লিখেছেন । সায়ন্তন দত্ত

অ্যা ম্যারিড ওম্যান
Une femme mariée
স্ক্রিনরাইটার, ফিল্মমেকার । জ্যঁ-লুক গোদার
সিনেমাটোগ্রাফার । রাউল কুতার
এডিটর । অঁদ্রি শোতি
কাস্ট [ক্যারেক্টার] । মাশা মেরিল [শার্লট]; বার্নার্ড নোয়েল [প্রেমিক]; ফিলিপ লিরয় [স্বামী]
রানিংটাইম । ৯৪ মিনিট
ভাষা । ফ্রেঞ্চ
দেশ । ফ্রান্স
রিলিজ । ৪ ডিসেম্বর ১৯৬৪
চলতি একটা কথা আছে, ক্যাপিটালিজমের যখন কোনো সঙ্কটকাল আসে, তখনই শুধু তাকে সচেতনভাবে অনুভব করা যায়– অন্যথায় অক্সিজেনের মতো ক্যাপিটালিজম আমাদের ঘিরে থাকে; আমরা বুঝতেও পারি না। আমাদের শরীর, আমাদের মন, আমাদের দৈনন্দিন জীবন, ভালোবাসা, মনন– সবকিছু কীভাবে ক্যাপিটালিজম ঘিরে থাকে এবং ধীরে তাদের নিয়ন্ত্রকের আসন নিয়ে নেয়, স্বাভাবিক সময়ে স্বাভাবিক নিয়মে আমরা তা বুঝতে পারি না। বুঝতে পারি তখন, যখন জ্যঁ-লুক গোদারের মতো কোনো অস্বাভাবিক শিল্পী, যিনি স্বাভাবিক উপায় সিনেমা না বানিয়ে দৃশ্য-শব্দকে ক্রমশঃই অস্বাভাবিক করে তোলেন, তার কোনো ছবি দেখার প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে অভিজ্ঞতায় স্বাভাবিক ক্যাপিটালিজম ক্রমশঃ অস্বাভাবিক হতে শুরু করে– জীবনযাপনের প্রতিটি ক্রিয়াকে একটু একটু করে আন্ডারলাইন করে গোদারের ছবি দেখিয়ে দিতে থাকে অজান্তে আমাদের সকল জীবন ধনতন্ত্রের পণ্যকে লক্ষ্য করেই নির্মিত।
অ্যা ম্যারিড ওম্যান গোদারের শিল্পীজীবনের অত্যন্ত সক্রিয় প্রথম পর্বে নির্মিত– ১৯৫৯’র সাড়া জাগানো ব্রেথলেস এবং ছবির শেষ টাইটেলে সিনেমার সমাপ্তি ঘোষণা করা ১৯৬৭’র উইকেন্ড অবধি সময়ে, যেখানে আট বছরে গোদার পনেরোটা পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি [শর্টফিল্ম আছে খান চারেক] নির্মাণ করেছিলেন। এই ছবিগুলির অনেকটাই সমসময়ে একইসঙ্গে চূড়ান্ত তিরস্কৃত এবং পুরস্কৃত– তুলনায় আমাদের আলোচ্য অ্যা ম্যারিড ওম্যান খানিক উপেক্ষিত, অন্তত প্রাতিষ্ঠানিক স্তরে [কোনো ফেস্টিভ্যাল প্রাইজ এর ভাগ্যে জোটেনি, ভেনিসে যদিও প্রথমবার দেখার পরে আন্তোনিওনি গোদারকে ব্যক্তিগতভাবে অভিনন্দন জানান]।
কাইয়ে ক্রিটিকরা ছবিটির প্রশংসা করেছিলেন, আর ফ্রেঞ্চ সেন্সরশিপ বোর্ড ছবিটিকে ব্যান করতে চেয়েছিল, ছবির নাম শুরুতে ‘দ্য ম্যারিড ওম্যান’ থাকার কারণে। ছবিটিকে ব্যবসায়িকভাবে ফ্রান্সে মুক্তি পেতে নাম বদলে অ্যা ম্যারিড ওম্যান করা হয়।
