স্মৃতির তারকোভস্কি: নাতালিয়া বন্দারচুক [২]

187
নাতালিয়া বন্দারচুক

মূল । নাতালিয়া বন্দারচুক
অনুবাদ । রুদ্র আরিফ

গ্র ন্থ সূ ত্র
স্মৃতির তারকোভস্কি
গ্রন্থনা ও অনুবাদ । রুদ্র আরিফ
পৃষ্ঠাসংখ্যা । ১১২
প্রথম প্রকাশ । ফেব্রুয়ারি ২০১৮
বাংলদেশি সংস্করণের প্রকাশক । মেঘ
ভারতীয় সংস্করণের প্রকাশক । প্রতিভাস

প্রথম কিস্তি পড়তে এই বাক্যে ক্লিক করুন


কিস্তি । ২ [২]


আন্দ্রেই তারকোভস্কিনাতালিয়া বন্দারচুক

কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে [ফ্রান্স] গ্র্যান্ড প্রিক্স দু জুরি অ্যাওয়ার্ড জিতে নিয়েছিল সোলারিস। কানে সেটি অফিসিয়ালি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদক; খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক পুরস্কার। সোভিয়েত আমলে অন্য একটি পুরস্কারকে করা হয়েছিল গোপন : ফিল্মটির স্বর্গীয় বৈশিষ্ট্যের কারণে ক্যাথলিক চার্চ প্রাইজও জিতেছিলাম আমরা। এ বিষয়টি সোভিয়েত ইউনিয়নে একেবারেই কঠোরভাবে গোপন রাখা হয়েছিল; কেননা, সোভিয়েত কোনো ফিল্মমেকারের পক্ষে কীভাবে এমন কোনো পুরস্কার পাওয়া সম্ভব? আমার বিশ্বাস, ভ্যাটিকান সিটি থেকে [পুরস্কারমূল্য হিসেবে] যে টাকা তিনি পেয়েছিলেন, তা তাকে বেঁচেবর্তে থাকতে সাহায্য করেছে। কেননা, আন্দ্রেইর জীবন তখন ভয়ঙ্কর কঠিন হয়ে উঠেছিল। সোলারিস তখনো মুক্তি পায়নি; মুক্তি পায়নি আন্দ্রেই রুবলভও। এ ছিল এমনই এক পরিস্থিতি।

মাত্র তিন মাস এভাবেই কেটেছে। কিন্তু এই তিনটি মাসের মূল্য তাকে জীবন দিয়ে দিতে হয়েছিল। সেন্সরবোর্ড আমাদের জানিয়ে দিয়েছিল, ৪২টি সংশোধন করতে হবে। তার মানে, পুরো ফিল্মটি নতুন করে শুট করারই সামিল। তাদের সমালোচনার বেশিরভাগই, নিঃসন্দেহে ছিল, আমার [হারি] পুনর্জন্মের দৃশ্যটি নিয়ে। অথচ এটিই এই সিনেমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য। আর এটি করার জন্য, প্রচুর প্রস্তুতি নিতে হয়েছিল আমাকে। তারা [তারকোভস্কি ও তার ক্রু] আমাকে একটি স্ফটিক দ্রবণ দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলেন। বলে রাখা ভালো, এ ধরনের কাণ্ড এই প্রথমবার করা হয়েছিল। এর প্রভাবে আমি বেঁচে থাকব কি না– সে ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন না কেউ। তবু এ নিয়ে কেউই উদ্বিগ্ন হননি। আসল ব্যাপার ছিল, দৃশ্যটির শুট করা। আমার বাঁচা-মরার বিষয়টির গুরুত্বও ছিল অবান্তর!

