লিখেছেন । শান্তনু হালদার

দ্য সাইলেন্স
ফিল্মমেকার, স্ক্রিনরাইটার, এডিটর । মোহসেন মাখমালবাফ
প্রডিউসার । মারিঁ কার্মিৎস
সিনেমাটোগ্রাফার । এব্রাহিম গাফোরি
কাস্ট [ক্যারেকটার] । তাহমিনা নরমাতোভা [খোরশেদ]; নাদিরা আবদেলাহিয়েভা [নাদিরা]; গইবিবি জিয়াদুলাহিয়েভা [খোরশেদের মা]
রানিংটাইম । ৭৬ মিনিট
ভাষা । ফার্সি
দেশ । ইরান; তাজিকিস্তান; ফ্রান্স
রিলিজ । ১৯৯৮
কেবল শব্দে সংগীত তৈরি হয় না; শব্দের নীরবতায় হয় সংগীত। সংগীতের সেই নীরব অন্তরগত দৃশ্যকাব্য নির্মাণ করেছেন মোহসেন মাখমালবাফ তার দ্য সাইলেন্স সিনেমায়।
মোহসেন মাখমালবাফ একজন আলোচিত ইরানি সিনেমামেকার। প্রথম দিককার সিনেমায় [১৯৮৫-এর দিকে] ধর্মীয় কুসংস্কার নিয়ে বোঝাপড়া করেন। ইরানে যখন মোল্লারা ১৮৮৫-১৯৯০ সালে শাসন কায়েম করেন, তখন থেকে তার গল্প উপস্থাপনের পটভূমি পাল্টে যায়। ইরানীয় নিজস্ব রীতিতে বর্ণনা তার ক্যানভাসে জায়গা করে নেয়। তার মতে, প্রথম দিককার সিনেমা ফিলোসফিক্যাল। পরবর্তী সিনেমা কাব্যিকধর্মী। যেখানে তিনি ব্যবহার করেন ধ্রুপদী বর্ণনাধর্মী রীতি। যেখানে তিনি তার ভালোলাগার ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে বোঝাপড়া করেন। রূপক ধর্মিতা এবং সুফিতত্ত্বের বিষয়আশয় নিয়ে বোঝাপড়া করেন।
তাকে বলা হয় আধ্যাত্মিক সিনেমামেকার। দ্য সাইলেন্স সিনেমাটিতে সুফিতত্ত্বের আধ্যাত্মিক বিষয় নিয়ে বোঝাপড়া করেন। সুফিইজম থেকে নেওয়া নানা প্রতীক এই সিনেমায় জায়গা করে নেয়। এবং গল্পের ধারাবাহিকতায় খোরশেদ চরিত্রটির যে যাত্রা এবং শেষ অবদি সে যেখানে উপনীত হয়, তা মূলত সুফি তত্ত্বেরই মূলগত ভীত। সুফি তত্ত্বে এবং গৌতম বুদ্ধ মানুষের যে আধ্যাত্মিক মুক্তির সোপান নির্মাণ করেছেন, তারই দৃশ্যকাব্য দ্য সাইলেন্স। এই সিনেমের প্রধান চরিত্র ১১ বছরের অন্ধ খোরশেদ সেই আধ্যাত্মিক মুক্তির পথের যাত্রী।

খোরশেদ চরিত্রটি এবং তার অন্ধত্ব– দুটোই প্রতীকী হিসেবে নির্দেশক ব্যবহার করেছেন। পক্ষান্তরে তিনি মানুষের যাপিত জীবনের শৃঙ্খল ভেঙ্গে মুক্তির ক্যানভাস এঁকেছেন। সংগীত, প্রকৃতি, ভাঙা আয়না, নদী ও আলোর ব্যবহার সুফি ইসলাম থেকে নেওয়া। নানা উপাদানের প্রতীকী ব্যবহার সিনেমাটিকে ঋদ্ধ করে।
মাখমালবাফের ক্যানভাসে ইরানের স্থানিক পটভূমি উপস্থাপিত হলেও সিনেমায় প্রধান কার্যকরি উপাদান সংগীত; সেই উপাদানটি তিনি নিয়েছেন বিটোভেনের কাছ থেকে। এই সিনেমায় স্থানিক বা ট্রেডিশনাল মিউজিকের ব্যবহার তিনি করেছেন, কিন্তু বিটোভেনের পঞ্চম সিমফোনিকে কেন্দ্র করে গল্পটি আবর্তিত হয়। এই সিম্ফোনির একটি সার্বজনীন রূপ আছে। এবং এটি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে মাখমালবাফ সার্বজনীন হয়ে ওঠেন। সিনেমার নাম যে কারণে দ্য সাইলেন্স, সেটি বুঝবার জন্য এবং বিটোভেনের মিউজিক কেন ব্যবহার হলো, সে সম্পর্কে বুঝবার জন্য আধ্যাত্মিক গুরু অজোনিসি অসো’র কয়েকটি লাইন উদ্ধৃতি করছি :
‘মহৎ সংগীতশিল্পী আর কিছুই না, কেবল অন্তর জগতের প্রতিধ্বনি মাত্র। যখন একজন মহৎ সংগীতশিল্পী সংগীতের সঙ্গে একাত্ম হয়, কেবল তখনই মহৎ সংগীত উচ্চারিত হয়। মাত্র কয়েকজন সেই স্তরে পৌঁছাতে পেরেছেন– বিটোভেন, তানসেন, মোজার্ট– এ রকম কয়েকজন।’
সেই অন্তর জগতের মিউজিক তৈরি করেছেন বিটোভেন। এবং বিটোভেনের পঞ্চম সিমফোনিকে আশ্রয় করে মোহসেন মাখমালবাফ নির্মাণ করেছেন দ্য সাইলেন্স সিনেমাটি।
সংগীতের এবং জীবনের সাইলেন্স বিষয়টি সম্পর্কে অসো আরও পরিস্কার করে বলেন– ‘সাধারণ সংগীতশিল্পীদের কাছে কেবল শব্দই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যারা সংগীতের গুরু, কেবল তাদের কাছে নীরবতা গুরুত্বপূর্ণ। সে শব্দ ব্যবহার করে কেবল নীরবতা তৈরির জন্য। সে শব্দের উচ্চনিনাদ তৈরি করে কেবল গভীর নীরবতায় প্রবেশের জন্য।’