ছবিটি সম্পর্কিত কোনো সহজবোধ্য প্রাইমার বা মানেবই লেখার উদ্দেশ্য আমার নয়। অ্যা ম্যারিড ওম্যান গোদারিয়ান ছবির ফর্মে কোলাজধর্মী, একইসঙ্গে অনেককিছু বিষয় নিয়ে কথা বলে সে। এর মধ্যের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা, যেমন হলোকাস্ট সম্পর্কিত কথা, মধ্যিখানের ইন্টারভিউ-সদৃশ দীর্ঘ দার্শনিক আলোচনার প্রসঙ্গ বাদ রেখে আমি মনোনিবেশ করব মূলত তিনটি [কিংবা দুটি] দৃশ্যে– যেখানে সংলাপের চেয়েও ইমেজ এবং সময় সময় শব্দনির্মাণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে ছবির মূল অন্যতম প্রধান বক্তব্যে আমাদের পোঁছতে সাহায্য করে।
…
গোদার
এই সামান্য
গল্পকে প্রায় আক্রমণ
করেন অসামান্য কিছু
ইমেজ এবং সাউন্ড দিয়ে
…
আপাতভাবে অ্যা ম্যারিড ওম্যান অতি সাধারণ একটি ত্রিকোণ প্রেমের গল্প– গোদারের ছবি অধিকাংশ সময়েই যা হয় আর-কি। শার্লট নামের এক অল্পবয়সী মেয়ে তার স্বামী এবং তার প্রেমিক– দুজনের সঙ্গেই সম্পর্কে জড়িত। তার জীবনের আড়াইখানা দিন আমরা দেখি, যেখানে গল্পের হিসেবে সে বিবাহিত তা ধরা পড়ে এবং তার প্রেমিকের সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়। কিন্তু, গোদারের ছবি যেমন, এটুকু বললে কিছুই বলা হয় না– কারণ গোদার এই সামান্য গল্পকে প্রায় আক্রমণ করেন অসামান্য কিছু ইমেজ এবং সাউন্ড দিয়ে। তারই কিছু কিছু অংশ আমরা পড়ার চেষ্টা করব।

ছবির প্রথম প্রায় ছয় মিনিট দৃশ্যগত ভাবে ‘অস্বাভাবিক’, বিমূর্ত, ভীষণই স্টাইলাইজড একটি যৌনমিলনের দৃশ্য। ‘স্বাভাবিক’ অর্থে চলচ্চিত্রে যৌনমিলনের দৃশ্য বলতে আমাদের যা যা জিনিস মনে আসে– ছবিতে সেগুলো ঠিক তাই তাইই না; অর্থাৎ, ‘স্বাভাবিক’ দুটো মানুষের রতিক্রিয়ার কোনো ইমেজ বা সাউন্ড ছবিতে নেই। বদলে আছে [ছবিতে এই দৃশ্য থেকে প্রায় প্রতিটি শট নিয়ে একটি কোলাজ ইমেজ উপরে দেওয়া হয়েছে] টুকরো হাত, টুকরো পা, টুকরো গলা, শরীরের টুকরো অংশের ছবি। চলচ্চিত্রের ইমেজ যে ‘রিয়েলিজম’ বা ‘ন্যাচেরালিজম’র উপর ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রে নির্ভরশীল, এ ছবির এই দৃশ্যটি [গোটা ছবিটাই] তাকে প্রায় বাদ রেখে ‘অদ্ভুত’, ‘অস্বাভাবিক’ এক কাষ্ঠলতায় নির্মিত।
