কিয়েস্লোফস্কি, আমার বাবা

210
ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি

মূল : মার্তা হ্রিনিয়াক
অনুবাদ : রুদ্র আরিফ

অনুবাদকের নোট
ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি [১৯৪১-১৯৯৬]। পোলিশ মাস্টার ফিল্মমেকার। সিনেমার ইতিহাসের অন্যতম কিংবদন্তি ও স্বকণ্ঠী ফিল্মমেকার। তার ফিল্মের মধ্যে রয়েছে ‘ডেকালগ’ [১০ পর্ব], ‘থ্রি কালারস’ ট্রিলজি, ‘দ্য ডাবল লাইফ অব ভেরোনিকা’, ‘ব্লাইন্ড চান্স’, ‘নো এন্ড’, ‘অ্যা শর্টফিল্ম অ্যাবাউট কিলিং’, ‘অ্যা শর্টফিল্ম অ্যাবাউট লাভ’ প্রভৃতি। অকালপ্রয়াত এই ফিল্মমেকারের একমাত্র সন্তান, মার্তা কিয়েস্লোফস্কা ওরফে মার্তা হ্রিনিয়াক [১৯৭২-] মূলত আড়ালে থাকতেই পছন্দ করেন। তবু তাকে পাওয়া গেল, বলা ভালো অনেক মিনতি করেই রাজি করানো গেল বাবার স্মৃতিচারণ করতে। তুরস্কের ইস্তাম্বুলে, ২০১৪ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি, ‘অল অ্যাবাউট কিয়েস্লোফস্কি’ নামে এক বিশেষ সিনেমা-সভার আয়োজন করা হয়। সেখানে অন্য অতিথিদের মধ্যমণি হয়ে, মূলত দর্শকদের প্রশ্নের জবাবেই মার্তা তার বাবাকে ঘিরে কিছু স্মৃতিচারণ করেছেন। দীর্ঘ সেই আলাপচারিতা থেকে, অন্য অতিথিদের স্মৃতিচারণ বাদ দিয়ে, শুধু মার্তার অংশটুকুই হাজির করা হলো এখানে। বলাবাহুল্য, মূল ব্যাপারটি সাক্ষাৎকার বা প্রশ্নোত্তর ভঙ্গিমায় হলেও সেই স্মৃতিচারণ এখানে বরং গদ্য হিসেবেই হাজির করাই শ্রেয় মনে হলো…


ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি
রোম, ইতালি; ১৯৯০
মেয়ে মার্তার সঙ্গে কিয়েস্লোফস্কি

বাবা যখন ডকুমেন্টারি বানাতেন, তখন আমি একদম শিশু, কিংবা জন্মাইনি তখনো। ফলে সেইসব দিন একদমই মনে নেই।… অনেক, অনেক দিন পর্যন্ত, কেন জানি না, আমি ভাবতাম, বাবা নিশ্চয়ই খুবই বিখ্যাত অভিনেতা ছিলেন। এ নিয়ে গর্বের শেষও ছিল না আমার। আরও ভাবতাম, মা নিশ্চয়ই ছিলেন মডেল।… সেই সময়ের এটুকুই মনে পড়ে।

বাবা যে আর নেই– এ কথাটাও মনে পড়ত না। আমি ভাবতাম, নিশ্চয়ই তিনি আছেন; কারণ, সিনেমা বানাতে তো সময় লাগে [বানানো শেষ হলেই ফিরবেন]। সবসময়ই মনে হতো, বাবা আছেন। সেই সময়গুলো দারুণ ছিল আমার জন্য।

ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি
স্ত্রী মারিয়া কতিলোর সঙ্গে কিয়েস্লোফস্কি

বাবা বলতেন, ‘যা কিছুর শুরু ভালোভাবে হয়, তার শেষ হয় খারাপভাবে; আর খারাপভাবে শুরু হওয়া যেকোনো কিছুই শেষ হয় আরও খারাপভাবে।’ সেদিক থেকে আমরা নৈরাশ্যবাদীই ছিলাম! তবে দৈনন্দিনজীবনে তিনি সেটি ছিলেন না। কতটা মজার মানুষ তিনি ছিলেন, আপনারা ভাবতেও পারবেন না।… দেখতে তাকে মজার মানুষ যদি মনে না-ও হয়, তবু তিনি মজারই ছিলেন। আর পেশাজীবনে ছিলেন চরম সিরিয়াস এক মানুষ।

