জোকার: নৈরাজ্যের রাস্তায় ‘পিতা’র হত্যাকারী

1546
জোকার

লিখেছেন । বিধান রিবেরু

জোকার

জোকার
Joker
ফিল্মমেকার । টড ফিলিপস
প্রডিউসার । টড ফিলিপস; ব্র্যাডলি কুপার; এমা টাইলিঙ্গার কসকফ
স্ক্রিনরাইটার । টড ফিলিপস; স্কট সিলভার
সিনেমাটোগ্রাফার । লরেন্স শার
এডিটর । জেফ গ্রথ
কাস্ট [ক্যারেকটার] । হোয়াকিন ফিনিক্স [আর্থার ফ্লেক/জোকার]; রবার্ট ডি নিরো [মুরে ফ্র্যাঙ্কলিন]
প্রোডাকশন কোম্পানি । ওয়ার্নার ব্রোস পিকচারস; ডিসি ফিল্মস
ভাষা । ইংরেজি
দেশ । যুক্তরাষ্ট্র
রানিং টাইম । ১২২ মিনিট
রিলিজ । ৩১ আগস্ট ২০১৯
অ্যাওয়ার্ড । গোল্ডেন লায়ন [ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল; ২০১৯]


জোকার
জোকার
ফিল্মমেকার । টড ফিলিপস

প্রথমে এই দুনিয়াটাকে দুঃখ ভারাক্রান্ত ঠাওরেছিল সে, পরে দেখল– না, তা নয়, দুনিয়া এক মশকরা। দুর্বলের প্রতি সবলের। অসুস্থের প্রতি সুস্থের। গরীবের প্রতি ধনীর। অসহায়ের প্রতি ক্ষমতাবানের। আর্থার নিজের জীবন দিয়ে এসব বুঝতে শেখে। তাই সে মশকরাকারীদের শায়েস্তা করতে নিজেই ‘মশকরা’ শুরু করে। বড্ড নিষ্ঠুর সে মশকরা। তাই নিজের ডাকনাম হিসেবে ‘ক্লাউন’ বা ‘কমেডিয়ান’ নয়, বেছে নেয় ‘জোকার’ শব্দটিকে। নৈরাজ্যের পথে পা বাড়ায় জোকার। মনোবিশ্লেষণের ভাষায় পিতার কর্তৃত্বকে তছনছ করে দিতে হত্যা করে সে ‘পিতা’কেই। ভেবেছিল এতে বুঝি মুক্তি মিলবে, কিন্তু এমন নৈরাজ্যে মুক্তি মেলে কি?

ডিসি কমিকসের ব্যাটম্যান সিরিজে জোকার এক মানসিক বিকারগ্রস্ত, নিষ্ঠুর খলচরিত্র। ১৯৪০ সালের ২৫ এপ্রিল ব্যাটম্যানের প্রথম সংখ্যায় তার আবির্ভাব। জোকারের স্রষ্টাদের নাম বিল ফিঙ্গার, বব কেইন ও জেরি রবিনসন। জোকারকে প্রথমে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত হলেও পরবর্তীকালে তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয় এবং ধীরে ধীরে কমিকসপ্রেমীদের কাছে ব্যাটম্যানের সবচেয়ে বড় শত্রু, ক্লাউন প্রিন্স অব ক্রাইমখ্যাত জোকার হয়ে ওঠে জনপ্রিয় চরিত্র। সম্প্রতি এই চরিত্রকে নিয়েই চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন টড ফিলিপস। মানসিক ব্যধিগ্রস্ত, ধর্ষকামী, ধুরন্ধর শয়তান এই চরিত্রটি যেভাবে বর্ণিত হয়ে আসছিল সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে, সেটির ঠিক উল্টো বয়ান হাজির করেছেন নির্মাতা ফিলিপস। সমাজের প্রতিকূলে থেকে অসহায় মানুষ মার খেতে খেতে কি করে একজন ‘জোকার’ হয়ে ওঠে, সেই কাহিনীই দেখান তিনি আমাদের। এই হয়ে ওঠার গল্পে নরহত্যা আছে, নৈরাজ্য আছে। যে পথে জোকার অর্থাৎ আর্থার হেঁটেছে, সেই পথে মুক্তি মিলবে কি না, সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে সংক্ষেপে জেনে নেওয়া যাক ফিলিপসের জোকার-এর সারসংক্ষেপ।