বিমূর্ত এই স্টাইলাইজেশন অবশ্যই গোদারের স্বাভাবিক চলচ্চিত্রের ইমেজকে ঠেলতে ঠেলতে নতুনভাবে দৃশ্য নির্মাণের একটি প্রচেষ্টা; কিন্তু শুধুই স্টাইলাইজেশনের জন্য বিমূর্তকরণ বললে এই দৃশ্যকে শুধুই ফর্মালিস্টিক বলে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। গোদার এই বিমূর্ত দৃশ্যের ভিতর থেকে কিছু যেন খুঁড়ে বের করার চেষ্টা করছেন– ছবিতে তিনবার ফিরে ফিরে আসা এই ধরনের যৌনদৃশ্যগুলি থেকে এ বুঝতে আমাদের অসুবিধে হয় না।
…
বই
থেকে রিডিং
পড়ার মতো বিচ্ছিন্ন
উচ্চারণে চরিত্রেরা
যেন প্রেম
নিবেদন
করে
…
লক্ষ্যণীয়, এ দৃশ্যগুলির শব্দের ট্র্যাক বেশিরভাগ সময় নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ। কখনো অভিনেতারা কথা বলেন– আই লাভ ইউ। কিন্তু এই ‘আই লাভ ইউ’ সম্ভাব্য সকলরকম ‘আই লাভ ইউ’র তুলনায় ঠান্ডা, নিষ্ক্রিয়। বেটোভেনের স্ট্রিং কোয়াট্রেট’র করুণ সুর আবহে বেজে চলে, আর প্রায় বই থেকে রিডিং পড়ার মতো বিচ্ছিন্ন উচ্চারণে চরিত্রেরা যেন প্রেম নিবেদন করে। দৃশ্যগুলি কোনোরকম যৌনউত্তেজনা জাগানো তো দূরের কথা, বিমূর্ত ফর্মালিস্ট শিল্পের মতো দর্শক থেকে বিযুক্তি চায়, দর্শককে দূরে ঠেলতে চায়। জীবনানন্দের কবিতা মনে পড়তে পারে আমাদের,
‘পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়,
জানি আমি; –তারপর আমাদের দুঃস্থ হৃদয় কী নিয়ে থাকিবে বলো।’
আমরা লক্ষ্য করি, এ দৃশ্যের প্রধান যোগসুত্র যেন এক ধরনের বিযুক্তি। হাত, তা যেন বাকি শরীরের থেকে বিযুক্ত; শরীর, তা যেন চরিত্র থেকে বিযুক্ত। কন্ঠ– তা বিযুক্ত চরিত্রের শরীর থেকে, আদর– তা বিযুক্ত শরীরের প্যাশন থেকে। চরিত্রদের শরীর, কন্ঠ, আদর– সবকিছু একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেন সাদা চাদরে মরুভূমির মতো শূন্যতা তৈরি করে, যেন শব্দের ট্র্যাকের ধূসর নিস্তব্ধতায় এক্ষুণি হু হু করে হাওয়া দিয়ে উঠবে, আর বালি ঝরে পড়বে সমসময়ের জাপানি ছবি ‘মরুভূমির নারী’র মতন।বিখ্যাত চলচ্চিত্র সমালোচক রিচার্ড ব্রডি গোদারকে নিয়ে যে বই লেখেন, তার অ্যা ম্যারিড ওম্যান সংক্রান্ত অধ্যায়ে এই দৃশ্যটি আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন, দৃশ্যটি যেন ‘traces of an erotic disaster’।
