ঋত্বিকের ভার্চুয়াল উপস্থিতি: নামজপ বনাম ঋত্বিক বাহাস

764
ঋত্বিক ঘটক

লিখেছেন । বেলায়াত হোসেন মামুন

বাংলা মদ আর খিস্তি মিলেই যেন ঋত্বিক। ঋত্বিকের বহু কীর্তি থাকলেও বাঙালির প্রিয় বস্তু তার মাতলামি ও খিস্তিখেউর। মধ্যবিত্ত সমাজের ন্যাকাবোকা মূল্যবোধের ঘরোয়া রাজনীতির দুষ্ট-মিষ্টি কথার বাইরে গিয়ে ঋত্বিক কিছু বলার চেষ্টা করেছেন বলে ঋত্বিক হলেন ভাঙ্গা-কুলা। পরিবারের বা সমাজের সবচেয়ে দুরন্ত ‘বখে যাওয়া’ সন্তানটিকে ভালোবেসে আমরা বাউণ্ডুলে নাম দিলাম। ঋত্বিকের মেজাজ আর আপস না করবার যে প্রচারিত ইমেজ, সেখানে ঋত্বিক কতখানি হাজির আছেন? এই ইমেজ গড়ে তোলা নাকি গড়ে ওঠা?

সমকালে যেন ঋত্বিক পাঠের আর প্রয়োজন নেই; এখন চলছে ঋত্বিক বন্দনার সময়। অথচ ঋত্বিক নিজেই বন্দনাবিরোধী যোদ্ধা। ঋত্বিকের যাপিত জীবনের বাইরের এই ‘ভার্চুয়াল ঋত্বিক’ বন্দনার জীবন নিয়ে ভাবনা হয়? পরিবর্তন, বদল, অতীতের সাথে বর্তমানের বিরোধ, রাজনীতিবিদদের স্বেচ্ছাচারিতার শিকার হওয়া গণমানুষকে রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে প্রয়োগের ভাবনায় ঋত্বিক কেন জরুরি সে সব আলোচনা পাশে রেখে কেবল উচ্চারিত হয় ‘তুমি গেছো, স্পর্ধা গেছে, বিনয় এসেছে’!

এ এক নির্জলা আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কী? ঋত্বিকের কাজ, ঋত্বিকের জীবন যদি আজ কাউকে প্রণোদিত না করে, অনুপ্রেরণা না যোগায় তবে ঋত্বিকের নাম উচ্চারণের ফায়দা কী? অতীত আমাদের শিক্ষা দিতে পারে এইভাবে– যে কী ভাবে লড়তে হয়।


আত্মসমর্পণ করা যতসব
কুচুরিপানার নিরাপদ
আশ্রয় আজ
ঋত্বিকের
নাম

ঋত্বিক কি আজ লড়াইয়ের প্রেরণা দেন? তো এই লড়াই কার বিরুদ্ধে? পক্ষ-প্রতিপক্ষের জ্ঞানহীন, আত্মসমর্পণ করা যতসব কুচুরিপানার নিরাপদ আশ্রয় আজ ঋত্বিকের নাম। মদ খেয়ে বর্তমানের সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতির নষ্টামির থেকে মুখ লুকিয়ে গলিগুপচিতে খিস্তি-খেউর করার নাম ঋত্বিক বন্দনা?

ঋত্বিক ঘটক
নাগরিক
ফিল্মমেকার । ঋত্বিক ঘটক

ঋত্বিক আজ যেন ধর্ম। আর এই ধর্মের অনুসারিরা হচ্ছে চিহ্নিত আপসকামী, করপোরেটের ভাড়াখাটা, টিভি চ্যানেলের জন্য মলমূত্র তৈরিকারী আর চলচ্চিত্রে আশ্রয় খোঁজা সৃজনশীল চিন্তায় অক্ষম আত্মসর্বস্ব মানুষের দল। এরা কার্যত কোনো লড়াইয়ে নেই; ছিলেন না কোনোকালে। এক একজন হতাশার জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির মতো নিত্য হতাশা নামক লাভা উদগীরণ করেন। আর নিঃশ্বাসের উত্থান-পতনে ঋত্বিকের নামমন্ত্র তসবীর মতো অথবা রুদ্রাক্ষের মালার মতো গলায় ধারণ করেন। এদেরকে ঋত্বিকতন্ত্রের ফ্যানাটিকও ভাবা যেতে পারে।

