পূর্ব ইউরোপের বৈচিত্র্যময় চলচ্চিত্র

567
লাভলেস
লাভলেস

লিখেছেন । বিধান রিবেরু

ইউরোপিয় চলচ্চিত্রকে, হলিউডের বিপরীতে, সবসময়ই একটি আলাদা স্থান দেওয়া হয়ে থাকে। নন্দনতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক বিচারে ইউরোপিয় চলচ্চিত্রের বিষয়বৈচিত্র্য যেমন আছে, তেমনি আছে নির্মাণবৈচিত্র্য, সে কারণেই দুনিয়ার বহু মানুষ ইউরোপিয় ছবির ভক্ত হয়ে উঠেছে। হলিউড বনাম ইউরোপের ছবি, এমন ভাবনার মধ্যে ‘জাতীয় ভাবধারা’ আছে বটে, তারপরও সিনেমাপ্রেমী মানুষ হলিউডের বাইরের ছবি দেশ ও জাতির নাম ধরে ধরেই দেখে, তারা মূলত বিচিত্র স্বাদের কাহিনি ও দৃশ্যমালা দেখতে চায়।

সারা দুনিয়ায় হলিউড সাম্রাজ্য বিস্তার করলেও বিষয়ের দিক থেকে ইউরোপ অনেক বেশি রঙিন। তাই যারা বুদ্ধিদীপ্ত ছবি পছন্দ করেন, তারা মুখ ফিরিয়ে রাখেন ইউরোপের দিকেই। চলচ্চিত্র বিদ্যার অধ্যাপক জিনেট ভিনসেনদ্যুর কথা এখানে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, মৌলিকত্ব ও বৈচিত্র্যের কারণেই হলিউডের বিপরীতে ইউরোপের ছবি ‘হাই আর্ট’ হিসেবে মর্যাদা পায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধকল কাটিয়ে, হলিউডের আগ্রাসন সামলে, ইউরোপিয় চলচ্চিত্র ষাটের দশক থেকেই নিজস্ব পরিচিতি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, গ্রিস প্রভৃতি দেশের পরিচালকদের ছবি ভারতবর্ষেও সমাদৃত হয়েছে। ইউরোপের পুবদিকের দেশগুলোর ভেতর সোভিয়েত ইউনিয়নের চলচ্চিত্র এই অঞ্চলের মানুষ চর্চার ভেতর রেখেছেন এখনো। যদিও সমাজতন্ত্রের বিদায়ের পর রাশিয়ার সাম্প্রতিক ছবি নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা চোখে পড়ে না আজকাল।

রাশিয়া ছাড়াও পূর্ব ইউরোপের বুলগেরিয়া, ইউক্রেন, বেলারুশ, হাঙ্গেরি, ক্রোয়েশিয়া, মন্টেনেগ্রো, স্লোভাকিয়া প্রভৃতি দেশের ছবিও অতটা চর্চিত নয় বাংলাদেশে। সেই খড়া কিছুটা কাটাতে তাই পূর্ব ইউরোপের সাম্প্রতিক সময়ে মুক্তি পাওয়া গোটা তিনেক ছবি নিয়ে এখানে আলাপ করব।

ইউ ক্যারি মি
ইউ ক্যারি মি
ফিল্মমেকার । ইভোনা ইয়োকা

১.

ক্রোয়েশিয়া ও মন্টেনেগ্রোর পরিচালক ইভোনা ইয়োকার প্রথম চলচ্চিত্র ইউ ক্যারি মি [২০১৫], ছবিটি মুক্তির পরপরই বেশ সাড়া জাগায়। নারী নির্মাতা হিসেবে নারীদের প্রতিকূল ও কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলার কথা তিনি বলেছেন চালচ্চৈত্রিক পুনরাবৃত্তি বা লুপ তৈরির মাধ্যমে, কয়েকটি ঘটনা বা প্লটের ভেতর দিয়ে। সবগুলো প্লট আবার একে অপরকে ছেদ করে গেছে।

