নতুন সিনেমা

266
অমিতাভ পাল

লিখেছেন । অমিতাভ পাল

নিও রিয়ালিজম সিনেমাকে বাস্তবের যে স্তরে পৌঁছে দিয়েছিল, তা আর এখন সিনেমার প্রধান ধারা না। সিনেমা এখন পৌঁছে গেছে বাস্তব-অবাস্তবের মিশ্রণ মাখানো সময়ের এমন এক দ্রবণে, যা মূহূর্তেই কাছে চলে আসে আবার চলে যায় ধরা ছোঁয়ার অনেক বাইরে। সিনেমার এই বদলের মুল কারণ প্রযুক্তির উল্লম্ফন। এটা মানুষের কল্পনাকে এমন একটা শক্তি দিয়েছে, যা মানবজীবনের সবক্ষেত্রেই মানুষকে করে তুলেছে আরো ঘনিষ্ট, আরো চক্ষুষ্মান। চিকিৎসকরা এখন রক্তের একটা হিমোগ্লোবিনের সাথে ঘুরে বেড়াতে পারেন সারাটা শরীর জুড়ে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা দেখে নিতে পারেন অকল্পনীয় দূরের কোন গ্যালাক্সির রঙিন আগুন। সমুদ্রের গোপনাঙ্গেও পৌঁছে গেছে আমাদের বেহায়া আঙুল। সিনেমাই বা তাহলে কেন দূরে বসে থাকবে কোন ভীত গ্রাম্য বালকের মতো?

বসে থাকেনি– বরং মস্তিষ্কের কল্পনার জোরে অতীত-ভবিষ্যতকে যেভাবে নির্মাণ করে সাহিত্য, সিনেমাও সেই ক্ষমতা আয়ত্ব করে ফেলেছে প্রযুক্তির টুলবক্সের জোরে। অবশ্য আগেও সিনেমা সময়ের বিভিন্ন স্তরের রূপকথাকে জ্যান্ত করে তোলার চেষ্টা করতো, কিন্তু বর্তমানের সিনেমা শুধু চেষ্টাতেই থেমে থাকে না বরং তার তৈরি করা রূপকথাকে ভয়ংকর বিশ্বাস্য করে তোলে। এর উদাহরণ অ্যানিমেটেড মুভিগুলি। সেই অ্যাভাটারই ধরুন কিংবা হালের ব্লাডশট, সিনেমা আমাদের দেখিয়ে দেয় কিছুই অধরা না। আর আমরাও তার দেখানো সবকিছুকে ধরে নিয়ে পৌঁছে যাই সিনেমার বাস্তবে। এদিক থেকে সিনেমা যেমন পাচ্ছে এক বৃহত্তর ব্যাসার্ধে ছড়িয়ে পড়ার স্বাদ, তেমনি আমরাও টিকিট কেটে সত্যিকারের টাইম মেশিনের যাত্রী হয়ে উঠছি।

নতুন এই সিনেমা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মতো সব সম্ভবের জিনিস। একটা টিকিট কেটে, এক বাক্স পপকর্ন কিনে হলে গিয়ে বসে পড়লেই হলো, শ্রোয়েডিঙ্গারের বিড়ালের মতো সব সম্ভাব্যতাকে পর্দায় হাজির করবে সে। আর দর্শকও যাবতীয় জৈবিক আর ভৌতিক অভিজ্ঞতায় মাখামাখি হয়ে এক নতুন নিজেকে খুঁজে পাবে। প্রভাবিত করবার যে দারুণ শক্তি আছে সিনেমার, যার জন্য ঋত্বিক ঘটক সিনেমাকেই নিজের মাধ্যম করেছিলেন– এক নতুন মানবমনও তৈরি করে দিচ্ছে এই সুযোগে। এই মন অসম্ভবের দিকে হাত বাড়াতে দ্বিধা করে না। অসম্ভব বলে না কোনকিছুকেই।


একদা
ফটোগ্রাফির
সঙ্গে যে দ্বন্দ্ব তৈরি
হয়েছিল চিত্রশিল্পের– এবার
সিনেমার সাথে তার সেই
দ্বন্দ্বেরই যেন
আভাস
পাওয়া
যাচ্ছে

নির্মাণ ক্ষমতায় চিত্রশিল্পের ঘনিষ্ট হয়ে উঠছে নতুন সিনেমা। একটা সবুজ ব্যাকগ্রাউন্ডের সামনে দাঁড়িয়ে অভিনেতাদের অভিনয় করা দৃশ্যকে ক্যামেরায় ধরে তারপর কম্পিউটার সিম্যুলেশনের মাধ্যমে তাতে যেকোনো বাস্তবের অনুরূপকে বসিয়ে দিয়ে এক নতুন দৃশ্য তৈরি করা সিনেমা নতুন চিত্রশিল্পই তো নির্মাণ করে। রঙের পর রঙের স্তর বসিয়ে শিল্পীর ছবি আঁকার মতোই কম্পিউটারের পর্দায় সিনেমাও দৃশ্যের পর দৃশ্য সংযোজন করে তৈরি করে নিজেকে। আর ইম্প্রেশেনিজম বা এক্সপ্রেশনিজম কিংবা কিউবিজমের মতো আমাদের দেয় এক নতুন বাস্তবের খোঁজ। একদা ফটোগ্রাফির সঙ্গে যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল চিত্রশিল্পের– এবার সিনেমার সাথে তার সেই দ্বন্দ্বেরই যেন আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এ ধরনের দ্বন্দ্ব অবশ্য উপকারী– নিজের অস্তিত্বের প্রয়োজনেই এবার চিত্রশিল্পকে আরো আলাদা হয়ে ওঠার পথ খুঁজতে হবে। আর সিনেমাও এই দ্বন্দ্বের কারণে পৌঁছে যাবে এক নতুন চরিত্রে।

