লিখেছেন । বেলায়াত হোসেন মামুন

জন্ম। ১ মার্চ ১৯৪২; ঢাকা
মৃত্যু । ১৭ এপ্রিল ২০২০; ঢাকা
এ এক দুঃখজনক সময়। যখন আমরা ঘরে থাকাটাকেই নিরাপদ থাকার মন্ত্র করে নিয়েছি। এই মন্ত্রপাঠ কতদিনের জন্য তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না। কিছু দিনের রসদ জুগিয়ে আমরা ঢুকে পড়েছি নিজ নিজ গুহায়। কত দিন চলবে এই রসদে তা আমাদের জানা নেই। এই বহুবিধ অজ্ঞানতার মাঝে আপাতত, আমরা ভাবছি জীবনের জন্য এই গর্ত বা গুহাবাসই উত্তম ব্যবস্থা। জীবনের জন্য আমাদের এই সম্মিলিত গর্তবাসে প্রাণ ও প্রকৃতির জন্ম-মৃত্যু স্বাভাবিক ছন্দে বয়ে যাচ্ছে। আর তাই আমরা জানছি নতুন শিশুর আবির্ভাবের উচ্ছাস আর প্রিয়জন হারানোর আর্তি।
আজ, ব্যক্তিগত গর্তে বসেই দুপুরে জানলাম চলে গেছেন আমাদের একজন প্রিয় চলচ্চিত্রজন। খ্যাতিমান শিল্পনির্দেশক, চলচ্চিত্রকার এবং চলচ্চিত্র শিক্ষক মহিউদ্দিন ফারুক। এই মহামারির দুঃখজনক সময়ে তাঁর এ প্রস্থান বেদনার; এ বেদনা আরও ভারী হয়ে ওঠে যখন আমরা ঘর হতে বের হয়ে তাঁর শোকাকূল শিল্পস্বজনেরা সম্মিলিত হতে পারি না। আমরা জীবাণু সংক্রামণের ভয়ে সমবেত না হয়েই বিদায় জানালাম তাঁকে।
ফারুক ভাই অকাল প্রয়াত নন। তিনি এই পৃথিবীতে ৭৮টি বসন্ত যাপন করেছেন। সুস্থ ও সক্ষম ছিলেন জীবনের প্রায় পুরোটা সময়। এসব ভেবে গভীর দুঃখ না থাকলেও আছে মনস্তাপ। কেননা, ফারুক ভাইয়ের মতো এমন একজন অভিজ্ঞ চলচ্চিত্র শিক্ষকের প্রয়াণে আমাদের চলচ্চিত্র শিক্ষার দূর্বলতার মাঝে আরও একটু গভীর শূন্যতা তৈরি হলো। ফারুক ভাইয়ের প্রয়াণে আমাদের চলচ্চিত্র শিক্ষায় অভিজ্ঞ চলচ্চিত্র শিক্ষকের অভাবটা আরও একটু বাড়লো।
…
তিনি
এমন গল্প
বলতেন যা জীবনের
ভেতর থেকে তিনি আহরণ করেছেন
…
শিল্পরুচি এবং ঘটনাবহুল যাপনের বর্ণাঢ্য অভিজ্ঞতায় ফারুক ভাইয়ের সাথে যে কোনো সাক্ষাৎ স্মরণীয় হতো। তিনি এমন গল্প বলতেন যা জীবনের ভেতর থেকে তিনি আহরণ করেছেন। তাই তা থেকে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আলোর বিকিরণ হতো। আমি ওনার ছাত্র ছিলাম না। কখনও ওনার কোনো ক্লাসও করিনি। তবে ওনার ছাত্রদের ওনার প্রতি মুগ্ধতার অনেক গল্প শুনেছি। আর শুনেছি ক্লাসে দরদ দিয়ে ওনার চলচ্চিত্র পড়ানোর এবং বোঝানোর আন্তরিক সময় ও শ্রমের কথা।