যে সমাজ, যে রাজনীতি আর মানুষের যে বুদ্ধিবৃত্তিক অক্ষমতার কারণে ঋত্বিক সমকালে পঠিত হননি, হননি আদরণীয়, সে সমাজ ভাঙ্গার বা নতুন সমাজ গড়ার বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ে না-হাজির এই ঋত্বিকতান্ত্রিকগণ আদতে নিজেদের ব্যক্তিগত অক্ষমতার ক্ষতে ঋত্বিকের নামকবজে আশ্রয় খোঁজেন। এতে না ঋত্বিকের কোনো চিন্তা বাস্তবে কার্যকর হয়, আর না সমাজ বা মানুষের বিকাশে ঋত্বিক কোনো উপকারে লাগেন। ঋত্বিকের নামজপ তাদের জন্য কেবল এক চর্বিতচর্বণ। ঋত্বিক যেন কিছু মানুষের জন্য বাংলামদ, খিস্তিখেউর আর পরনিন্দার বিজ্ঞাপন বা জাস্টিফিকেশন মাত্র। কিছু বেখেয়াল, অক্ষম মানুষের ঋত্বিকের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়ে সমকালের বাস্তবতা থেকে মুখ লুকানো পলায়ন বিশেষ।

ভার্চুয়ালি ঋত্বিক আজ এমনই। বহুদিন যাবত অথবা বহুবছর ধরে ঋত্বিক বন্দনার এই হলো মনোজাগতিক কড়চা। অথচ ঋত্বিক পাঠে, চর্চায় ঋত্বিক হতে পারতেন বা হতে পারেন বর্তমানের দ্রোহী মননের প্রতীক। হয়েছেন কী? যদি হয়ে থাকেন তবে বর্তমানে ঋত্বিকের নামজপ করা একজন দ্রোহী ঋত্বিক-মানসসন্তান কাউকে দেখান। আছেন নাকি কেউ? আমি তো কাউকে দেখি না।

ঋত্বিকের বেদনা অথবা ঋত্বিকের দুঃখ, ঋত্বিকের সমকালে তার বন্ধু-স্বজনদের ভণ্ডামির কারণে ঋত্বিকের জীবনে সৃষ্টি হওয়া ক্ষতের উপশম খোঁজার জন্য ঋত্বিক যে চিৎকার করেছেন, সে চিৎকার আজ আপনার কাছে রোমান্টিক মনে হয়? আপনি ঋত্বিকের বেদনায় দগ্ধ চিৎকারে ভাবালুতা অনুভব করেন। ঋত্বিক কি এইভাবে কাজে লাগতে চেয়েছিলেন?


তার
চিৎকার, তার
ক্ষত ভীষণ ব্যক্তিগত

ঋত্বিক একজন সৃষ্টিশীল মানুষ, যিনি চেতনায় গণমানুষের প্রতি দায়গ্রস্ততা বহন করেন; চেতনায় দগ্ধ সেই ঋত্বিকের আর্তস্বরকে আজকের ঋত্বিক বন্দনাকারীগণ প্রায় আধ্যাত্মিক করে তুলেছেন। ঋত্বিক জেসাস ছিলেন না। তিনি কেবল একজন মানুষ ছিলেন। তিনি সমগ্র মানবজাতির দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা নিজের শরীরে ধারণ করবার দায় নিয়ে কোনো আধ্যাত্মিক সাধনায় মগ্ন ছিলেন না। তাই তার চিৎকার, তার ক্ষত ভীষণ ব্যক্তিগত। ভীষণ মানবিক। ভীষণ জীবন্ত। আর সে কারণেই তিনি তার চারপাশকে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ করেছেন, প্রত্যাখ্যান করেছেন। এ চ্যালেঞ্জ, এ প্রত্যাখ্যান কোনো রোমান্টিকতা নয়। একে রোমান্টিসাইজ করার সবরকম চেষ্টাকে তাই প্রত্যাখ্যান করা জরুরি।

