার নাচ আর আমিরের মিষ্টি প্রেমের আখ্যান মাঝে কিছু নাগ নাগিনীর প্রেমে হাঁসফাঁস করছিল, সেই সময়েই শাহরুখ খান আসলেন বটে; তবে তাঁর এক ভিন্ন তাৎপর্য দেখতে পাই যে, খলনায়কের নায়ক হয়ে ওঠা বা আজকের যে ‘জোকার’ চলচ্চিত্রের কনসেপ্ট, তাঁর সাথে কোথায় যেন এর মিল খুঁজে পাই। খলচরিত্রের খল হয়ে ওঠার জাস্টিফিকেশন, আবার একইসাথে তাকে নায়কের মর্যাদাও দিতে চাওয়া। তো, এইসব পরম্পরার মধ্য দিয়েই ইরফান খান আসলেন তাঁর নিজস্বতা নিয়ে; একদিন দ্য লাঞ্চবক্স-এর মতো সিনেমাতে অভিনয় করলেন।
তাঁর ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা, থিয়েটার, সিরিয়াল নাটক ইত্যাদি পথ মাড়িয়ে তিনি বলিউডে তখন প্রায় হিট নায়ক, তখনই রিতেশ বাত্রার দ্য লাঞ্চবক্স করলেন তিনি। এবং আর্ট হাউজ সিনেমায় তিনি তাঁর সর্বোচ্চ অভিনয় করে দেখালেন। যেখানে নাওয়াজ উদ্দিন সিদ্দিকিও রাখলেন পার্শ্ব অভিনেতার অনন্য স্বাক্ষর। একজন মাঝ বয়েসী ক্লারিক্যাল লাইফ মেন্টেইন করা কেতা দুরস্ত মানুষের এক আশ্চর্য্য পত্র-মিতালির গল্প এই ছবি। আটপৌরে জীবনের ভেতর কত যে ফ্যান্টাসি, কত যে বন্ধ জানালা এরকম চাপা পড়ে আছে সে ছবি আমাদের সামনে সে কথাই তুলে ধরল যেন। এই ছবি রিতেশের ডেবু ফিল্ম। ব্যবসাসফল হয়তো হয়নি; তবে ফেস্টিভালগুলোতে বেশ নজর কেড়েছিল আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের।
…
নানা
পাটেকরের
মেনারিজমের
থেকে নাসিরুদ্দিন শাহের
অভিনয়ধারাই তাঁকে বেশি
প্রভাবিত করে থাকবে বলে অনুমান করি
…
ইরফান খানের অভিনয় একইসাথে মিনিমালিস্টিক, আবার একইসাথে তিনি ম্যানারিস্ট। একটা ছকের বাইরে তিনি যাননি। তাঁর অভিনয়ের সাথে নানা পাটেকরকে যদি তুলনা করি, তাহলে দেখা যাবে দুজনই টাইপড একটা ফর্মে বাঁধা; আবার কিন্তু ইরফান মেলোড্রামা করতে জানতেন না, যা নানা পাটেকরেরা বেশ সফলতার সাথেই করেছেন। কিন্তু এর বাইরেও উদাহরণ আছে, যেমন– নাসিরুদ্দিন শাহ। পুরো ভারতবর্ষের সেরা অভিনেতাদের মধ্যে অন্যতম যিনি। যার অভিনয় ব্রেখটিও ধারার। এবং আশ্চর্যজনকভাবে তিনিও স্ল্যাপেস্টিক কমেডিতে অনন্য– যে কারও থেকে। নানা পাটেকরের মেনারিজমের থেকে নাসিরুদ্দিন শাহের অভিনয়ধারাই তাঁকে বেশি প্রভাবিত করে থাকবে বলে অনুমান করি। তাঁর নির্মিত প্রতিটি চরিত্রকে তিনি যেভাবে তাঁর নিজস্বতা আরোপ করে একটা ম্যানারিজমের আন্ডারে নিয়ে আসতেন, তা করবার কুদরত বলিউডের অনেক অভিনেতারই নেই।