নীরবতা কবিতা । নীরবতা মুক্তি। নীরবতা মানুষের কেন্দ্র। মহাজাগতিক সম্পর্ক নির্মাণে নীরবতায় নিমজ্জন হতে হয়। পক্ষান্তরে আমরা বসবাস করি এক নয়েসি পৃথিবীতে। পৃথিবীর নয়েস অপসারণ করে খোরশেদ নীরবতায় উপনীত হয় সংগীতের সিমফোনির মধ্য দিয়ে। সে কারণেই হয়তো মোহসেন মাখমালবাফ সিনেমার নামকরণ করেছেন– দ্য সাইলেন্স।

প্রধান চরিত্র খোরশেদ কেবল ভালো সংগীত বা সিমফোনি খুঁজে বেড়ায়। তার খুঁজে বেড়ানোর যাত্রা সমাপন হয় বিটোভেনের সিমফোনির মধ্য দিয়ে নীরবতা অনুভব করে।
এই সিনেমায় যে ট্রিটমেন্ট করা হয়েছে, তা কোনো ফিকশনাল জারগণ তৈরি করে না। বরং ফিকশন ও নন-ফিকশনের মধ্যবর্তী যোগসূত্র তৈরি করে। অভিনয়ে সমস্ত বাহুল্যতা বর্জন করা হয়। অভিনয় হয়ে ওঠে না-অভিনয়। প্রামাণ্যচিত্রের ন্যায় খোরশেদের জীবনের সরল বয়ান উপস্থাপিত হয়। গল্পের উপস্থাপন ঢং, অভিনয়, ক্যামেরার ব্যবহার কোনো ফিকশনাল গল্প বলার কারিগর না হয়ে বরং সরল বয়ানে খোরশেদের জীবনের পরিপাশ ও অন্তরপাশ প্রকাশ করে।
…
হেজিমোনাইজ
করার অপর
পিঠ এই
সিনেমা
…
সমাজ সম্পর্কিত ফিকশনাল গল্প আমাদের হেজিমোনাইজ করে। বরং বলা যায়, এই হেজিমোনাইজ করার অপর পিঠ এই সিনেমা। নির্দেশক সচেতনভাবেই সেই হেজিমনির খোলস উন্মোচন করেছেন এবং সামাজিক জারগণ তৈরি হবার সম্ভবনা থেকে তার সিনেমাকে দূরে রেখেছেন।
সিনেমাটি কোনো ফিকশনাল বা ডক্সা [doxa] টাইপ প্রেজেনটেশন নয়; বরং সিনেমার মধ্যে যে ফিকশন থাকে বা সিনেমাটিক ব্যাপার থাকে– সেটিকে চ্যালেঞ্জ করে। এই ডক্সা সম্পর্কে বুঝবার জন্য রোলাঁ বার্থ যা বলেছেন, সেটি একটু খোলসা করা যাক :
‘ডক্সা হচ্ছে একটি সাংস্কৃতিক স্টেরিওটাইপ বা ছাঁচ। আর এভাবেই এটা একটা ফিকশন হয়ে ওঠে এবং একটি জারগণ বা পরিভাষা হিসেবে কার্যকর থাকে। পাশাপাশি এক অজ্ঞান অথবা এমনকি এক অকর্মণ্য ডিসকোর্সেও পরিণত হয়।’
নির্দেশক মাখমালবাফ তৎকালের সমাজ ব্যবস্থার যে ছাঁচ বা ডক্সা বিরাজমান রয়েছে, তা ভেঙে দিতে চান না; বরং সামাজিক স্তর বিন্যাসের পর্দগুলো উন্মোচন করে মানব সত্ত্বার গভীরে উঁকি দিতে চান।

গল্প সংক্ষেপ
১০-১১ বছরের একটি অন্ধ ছেলে খোরশেদ। একটি যন্ত্র নির্মাণের দোকানে টিউনার হিসেবে কাজ করে। তাকে পরিবারের ভার বহন করতে হয়। পরিবারের জন্য উপার্জন করতে হয়। কিন্তু সব সময় মিউজিক তাকে মোহিত করে রাখে। তার কাজ থেকে বিচ্যুত করে।
তাজিকিস্তানের কোনো এক জায়গা এই গল্পের পটভূমি। তাজিকিস্তানের কোনো এক নদীর পারে একটি ছোট ঘর, সেখানে খোরশেদ আর তার মা থাকে। প্রতিদিন সকালবেলা বাড়ির মালিক এসে ঘর ভাড়া চায়। মালিক এসে কড়া নেড়ে জানিয়ে দেয়, পাঁচদিনের মধ্যে টাকা পরিশোধ করতে হবে, অথবা তাদের চলে যেতে হবে।
তার অন্ধত্ব তাকে এক অদ্ভুত ক্ষমতা দেয়। কিন্তু সমস্যা হলো, উচ্চনিনাদিত শব্দ খোরশেদকে সবসময় মোহিত করে ফেলে। যখনই কোনো ভালো যন্ত্রবাদকের বাজনা শোনে, তখনই সে মোহিত হয়ে যায়; সে নিত্যনৈমেত্তিকতা থেকে বিচ্যুত হয়ে সময় এবং স্থান ভুলে যায়। এ কারণে তার গন্তব্য কাজে পৌঁছাতে দেরি হয়। সে কারণে মালিক তার ওপর বিরক্ত। সে সবসময় চেষ্টা করে মিউজিকের প্রতি ভালোবাসা এবং রুটিরোজগারের দ্বায়িত্বের মধ্যে ভারসম্য রক্ষা করতে।
কিন্তু শেষ অবদি তার চাকরিটা চলে যায়।বাড়ি থেকে তাদের বিতাড়িত করা হয়। খোরশেদ মিউজিকে আপ্লুত হয়ে সব বন্ধন ছিন্ন করে দূরে কোথাও, দূরে… দূরে… চলে যায়।

প্লট বিভাজন
১. টাইটেল
[গ্রাফিকস] মিউজিক রেখা এবং বিটোভেনের মিউজিক।
২. তাজিকিস্তান, [প্রথম দিন] খোরশেদের বাড়ি
নদীর পারে অবস্থিত খোরশেদের বাড়িতে খোরশেদ আর তার মা। বাড়িওয়ালা এসে দরজায় কড়া নেড়ে জানান দেয় পাঁচদিনের মধ্যে ভাড়া দিতে না পারলে বাড়ির মালপত্র সব রাস্তায় ফেলে দিবে।
৩. কর্মক্ষেত্র ওয়ার্কশপের উদ্দেশ্যে যাত্রাপথ
ক. খোরশেদ তার কাজে মিউজিক ওয়ার্কশপের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। সে একজন মিউজিক টিউনার হিসেবে কাজ করে। পথিমধ্যে সে রুটি আর ফল বিক্রেতাদের কাছ থেকে রুটি, ফল ক্রয় করে।