সোলারিস
সোলারিস
ফিল্মমেকার । আন্দ্রেই তারকোভস্কি
কাস্ট । দোনাতাস বানিওনিসনাতালিয়া বন্দারচুক

তার মানে, তারা আমাকে এ দ্রবণ দিয়ে ঢেকে দিলেন, যেটি ছিল স্ফটিক, এবং আমার এটি কয়েক সেকেন্ডের জন্য গায়ে মেখে রাখার কথা ছিল। আমাকে দম আটকে রাখতে হলো, যেন দেখে মৃত মনে হয়। আমাকে সদ্যই লিকুইড অক্সিজেন গেলানো হয়েছে, এবং তা পরিণত হয়েছে বরফে। এ ধরনের জিনিসে কতক্ষণ আমার ঢেকে থাকতে হবে– জানা ছিল না। আমি কেবলমাত্র ইশারা-ইঙ্গিতে আন্দ্রেইর সঙ্গে যোগাযোগ করছিলাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি আধামিনিটের মতো টিকতে পারবেন?’ আমি বললাম, হ্যাঁ। তবে আমি দেড় মিনিটের মতো টিকে ছিলাম। কেননা, পানিতে ঝাঁপ দিয়ে, অনেকক্ষণ দম আটকে রাখার অভ্যাস ছিল আমার।

দৃশ্যটির শুটিং মনমতো করতে পেরেছিলেন বলে খুশি ছিলেন আন্দ্রেই। চিৎকার করে বলেছিলেন, ‘সাবাশ! এই তো আমার বরফ-রানী!’ এরপর ভয়ঙ্কর এক ব্যাপার ঘটে গেল। হাসি আটকাতে পারছিলাম না আমি; অথচ স্ফটিক দ্রবণটি তখনো ঢেকে রেখেছে আমাকে। হাসতে গেলে সেটির ধারে আমার মুখ কেটে যেত, নিশ্চিত। ভাগ্য ভালো, পানির একটি বালতি ছিল সেখানে। আমাকে ছুড়ে ফেলা হলো সেটিতে। আমি হাতভর্তি পানি নিয়ে, মুখে ছিটাতে লাগলাম; আর আবরণটি গলে পড়ল। তারপর আন্দ্রেইকে আমি সেই কথাটি শোনালাম, যেটি সেই মুহূর্তে মনে হয়েছিল তাকে! তবে বেশিরভাগ সময় আমরা যথেষ্ট ভালো বন্ধুই ছিলাম। আন্দ্রেই আমার খুব খেয়াল রাখতেন। তার সঙ্গে কাজ করা সবসময়ই আনন্দের ছিল আমার জন্য। আমরা– সব অভিনেতা-অভিনেত্রী, একই ঘোরের ভেতর কাজ করতাম। দোনাতাস আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। এর মূল কারণ, আন্দ্রেইর নজর এড়িয়ে, তিনি আর আমি রিহার্সেল করে নিতাম। আমাদের ‘জিনিয়াস’টি রিহার্সেল সাধারণত এড়িয়ে যেতেন। তিনি চাইতেন, সবকিছু যেন বাস্তবজীবনের মতো হয়।


চুল
ঠিক করতে
দুই ঘণ্টার মতো
লেগে যেত আমার;
তারপর দৃশ্যপটে হাজির হয়ে
তিনি এলোমেলো করে দিয়ে
বলতেন, ‘যেন বাতাস
এসে এমনটা করে
দিয়েছে’

যেমন ধরুন, চুল ঠিক করতে দুই ঘণ্টার মতো লেগে যেত আমার; তারপর দৃশ্যপটে হাজির হয়ে তিনি এলোমেলো করে দিয়ে বলতেন, ‘যেন বাতাস এসে এমনটা করে দিয়েছে।’ তারপর আরও দুই ঘণ্টা আমার ব্যয় হয়ে যেত, চুল ঠিকঠাক করতে। কেননা, একটু পরেই তো তিনি আবার বলে বসবেন, ‘এ কী হাল হয়েছে আপনার চুলের?’ দোনাতাসের সঙ্গেও একই কাণ্ড ঘটত। তাকে আন্দ্রেই অস্থির করে তুলতেন। আসল কারণটি ছিল, ‘দুর্দান্ত হয়ে ওঠতে হবে– এটাই শেষ কথা।’ কিন্তু আপনি যেহেতু তখনো স্ক্রিপ্ট পাননি, কী করে দুর্দান্ত হয়ে ওঠা সম্ভব? বিশেষ করে, দোনাতাস তো এসেছেন থিয়েটার ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে। নিজের চরিত্রটির নির্যাস সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার ছিলই তার। অথচ চরিত্রটির নির্যাসের ব্যাপারে আন্দ্রেইর কোনো আগ্রহ ছিল না। তিনি আগ্রহী ছিলেন অভিনেতাটির অবস্থার প্রতি। এ তো দুটি আলাদা ব্যাপার।

