লিখেছেন। দেবদীপ রায়

ম্যান উইথ অ্যা মুভি ক্যামেরা
Chelovek s kino-apparatom
স্ক্রিপ্টরাইটার ও ফিল্মমেকার । জিগা ভের্তভ
সিনেমাটোগ্রাফার । মিখাইল কাফমান
এডিটর । এলিজাভেতা সভিলোভা
প্রোডাকশন কোম্পানি । অল-ইউক্রেনিয়ান ফটো সিনেমা অ্যাডমিনিস্ট্রেশন
ধরন । ডকুমেন্টারি
ভাষা । নির্বাক
রানিংটাইম । ৬৮ মিনিট
দেশ । সোভিয়েত ইউনিয়ন
রিলিজ । ৮ জানুয়ারি ১৯২৯
ম্যান উইথ অ্যা মুভি ক্যামেরা ভের্তভের বানানো একটা পরীক্ষামূলক নির্বাক তথ্যচিত্র। এবার সিনেমা শুরু হচ্ছে এই টেক্সট দিয়ে– ‘এই ছবিতে কোনো গল্প নেই, কোনো অভিনেতা কিংবা ইন্টারটাইটেল নেই।’ ব্যাপারটা ঠিক কী? নির্বাক ছবি, অথচ ইন্টারটাইটেল নেই; তবে প্রসঙ্গ আন্দাজ করা যাবে কী করে? কোনো গল্প/চিত্রনাট্য নেই, তাহলে হবেটা কী? অভিনেতা নেই- সে না হয় মানা গেল!
এত ধোঁয়াশা মেটানোর একটাই উপায়– ইতিহাসের রাস্তা দিয়ে ঘুরে আসা। না-হলে ঠিক ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে না।
সাল ১৯১৭, রাশিয়া। রুশ বিপ্লব হয়ে গেল। বলশেভিক ক্ষমতায় এলো। এসেই মহামান্য লেনিনের মনে হলো, সিনেমার মাধ্যমে মানুষের কাছে অনেক তথ্য বা ভাবাবেগ পৌঁছে দেওয়া যায় খুব সহজে। অতএব, জোর কদমে চলল চিন্তা, ভাবনা, পরিকল্পনা। বানিয়ে ফেললেন, ‘অল সোভিয়েত স্টেট ইউনিভার্সিটি অব সিনেমাটোগ্রাফি’– যেখানে সিনেমা নিয়ে চলল পড়াশোনা, আলাপ-আলোচনা, আরও সরকারি অনেক প্রোগ্রাম। দেশের সিনেমার গুণি পরিচালকদের ডাক পড়ল : তোমরা এসে সরকারের টাকায়, সরকারের অনুমোদনে পুষ্ট স্টুডিওতে কাজ করে সরকারের গুনগান শুরু করো, এবং তার সঙ্গে নিজেদের কাজকর্মটাও চালানো সম্ভব হবে। অতএব একদল তুখোড় ফিল্মমেকার চলে এলেন। যারা সিনেমার ইতিহাসে উজ্জ্বল নক্ষত্র; যেমন– লেভ কুলেশভ, ভসেভলোদ পুদিভকিন, আলেক্সান্দর দভঝেঙ্কো, সার্জেই আইজেনস্টেইন, এস্ফির শুব প্রমুখ। তারা সরকারি সাহায্যে বানাতে থাকলেন পৃথিবী কাঁপানো ছবি। রাশিয়া, ইতালি, ব্রিটেন ও আমেরিকার তখন তুল্যমূল্য পারফরম্যান্স– কাকে ছেড়ে কাকে দেখা যায়!

