গোদার পাঠ: ২

1234

লিখেছেন । লাবণ্য দে

আগের কিস্তি পড়তে এই বাক্যে ক্লিক করুন


গোদারের ছবি নিয়ে কথা উঠলেই প্রথম যে কথাটা শুনতে পাওয়া যায় তা হলো, গোদার দুর্বোধ্য। এখন, এই গোদারের ছবি বলতেও কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই গোদারের আর্লি, অর্থাৎ নিউওয়েভ ফেজ-এর [phase] ছবিগুলোর কথা বলা হয়ে থাকে। নিউ ওয়েভ ফেজের ছবিগুলোতেই আপাতত আলোচনা সীমাবদ্ধ রেখে এই ‘দুর্বোধ্য’ অপবাদের প্রশ্নটা নিয়ে ভাবা যেতে পারে।

গোদারের ছবি দেখতে গেলে সাধারণ দর্শকের অসুবিধা হয়, মনে হয় কঠিন ছবি।কিন্তু সিনেফিলেরা সেই গোদার নিয়েই অতি উৎসাহী হয়ে পড়েন। হিচকক বা বিলি ওয়াইলডার, তারান্তিনো বা বং জুন-হো— এনাদের ছবি নিয়ে এই দ্বন্দ্ব নেই। তাহলে কেন গোদার? গোদারের ছবি কি সত্যি কঠিন? গোদার কি দর্শকদের সাথে সংযোগ-স্থাপনে উৎসাহী নন? তা কিন্তু ঠিক নয়; অন্তত নিউ ওয়েভ-এর পর্বটাতে তো নয়ই।

আসলে ক্লাসিকাল হলিউডের স্টুডিও সিস্টেম থেকে চলে আসা যে ধ্রুপদী সিনেমা বানানোর পদ্ধতি, ধ্রুপদী গল্প বলার ধরণ– তার সাথে অভ্যস্ত হয়ে গেছে সকলেই। যেকোনো মেনস্ট্রিম ছবিই কম-বেশি এই ধ্রুপদী ন্যারেশানের নিয়ম মেনে চলে। অর্থাৎ দুটি চরিত্র কথা বলাকালীন ক্যামেরার ১৮০° নিয়ম, ছবিতে কন্টিনিউটি এডিটিং, ম্যাচ-অন অ্যাকশান ইত্যাদি।এছাড়াও আছে গল্পের একটি নির্দিষ্ট একমুখী চলন ও সমাপতন।


স্কুলের
সবথেকে
দুরন্ত যে ছেলেটা
স্কুলের সমস্ত নিয়মগুলো
নিয়ম করে ধূলিসাৎ
করতো– গোদার
হলেন ঠিক
সেই ছেলে

ক্লাসিকাল হলিউড এই পরিপাটি করে সিনেমার ভাষায় গল্প বলতে এতবেশি দক্ষ হয়ে যায় যে, স্টুডিও সিস্টেম ভেঙে পড়ার পরও পৃথিবীজুড়ে সিনেমার ইতিহাসে এই পদ্ধতি অনুসরণ হয়ে চলতে থাকে। অথচ সিনেমার ইতিহাস তো কেবল নিয়ম মানা ভালো ছেলেপুলেদের ইতিহাস না, বরং ছকভাঙা দুষ্টু ছেলেমেয়েরাই এই ইতিহাসকে কালে-কালে পুষ্ট করেছে। জ্যঁ-লুক গোদার হলেন এই দুষ্টুছেলের দলে। স্কুলের সবথেকে দুরন্ত যে ছেলেটা স্কুলের সমস্ত নিয়মগুলো নিয়ম করে ধূলিসাৎ করতো– গোদার হলেন ঠিক সেই ছেলে।