খ. ফল বিক্রেতা কিশোরী সাদাতকে খোরশেদ আন্দাজ করতে পারে। সাদাত তাকে বাসে উঠতে সাহায্য করে এবং খোরশেদকে সতর্ক করে সে যেন সব সময় কান বন্ধ রাখে। শব্দ শুনলে শব্দের মোহে খোরশেদ যেকোনো স্টপিজে নেমে পড়তে পারে। খোরশেদ চোখে দেখতে পায় না।
গ. বাসে ওঠে দুজন স্কুল ছাত্রীর সঙ্গে কথা বলে।
ঘ. নাদিরা অপেক্ষা করে। বাস থামে। বাস থেকে নেমে বাজারে মিউজিক শুনে খোরশেদ হারিয়ে যায়। নাদিরা চোখ বন্ধ করে মিউজিক শুনে তাকে খুঁজে বের করে। ততক্ষণে কর্মক্ষেত্রে পৌঁছাতে দেরি করে ফেলে খোরশেদ।
৪. মিউজিক ওয়ার্কশপ
ক. দোকানের মালিকের কথা খোরশেদ শুনতে পায় না, কেবল একটা গোবরা পোকার শব্দ পায়। নাদিরা দোভাষি হিসেবে কাজ করে।
খ. নাদিরা জল আনতে জলের ঘাটে যায়। সেখানে একা একা ফল-ফুল দিয়ে নিজেকে সাজায় । পকেট আয়নায় নিজেকে দেখে নেয়।
গ. মিউজিক ওয়ার্কশপে খোরশেদ যন্ত্র টিউন করে। নাদিরা তাকে নাচের ছোট ছোট মুদ্রায় টিউন তুলতে সাহায্য করে।
৫. খোরশেদের বাড়ি [দ্বিতীয় দিন]
ক. গোবরা পোকা শব্দ করে। বাড়ির মালিক টাকা পরিশোধ করতে বলে। মা খোরশেদকে তার মালিকের কাছ থেকে টাকা ধার নিতে বলে।
খ. পূর্বেকার মতো খোরশেদকে সাদাত বাসে উঠিয়ে দেয়। বাসে এক স্কুল ছাত্রের মিউজক বাজনা শুনে তাকে ফলো করে নেমে পড়ে। খোরশেদ তাকে ফলো করে অর্কেস্ট্রায় পৌঁছে যায়। মাস্টার তাকে বকা দেয়। তার দোকান থেকে কেনা যন্ত্রের টিউন ভালো না বিধায় একটি দোতারা ফেরত দেয়।
গ. বৃষ্টি শুরু হয়। বৃষ্টিতে ভিজে খোরশেদ নদীপারে হেঁটে চলে। দোতারায় বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে মিউজিক তৈরি হয়। প্রকৃতি আর যন্ত্রের শব্দ তার কাছে এক হয়ে যায়।
ঘ. ওয়ার্কশপ : নাদিরা তাকে বাড়ি যেতে বলে। কারণ, মালিক আজ বেতন দিবে না; কারণ, সে ক্ষেপে আছে।

৬. খোরশেদের বাড়ি [তৃতীয় দিন]
ক. আবার বাড়িওয়ালার ভাড়ার জন্য তাড়া। মাত্র তিনদিন বাকি।
খ. একই স্টপেজ থেকে বাসে করে রওনা। এবার গাড়িতে বাউলের মিউজিক শুনে তাকে ফলো করে বেড়িয়ে পড়ে। তাকে খোঁজার জন্য একটি ঠেলা গাড়ি ঠিক করে তাতে চলতে থাকে। আরেক কিশোর ছেলে হাঁপড় তুলে তাকে টেনে নিয়ে চলে।
গ. একটা মেটাল ওয়ার্কশপে নেমে পরে খোরশেদ। তাদের হাতুরি দিয়ে বো বো-বো-বোম… সাউন্ড তৈরি করতে বলে।
ঘ. ওয়ার্কশপ। টিউন করায় ব্যস্ত খোরশেদ।
ঙ. নাদিরার সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে পড়ে খোরশেদ। পুলিশের বন্দুকের নল দেখে ভয় পায় নাদিরা। কারণ, পুলিশ মাথায় স্কার্ফ না পরলে মারে। পথ ঘুরে অন্য পথে যায়। কামানের নিচে বসে একজন দোতরা বাজায়। তাকে ওভারকাম করে চলে যায় খোরশেদ ও নাদিরা।
চ. নদীর পারে বসন্তে নাদিরা ও খোরশেদ। খোরশেদ নাদিরার আয়নাটা ভেঙে ফেলে। খোরশেদ ঝরা পাতার নিচে শুয়ে থাকে । নাদিরা ফিরে যায়।
৭. খোরশেদের বাড়ি [চতুর্থ দিন]
ক. মায়ের তাড়া টাকা আনার জন্য। খোরশেদ বেড়িয়ে পড়ে।
খ. খোরশেদ বাসের মধ্যে গতকালের মিউজিশিয়ানকে খোঁজে; কারণ তাকে খুঁজতে গিয়ে তার দেরি হয়েছে, সেটা তার মালিককে বোঝাতে চায়। এ বাস থেকে অন্য বাসে। খোরশেদের কানে কান বন্ধ করার পরেও পানির শব্দ ঢুকে পড়ে।
গ. মা জলে বরশি দিয়ে মাছ ধরে। সেখানে আরেক বৃদ্ধকে তার অবস্থার কথা জানায়।
ঘ. খোরশেদ সেই মিউজিশিয়ানকে নিয়ে তার ওয়ার্কশপে চলে আসে; কিন্তু এসে দেখে প্রতিদিন দেরি করার জন্য মালিক ঘরে তালা ঝুলিয়ে রেখেছে। তাদের দুজনকে কাজ থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
ঙ. মিউজিশিয়ানের সঙ্গে ওরা দুজন চলে যায়।
চ. ওরা নদীর পারে এসে থামে। যেখান থেকে খোরশেদের বাড়িটি দেখা যায়। নৌকায় মালিক যেয়ে ওদের বাড়ির মালপত্র সব ফেলে দেয়। এপারে খোরশেদ ও নাদিরার সঙ্গে মিউজিশিয়ানরা মিউজিক করে। তার মা খোরশেদের জিনিসপত্র নিয়ে তাদের দিকে আসতে থাকে। খোরশেদ বলে, আমি অনেক দূরে চলে যা্ সেই মিউজিক বাজাও। বাজতে থাকে। সব প্রাণীরা নাচতে থাকে। খোরশেদ ঘোড়ার মতো দৌড়ে মেটাল ওয়ার্কশপে চলে আসে।
