সাক্ষাৎকার । এডওয়ার্ড ডগলাস
অনুবাদ । রুদ্র আরিফ
অনুবাদকের নোট
ম্যাক্স ফন স্যিদো। জন্ম ১০ এপ্রিল ১৯২৯। সুইডিশ মাস্টার অ্যাকটর। অভিনয় করেছেন শতাধিক সিনেমা ও টিভি সিরিজে। অল্পবয়সে স্বদেশি মাস্টার ফিল্মমেকার ইংমার বারিমনের মাস্টারপিস ‘দ্য সেভেন্থ সিল’-এ [১৯৫৭] মৃত্যুর সঙ্গে দাবা খেলা সেই নাইট তিনিই। সব মিলিয়ে বারিমনের ১১টি সিনেমায় দেখা গেছে তাকে। আরও অভিনয় করেছেন জর্জ স্টিভেন্সের ‘দ্য গ্রেটেস্ট স্টোরি এভার টোল্ড’ [১৯৬৫], উইলিয়াম ফ্রাইডকিনের ‘দ্য এক্সরসিস্ট’ [১৯৭৩], ডেভিড লিঞ্চের ‘ডুন’ [১৯৮৪], উডি অ্যালেনের ‘হান্না অ্যান্ড হার সিস্টারস’ [১৯৮৬], পেনি মার্শালের ‘অ্যাওয়াকেনিংস’ [১৯৯০], স্টিভেন স্পিলবার্গের ‘মাইনরিটি রিপোর্ট’ [২০০২], মার্টিন স্করসেজির ‘সাটার আইল্যান্ড’ [২০১০] প্রভৃতি সিনেমায়। সদ্য, ৮ মার্চ ২০২০, ৯০ বছর বয়সে চিরতরে চোখ বোজা এই কিংবদন্তির ১৩ বছরের পুরনো এক সাক্ষাৎকার দুই কিস্তিতে হাজির করা হলো এখানে। ২০০৭ সালে এডওয়ার্ড ডগলাসকে দেওয়া এই সাক্ষাৎকার মূলত জুলিয়ান স্ন্যাবেলের ‘দ্য ডাইভিং বেল অ্যান্ড দ্য বাটারফ্লাই’ [২০০৭] সিনেমাটি ঘিরেই।

কিস্তি-১
ম্যাক্স ফন স্যিদো : আজব ব্যাপার হলো, [আমার নামের বানানটা] যারা দেখে, তারা ঠিকঠাক উচ্চারণ করতে পারে না, আবার [যারা নামটা] শোনে, তারা বানান করে লিখতে পারে না; কী একটা অবস্থা!
এডওয়ার্ড ডগলাস : আপনার নামটাতে আসলে দুটি সিলেবল [পদ্যাংশ]; আর ভাওয়েলের [স্বরবর্ণ] উচ্চারণ বলতে গেলে বোঝাই যায় না। ‘ফন স্যি-দোহ্’… উচ্চারণ এ রকম, তাই না?
স্যিদো : সুইডেনেও উচ্চারণটা সহজ নয়; কারণ, নামটা সুইডিশ না। আমার পূর্বপুরুষরা ২০০ বছর আগে জার্মানি থেকে সুইডেনে এসেছিলেন; ফলে এটি কোনো জার্মান নামও না। আমার ধারণা, এ অনেকটাই ইস্টার্ন জার্মান, সম্ভবত স্লাবিক নাম।

ডগলাস : এই বছরটা [২০০৭] আপনার জন্য নিশ্চয়ই দারুণ গেছে। কারণ জুলিয়ান স্ন্যাবেলের এই [‘দ্য ডাইভিং বেল অ্যান্ড দ্য বাটারফ্লাই’] চমৎকার ও শৈল্পিক সিনেমাটিতে আপনি কাজ করতে পেরেছেন; আবার ‘রাশ আওয়ার থ্রি’তেও [ব্রেট র্যাটনার] কাজ করেছেন। দুটি সিনেমার শুটিংই হয়েছে ফ্রান্সে।
স্যিদো : দুটি একেবারেই দুই ধরনের সিনেমা অবশ্য।
ডগলাস : হ্যাঁ; তবে এ রকম দুটি বিশিষ্ট সিনেমায় আপনার দেখা পাওয়া বেশ দারুণ ঘটনা। ‘ডাইভিং বেল…’-এ জ্যঁ-দোর বাবার চরিত্রে আপনাকে অভিনয়ে প্রস্তাবটি জুলিয়ান স্ন্যাবেল কীভাবে দিয়েছিলেন?
