লিখেছেন । সায়ন্তন দত্ত

ভ্যাগাবন্ড
[Sans toit ni loi]
ফিল্মমেকার ও স্ক্রিনরাইটার । অ্যানিয়েস ভার্দা
প্রডিউসার । উরি মিলস্টেইন
সিনেমাটোগ্রাফার । প্যাট্রিক ব্লোশিয়া
এডিটর । প্যাট্রিসিয়া মাজু; অ্যানিয়েস ভার্দা
মিউজিক । জোয়ান্না ব্রুজদুভিকস; ফ্রেড চিচিঁ
কাস্ট [ক্যারেক্টার] । সাঁদ্রিন বোনেইর [মোনা]; মাশা মেরিল [মি ল্যান্ডার]
ডিস্ট্রিবিউটর । এমকে২ ডিফিউশন
রানিংটাইম । ১০৫ মিনিট
ভাষা । ফ্রেঞ্চ
দেশ । ফ্রান্স
রিলিজ । সেপ্টেম্বর ১৯৮৫
অ্যাওয়ার্ড । গোল্ডেন লায়ন [ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল]

ফিল্মমেকার । অ্যানিয়েস ভার্দা
সমকালে তো বটেই, এমনকি ইতিহাসেও এমন ছবি খুঁজে পাওয়া ভার যেখানে প্রধান চরিত্রের মধ্যে স্রষ্টার সমস্ত রকম সম্ভাব্য সমান্তরাল সম্ভাবনা খুঁজে নেওয়ার প্রলোভন থাকা সত্ত্বেও এবং সেই চরিত্রের আইডেনটিটি সামাজিক প্রথাগত রাজনীতির বিপ্রতীপে বসানোর এমন আদর্শ অবস্থা থাকা সত্ত্বেও পরিচালক সে প্রলোভন সচেতনে প্রত্যাখ্যান করেন। আমরা জোকার জেনারেশন– আমাদের অভ্যাসই প্রধান চরিত্রকে হয় থরথর আবেগে সমাজ-বহিষ্কৃত হিরো বানিয়ে দেখা, নয়তো পলিটিকাল কারেক্টনেসের দাঁড়িপাল্লায় মেপে অমুক আইডেনটিটির ‘রিপ্রেজেন্টেশন’ ছবির পর্দায় কত পার্সেন্ট হলো এবং তার ফলে ছবির ইতিহাসের পলিটিকাল ইনকারেক্টনেস কত পার্সেন্ট শুদ্ধ হলো– তা বিচার করে দেখা। আমরা ছবি দেখতে ভুলে গেছি, তাই অ্যানিয়েস ভার্দা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন সদ্য। আমরা রাজনীতি ভুলে গেছি, তাই অ্যানিয়েস ভার্দা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন সদ্য। আমরা চলচ্চিত্রের সাপেক্ষে কীভাবে ‘ফর্ম’-এর মাধ্যমে রাজনীতির নির্মাণ করতে হয়, তাও ভুলে গেছি, তাই অ্যানিয়েস ভার্দা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন সদ্য।