ছ. মেটাল ওয়ার্কশপে সবাইকে হাতুরি পাতিল দিয়ে সাউন্ড মিউজিক করার নির্দেশনা দেয়। আলো এসে খোরশেদের গায়ে পড়ে। হাড়ি পাতিলে মিউজিক তৈরি হয়ে বিটোভেনের সিমফোনিতে আপ্লুত হয়ে নাচতে থাকে খোরশেদ।
৮. টাইটেল
সমাপ্ত।

সিনেমার ঘটনা শুরু হয়
মালিক টাকার জন্য খোরশেদের ভাড়া বাড়িতে কড়া নাড়ে। শুরুতেই ‘পয়েন্ট অব অ্যাটাক’ স্থাপিত হয়। এর সূত্র ধরে নাট্যক্রিয়া ডেভলপ হতে থাকে। দর্শক আগ্রহ নিয়ে দেখতে থাকে, কীভাবে একটি অন্ধ বালক সেই টাকা পাঁচদিনের মধ্যে পরিশোধ করবে। খোরশেদ নিত্যকার মতো তার কাজে যায়। মনে মনে ভাবে, তার মালিকের কাছে টাকা ধার চাইবে; কিন্তু নানা কারণে সেটি হয়ে ওঠে না । খোরশেদের পাঁচদিনের যাত্রাপথে যা হয়, তা-ই এই সিনেমা। প্লট গঠনে তেমন বাহুল্য নাই। কেবল বাড়ি থেকে কর্মক্ষেত্রে যাত্রার পাঁচদিনের পরিক্রমা। অবশেষে খোরশেদের চাকরিটা চলে যায়। তাদের বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয় এবং খোরশেদ সব ছেড়ে মুক্তির পথে যাত্রা করে।
…
গল্পের
এই সরল
বয়ান কেবল
জীবনকে স্পষ্ট করে তোলে
…
লিনিয়ার পদ্ধতিতে গল্পটি বলা হয়। প্লট গঠনে কেবল একটি চরিত্র প্রকাশ, বিকাশ ও বুঝবার দিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। খোরশদ একজন অন্ধ শব্দ সংবেদনশীল ১০ বছরের ছেলে। তাকে কেন্দ্র করে গল্পের পরিক্রম। অন্যান্য চরিত্র, বিষয়, অবজেক্ট কেবল তাকে প্রকাশের অনুষঙ্গ হিসেবে আসে। আর চরিত্রটির পাঁচদিনের যাত্রার মধ্যে সমাজ, রাজনীতি, ধর্ম, জগত ও পরম আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। গল্পের এই সরল বয়ান কেবল জীবনকে স্পষ্ট করে তোলে। আইডিয়ার ক্যারিশমা প্রকাশ করে না। প্রক্ষিপ্ত আইডিয়া বা কারিগরি কলকবজার চাতুর্যপূর্ণ ব্যবহার এই সিনেমায় নাই বললেই চলে।
এ ক্ষেত্রে সিনেমাকারদের জন্য চলচ্চিত্র পরিচালক আন্দ্রেই তারকোভস্কির উপদেশ এ রকম– ‘কখনোই তোমার আইডিয়াকে দর্শকের কাছে উপস্থাপন করো না, এটা নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক এবং ধন্যবাদের অযোগ্য। দর্শককে জীবন দেখাও; দর্শক সেখান থেকে মূলগত ভাব খুঁজে নেবে।’
মোহসেন মাখমালবাফও আমাদের কাছে কেবল জীবন উপস্থাপন করেন। এবং দর্শকের জীবন ও পরম বোঝবার রসদ এই সিনেমায় স্পষ্ট আছে।
এবার দেখা যাক ফ্রেম, আলো, রঙ, শব্দ কীভাবে বক্তব্য প্রকাশে সহায়ক হয়ে ওঠে বা কতটা কার্যকরী।
বিশ্ব প্রকৃতির এই ক্যানভাসে খোরশেদের জীবনের অনুপুঙ্খ আমাদের আগ্রহের বিষয়। সুতরাং সমগ্র সিনেমাজুড়ে ক্লোজআপ শট এবং লং শটের আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। ক্যামেরার অ্যাঙ্গেলের কোনো চাতুর্যপনার প্রকাশ নাই; কেবল দর্শককে আই-অ্যাঙ্গেলে মুখোমুখি অবস্থান করায়। যেখানে দর্শক চরিত্রের সঙ্গে এবং নিজের সাথে কনফ্রন্টে লিপ্ত হতে পারে।
এডিটিংয়ে কোনো ইফেক্টের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় না; কেবল কাট-টু-কাট শটের সংযোজন। কয়েক জায়গায় ম্যাচকাটের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। এবং ম্যাচকাটে ভিন্ন বিষয়ের অবতারণ আমাদের জগতের পার্থ্যক্যগুলো বুঝতে সহায়তা করে।
…
প্রতিটি
শটের পর
পর উপস্থাপন
প্রতীকী অর্থ ও জীবনের
বৈপরীত্যগুলো স্পষ্ট করে তোলে
…
প্রথম শট লং– নদীর এপার থেকে ওপারে খোরশেদের বাড়ি দেখা যায়। সাধারণ ব্যবহার, বলা যায় স্টাবলিস্ট শট। দ্বিতীয় শট ক্লোজ। দরজায় একটা হাত নক করে। একই ফ্রেমে খোরশেদের মায়ের ব্যাক-এন্ট্রি। আবার একই ফ্রেমে একটি স্ক্রাপ ঝুলতে থাকে। একটি হাত প্রবেশ করে স্ক্রাপটি নিয়ে যায়। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। সেই ফ্রেমেই প্রবেশ করে খোরশেদ। কাট। আবার একই ফ্রেমে মা স্ক্রাপটি মাথায় বেঁধে নেয়। ক্যামেরা স্থির থাকে। মা দরজা খোলে। কাট। একটি বোতলে গোবরা পোকা ভো-ভো… শব্দ করে বেরিয়ে যায়। মিড-ক্লোজে খোরশেদ প্রার্থনা করে পোকাটি যেন সুস্থ ভবে বাড়ি যেতে পারে। প্রতিটি শটের পর পর উপস্থাপন প্রতীকী অর্থ ও জীবনের বৈপরীত্যগুলো স্পষ্ট করে তোলে।