স্যিদো : যতদূর মনে পড়ে, আমি একটা ফোনকল পেয়েছিলাম; না, জুলিয়ানের কাছ থেকে নয়, বরং সিনেমাটির প্রডিউসার ক্যাথলিন কেনেডি করেছিলেন। তার সঙ্গে আগে থেকেই পরিচয় ছিল। তিনিই আমার কাছে স্ক্রিপ্টটি পাঠিয়েছিলেন। পড়ামাত্রই প্রেমে পড়ে গেলাম। স্ক্রিপ্ট এবং যে চরিত্রে আমাকে অভিনয়ের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল– দুটোই ভালো লেগে গেল খুব। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সব স্ক্রিপ্ট সবসময় যথেষ্ট ভালো হয় না; ফলে যখন আপনি [অভিনেতা হিসেবে] ভালো কোনো স্ক্রিপ্ট পাবেন, মনটাই ভালো হয়ে যাবে।
জীবনে আগে কোনোদিনই করিনি, এমন একটা কাণ্ড করে বসলাম এ বেলা : রোন্যাল্ড হ্যারউডকে [স্ক্রিনরাইটার] চিরকুট পাঠিয়ে ধন্যবাদ জানালাম; অভিনন্দন জানালাম। এমন কাণ্ড এর আগে কখনোই করিনি। চিঠি লিখতে আমার ভালোই লাগে; কিন্তু এর আগে কোনোদিন [কোনো স্ক্রিনরাইটারকে] লিখিনি। লস অ্যাঞ্জেলেসে আসার আগ পর্যন্ত আগে কোনোদিন দেখাই হয়নি তার সঙ্গে। আমাদের প্রথম দেখা সিনেমাটির উদ্বোধনী প্রদর্শনীর সময়। লস অ্যাঞ্জেলেসে প্রচারণার কাজে এসেছিলাম আমরা। সেখানেই আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ। আপনার কি তার সঙ্গে দেখা হয়েছে?

ডগলাস : হ্যাঁ; তিনি যখন [স্ক্রিনরাইটার হিসেবে] রোমান পোলান্সকির ‘অলিভার টুইস্ট’-এর জন্য ইন্টারভিউ দিয়েছিলেন, তখন দেখা হয়েছিল। আপনারা কি রোমানের বন্ধু? আপনারা দুজনই [রোমান ও স্যিদো] তো ফ্রান্সে থাকেন, এবং ‘রাশ আওয়ারস থ্রি’তে অভিনয় করেছেন। এই সিনেমাটিতেও [‘দ্য ডাইভিং বেল অ্যান্ড দ্য বাটারফ্লাই’] তার অনেক সম্পৃক্ততা আছে।
স্যিদো : না, না, না; তাকে [রোনাল্ড] আগে থেকে চিনতাম না। তাকে চিনি মূলত তার মঞ্চনাটক ‘দ্য ড্রেসার’-এর মাধ্যমে। নাটকটিকে অভিনয়ের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল আমাকে; কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে করতে পারিনি। সে অনেক আগের কথা।
ডগলাস : এই সিনেমা বানানোর আগে থেকে জুলিয়ানের সঙ্গে পরিচয় ছিল?
স্যিদো : না, না; এর আগে তার সঙ্গে দেখাও হয়নি আমার। তবে তাকে স্রেফ চিনতাম একজন আর্টিস্ট হিসেবে; ফিল্মমেকার হিসেবে নয়। আপনার কি তার সঙ্গে পরিচয় আছে?
ডগলাস : না, এই সিনেমা আমি দুবার দেখেছি; তবে [তার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার] সেই সুযোগ এখনো হয়নি। আপনাকে এই চরিত্রের জন্য তিনি বেছে নিলেন কেন, আপনি কিছু জানেন? আমার ধারণা, আমরা বেশিরভাগজনই আপনাকে জানি মূলত সেইসব দাপুটে, সাধারণত মন্দলোকের চরিত্রে অভিনয় করতে; কিন্তু এ রকম দুর্বলচিত্তের একটা লোকের চরিত্রে আপনি কখনোই অভিনয় করেছেন বলে মনে পড়ে না।
স্যিদো : না; সিনেমায় করিনি সম্ভবত। না; আমি আসলে নিশ্চিত নই।
ডগলাস : এই যে ভিন্ন কিছু করা, এ কারণেই কি চরিত্রটি আপনাকে টেনেছে?