একটি প্লটে দেখা যায় ডোরা নামের এক টমবয় কিশোরী ফুটবলকে ভালোবাসে। তবে তার বাবা ভেদরান মাদক ব্যবসা ও নানা অপরাধের সঙ্গে যুক্ত। প্রায়ই পরিবার থেকে তাকে দূরে থাকতে হয়। ডোরার মা লিডিয়া এটা নিয়ে ত্যক্ত-বিরক্ত। ডোরার একটি ছোট ভাইও থাকে। বিশৃঙ্খল পরিবারের ভেতর বাবা ও মায়ের সঙ্গে কিশোরী ডোরার টানাপড়েন এই প্লটে গুরুত্ব পায়। এখানে অন্য দুটি চরিত্রকেও সমান গুরুত্ব দেন পরিচালক। বাবা ভেদরানকে দেখা যায় সে পরিবার ও সন্তানদের ভালোবাসে, কিন্তু সবসময় পরিবেশ ও প্রতিবেশ তার অনুকূলে থাকে না। স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাইলেও একটি খুনের ঘটনায় সে জড়িয়ে যায়, পালানোর সময় বাধ্য হয়ে দুই সন্তানকে নিয়ে সে পালায়। আর তার স্ত্রী লিডিয়া কাজ করে ‘প্রিজনার্স অব হ্যাপিনেস’ নামের একটি টিভি সোপের মেকআপ বিভাগে।

ইউ ক্যারি মি
ইউ ক্যারি মি

এই টিভি সোপটির পরিচালক ইভেসও একজন নারী। সে থাকে তার বাবা ইভানের সঙ্গে একা। বাবা আলজেইমারের রোগী। সবকিছু সে ভুলে যায়, এমনকি মাঝে মাঝে মেয়েকেও। প্রায় বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যায়, আর ফেরার পথ মনে রাখতে পারে না। তাই কবজিতে ঠিকানা লাগিয়ে রাখতে হয়। এমন এক বাবা, যার জন্য সার্বক্ষণিক নজরদারি প্রয়োজন, তাকে সামলে, টিভি সোপের কাজ করতে করতে হাঁপিয়ে উঠতে থাকে ইভেস।


শরীরে
মরণব্যাধী
ধরা পড়েছে তার,
বেশিদিন বাঁচবে না–
সেটা জেনেই বোধহয়
বেপরোয়া হয়ে
ওঠে নাতাশা

টিভি সোপটির প্রধান প্রযোজক নাতাশার চরিত্রটিও বেশ জটিল। প্রথম প্লটের লিডিয়া স্বামীর প্রতি বিরক্ত হয়ে যার সঙ্গে প্রেম করে, সেই লোকটি আবার এই নাতাশার স্বামী। নাতাশা পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। নিজের বাবার সঙ্গেও তার দূরত্ব রয়েছে। ছবিটির শেষ ভাগে দেখা যায়, নিজের সৎ ছেলের সঙ্গে নাতাশা শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে। শরীরে মরণব্যাধী ধরা পড়েছে তার, বেশিদিন বাঁচবে না– সেটা জেনেই বোধহয় বেপরোয়া হয়ে ওঠে নাতাশা।

ইউ ক্যারি মি
ইউ ক্যারি মি

মোটামুটি নারীর কয়েকটি সময় ও পর্যায়ের কথাই পরিচালক বলে ওঠেন এই ছবিতে। কিশোরী ডোরা, যুবতী ইভেস, বিবাহিত; কিন্তু অসুখী মা লিডিয়া, ব্যবসায় সফল, তবে পারিবারিক ও শারীরিকভাবে অসুখী, মৃত্যু পথযাত্রী নাতাশা– এসব চরিত্রের ভেতর দিয়ে পরিচালক ইয়োকা নারীর প্রেম ও অপ্রেমের বয়ান, অসরল রৈখিক উপায়ে হাজির করেন দর্শকের সামনে।