সিনেমার ইতিহাস যাকে পরে মাথায় তুলে রাখবে– ষাটের দশকে নিউ ওয়েভের প্রাক্কালে এই দামাল যুবকটি তখনো তা ঠাউরে উঠতে পারেননি। তিনি শুধু এটুকুই জানতেন, প্রতিষ্ঠিত নিয়ম যদি সুসজ্জিত রাজপ্রাসাদ হয়, তবে সেই রাজপ্রাসাদের বাইরে পড়ে আছে এক মাঠখোলা আকাশ। জ্যঁ-লুক সেই খোলা আকাশের ডাকে সাড়া দিয়ে তার নিচে এসে দাঁড়িয়েছেন, সিনেমায় গল্প বলেছেন, প্রেম করেছেন, রাজনীতি করেছেন, বিস্তর মজা করেছেন– কিন্তু পুরোটাই খোলা মাঠের মতো করে; প্রাসাদের নিয়ম সেখানে খাটে না।

সুতরাং, গোদারকে বুঝতে হলে প্রথমেই ওই রাজপ্রাসাদের থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, অচলায়তন ভেঙে নাম লেখাতে হবে দস্যি ছেলেমেয়ের দলে। কারণ এই দলে তো গোদার একা নন; রয়েছেন পৃথিবীর আরও অনেক অনেক ছবি করিয়ে। আপাতত সিনেমার একটি দস্যিছেলের গল্পেই মনোযোগ দেওয়া যাক।


গোদারের ছবির ফর্ম
কঠিন নয়; বরং
ব্যক্তিগত

সুসজ্জিত রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এলেও সেই প্রাসাদকে আজীবন ভালোবেসে গেছেন গোদার। তাই ক্লাসিকাল হলিউডের বহু ছবি ও পরিচালকের প্রভাব তার জীবনেঅ পরিসীম।তবে নিজে ছবি করবার সময় ছবির ফর্মে তিনি পরিবর্তন আনতে চেয়েছেন, বা বলা ভালো চিরাচরিত ছবির ফর্মকে গড়ে পিটে নিয়েছেন নিজের মতো করে। গোদারের ছবির ফর্ম তাই কঠিন নয়; বরং ব্যক্তিগত৷ একটু মনোযোগ দিলেই এই জগতে প্রবেশের প্রাথমিক অসুবিধা ছাপিয়ে আলো-বাতাসের গন্ধ পাওয়া যাবে।

জ্যঁ-লুকের প্রথম ফিচার লেন্থ ছবি ব্রেথলেস-এর প্রসঙ্গ দিয়েই শুরু করা যাক। ছবির শুরুতেই নায়ক বেলমদোঁ [মিশেলের চরিত্রাভিনেতা] নিজেকে এভাবে পরিচয় দেন– “After all, I’m an arsehole”। চিরাচরিত সিনেমার ইতিহাসের নায়কের সংজ্ঞা উলটে যায় শুরুতেই। প্রধান চরিত্র মিশেল-এর চরিত্রায়ণ গড়েই ওঠে এক রকমভাবে, যাতে নায়কের মহত্বের প্রত্যেকটি বিপরীত গুণ খুঁজে পাওয়া যাবে। তবে ফিল্মের বিষয় থেকে ফর্মের দিকে যদি সরে আসি, তবে দেখা যাবে গোদার ছবিতে কিভাবে গল্প বলছেন এবং কেন প্রথম দৃশ্য থেকেই ছবি দেখার অভিজ্ঞতায় একটা ধাক্কা লাগছে।