স্যিদো : না, না; কারণ স্রেফ, এটি এক দারুণ চরিত্র। আরেকটি কারণ হলো, এর দৃশ্য দুটি : ফলে এটির মধ্যে সম্পর্কের দুটি দিকই রয়েছে, যেখানে একটিতে চরিত্রটি পরস্পরের সঙ্গে ইয়ার্কি ও এক ধরনের জ্বালাতন করে, তবে সেই জ্বালাতনটি খুবই মধুর। ভীষণ কোমলত্বে ভরা দৃশ্য সে এক; তবে তারপরই সেই নৈরাশ্য নেমে আসে– যখন সে জানতে পারে, কোনোদিনই নিজের ছেলের কণ্ঠস্বর শুনতে পাবে না আর। ছেলের দেখা পাবে না আর কোনোদিন। ফলে এমন একটি চরিত্র করার সুযোগ পেয়ে আমি ভীষণ খুশি ও তৃপ্ত।

ডগলাস : আপনি ও ম্যাথু আমালরিকের মধ্যে বাবা-ছেলে চরিত্রের সম্পর্কটিই এ সিনেমায় অনেকের কাছে বেশি প্রিয়। সিনেমাটিতে মাত্র দুটি দৃশ্যে অভিনয় করেছেন আপনারা, আর একসঙ্গে ছিলেন মাত্র একটি দৃশ্যে; দাড়ি কামানোর সেই দৃশ্য অবিস্মরণীয়। দৃশ্যটির জন্য কি আপনাদের দুজনের কোনো প্রস্তুতি ছিল? তিনি আপনার দাড়ি কামিয়ে দিচ্ছেন– এমন দৃশ্যে তার প্রতি আপনার ভরসা ছিল কতটুকু?
স্যিদো : না! কানাডায় ‘ইমোশনাল অ্যারিথমেটিক’ [পাওলো ব্রাজম্যান; ২০০৭] নামে একটা সিনেমা করছিলাম আমি; সেটির প্রোডাকশনের মাঝেই ‘দ্য ডাইভিং বেল…’-এর সিডিউল চলে এলো। ফলে দৃশ্যটির শুট করতে আমাকে প্যারিস ফিরতে হলো; এর মাঝখানে সময় পেয়েছি মাত্র তিনদিন। দাড়ি কামানোর দৃশ্যটির জন্য চেয়েছিলাম খোঁচা- খোঁচা দাড়ি রেখে দিতে; কিন্তু ওই সিনেমার জন্য সে সময় বের করতে পারিনি। ফলে অনেকটা ক্লিন- শেভ অবস্থায়ই ছিলাম আমি; মাঝখানের তিনটা দিনে দাড়ি যতটুকু গজিয়েছে, এই যা।
যাহোক, সেটে যখন পৌঁছলাম, ততক্ষণে দাড়ি কিঞ্চিৎ খোঁচা- খোঁচা হয়েছে; তারপর ভাবলাম, আমরা বরং দ্বিতীয় দৃশ্যের শুটই আগে করি। ফলে কেউ যদি মন দিয়ে খেয়াল করেন, দেখবেন, আমি একা দাঁড়িয়ে আছি, কেউ আমার দাড়ি কামাচ্ছে না। ফলে সেটির শুট আমরা আগে করেছি; পরে করেছি প্রথম দৃশ্যটি– আমার দাড়ি তার কামিয়ে দেওয়ার দৃশ্য…। তিনি সত্যি সত্যি আমার দাড়ি কামিয়ে দিয়েছেন। ফলে দৃশ্যটি একেবারেই নির্ভেজাল।
ডগলাস : দাড়ি কামানোর ক্ষেত্রে নাপিতের ওপর আমি ভরসা করতে পারব কি না, বলতে পারছি না; সেখানে কোনো অভিনেতা, বিশেষ করে ম্যাথু কী রকম প্রাণবন্তভাবে…
স্যিদো : তা নয়…। আমি জানি না এটাকে তারা ইংরেজিতে কী বলে [একটি স্ট্রেট রেজার], তবে রেজারটি পুরনো ধাচের ছিল না, এ কারণে আমি খানিকটা ভড়কে গিয়েছিলাম।
ডগলাস : টেলিফোনের দৃশ্যটিতে অন্য অভিনেতা আরেকটি লাইনে কথা বলছিলেন, এবং এ ক্ষেত্রে অন্য লোকটির পক্ষে কথা বলা বা কমিউনিকেট করা সম্ভব না। এ খুবই বিরল ব্যাপার। এই মুহূর্ত সৃষ্টির রহস্য কী? জুলিয়ান কি আপনাকে স্রেফ ফোন হাতে রুমটিতে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন, আর বাকি যা কিছু ঘটছে– সেগুলোর কল্পনা করছিলেন আপনি?