নির্দেশক মোহসেন মাখমালবাফ কোনো প্রক্ষিপ্ত মন্তাজ তৈরি করেননি। ইফেক্টের কোনো ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় না; কিন্তু প্রতিটি এলিমেন্ট মুভমেন্ট আমাদের তৃতীয় অর্থ বুঝতে উদ্ভুদ্ধ করে। কখনোই আমরা বাড়িওয়ালাকে দেখতে পাই না; শুধু তার দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পাই। ঠিক তখনই খোরশেদের বোতল থেকে গোবরা পোকাটি বেড়িয়ে যায়, যে পোকা কোনো মিষ্ট শব্দ করতে জানে না এবং বাজে গন্ধের ফুলের প্রতি তার আগ্রহ। এবং দরজায় কড়া নাড়া এক অদৃশ্য ব্যক্তি– যা সমাজের বুর্জোয়া শ্রেণির প্রতিভূ হয়ে প্রতীয়মান হয়। কড়া নাড়ার পরের শট একটি মহিল তটস্থ হয়ে উঠে পড়ে এবং একটি স্ক্রাপ ঝুলতে থাকে। স্ক্রাপটি মাথায় পরে দরজা খুলে দেয় খোরশেদের মা। আমাদের কাছে ইরানের সমাজব্যবস্থা এবং ইরানের রঙ সামাজিক স্তরের বুনন স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ক্যামেরায় প্রকৃতির দৃশ্যরূপ লং শটের ব্যবহার নদীর ছোট ছোট ঢেউ, পাতার ঝিরিঝিরি মিউজিকের সিমফোনি তৈরি করে এবং স্টেডি শট মিউজিকের নীরবতা বুঝতে সাহায্য করে। এবং ক্লোজআপের ব্যবহার মানবের অন্তর জগতকে বুঝতে সাহায্য করে। খোরশেদ ও নাদিরার পুনঃপুন ক্লোজআপ দর্শককে এক বৃহৎ মিউজিক্যাল সিমফোনির জগতে উত্তীর্ণ করে এবং সমস্তু সিনেমাটি আমাদের কাছে কবিতা হয়ে ধরা দেয়।
লং শটে ব্রিজ পার হয়ে কাজের উদ্দেশ্যে রওনা করে খোরশেদ। দেখা যায় মেয়েরা রূটি, ফল নিয়ে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে বিক্রির উদ্দেশ্যে। হঠাৎ করে তাদের উপস্থিতি পণ্যায়নের যুগে পণ্য বিক্রির উদ্দেশ্যে মেয়েদের যেভাবে ব্যবহার করা হয় এবং তার রূপ-সাজ-সজ্জা– সব মিলে নারী নিজেই পণ্য হয়ে ওঠে; কিন্তু বৈপরীত্য তৈরি হয় তখন, যখন খোরশেদ তার ক্রেতা হয়; কারণ, খোরশেদ অন্ধ। একজন অন্ধ ক্রেতার কাছে নারীর বৈচিত্রপূর্ণ ডেকরেটিভ উপস্থাপন কোনো মানে তৈরি করে না। কিন্তু সংবেদনশীল খোরশেদ, যে মেয়ের কণ্ঠ ভালো, তার রূটি ক্রয় করে এবং স্পর্শ করে অনুভব করে ফল ও বিক্রেতাকে। নিজের সংবেদনশীলতায় অনুভূত হয়ে নিজেই সিদ্ধান্ত নেয় খোরশেদ।
এখানে আমরা যারা চোখে দেখি, আমাদের দন্যতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আমরা দেখার মাধ্যমে বিভ্রান্ত হই; নানাদিকে আমাদের সত্তা বিচ্যুত হয়। আমরা নিজেকে হারিয়ে ফেলি বাজারি সভ্যতায়। সংবেদনশীলতা বিলুপ্ত হয়ে যায়। নিজের সিদ্ধান্ত ও অনুভূতির ক্ষমতা হারিয়ে কেবল দাসে উপনীত হই।
আর খোরশেদ না দেখেও দেখে। ওর অনুভূতিগুলো সক্রিয় ও সংবেদনশীল। শেষদৃশ্যে সে তার নিজস্ব সত্তা নিয়ে হাজির হয়। ফকির লালন শাই যে রূপ গেয়েছিলেন :
‘শব্দ স্পর্শ রূপ রস গন্ধ
পঞ্চেতে হয় নিত্যানন্দ
যার অন্তরে সদানন্দ
নিরানন্দ জানে না সে…’
শেষদৃশ্যে এই পঞ্চ অনুভূতি নিয়ে খোরশেদ নিত্যানন্দের অনুভূতি লাভ করে।
এ রকম প্রতিটি ফ্রেমেই ক্যামেরার মুভমেন্ট অ্যাঙ্গেল বা অতিরিক্ত ক্যারিশমা দিয়ে কোনো ফ্রেম ধরেননি মোহসেন মাখমালবাফ। কেবল ক্যানভাসে যা দেখা যায়, সেই উপাদানগুলো বাছাইকৃত। এবং বাছাইকৃত উপাদান আমরা যা দেখি, তার গভীরে দেখার প্ররোচণা যোগায়। সিনেমা হয়ে ওঠে দৃশ্যকল্পের কবিতা।