তবে নতুন এই সিনেমা সবচেয়ে বড় যে সংকটের মুখোমুখি, তাহলো– এর ব্যবহার খুব একমুখি। অর্থাৎ অ্যানিমেশনের জাদু ব্যবহার করে নিজেকে অন্যমাত্রায় তুলে আনার পরও সে কেবলি ব্যবহৃত হচ্ছে বিনোদনের কাজে। সিনেমার সবচেয়ে উর্বর বাগান যে হলিউড, সেও মেতেছে এই নেশায়। এখন সিনেমার উৎকর্ষ নির্ধারিত হয় কে কত টাকা কামালো– তাই দিয়ে। প্রথম সপ্তাহে বিক্রির রেকর্ড কে কতবার ভাঙলো– সেটাই হয়ে উঠছে সিনেমা সমালোচকদের প্রধান আলোচনা।


দেখাশোনার ফাঁক দিয়ে দর্শককে
প্রভাবিত করবার, নিজের
প্রচার করা শিক্ষায়
শেখাবার এক
জটিল
মনস্তাত্ত্বিক কাজ করে ফেলে সে

পুঁজির এই সর্বগ্রাসী সময়ে এটা হওয়াই স্বাভাবিক কিন্তু এতে প্রতিভার প্রয়োগ বড় একমুখি হয়ে যাচ্ছে। অথচ সিনেমা কি করতে পারে না, এই উত্তর খুঁজতে গেলে দিশাহারা হয়ে এর বহুমুখিতার কাছে মাথা নোয়াতে হয়। নির্মাণ ক্ষমতায় দিনকে রাত করে ফেলতে পারা এই অদ্ভূত নতুন জাদুকর দর্শকের কাছে দুইটা চোখ আর দুইটা কান ছাড়া কিছুই দাবি করে না– লেখাপড়া, ধনগৌরব, শ্রেণীগরিমা, বংশমর্যাদা কিছুই এর চাই না। শুধু তাকিয়ে দেখো আর শোনো। এরচেয়ে সহজ চাহিদা আর কি হতে পারে? তবে এই দেখাশোনার ফাঁক দিয়ে দর্শককে প্রভাবিত করবার, নিজের প্রচার করা শিক্ষায় শেখাবার এক জটিল মনস্তাত্ত্বিক কাজ করে ফেলে সে। এই কাজটাই সিনেমার বহুমুখিতার বীজ– তার আশ্চর্য ক্ষমতার উৎস।

একসময় আমাদের দেশে ডায়রিয়া প্রতিরোধে একচিমটি লবণ ও একমুঠ গুড় দিয়ে সরবত বানানোর একটা কৌশল দেখানো হতো টেলিভিশনে। সারাদেশের আপামর জনতার এটা শিখতে এবং প্রয়োগ করতে খুব বেশি সময় লাগেনি। শিক্ষক হিসাবে যার এরকম ক্ষমতা, তার ব্যবহারের ব্যাপারে সতর্ক হওয়াটাইতো বুদ্ধির কাজ। নতুন সিনেমা এই বুদ্ধির কাজে খুব একটা লাগছে না। ফলে মানুষের একটা আশ্চর্য শক্তি নষ্ট হচ্ছে। বিনোদন এবং টাকা কামানোর মেশিন বনে যাওয়া সিনেমাও এতে ক্লান্ত হচ্ছে নিশ্চয়ই। এদিকে তরুণ প্রযুক্তির মোহে আচ্ছন্ন আমরাও আপাতত প্রশ্ন করতে ভুলে গেছি, ভুলে আছি। নতুন সিনেমা তাই মাথা নীচু করে কলুর বলদের মতো খেটে যাচ্ছে সমানে। এতে অবশ্য একটা খুব বড় সুবিধাও হচ্ছে– সিনেমার শরীরে জং ধরছে না।

এই জং না ধরাটাই নতুন সিনেমার সম্ভাবনার রাস্তা। মানুষের সমাজে সবসময়ই এমনকিছু চরিত্র থাকে, যারা উল্টা স্রোতে সাঁতার কাটতে চায়, কাটে। নতুন সিনেমার সাথে এদের কারো দেখা হয়ে গেলেই সে পৌঁছে যাবে অন্যতর উচ্চতায়। ধৈর্য নিয়ে সেই সময়টুকু আমাদের খরচ করতেই হবে।

Print Friendly, PDF & Email

১টি কমেন্ট

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here