লোকেশনের আবহ ছিল খুবই ইন্টারেস্টিং। প্রত্যেক অভিনেতাকে আলাদা আলাদা করে ট্রিট করতেন তিনি। সবচেয়ে বেশি জ্বালাতন চালাতেন নিজের প্রিয়– সলোনিৎসাইনের ওপর। আন্দ্রেই রুবলেভ-এ অভিনয় করেছেন সলোনিৎসাইন। ফলে তারকোভস্কি জানতেন, আনাতলিকে যদি খেপিয়ে তোলা না যায়, তার কাছ থেকে সেরাটা বেরিয়ে আসবে না। এ কারণে আনাতলিকে ততক্ষণ পর্যন্ত নিপীড়নের মধ্যে রাখতেন– যতক্ষণ না বেচারার চোখ দুটো জ্বলে ওঠে; আর, কেবল তারপরই শুটিং শুরু করতেন আন্দ্রেই।


অনুপ্রাণিত করার জন্য
আমাকে কবিতা পড়ে
শোনাতেন
তিনি

আমার প্রতি তার ব্যবহার ছিল ভীষণ নরম। অনুপ্রাণিত করার জন্য আমাকে কবিতা পড়ে শোনাতেন তিনি। স্রেফ চমৎকার এক মানুষ ছিলেন তিনি। বানিওনিসের সঙ্গে তার কোনো-না-কোনোভাবে এক ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। বানিওনিস ছিলেন একজন “পিপল’স আর্টিস্ট”, একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা দোনাতাস টের পেতেন; তার মনে হতো, আন্দ্রেই তার প্রতি কম মনোযোগ দিচ্ছেন। সেখানে আরও ছিলেন ভ্লাদ দভোর্জেৎস্কি আর ইউরি ইয়ার্ভেত। মনোমুগ্ধকর এক কাস্টিং ছিল : প্রত্যেকেই দুর্দান্ত।

লাইব্রেরির দৃশ্যটি আমার খুব প্রিয়। এই অতুলনীয় মাইক্রোকোজমটি মিশা রমাদিনের সৃষ্টি। তারা [চরিত্রগুলো] মহাশূন্যে ভ্রমণ করছে, আর দুনিয়া থেকে সব সর্বসেরা জিনিস তারা নিয়ে এসেছে। পুশকিনের ডেথ-মাস্ক, ড্রাগনটি, ব্রুখেলের একটি পেইন্টিং… আর আমি ও দোনাতাস উড়ছি হাওয়ায়। তার [তারকোভস্কি] সঙ্গে কাজ করা ছিল ভীষণ ইন্টারেস্টিং ও সহজ; কেননা, আমাদের এই ফিল্মমেকারটির প্রতি আমার আস্থা ছিল একেবারেই নিখাদ। ‘দেখুন, আপনি কেমন অভিনয় করছেন কিংবা কী বলছেন– আমার কাছে এসবের কোনো গুরুত্ব নেই। আপনি জীবন্ত– এটাই ঘটনা। আপনার চোখের পাঁপড়িগুলো কাঁপছিল; চোখে চিকচিক করছিল অশ্রু’– তিনি যখন আমার কাছে এসে, আমাকে এ কথাগুলো বললেন, খুব ভালো লেগেছে আমার। কোনো রকম উদ্ধত না হয়েই, মানবাত্মার জীবনকে ব্যাখ্যা করতেন তিনি : আত্মার অবস্থান সবকিছুর ওপরে।