ব্রেথলেস-এর শুরুতে মিশেল খবরের কাগজ থেকে চোখ সরিয়ে ঠোঁটে বুড়ো আঙুল বোলাতে বোলাতে স্ক্রিনের ডানদিকে তাকায়, কাট হয়, কাউন্টার শটে দেখা যায় একজন মহিলাকে– যে স্ক্রিনের বাঁদিক থেকে ডানদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে মিশেলকে কিছু একটা ইঙ্গিত করে। এরপর একইভাবে এদের দুজনের আরও কিছু শট কাউন্টার শট আসে, এবং প্রতিটাতেই দুজনকে স্ক্রিনের ডানদিকে মাথা ঘুরিয়ে পরস্পরকে ইশারা করতে দেখা যায়। দুজনেই স্ক্রিনের ডানদিকের স্পেসে তাকানোর ফলে ওদের মধ্যে ঠিক সংযোগ তৈরি হয় না, বোঝা যায় কিছু একটা সঙ্গতির অভাব হচ্ছে, ওরা যেন পরস্পর পরস্পরের উলটো দিকে তাকাচ্ছে। যেকোনো কনভেনশানাল ছবির সামনাসামনি অবস্থান করা দুজনের কথোপকথনকে ধরতে চাইলে ক্যামেরা এমনভাবে রাখা হয় যাতে একজনকে স্ক্রিনের ডানদিক ঘেঁষে তাকাতে দেখলে আরেকজনকে বাঁদিক ঘেঁষে তাকাতে দেখা যায়– ফলে দুজনে যে দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে, এমন একটি ভাব তৈরি হয়। অথচ, গোদার তার প্রথম ছবির প্রথম শটেই এই সঙ্গতির প্রশ্নকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেন; বুনুয়েল ছুরি দিয়ে চোখ কেটে নতুন চোখের জন্ম নিতে আহ্বান দেন যেমন, গোদার ও তেমনি আমাদের আহ্বান করেন অন্য এক দেখার জগতে।

গোদার
ব্রেথলেস । প্রথম দৃশ্য

গোদারের জাম্প কাটের ব্যবহারও একইভাবে ব্যখ্যা করা যায়। জাম্প কাট হলো তাই, যাতে একটি শটের সাথে আরেকটি শটের মধ্যে কন্টিনিউটি বজায় না রাখবার ফলে দেখার অভিজ্ঞতায় jerk বা ধাক্কা লাগে। কন্টিনিউটি এডিটিং একটি ছবি দেখার অভিজ্ঞতার যে সামঞ্জস্যতা এবং স্থিতিশীলতা বজায় রাখে, জাম্প কাটের ব্যবহার তাকেই বিপন্ন করে তোলে। ডেভিড ব্রডওয়েল তার ‘Jump Cut and Blind Spot’ প্রবন্ধে জাম্প কাট নিয়ে বিবৃত করতে গিয়ে লেখেন : “jump cut is a continuity of viewpoint and discontinuity of duration”।

ব্রেথলেসজুড়ে জাম্প কাটের ব্যবহার একাধিক, তার মধ্যে একটি অংশ নিয়ে কথা বলা যাক। মিশেল পোকার গাড়িতে করে প্যাট্রিশিয়াকে তার অফিসে পৌঁছে দিতে যাচ্ছে। এইসময় গাড়ির মধ্যে ক্যামেরা প্যাট্রিশিয়ার দিকে তাক করা। ক্লোজ শটে প্যাট্রিশিয়ার ঘাড় অবধি দেখতে পাওয়া যায়, আর সাউন্ডে মিশেল অর্থাৎ অভিনেতা বেলমদোঁ একটানা কথা বলে চলে। ব্রেথলেস পূর্ববর্তী শর্ট ফিল্ম শার্লট অ্যান্ড হার বয়ফ্রেন্ড-এও বেলমদোঁকে প্রেমিকার সামনে একটানা বকবক করে যেতে দেখা যায়। গোদারের পরের পর ছবিতে প্রেমিকদের এমন বাচালতা ক্রমশ এক ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠবে। গাড়ির মধ্যে ক্যামেরা জঁসেবার্গের (প্যাট্রিশিয়ার চরিত্রাভিনেত্রী) দিকে তাক করা, বেলমদোঁ বলে চলে তার প্রেমিকার সুন্দর ঘাড়, সুন্দর বক্ষ, সুন্দর আওয়াজ, সুন্দর হাত, সুন্দর কপাল ইত্যাদি ইত্যাদি এবং প্রতিবার তার প্রতিটি বাক্যের শেষে একটি করে জাম্প কাট হতে থাকে।