জোকার
জোকার

আশির দশক। অপরাধ, সহিংসতা, দারিদ্র ও সর্বোপরী বেকারত্বের ভারে ধুঁকতে থাকা গথাম শহরে ছোটখাটো এক ফ্ল্যাটে বাস করে পার্টি ক্লাউন ও স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ান যশপ্রার্থী আর্থার ফ্লেক [হোয়াকিন ফিনিক্স]। সঙ্গে থাকে বৃদ্ধ মা পেনি ফ্লেক। মানসিকরোগে আক্রান্ত আর্থার নিজের আবেগকে, বিশেষ করে নিজের বেমক্কা হাসিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। স্যুয়োডোবালবার ইফেক্টে আক্রান্ত আর্থার তাই নিজের সাথে ছাপানো কার্ড রাখে, যাতে এই সমস্যা সম্পর্কে লেখা রয়েছে, হাসির দমক উঠলে সেটা বাড়িয়ে দেয়, যেন লোকে ভুল না বোঝে। তবুও লোকজন তার এই বিটকেলে ব্রেকহীন হাসি দেখে বিষম খায় ও বিরক্ত হয়।

একাকিত্ব ও বিষণ্ণতায় ভোগা আর্থার পরিত্রাণের আশায় সামাজিক সেবার আওতায় ওষুধ সেবন করে। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হয় না, কারণ তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও কাজের ধরনের কারণে চরম বৈরি পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়। মনের ক্ষত উপশম হওয়ার জন্য কোথাও সহানুভূতি পায় না সে। মনের রোগ সারবে কেমন করে? একটি ক্লাউন সংস্থার পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনের বোর্ড নিয়ে ক্লাউন সেজে রাস্তায় দাঁড়াতে হয় আর্থারকে। সেখানেও উৎপাত। প্রতিদিনের মতো সেদিনও একদল বখাটে ছেলে তাকে উত্যক্ত করে, এমনকি হাতে ধরে থাকা বিজ্ঞাপনের বোর্ডটি ভেঙেও ফেলে। শুধু তাই নয়, সর্বক্ষণ আতঙ্কে থাকা আর্থারকে বেধড়ক মারপিটও করে। এতে আর্থার আরো বেশি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। আর্থারকে সাহস জোগাতে সংস্থারই আরেক কর্মচারী র‍্যানডল তাকে একটি পিস্তল দেয়।

জোকার
জোকার

পিস্তলটিই পরিস্থিতি পাল্টে দিতে থাকে। একটি হাসপাতালে ক্লাউন সেজে শিশুদের আনন্দ দেওয়ার সময় পিস্তলটি আর্থারের পকেট থেকে পড়ে যায়। যদিও ভয় পাওয়া শিশুদের সে বলে এটা খেলনা পিস্তল, কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয় না। সংস্থা থেকে চাকরি যায় আর্থারের। আর্থারকে পিস্তল দেওয়ার কথা র‍্যানডলও অস্বীকার করে। বিধ্বস্ত আর্থার এ সময় ট্রেনে একটি ঘটনার মুখোমুখি হয়। আপাত ভদ্র তিন ধনীর দুলাল ট্রেনের ভেতর এক নারীকে বিরক্ত করতে থাকে। নারীটি উঠে অন্যত্র চলে গেলে, সেই বিটকেলে হাসি হাসতে থাকে আর্থার। আর এতে ক্ষিপ্ত হয়ে তার উপর চড়াও হয় তিনজন। কিছুক্ষণ মার হজম করার পর পকেট থেকে পিস্তাল বের করে ঘোড়া টেনে দেয় আর্থার। ট্রেনের ভেতরেই দুজন পড়ে যায়। আর তৃতীয়জন পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও রেহাই পায় না আর্থারের ক্রোধ থেকে। ঘটনাচক্রে এই নিহত তিনজনই ছিল শহরের মেয়র পদপ্রার্থী, ধনাঢ্য থমাস ওয়েনের কোম্পানির লোক।