কিন্তু কেন? কেন এমন শূন্যতা, কেন এমন হাহাকার? অনেকেই গোদারের ব্যক্তিগত জীবনে এর কারণ খুঁজবেন– যেভাবে রিচার্ড ব্রডি দেখান এ ছবি কীভাবে গোদার, আনা কারিনা এবং আনা করিনার এক প্রেমিকের সম্পর্কের এক প্রতিরূপ। ব্যক্তিগত হতাশা কিংবা অবসাদ ছবির এ শূন্যতার কারণ হিসেবে উঠে আসতেই পারে; কিন্তু আমরা বেশি উৎসাহী ছবির মধ্যে, ছবির ইমেজ-সাউন্ডেই তার কারণ খুঁজে বের করায়। এবং এ লেখা শুরু হয়েছিল যে কথা বলে– আমরা এবার সেই প্রসঙ্গে ঢুকব ছবির মধ্যিখানের সবচেয়ে এবং নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বেপরোয়া অংশটির মধ্যে।
এই দৃশ্যের ইঙ্গিত আমরা আগেই পাই, যখন ছবির পঁচিশ মিনিট নাগাদ শার্লট তার সাজঘরে অন্তর্বাস পরে একটি ম্যাগাজিন থেকে আদর্শ স্তনের দৈর্ঘ্য সংক্রান্ত উপদেশ পড়ে এবং তার নিজের বুক ফিতে দিয়ে মেপে দেখে তা কতখানি ঐ উপদেশের কাছাকাছি। দৃশ্যটি খুব স্পষ্ট এবং মোটা দাগের একটি স্যাটায়ার– নাওমি উলফের দ্য বিউটি মিথ প্রকাশের প্রায় পঁচিশ বছর আগে গোদার বাজারচালিত সৌন্দর্য্যের ধারণায় কীভাবে মানুষের ব্যক্তিগত শারীরিক সৌন্দর্য্যের ধারণা তৈরি হয়, তা দেখাতে থাকেন। শার্লট ফিতে দিয়ে বিভিন্নভাবে তার স্তনের দৈর্ঘ্য মাপতে থাকে, সঙ্গে ম্যাগাজিন থেকে পড়তে থাকে কোনটা গোল্ডেন রেশিও আর কোনটা যথেষ্ট মাপের স্তনের দৈর্ঘ্য নয়।

ইমেজে এবং সংলাপে স্পষ্ট স্যাটায়ারে যে বিষয় এখানে বলা হয়, আমাদের আলোচ্য দৃশ্যে গোদার তাকেই ঠেলতে ঠেলতে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যান। দৃশ্যটি শুরু হয় ক্রাইটেরিয়ন কালেকশনের রেস্টোর্ড প্রিন্ট অনুযায়ী একঘণ্টা দু মিনিট থেকে। শার্লট একটি সুইমিং পুলে আসে এবং গোদারিয়ান ভঙ্গিতে একটি বড় নাম-লাইটিং-এর ওপর এক্সট্রিম ক্লোজ-শটে একটি প্যান হয়– যেখানে দুবার ক্যামেরা স্থিত হয়, দেখা যায় Mer [ফরাসি ভাষায় সমুদ্র], Ame [ফরাসি ভাষায় আত্ম, ভালো বোঝা যায় ইংরেজি শব্দের অনুরণনে– Soul]। এখানে বলে রাখা দরকার, ‘soul’ শব্দটার প্রতি গোদারের ফ্যাসিনেশনের কথা। সেই কবে ’৬০ সালে তার দ্বিতীয় ছবিতে গোদার চরিত্রদের মুখ দিয়ে বলিয়েছিলেন, ক্যামেরা দিয়ে কোনো মুখের ছবি তোলা হলে, তার আত্মার ছবিও তোলা হয়। ক্যামেরার সামনে ছিলেন তখন গোদারের প্রেমিকা আনা কারিনা। পরে আনা’কে নিয়েই গোদার চতুর্থ ছবি ভিভরে সা ভি’তে এই প্রশ্নটার ওপর নির্ভর করেই যেন আনার ক্লোজ শটগুলি তুলতে থাকেন, আর ফিসফিস করে যেন বলেন, এ ছবি শরীর না আত্মার?