জাম্প কাটকে
ছবির একটি বিশেষ
স্টাইলিসটিক মার্কার হিসেবে
ব্যবহার করতে থাকেন গোদার

তার এই কথা বলার সময় ক্যামেরা জঁসেবার্গের দিকে চুপচাপ একটানা স্থির হয়ে থাকতেই পারতো, তা না করে প্রতি কথার ছন্দে ছন্দে গাড়ির বাম্পারের মতো একেকটি জাম্প কাট হতে দেখা যায়। তার ফলে প্রেমিকের প্রেমিকার প্রতি আদেখলাপনার মতো সাধারণ এই দৃশ্যটির গঠনও ভীষণ মজাদার ও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। এই জাম্প কাটের ব্যবহার কিন্তু কোনো বৃহত্তর অর্থ তৈরি করতে চায় না, কেবল সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতাকে আরও মজাদার এবং নতুন রকম করে তোলে। জাম্প কাটকে ছবির একটি বিশেষ স্টাইলিসটিক মার্কার হিসেবে ব্যবহার করতে থাকেন গোদার।

ব্রেথলেস । গাড়িতে প্যাট্রিশিয়া

জ্যঁ-লুকের চতুর্থ ছবি ভিভরে সা ভি-এর কিছু দৃশ্য গঠনে আসা যাক। ভিভরে সা ভির প্রথম চ্যাপটারে নানা [আনা কারিনা অভিনীত] ও তার প্রেমিক একটি ক্যাফেতে দেখা করে যেখানে নানা এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসবার কথা বলে। এখন যেকোনো ধ্রুপদী কথোপকথন দৃশ্যে চরিত্র দুটি সামনাসামনি দাঁড়িয়ে বা বসে থাকে এবং ক্যামেরা এক চরিত্রের ঘাড়ের উপর দিয়ে আরেক চরিত্রকে দেখতে থাকে– শট কাউন্টার শটের ১৮০ ডিগ্রি নিয়ম মেনে তৈরি হয় দৃশ্যায়ন। গোদার এইসব থেকে সরে গিয়ে চরিত্র দুটিকে ক্যামেরার দিকে পিছন করে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে দেন, ক্যামেরার দিকে পিছন করেই তাদের কথোপকথন চলতে থাকে। দৃশ্যে বেশিরভাগ সময়েই নানার পিঠ অবধি মিড শট দেখতে পাওয়া যায়, শব্দে শোনা যায় দুজনকেই। নানা ক্যামেরার দিকে পিঠ করে ক্যাফেতে দাঁড়িয়ে, সামনের একটি আয়নায় নানার ঘষা প্রতিচ্ছবি, আয়নার মধ্যে দিয়ে মাঝেমধ্যে তার প্রাক্তন প্রেমিককেও দেখা যাচ্ছে আর সামনে দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে ক্যাফের ওয়েটাররা। কখনো ক্যামেরা একইভাবে নানার প্রেমিকের কাঁধে স্থির।

এইভাবেই ভিভরে সা ভির প্রথম কথোপকথনের দৃশ্য রচনা করেন গোদার। তারা যে পরস্পরের সাথে কথা বলছে তা বুঝতে কোনো অসুবিধা হয় না, কিন্তু ধ্রুপদী ছবি দেখবার অভ্যাসে আঘাত লাগে, গোদার ডাক দেন তার নিজের ছবির জগতে, উন্মুক্ত করে দেন ব্যক্তিগত ছবির ফর্মকে।