স্যিদো : আমরা যখন দৃশ্যটির শুটিং করি, আমার সামনে তখন অন্য মেয়েটি, নার্সটি কথা বলছিল; তবে সেটি শুরু হয়েছিল এক মজার তরিকায়। ফলে তারা দৃশ্যটির শুট করেছেন মেয়েটিকে এবং আমার ছেলেকে রেখেই– যাকে আমি দুই সপ্তাহ আগে ফোনকল করেছিলাম। সে সময়ে আমরা প্যারিসে নয়, বরং ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চলের কোনো এক জায়গায় ছিলাম; আমি ফোন পেলাম। ফোনটা জুলিয়ান স্ন্যাবেল করেছেন। তিনি বললেন, ‘ম্যাথুর সঙ্গে আপনার দৃশ্যটির শুট করতে যাচ্ছি আমরা; আপনাকে যখন কল করছি, তখন আমরা মেয়েটির দৃশ্যটির শুট করছি। অন্য কারও চেয়ে বরং আপনার কণ্ঠ শুনলে সে [মেয়েটি] বেশি খুশি হবে; আপনি তাকে স্রেফ তার সংলাপগুলো বলে দিন। এই নিন ফোন নম্বর। আপনি কি দয়া করে ১৫ মিনিট পর আমাদের ফোন করবেন?’ হাহাহা! আমি সেটাই করেছি।
ডগলাস : তার মানে আপনার দৃশ্যটির শুটিং হওয়ার যথেষ্ট আগের কথা এটি?
স্যিদো : ওহ, হ্যাঁ; দুই সপ্তাহ আগের।
ডগলাস : সেই দৃশ্যে আপনার শুটিং করার আগে জুলিয়ান কি আপনাকে সেই শুটের কোনো ফুটেজ দেখিয়েছিলেন?
স্যিদো : না, না। কিছুই দেখিনি। আমি তখন দক্ষিণাঞ্চলে ছিলাম; পরে অবশ্য যখন আমার [শুটিংয়ের] দিন এলো, তখন তারা আমার সংলাপগুলো রেকর্ড করে নিয়েছেন; আর ওইদিন টেলিফোনেরটা ছিল ওই মেয়ের জন্য।

ডগলাস : ২০ বছর আগে, ‘পেলে দ্য কনকুরার’-এর [বিলি আগস্ট; ১৯৮৭] জন্য আপনি অস্কার নমিনেশন পেয়েছিলেন। এই সিনেমা ঘিরেও অ্যাওয়ার্ডের অনেক ঝনঝনানি শোনা যাচ্ছে। ক্যারিয়ারের এই পর্যায়ে এসে অ্যাওয়ার্ড আপনার কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
স্যিদো : দেখুন, অ্যাওয়ার্ড যেহেতু উৎসাহ যোগায়, তাই এটি সবসময়ই চমৎকার ব্যাপার। অ্যাওয়ার্ড দারুণ জিনিস; সবসময়ই স্বাগত জানানোর মতো। তবে অ্যাওয়ার্ডের ভাবনা মাথায় নিয়ে কোনোদিনই আমি কাজ করিনি। না, না; আপনি কাজ করেন, কারণ কাজ করতে পছন্দ করেন বলেই। ‘এই কাজটা আমি এমন দারুণভাবে করব, যেন অস্কার পাই’– এমন ভাবনা মাথায় থাকবে না আপনার।
দ্বিতীয় ও শেষ কিস্তি, আসছে শিগগির…