লিখেছেন । অনামিকা বন্দ্যোপাধ্যায়
ইরানের সিনেমা আন্তর্জাতিক বলয়ে ঢুকে পড়তে থাকবে এই সময় থেকেই।
তখনও শাহ পাহলভি’র রাজত্ব। ষাটের দশক।
বিশ্ব-সিনেমার পরীক্ষণমূলক শিল্পের ছাপ তার গায়ে এসে লাগছে। ইরান দেশের নতুন সিনেমায়। হলিউডি নন্দনের ছায়া ছেড়ে ইরানের সিনেমা ক্রমে হয়ে উঠছে ব্যক্তি সিগনেচারের মতো বিশিষ্ট।
আমরা বলছি ইরানের সিনেমার শিল্প-ভাষার কথা। নারীবাদের বয়ানে।
ইরানের প্রথম আর্ট-হাউস সিনেমার প্রতিনিধি হিসেবে সিনেমা বিশেষজ্ঞরা সাধারণত চিহ্নিত করে থাকেন ১৯৬৭ সালে নির্মিত দারিউস মেহরজুই-এর দ্য কাউ ছবিটিকে। এর পর আশির দশক। এক ঝাঁক চলচ্চিত্রী এসে যাবেন। ক্রমে আশি থেকে নব্বইয়ের দশকে আসবেন আব্বাস কিয়ারোস্তামি, আমির নাদেরি, মোহসেন মাখমালবাফ, বারহাম বেইজাই, মাজিদ মাজিদি, জাফর পানাহি, জালিলি, তাহমিনা মিলানি, সামিরা মাখমালবাফ।
আমাদের নারীবাদের পাঠ পড়াতে ইরানের সিনেমায় উপস্থিত হবেন আরও শিল্পীরা– বানি এতেমাদ, শিরিন নেশাত, মারজানে সাতরাপি-রা। সমাজের নারী-বিরোধী ভাষ্যের বিরুদ্ধে নারীরা তার কাউন্টার লিখবেন তাদের দর্শন-ক্ষেত্র থেকে, এই স্বাভাবিক। ফলে নারীরা কিভাবে চলচ্চিত্রের নির্মাণ করছেন এই বিষয়টি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে কতজন নারী চলচ্চিত্রকার চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন এই পরিসংখ্যানের কাছে। আবারও। যেহেতু আমরা চিত্রভাষার সন্ধানে আছি।

কাস্ট । নিকি কারিমি
ফিল্মমেকার । তাহমিনা মিলানি
আর যদি মূলস্রোত ও আর্ট-হাউস সিনেমার গণ্ডি না টানা হয়, তবে দেখব– এ সময়ে ইরানে চলচিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে নারী চলচ্চিত্রীদের সবচে পরিচিত মুখ হলেন– তাহমিনা মিলানি, নিকি কারিমি-রা। এদের ছবি বাণিজ্যসফল। নানা বিদেশি চলচিত্র উৎসবেও এদের ছবি দেখার সুযোগ মেলে। তাহমিনা ২০০১-এ গ্রেফতার হয়েছিলেন ইসলামে নারীর অবস্থানটিকে সমালোচনা করার দায়ে। খ্যাতি ও বড় বাজেটের ছবির লগ্নি পেতে থাকায় তাহমিনা মিলানি, নিকি কারিমি এরা এক বক্স-অফিস সফল ঘরানার বার্তা-বাহিকা হয়ে উঠলেন ক্রমে। নারীর অধিকার অর্জনের বিষয়গুলি আখ্যানেই নিহিত থাকল শুধু। চিত্রভাষায় আগ্রহ হারালেন। ছবিগুলি হয়ে উঠল বিপুল বাণিজ্য-সফল বিগ বাজেট মেলোড্রামা।
…
বিষয়গতভাবে তিনিও কোথাও গিয়ে
ধর্ম ও তার মানস সন্তান
পুরুষবাদকে
অতিক্রম
করে
উঠতে পারছেন না
…