ভিভরে সা ভি । ক্যাফের দৃশ্য

ভিভরে সা ভি ছবিটির প্রতিটি কথোপকথনের দৃশ্যই বিভিন্ন নতুন নতুন আঙ্গিকে শুট করা হয়েছে। নানার চিঠি লেখবার পর তার পিম্প রাউলের কথা বলার দৃশ্যে নানাকে আর রাউলকে সামনাসামনি বসানো হয়। ক্যামেরা রাওলের পিছন দিক থেকে তাদের দেখতে থাকে। কখনো ডানদিকে প্যান করে, কখনো বামদিকে আর কখনো তাদের সমান্তরালে এসে ক্যামেরা স্থির হয়ে যায়। এর ফলে দৃশ্যে আনা কারিনার মুখ সামনে থেকে দেখা গেলেও রাউলকে দেখা যেতে থাকে কেবল তার পিঠের দিক থেকে আর ক্যামেরা সমান্তরালে স্থির হলে রাউলের পিঠের অবয়ব নানার শরীরকে ঢেকে দেয়। এইভাবেই তাদের দীর্ঘ কথোপকথনের দৃশ্য রচিত হয়, রাউলের সূত্রে নানা বেশ্ম্যাবৃত্তিতে যোগদান করে।

ভিভরে সা ভি । রাউল ও নানার কথোপকথন

শট কাউন্টার শটের একঘেয়ে চিরাচরিত পদ্ধতি কখনোই গোদারকে বিশেষ উৎসাহিত করেনি। মাসকুলা ফেমিনা-এর ক্যাফের দৃশ্যেও তাই একটানা ম্যাদেলিনের মুখে ক্যামেরা স্থির রেখে তার আর পলের কথাবার্তা চলতে থাকে। আবার খানিক পর ক্যামেরা পলের ক্লোজআপে স্থির হয়ে যায়- এবং তখনো শব্দে তাদের দুজনের কথাই চলতে থাকে একইভাবে। ক্যাফের দৃশ্যের পরেও তাদের যে দীর্ঘ কথোপকথনের দৃশ্য, সেখানেও শট গ্রহণের এই একই পদ্ধতি ব্যবহার করেন গোদার। ইন্টারভিউ মোডে চরিত্রদের কথা শোনা ও তাদের অভিব্যক্তিগুলোকে একটানা দেখে যাওয়া গোদারের অন্যতম প্রিয় একটি বিষয়।

বহুবার বহু ছবিতে তিনি চরিত্রদের ক্লোজআপ বা মিড শটে ক্যামেরা বসিয়ে রেখে ক্যামেরার পিছন থেকে প্রশ্ন করতে থাকেন। বেশিরভাগ সময়েই এই প্রশ্নগুলো জ্যঁ-লুকনিজেই করেন। কাউকে ইন্টারভিউ করা হলে সে যেভাবে উত্তর দিতে থাকে, ফিকশানাল গল্প চলাকালীন থেমে গিয়ে গোদার মাঝেমধ্যেই এই পদ্ধতি ব্যবহার করায় ফিকশানাল চরিত্র থেকে চরিত্রের মধ্যে থাকা অভিনেতা মানুষটির নন ফিকশান সত্ত্বা বেরিয়ে আসে যেন।

মাসকুলা ফেমিনা-এর একটি চ্যাপটারে এইভাবেই ম্যাদেলিনের এক বন্ধুর সাথে ইন্টারভিউ মোডে কথা চালান গোদার। সেখানে ম্যাদেলিনের সাথে মেয়েটির বন্ধুত্ব থেকে তার জীবনের প্রেম, যৌনতা, প্যারিস শহর, রাজনীতি সমস্ত প্রসঙ্গই উঠে আসে। ছবিটির আর কোনো অংশে এই মেয়েটিকে দেখতে পাওয়া যায় না, বা ছবিটির মূল ন্যারেটিভের সাথে এই দৃশ্যের কোনো সরাসরি যোগাযোগও তৈরি হয় না। কেবল এই দৃশ্যটি একটি স্বতন্ত্র ইন্টারভিউ-এর মতো করে ছবির মাঝে থেকে যায়, যেন পরিচালকের সাথে পারী নগরীর এক কথোপকথন।

