লিখেছেন । স্বজন মাঝি
মহিউদ্দিন ফারুক স্যার আমাদের পরম শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক। আমি মনে করি তাকে শুধুমাত্র চলচ্চিত্র শিক্ষক বললে কম বলা হবে, তিনি ছিলেন এক আস্ত চলচ্চিত্র বিদ্যাপীঠ। যারা স্যারের দীর্ঘদিনের ছাত্র, তারা আমার কথায় একমত হবেন– তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। শেষের দিকে তিনি সহযোগী শিক্ষক দিয়ে ক্লাস নিতেন। এই সময়ের শিক্ষার্থীরা হয়তো আমার সঙ্গে একমত নাও হতে পারেন!
স্যারের সঙ্গে ছাত্র-শিক্ষকের বাইরেও আমার একটা পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। যদিও সেটা আমি নিজেও জানতাম না, এক দুপুরের ক্যাফেটেরিয়ায় স্যারই আমাদের এই পারিবারিক সম্পর্কটি আবিস্কার করেছিলেন। গত ১ এপ্রিল আমার মাতামহীর মৃত্যুর খবর দেওয়ার জন্য জীবনে প্রথম পারিবারিক সম্পর্কের জের ধরে স্যারকে ফোন দিয়েছিলাম। মাত্র আঠারো দিন আগে! তখনো ভাবিনি আড়াই সপ্তাহ পর স্যার আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন।

ফিল্মমেকার। মহিউদ্দিন ফারুক
স্যারকে আমি প্রথম দেখি ২০০৮ সালের দিকে। স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির সিদ্ধেশ্বরী ক্যাম্পাস মিলনায়তনে। না, আমি ফিল্ম ডিপার্মেন্টের শিক্ষার্থী ছিলাম না। আমি তখন জার্নালিজমের শিক্ষার্থী। আমাদের ক্যাম্পাস ছিল ধানমন্ডি ১৫ নম্বরে। ডিবেটিং ক্লাবের কোনো একটা অনুষ্ঠানে তিনি ছিলেন বিশেষ অতিথি বা প্রধান অতিথি। আরও অনেক গুণী শিক্ষকের মাঝে তিনি আমার নজর কেড়েছিলেন, কারণ উপস্থাপিকা বিরাজ বৌ চলচ্চিত্রের নির্মাতা হিসেবে তার পরিচয় দিয়েছিলেন! স্কুল জীবনে, বিটিভিতে স্যারের নির্মিত বিরাজ বৌ [১৯৮৮] চলচ্চিত্রটি দেখেছি।
এরপর স্যারকে দ্বিতীয়বার দেখি বিসিটিআই ক্যাম্পাসে, ২০১৪ সালে। তখন আমরা চলচ্চিত্র নির্মাণ কোর্সের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী। এর আগেই একজন বিশিষ্ট চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব হিসেবে মহিউদ্দিন ফারুক স্যারকে জেনে গেছি। কোনো রেগুলার ক্লাসে না, তিনি আমাদের ক্লাসে প্রথমবার এসেছিলেন অতিথি শিক্ষক হিসেবে। নিমকোতে অন্য কোনো ক্লাস নিতে এসছিলেন হয়তো, লাঞ্চের পর আমাদের ক্লাসে ঢুকে পড়েন। সেদিন কথা বলেছিলেন চিত্রগ্রহণ বিষয়ে। যদিও সেসময় অন্য শিক্ষকের অধীনে চিত্রগ্রহণের নিয়মিত ক্লাস চলছিল; কিন্তু আমার এখনও মনে আছে, তিনি মাত্র দু’ ঘণ্টায় ক্যামেরা-লেন্স-লাইটের ওপর অসাধারণ পাঠ প্রদান করেছিলেন।
…
মহিউদ্দিন ফারুক স্যার
সব সময় একটা
কথা বলতেন,
‘শিল্পের
কাজ বর্জন
করা, অর্জন করা নয়!’
…
এরপর ২০১৫ সালে বিসিটিআই-এর শিল্প নির্দেশনার ক্লাসে তাকে নিয়মিত শিক্ষক হিসেবে পাই। যদিও শিল্প নির্দেশনার শিক্ষক হিসেবে তিনি পাঠদান করতে আসতেন, কিন্তু পাশাপাশি অনেক বেশি পাঠ প্রদান করতেন চলচ্চিত্রের অন্যান্য শাখা– সম্পাদনা, চিত্রগ্রহণ, অভিনয়, নন্দনতত্ত্ব, ইতিহাস, অ্যানিমেশন, প্রযোজনা, পরিবেশনা এবং ইন্ডাস্ট্রির নানা খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে। এজন্যই তাকে শুধুমাত্র শিক্ষক বলার চেয়ে চলচ্চিত্র বিদ্যাপীঠ আখ্যা দিতে আমি বেশি আগ্রহী। মহিউদ্দিন ফারুক স্যার সব সময় একটা কথা বলতেন, ‘শিল্পের কাজ বর্জন করা, অর্জন করা নয়!’