ঋত্বিক কোনো ধর্মগুরু বা গুপ্তবিদ্যার সাধক নন। তিনি জাগতিক বিষয়ে ভীষণ রাজনৈতিক। তিনি মানুষের জন্য বেদনাহত হয়েছেন, তিনি মানুষের জন্য রাজনীতি করেছেন। একজন শিল্পী যখন নিজের শিল্পীস্বত্তায় মানুষের জন্য রাজনীতি ধারণ করেন, তখন তা মহত্তম শিল্পে পরিণত হয়। ঋত্বিকও তাই করেছেন। কিন্তু আজকের ঋত্বিক বন্দনাকারীদের জীবনে ঋত্বিক কেবল এক জপমন্ত্রবিশেষ। তসবীর এক একটি দানায় ঋত্বিকের নাম নেওয়াতে ঋত্বিকের মনন আপনার মননে জায়গা করে নেবে না। ঋত্বিক একজন ভীষণ আত্মসচেতন শিল্পী ছিলেন। তিনি আকন্ঠ মদ্যপান করেও স্থির জানতেন তাকে কী করতে হবে, কী করতে হবে না। এ রকম ব্যালেন্সড মানুষ শিল্পের ইতিহাসে আর কয়জনই বা এসেছে!

ঋত্বিক ঘটক
মেঘে ঢাকা তারা
ফিল্মমেকার । ঋত্বিক ঘটক

আজকের ঋত্বিক উদযাপন বা ঋত্বিক স্মরণে যে মনোভাব ব্যক্ত হয়, তা ভীষণ হাস্যকর। অধিকাংশ অপ্রয়োজনীয়। না শুনলে বা না জানলে তেমন কোনো ক্ষতি নেই। ঋত্বিকের লেখা, ঋত্বিকের নির্মিত চলচ্চিত্র, ঋত্বিকের বলা প্রতিটি কথা চাইলেই সংগ্রহ করা যায়। পড়া যায়, দেখা যায় এবং বিচার করা যায়। যে ঋত্বিক বলেন ‘প্রথমে সত্যনিষ্ট হও, পরে সৌন্দর্য্য নিষ্ঠ হইও’– সে ঋত্বিকের সত্যনিষ্ঠ ভক্তকুল কোথায়?


ঋত্বিকের
স্ববিরোধ
প্রচুর

ঋত্বিক বলেন তিনি ‘সিনেমার প্রেমে পড়েননি’। কিন্তু তার সিনেমা দেখলে কি এই প্রেমে না-পড়া চোখে পড়ে? তার নির্মিত চলচ্চিত্রের চেয়ে নির্মাণ করতে চাওয়া চলচ্চিত্রের সংখ্যা, অ-সমাপ্ত চলচ্চিত্রের সংখ্যা বেশি হয় ‘প্রেমে না পড়েই’? অতএব ঋত্বিকপাঠ সহজ নয়। ঋত্বিকের স্ববিরোধ প্রচুর। স্ববিরোধ থাকাটাই তো শৈল্পিক। কারণ শিল্পী কেবল একটি মতে যদি আটকে পড়েন, তবে সত্য তিনি দেখবেন কী করে?