শিল্পনির্দেশক । মহিউদ্দিন ফারুক
মহিউদ্দিন ফারুক চলচ্চিত্র ভালোবাসতেন। বহুলোক আছেন যাঁরা চলচ্চিত্রে আছেন, থাকেন কিন্তু চলচ্চিত্রকে ভালোবাসেন না। মহিউদ্দিন ফারুক তা নন। যদিও তিনি পুরো জীবনজুড়েই এফডিসিকেন্দ্রিক ইন্ডাস্ট্রির বাতাবরণেই কাজ করেছেন; কিন্তু নিজস্ব শিল্পবোধ ও রুচিতে তিনি ইন্ডাস্ট্রির কলুষতার পঙ্কিলে হারিয়ে যাওয়ার মানুষ ছিলেন না। যতবার যত প্রয়োজনে বা অপ্রয়োজনে ওনার সাথে দেখা হয়েছে, ততবারই ওনার ব্যক্তিত্বের স্নিগ্ধ উষ্ণতায় ভালোবোধ করেছি।
…
ইন্ডাস্ট্রির
বাতাবরণে আর
কে কে আছেন যাঁকে
সমাজ আজও সম্মান ও গুরুত্ব দেয়?
…
চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের বিভিন্ন সভা-সেমিনার ও বৈঠকে ওনাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছি। উনি এসেছেন। নিজস্ব কথাটুকু দৃঢ়ভাবে বলেছেন। অস্পষ্ট কথা বলাটা হয়তো ওনার স্বভাবে ছিল না। এসব ভালো লেগেছে। গত বছর চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেনের মৃত্যুর পর বলেছিলাম যে আমাদের ইন্ড্রাস্টি পাড়াকে বিভিন্ন পরিসরে প্রতিনিধিত্ব করবার মতো গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি আর রইলো না। কথাটা তখন আংশিক সত্য ছিল। আজ মহিউদ্দিন ফারুক ভাইয়ের মৃত্যুর পর ওই কথাটি আরও জোর দিয়ে বলতে চাই। আমাদের এই ইন্ডাস্ট্রির কাঠামো এসব গুণী মানুষ হারিয়ে এখন অন্তসারশূন্য হয়ে পড়েছে। এ পরিণিতি দুঃখজনক হলেও তা অবধারিতই ছিল। ইন্ডাস্ট্রির বাতাবরণে আর কে কে আছেন যাঁকে সমাজ আজও সম্মান ও গুরুত্ব দেয়?
আমি জানি এ তালিকার আর মাত্র দুই একটি নামই অবশিষ্ট আছে। এরপর কি হবে এ বাণিজ্য মাফিয়াচক্রের? কে ওনাদের ইমেজ রক্ষার ঢাল হয়ে দাঁড়াবেন? আমি তেমন কোনো নতুন মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কে জ্ঞাত নই; কারণ নেতৃত্বের সামাজিক সম্মতি রাতারাতি তৈরি হয় না। একজন সুভাষ দত্ত, একজন আমজাদ হোসেন অথবা একজন চাষী নজরুল ইসলামের একটি দীর্ঘ সময়, শ্রম ও মেধার বিনিয়োগে তাঁদের প্রতি সমাজের সম্মতি তৈরি হয়েছিল। সে যাত্রার আরও একটি মানুষের আজ প্রয়াণ হলো। যাঁর প্রতি সমাজের শ্রদ্ধাবোধ ও মর্যাদাপূর্ণ দৃষ্টি তৈরি ছিল।

ফিল্মমেকার । মহিউদ্দিন ফারুক
চলচ্চিত্রকার হিসেবে ফারুক ভাই মাত্র একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। ছবিটির নাম বিরাজ বউ। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাহিত্যনির্ভর হলেও ছবিটি বাণিজ্যিক অভিপ্রায়ে নির্মিত ছিল। এই বাণিজ্যপ্রবণতা ছবিটিকে বাংলাদেশের আর দশটি ‘সুস্থ বিনোদনমূলক’ ছবি করে তুললেও ছবিটির প্রতি নির্মাতা মহিউদ্দিন ফারুকের যত্ন স্পষ্টভাবেই দৃষ্টিগোচর হয়। ছবিটির দৃশ্যগত শিল্পমান এই ঘরানার আর দশটি ছবির থেকে এই ছবিটিকে পৃথক করেছিল। আর এই ‘পৃথক’ হওয়াটা কোনো ব্যতিক্রম নয়। শিল্পী মহিউদ্দিন ফারুকের নিজস্ব নির্মিতিতে এটুকু ‘পৃথক’ হওয়াটা স্বাভাবিকই। যতটুকু জানি, ছবিটি বাণিজ্যিকভাবে মার খায়নি। তবুও কেন ফারুক ভাই আর ছবি নির্মাণ করলেন না তা অজানাই রয়ে গেল।
নির্মাতা পরিচয়ের বাইরে ফারুক ভাইয়ের অন্য প্রধান পরিচয় তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের একজন নন্দিত শিল্পনির্দেশক এবং ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান গুণী চলচ্চিত্র শিক্ষক। শতাধিক চলচ্চিত্রে তিনি শিল্পনির্দেশনা দিয়েছেন। এবং স্বাভাবিকভাবেই শ্রেষ্ঠ শিল্পনির্দেশনার জন্য তিনি বহুবার বাংলাদেশের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছেন।