সোলারিস-এর সেটে দোনাতাস নাতালিয়াকে দৃশ্য বুঝিয়ে দিচ্ছেন তারকোভস্কি

একবার তিনি আমাকে একটি ফেনোমেনাল প্রস্তাব দিলেন। ফ্রিজিং দৃশ্যটিতে একটি মুহূর্ত ছিল, যখন হারি ফিরে আসে জীবনে। তিনি বললেন, ‘এই পুনর্জন্মটি বেদনা সহকারে অনুভব করা চাই। তার [হারি] ইন্টারনাল অর্গানের বিকাশ ঘটছে। মৃতদেহটি মৃত্যু পেরিয়ে ফিরে আসছে জীবনে।’ তিনি চাইলেন, আমি যেন আমার হাতগুলোর দিকে মনোযোগ দিই। এটি বেশ কাজে লেগেছে। আমি বিশ্বাস করে ফেলেছিলাম, মৃত্যুর কোনো অস্তিত্ব নেই; যে কোনো পরিস্থিতিতেই বেঁচে থাকব আমরা। এখানে কোনো মৃত্যু নেই– মেনে নিয়েছিলাম আমি। এটি একটি ট্রান্সফরমেশন, যদিও; তবে আত্মা কখনো মিলিয়ে যায় না। কেবল আমাদের শরীর, খোলস ইত্যাদি মিলিয়ে যায়।

আমাদের দুজনের জীবনদর্শন একই ছিল। তিনিও মনে করতেন, এই খোলসের কোনো মানে নেই। এই শারীরিক খোলস থেকে অন্য কোনোকিছুর আবির্ভাব ঘটে।… ফিল্মটির শুরুতে আমি আকাশে, কোনোকিছুর দিকে তাকিয়েছিলাম। এ এমন নয়, হারি আপনার [দর্শক] দিকে তাকিয়েছে; না তাকিয়েছে পৃথিবীর কারও দিকে। এ আসলে, তার চোখ দিয়ে আপনার দিকে তাকিয়ে আছে আসলে সোলারিসই, কিংবা সৌরজগৎ, কিংবা ঈশ্বর, কিংবা আর যা আপনি মনে করেন। আমার বিশ্বাস, এ রকম সিনেমার সংখ্যা খুবই কম। একেবারেই কম।

সোলারিস আমি দেখেছিলাম এটি মুক্তি পাওয়ার পরপরই। এরপর কতবার যে দেখেছি! ফিল্মটি নিয়ে ৪২টি দেশে আমি সফর করেছি : নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, বলিভিয়া, গিনিয়া… ফ্রান্সে বহুবার, ইতালি, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র। স্যান ফ্র্যান্সিস্কোর ফেস্টিভ্যালে দেখিয়েছিল এটি। প্রতিবারই আমি দেখেছি, দর্শক সিনেমা-হল থেকে টলোমলো হয়ে বেরিয়ে আসছেন– স্বর্গীয় আবহটিতে নিমজ্জিত হয়ে। এটি [স্বর্গীয় আবহ] কীভাবে সৃষ্টি করতে হয়, আন্দ্রেই তা জানতেন।

সোলারিস কী? আমার কাছে, আজ আমি যেমন, তেমনি, এ হলো জীবনের পর জীবন। আমাদের প্রত্যেককেই নিজেদের বিবেকের সঙ্গে এ রকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হবে– যে বিবেকের মধ্যে, প্রায়শ্চিত্য কিংবা প্রশমিত করার মতো পার্থিব প্রার্থনার কোনো স্থান নেই। আমরা যখন বিদায় নেব, প্রত্যেকেই তার নিজস্ব ‘অতিথি’র দেখা পাব নিশ্চয়ই। এ এমনই এক পাপে আমরা পাপীষ্ঠ, যা সংশোধনের পক্ষে যথেষ্ট দেরি হয়ে গেছে; কেননা, এই মানুষগুলো আর জীবিত নেই। বন্ধুরা তখন আপনাকে বলবে, ‘হারির আত্মহননে আপনার কোনো দায় নেই। এখানে আপনার কিছুই করার ছিল না। এ ছিল নেহায়েত এক দুর্ঘটনা।’ কিন্তু এটি কোনো দুর্ঘটনা ছিল না। অন্তরাত্মা এ কথা জানে, আপনি যথেষ্ট পরিমাণ ভালোবাসেননি, কিংবা আপনি তাকে মানসিকভাবে উদ্ভ্রান্ত করে দিয়েছিলেন; আর সে মিলিয়ে গেছে– অনস্তিত্বের মধ্যে। কিন্তু সে যে প্রয়াত হয়েছে– এটিকে কেবল আন্দাজ করা যায়; কেননা, সে আপনার কাছাকাছি, আরও কাছাকাছি বিরাজ করছে। আপনি যত বুড়ো হবেন, আপনার বিবেকের ওপর পাপের ভার ততই বাড়তে থাকবে। আজ হোক, কাল হোক– এর মুখোমুখি হতেই হবে আপনাকে।