ফোর হান্ড্রেড ব্লোজ-এর একটি দৃশ্যে দনিয়েলের সাথে যে বিখ্যাত ইন্টারভিউ মোড ব্যবহার করেন ত্রুফো, গোদারের ছবিজুড়ে তা বারংবার ফিরে ফিরে আসতে থাকে। কিছু সংলাপ স্ক্রিপটেড হলেও, কিছু সংলাপ হয়ে ওঠে চরিত্রদের ইম্প্রোভাইজ করা, যা ফিকশানের জগতের মধ্যে থেকেও মাঝেমধ্যে নন-ফিকশানের মতো ইলিউশানের এক বাতাবরণ তৈরি করে।

মাস্কুলা ফেমিনা । ইন্টারভিউ মোডের দৃশ্য

অ্যা ম্যারিড ওম্যান ছবিটিতে দম্পত্তির বাড়ির পার্টিতে তিনটি চরিত্র যথাক্রমে তিনটি বিষয় নিয়ে কথা বলে যেতে থাকে– ‘স্মৃতি’ [memory], ‘বর্তমান’ [Present] এবং ‘বুদ্ধিমত্তা’ [Intelligence]। এই বিষয়গুলির নামে ছবিটির এক একটি চ্যাপ্টার তৈরি হয় এবং সেই চ্যাপ্টারজুড়ে চরিত্রেরা এই বিষয়গুলির ওপর কথা বলে যায়। ক্যামেরা এক্ষেত্রেও সেই ইন্টারভিউ মোডে চলে যায়, চরিত্রের ক্লোজআপে স্থির হয়ে তাদের কথা চুপ করে শুনতে থাকে। কখনো কখনো ক্যামেরার ওপারের কিছু প্রশ্ন শুনে সেইমতো প্রতিক্রিয়া দিতে থাকে চরিত্রেরা, কিন্তু প্রশ্নগুলো দর্শক শুনতে পায় না।

অ্যা ম্যারিড ওম্যান । ইন্টারভিউ মোডের দৃশ্যায়ন

জ্যঁ-লুকের প্রথম পর্বের শেষের দিকের ছবিগুলোয় এই ফর্ম আর বেশি আত্মসচেতন হয়ে যায়। তাই লা শিনোয়াজ-এ জ্যঁ-পিয়ের লিও সংলাপ বলতে বলতে ফোর্থ ওয়াল ভেঙে ক্যামেরার দিকে তাকায়, তক্ষুণি তার কাউন্টার শটে দেখা যায় ক্যামেরা নিয়ে বসে আছেন রাউল কুতার। ব্রেশটিয়ান পদ্ধতি আসলে গোদারের খুব পছন্দের একটি বিষয়, সে নিয়ে পরের কোনো লেখায় বিস্তারিত লেখা যাবে।

লা শিনোয়াজ । জ্যঁ পিয়ের লিও ও তার কাউন্টারশটে রাউল কুতার

জ্যঁ-লুক আসলে প্রেমিক মানুষ, তার সিনেমার প্রেমে নিমজ্জিত প্রাণ সবসময় নতুনের সন্ধানে আগ্রহী। সে রাজপ্রাসাদের নিয়মকানুনের গণ্ডিকে পেরিয়ে তাই পৌঁছে যায় অন্য কোনোখানে। তার ছবি আসলে কঠিন হতে চায় না, হতে চায় না দুর্বোধ্যও; কেবল রাজপ্রাসাদের নিয়মমানা ছবি দেখার অভ্যাসকে নিয়ে ঠাট্টা করে নিজেই নিজের পদ্ধতি গড়ে তুলতে চায়। তাই অচলায়তনের ভিতর থেকে দর্শককেও ডাক পাঠায় তার উন্মুক্ত খোলা আকাশের নিচে।


পরের কিস্তি পড়তে এই বাক্যে ক্লিক করুন

Print Friendly, PDF & Email
সিনেমা ও সাহিত্য প্রেমী; বর্তমানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচ্চিত্রবিদ্যা বিভাগের স্নাতকোত্তরের ছাত্রী; যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই তুলনামূলক সাহিত্যে স্নাতক ।। পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here