ফিল্মমেকার । মিরা নায়ার
একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, আমির খান– যিনি একইসাথে অনেক রকমের চরিত্র করে খ্যাতি পেয়েছেন। যিনি গেটআপ মাস্টার। তাঁর ছবি মানেই তাঁকে দেখা যাবে নতুন রূপে– এই যে একটা দর্শককে চমকে দেওয়ার মানসিকতা বা ব্র্যান্ডগুলো যেভাবে নিজেদের বাজারজাত পণ্যের মোড়ক বদলায় ক্ষণে ক্ষণে, এ যেন তারই প্রকাশ। ফলে তাঁর অভিনয় কোনো পরম্পরাকে মনে করিয়ে দেয় না। তিনি অবশ্যই অসাধারণ, সে কথা অস্বীকার করি কিভাবে? কিন্তু একইসাথে তিনি বৈচিত্র্যের কাঙ্গাল। যেখানে টম হ্যাঙ্কস, মরগান ফ্রিম্যান, জ্যাক নিকলসন, এন্থনি হপকিন্সের মতো অভিনেতারা একটা চরিত্রেই অভিনয় করে যাচ্ছেন সারা জীবন, সেখানে একজন অভিনেতার এত বৈচিত্র্য তাঁর আত্মবিশ্বাসের ভিতকে আলগা করে দেয়।
…
আমরা যারা হুমায়ূনভক্ত ছিলাম
একদা, তারা ঠিক ইরফানের
মধ্যে হুমায়ূনকে
খুঁজে পাইনি
…
ইরফান খান সেই বৈচিত্রের কাঙ্গাল ছিলেন না। তিনি বরং ইঙ্গমার বার্গম্যানের মতো একটা চেয়ারই তৈরি করে গেছেন জীবনভর। লাইফ অব পাইতে ইরফানের অভিনয় দেখেছি যা বরাবরের মতোই সাবলীল আর সহজ। কোনো অলংকার নেই। ডুব ছবিতে তাঁর অভিনয় অবশ্যই ভালো লেগেছে; কিন্তু সমস্যা যেটা হয়েছিল তা অন্য। আমরা যারা হুমায়ূনভক্ত ছিলাম একদা, তারা ঠিক ইরফানের মধ্যে হুমায়ূনকে খুঁজে পাইনি। বাস্তব চরিত্র যখন পর্দায় হাজির হয়, তখন এ সমস্ত ঝুঁকি থাকে। ইরফান সেই ঝুঁকি নিয়েছিলেন। এই এক ছবির কল্যাণে তিনি আমাদেরও হয়ে উঠলেন কিছুটা।

ফিল্মমেকার । অ্যাং লি
ইরফান খানের ইংরেজি উচ্চারণে ইন্ডিয়ান এক্সেন্ট আমাকে মুগ্ধ করত। যা অনেকের কাছে হয়তো অস্বস্তিকর। আমার ধারণা, তিনি তা ইচ্ছা করেই করতেন। তাছাড়া এই বিষয়টা তাঁর চরিত্রের সাথেও দারুণ সিঙ্ক হয়ে গিয়েছিল। তাঁর মুখে চোস্ত ইংরেজি বরং বেমানানই লাগত। ক্যানসার আক্রান্ত হবার পর তিনি একটি পত্রিকা কাছে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন। যা হুবহু তুলে ধরছি,
”I had been in a different game, I was travelling on a speedy train ride, had dreams, plans, aspirations, goals, was fully engaged in them. And suddenly someone taps on my shoulder and I turn to see. It’s the TC: “Your destination is about to come. Please get down.” I am confused: “No, no. My destination hasn’t come.” “No, this is it. This is how it is sometimes.”
এরকম একটা অবস্থাতেও তিনি নিজের আসন্ন মৃত্যুকে গল্পের মতো করে ভাবতে পারছিলেন; কারণ তাঁর মনের জোর। ইরফানের মতো সকল মানুষকেই কেউ না কেউ একদিন পিছন থেকে ডেকে বলবে ‘আপনি এবার নেমে পড়ুন ভাই। আপনার গন্তব্য এইটুকুই।’ এবং তখন প্রত্যেককেই প্রশ্নহীন নেমে পড়তে হবে যার যার স্থানে।

৭ জানুয়ারি ১৯৬৭–২৯ এপ্রিল ২০২০; ভারত
ইরফান খান তাঁর চক্র সম্পন্ন করেছেন। তাঁকে আমার প্রথম নমস্কার জানাই শেষ বিদায়ের আগে।