লিখেছেন। জিম ইসমাইল

দ্য ব্রেড অ্যান্ড অ্যালি
মূল শিরোনাম : Nān o Kūcheh
স্ক্রিপ্ট ও ডিরেকশন : আব্বাস কিয়ারোস্তামি
রানিং টাইম : ১০ মিনিট
রঙ : সালাকালো
ভাষা : ফার্সি
নির্মাণকাল : ১৯৭০
ষাটের দশক। তখনও ইরান আধুনিক চলচ্চিত্রের মক্কা হয়ে ওঠেনি। সদ্য ফরাসি নবতরঙ্গের ঢেউ এসে পৌঁছেছে ইরানি চলচ্চিত্রে। দারিউস মেহরজুই’র দ্য কাউ ইরানি চলচ্চিত্রে নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত খুলে দিয়েছে।আরও কয়েকজন ‘নিউ ওয়েভ’ পরিচালক উঠে আসছেন।
ইরানে তখন শাহ্-র আমল। ‘ইসলামিক মূল্যবোধ’-কে অক্ষুন্ন রেখে তবে ছবি তৈরি করা যাবে।সরকারবিরোধী উচ্চারণ থাকবে না। তো, রাষ্ট্রের এই নিষেধাজ্ঞা আর সেন্সরশিপের কড়াকড়ির সঙ্গে সমানে দর কষাকষি করে চলচ্চিত্র সৃষ্টি করে চলেছেন এই কয়েকজন তরুণ পরিচালকেরা। এ রকম এক সময়ে এই পরিচালকদের মধ্যে থেকে উঠে আসছেন এক গেরিলা পরিচালক– আব্বাস কিয়ারোস্তামি। যার সম্পর্কে পরবর্তীকালে গোদার বলবেন, ‘চলচ্চিত্রের শুরু ডি. গ্রিফিথকে দিয়ে, আর শেষে থাকবেন আব্বাস কিয়ারোস্তামি’।

ফিল্মমেকার। আব্বাস কিয়ারোস্তামি
ইরানি সিনেমার সাধারণ বৈশিষ্ট্য শিশু চরিত্রের প্রাধান্য। কিয়ারোস্তামির ছবিতেও তাই। কিন্তু কেন?
এর অনেকগুলো দার্শনিক কারণ ছাড়াও অন্যতম একটা কারণ হলো, ১৯৬৫ সালে তৎকালীন ইরান সরকার শিশুদের বৌদ্ধিক বিকাশের জন্য ‘ইন্সটিট্যুট্ ফর দ্য ইন্টেলেকচুয়াল ডেভেলপমেন্ট অব চিলড্রেন অ্যান্ড ইয়াং অ্যাডাল্টস [আইআইডিসিওয়াইএ]’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করে। এই সংস্থা শিশুদের জন্য আরও অন্যান্য কাজ ছাড়াও চলচ্চিত্র তৈরি করে। কিয়ারোস্তামি এই সংস্থার প্রযোজনায় বেশ কয়েকটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের ‘শিশুকেন্দ্রিক’ ছবি তৈরি করেন। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম দ্য ব্রেড অ্যান্ড অ্যালি। কিয়ারোস্তামির প্রথম ছবি।
দ্য ব্রেড অ্যান্ড অ্যালি আজ থেকে ঠিক পঞ্চাশ বছর আগে, ১৯৭০ সালে মুক্তি পায়। এগারো মিনিটের ছোট ছবি। একটিও সংলাপ নেই। গল্পটা এ রকম– একটি বাচ্চা ছেলে হাতে রুটি নিয়ে বাড়ি ফিরছে। বাড়ির গলির মুখে ঢোকার সময় হঠাৎ দেখে একটি কুকুর সেই গলিতে বসে আছে। তাকে দেখে কুকুরটি ঘেউ ঘেউ করতে শুরু করে। ছেলেটি এগোতে গেলে কুকুরটিও সঙ্গ নেয়, পথ আগলে ধরে। একে কাঠফাটা রোদ্দুর, তদুপরি কুকুরের চিৎকার; ছেলেটি ভয় পেয়ে গলির মুখে দাঁড়িয়ে পড়ে। অপেক্ষা করতে থাকে অন্য কোনো পথচারীর জন্য– যার সঙ্গ নিয়ে সে গলিটা পেরোতে পারে। তাকে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। এই সময়টাই কিয়ারোস্তামির ক্যামেরা ছেলেটির সঙ্গে অপেক্ষা করতে থাকে। দর্শক ক্লোজআপে তার কার্যকলাপ নিরীক্ষণ করে যায়।