২০১৫ সালের এক মধ্যাহ্ন বিরতির গল্প না বললেই নয়। আমি যখন বিসিটিআই প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী, তখন আমার আর্থিক অবস্থা খুব সংকটাপন্ন। পকেটে টাকা থাকত না বলে বেশির ভাগ দিনেই দুপুরের খাবার খেতে ক্যাফেটেরিয়ায় যেতাম না। তখন চল্লিশ টাকায় নিমকো ক্যাফেটেরিয়ার ভাত-ডাল-সবজি-মাছ/মাংস খাওয়া যেত। আমরা শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ এই সামান্য টাকার অভাবে ক্যাফেটেরিয়া বিমুখ থাকতাম। সিগারেট খেতাম ডার্বি, তা-ও দু’টাকা মূল্যের একটা ডার্বি অনেক সময় দুইবারে টানতাম; মানে অর্ধেকটা টেনে নিভিয়ে দিতাম, তারপর বাকি অর্ধেকটা খেতাম অন্যসময়। এক সিগারেট দু’বারে খাওয়ার তরিকাটা শিখেছিলাম সহপাঠী দিনার মাহমুদের কাছে।
সেসময় একদিন, ক্লাস শেষে ক্যাফেটেরিয়ার দিকে না গিয়ে আমি যাচ্ছিলাম বাইরে চা-সিগারেটের দোকানের দিকে। এমন সময় মহিউদ্দিন ফারুক স্যার আমাকে পেছন থেকে ডাকলেন। বললেন, ‘লাঞ্চ করবে না!’ আমি থতমতভাবে বললাম, ‘করব।’ তিনি বললেন, ‘তাইলে বাইরে যাচ্ছ কেন! চলো আমার সাথে।’ আমি ভদ্রছেলের মতো স্যারের সঙ্গে সঙ্গে হাঁটছি। আমার ধান্দা ছিল, স্যার শিক্ষকদের টেবিলে বসলে আমি এক কক্ষ দিয়ে ঢুকে অন্য কক্ষ দিয়ে বেরিয়ে যাব। বিসিটিআই-এর বেশির ভাগ শিক্ষক সাধারণত নিমকোর আচার অনুযায়ী আমলাদের টেবিলে বসেন। মুরাদ স্যার, শামীম আপা, অঞ্জন স্যার, খালেদ স্যারসহ কোনো কোনো ব্যতিক্রমী শিক্ষকও আছেন।
ক্যাফেটেরিয়া অব্দি স্যারের পেছন পেছন হেঁটে দরজার সামনে পৌঁছতেই তিনি আমার দিকে ঘুরে বললেন, ‘তুমি আমার সাথে বসো, আমরা একসাথে খাই চলো!’ বুঝলাম পালানো উপায় নাই আর। আমি আর স্যার একটা ফাঁকা টেবিলে বসলাম। প্লেটে ভাত তুলতে তুলতে স্যার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার বাসা কোথায়?’ আমি বললাম, ‘সানারপাড়।’ স্যার পাল্টা জিজ্ঞেস করলেন, ‘মানে শনির আখড়ার পর যে সানারপাড়!’ আমি বললাম, ‘জ্বি’। স্যার বলেন, ‘আরে, আমি তো ঐদিক দিয়েই আমার গ্রামের বাড়ি যাই।’ আমি এবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার গ্রামের বাড়ি কোথায়?’ উনি বলেন, ‘কাছেই, গজারিয়ার নাম শুনেছ? মেঘনা নদী পার হয়ে।’

অঙ্কন । শতভিষা