ছবিতে ডোরার বাবা ভেদরানের কিছু ভ্রম ও স্বপ্নদৃশ্য ঘোর তৈরি করে। যেমন দেখা যায়, ভেদরান পাথরচাপা পড়েছে বা পাথর দিয়ে দরজা আটকানো, ঢোকার রাস্তা বন্ধ, অথবা একটি টানেলের মাঝখানটায় আটকা পড়ে গেছে সে, কোনদিকে যাবে তার হদিশ নেই। এসব দৃশ্য মোটিফ হয়ে যায় ইয়োকার হাতে। যেন তিনি বলতে চাইছেন, আমরা সকলেই বাসনার নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছি, পথ হারিয়ে ফেলছি বারবার। টিভি সোপটির নামের সার্থকতা বিচার করা যায় চরিত্রগুলোকে বিশ্লেষণ করলেই। নিজেদের ভালো থাকা ও অহমকে তুষ্ট করার বাসনাই মানুষের অবস্থাকে আরও শোচনীয় করে তোলে। কি ডোরার বাবা -মা, কি ইভেস বা নাতাশা। এই শোচনীয় অবস্থার শেষ নেই। যতদিন মানুষ আছে, ততদিন এই বাসনা আছে। একে বহন করে নিয়ে যেতে হবে।

ইউ ক্যারি মি
ইউ ক্যারি মি

ছবিটির চিত্রধারনের মধ্যে কবিতা বলার ঝোঁক আছে। অবধারিতভাবে ইউরোপিয় জলবায়ুর অবিচ্ছেদ্য অংশ বরফের সফেদ রঙের আধিক্য দেখা যায়। উষ্ণ রঙের ব্যবহার কম। তাই ছবিটিকে মনে হয় ভাবলেশহীনভাবে কিছু মানুষের জীবনের চরম সঙ্কটের কথা বলে যাচ্ছে। কোনো মেলোড্রামা নেই। নেই কোনো অতিকথন। ঔপন্যাসিকের মতোই কাহিনি বুনেছেন পরিচালক।

অন বডি অ্যান্ড সোল
অন বডি অ্যান্ড সোল
ফিলমমেকার । ইলডিকো এনেডি

২.

অপরদিকে, ইলডিকো এনেডি পরিচালিত হাঙ্গেরির অন বডি অ্যান্ড সোল [২০১৭] ছবিতে উঠে এসেছে অসমবয়সী ও বিষম স্বভাবের নারী-পুরুষের মধ্যকার এক অদ্ভুত সম্পর্কের বয়ান। বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে সোনালি ভল্লুক পাওয়া ছবিটির প্রধান অস্ত্র এর নির্বিকার থাকা।


কসাইখানায়
পশু জবাই হচ্ছে,
রক্ত গলগল করে পড়ছে,
আত্মহত্যার জন্য হাতের রগ
কেটে ফেলা হচ্ছে, ফিনকি
দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে,
নারী-পুরুষের
যৌনতা
হচ্ছে– সবক্ষেত্রেই
পরিচালকের প্রকাশভঙ্গি বেশ নির্বিকার

কসাইখানায় পশু জবাই হচ্ছে, রক্ত গলগল করে পড়ছে, আত্মহত্যার জন্য হাতের রগ কেটে ফেলা হচ্ছে, ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে, নারী-পুরুষের যৌনতা হচ্ছে– সবক্ষেত্রেই পরিচালকের প্রকাশভঙ্গি বেশ নির্বিকার। তিনি কোথাও উচ্চকিত কোনো সঙ্গীত প্রয়োগ করেননি। এমনকি ক্যামেরার কাট নিয়েও অস্থির হতে দেখা যায়নি তাকে। আর এই আচরণকেই এই ছবির মূল চালিকাশক্তি বলে মনে হয়েছে।

ছবিটিতে দেখা যায়, বুদাপেস্টের এক বিশাল কসাইখানা, সারাদিনে প্রচুর গরু কাটাকাটির কাজ হয়। সেখানে একদিন নতুন একটি মেয়ে আসে মাংসের মান পরীক্ষক হিসেবে। দেখতে স্নো হোয়াইট যেন, তাই সকলের নজর ওর ওপর। নাম মারিয়া। অসম্ভব রকম মেধাবী, প্রত্যেকটি ঘটনার দিন তারিখ শুধু নয়, কথোপকথনও সে বলে দিতে পারে লাইন ধরে ধরে। পরে দেখা গেল মেয়েটি অটিস্টিক। তার অকুপেশনাল থেরাপির প্রয়োজন। বাইরের কারও স্পর্শ সে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে না।