এর কিঞ্চিত অপর মুদ্রারও একটি মুখ আছে। স্বল্প বাজেটে আর্ট-হাউসের অন্দরে কাজ করছেন এমন ইরানি নারী পরিচালক আছেন, তারাও নারীর অধিকার চান। নারীর অধিকার অর্জনের আখ্যান বলতে চান। সিনেমার ভাষা নিয়ে পরীক্ষাও করছেন। তবে ধর্মের ছায়ায় থেকে। নারীর অধিকারের আখ্যানগুলিতে ঈশ্বরের হাতের মঙ্গলকাব্য খুঁজছেন। এমন এক শিল্পী– শিরিন নেশাত। ইরানে জন্ম। নিউইয়র্কের বাসিন্দা। অসামান্য তার চিত্র-ভাষা। শৈলী। কিন্তু বিষয়গতভাবে তিনিও কোথাও গিয়ে ধর্ম ও তার মানস সন্তান পুরুষবাদকে অতিক্রম করে উঠতে পারছেন না বলেই আমার প্রত্যয়।

ফিল্মমেকার । শিরিন নেশাত
ইসলামিক বিপ্লবের দিনগুলির সময়, খোমেইনিকে ফিরিয়ে আনা নিয়ে যখন আন্দোলন চলছে, তখন বিপুলসংখ্যক নারী তাতে সামিল ছিলেন। তারা রাস্তায় নেমে বিপ্লব করেছেন। পাবলিক মিটিং করেছেন। শাহের পরিবারের মতো আমেরিকান ঢঙের সাজপোশাক তাদের ছিল না ঠিকই, কিন্তু পুরোপুরি পর্দার আড়ালের মানুষও তারা ছিলেন না। মাথা ঢেকে রাস্তায় নেমেছিলেন। কিন্তু বিশ্বাস ছিল, অন্তত শুধু মাথা ঢেকেই রাস্তায় বেরতে পারবেন। ধর্মের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে ঈশ্বর তাদের নারীদের অধিকার মঞ্জুর করবেন। কিন্তু খোমেইনির শাসন চালু হলে পাল্টে গেল সব। নারীদের ঢুকে পড়তে হলো অন্দরমহলে। মাথা ঢাকার সাথে ঢাকা পড়ল নারীদের বাহিরানা। সাজের সাথে সাথে কাজের স্বাধীনতাও বিনষ্ট হলো।
…
নারীকে
ঢেকে রাখার
পর্দা ও সিনেমার প্রেক্ষাগৃহের
পর্দা কিভাবে একযোগে নির্মাণ
করলো নতুন এক প্রকার চলচ্চিত্রের ভাষা
…
১৯৮২ সাল থেকে চালু হলো নিয়ম। রাষ্ট্র চলবে ইসলামি নিয়ম মতে। সেইমতো নারীরাও।
শরিয়া মতে বেঁধে ফেলা হলো নারীর রেপ্রেসেন্টেশনকে। পর্দায়। ঠিক এখানেই আমি প্লুরালিস্টিক মেটাফরের আঙ্গিকে ‘পর্দার’ রাজনীতিকে পড়তে চাইব। দেখতে চাইব– নারীকে ঢেকে রাখার পর্দা ও সিনেমার প্রেক্ষাগৃহের পর্দা কিভাবে একযোগে নির্মাণ করলো নতুন এক প্রকার চলচ্চিত্রের ভাষা। সে ভাষাই নির্দিষ্ট করবে এবার নারীর চলচ্চিত্রায়ন। পরিবেশন। রেপ্রেসেন্টেশন।
এই রেপ্রেসেন্টেশনকে কনট্রোল করবে রাষ্ট্র ।
নারীর ভব্যতা ও আচরণের ইসলামি কোডগুলিকে গুঁজে দেওয়া হচ্ছে ছবির পর্দায়। যার পোশাকি নাম– মডেস্টি। পোশাক, বাহির ও অন্দরের ব্যবহার, কেমন করে করতে হবে অভিনয়– এই সবই লেখা হচ্ছে শরিয়া আইনের মতে। যেমন :