কেউ
কেউ মনে
করে, ক্যান্সার
হলো শরীরের পক্ষ
থেকে এক ধরনের আত্মরক্ষা।
সত্যি কি না, জানি না। কিন্তু
যে কোনোভাবেই,
পুরোপুরি ডুবে
গিয়েছিলেন
আন্দ্রেই

আন্দ্রেইর সব সিনেমাই ছিল, ভবিষ্যদ্বাণীপূর্ণ। দুর্ভাগ্যক্রমে, এগুলো ছিল তার নিজের জীবনেরও ভবিষ্যদ্বাণী। কেননা, যখন তিনি নিজ দেশ ছেড়ে গিয়েছিলেন… সোলারিস-এ একটি বচন রয়েছে– চলুন, অনুবাদ করে শোনাই : ‘আমরা যা হারাতে সক্ষম, কেবল তা-ই ভালোবাসি। বাড়ি, স্বদেশ, নারী…।’ একটি নির্দিষ্ট সময়ে, তিনি এ সবই হারিয়েছিলেন। আর হয়ে পড়েছিলেন মারাত্মক অসুস্থ। একজন মানুষ হিসেবে তার যা মূল্য ছিল, নিজ বাড়িতে তিনি তা কোনোদিনই উপভোগ করতে পারেননি; সে রকম স্বস্তি তাকে কেউই দেয়নি; এক নারী তাকে সম্পূর্ণ বুঝতে পারবেন, এবং নিজের দেশকে তিনি ভীষণ রকম ভালোবাসতেন– কিন্তু এর কেউ বা কোনোটিই তাকে না পেরেছিল বুঝতে, না নিয়েছিল মেনে। পালিয়ে যাওয়ার কথা তিনি বহুকাল ধরেই ভেবেছেন। তার মা যখন মারা গেলেন, তাকে কবর দিতে, নিজ দেশে ফিরতে পারেননি তিনি। এরপরই ক্যান্সার আক্রমণ করল তাকে। কেউ কেউ মনে করে, ক্যান্সার হলো শরীরের পক্ষ থেকে এক ধরনের আত্মরক্ষা। সত্যি কি না, জানি না। কিন্তু যে কোনোভাবেই, পুরোপুরি ডুবে গিয়েছিলেন আন্দ্রেই। এ ছিল ভোগান্তিতে ডুবে যাওয়া।

৩ বছর বয়সে, মায়ের সঙ্গে আন্দ্রেই তারকোভস্কি

একবার গস্কিনো’তে [স্টেট কমিটি ফর সিনেমাটোগ্রাফি; সোভিয়েত ইউনিয়ন], কর্তৃপক্ষ যখন আমাদেরকে ফিল্মটির ৪২টি সংশোধনী করে দিতে বললেন, আমরা দুজন [আমি ও তারকোভস্কি] তখন তাকিয়ে ছিলাম জানালার বাইরের দিকে। দাঁড়িয়ে, ঠায় দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন তিনি। বলছিলেন, ‘আমি সবার জন্যই দুঃখ বয়ে আনি। আপনার জন্যও।’ আমি বলেছিলাম, ‘না, আন্দ্রেই, আপনি আমাকে অপরিমেয় আনন্দ এনে দিয়েছেন– আপনার সঙ্গে কাজ করতে পারার আনন্দ।’ এ কথাগুলো তিনি সবসময় মনে রেখেছেন।