ফিল্মমেকার । জিগা ভের্তভ
এবার চলে আসা যাক একটা বেবাগা ছেলের কথায়। অনেকটা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো ব্যাপার আরকি! যদিও সাধু উদ্দেশ্যে! ভের্তভ পোল্যান্ড [তৎকালীন রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত] শহরে বেড়ে উঠলেন। একটু বড় হয়ে চলে এলেন রাশিয়ার কেন্দ্রবিন্দুতে। নিউজরিল এডিটর হিসেবে কাজ শুরু করলেন। তারপর ওই সরকারি সিনেমা গোষ্ঠীতেই নাম লেখালেন পরিচালক হিসেবে। তৈরি করলেন কিছু ভালো সিনেমা; তৈরি করলেন পৃথিবীর প্রথম অ্যানিমেটেড ছবি– সোভিয়েত টয়স [১৯২৪]। কিন্তু মন থেকে কিছুতেই অনেক কিছু মেনে নিতে পারলেন না, সময় যত এগিয়ে চলল। ওনার লেখা ম্যানিফেস্টো থেকে বোঝা যাবে, তিনি ঠিক কি চাইছেন। তার স্বপ্নের প্রজেক্ট হবে সেটাই, যেটা নাকি ক্যামেরাম্যান ছাড়াই তৈরি করা যাবে। মানে, যেখানে দেখিয়ে দেওয়ার লোক থাকবে না।
…
কোনোভাবে মিথ্যা কিছু
নিয়ে দেখানো যাবে না;
অন্যভাবে বলতে গেলে,
সরকারের তোষামোদি
করা হবে
না
…
তৎকালীন পরিচালকদের ছবিগুলোর জন্য বললেন, ‘দ্য সেম ওল্ড ক্র্যাপ টিন্টেড রেড’; অর্থাৎ নতুন কিছু হচ্ছে না। তৎকালীন যে ছবির ধাঁচটা চলছিল, সেটাকে ‘আর্ট অব বুর্জোয়া’ নামে দেগে বসলেন। কোথাও একটা নন্দনতত্ত্বের পার্থক্য হচ্ছিল। ঠিক সেইসময় একদল ডকুমেন্টারি ছবি করিয়েদের দল তৈরি হলো, যার নাম– ‘কিনোকস’ [kinoks], অর্থাৎ ‘সিনেমার চোখ’। এদের মূল মন্ত্র– যা দেখানো হবে, তা যেন সমাজের একদম সত্যি কথা হয়; কোনোভাবে মিথ্যা কিছু নিয়ে দেখানো যাবে না; অন্যভাবে বলতে গেলে, সরকারের তোষামোদি করা হবে না। এই দলেই ঢুকলেন তিনি। এই আদর্শেরই এক প্রচেষ্টা, ম্যান উইথ অ্যা মুভি ক্যামেরা।

সিনেমাটা নিয়ে কথা হোক এবার। চার বছর ধরে ছবি তোলার কাজ চলল রাশিয়ার তিন শহরে- মস্কো, ওদেশা আর কিয়েভ। সিনেমাটোগ্রাফার মিখাইল কাফমান [ভের্তভের ভাই]। ছবির একমাত্র চরিত্র ক্যামেরা, মাঝে মাঝে ক্যামেরাম্যানকে কিছু কারসাজি করতে দেখা যায় । ফলে যদি লিভিং কাস্ট কাউকে বলা যায়, তাহলে সিনেম্যাটোগ্রাফার।ভাবা যায়!
এই সিনেমাটা এক ধরনের ‘সিটি সিমফোনি’। অর্থাৎ, একটা শহরকে দিন থেকে রাত অবধি তুলে ধরা হবে, সঙ্গে চলবে মিউজিক্যাল অর্কেস্ট্রা। এর আগে প্যারিস, ম্যানহাটন আর বার্লিন নিয়ে এইরকম ছবি হয়ে গেছে। তবুও এই ছবি ক্লাসিক হয়ে থাকবে। কেন?
ছবিটি আসলে শুধুই ছবি নয়; ছবি তৈরি করা নিয়ে ছবি- ‘ফিল্ম অন মেকিং অব অ্যা ফিল্ম’। সকাল হলে শহরের বিভিন্ন জায়গায় আমরা দেখতে থাকি বিভিন্ন কর্মকাণ্ড। দোকান পাঠ খোলা হচ্ছে, স্কুল খুলছে; এক কথায়, দিন শুরু হচ্ছে। হঠাৎ ভিডিও ফ্রিজ হয়ে গেল। কী হলো? না, যে এডিটিং করছেন [ভের্তভের স্ত্রী এলিজাভেতা সভিলোভা], তার কিছু ফিল্ম কাটার প্রয়োজন পড়েছে, মানে তিনি তখন ফিল্ম এডিট করছেন। উনি কিছু কাটছাঁট করলেন, তারপর ফিল্ম আবার রোল করানো হলো। আমরা আবার শহর দেখা শুরু করি। মানে, ছবি কী করে তৈরি হচ্ছে, এটাও ছবির একটা অংশ হয়ে উঠতে হবে।
…
ক্রাফট
যেন হয়
পুরোপুরি সিনেমার রাজ্য
…
আসলে ভের্তভের মূল লক্ষ্য ছিল ট্রেডিশনাল স্টেজ প্লে থেকে উঠে এসে এমন একটা কিছু করে দেখাতে হবে, যা পুরোপুরি সিনেমার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। ক্রাফট যেন হয় পুরোপুরি সিনেমার রাজ্য।