নারীর মুখের ও শরীরের ক্লোজআপ দেখানো যাবে না। দেখালে– ‘কাট’। অর্থাৎ থামিয়ে দেওয়া হবে। কোনো যৌন দৃশ্য তো ছাড়, যৌন আবেদন নিয়ে পর্দায় নারী পুরুষের পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকা যাবে না। তবে কিভাবে হবে চরিত্রায়ন, কেমন করে ক্যামেরা জারি রাখবে তার চলন। কোথায় এডিটিং এসে থামিয়ে দেবে শট… এই সবই নব নির্মিত হতে থাকলো।
…
নারীকে
রক্ষা– একটি প্রথম
সারির পুরুষতান্ত্রিক ভাবনা
…
ফলে পাল্টালো ছবির ভাষা, দৃশ্যায়নের ভাষা। নারীদের সম্মান ও নারীর গুণ রক্ষার্থে। নারীকে রক্ষা– একটি প্রথম সারির পুরুষতান্ত্রিক ভাবনা। নারীর গুণ রক্ষা না করলে তা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। মূল্যহীন হতে যেতে পারে। নারীর গুণ ভোগ্য। নারী– পুরুষের সম্পদ। মোটামুটি অর্থে নারী ক্লীব, চেতনাহীন; পুরুষ না বাঁচালে নারীরা নিজেদের রক্ষা করতে অক্ষম। এ কথা ধর্মভেদে যে কোনো পুরুষতন্ত্রের আহ্বান।
সিনেমার জন্মের অব্যবহিত পর থেকে এতদিন মূলস্রোত বিশ্ব-সিনেমায় নারীকে, সিনেমার পর্দায় যেভাবে বস্তুকরণ করা হতো, তা নিয়ন্ত্রণ করত ক্যাপিটালিস্ট উৎপাদনের ধারণা। বস্তুবাদের ধারণা। যাকে লরা মালভি [Laura Mulvey] তার যুগান্তকারী প্রবন্ধ’তে মারহাব্বা বিশ্লেষণ করেছিলেন। সত্তরের জমানায়। নারীর ও নারী শরীরের বস্তুকরণ এবং হলিউডের দর্শক মননকে তিনি মেইল গেজের ধারণায় সংযুক্তির একটা বিশ্লেষণ করে দেখিয়ে ছিলেন মেইল গেজ কী, তা কীভাবে কাজ করে।

ফিল্মমেকার । আব্বাস কিয়ারোস্তামি
পরে অবশ্য তিনি অনেকের হাতে খণ্ডিত হন, কিন্তু সে অনেক পরের নারীবাদের ধারণা, আমরা অতটা এগিয়ে যাব না। আমরা থাকব বিপ্লব পরবর্তী ইরান দেশে। আশির দশকে। সেখানে তখন ইসলামি মতে নারীর শরীরের প্রদর্শন ও অবজেক্টিফিকেশনের বিরুদ্ধে চালু হলো ফতোয়া। যা এই পর্যন্ত পড়ে মনে হতে পারে নারীবাদের পক্ষে ঘটল। কিন্তু আমরা নিশ্চিতভাবেই জানব যে, আসলে তা ঘটবে না। তা আসলে ঘটবে পুরুষবাদের নিয়ম মেনেই। নারীকে সম্পত্তি মনে করে আসবাবের মতো ঢেকে রাখা হবে। তার ব্যক্তিসত্তা হরণ করা হবে। তার ব্যবহারিক বিধিগুলি পুরুষ কর্তৃক নির্দিষ্ট করে দেওয়া হবে।
‘নাইদার ইস্ট নর ওয়েস্ট’– আয়াতোল্লা খোমেইনির জমানায় এই ছিল চালু রাজনীতিক স্লোগান। আমেরিকার বস্তুবাদ না, সোভিয়েতের কম্যুনিজম না, ইসলামের মত-ই তৃতীয় পরিসরের মত ইরানের মজ্জায় ঢুকছে তখন।