এই সিনেমায় আলোর ব্যবহারও আলাদা করে চোখে পড়বার কিছু নেই । কেবল ন্যাচারাল আলোর ওপর ভর করেছেন নির্দেশক। এক্সট্রা আলো দিয়ে গিমিক তৈরির ব্যাপার তিনি স্বচিন্তায় উপেক্ষা করেছেন। কেবল প্রকৃতির আলো তিনি ধরবার চেষ্টা করেছেন। এই সিনেমার দৃশ্য পটভূমি খোরশেদের ঘরের অভ্যন্তর ও মিউজিক ওয়ার্কশপের অভ্যন্তর এবং কয়েকটি বহিরাঙ্গন দৃশ্য। আলোর কোনো ইফেকটিভ ব্যবহার এখানে লক্ষ করা যায় না; অর্থাৎ, আলো দিয়ে কোনো ইফেক্টিভ ইল্যুশন নির্দেশক সচেতনভাবেই করেননি। আলো যেহেতু মুড তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয়, আলো ব্যবহার না করে যে মুড তৈরি হয়, নির্দেশক সেই মুড তৈরি করেছেন। যে মুড প্রকৃতিতে বিরাজমান।
শেষদৃশ্যে আলোর ব্যবহার কেবল লক্ষ্য করা যায় এবং তা ইফেক্ট হিসেবে কার্যকরী হয়। বক্তব্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। তবে তা তৈরিকৃত কোনো আলো নয়।
…
কারখানায় সবাই হাতুরি
পাত্র দিয়ে মিউজিকের
সিমফোনি তৈরি
করে, আর
খোরশেদ
মিউজিক
আলোতে আপ্লুত হয়ে নৃত্যরত থাকে
…
শেষদৃশ্যে মা নৌকায় করে আসতে থাকে, তার হাতে একটি ওয়াল আয়না। আয়নায় সূর্যের আলো পড়ে নদীতে রিফলেকশন তৃতীয় মাত্রা তৈরি করে। আর খোরশেদ একটি কারখানায় ঢুকে পড়ে , ছাদ গলে সূর্যের আলোক রশ্মি খোরশেদকে ভিজিয়ে দেয়। কারখানায় সবাই হাতুরি পাত্র দিয়ে মিউজিকের সিমফোনি তৈরি করে, আর খোরশেদ মিউজিক আলোতে আপ্লুত হয়ে নৃত্যরত থাকে। এই দৃশ্যে আলোর ব্যবহার সিনেমার মূল বক্তব্য প্রকাশে ভীষণ কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছে।
এই সিনেমায় রঙের ব্যবহার লক্ষ্য করলে দেখা যায়, খুব চড়া রঙের প্রয়োগ আছে। অন্ধ খোরশেদের পয়েন্ট অব ভিউ থেকে জগত এত রঙিন-সুন্দর– ভাবতে খটকা লাগে; কিন্তু এখানেই মাখমালবাফের কৃতিত্ত্ব। পোশাকে এবং সমগ্র সিনেমায় লাল রঙ ডমিনেন্ট করে। ইরানি স্কার্ফের ছাপা রঙ ইরানকে রিপ্রেজেন্ট করে। চড়া রঙের ব্যবহার শিশুদেরও রিপ্রেজেন্ট করে এবং বিশেষ করে প্রকৃতির নানা রঙ, ফুল-ফল, গাছপালা এবং পাত্র-পাত্রীর পোশাকের রঙ– সব মিলে রঙের কাব্যময়তা উপস্থাপিত হয়। কেবলমাত্র বৃদ্ধ দোকান মালিকের এবং লোহার ওয়ার্কশপে কর্মরত ব্যক্তিদের পোশাকের রঙ ধুসর কালচেটে।

সাউন্ড বা মিউজিক এই সিনেমার মূল প্রতিপাদ্য। মোহসেন মাখমালবাফ বলেছেন, ছোটবালায় তার নানী সংগীতের শব্দ শুনলে তাকে কানে আঙুল দিতে বলতেন; কারণ সংগীত শুনলে গুণাহ হবে। এক সময় বিটোভেনের পঞ্চম সিমফোনি শুনে তিনি আপ্লুত হন। তিনি উপলব্ধি করেন, এই সংগীত কোনো প্রথাগত সংগীত নয়; বরং প্রথার বাইরে নিজেকে আবিষ্কারের উপায়। সে কারণে তিনি মূলত বিটোভেনের পঞ্চম সিমফোনির ওপর ভর করে এই সিনেমা তৈরি করেন। সমস্ত প্রকৃতির শব্দ বিটোভেনের মিউজিক হয়ে ধরা দেয় এবং মানব সত্তাকে এক মহাজগতে উপনীত করে। খোরশেদ– যে দেখতে পায় না, কিন্তু শোনার ওপর ভর করে সাধারণের চাইতে অধিক সংবেদনশীল। তাকে মিষ্ট শব্দ এবং ভালো মিউজিশিয়ানের মিউজিক আচ্ছন্ন করে রাখে; আবার বাজে শব্দ এবং নয়েস তাকে বিচ্যুত করে।
শুরুতেই দরজায় মালিকের কড়া নাড়ার শব্দ– যা বুর্জোয়ার রিপ্রেজেনটেনশন, সেই শব্দকে খোরশেদ বানিয়ে নিতে চায় বিটোভেনের সিমফোনি। বলতে থাকে, বু-বু-বুম, বু-বু-বুম… এবং সে তার যন্ত্রে টিউন তোলে এবং নাদিরা নাচতে থাকে। যেহেতু খোরশেদ শব্দ শুনে বিচ্যুত হয়, তাই সে বাসে যাওয়ার সময় কানে আঙুল দিয়ে রাখে। কিন্তু এক কান খুলে দিলে জলের নয়েস তার কানে আসে, আর ভেসে ওঠে তার মায়ের মাছ ধরারা দৃশ্য– যে এক সামাজিক পরিস্থিতির ক্রিড়ানক; অপর দিকে অন্য কান খুলে দিলে সে দোতরা বাজানোর মিউজিক শুনতে পায়। এবং বাস থেকে নেমে বাদককে খুঁজতে থাকে।
আবার, বাজারে নেমে খোরশেদ নানা রকম শব্দ/নয়েস দ্বারা বিচ্যুত হয়। একটি আধুনিক যন্ত্র থেকে ভেসে আসা সংগীতকে সে খুজতে থাকে, তার পিছু হাঁটতে থাকে; কিন্তু শেষ অবদি তা পরিত্যাগ করে লোকাল আধ্যাত্মিক গানে সে আকৃষ্ট হয়। এবং সুর ভেসে আসে :
‘The pilgrim and the dwelling are both with me
The wise man and the fool are with me
The master is me
The enchained man is also me.’