অ্যা ম্যারিড ওম্যান ছবির এই দৃশ্যে সুইমিং পুলের সামনে যে শব্দটির ক্লোজআপ নিয়ে, শব্দটি থেকে খুঁড়ে গোদার এই দুটি আলাদা শব্দ বের করে আনেন– সেই শব্দটি সম্ভবত America [শব্দের পুরোটা আমরা দেখতে পাই না, শুধু mer এবং ame– এই দুটো খণ্ডাংশ দেখা যায়]। গোদারের পরবর্তী ফিল্ম-জীবনের তীব্র রাজনৈতিক বাঁক যেন আগে থেকে ছুঁয়ে যায় এই অংশে, যেখানে আমেরিকা শব্দের সঙ্গে সমার্থক শব্দ হিসেবে গোদার বসান ক্যাপিটালিজমকে। শুধু আমেরিকাই নয়, বরং ক্যাপিটালিস্ট একধরনের জীবনযাপন যেখানে সবকিছু থাকলেও ‘soul’, ‘আত্ম’র ব্যপক অনুপস্থিতি; তাই পরবর্তী দৃশ্যে আমরা দেখব ধনতন্ত্র একধরনের জীবনযাপন তৈরি করে কীভাবে তা ‘আত্ম’শূন্য প্রতিকৃতিতে মানুষকে পর্যবসিত করছে।
ক্যামেরা সহযোগে একটি ফ্যাশন-মডেলিং জাতীয় শ্যুটিং চলছে সুইমিংপুলে, আমরা দেখি। গোদার তীব্র আক্রমণাত্মক হয়ে যান– ফ্যাশন শ্যুটিং’র সেই ইমেজ নেগেটিভে আমরা দেখতে থাকি। পরপর কিছু ছবি আগে আমরা দেখে নেব, নইলে শুধু কথা এ ইমেজের গভীরতা বর্ণণা করতে পারবে না।

গোদার জানেন তিনি যে মাধ্যমে কাজ করছেন, সেটাও এই ফ্যাশন ফটোগ্রাফির মতোই নারীকে পণ্য করেই দেখে অধিকাংশ সময়ে। তাই যে ছবি যৌনগন্ধী পণ্য হওয়ার কথা ছিল, নেগেটিভ ইমেজে সে ছবিকে ভৌতিক লাগে– একটানা ক্লোজ শটে দেখতে দেখতে ভয় লাগে আমাদের। কোনো মেয়ের নাক চোখ মুখের অন্ধকার অংশ সাদা হয়ে নেগেটিভ ইমেজে ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায়– পণ্য সভ্যতার নির্যাসকে গোদার আক্রমণ করেন ইমেজের এহেন বিকৃতকরণে।
…
যে
ছবি
যৌনগন্ধী
পণ্য হওয়ার কথা
ছিল, নেগেটিভ ইমেজে
সে ছবিকে ভৌতিক লাগে
…
এরপরের অংশটি আরও সাহসী, আরও আক্রমণাত্মক। শার্লট সুইমিংপুলেরই একটি ক্যাফে’তে বসে দেখতে একটি ম্যাগাজিন দেখতে থাকে। তার পিছনের চেয়ারে দুটি অল্পবয়সী মেয়ে তাদের প্রথম যৌনতার কথা বর্ণণা করে– আর রাউল কুতারের ক্যামেরা প্যান করে ম্যাগাজিনের অজস্র ব্রা পরিহিত মহিলার ছবির ওপর দিয়ে। সাউন্ডট্র্যাকে আমরা শুনি যৌনতার বিবরণ, সঙ্গে ইমেজের মন্তাজ চলতে থাকে যৌনতার পণ্যের ছবির ওপর দিয়ে। একটি পপ মিউজিকের সাথে করে প্রায় ছ’মিনিট ধরে এই দৃশ্যটি চলে, একের পর এক ইমেজের মন্তাজে দর্শকের চোখ ধাঁধিয়ে দেন গোদার।

পণ্যে মোড়া এক ‘স্বাভাবিক’ পৃথিবীর কথা যখন চলচ্চিত্র তার নিজস্ব শারীরিক ‘অস্বাভাবিকতা’য় আমাদের দেখাতে থাকে, আমরা ক্রমশঃ বুঝতে থাকি– মানুষেরা আর যেন মানুষ নেই, ক্রমশঃই তারা পণ্যের নির্ধারিত, বাজারের নির্ধারিত মানুষ হতে থাকছে। তাদের শারীরিক সৌন্দর্য্য, তাদের প্রেম, ভালোবাসা, তাদের ব্যক্তিগত আবেগ অনুভূতি সবই নির্ভর করছে পণ্যের পৃথিবীর ঠিক করে দেওয়া