এরপর একজন বয়স্ক পথচারী আসেন। ছেলেটি সঙ্গ নেয়। কিন্তু লাভ হয় না; কারণ বয়স্ক ভদ্রলোক কিছুক্ষণ এগিয়ে অন্য এক গলিতে ঢুকে যান। এবারে ছেলেটি সতর্ক সাহসে একা একাই এগোতে থাকে। কুকুরটি চিৎকার করে এগিয়ে আসে বটে, কিন্তু ছেলেটি রুটির এক টুকরো কুকুরটিকে ছুঁড়ে দেয়। ছেলেটি শেষ পর্যন্ত বাড়ি পৌঁছে যায়।
ছবিটা এখানে শেষ হয়েও শেষ হয় না। সেই গলিতে এবার আর একটি বাচ্চা ছেলের উদয় হয়। হাতে বোঝা। সে এগোতে গেলে কুকুরটি চিৎকার করে ওঠে। ছেলেটি চমকে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। তার এই হতবিহ্বল মুখকে ক্লোজআপে ফ্রিজশটে কিছুক্ষণ স্থির করে রাখা হয়। জিজ্ঞাসার মতো অনেকটা। ছবি শেষ হয়।
…
ছবির
শিশুটির
চোখে এই বিশাল
পৃথিবী কঠিন এবং ভয়ংকর;
কিন্তু শেষমেশ অপরাজেয় নয়
…
ইরানি ছবিতে ‘চাইল্ড’স গেজ’ বা ‘শিশুর দৃষ্টি’ ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর দৃষ্টিতে বাস্তব প্রতিভাত হয়। ছবির শিশুটির চোখে এই বিশাল পৃথিবী কঠিন এবং ভয়ংকর; কিন্তু শেষমেশ অপরাজেয় নয়। ছেলেটি হয়তো এই প্রথম অভিভাবকহীন একা পথ চলছে। এই অভিজ্ঞতার ফলে সে শৈশবের গণ্ডি পেরিয়ে প্রবেশ করছে কৈশোরে। চোখের সামনে উন্মুক্ত হচ্ছে জগৎ।

‘‘এই যে অলিগলি ঘোরা, এই যে ঘুরতে ঘুরতে ‘বাড়ি’ ফেরার ইচ্ছে, আর চলতি পথ আগলে ধরা ক্ষুধার্ত প্রাণের আকুতি কিংবা হুঙ্কারের সঙ্গে খানিকটা বোঝাপড়া করে জীবনের শ্বাশ্বত অর্থময়তা খুঁজে নেওয়া–এই জার্নির এ ছিল কেবলই শুরু”।*
এই ছোট ছবির এই ছোট জার্নি খুব সহজেই মিলে যায় সমগ্রের সঙ্গে। দ্য ব্রেড অ্যান্ড অ্যালির এই জার্নিকে কিয়ারোস্তামি আরও এগিয়ে নিয়ে যান তার দ্য ট্রাভেলার (১৯৭৪) এবং হোয়্যার ইজ মাই ফ্রেন্ড’স হাউস? (১৯৮৭) ছবিগুলোতে।
এবার আসা যাক পরের ছেলেটির কাছে। সে কি পারবে এই উদ্ভূত পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে? আগের ছেলেটি যে উপায়ে পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছে, সেই একই উপায় কি এই নতুন ছেলেটির ক্ষেত্রেও গ্রাহ্য হবে? জানানো হয়নি।
চলচ্চিত্রবিদ্যার শিক্ষক মানস ঘোষের পর্যবেক্ষণ: ‘‘কিয়ারোস্তামির ছবির গল্প শেষ হয় এমনভাবে যাতে সহজ ‘ক্যাথারসিস’-এর বদলে নতুন একটা প্রশ্নের উদয় হয়-আর উত্তর খোঁজার দায় ন্যস্ত হয় দর্শকের উপর।”
দর্শক ভাবতে থাকুন।
গ্রন্থ-ঋণ
মানস ঘোষ, চলচ্চিত্রে তৃতীয় দুনিয়া, ইরান, বৈ-চিত্র প্রকাশন,২০১৯
* রুদ্র আরিফ, কিয়ারোস্তামির সিনে রাস্তা, প্রতিভাস, ২০১৭