এবার আমি নড়েচড়ে বসে বেশ উৎফুল্ল হয়ে বললাম, ‘আমাদের গ্রামের বাড়ি তো গজারিয়াতে।’ এবার স্যার বেশ উৎফুল্ল হয়ে বললেন, ‘বলো কি, কোন গ্রাম তোমাদের!’ আমি বললাম, ‘দাদাবাড়ি বাঘাইকান্দি, নানাবাড়ি ভিটিকান্দি।’ স্যার বললেন, ‘গ্রামে যাও?’ আমি বললাম, ‘না স্যার!’ তিনি বললেন, ‘এত কাছে গ্রামের বাড়ি, গ্রামে যাবে।’ আমি কিছু বললাম না, মুরগির মাংস দিয়ে গোগ্রাসে ভাত খেয়ে যাচ্ছি। স্যার বললেন, ‘তোমাদের বাঘাইকান্দি গ্রামে একজন চলচ্চিত্র নির্মাতার জন্ম হয়েছে, তার নাম জানো?’ আমি বিস্ময়ে মাথা নেড়ে বললাম, ‘না স্যার।’ তিনি বিরক্তির সুরে বললেন, ‘ঢাকা ৮৬‘ সিনেমাটা দেখছ? ওই সিনেমার পরিচালক শফিকুর রহমান।’ আমি প্লেটে ডাল তুলছিলাম। আশ্চর্য দৃষ্টিতে স্যারের দিকে তাকালাম। স্যার মিষ্টি হাসলেন। এবার স্যার নিজে থেকে আবার বললেন, ‘ভিটিকান্দি গ্রামের রফিকুল ইসলামকে চেনো?’ আমি বললাম, ‘কোন রফিকুল ইসলাম?’ উনি আবার খানিকটা বিরক্তি নিয়ে বললেন, ‘আরে, কমান্ডার রফিক।’ এবার আমি একটু সাহস নিয়ে বললাম, ‘মুক্তিযোদ্ধা রফিক? উনি আমার বড় মামা।’
আমার খাওয়া শেষ। স্যার তখনও আস্তে আস্তে খাচ্ছেন। স্যার আমার কথা শুনে এবার ভীষণ উৎফুল্ল ভাব নিয়ে বলেন, ‘তুমি রফিকের ভাগিনা! তুমি তো তাইলে আমারও আত্মীয় হও।’ এতোক্ষণ পর আমি স্যারের গ্রাম জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনাদের গ্রাম ভিটিকান্দি?’ উনি বললেন, ‘না, না; আমার বাড়ি আড়ালিয়া গ্রামে। আমি বিয়ে করেছি তোমার নানীর বাপের বাড়ি, ঢালী বাড়িতে। শ্রীনগর গ্রাম, গেছো কখনো?’ আমি বললাম, ‘ছোটবেলায় অনেক গেছি।’ তারপর উনি মুচকি হেসে বললেন, ‘তাইলে তো আমি তোমার খালু হই। তোমার নানী তো বেঁচে আছেন এখনো, শরীরটা কেমন? অনেক দিন দেখি না।’ আমি বললাম, ‘নানী বেশ সুস্থ, উনি এখন আমাদের বাসায় আছেন।’ স্যার বলেন, ‘রাতে তাইলে তুমি একটা ফোন দিয়ো, ওনার সাথে কথা বলব একবার।’

ফিল্মমেকার । শফিকুর রহমান
আমি সেদিন রাতে বাসায় ফিরে, নানীর সঙ্গে স্যারকে কথা বলিয়ে দিলাম। আরও অনেক দিন পর বাবার কাছে শুনেছিলাম, ছোটবেলায় বিটিভিতে দেখা সেই ঢাকা ৮৬ [১৯৮৬] সিনেমার পরিচালক আমার বাবার ক্লাসমেট ছিলেন। সেদিন দুপুরের খাওয়া শেষ করে আমরা আরও অনেকক্ষণ গল্প করেছিলাম। সেদিনই স্যার আমাকে বলেছিলেন, আখতার জং কারদারের বিখ্যাত জাগো হুয়া সাভেরা [১৯৫৯] সিনেমার শুরুতে যে অসাধারণ নদীর দৃশ্য, সেটি আমাদের গ্রামের কাছের মেঘনা নদীতে শুট করা। আরও বলেছিলেন, মহান ঋত্বিক ঘটকের কালোত্তীর্ণ তিতাস একটি নদীর নাম [১৯৭৩] সিনেমাটিও মেঘনা পাড়ে ধারণকৃত। স্যারের সঙ্গে আলাপচারিতার ২০১৫ সালের সেই চৈত্রের দুপুর চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে আমাকে জাদুকরী উত্তরাধিকার দিয়েছিল। সেই দুপুর আমার স্মৃতিতে এক দারুণ দুপুর হয়ে বেঁচে থাকবে আজীবন।
…
শারীরিকভাবে
দূর্বল হলেও মানসিক
উদ্দীপনা ষোল আনা ছিল
…