এই গানে জীবনের আধ্যাত্মিকতার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অর্কেস্ট্রা থেকে ফেরার পথে প্রচণ্ড বৃষ্টিতে যখন খোরশেদ ভিজে যায়, তার হাতে থাকে একটি সেতার। সেতারে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে যে মিউজিক তৈরি হয়, তা আমাদের বুঝতে সাহায্য করে মিউজিকের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক এবং নিজের মধ্যে ধী-স্থিত হলে নীরবতার মধ্য দিয়ে সমগ্র জগত আমাদের কাছে মিউজিক্যাল হয়ে ওঠে।
…
এমন
মিউজিক
বাজাও– যা
আমাকে অন্য কোথাও
নিয়ে যেতে সাহায্য করবে
…
শেষদৃশ্যে খোরশেদ ভবঘুরে মিউজিশিয়ানদের বলে, এমন মিউজিক বাজাও– যা আমাকে অন্য কোথাও নিয়ে যেতে সাহায্য করবে। তারা বাজায়। সমগ্র প্রকৃতি নেচে ওঠে। ঘোড়া জলে ছলাৎ-ছলাৎ শব্দে নাচতে থাকে খোরশেদ ও ঘোড়ার মতো উচ্চনিনাদে লাফাতে থাকে এবং লোহার কারখানায় পৌঁছে যায়। সেখানে পাত্রে হাতুরি দিয়ে শব্দ করতে বলে সবাইকে খোরশেদ। সবাই মিলে এক সিমফোনি তৈরি করে। বিটোভেনের পঞ্চম সিমফোনি বাজার চার নোট শেষ করে প্নচমে পৌঁছে যায় খোরশেদ। সে আলোর মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকে নিজের মধ্যে নিত্যানন্দ অনুভব করে। তার সব অবগুণ্ঠন খুলে যায়।

নির্দেশক শব্দ মিউজিক অ্যামবিয়ান্স নয়েস ও নীরবতা এইসব উপাদান খুব সচেতনভাবে যোজনা করেছেন। এবং দৃশ্য ও মিউজিক মিলে এপিক হয়ে ওঠে। প্রকৃতির বিরাজমান শব্দ নয়েস সবই যুক্ত করেছেন। সিনেমাটি হয়ে ওঠে নিওরিয়ালিস্টিক।
এই সিনেমায় ব্যবহৃত সমস্ত উপাদান একটি ফিল্মের আকার তৈরি করে। উপাদানগুলো কার্যকরী হয়ে ওঠে ফ্রেম, রঙ , আলো, সংলাপ, শব্দ– সবই মূল বক্তব্যে উপনীত হতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। গোবরা পোকার শব্দ এবং আয়নার পুনঃপুন ব্যবহার মোটিফ হয়ে কাজ করে। এই গোবরা পোকাটি সিনেমায় ফাংশনাল হয়ে ওঠে। সমাজের বুর্জোয়া শ্রেণির প্রতীক হয়ে গোবরা পোকা ধরা দেয়। খোরশেদ চায় সে মিষ্টি শব্দ ছড়াক। নাদিরার আয়নার ব্যবহার এবং আয়নাটি ভেঙে যাওয়া মোটিফ ও রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। ভেঙে যাওয়া দুই খণ্ড আয়নায় দুজনকে আলাদা আলাদা দেখা যায়; অর্থাৎ আমাদের প্রত্যেকের কাছে নিজস্ব সত্যকেই সত্য বলে জানি, আয়নায় কেবল নিজের চেহারাটা দেখা যায়– তাতে পৃথিবীর আরও অন্য সত্য অজানা থেকে যায়। ব্যক্তিস্বাতন্ত্রকে উপেক্ষা করে খোরশেদ যে খণ্ডে নাদিরার চেহারাটি দেখা যায়, সেই আয়নাটি নিয়ে নেয়; আর নাদিরা খোরশেদের এই প্রতীকায়নের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র উপেক্ষিত হয়ে সার্বজনীনতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
শেষদৃশ্যে আবার খোরশেদের মায়ের হাতে আয়না। এই আয়নার প্রতীকটি মোহসেন মাখমালবাফ নিয়েছেন সুফি দার্শনিক রুমির কাছ থেকে। আয়নার পুনঃপৌণিক ব্যবহার মোটিফ হয়ে ব্যবহার হয়েছে। এবং সিনেমায় কার্যকারী ভূমিকা পালন করেছে। আর স্কার্ফ অবজেক্টটি এই সিনেমায় রিপিটিটিভ ব্যবহারে মোটিফের ভূমিকা পালন করে এবং অবজেক্টটি ধর্ম এবং ইসলামের নামে যে অপরাজনীতি প্রচলিত রয়েছে, সেই রাজনীতির দিকে দর্শককে চিন্তায় লিপ্ত হতে নির্দেশ করে।
…
খোরশেদের অন্ধত্ব আমাদের
প্রথাগত চিন্তার সঙ্গে
পার্থক্য নির্মাণ
করে
…
পার্থক্য এবং বৈচিত্র যদি আমরা লক্ষ্য করি, দেখা যায়, খোরশেদের অন্ধত্ব আমাদের প্রথাগত চিন্তার সঙ্গে পার্থক্য নির্মাণ করে। খোরশেদের সংবেদনশীলতা সাধারণের মতো নয়। আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয় খোলা থেকেও বন্ধ আছে, পক্ষান্তরে খোরশেদ অন্ধ হয়েও আমাদের চাইতে অধিক সংবেদনশীল। বাসের মধ্যে দুই স্কুলছাত্রী পড়া মুখস্ত করতে পারে না। খোরশেদ তাদের বলে, চোখ বন্ধ করে বলো, মুখস্ত হয়ে যাবে। এবং না দেখলে আমাদের মন স্থির থাকে।
মার্কেটে যখন খোরশেদ হারিয়ে যায়, তখন আধুনিক যন্ত্র থেকে ভেসে আসা মিউজিকে সে ভেসে যায়। যে মিউজিক কেবল আমাদের বিনোদন তৈরি করে, অথবা নয়েস। কিন্তু বিপরীতে ভেসে আসে সুফি মিস্টিক মিউজিক– যা খোরশেদকে আপ্লুত করে। এবং সেই মিউজিকের মধ্যে খোরশেদ নীরবতা শুনতে পায়।
এভাবে সমাজের সঙ্গতিগুলোর অসঙ্গতি প্রকাশ করেন আর অসঙ্গতির মধ্য থেকে সঙ্গতি খুঁজে পান নির্দেশক। দুটি চরিত্র নাদিরা ও খোরশেদ ভিন্ন রকম। নাদিরা ভীষণ সুন্দর, কিন্তু সে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে ভয় পায়; নিজের সত্তা অনুযায়ী চলতে পারে না। কিন্তু খোরশেদ নিজ সত্তার মাধ্যমে পরিচালিত হয়।
আমরা যদি সিনেমার ইউনিটি বা ডিসইউনিটি বুঝতে চাই, তাহলে শেষদৃশ্যটি বিবেচনায় আনা যেতে পারে।