ভার্চুয়ালি ভেসে বেড়ানো ঋত্বিকভক্তকুল ঋত্বিককে জানেন কিছু শোনা কথায়, কিছু শিরোনাম পড়ায়। দেশভাগ ঋত্বিকের জীবনের সাথে জুড়ে যাওয়া গল্প বটে; তবে দেশভাগের মানবিক বিপর্যয়কে ঋত্বিক যে হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যের মানবিক ন্যারেটিভ দিয়ে মূর্ত করেন, সে হাজার বছরের বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্যের মুক্তমনা চোখ আপনার আছে নাকি? যদি থাকতো, তাহলে দেশভাগের বিপর্যয়ের নামতা পড়ার সময়ে আপনি কেবল ১৯৪৭-এ আটকে পড়তেন না। ১৯৪৭-কে আপনার কেবল একটি ঘটনা মনে হতো। আপনি সময়ের দীর্ঘ মানচিত্রে মানুষের স্থানিক লড়াইয়ের অপরাজেয় শক্তির উন্মোচন আবিষ্কার করতেন। ঋত্বিক তো তাই করেছেন। ঋত্বিক মানুষের হৃদয়ের অপরাজেয় ঐশ্বর্য্যের সন্ধান করেছেন, আর আপনি আজ ঋত্বিকধর্মে নিষ্ঠ মানুষ, আপনি কেবল ঋত্বিকের খিস্তি-খেউর আর বাংলামদে ঋত্বিককে খুঁজে পেলেন!

ঋত্বিক ঘটক
তিতাস একটি নদীর নাম
ফিল্মমেকার । ঋত্বিক ঘটক

ঋত্বিক প্রতীক-মিথ-ধর্ম-লোকাচার হয়ে দুনিয়ার মানুষের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানকাণ্ডের সকল ব্যাখ্যার সাথে কম-বেশি পরিচিত ছিলেন। এক অসম্ভব ভালো পাঠক ও চিন্তক ছিলেন ঋত্বিক। ছিলেন নিজের সময়ের দূরদর্শী রাজনৈতিক ব্যাখ্যাকারও। নাটক-সিনেমায়, প্রবন্ধ-গল্প ও কবিতায় তিনি তার সেই মননের অল্পবিস্তর ছাপ আমাদের জন্য ছেড়ে গেছেন। সে সব সৃষ্টি দেখা-পড়া ও বোঝায় যদি আপনি ঋত্বিককে চিনতে না পারেন, তবে ঋত্বিককে চিনতে কোনো পুরোহিত, তান্ত্রিক বা মওলানার দারস্ত না হওয়াই উত্তম। কারণ এরা আপনাকে ঋত্বিক চেনাতে পারবে না। ঋত্বিকের থিসিস-এন্টিথিসস এবং সিনথেসিস আপনাকেই বুঝতে হবে। আর সেজন্য ঋত্বিকের সাথেই আলাপে বসুন; ঋত্বিক-পুরোহিতের সাথে নয়। কারণ চিরকাল এটাই সত্য যে, ধর্মের সৃষ্টিকারী মহাপুরুষদের ধর্মকে তার ব্যাখ্যাকারেরা ঘুঁটে দিয়েছেন। ধর্মের কলকব্জা গড়ে উঠেছে অনুসারিদের বন্দিত্বকে চিরস্থায়ী করবার অভিপ্রায়ে। অথচ চিরকাল মহামানুষগণ এসেছিলেন মানুষের মুক্তির বার্তা নিয়ে। আজ প্রতিটি ধর্ম মানুষকে বন্দি করতেই তৎপর। ঋত্বিককে ধর্ম বানানো ঋত্বিক-পুরোহিতগণও এর বাইরের কিছু নন।


সকলের
নিজস্ব ব্যর্থতার
ও অক্ষমতা ঢাকার
জন্য আড়ালের দরকার হয়।
আজকের দিনে ঋত্বিক হলেন সেই আড়াল