২০১৭ সালে স্যারকে আবারও বিসিটিআই ক্লাসরুমে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম। কিন্তু ততদিনে স্যার শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। ক্লাস নিতেন সহযোগী শিক্ষকের সহায়তায়। শারীরিকভাবে দূর্বল হলেও মানসিক উদ্দীপনা ষোল আনা ছিল। স্যারের ক্লাসে করা আমার শেষ অ্যাসাইনমেন্টটি আমি আজও আমার ঘরের দরজায় লাগিয়ে রেখেছি। এবার হয়তো সেটি, দুই আনা কথা নামে চলচ্চিত্রের প্রাথমিক পোস্টারটি বাঁধাই করে রাখতে হবে! এবং সিনেমাটি বানানোর কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আমার আরেকটি নির্মিতব্য চলচ্চিত্রে স্যারের সহযোগিতা পেয়েছিলাম। কাস্টিংয়ের জন্য স্যার পশ্চিমবঙ্গের প্রসেনজিৎকে ফোন দিয়ে আমার কথা বলে ছিলেন।

যেদিন থেকে জেনেছি স্যার আমার খালু হন, তারপর থেকে খুব সচেতনভাবে আমি স্যারকে অ্যাভোয়েড করে গেছি। গতবছর গল্প-সংক্ষেপ স্বল্পদৈর্ঘ্য ক্যাটাগরিতে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে মনোনীত হওয়ার পর স্যার আমাকে ফোন দিয়ে অভিবাদন জানিয়েছিলেন। স্যারের সেই ফোন আমাকে ভীষণ আনন্দিত করেছিল। শুধু শিক্ষক নন, একজন চলচ্চিত্র সংগঠক হিসেবেও তিনি খুব দক্ষ একজন ব্যক্তি ছিলেন। বিসিটিআই থেকে বেরিয়ে জেমী স্যারের নেতৃত্বে আমরা বাকপ্রো নামে একটা সংগঠন করেছিলাম। সেসময় সংগঠনের গঠনতন্ত্র প্রণয়নের কাজে আমরা বারবার মহিউদ্দিন ফারুক স্যারের সহায়তা নিয়েছি।
শিক্ষক, সংগঠক বা নির্মাতার চেয়ে শিল্প নির্দেশক হিসেবে দেশ-বিদেশের মানুষের কাছে মহিউদ্দিন ফারুক স্যার অধিক সমাদৃত। তিনি শিল্প নির্দেশনার কাজ করেছেন পালঙ্ক [১৯৭৫], সূর্য দীঘল বাড়ি [১৯৭৯], সারেং বৌ [১৯৭৮], পদ্মা নদীর মাঝি [১৯৯৩], মনের মানুষসহ [২০১০] অসংখ্য চলচ্চিত্রে। উল্লেখিত এ কয়টা নাম ছাড়া অন্যান্য চলচ্চিত্রের নামই বেশির ভাগ মানুষ উল্লেখ করে থাকেন। অনেকই হয়তো জানেন না বা উল্লেখ করেন না, মহান ঋত্বিক ঘটকের সাথে তিতাস একটি নদীর নাম [১৯৭৩] চলচ্চিত্রে তিনি কাজ করেছেন।

শিল্পনির্দেশক । মহিউদ্দিন ফারুক
আজ থেকে মাত্র আঠারো দিন আগে, ১ এপ্রিল ২০২০ আমার প্রিয় নানী আমাদের বাসায় মৃত্যুবরণ করেন। নানীর চলে যাওয়ার সংবাদ জানাতে পরিবারের পক্ষ থেকে সেদিন ভোরবেলা আমি কেবল একজন মানুষকেই ফোন দিয়েছিলাম, তিনি মহিউদ্দিন ফারুক স্যার। আমি ভাবতেও পারি না, মাত্র আড়াই সপ্তাহ পর আমাকে স্যারের স্মৃতিচারণ লিখতে হবে!
[স্যারের সঙ্গে আমার সংগ্রহে কোনো ছবি নাই। আমাদের ক্যাফেটেরিয়া ছবিটি বন্ধু শতভিষা’র আঁকা]
স্যারকে চিনতাম না। দেখাও হয়নি কোনদিন। কিন্তু অাপনার স্মৃতিকথা পড়ে মনে হলো স্যার অামার অনেকদিনের চেনা।
বাহ্!কী সুন্দর স্মৃতিচারণ।