প্রথাগত জীবনে যে ইউনিটি বিরাজমান, তাকেই অস্বীকার করেছেন মাখমালবাফ। আমাদের যাপিত জীবনে যাকে আমরা ইউনিটি বলে ভাবছি, তা-ই আসলে ডিসইউনিটি। আর সেখান থেকে উড়াল দিয়ে ডিসইউনিটির মধ্যে স্থাপিত হলেই হয় ইউনিটি। যেখানে যাপিত জীবনের ইউনিটি থেকে প্রস্থান করে মহাজগতের ইউনিটির মধ্যে আমরা উপনীত হই। এই সিনেমায় দর্শক আসা করে খোরশেদ মার কাছে ফিরে গেলেই পরিণতি হতো সুন্দর; কিন্তু খোরশেদ সমস্তকিছুকে উপেক্ষা করে সংগীত-শব্দে আপ্লুত হয়। তার মহামুক্তি ঘটে।
…
বর্তমানকে
বন্ধনমুক্ত করে
দেয় খোরশেদ, তারপর
একে চিরায়ত সময়ের অংশ করে নেয়
…
এই দৃশ্যটি রবীন্দ্রনাথের চণ্ডালিকা নাটকের শেষদৃশ্যের মতো। চণ্ডালিকায় প্রকৃতি সমস্ত অবগুণ্ঠণ খুলে মন্দিরে নৃত্য করতে থাকে আনন্দকে পাওয়ার আশায়। প্রকৃতির সেই নৃত্য কোনো ট্রেডিশনাল নৃত্য নয়। সমস্ত ফর্মকে ভেঙে সাবকনশাস বডির আন-কনশাস উচ্চারণ। সময়কে অতিক্রম করে মহাজাগতিক অংশ হয়ে ওঠে প্রকৃতি। সমাজ, রাজনীতির যে নিয়ম বা রূল হাজির আছে, সমস্তকিছুর অবগুণ্ঠন খুলে পরম-আনন্দের দেখা পায় প্রকৃতি। এখানেও খোরশেদ সাবকন্সাস বডিতে উপলব্ধি করে মিউজিকের ধ্বনি। বর্তমানকে বন্ধনমুক্ত করে দেয় খোরশেদ, তারপর একে চিরায়ত সময়ের অংশ করে নেয়। খোরশেদের কাছে অতীত-ভবিষ্যৎ নাই হয়ে গিয়ে কেবল বর্তমানে অবগাহন হয়। আর এই অবিরত প্রবাহে মহাজগতের সময়হীন ও শাশ্বত শৃঙ্খলা ধরা পড়ে।
খোরশেদ সামাজিক দেহের মধ্যে জড়িয়ে থাকা অবদমনকে ঝেড়ে ফেলতে চায়; অব্যক্ততা সন্ধানী দৈহিক ইমেজ স্পষ্ট হয়। সুফি সদর উদ্দিন আহমদ চিশতী অখণ্ড কোরআনদর্শনে উল্লেখ করেছেন, জান্নাতে অবস্থিত মানবদেহ হলো ‘সিদরাত’। যা আমাদের নিত্যকার সামাজিক দেহ। আর লা মোকামে স্থিত মানবদেহ হলো ‘তুয়াগাছ’। যে দেহ সংস্কারমুক্ত। সমগ্র সিনেমার মধ্যে অভিনেতাদের দেহভঙ্গি এবং চিন্তাভঙ্গি সেই সিদরাতি দেহ অতিক্রম করার বাসনা স্পষ্ট করে, এমনকি পরিশেষে তুয়াগাছরূপী দেহের সন্ধান করে। খোরশেদকে মনে হয় ‘কাহাফের’ যুবক। কাহাফে থাকা মানে হলো আপন দেহের মধ্যে সমাধিস্থ থাকা। সমগ্র সিনেমায় খোরশেদের উপস্থিতি আমাদের বলে দেয়, সে আপন দেহের মধ্যে সমাধিস্থ হয়ে আপন সত্তার সন্ধানে রত।

কার্ল মার্কস বলেন, ‘মানবিক চৈতন্য, প্রবৃত্তি এবং মনন সবসময় অর্থনৈতিক ও সামাজিক উপাদান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে এবং এই ক্রিয়া-প্রক্রিয়ায় মানুষের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।’ সেভাবেই চলছিল খোরশেদ। শেষদৃশ্যে দেখা যায় সে নিজেই নিজের মুক্তির সোপান নির্মণ করেছে।
মার্কসকে অস্বীকার করে খোরশেদ আমাদের এক নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখায়। যে পৃথিবীতে আমিই কেবল সত্য। আর সত্তা দাসত্ত্বমুক্ত।
যন্ত্র থেকে উচ্চারিত ছন্দে নৃত্যরত খোরশেদ নিজের ভেতরকার বৌদ্ধসত্তা দর্শন করে। দেহ ও মনকে একসূত্রে গ্রথিত করে সে। সুফি সদর উদ্দিন চিশতীর কোরআন দর্শন অনুযায়ী যাকে বলা যায় তৌহিদ লাভ করা; তৌহিদ মানে একাঙ্গীভূতকরণ। সৃষ্টিকর্তা যে বাতেনরূপে মানুষের মধ্যে অবস্থিত, সেই বাতেনের দেখা পায় খোরশেদ।
এই সিনেমায় ১৯৮০ সালের ইরানি প্রেক্ষাপট চিত্রায়ন হয়– যখন মুসলিম বিপ্লব সাধিত হয়েছে। রক্ষণশীল মুসলিম শাসন এবং ইসলামি আধ্যাত্মিকতা– দুই-ই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এটি তাজিকিস্তানে তৈরি করা হয়েছে। সিনেমায় নাদিরার স্কার্ফ ছাড়া উপস্থিতি এবং তার নৃত্যরত অবস্থার কারণে সিনেমাটিকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল ইরানি সরকার। তৎকালে বুর্জোয়া সমাজের উত্থান সমাজ, রাজনীতি ও আধ্যাত্মিকতা এই সিনেমার পাঠ।
শেষ হয় দুটি বিষয় দিয়ে; এক– বাড়ি থেকে বের করে দেয়া মা ছেলেকে ডাকে, খোরশেদ…। তার সঙ্গে থাকা একটি দেয়ালের আয়না । নদীতে নৌকায় আসতে আসতে সেই আয়না রিফ্লেক্ট হতে থাকে– যা মানবের আধ্যাত্মিকতা প্রকাশ করে এবং মায়ের ভালবাসার সর্বজনীন মানবিকতা স্পষ্ট করে তোলে।
নদী ও নৌকায় ভেসে আসা মা যেন বিশ্ব প্রকৃতির প্রতিকৃতি।
অন্যদিকে, খোরশেদ মানবিকতার অন্য আধ্যাত্মিকতাকে প্রকাশ করে। বন্ধন, দায়িত্ব থেকে মুক্ত এক মানুষ সে। খোরশেদের অন্ধত্ব তাকে সংবেদনশীল করে তোলে। তাকে নিজের মধ্যে স্থিত হতে এবং মহাজগতিক নীরবতা অনুভব করতে সাহায্য করে।
খোরশেদের জীবন উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে নানা প্রতীকায়নে আমাদের সামাজিক জারগণগুলো স্পষ্ট করে দেন এবং এক মুক্তির ক্যানভাস নির্মাণ করেন মোহসেন মাখমালবাফ। এভাবে তিনি ইরানি সিনেমার এক নতুন ভাষা আবিষ্কার করেন। নিওরিয়ালিস্ট ফিল্মের পথে যাত্রা করেন।
এই সিনেমা দেখে আমার উপলব্ধি পল ভালেরির একটি কবিতার পঙক্তি উচ্চারণের মধ্য দিয়ে শেষ করছি :
‘ততক্ষণ তৃষ্ণাস্ফীত আমি,
না যোগায় সত্তা যতক্ষণ।’
::: আলোচনা বেশ ভালো লাগলো। আয়নার উপস্থাপনাকে লাঁকানিয়ান কনসেপ্ট থেকেও দেখা যায়, কি বলেন?