তো, এই মারিয়ার সঙ্গে পরিচয় হয় বয়সে বড় এনড্রের। এনড্রে এই কসাইখানার আর্থিক ব্যবস্থাপনা প্রধান। সে আবার শারীরিক প্রতিবন্ধী; তার বাম হাত অকেজো। এনড্রে আর মারিয়া এক স্বপ্নের সূত্র ধরে একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে।

অন বডি অ্যান্ড সোল
অন বডি অ্যান্ড সোল

স্বপ্নের বিষয়টি ধরা পড়ে কসাইখানায় একটি চুরির ঘটনার পর। গুদাম থেকে পশুর যৌন উত্তেজক গুড়া, মেটিং পাওডার চুরি হয়। চোর কে– সেটা বের করার জন্য কর্তৃপক্ষ ভাড়া করে আনে এক মনোবিদকে। সে সকলকে আলাদা আলাদা করে যৌনজীবন, স্বপ্ন ইত্যাদি নিয়ে জেরা করতে থাকে। এক পর্যায়ে এনড্রে ও মারিয়া একইরকম স্বপ্নের কথা বলে মনোবিদকে। এই স্বপ্নটি ছবির শুরু থেকেই দর্শককে দেখিয়ে আসছিলেন পরিচালক। বরফে ঢাকা বনের ভেতর এক হরিণ আর হরিণীর প্রণয়। মনোবিদ ভাবল, তার সঙ্গে মজা করার জন্য এই দুজন বানিয়ে এসব বলেছে। এমন অদ্ভুত ঘটনাটি জানাজানি হোক, তা চায়নি এনড্রে ও মারিয়া। তাই মনোবিদকে এনড্রে বলে, তারা ইচ্ছে করেই এক স্বপ্নের কথা বলেছিল। মনোবিদও বিষয়টি বিশ্বাস করে আর আসল চোরের পরিচয়টি জানায়। মেটিং পাউডার চুরি করেছিল এনড্রেরই এক সহকর্মী।

এই চুরিকে কেন্দ্র করে একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী বয়স্ক মানুষ ও আরেকজন অটিস্টিক কম বয়সী তরুণী জানতে পারে, তারা দুজনই এক স্বপ্ন দেখছে। প্রায় প্রতিদিনই। নিজেরা একদিন ঠিক করল, তারা একই বিছানায় শুয়ে অভিন্ন স্বপ্নটি দেখবে। ঘনিষ্ঠতার সুবাদে অটিস্টিক মেয়েটি লোকটির প্রেমে পড়ে ঠিকই; কিন্তু স্পর্শ সংক্রান্ত জটিলতার কারণে সে শারীরিকভাবে মিলিত হতে পারে না। বিষয়টি নিয়ে এনড্রে অস্বস্তিতে পড়ে যায়। সে এড়িয়ে চলতে থাকে মারিয়াকে। মরিয়া এতে বিষণ্ণ হয়ে পড়ে এবং আত্মহত্যার চেষ্টা চালায়। পরে অবশ্য এনড্রের সাড়া পেয়ে সে সামলে নেয়। সে রাতে তারা মিলিত হয়। এই মিলনের জন্য মারিয়া থেরাপি নিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করেছিল। যাহোক, পরের দিন ঘুম ভাঙার পর তারা দুজন আবিষ্কার করে, তারা আর স্বপ্নটি দেখছে না।


অচেতনে
যে ফ্যান্টাসি বা
কল্পজগৎ দুটি মানুষ
রচনা করেছিল, সেটিই বাস্তবে
যখন সম্পন্ন হয়, তখন
সেই স্বপ্ন বিদায়
নেয়

না, এখানে কার্ল গুস্তাফ ইয়ুঙের যৌথ অচেতনের বিষয় নেই; তবে জিগমুন্ট ফ্রয়েডের খোয়াবনামা ঘেটে কিছুটা হলেও এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা মিলতে পারে। যতদূর ঠাওর করা যায়, গোটা স্বপ্নটাই একটা রূপক আকারে হাজির করেছেন পরিচালক এনেডি। স্বপ্নের জগৎ কর্পূরের মতো, বাস্তবে এলে তা উবে যায়। স্বপ্ন, অর্থাৎ অচেতনে যে ফ্যান্টাসি বা কল্পজগৎ দুটি মানুষ রচনা করেছিল, সেটিই বাস্তবে যখন সম্পন্ন হয়, তখন সেই স্বপ্ন বিদায় নেয়। ফ্রয়েডের কল্যাণে আমরা জানি, মানুষের যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতাই অচেতন রচনায় সাহায্য করে, সেখানে এই ফ্যান্টাসি বা কল্পনার হাতও থাকে।