ঋত্বিককে ধর্ম বানানো আজকের ভার্চুয়াল ঋত্বিক অনুসারিগণ যদি রাষ্ট্রের জবরদস্তিমূলক শাসনের বিরুদ্ধে, করপোরেট মনোপলির বিরুদ্ধে অথবা ভ্রষ্ট সমাজের প্রতি একটি করে পাথর নিক্ষেপ করেন, তবে সমাজের দেয়ালে ফাটল ধরতে বাধ্য। কিন্তু কেউ রাষ্ট্র-সমাজ বা করপোরেট মনোপলির বিরুদ্ধে কিচ্ছুটি করবেন না। বসে বসে কূটকচাল করবেন– কীভাবে আপনার বা আপনার পরিবারের জন্য সবটা লুটে নেওয়া যায়, দখল করা যায়, নিজের জন্য আরও একটু ‘সুবিধা’ বের করে নেওয়া যায়। এসব হয়ে-টয়ে গেলে কোনো একদিন সন্ধ্যায় নিজস্ব ভক্তকুলের সাথে বসবেন নামজপ ও বন্দনার আসরে। অথবা হঠাৎ হঠাৎ লিখবেন ‘তুমি গেছো, স্পর্ধা গেছে, বিনয় এসেছে’! এসব করেন বা করবেন; কারণ সকলের নিজস্ব ব্যর্থতার ও অক্ষমতা ঢাকার জন্য আড়ালের দরকার হয়। আজকের দিনে ঋত্বিক হলেন সেই আড়াল।

ঠিক এমনি অপরের ব্যর্থতার, আত্মসমর্পণের আড়াল হতে পারেন যে কেউ। সত্যজিৎমৃণালও। হতে পারেন জহির রায়হানআলমগীর কবির অথবা তারেক মাসুদও। হতে পারেন ব্রেঁসো-তারকোভস্কিকুরোসাওয়াগোদার অথবা আব্বাস কিয়ারোস্তামি। হালের কিম কি-দুক অথবা সেকালের বুনুয়েলও হতে পারেন আজকের কারও কারও ব্যর্থতার, অক্ষমতার আড়াল। আফ্রিকার ওসমান সেমবেনে বা দক্ষিণ আমেরিকার মিগুয়েল লিতিন বা ফার্নান্দো সোলানাসও হতে পারেন কারও কারও প্রিয় আড়াল।

এসব আড়ালের রাজনীতির পাঠ ও বিচারের বোঝাপড়ার জন্য যে সচেতন তৎপরতার প্রয়োজন, সমাজে আজ তা জারি নেই। আর নেই বলেই তুলনামূলক শূন্য-বুদ্ধিমত্তার মানুষগণ এসব নামের জপতপে নিজস্ব আড়াল খুঁজে নেন। কার্যত এসব আড়াল সমকালে নিজের নিষ্ক্রিয়তার বটিকাবিশেষ– যা সময়ে সময়ে উচ্চারণ করে সমকালের ভ্রষ্টতা, অনাচার, মানবিক বা সামাজিক বিপর্যয়ে নিজের দায় ও দায়িত্ব থেকে পলায়নের অজুহাত তৈরি করেন। পলায়নবাদী-সিনিক্যাল মানুষের জন্য অতীত এমন কিছু নাম রেখে গেছে, যা উচ্চারণে সমকালের যন্ত্রণা লাঘব হয়। বাংলায় ঋত্বিক হলেন এমন নামের অন্যতম বড় বিজ্ঞাপন।

ঋত্বিক ঘটক
যুক্তি তক্কো আর গপ্পো
ফিল্মমেকার । ঋত্বিক ঘটক

আমার ঋত্বিক বিচার পলায়নবাদী নয় বা সিনিক্যালও নয়। আমি ঋত্বিকের মদ খেয়ে করা মাতলামি বা তার অবিরল খিস্তি-খেউরকে গুরুর ‘আশীর্বাদ’ বলে গড় প্রণাম ঠুকি না। আমি বরং খুঁজে দেখি কেন ঋত্বিক পাঁড়মাতাল হলেন, কেন একজন সো-কল্ড ভদ্র তরুণ মধ্যবয়সে খিস্তি-খেউরের বন্যা বইয়ে দিলেন। আমি ঋত্বিকের কাছ থেকে এক-পা দূরে দাঁড়িয়ে ঋত্বিক তর্জমা-তাফসীরকে কার্যকর কাজ বলে মনে করি। ঋত্বিক বা দুনিয়ার কোনো মানুষই আমার জন্য ‘বিনা-বাহাসে’ গৃহিত ব্যক্তিত্ব নন। সময় ও চিন্তাকে বোঝার জন্য কার্ল মার্কস বা রবীন্দ্রনাথ বা লালনকে যদি বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারি, তবে ঋত্বিক-সত্যজিৎ বা মৃণাল কেন নয়? কেন নয় জহির রায়হান-আলমগীর কবির বা তারেক মাসুদ? কেন নয় যে কেউ?