ভ্যাগাবন্ড ছবিটি এককথায় কী? এ ছবিকে এককথায় সারসংক্ষেপ করা খুবই সহজ; কারণ এর বেশি কিছু বলাই যায় না। মোনা নামের এক তরুণী ফ্রান্সের গ্রামে গ্রামে ভবঘুরে হয়ে ঘুরে বেড়ায়, কোথাও সে বেশিদিন থাকে না, থিতু হওয়ার সমস্ত রকম প্রলোভন সে প্রথমেই প্রত্যাখ্যান করে। শুধু এইটুকু বললেই আমাদের আবেগ জর্জরিত বাঙালি হৃদয়ে যে রোম্যান্টিক ভবঘুরে ছবি ফুটে উঠে, সবিনয়ে জানাতে হয়, অ্যানিয়েস ভার্দার মোনা প্রতিটি বিষয়েই তার ঠিক উল্টো। সে বাধ্য হয়ে ভবঘুরে নয়, স্বেচ্ছায় নির্বাসিত; তার থাকার জায়গা জোটে না– এমন না, তাকে কোথাও থাকতে দেওয়া হয় না– এমন না; সে ইচ্ছে করেই সেখানে থাকে না। এই সূক্ষ্ম পার্থক্য ছবির শুরুতেই স্পষ্ট হয় না, আমাদের জোকার অভ্যস্ত সিনেমা দেখার চোখ বারবার নোঙর ফেলতে চায় এমন কিছুর উপর যাকে নির্ভর করে মেয়েটাকে অন্তত ভালোবাসা যাবে, ভালোবাসা না গেলেও অন্তত সিম্পাথেসাইজ করা যাবে। আর তা বুঝেই যেন মোনা দর্শককে ঠাট্টা করতে করতে পিছলে যায় ক্রমশঃ।
…
তার
নারীবাদ
ছবির শুরুতে
ভিক্টিম নির্মাণ করে
বাকি ছবিজুড়ে ভিক্টিমহুড
সেলিব্রেশনের জনপ্রিয়
রাজনীতির শিল্প
নির্মাণের
জন্য
নয়
…
একটি একা মেয়ে ফ্রান্সের প্রত্যন্ত গ্রামের প্রায় ‘টক্সিক ম্যাস্কুলিন’ একটি পরিবেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, একজন মহিলা ফেমিনিস্ট পরিচালকের কাছে পুরুষতন্ত্র এবং প্রতিষ্ঠানকে সজোরে বিদ্ধ করার এর চেয়ে আর কী-ই-বা সুযোগ্য বিষয় আসতে পারত? কিন্তু অ্যানিয়েস ভার্দা অন্য জাতের, অন্য ধাতের শিল্পী, তার নারীবাদ ছবির শুরুতে ভিক্টিম নির্মাণ করে বাকি ছবিজুড়ে ভিক্টিমহুড সেলিব্রেশনের জনপ্রিয় রাজনীতির শিল্প নির্মাণের জন্য নয়। তিনি বজায় রাখেন অদ্ভুত এক নিরপেক্ষ দৃষ্টি। পরবর্তীকালে আব্বাস কিয়ারোস্তামি তার টেস্ট অব চেরি ছবিতে বাদীর প্রতি অদ্ভুত ঠাণ্ডা হৃদয়ে ক্যামেরা তাক করে থাকবেন যেভাবে, যেভাবে তিনি প্রধান চরিত্রের আত্মহত্যা করতে যাওয়া নিয়ে নির্মিত ছবিতে আত্মহত্যার একটিও কারণ দেখাতে সচেতনভাবে অস্বীকার করবেন– এই রূপগত এবং রাজনৈতিক অনুশীলন ভার্দার ছবিরও প্রধানতম বৈশিষ্ট্য। সবই বুঝতে পারছি আমরা, মোনা ভবঘুরে। কিন্তু কেন? ভার্দা জানাতে অস্বীকার করছেন।

কিন্তু কেন? প্রধান চরিত্রের সাথে একাত্ম হওয়ার সমস্ত রকম সুযোগ এবং প্রলোভন যখন পরিচালক এবং দর্শকের কাছে আছে, তখন কেন শিল্পী সচেতনভাবে এড়িয়ে যাচ্ছেন সেই পথ? চরিত্রদের সাথে একাত্ম করে ফেললে শিল্প কি কম ভালো হয়? ইতিহাস আমাদের দেখিয়েছে, মোটেই তা নয়। বেশিদূর যেতে হবে না, ঘরের কাছেই ঋত্বিক ঘটক আছেন, তার ‘মেলোড্রামা’ ব্যবহারের অন্যতম প্রধান শর্তই এই একাত্মীকরণ। [অযান্ত্রিক বা মেঘে ঢাকা তারা ভাবুন।] কিন্তু, অ্যানিয়েস ভার্দার ঘরানা খানিক অন্যরকম, তিনি অন্য পরিকল্পের শিল্পধারণায় বিশ্বাসী– যেখানে একাত্ম করে দর্শককে নাড়া দেওয়ার বদলে ক্রমশঃ শূন্যতায় ফেলে দেওয়া হয়। ভার্দার মোনা তাই একা একা ঘুরতে ঘুরতে কখনও সৌভাগ্যক্রমে ধনী মহিলা প্রফেসরের নিশ্চিত সান্নিধ্য পায়, আবার কখনও খাবারের পয়সার প্রয়োজনে যৌনতা বিক্রি করতে হয়, কখনও ধর্ষিতাও হতে হয়।