অন বডি অ্যান্ড সোল
অন বডি অ্যান্ড সোল

তবে কল্পনায় মানুষ যতটা বিনা বাধায় প্রাসাদ নির্মাণ করতে পারে, বাস্তবে সেটা সম্ভব হয় না। বাস্তবের দুনিয়ায় কল্পনা পদে পদে ঠোঁকর খায়। তারপরও মানুষ কল্পনার কাছাকাছি বাস্তব রচনা করতে চায়। চাওয়া পূরণ হলে অপূরণীয় কল্পনারা আর স্বপ্নে ঘুরঘুর করে না। তারা হয়তো অন্য কল্পনাকে আশ্রয় করে নতুন কিছু বলার প্রস্তুতি নিতে থাকে।

এই ছবিতে রূঢ় বাস্তবতার সমান্তরালে যেভাবে কোমল কল্পনার সৌধ নির্মিত হয়, তাতে বলতেই হয় পরিচালক এনেডি একজন কবি। নয়তো কসাইখানার রক্তমাংসের খোলাখুলি কারবার ও রক্তমাংসের মানুষের রহস্যময় মনোজগত নিয়ে জেরবার হওয়ার দ্বান্দ্বিক দৃশ্য দেখাতে পারতেন না।

লাভলেস
লাভলেস
ফিল্মমেকার । আন্দ্রেই ভিয়াগিনস্তেভ

৩.

রুশ পরিচালক আন্দ্রেই ভিয়াগিনস্তেভের ছবি নেলিউবভ বা লাভলেস [২০১৭] এক ভালোবাসাহীনতার গল্প। রুশ ‘নেলিউবভ’ শব্দটির মানে যতটা না ‘ভালোবাসাহীন’, তারচেয়ে বেশি ‘ভালোবাসাবিরোধী’র কাছাকাছি। এই ছবি রাশিয়ার সঙ্গে যৌথভাবে প্রযোজনা করেছে ফ্রান্স, বেলজিয়াম ও জার্মানি। কান চলচ্চিত্র উৎসবে জুরি পুরস্কার পাওয়া এই ছবিতে একটি ভেঙে পড়া পরিবারের করুণ কাহিনি বলা হয়েছে।

জিনিয়া আর বরিস নামে এক দম্পতির একমাত্র ছেলে আলিওশার বয়স ১২। বাবা-মায়ের দাম্পত্য কলহে জেরবার এই ছেলেটি। জিনিয়া ও বরিস দুজনেই পরকীয়া করে। মাঝে আলিওশা থেকে যায় মনোযোগের বাইরে। বাবা-মায়ের স্নেহবঞ্চিত। বরিসের প্রেমিকা সন্তানসম্ভবা। স্ত্রী জিনিয়ার সঙ্গে বিচ্ছেদের বিষয়টি চূড়ান্ত। জিনিয়াও তার বড়লোক প্রেমিকের বাড়িতেই থাকে বেশিরভাগ সময়। সংসার যেহেতু টিকছে না, তাই অ্যাপার্টমেন্টটি বিক্রি করে দেওয়া হবে। কিন্তু নিজের এতদিনের ঘরটি ছাড়তে চায় না ছোট্ট আলিওশা। এমনিতেই বাবা-মায়ের প্রেমবঞ্চিত বালকটি বিমর্ষ ছিল, যখন সে দেখল অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি হয়ে যাচ্ছে, তার আর নিজস্ব কক্ষ থাকছে না, তখন সে আরও ভেঙে পড়ে। তাহলে সে কোথায় থাকবে? এক ধরনের অনিশ্চয়তা ভর করে তার ভেতর। একদিন স্কুল থেকে সে আর ফেরে না।