পশ্চিমী নারীবাদ যদি হলিউডের দফরফা করে অবজেক্টিফকেশনের মর্মে, নারীর সৌন্দর্য ও আকর্ষণীয়তার বাজার-ভিত্তিক পুরষতান্ত্রিক স্টিরিওটাইপের কারণে, তবে শরম ও নেজাবত-ই হলো তার উল্টোপিঠে দাঁড়িয়ে থাকা ইরানি সিনেমায় নারীর অবস্থানের পরাকাষ্ঠা।
এখানে স্পেস ও স্থানিক রাজনীতিকে খণ্ডন করা হলো।
তাই এখানে হিজাব বা নারীর মুখের পর্দার বাহিরানা ও অন্দরানা এবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে– প্রাইভেট ও পাবলিক-এর ডিসকোর্সে।

আমি সংক্ষেপে বলতে চাইব– বাধ্যতামূলক পর্দা-প্রথা কীভাবে এই স্পেস ও স্পেসগুলিকে খণ্ডন করছে, সে ব্যাপারে। যেমন পাবলিক স্পেস। সিনেমার প্রেক্ষাগৃহ এবং চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর স্পেসগুলি হলো পাবলিক স্পেস। শরিয়া মতে পর্দা প্রথা নারীকে আড়াল করবার অর্থে। [আমি মোট দুটি চলচ্চিত্রকে বেছে নিচ্ছি আমার বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করতে।]
ফলে নতুন নন্দন তত্বের জন্ম ও খণ্ডন হলো। অর্থাৎ এস্থেটিকস খানিক এলোমেলো হলো। লঙ-শট, ক্লোজআপের খেলায়। নির্মাণ ও খণ্ডনের খেলায়।
শরিয়া নিয়ম মানতে লঙ-শট এলো। ক্লোজআপ খণ্ডিত হলো। কারণ নারীকে দেখতে হবে নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে। আইন না মানলে ভয় দেখানো হলো ‘কাটের’। কেটে ফেলা হবে শট। খণ্ডন করা হবে।
…
চলচ্চিত্রী
যিনি, তিনি নিজে
নারী নন। কিন্তু তার
ক্যামেরাটি কি বিস্ময়করভাবে নারীবাদের
…
এইখানে, ঠিক এইখানে আমাদের মনে পড়ে যাবে– শিরিনকে। শিরিন একটি চলচ্চিত্র।
আব্বাস কিয়ারোস্তামির শিরিন। স্পেক্টেটরশিপের অসীম ভূমিকা নির্ণয়ে কী তুমুল চলচিত্র।
চলচ্চিত্রী যিনি, তিনি নিজে নারী নন। কিন্তু তার ক্যামেরাটি কি বিস্ময়করভাবে নারীবাদের। অবাক হতে হয় ভেবে, ইরানের নারীবাদের একটি চরম ভাষ্য এভাবে নির্মিত হচ্ছে তার হাতে। আধুনিক সিনেমার বিরল ঈশ্বরদের এক ঈশ্বর– আব্বাস কিয়ারোস্তামির হাতে।
চলচিত্রের ভাষায় শিরিন একটি বিস্ময়কর পরীক্ষামূলক কাজ। একটি মাত্র শট গোটা ছবিজুড়ে। যাকে আমরা ‘সিঙ্গেল শট ছবি’ বলি। যার সব কটি শট শুধুই ক্লোজ আপে নির্মিত।

আশা করি আমি বলে ফেলেছি। আশা করি আমি বলতে সক্ষম হয়েছি কিয়ারোস্তামি কি কাণ্ডটি ঘটিয়েছেন–
১১৪ জন অভিনেত্রীর ক্লোজআপের সমাহারে পূর্ণ দৈর্ঘ্যের এই চলচ্চিত্র। ছবিটি ঘটে চলে একটি প্রেক্ষাগৃহের অন্দরে। যা পাবলিক প্লেস। সব চরিত্র দর্শক। নারী দর্শক। তাদের মুখ উন্মুক্ত। কোনো পুরুষ উপস্থিত নেই সেখানে। শুরুতেই তাদের গেইজ-টিকে উন্মুক্ত করলেন কিয়ারোস্তামি।