ছবি নিজের আন্দাজে শহরের নানাবিধ দিক দেখাতে শুরু করল। এর মধ্যে কিছু জায়গা এমন :
–এক শটে একটা বাচ্চার জন্মের দৃশ্য, ইন্টারকাট– একটা শব যাত্রার ছবি।
–এক শটে একজন মহিলা পার্লারে বসে হেয়ার স্পা নিচ্ছেন, ইন্টারকাটে অন্য একজন মহিলা ফ্যাক্টরিতে দৈহিক পরিশ্রমে রত।
–প্রথমে দুজন একটা অফিসে ম্যারিজ সার্টিফিকেট নিতে এসেছেন, তার পরের শটে অন্য দুজন ডিভোর্স ফাইল করতে এসেছেন।
এই রকম কিছু বিপরীত ভাবাবেগের ঘটনা জুড়তে থাকেন ভের্তভ। সামাজিক অসাম্যগুলো তিনি তুলে ধরতে থাকেন। শহরের উজ্জ্বল দিকগুলো যেমন উঠে আসছে, ঠিক তেমনি বিশ্রী দিকগুলোও উঠে আসছে। ছবি আর ছবি থাকছে না; মানুষের চোখ হয়ে উঠছে, যেমনটা ভের্তভ চান।
…
নাক
উঁচু ক্রিটিকরা
বললেন, ‘ডিসঅরিয়েন্টেশন!’
জবাব দিলেন ভের্তভ, ‘রেভেলেশন!’
…
এবার এডিটিংয়ের কিছু কৌশল নিয়ে কথা বলা যাক। এই ব্যাপারগুলো ডিজিটাল এডিটিংয়ের যুগে খুব সহজসাধ্য হলেও গত শতকের কুড়ির দশকে বেশ নতুন এবং কষ্টসাধ্য ভাবনা ছিল। উনি আইজেনস্টেইনের ‘মন্তাজ’ ফর্মটাকে ব্যবহার করলেন। সঙ্গে কিছু স্টাইলের নতুন আইডিয়া দেখালেন; যেমন– ডিজলভ, স্লো মোশন, স্টপ মোশন, ডাবল এক্সপোজার ইত্যাদি। এগুলো ফার্স্ট-পেসড মিউজিক্যাল অর্কেস্ট্রার সঙ্গে এমনভাবে ব্যবহার করলেন, যেটা আগে দেখা যায়নি। নাক উঁচু ক্রিটিকরা বললেন, ‘ডিসঅরিয়েন্টেশন!’ জবাব দিলেন ভের্তভ, ‘রেভেলেশন!’

যে এডিটিংয়ের ধারণা উঠে এলো, তা থেকে পৃথিবীর বহু পরিচালক ভাবনার দিক থেকে পুষ্ট হলেন। তারা কাজে লাগালেন। কিন্তু ভের্তভকে আস্তে আস্তে সরকার পরিত্যাগ করল। সিনেমা বানানোর পথে তাকে বহু বেগ পেতে হলো। তবু আর যাইহোক, সত্যিটা উঠে এলো। ফিল্মমেকিংয়ের অনেক প্রথা ভাঙলেন।
আমরা বহু ভালো ছবি পেয়েছি, আরও হয়তো পাব। কিন্তু এই আস্পর্ধাগুলো পৃথিবী আর পাবে কি না, সেটাই দেখার!