একটা কথা তিনি বারবার বলতেন, ‘তুমি যা কিছুই করো, যত মানুষের সঙ্গেই মেশো, তোমাকে খুবই সাবধান থাকতে হবে…।’ তিনি সবাইকে বুঝতেন, এ কথা সত্য : সবারই খেয়াল রাখতেন, সবার দিকে তাকাতেন, সবার কথা মন দিয়ে শুনতেন। তার চোখের রঙ ছিল নীল। তার সঙ্গে কথা বলতে খুব ভালো লাগত আমার। কারণ, [অসুখের দিনগুলোতে] তিনি সারাটাক্ষণ আমার সঙ্গেই থাকতেন। আমি যা বলতাম, সব কথা মেনে না নিলেও, সবসময় বুঝতে ঠিকই পারতেন।…

মার্তা [কিয়েস্লোফস্কা] হ্রিনিয়াক

একজন ভীষণ সাবধানী ও দায়িত্ববান মানুষ ছিলেন তিনি। আমার ধারণা, এটিই আমার বাবার মূল বৈশিষ্ট্য। তাকে আমি সত্যিই ভালোবাসতাম। খুব বেশি মিস করি তাকে। সত্যি জানতাম, তার ওপরই পুরোপুরি ভরসা করতে পারি।… দারুণ এক মানুষ ছিলেন তিনি।

[১৯৯৫ সালে ফ্রান্সে থ্রি কালারস বানানোর পর ফিল্মমেকিং ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন বাবা।] খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। তবু… প্রডিউসারের প্রতি, মানুষের প্রতি দায়িত্ববোধ সম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন : দায়ভার নেওয়ার চেষ্টা করে গেছেন।


নিজের
দায়িত্বভার
নিয়ে ভাবতে বাধ্য
ছিলেন তিনি; আর এটিও
তার এমন ক্লান্ত হয়ে পড়ার এক কারণ

হারতে আমরা পছন্দ করতাম না।… পোল্যান্ডে তিনি কাজ করার আগে, কাজটি সহজ কিন্তু ভিন্ন ছিল : টাকা ছিল ভিন্ন, লোকজন ছিল ভিন্ন, আমরা খুব সুপরিচিত ছিলাম।… আমার ধারণা, নিজের দায়িত্বভার নিয়ে ভাবতে বাধ্য ছিলেন তিনি; আর এটিও তার এমন ক্লান্ত হয়ে পড়ার এক কারণ।

ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি
শৈশবে, বাবার কোলে মার্তা

তিনি যে প্রচুর কাজ করেছেন, তাতে সন্দেহ নেই : অল্প সময়ের মধ্যে প্রচুর কাজ করেছেন; দুই-তিন বছরের মধ্যে ডেকালগসহ ১২টি সিনেমা বানিয়েছেন! মনে পড়ে, একই দিনে একই বিল্ডিংয়ে ডেকালগ-এর তিনটি আলাদা ফিল্মের শুটিংও তিনি করেছেন! একই জায়গায় সবকিছুর শুট করার এই আইডিয়া দারুণ ছিল ঠিকই, ভিন্ন ভিন্ন অভিনেতা, ভিন্ন ক্যামেরাম্যান নিয়ে কাজ করার সময় কী করে আপনি মাথার ভেতর থেকে সবকিছু বদলে ফেলবেন?

থ্রি কালারস-এর শুটিংয়ের সময় আমি প্যারিসে ছিলাম। মনে পড়ে, দিনের বেলা শুটিং আর রাতের বেলা এডিটিং করতেন তিনি; তারপর বাসায় ফিরতেন ভোর চারটায়। তারপর আবার সকাল সাতটায় শুটিংয়ে বেরিয়ে পড়তেন। শুটিং শেষে আবার বসে পড়তেন আগে শুট করে রাখা অন্য কোনো সিনেমার এডিটিংয়ে। মাথা থেকে ভাবনা, বিষয়বস্তু, সবকিছু বদলে নেওয়া– এ এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার। এ রকমভাবে বেশিদিন তো চলার কথা নয়…!

আজব ব্যাপর হলো, সিনেমার প্রতি আমার কোনো আগ্রহ ছিল না। কিশোরী বয়সে আমার বন্ধু-বান্ধব হলো, তখন সবকিছু দেখতাম। তবে বাবা-মা সিনেমা-হলে যেতেন না। সম্ভবত তিনবার গিয়েছিলেন : আমরা স্টার ওয়ারস দেখেছি; সে এক দারুণ অভিজ্ঞতা! তবে বাবা-মা আমাকে কখনোই সিনেমার জগতের সঙ্গে পরিচয় করাননি। এটা আমি নিজে নিজেই হয়েছি!