ছবির সাউন্ড-ট্র্যাক থেকে আমরা সিনেমার পর্দার উপস্থিতি জানতে পারি। অনুমান করি দৃশ্যের জন্ম হচ্ছে পর্দায়। কিন্তু পর্দায় কি দৃশ্য চলছে তা কখনোই দেখতে পাই না। দেখতে পাই– অনন্ত নারীদের মুখচ্ছবি। তারা দর্শকের ভূমিকায় অভিনয় করছেন। আমরা তাদের মুখের আয়নায় ফুটে ওঠা অভিব্যক্তিগুলি পাঠ করি । ক্রমে শিরিন হয়ে নারীবাদের সিনেমা পাঠ, আমাদের কাছে। নারীর সিনেমা পাঠ। নারীর সিনেমা দর্শন। পর্দাবিহীন।
নারীর চোখে, নারীর দৃষ্টি, অন্দর, এর অভিব্যক্তি, দীর্ঘশ্বাস, কান্না, হাসি দেখতে পাই। কোনো পর্দার উপস্থিতি নেই সেখানে। না মুখের ওপরের হিজাবি পর্দা, না সিনেমার পর্দা।
পর্দার অন্দরানা ও ইরানের বাহিরানা’কে চিনে নিই। বিস্ময়কর এই পাঠ। যেমন সিনেমার। তেমনি নারীবাদের। এবং সিনেমার নারীবাদের।
আবারও– পর্দাবিহীন। কী কান্ড!!
শিরিন বিষয়ে বক্তব্য এ পর্যন্তই।
…
জাতীয়তাবাদ,
অন্দরের রাজনীতি,
পরিচিতি নির্মাণ ও পিতৃতন্ত্রকে
টেনে আনবে অন্য এক সংযুক্তিতে
…
আর অন্য যে চলচ্চিত্রটির কথা বলে প্রবন্ধ শেষ করব, তা হলো আরেক অন্দর-বাহিরানার আরেক নারীবাদী কিস্যা। এর সাথে পশ্চিমী বা অন্য এশীয় নারীবাদের ধাঁচা মিলবে না। তা জাতীয়তাবাদ, অন্দরের রাজনীতি, পরিচিতি নির্মাণ ও পিতৃতন্ত্রকে টেনে আনবে অন্য এক সংযুক্তিতে। ইরানে কলোনি শাসন হয়নি কখনো, এ কথা ঠিক। তেমনই আবার সোভিয়েত ও ব্রিটিশ সংস্কৃতির কিছু প্রভাবও তাদের ওপর ছিল গত শতাব্দীতে, এ কথা অস্বিকার করার নয়– অন্তত সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের বয়ানে। ফলে ইরানের জাতীয়তাবাদ এই প্রভাব কাটিয়ে ওঠার পক্ষে থাকবে– এ কথাও আবারও গুরুত্বপূর্ণই। ফলে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যা সাম্রাজ্যবাদী তা হয়ে উঠবে বহিরাগত। তাই তার বিরুদ্ধে গিয়ে তৈরি করতে হবে দেশ-বোধ। আর বাইনারি মতে অবধারিতভাবে তা হবে– অন্দরমুখী। আর এই অন্দরের ভেতরে তাকে আবার লড়াই করতে হবে। নারীবাদকে চিনে নিতে হবে তার বিপক্ষ অন্দরে। বাইরের, বহিরাগত পুরুষতন্ত্রের থেকে আলাদা এই পুরুষতন্ত্র। ফলে নারীবাদকে হতে হবে প্রথমে ইরানি তার সংস্কৃতিতে, আর তারপর সে লড়াই করবে অন্দরে। পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে। নারীর অধিকারের অর্জনের লড়াইয়ে।

ফিল্মমেকার । সামিরা মাখমালবাফ