জীবনে
যারা কিছু
করে উঠতে
পারেনি, যারা তাকে
হিংসা করে, তাদের দিকে
তাকালে তার ক্লাউন মনে হয়

ট্রিপল মার্ডারের পর এমনিতেই চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয় শহরে। এরপর এই হত্যা নিয়ে তীর্যক মন্তব্য করে বসে কোটিপতি থমাস ওয়েন। সে বলে, জীবনে যারা কিছু করে উঠতে পারেনি, যারা তাকে হিংসা করে, তাদের দিকে তাকালে তার ক্লাউন মনে হয়। ব্যস সমাজের নিচুতলার মানুষ এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তাছাড়া থমাস ওয়েন যেহেতু মেয়র নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল, ঘটনা রাজনৈতিক দিকে মোড় নেয়। গরীব ও সর্বহারা মানুষ ক্লাউন সেজে বা সঙের মুখোশ পরে রাস্তায় নেমে আসে। আন্দোলনের কেন্দ্রে চলে আসে ধনী ও গরীবের দ্বন্দ্ব।

 জোকার
জোকার

দ্বন্দ্ব শুরু হওয়ার পর সামাজিক পরিষেবা বন্ধ হয়ে যায়। ওষুধ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয় আর্থার। তারপরও সে চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে কৌতুক অভিনেতা হিসেবে নাম করার। কিন্তু তাতে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় সেই নিয়ন্ত্রণহীন উদ্ভট হাসি। এক অনুষ্ঠানে বেইজ্জতি হতে হয় তাকে। আর যে কৌতুকাভিনেতা মুরে ফ্র্যাঙ্কলিন [রবার্ট ডি নিরো] ছিল আর্থারের আদর্শ শিল্পী, সেই মুরেই নিজের টিভি শোতে আর্থারের সেই অনুষ্ঠানের অংশবিশেষ দেখিয়ে মশকরা করে। আর্থার মনে মনে ভাবত, একদিন মুরে তার শোতে তাকে দর্শক সারি থেকে ডেকে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরবে। কিন্তু ঠিক উল্টোটা দেখে মন ভেঙে যায় আর্থারের।

এরইমাঝে হঠাৎ একদিন আর্থার তার মায়ের কাছ থেকে জানতে পারে কোটিপতি ও মেয়র পদপ্রার্থী ওয়েন তার বাবা। দুইবার চেষ্টার পর আর্থার সফল হয় ওয়েনের সাথে দেখা করতে। কিন্তু দুইবারই আর্থার জানতে পারে, তার মায়ের মানসিক সমস্যা ছিল। আর ওয়েন সরাসরিই বলে দেয় আর্থার পালিত সন্তান। তার মা ওয়েনের ওখানে কাজ করত কেবল, কিন্তু কোনোরকম সম্পর্ক তার সাথে হয়নি। ওয়েনের কথার সত্যতা যাচাই করতে গিয়ে আর্থার আবিষ্কার করে, সে আসলে এতিম বাচ্চা। পেনি তাকে লালনপালন শুরু করে। ছোটবেলায় পেনির কোনো এক ছেলেবন্ধু তাকে নির্যাতন করত, মানসিক ও শারীরিকভাবে। আর সম্ভবত সে কারণেই আতঙ্ক দানা বেধে ওঠে তার মনে।


এর
আগে দেখানো
সোফির সাথে বন্ধুত্ব

প্রেম সবটাই ছিল
আর্থারের
ভ্রমমাত্র

যদিও আর্থারের পালক মা বলার চেষ্টা করে ওয়েন নিজের অবৈধ প্রেমকে লুকাতেই পাগলাগারদে তাকে ভর্তি করে দেয় এবং শিশু আর্থারকে পালিত বলে চালিয়ে দেয়, তবে এর কোনো সত্যতা পাওয়া যায় না।তাহলে মিথ্যাবাদী কে? মিথ্যা যেই বলুক না কেন, সত্য হলো, ছোটবেলায় আর্থার নিরাপদ শৈশব পায়নি। পালক মায়ের প্রতি ঘৃণা উগড়ে আসে আর্থারের। হাসপাতালে অসুস্থ মাকে তাই বালিশ চাপা দিয়ে মেরে ফেলতে তার হাত কাঁপে না। খুন করার পর প্রতিবেশী সোফির অ্যাপার্টমেন্টে প্রবেশ করে আর্থার। আঁতকে ওঠে সোফি। ভয় পেয়ে আর্থারকে দ্রুত বেরিয়ে যেতে বলে। বোঝা যায়, এর আগে দেখানো সোফির সাথে বন্ধুত্ব ও প্রেম সবটাই ছিল আর্থারের ভ্রমমাত্র।