বাবা
আমাকে
খুটিয়ে খুটিয়ে
সব দেখালেন : কীভাবে
রঙ করা হয়েছে, ‘ওই দেখো
ওখানে ফুল, এখানে দেখো ল্যাম্প’

বাবার সিনেমা আগেই দেখেছি, প্রিমিয়ারে তার সঙ্গে যেতাম বলে।… শুরুর দিকে আমি কিছুই বুঝতাম না; পরে ধীরে ধীরে বুঝতে ও ভালোবাসতে শিখেছি। এরপর প্রায় নিয়মিতই সেটে চলে যেতাম। ব্লুর শুটিংয়ের কথা মনে পড়ে : একটা পুরনো প্যারিসীয় বিল্ডিং বানিয়েছিলেন তারা, প্যারিসের ভিউ ছিল সেটিতে; নিশ্চয়ই সবকিছুই নকল ছিল। বাবা আমাকে খুটিয়ে খুটিয়ে সব দেখালেন : কীভাবে রঙ করা হয়েছে, ‘ওই দেখো ওখানে ফুল, এখানে দেখো ল্যাম্প…’। আমরা সারাদিন হাঁটতাম।…

বাবার সঙ্গে মার্তা

আমার ধারণা, ছোট ছোট মুহূর্তগুলো বাবা পছন্দ করতেন ঠিকই, কিন্তু শুটিং তার ভালো লাগত না : বরং এডিটিং করতেই ভালোবাসতেন। আসলে যখন তিনি ঘোষণা দিলেন, আর সিনেমা বানাবেন না, তখন একটা এডিটিং স্টুডিও বানাতে চেয়েছিলেন; চেয়েছিলেন অন্যদের বানানো সিনেমা এডিট করতে।

[বাবার বানানো সিনেমা, বিশেষত দ্য ডাবল লাইফ অব ভেরোনিকা দেখে মনে হয়েছে,] রাজনীতি তার কাছে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, বরং স্বয়ং জীবনের প্রতিই বেশি কৌতূহলী ছিলেন।

বাবার হয়ে [বাবার সিনেমা নিয়ে] কথা বলতে আমি একদমই পারব না : তার হয়ে কথা বলার জন্য তার সিনেমাগুলোই রয়েছে। তাকে আমি দর্শকদের চেয়ে বেশি চিনি ঠিকই, তবু তার কাজ নিয়ে কথা বলার কর্তৃত্ব আমার আছে বলে মনে করি না।

ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি
বাবার সঙ্গে মার্তা

আমি মনে করি, যদি তিনি এখন এখানে থাকতেন, আমাদের দুজন হয়তো তর্ক লেগে যেত। লোকেরা আমার কাছে ব্যক্তিগত প্রশ্নের উত্তর চায়, এ কারণেই এখানে এসেছি; কিন্তু একইসঙ্গে বলতে চাই, আমার বাবা ছিলেন একজন ভীষণ রকমের ব্যক্তিগত মানুষ, এবং নিজের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে তিনি কখনোই খুব একটা কথা বলেননি।… তবে আমি মনে করি, আপনি যদি তার সিনেমাগুলো দেখেন, তাহলে তার ধর্মীয় ভাবনা কিংবা আইডিয়া সম্পর্কে কম-বেশি একটা মন্তব্য পেয়ে যাবেন। হয়তো সেরা জবাবটিই পেয়ে যাবেন।

Print Friendly, PDF & Email
সম্পাদক: ফিল্মফ্রি । ঢাকা, বাংলাদেশ।। সিনেমার বই [সম্পাদনা/অনুবাদ]: ফিল্মমেকারের ভাষা [৪ খণ্ড: ইরান, লাতিন, আফ্রিকা, কোরিয়া]; ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো: প্রেম ও দেহগ্রস্ত ফিল্মমেকার; তারকোভস্কির ডায়েরি; স্মৃতির তারকোভস্কি; হিচকক-ত্রুফো কথোপকথন; কুরোসাওয়ার আত্মজীবনী; আন্তোনিওনির সিনে-জগত; কিয়ারোস্তামির সিনে-রাস্তা; সিনেঅলা [৪ খণ্ড]; বার্গম্যান/বারিমন; ডেভিড লিঞ্চের নোটবুক; ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার চান্তাল আকেরমান; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার বেলা তার; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার নুরি বিলগে জিলান; ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; বেলা তার; সের্গেই পারাজানোভ; ভেরা খিতিলোভা; সিনেমা সন্তরণ ।। কবিতার বই: ওপেন এয়ার কনসার্টের কবিতা; র‍্যাম্পমডেলের বাথটাবে অন্ধ কচ্ছপ; হাড়ের গ্যারেজ; মেনিকিনের লাল ইতিহাস ।। মিউজিকের বই [অনুবাদ]: আমার জন লেনন [মূল : সিনথিয়া লেনন]; আমার বব মার্লি [মূল: রিটা মার্লি] ।। সম্পাদিত অনলাইন রক মিউজিক জার্নাল: লালগান

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here