তার
প্রেম সময়ের
ভেতর দিয়ে বয়ে
যাওয়া মানুষের জীবন

প্রকৃতির
আশ্চর্য যাপনের
ইতিহাস লিপিবদ্ধ করায়

ঋত্বিক চলচ্চিত্রের প্রেমে না পড়েই চলচ্চিত্রের মহান স্রষ্টাদের একজন। আমিও ঋত্বিকের প্রেমে না পড়েই ঋত্বিকের জন্য কাটিয়ে দিলাম বহু দিন-মাস-বছর। প্রেমের মায়া কাজ করে অলক্ষ্যে, স্পষ্ট উচ্চারণে প্রেম করি না বলেও তাই বহু প্রেমিক আজীবন প্রেমকে জীবন দিয়ে যায়। চলচ্চিত্রের সাথে প্রেমে ও অ-প্রেমে ঋত্বিকও তেমন প্রেমিক। তিনি চলচ্চিত্রের প্রেমে পড়েননি সত্য, চলচ্চিত্র তার প্রেমের বাহন মাত্র। তার প্রেম সময়ের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া মানুষের জীবন ও প্রকৃতির আশ্চর্য যাপনের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করায়। তার প্রেম মানুষের জন্য শাশ্বত মুক্তির পুনঃপৌণিক লড়াইয়ের গাথা গড়ায়। এই ঋত্বিক ইতিহাসে নিজস্ব অস্তিত্বে উজ্জ্বল। তাই ঋত্বিকের প্রতি প্রেমে ঋত্বিকের কোনো লাভ-ক্ষতি নেই। ঋত্বিক যদি আপনার সময়কে বুঝতে আপনাকে কোনো সহযোগিতা করেন বা করতে পারেন, তবেই ঋত্বিক আপনার জন্য প্রয়োজনীয়। সেই প্রয়োজনটা খুঁজুন। ঋত্বিককে ধর্ম না বানিয়ে তর্ক বানান। কারণ তর্কে আপনার মুক্তি, বিশ্বাসে বহুদূর!


৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০

Print Friendly, PDF & Email
লেখক; চলচ্চিত্র নির্মাতা; চলচ্চিত্র সংগঠক। ঢাকা, বাংলাদেশ। সাধারণ সম্পাদক, ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশ। সভাপতি, ম্যুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটি। নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র : অনিবার্য [ পোশাক শ্রমিক আন্দোলন; ২০১১]; পথিকৃৎ [চলচ্চিত্রকার বাদল রহমানের জীবন ও কর্মভিত্তিক; ২০১২ (যৌথ নির্মাণ)]; সময়ের মুখ [জাতীয় অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলামের জীবন অবলম্বনে; ২০১৮]। সম্পাদিত ফিল্ম-ম্যাগাজিন : ম্যুভিয়ানা; চিত্ররূপ। সিনে-গ্রান্থ : চলচ্চিত্রপাঠ [সম্পাদনা]; চলচ্চিত্রের সাথে বোঝাপড়া; স্বাধীন চলচ্চিত্র আন্দোলনের ইশতেহার : বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ; চলচ্চিত্রকথা [তারেক মাসুদের বক্তৃতা ও সাক্ষাৎকার; সম্পাদনা]। পরিকল্পক ও উৎসব পরিচালক : নতুন চলচ্চিত্র নতুন নির্মাতা চলচ্চিত্র উৎসব

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here