লাভলেস
লাভলেস

বাবা ব্যস্ত ছিল প্রেমিকার গর্ভে নিজের অনাগত সন্তান নিয়ে, চিন্তিত ছিল নিজের চাকরি বাঁচানো নিয়ে; কারণ, তার কার্যালয়ে বিচ্ছেদপ্রাপ্ত কাউকে রাখা হতো না। কঠিন ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলে বরিসের বস। বরিস নিজের বাসায় প্রায়ই ফিরত না, আর স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ সমাগত, এসব খবর যেন অফিসে জানাজানি না হয়– সেটা নিয়ে চাপে থাকে। অন্যদিকে, জিনিয়া ঘরে দেরি করে ফিরলেও, ছেলে ফিরেছে কি না– তার খোঁজ রাখত না। একদিন চব্বিশ ঘণ্টা পর যখন তার মনে হয় ছেলে কোথায়, তখন সে খোঁজাখুঁজি শুরু করে, বরিসকে খবর দেয়। হঠাৎ নিখোঁজ পুত্রের জন্য বরিস ও জিনিয়া কিছু সময়ের জন্য এক হয়। হাসপাতালের মর্গেও যায়। তবে তারা আর এক ছাদের নিচে ফিরে আসেনি। ফিরে আসেনি ছেলেটিও।

ছবিটি শুরু হয় লেনিনগ্রাদ অঞ্চলের বরফে ঢাকা রাস্তাঘাট, ছোট জলপ্রবাহ, গাছপালার দৃশ্য দিয়ে। এরপর ক্যামেরা স্থির হয় একটি বিদ্যালয়ের সামনে। আলিওশার স্কুল। সবকিছুইতেই যেন একটা বিষণ্ণভাব। অন্য ছেলেমেয়েরা যেখানে দল বেঁধে বাড়ি ফেরে, সেখানে আলিওশা একাকী বরফ ভেজা পাতার ওপর বিষাদগ্রস্ত হয়ে হাঁটে। বাড়ি ফিরতে মন চায় না তার। একদিন বাড়ি ফেরার পথে ‘পুলিশ-ফিতা’ কুড়িয়ে নেয় আলিওশা, এরপর মনের খেয়ালে তা ছুড়ে মারে আকাশের দিকে। সেটি গিয়ে ঝুলে থাকে নিষ্পল্লব বৃক্ষের ডালে।

লাভলেস
লাভলেস

ছবির শেষদৃশ্যেও ঐ ফিতাটি ঝুলে থাকতে দেখা যায়। যে ছুঁড়ে মেরেছিল তার খোঁজ নেই, তবে নিখোঁজ বালকের চিহ্ন হয়ে ঝুলে থাকে ফিতাটি। বরফাচ্ছাদিত আবেগহীন বনের ভেতর এক রুক্ষ গাছের মগডালে ঝুলে থাকা ফিতাটি যেন জানান দিচ্ছে এক প্রাতিভাসিক সত্যের– ছেলেটি এই বৃক্ষের নিচ দিয়েই হেঁটে গিয়েছিল একদিন। ছেলেটি একদিন সত্যি সত্যি ছিল; এখন আছে কি? কেউ জানে না এর উত্তর।


যে
ছুঁড়ে
মেরেছিল
তার খোঁজ নেই,
তবে নিখোঁজ বালকের
চিহ্ন হয়ে ঝুলে থাকে ফিতাটি

‘প্রেমের বিপরীত’ এই ছবিটি প্রসঙ্গে রুশ সমালোচকরা টেনে আনেন রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যকার সম্পর্ককে। জিনিয়াকে রাষ্ট্র আর অবহেলিত আলিওশাকে তারা তুলনা করেন নাগরিকদের সঙ্গে। রাষ্ট্র নাগরিকদের প্রতি প্রেমহীন, শীতল ও দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ করে চলেছে। এমন তুলনায় অনেকেই তখন নড়েচড়ে বসে।