তারপর দেখা হলো কান ফেস্টিভ্যালে। নিজের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ানোর শক্তি তখন ছিল না এ শিল্পীর। একদিন আমরা রমাদিনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। আন্দ্রেই ছিলেন খেতে ভালোবাসা এক মানুষ। ভালো ভালো জিনিসের প্রতি তার ছিল টান। সবসময়ই পরতেন অনিন্দ্য সব পোশাক। [সেদিন] ডিনারে তিনি এক হাতে কাটাচামক আর অন্য হাতে একটি ছুরি ধরলেন। তারপর এক টুকরো খাবার পড়ে গেল মেঝেতে। তিনি সেটি তুলে এনে রাখলেন নিজের প্লেটে; তারপর খেয়ে নিলেন! ক্ষুধার্ত ছিলেন তিনি। তার কাছে কোনো টাকা ছিল না। ১১ হাজার রুবেল ধার হয়ে গিয়েছিল তার। পকেটে একটি ফুটো পয়সাও নেই। তখন সোভিয়েত আমল। আপনাকে বুঝতে হবে, ১১ হাজার রুবেল মানে কত! ১১ হাজার মার্কিন ডলারের চেয়েও বেশি।

সোলারিস-এর সেটে, নাতালিয়াকে দৃশ্য বুঝিয়ে দিচ্ছেন আন্দ্রেই

আন্দ্রেইর ক্যান্সার হয়েছে জেনে, দেখা করার জন্য ভীষণ উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলাম আমি। কিন্তু তার সঙ্গে যোগাযোগের কোনো উপায় ছিল না, জানেন তো? আপনাকে বলছি, শুনুন। ফ্রান্সে যাওয়ার একটি সুযোগ এলো আমার– একটি চিলড্রেন’স ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে যোগ দিতে। আমি তখন মাত্রই বাম্বি’স চাইল্ডহুড [Detstvo Bambi ; ১৯৮৬] ফিল্মটি বানিয়েছি; বেশ কিছু আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছে এটি। ফিল্মটি নিয়ে আমি বেরিয়েছি বিদেশভ্রমণে। তাই জানতে চাইলাম, আমার সঙ্গে তার [তারকোভস্কি] দেখা করিয়ে দেবার ব্যবস্থা তারা [কর্তৃপক্ষ] করতে পারবেন কি না।


তখনো
আমার জানা
ছিল না, লারিসা
[তারকোভস্কির স্ত্রী]
তাকে [তারকোভস্কি] ইতোমধ্যেই
পরিত্যাগ করেছেন। তাকে ফেলে
গেছেন ক্যান্সার ক্লিনিকে
ধুঁকে ধুঁকে
মরার
জন্য

কেজিবি’র [স্টেট সিকিউরিটি অ্যাজেন্সি; সোভিয়েত ইউনিয়ন] যে লোকটি সর্বক্ষণ আমাকে অনুসরণ করছিলেন, বললেন, ‘একদমই না! আমি এটা হতে দেবো না!’ ক্যান্সার ক্লিনিকটির ঠিক পাশ দিয়ে, গাড়ি চালিয়ে আমাকে নিয়ে চলে গেলেন লোকটি। আমি এই ভৌতিকতার কথা কোনোদিনও ভুলতে পারব না। আমি এতটাই মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম যে, গাড়ির দরজা খুলে লাফাতে যাচ্ছিলাম– হারি যেমনটা করেছিল, স্টিলের দরজাটি ভেঙে ফেলার সময়। তখনো আমার জানা ছিল না, লারিসা [তারকোভস্কির স্ত্রী] তাকে [তারকোভস্কি] ইতোমধ্যেই পরিত্যাগ করেছেন। তাকে ফেলে গেছেন ক্যান্সার ক্লিনিকে ধুঁকে ধুঁকে মরার জন্য। আমার তখন তা জানা ছিল না; যদি জানতাম, তার সঙ্গে দেখা করতে, সে রাতে আমি পালিয়ে চলে আসতাম। ফ্রান্সের রাস্তাঘাট আমার চেনা ছিল না। এ ঘটনার পরপরই তারা [কর্তৃপক্ষ] আমাকে প্রাদেশিক অঞ্চলগুলোতে নিয়ে গেলেন। এ ছিল এক সত্যিকারের হরর।