আসলে নারীবাদ ও নারীর অধিকারের লড়াইটিই ইরানের ইসলামি আইনে স্বীকৃত নয় এখনো।
তাই সামিরার ছবি আপেল হয়ে উঠবে এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের এক অবশ্যম্ভাবী পাঠ। সামিরা মাখমালবাফ। আমরা জানি মাখমালবাফ পরিবারের জ্যেষ্ঠতমা। প্রথম ছবি তৈরি করেন মাত্র ১৭ বছর বয়সে।
সামিরার ছবি আপেল ইরানের নারীবাদী চিত্রভাষার এক সার্থক অ্যালিগরিময় আখ্যান। ডিসকোর্স। আখ্যান গড়ে ওঠে দুটি যমজ ভগিনীকে ঘিরে। এক সত্যকাহিনি অবলম্বনে। প্রথম দৃশ্যেই দেখি– যমজ বোনেরা গরাদের ভেতর থেকে তাদের বেড়ি দেওয়া হাতগুলিকে বাড়ায়। গরাদের বাইরে থাকা ফুলগাছটিতে জল দ্যায়।

তাদের আব্বায় বলেছে – নারীরা ফুলের মতো। রোদের তাপে তারা মূর্ছা যায়। তাদের রোদ-বাতাস থেকে দূরে থাকতে হবে। তাদের পারে বেড়ি। হাতেও। বাবা তাদের তালাচাবি দিয়ে বন্ধও করে রেখেছেন তাদের বিশাল বাড়িখানায়। তাদের মা হলেন অন্ধ। তিনি এই বাড়িতে একাকী ঘুরে বেড়ান। তার হাতে পায়ে বেড়ি নেই। কিন্তু তিনি মেয়ে দুটিকে মুক্ত করেননা। মুক্ত করার কারণও দেখতে পাননা। পা থেকে মাথা পর্যন্ত তার ঢাকা কালো চাদরে। সামিরা আমাদের মনে করাতে চান- তিনি এই পরিবারের সবথেকে বন্দী একজন মানুষ। তিনি মুক্তি চান না। পিতৃতন্ত্রের চাদরে নিজেকে মুড়ে রাখেন, বন্দি করে রাখেন।
এক সময় বালিকা দুটি মুক্তি পায়। এক সমাজ-সংস্থা এসে তাদের মুক্ত করে।
এরপরই সামিরা খেলে দেবেন এক অদ্ভুত খেলা।
সমাজের বাহিরানায় বেড়িমুক্ত মেয়ে দুটির অন্দরের ভাষা ভাঙবার খেলা।
তাদের হাতে একটি আপেল। তারা আইসক্রিমের দোকানের কাছে বিহ্বল। তাদের অর্থনীতিবোধ নেই। বোধ নেই মুদ্রা ব্যবহারের। তারা বিহ্বল এই পণ্যদারীর কাছে। কি ভাষায় জানাবে তবে। কিভাবেই নিজেরা জানবে– কী আছে এই পণ্যের সম্ভারে।
আর আছে ক্লোজআপ। নানা মাপের। ছবিজুড়ে।
…
হিজাব
সরিয়ে মুখচ্ছবি
ধরা পড়ে যার অন্দরে
…
যেমন আব্বাসের ছবিতে। বে-পর্দা এই পর্দা, পর্দার নন্দনতত্বে। চলচ্ছবিতে । তাই সামিরা অ্যালিগরিতে আনেন আপেল ও আয়না। অন্দর ও বাহিরানা। হিজাব সরিয়ে মুখচ্ছবি ধরা পড়ে যার অন্দরে। বাইরের না। নিজের। নিজের অন্দরের। সেই অন্দরানা তুলে নেয় এক আপেল হাতে। তা তার জ্ঞানপিপাসু মন।
ঘনিয়ে ওঠে আপেল ও আয়নার মহাকাব্য।

আমরা দাঁড়িয়ে থাকি নির্দিষ্ট দূরত্বে। অনুধাবন করি এই নন্দন ও তার খণ্ডনগুলিকে।
ইরানের সিনেমার জয় হোক।
জয় হোক ইরানের মেয়েদের।