 জোকার
জোকার

ট্রেনের ট্রিপল মার্ডারের ঘটনায় এরইমধ্যে পুলিশ সন্দেহ করতে শুরু করেছে আর্থারকে। অন্যদিকে খ্যাতিমান মুরে, আর্থারের কাছে পিতৃস্থানীয় ব্যক্তি, তাকে টেলিভিশন শোতে আমন্ত্রণ করে বসে। টিভি শোতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল আর্থার। তখন তার সাথে দেখা করতে আসে ক্লাউন সংস্থার সাবেক দুই সহকর্মী। তাদের একজন সেই র‍্যানডল, যে তাকে পিস্তল দিয়েছিল। প্রতিশোধ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে আর্থারের। র‍্যানডলকে নৃশংস কায়দায় হত্যা করে সে। নির্বিকার আর্থার এরপর পকেটে সেই পিস্তলটি নিয়ে রওনা দেয় টিভি স্টেশনের দিকে। পথে দুই পুলিশ তাকে তাড়া করে। কিন্তু ঘটনাক্রমে ক্লাউনের মুখোশ পরা অন্য একজনকে গুলি করে বসে পুলিশ। ব্যস দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়। সেই সুযোগে পালিয়ে যায় আর্থার।

টিভি স্টেশনে পৌঁছে মুরেকে সে বলে, তাকে যেন টিভিতে ‘জোকার’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। কারণ এর আগের শোতে মুরে মশকরা করে তাকে জোকারই বলেছিল। টিভিতে সরাসরি সম্প্রচার শুরু হলে জোকার স্বীকার করে, ট্রেনের হত্যা তারই করা। সমাজে লাঞ্ছিত ও বঞ্চিতদের পক্ষে ধনীদের প্রতি ক্ষোভও প্রকাশ করে জোকার। এবং এটাও বলে এর সাথে রাজনীতির কোনো যোগ নেই। আর্থারের ক্রোধ সঞ্চারিত হয় আরেকটি খুনের দিকে। লাইভ অনুষ্ঠানে আর্থার গুলি করে মুরেকে হত্যা করে। এই ঘটনা দেখার সাথে সাথে পুরো শহরে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। ক্লাউনের মুখোশ পরে শত-শত দাঙ্গাকারী বেরিয়ে আসে রাস্তায়। লুটপাট শুরু হয়ে যায়। সঙ্গে অগ্নিসংযোগ। আর্থারকে গ্রেফতার করে পুলিশ।


দাঙ্গাবাজেরা যেন এক
নতুন বাদশার
দেখা পায়
তখন

রাস্তায় যখন প্রচণ্ড গণ্ডগোল চলছে, তখন ক্লাউনের মুখোশ পরা এক ছিনতাইকারীর হাতে প্রাণ যায় থমাস ওয়েন ও তার স্ত্রীর। সে সময় তাদের সাথেই দাঁড়িয়ে ছিল ব্রুস ওয়েন। এই ছেলেটি পরে বড় হয়ে বাদুড়মানব হবে। ওদিকে জোকারকে টিভি স্টেশন থেকে আর থানা পর্যন্ত নিতে পারে না পুলিশ। পথের মধ্যেই দাঙ্গাকারীরা মুক্ত করে জোকারকে। দাঙ্গাবাজেরা যেন এক নতুন বাদশার দেখা পায় তখন। যে বাদশাকে পুলিশের হেফাজতে রাখা সম্ভব হয় না, যদি না সে চায়। এই হলো জোকার ওরফে আর্থারের জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত ও করুণ পরিণতি।