কিছু ইমেজের মাধ্যমে– যেখানে সব নারী আদর্শ চেহারার, সব পুরুষ আদর্শ চেহারার– ইমেজ শুধু মানুষের নির্মিত ইমেজ নয়, ইমেজই নির্মাণ করতে থাকছে মানুষকে। ইমেজের কৃত্রিম মেয়ের কৃত্রিম ব্রা পরা বুকের কৃত্রিম ক্লিভেজ যা সততই দর্শকের চোখকে আহ্বান জানায় সে ইমেজের শরীর গিলে ফেলার জন্য– পৃথিবীজোড়া এই ইমেজই যেন ঠিক করে দিচ্ছে মানুষে মানুষে সম্পর্কের কথা। তাই একা, নিজের সঙ্গে থাকা শার্লটকে আমরা শুধু দেখি ম্যাগাজিনের উপদেশ মতো বুকের মাপ ঠিক করতে– ‘নিয়ন আলোয় পণ্য হলো যা কিছু সব ব্যক্তিগত’।
বলা বাহুল্য এহেন কৃত্রিম বাণিজ্যিক পৃথিবীতে যৌনমিলনও তো কাষ্ঠলই হবে– শিল্প তাকে তো বিযুক্তভাবে, মরুভূমির মতো, ধ্বংসের মতো করে দেখাবে। গোদারের ছবির যৌনতার দৃশ্য তাই মরুভূমির শূন্যতার খাঁ খাঁ করে, বিযুক্ত শরীর, কন্ঠ আর আদরের মাঝে যেখানে শত শত মাইলের ব্যবধান। ফ্রান্সে ছবিটি যখন সেন্সারে আটকে যায়, গোদার সে ঝামেলা মেটাবার পর মন্তব্য করেছিলেন, ‘সেন্সর বোর্ডের লোকেরা বোধহয় ঠিকই বুঝেছে, কারণ বিষয়টা রাজনৈতিক। আমার ছবি এক বিশেষ ধরনের জীবনচর্যাকে আক্রমণ করে, যে জীবন শুধু এয়ার কন্ডিশানিং আর এডভার্টাইসজমেন্টের ওপর নির্ভরশীল।’

ভাবতে অবাক লাগে, ‘আমেরিকা’র মেটাফরে গোদার যে পৃথিবীকে দেখেছিলেন আজ থেকে প্রায় পঞ্চান্ন বছর আগে; সেই পণ্যের পৃথিবী আজ কী অসীম ক্ষমতায় একেবারে আক্ষরিক অর্থে আমাদের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। সোশ্যাল মিডিয়া এবং ডিজিটাল মিডিয়ার ইমেজের যে নিরন্তর দৌরাত্ম, তাকে যদি কেউ ফিল্ম করেন, তা বুঝি দেখতে হবে এই ছবির মতো– একের পর এক যৌন-উত্তেজক ছবি– লক্ষ্যণীয় যার নির্মাণে শুধুই পুরুষ ক্যামেরাম্যান নেই আর; আর সেই ইমেজের মাঝে মানুষ শার্লটের এই ছবির মতোই বামন, ক্ষুদ্র। গোদারের ছবি এক অর্থে প্রফেটিক– আজকের পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে কনজিউমার সংস্কৃতির যে সীমাহীন বিস্ফোরণ হয়েছে, তা দিয়ে বুঝি শুধু ছয় মিনিট না, গোটা একটা ফিল্মই বানিয়ে নেওয়া যায়।
এমন এক পৃথিবী, যেখানে প্রেম নেই, ভালোবাসা নেই– মানুষ শুধু ইমেজ, ইমেজ আর ইমেজ নির্মিত যন্ত্র। গোদারের ছবির শেষ ইমেজে প্রজেক্টরের রোল থেকে ফিতে শেষ হয়ে যাওয়ার মতো করে [পারসোনার ইমেজ মনে করুন] মানুষ পরষ্পরের থেকে হাত সরিয়ে নেয়– পর্দাজুড়ে পড়ে থাকা ধূসর মরুভূমি শুধু– ধবধবে সাদা বিছানার চাদর। চরিত্রদের সংলাপে সমাপ্তির ঘোষণা শুধু গল্পের চরিত্রদের ভালোবাসার শেষই নয়; বরং এক ধরনের সভ্যতার আগামী ধ্বংসের আভাস দিয়ে যাওয়া হয়। ক্যামেরা-শব্দযন্ত্র নিয়ে সেই ধ্বংসের সভ্যতার ইমেজ-সাউন্ড নির্মাণ করে চলেন জ্যঁ-লুক।