লাভলেস
লাভলেস

ছবিটির অন্তর্গত বক্তব্য আসলে একটাই, অবহেলা আর চরম প্রেমহীনতায় মানুষ কেন, কেউই টিকে থাকতে পারে না। তারা স্রেফ মিলিয়ে যায় বা হারিয়ে যায়। সে হোক সন্তান কিংবা নাগরিক। পরিচালক ভিয়াগিনস্তেভ একইসঙ্গে কাব্য ও বিষাদ যেভাবে দৃশ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন, তা অমোঘ হয়ে আঘাত করে। বিশেষ করে ওই দৃশ্যটি, যেখানে মা ও বাবা বিচ্ছেদি ঝগড়া করে, ছেলেটি দরজার কোনায় নিশব্দ কান্নায় ভেঙে পড়ে। এমন দৃশ্য দেখলে যে কারও বুক হুহু করে উঠতে বাধ্য, জনমানবহীন প্রান্তরের ওপর দিয়ে হিম প্রবাহের মতো অনুভূতি সঞ্চার করে দৃশ্যটি।

অ্যাক্টস অব ভেনজ্যেন্স
অ্যাক্টস অব ভেনজ্যেন্স
ফিল্মমেকার । আইজ্যাক ফ্লোরেনটাইন

৪.

আগেই বলেছি, ইউরোপের ছবিকে সাধারণত উচ্চমার্গের শিল্পসৃষ্টি হিসেবে ধরা হয়; তার মানে এই নয়, সেখানে বাণিজ্যিক ধারার ধুমধারাক্কা ছবি নির্মিত হয় না। উল্লিখিত ছবিগুলোকে আর্ট হাউস ফিল্ম বলা হয়। এর পাশাপাশি পূর্ব ইউরোপে কমার্সিয়াল ফিল্মও হয়; সে তো হবেই। সমাজ ব্যবস্থার নিয়ম মেনে সেগুলোর ভোক্তাও আছে। তবে কোনো কোনো ছবি বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে বানালেও, সেখানেও কোথাও না কোথাও তারা দার্শিনকতার ছোঁয়া রাখতে চান। যেমন আন্তোনিও বানদেরাস অভিনীত অ্যাক্টস অব ভেনজ্যেন্স [২০১৭।

আইজ্যাক ফ্লোরেনটাইন পরিচালিত এই ছবিতে দেখা যায় স্টয়িক দার্শনিক মার্কুস ওরেলিউসের মেডিটেশনস বইটি হাতে পেয়ে জীবনদর্শন বদলে যায় নায়কের। ব্যক্তির নীতিনৈতিকতা সম্পর্কিত মার্কুসের বাণী আত্মস্থ করে শেষ পর্যন্ত নিজের স্ত্রী ও সন্তানের খুনিকে ক্ষমা করে দেয় সেই নায়ক। ছবিটি বুলগেরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ প্রযোজনা।

বুলেট হেড
বুলেট হেড
ফিল্মমেকার । পল সোলেট

যুক্তরাষ্ট্র ও বুলগেরিয়া প্রযোজিত আরও একটি অ্যাকশন ছবির কথা বলা যায়– বুলেট হেড ২০১৭]। এতে অভিনয় করেছেন অ্যাড্রিয়েন ব্রুডি, আন্তোনিও বানদেরাস ও জন ম্যালকোভিচের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অভিনেতারা। পল সোলেট পরিচালিত হরর ক্রাইম থ্রিলার ধরনের এই ছবিতে দর্শনের প্রভাব না থাকলেও, হলিউডের প্রভাব বেশ স্পষ্ট। তবে এসব ছবি যে বোদ্ধা দর্শক পছন্দ করেছে, তা নয়। নয়তো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে এ ধাঁচের ছবিগুলোর সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করা যেত।