 জোকার
জোকার

নির্মাতা এক দৃশ্যে জোকারকে মিলিয়ে দেন চার্লস চ্যাপলিনের মডার্ন টাইমস-এর সাথে। ওয়েনের সাথে দেখা করতে আর্থার যখন থিয়েটারে যায়, তখন বড় পর্দায় চলছিল চ্যাপলিনের মডার্ন টাইমস। কে না জানে, ছবিটি আধুনিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ভেতর গড়ে ওঠা যন্ত্রসভ্যতার গালে কষে বসানো ‘চড়’। এই ছবিটি বেশ যত্নের সঙ্গেই পরিবেশন করেন নির্মাতা তাঁর জোকার-এর সমান্তরালে। যেন জোকার আরও একবার এই আধুনিক সভ্যতার [!] গালে চড় বসাতে হাজির হয়েছে। যে সভ্যতা ভিন্ন ধরনের হলেই তাকে সমাজের বাইরে স্থান দেয়, ‘অসভ্য’ বলে দেগে দেয়। তাকে নিয়ে নানা ছেলেখেলায় মেতে ওঠে। মানসিক বিকারগ্রস্ত বা সামান্য অসুস্থ ব্যক্তিকে সুস্থ মানুষের সমাজ যেভাবে প্রান্তে ঠেলে দেয়, সেটাই যেন মূর্ত হয়ে ওঠে প্রক্ষালনকেন্দ্রে, আর্থারকে যখন ওয়েন ঠেলে সরিয়ে দেয় নিজের কাছ থেকে। সেই দৃশ্যে আর্থার বেশ করুণ কণ্ঠে স্নেহ প্রত্যাশা করে, বলে– “তোমরা কি সামান্য সৌজন্যতাও দেখাতে পারো না? তোমার সম্পদের দরকার নেই, সামান্য উষ্ণতা চাই।” কিন্তু সমাজ নিষ্ঠুর। সে আর্থারদের মতো ‘অস্বাভাবিক’ মানুষদের শুধু সরিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত হয় না, আঘাত করে, রক্তাক্ত করে, প্রতিশোধপরায়ন করে তোলে।

তথাকথিত পূর্ণাঙ্গ মানুষের সংজ্ঞায় যারা পড়ে না, অথবা স্বাভাবিক মানুষের যে ছক সমাজ বা রাষ্ট্র তৈরি করে রেখেছে, বাস্তবতা হলো সেই সমাজ ও রাষ্ট্রের বাইরেও মানুষ রয়েছে। তাদেরকে দূরে ঠেলে দিয়ে, তাদের প্রতি প্রতিনিয়ত অমানবিক আচরণ করে কি এই সমাজ বা রাষ্ট্র নিজেরই বিপদ ডেকে আনছে না? বুর্জোয়া সমাজে গরীবেরা যেমন মানুষের কাতারে পড়ে না, তেমনি মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন মানুষেরাও ঊন-মানুষ সেখানে। এই মনোভঙ্গিই বুমেরাং হয়ে দেখা দেয় রাষ্ট্রের জন্য। পরিচালক ফিলিপস সেটাই বলতে চেয়েছেন আর্থারের আখ্যানে।

জোকার
জোকার

ফরাসি মনোবিশ্লেষক জাক লাকাঁ ফ্রয়েডের বরাত দিয়ে যেমনটা বলেন, পিতা ধারণাটির সাথে সামাজিক আইন ও রাষ্ট্রীয় কানুনের সম্পর্ক রয়েছে। সেই আইনকানুনই কখনো কখনো পিতার স্থান দখল করে। মেয়রের বাংলাটি বেশ সুন্দর, নগরপিতা। আমরা জানি শহরের আইনকানুন শুদ্ধ নয়, শহরকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করতেও কাজ করে এই নগরপিতা, অন্তত পশ্চিমা দেশে তাই হয়। কল্পিত শহর গথাম, আসলে ভেতরে ভেতরে নয়া ইয়র্ক, যখন চরম বিশৃঙ্খলতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, তখন তার পিতা হতে চায় ওয়েন। আর তার সাথেই বিরোধ আর্থারের। যেন নগরপিতা আর নগর সমার্থক আর্থারের কাছে। এই নগরের নাগরিকরাই তো অন্যায় ও অমানবিক আচরণ করছে আর্থারের প্রতি, তার দায় তো সম্ভাব্য নগরপিতাকেই নিতে হবে। নগরের এক চমৎকার মেটাফোর বা রূপান্তর হয়ে ওঠে ওয়েন।