আমরা বুঝতে পারি, ফ্রান্সের প্রায় সব রকম শ্রেণির সমাজের ক্লেদ যখন এই একটি মেয়ের ভবঘুরে জীবনের গতি থেকে ফুটে উঠছে, তার বিপ্রতীপে সহজেই মোনা’কে ভিক্টিম বানিয়ে ফেলা যেত। ভার্দা ঠিক করেন, ভিক্টিমহুড সেলিব্রেশনের নয়, বরং অন্য এক ধরনের নারীত্বের কথা তিনি বলবেন, যে নারীত্ব অব্যর্থভাবে পুরুষতন্ত্রের বিরোধী হয়েও নিজের দুর্বলতার রাজনীতিকে আন্ডারলাইন করে না। বরং, এ ছবির এক অত্যন্ত জরুরি দৃশ্যে– ইউনিভার্সিটি ড্রপআউট দর্শনের মাস্টার্স এক প্রবীণ ছাত্রের সাথে মোনার কথপোকথনে সে ছাত্র যখন বলে, “তুমি সার্বিক স্বাধীনতা বেছে নিলে আসলে কিন্তু সার্বিক নির্জনতা পাবে! রাস্তা থেকে কোনো পুরুষ তোমাকে গাড়িতে তুলে নিলে তুমি ভাগ্যবান, আরও ভাগ্যবান সে তোমায় যদি মলেস্ট না করে।”

সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে অত্যন্ত হাল্কা চালে মোনা এ কথার উত্তর দেয়, ইংরেজি সাবটাইটেলে ‘I don’t care, I move’। মুহূর্তে অন্য এক নারীত্ব, অন্য এক রাজনীতির জন্ম হয় যেন, যে রাজনীতি সপাট– দার্শনিক– সাবলাইম।
পাঠক,
ভুল ভাববেন না!
পুরুষতন্ত্রের বিরূদ্ধে সব রকম রাজনীতিই সমর্থনযোগ্য, ভিক্টিমহুডের রাজনীতি তো বটেই। কিন্তু শিল্পের ভাষায় ভিক্টিমহুড সেলিব্রেশন দেখতে দেখতে হেজে যাওয়া চোখে যেন ঘুঁষি মারেন অ্যানিয়েস ভার্দা। নতুন করে মনে করিয়ে দেন, জীবনটা আসলে উপভোগের জন্য, হেসে-খেলে ঘুরে বেড়ানোর জন্য; সবসময় গোমড়া মুখে আইডেনটিটিগত লাভ-ক্ষতির হিসেব কষার জন্য নয়।

এ ছবির প্রাণ, আত্মা যেন পোরা আছে ছবির শেষের দিকের এক দৃশ্যে, যেখানে মোনা এক অপরিচিত বৃদ্ধার সাথে ওয়াইন খেতে খেতে খিলখিল করে হাসতে থাকে, প্রায় অকারণেই, আর অ্যানিয়েস মিড-লং শটে চুপ করে দেখতে থাকেন ওদের। অস্পষ্ট স্বরে বৃদ্ধার কিছু কথা ভেসে আসতে থাকে, তারপর তাও আর বোঝা যায় না; ফ্রেমজুড়ে ভেসে থাকে শুধু হাসি– এক বৃদ্ধা আর এক তরুণীর। এই হাসি অ্যানিয়েস ভার্দার ছবির জন্য খুব জরুরি। তিনি যেন এই হাসিটুকু ধরে রাখার জন্যই এই ছবি করেন, যেখানে ঘুরতে ঘুরতে, তাড়া খেতে খেতেও এই হাসিটুকু বেঁচে থাকে। ভার্দা কাব্যিক হয়ে যান এখানে, ফ্রেমজুড়ে লক্ষ টাকার কম্পোজিশনের ছেঁদো বাজারি কবিতা নয়, বরং জীবনের কবিতা– বেঁচে থাকার কবিতা, জীবনযাপন করার কবিতা। সে কবিতা রাজনৈতিক, সময় বিশেষে ধূসর; কিন্তু বড় আষ্টেপৃষ্টে জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা। অ্যানিয়েস ভার্দা ছবি করেন এই দর্শনে পৌঁছাবার জন্যই।