এখন ছবি কতটুকু নান্দনিক বা চিন্তাশীল হয়ে উঠবে, তা নির্ভর করে নির্মাতার ওপর। ফরাসি পণ্ডিত রোলাঁ বার্থ যেমন দ্য প্রবলেম অব সিগনিফিকেশন ইন সিনেমা প্রবন্ধে বলছেন, নান্দনিক মূল্য নির্ণিত হয় ‘দূরত্ব’ দিয়ে। কিসের দূরত্ব? এটা হলো চিহ্নের গঠন ও বিষয়ের দূরত্ব। চলচ্চিত্রে চিহ্ন কেন্দ্রে অবস্থান করে না ঠিকই, তবে বিষয়ের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে যদি সঠিক দূরত্ব মেপে পরিচালক সেটিকে ব্যবহার করতে পারেন, তাহলে নান্দনিকতার বিচারে একটি ছবি মূল্যবান হয়ে ওঠে। এটা নির্ভর করছে আসলে পরিচালকের ওপরই। তিনি যদি চিহ্নায়ন প্রক্রিয়ায় দূরত্ব বেশি তৈরি করে ফেলেন, তাহলে দর্শকের কাছে সেটা দুর্বোধ্য হয়ে উঠবে। যদিও দুর্বোধ্যতা সমাজ ও সাংস্কৃতিক আবহ এবং সময়ের ব্যবধানের কারণেও তৈরি হতে পারে। সে আলোচনা ভিন্ন। কথা হলো পূর্ব ইউরোপের যে চলচ্চিত্রগুলো নিয়ে উপরে আলাপ হলো, সেখানে পরিচালকগণ পদ-পদার্থ-বিষয়– তিনটির দূরত্বই বেশ সুন্দর করে রচনা করতে পেরেছেন। নয়তো দর্শক হিসেবে আমরা তাদের বক্তব্যের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারতাম না।

ইউ ক্যারি মি ছবিতে নানা বয়সী নারীর প্রতিকূলতার মুখোমুখি হওয়া, অন বডি অ্যান্ড সোল ছবিতে ভিন্নরকম দুই নারী-পুরুষের অভিন্ন জায়গায় নিজেদেরবাসনাকে আবিষ্কার করা, লাভলেস ছবিতে নারীপুরুষের স্বার্থপরতায় এক নাবালকের জীবন বিপন্ন হওয়ার গল্পগুলো বিভিন্ন স্তরে যেভাবে চিহ্নায়িত হয়েছে এবং দর্শক হিসেবে আমাদের আন্দোলিত করেছে, তাতে বলা যায় নন্দনতত্ত্বের বিচারে এগুলো ভালো ছবি। পরের বাণিজ্যিক ছবিগুলো সেই বিচারে মন্দ ছবি। পরিচালক দর্শককে সঠিক জায়গায় চিহ্ন স্থাপনের মধ্য দিয়েই চিন্তার খোড়াক দেন এবং সেইসঙ্গে নিজের ছবিকেও বুদ্ধিদীপ্ত বিভিন্ন পদ ও পদার্থ দিয়ে গর্ভবতী করে তোলেন।

আশা রাখি, শিগগিরই বাংলাদেশে এমন গর্ভবতী ছবির দেখা মিলবে।


দোহাই
১. জিনেট ভিনসেনদ্যু, ১৯৯৮, ইস্যুজ ইন ইউরোপিয়ান সিনেমা, জন হিল ও পামেলা চার্চ গিবসন সম্পাদিত দ্য অক্সফোর্ড গাইড টু ফিল্ম স্টাডিজ, নিউ ইয়র্ক: অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস।
২. রোলাঁ বার্থ, ২০১৬, সাইনস অ্যান্ড ইমেজেস, ক্রিস টার্নার অনূদিত, পেনসিলভ্যানিয়া: সিগাল বুকস।

Print Friendly, PDF & Email
লেখক, সাংবাদিক, সিনে-সমালোচক। ঢাকা, বাংলাদেশ। সিনে-গ্রন্থ : চলচ্চিত্র পাঠ সহায়িকা; চলচ্চিত্র বিচার; বলিউড বাহাস; উসমান সেমবেনের চলচ্চিত্র হালা

১টি কমেন্ট

  1. নানান সংস্কৃতিতে প্রব্রজ্যার জন্য চমৎকার রসদ পেয়ে গেলাম! একটা কথা কী, চলচ্চিত্রগুলোর নাম ক্যাপশনেও মূল হাঙ্গেরীয় বা রুশে দেওয়া উচিত। আমরা অন্তত চলচ্চিত্রের শিরোনামে যত মূলানুগ হব, তত ঐ অঞ্চলের সান্নিধ্যে যেতে পারব। নচেৎ একটা হলিউড-বিলেতি গন্ধ থেকে যায়।

Leave a Reply to আহমেদ আতিফ আবরার

Please enter your comment!
Please enter your name here