জোকার
হয়ে গেছে
বঞ্চনার বোধ
লালন করা সন্তান

লাকাঁর ভাষায় এই ওয়েন বা নগরপিতাকে বলা যায়, সিম্বলিক ফাদার বা সাকার-পিতামাত্র। এই সাকার-পিতাকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে মুক্তি খোঁজে জোকার। জোকার এখানে আর আর্থারে আটকে নেই। জোকার হয়ে গেছে বঞ্চনার বোধ লালন করা সন্তান। জোকার হয়ে গেছে বঞ্চিত মানুষের মুখ। পুরো বিষয়টি একটি ধারণায় পর্যবসিত হয়। নামান্তর ঘটে যায় তাদের। বঞ্চিতরা যেন ঈদিপাস কূটের মুখোমুখি হয়। তারা প্রবেশ করে সাকারের জগতে। সেখানে তার সাক্ষাৎ ঘটে সাকার-পিতার সাথে। সে মনে করে এই পিতা না থাকলেই ভালো। সন্তানেরা সুখী হবে। সেই হত্যাকাণ্ড আমরা দেখি। ওয়েনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সাকার-পিতার অবসান ঘটে। তবে সেটি সাময়িক। আমরা জানি, ব্যাটম্যানই হয়ে উঠবে গথামের পরবর্তী সাকার-পিতা। নিহত সম্ভাব্য নগরপিতার পুত্র ব্রুস ওয়েনই আসছে দিনগুলোতে শাসন করবে জোকার, রা’স আল গুল, ক্যাটউইম্যান, পেঙ্গুইন, টু ফেইস বা পয়জন আইভি নামধারী অপরাধীদের। কাজেই সাকার-পিতারা কখনো নিকেষ হয় না। বুঝি নিঃশেষ হলো, এমন সাময়িক ভ্রম তৈরি হয় মাত্র।

জোকার
জোকার

আর্থার নিজের ইমাজিনারি ফাদার বা আকার-পিতাকেও হত্যা করে। লাকাঁর ভাষ্যে আকার-পিতা আর কিছু নয়, ইমাগো [Imago] মাত্র। শব্দটি কার্ল গুস্তাফ ইয়ুঙ ১৯১১ সালে ব্যবহার করা শুরু করলেও, পরে ত্রিশের দশকে লাকাঁর ব্যবহারে এই শব্দটি ভিন্ন এক ব্যঞ্জনা তৈরি করে। ইমাগোর বাংলা করা যেতে পারে ভাবমূর্তি। তো এই ভাবমূর্তির প্রতি যখন আবেগ তৈরি হয় এবং যার দৃশ্যগত রূপায়ন [রেপ্রিজেনটেশন] থাকে, তখন তাকে আকার-পিতা বলে। টিভিতে জনপ্রিয় কৌতুকাভিনেতার দৃশ্যগত রূপায়ন ছিলো এবং তার প্রতি আবেগও তৈরি হয় আর্থারের। কিন্তু টিভি শোতে ডেকে এনে মুরে যখন আর্থারকে শাসন করতে থাকে, জেরার মুখে ফেলে দেয়, তখন এই আকার-পিতাই রূপান্তরিত হয়ে যায় সাকার-পিতায়। তাই মুরেকে হত্যা করতে দ্বিধা করে না জোকার।

অর্থাৎ ব্যক্তি জোকার ও সামষ্টিক জোকার, তারা উভয়েই সাকার-পিতাকে হত্যা করে এটা ভেবে যে এতে তাদের নাজাত মিলবে। কিন্তু সেটা মেলে না। চলচ্চিত্রের শেষভাগে যে নৈরাজ্য আমরা দেখি, সেটা দেখে মনে হতে পারে সরকারবিরোধী কোনো আন্দোলনে ভেঙে পড়েছে পুরো শহর। পরিচালক বেশ সুকৌশলে সেদিকেই ইঙ্গিত দেন। তিনি যেন বলতে চান, এই মানুষেরা মুক্তি চায়। সমাজের মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে যে স্বাধীনতা বন্দী হয়ে আছে, সেটার অবসান চায় তারা।