স্ত্রী লারিসার সঙ্গে তারকোভস্কি

একবার অন্তরঙ্গ এক আলাপ হয়েছিল তার আর আমার। কান ফেস্টিভ্যাল থেকে ফিরছিলাম আমরা। [সোভিয়েত] কর্তৃপক্ষ হুঁশিয়ার ছিল, আমরা দুজন হয়তো ফ্রান্সে থেকে যেতে পারি। কেননা, রাশিয়ান অভিবাসীদের সঙ্গে দেখা করতে দেখা গিয়েছিল আমাদের। বাস্কাকভ সেখানে ছিলেন। সর্বক্ষণ তিনি নজর রাখছিলেন আমাদের ওপর। আমরা কিছু পারফিউম কিনতে গিয়েছিলাম। আন্দ্রেই নিজের স্ত্রীর জন্য কিনেছিলেন; আমিও কিনেছিলাম। ফলে ফিরতে খানিকটা দেরি হয়ে গেল আমাদের। দেখি, বাস্কাকভের মুখ পুরো বেগুনি হয়ে গেছে।

আন্দ্রেইকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তার আবার হলোটা কী?’
‘তিনি ভেবেছিলেন, আমরা এ দেশেই থেকে যাব।’
আমি বললাম, ‘কী?!’
আমার কিন্তু কখনোই এমনটা মনে হয়নি। আন্দ্রেই বললেন, ‘জানেন তো, আমরা থাকতেই পারি।’
বললাম, ‘মানে কী?’

তিনি বললেন, ‘কিছু মনে করবেন না। সেদেশে [সোভিয়েত ইউনিয়ন] আমাকে কারই-বা কোনো দরকার আছে, বলুন? আমি কেবলই আমার সুদীর্ঘ বোরিং ফিল্মগুলোই বানাতে পারি।’

তিনি বললেন, ‘নিজের বাড়িটি আমি ভালোবাসি। আমার ছেলে আন্দ্রিয়ুস্কা মাত্রই জন্মেছে।’ না, লারিসা [দেশে] না থাকলে তিনি ফিরে যেতেন না।

লারিসা একটা আলাদা জীবন চেয়েছিলেন। তারপর তাকে ছেড়ে চলে গেছেন। আন্দ্রেইও কোনোদিনই আর ফিরে আসেননি দেশে।

আন্দ্রেই নাতালিয়া
নাতালিয়া বন্দারচুক
জন্ম ১০ মে ১৯৫০। অভিনেত্রী ও ফিল্মমেকার, রাশিয়া
ফিল্ম [অভিনয়] : সোলারিস; বাই দ্য লেক; লিভিং রেইনবো; দ্য ইয়ুথ অব পিটার দ্য গ্রেট প্রভৃতি
Print Friendly, PDF & Email
সম্পাদক: ফিল্মফ্রি । ঢাকা, বাংলাদেশ।। সিনেমার বই [সম্পাদনা/অনুবাদ]: ফিল্মমেকারের ভাষা [৪ খণ্ড: ইরান, লাতিন, আফ্রিকা, কোরিয়া]; ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো: প্রেম ও দেহগ্রস্ত ফিল্মমেকার; তারকোভস্কির ডায়েরি; স্মৃতির তারকোভস্কি; হিচকক-ত্রুফো কথোপকথন; কুরোসাওয়ার আত্মজীবনী; আন্তোনিওনির সিনে-জগত; কিয়ারোস্তামির সিনে-রাস্তা; সিনেঅলা [৪ খণ্ড]; বার্গম্যান/বারিমন; ডেভিড লিঞ্চের নোটবুক; ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার চান্তাল আকেরমান; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার বেলা তার; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার নুরি বিলগে জিলান; ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; বেলা তার; সের্গেই পারাজানোভ; ভেরা খিতিলোভা; সিনেমা সন্তরণ ।। কবিতার বই: ওপেন এয়ার কনসার্টের কবিতা; র‍্যাম্পমডেলের বাথটাবে অন্ধ কচ্ছপ; হাড়ের গ্যারেজ; মেনিকিনের লাল ইতিহাস ।। মিউজিকের বই [অনুবাদ]: আমার জন লেনন [মূল : সিনথিয়া লেনন]; আমার বব মার্লি [মূল: রিটা মার্লি] ।। সম্পাদিত অনলাইন রক মিউজিক জার্নাল: লালগান

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here