শিল্পনির্দেশক । মহিউদ্দিন ফারুক
শ্রেষ্ঠ শিল্পনির্দেশনার জন্য তিনি অনেকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেলেও সবসময় যে সঠিক ছবিটির জন্যেই পুরস্কৃত হয়েছেন, এমনটা আমি মনে করি না। আমার বিবেচনায় তিনি তাঁর যে ছবিগুলোর জন্য পুরস্কৃত হতে পারতেন, সে ছবিগুলোর কোনো কোনোটি পুরস্কার প্রদান কমিটি আমলেই নেয়নি।
আমার বিবেচনায় মহিউদ্দিন ফারুক ভাইয়ের দুটি অসাধারণ শিল্পনির্দেশনার কাজ হলো রাজেন তরফদার নির্মিত চলচ্চিত্র পালঙ্ক এবং শেখ নিয়ামত আলী ও মসিহউদ্দিন শাকের নির্মিত সূর্য দীঘল বাড়ী। এ দুটি চলচ্চিত্রের শিল্পগুণ ও মান অর্জনে আর সব কিছুর মতো মহিউদ্দিন ফারুকের অবদানও কম কিছু নয়। এছাড়া ফারুক ভাইয়ের অন্য যে চলচ্চিত্রগুলো আমার দৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলো হলো, বসুন্ধরা, ডুমুরের ফুল, সারেং বউ, পদ্মা নদীর মাঝি এবং দুখাই।
এই চলচ্চিত্রগুলোর নির্মাণশৈলীতে যে শিল্পমান তৈরি হয়েছে সেখানে একজন অভিজ্ঞ শিল্পনির্দেশকের অবদানও স্মরণীয় এবং স্বীকার্য। যদিও জনসমাজ চলচ্চিত্রকে কেবলমাত্র নির্মাতার একক সাফল্য অথবা অভিনয়শিল্পীদের ‘তারকা প্রথা’র কীর্তি হিসেবেই দেখে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। শিল্পরুচিসম্পন্ন একদল মানুষের দলগত প্রয়াস না হলে যে একটি শিল্পমানসম্পন্ন চলচ্চিত্র নির্মিত হয় না তা আমাদের জনপরিসরে খুব আলোচিত ও উচ্চারিত নয়। এ কারণে বর্তমানে মহিউদ্দিন ফারুকের মতো প্রতিভাবান শিল্পীদের চলচ্চিত্রে যোগদান কমছে।

শিল্পনির্দেশক । মহিউদ্দিন ফারুক
আমাদের দেশে চলচ্চিত্রে কাজ করতে আগ্রহী মানুষের সংখ্যা বহু হলেও তাঁদের মাঝে শিক্ষা-চর্চা ও সাধনায় গড়ে ওঠা প্রতিভার সংখ্যা নগণ্য। তাই একজন মহিউদ্দিন ফারুকের বিদায় বেদনার। কারণ তাঁর মাঝে শিক্ষা-চর্চা ও সাধনার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা রুচির সমৃদ্ধি ছিল। এ বস্তু বর্তমান বাংলাদেশে বিলুপ্তপ্রায় এক গুণ। এর বিপরীতে চারপাশে এখন যা চলছে তাকে প্রাতঃস্মরণীয় শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন বলেছিলেন, রুচির দূর্ভিক্ষ। কথাটি যে কতটা সত্য তা চারপাশে দৃষ্টি দিলে কারও অগোচর থাকবার কথা নয়।
…
সূর্য দীঘল বাড়ীর যে শিল্পমান,
তাতে এই ছবিটির
শিল্পনির্দেশকের
পুরস্কৃত
না
হওয়াটা
আমাদের ব্যর্থতাই
…
মহিউদ্দিন ফারুক ভাইকে নিয়ে আমার একটি দুঃখবোধ আছে। আর তা ফারুক ভাইকে বলেছিলাম। যখন জেনেছিলাম যে সূর্য দীঘল বাড়ীর জন্য তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাননি। তথ্যটি আমায় বেশ অবাক ও আহত করেছিল। কারণ সূর্য দীঘল বাড়ীর যে শিল্পমান, তাতে এই ছবিটির শিল্পনির্দেশকের পুরস্কৃত না হওয়াটা আমাদের ব্যর্থতাই। তাই সঙ্গত কারণেই যাঁরা এসব পুরস্কার কমিটিতে থাকেন, তাঁদের মান ও বিবেচনার প্রতি না একালে কোনো শ্রদ্ধাবোধ আছে, আর না সেকালে ছিল।
যদিও আমার এই অবাক হওয়াটায় তিনি উপভোগ করেছিলেন এবং খুব হেসেছিলেন। কিন্তু কিছু বলেননি।
আজ তিনি প্রয়াত হলেন। তাঁর ব্যক্তিত্বপূর্ণ অভিব্যক্তি ও নিরবতার মাঝেই আজ তাঁকে বিদায় বলতে হচ্ছে। ফারুক ভাই, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায় আপনার স্মৃতি আমাদের অন্তরে বিরাজ করবে।
ঢাকা। ১৭ এপ্রিল ২০২০
আন্তরিকভাবে নিবেদিত ও সুলিখিত। স্বল্প পরিসরে মহান শিল্পী মহিউদ্দিন ফারুক ভাইয়ের ব্যক্তিত্বের পরিচয় উঠে এসেছে। মামুনকে অনেক ধন্যবাদ।