সমাজের মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে
যে স্বাধীনতা বন্দী হয়ে আছে,
সেটার অবসান
চায় তারা

একটি পর্যায়ে মনে হতে পারে নৈরাজ্যবাদী মিখাইল বাকুনিন বা নৈরাজ্যবাদী শ্রমিকতন্ত্রী রুডলফ রকার বুঝি ভর করেছে জোকার ও শহরের উপর। তারা নগরের উপরের তলার সকলকে উচ্ছেদ করতে চায়, প্রতিষ্ঠা করতে চায় সত্যিকারের স্বাধীনতা, যেখানে সকলেই হবে সমাজের অংশীদার, কেউ তাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবে না, পাগলাগারদে পুরে দিয়ে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে না, ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করবে না, সম্পদের বৈষম্য টিকিয়ে রেখে দারিদ্রের চাষাবাদ করবে না। সমাজের সকল মানুষ, মানুষ হিসেবেই বিকশিত হবে এবং সকল রকম সুযোগ সুবিধা পাবে। আর্থারের ওষুধপত্র বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর সেই সমাজকর্মী যেমন বলছিল, যারা এই সুবিধা বন্ধ করে দিলো, তারা আর্থার বা ঐ সমাজকর্মীর মতো মানুষকে নিয়ে মোটেও চিন্তিত নয়, তারা তাদেরকে গোনার মধ্যেই ধরে না। তখন মনে হয়, এই সমাজে পরিবর্তন জরুরি। এই সমাজের মাথায় হাতুড়ি মারা সময়ের দাবী।

জোকার
জোকার

ফরাসি দেশের নৈরাজ্যবাদী তাত্ত্বিক দানিয়েল গুয়েরিন, অ্যাডলফ ফিশারের বরাত দিয়ে যেমন বলেন, সকল নৈরাজ্যবাদীই সমাজতন্ত্রী, কিন্তু সকল সমাজতন্ত্রী নৈরাজ্যবাদী নয়। একইরকম কথাই ১৮৬৫ সালে বাকুনিন বলেছিলেন নৈরাজ্যবাদের ইশতেহারে। পরবর্তীকালে রকারও তাই বলেন, সমাজতন্ত্রের চেতনা নিয়ে নৈরাজ্যবাদীদের সকল শোষণ ও বঞ্চনার অবসান করতে হবে। আনতে হবে সত্যিকারের স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতা তথাকথিত বুর্জোয়া রাষ্ট্র বা সমাজের খর্বিত স্বাধীনতা নয়, পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা। নৈরাজ্যবাদীদের এই পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা চাওয়ার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা আছে। ফ্রেডেরিক এ্যাঙ্গেলস এদের কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেছেন। এরা যে কোনো রাজনৈতিক দল না থাকার পক্ষে কথা বলেন, সেটাকে উল্টো দেশের নিয়ম বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন এ্যাঙ্গেলস। কথা হলো রাষ্ট্রকে উড়িয়ে দিয়ে শ্রমিক সংগঠন দিয়ে যে কল্পিত সমাজ পরিচালনার কথা নৈরাজ্যবাদীরা ভাবেন, সেটাও কিন্তু শেষতক রাষ্ট্রের মতোই একটি কাঠামো অর্জন করবে। যাক, সে আলোচনা ভিন্ন। যেটা বলতে চাইছি, ছবিটির শেষ পর্যন্তও আপনার মনে হবে, ফিলিপস বুঝি গথামকে গুড়িয়ে দিয়ে নৈরাজ্যবাদের ডঙ্কা বাজাতে চান।

সত্য হলো, এমন নৈরাজ্য দিয়ে কোনো কিছু কখনো অর্জিত হয় না। জোকার ও জোকার গংদেরও হবে না। সমাজে বৈষম্য আছে সত্যি, সেটিকে মোকাবেলা করতে হলে আপনাকে রাজনৈতিকভাবেই করতে হবে। সাকার-পিতাকে হত্যা করে আপনি রাজনীতির নতুন নতুন অলিগলি হয়তো খুলে ফেলতে পারেন, কিন্তু তাতে মুক্তি মিলবে না। যেমন মেলেনি জোকারের ক্ষেত্রে। বিষয়টি অতটা সরল নয়। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যদি অস্ত্রোপচার করা না যায়, তার শিক্ষা, রাজনীতি, অর্থনীতি ও নৈতিকতার জায়গায় যদি সূক্ষ্মভাবে কাজ করা না যায়, তাহলে জোকারের মতো মানসিক ও অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত মানুষদের সমাজে ঠাঁই হবে না এবং তাদের আৎকা বিপ্লবী হয়ে ওঠার পথ প্রশস্ত হবে।

জোকার
জোকার

মুরের সাথে সাক্ষাৎকারে যদিও জোকার বলছিল, এই জাগরণের সাথে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই, তারপরও আমরা তো জানি, কোনো কিছুই রাজনীতির উর্ধ্বে নয়। তাই রাজনৈতিক না হয়েও, ভীষণরকম রাজনৈতিক এই জোকার। অনেকেই একে এরইমধ্যে তুলনা করছে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ওকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলনের সাথে। আমরা এটাও জানি, ঐ আন্দোলন শেষ পর্যন্ত ভাগ্যহত মানুষের ভাগ্য ফেরাতে পারেনি। এর বড় কারণ কোনো রাজনৈতিক দিকনির্দেশনার ভেতর দিয়ে আন্দোলনটি দানা বাঁধেনি।

জোকার
জোকার

জোকার ছবিতেও যে গণজাগরণ দেখা যায়, সেটিও সমাজের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশমাত্র। তবে এই জাগরণ মানুষের মুক্তির কিশতি হতে পারবে না, পারবে না এর অন্তর্গত বৈশিষ্ট্যের কারণে, রাজনৈতিক কাঠামোর ভেতরে দ্রোহের আগুনকে আটকাতে না পারার কারণে। একে তো জোকারের মতো মানুষ, যার কোনো রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নেই, যে কি না প্রতিহিংসাপরায়ন এবং সবচেয়ে বড় কথা সমাজের ঘাত-প্রতিঘাতে সৃষ্ট এক খুনী, সে কখনো জনগণকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না। অনিচ্ছাকৃতভাবে সৃষ্ট তার এই নৈরাজ্য অন্ধগলিতে গিয়েই শেষ হবে।

শেষ কথা হলো, হুট করে মাথা গরমের আন্দোলন দিয়ে সমাজের বা রাষ্ট্রের চরিত্র পাল্টানো যায় না। তার জন্য চাই দীর্ঘ অনুশীলন ও চর্চা। তারপরও এই যে হুটহাট করে আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে শহরের এ প্রান্ত থেকে ওই প্রান্তে, এটি এও প্রমাণ করে সমাজে বা রাষ্ট্রে যা চলছে, তা ত্রুটিপূর্ণ। এই ত্রুটি সারাতে হবে। পথটি ভিন্ন।

জোকার
জোকার

দোহাই
১. Jacques Lacan, The Four Funamental Concepts of Psychoanalysis: The Seminar of Jacques Lacan Book XI, Edited by Jacques-Alain Miller, Translated by Alan Sheridan, (New York, London: W. W. Norton, 1998)
২.Jacques Lacan, Ecrits: A Selection, Translated by Alan Sheridan, (London. New York: Routledge, 2008)
৩. Noam Chomsky, On Anarchism, (New York: Penguin Books, 2014)

Print Friendly, PDF & Email
লেখক, সাংবাদিক, সিনে-সমালোচক। ঢাকা, বাংলাদেশ। সিনে-গ্রন্থ : চলচ্চিত্র পাঠ সহায়িকা; চলচ্চিত্র বিচার; বলিউড বাহাস; উসমান সেমবেনের চলচ্চিত্র হালা

১টি কমেন্ট

Leave a Reply to নিরন্তর ভবঘুরের কথা : অ্যানিয়েস ভার্দার ‘ভ্যাগাবন্ড’/ সায়ন্তন দত্ত | ফিল্মফ্রি

Please enter your comment!
Please enter your name here