‘ভালো ছবির’ ফর্মুলার বাইরের ভালো ছবি ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’

477
লাইভ ফ্রম ঢাকা

লিখেছেন । বেলায়াত হোসেন মামুন

লাইভ ফ্রম ঢাকা
Live From Dhaka
স্ক্রিনরাইটার, ফিল্ম এডিটর ও ফিল্মমেকার । আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ
প্রডিউসার । শামসুর রহমান আলভী
সিনেমাটোগ্রাফার । তুহিন তমিজুর
আর্ট ডিরেক্টর । উজ্জ্বল আফজাল
কাস্ট [ক্যারেক্টার] । মোস্তফা মনওয়ার [সাজ্জাদ]; তাসনোভা তামান্না [রেহানা];’ তানভীর আহমেদ চৌধুরী [মাইকেল]; মীর মোশাররফ হোসেন [মীর]; শিমুল জয় [শাহেদ]
রানিংটাইম । ১ ঘণ্টা ৩১ মিনিট
ভাষা । বাংলা
দেশ । বাংলাদেশ
প্রিমিয়ার । ২ ডিসেম্বর ২০১৬ [সিঙ্গাপুর]
রিলিজ । ২৯ মার্চ ২০১৯ [বাংলাদেশ]


লাইভ ফ্রম ঢাকা
লাইভ ফ্রম ঢাকা
ফিল্মমেকার । আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ

ঢাকা অনাত্মীয় শহর। এই শহর মানুষের ভেতর থেকে মানুষের আত্মাকে বের করে নিয়ে আসে ধ্বসিয়ে দেওয়ার অভিপ্রায়ে। ওষ্ঠাগত প্রাণ নিয়ে মানুষ প্রতিদিন ভাবে এই শহর ছেড়ে চলে যাবে দূরে। প্রতিদিন মানুষ পরিকল্পনা করে পালাবার, খোঁজে পালাবার পথঘাট। পালাতে পারে কেউ কেউ, কেউ পারে না। কেউ হয়তো পালাতে গিয়ে ধূসর করে দিয়ে যায় অন্য কারো জীবনের প্রাণবন্ত সবুজটুকু। ঢাকার আলোকোজ্জ্বল দিনরাতের আড়ালের ধূসর ঢাকার যাপনচিত্র ধরা দেয় আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের চলচ্চিত্র লাইভ ফ্রম ঢাকায়।

লাইভ ফ্রম ঢাকা আদতে একটি স্বাধীন চলচ্চিত্র। স্বাধীন চলচ্চিত্রের সকল গুণাগুণ এই চলচ্চিত্রে দৃশ্যমান। বাংলাদেশে স্বাধীন চলচ্চিত্রের পথচলায় লাইভ ফ্রম ঢাকা মননশীল সংযোজন। চলচ্চিত্রের নির্মাণশৈলীর ভেতর নির্মাতার গল্পবলার যে দক্ষতা আমরা খুঁজতে থাকি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে তা সাদের লাইভ ফ্রম ঢাকার প্রতিটি দৃশ্যে উপস্থিত আছে। সন্দেহ নেই বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে অপ্রাপ্তির প্রবল খরার মৌসুমে এইটুকু প্রাপ্তি অনেক আনন্দের ঘটনা।

লাইভ ফ্রম ঢাকা কিছু মানুষের ছেঁড়াখোঁড়া জীবনের গল্প। ৯২ মিনিট ধরে পর্দায় ধূসর পিক্সেলের ছেঁড়া ছেঁড়া দৃশ্যমান ডটগুলো যেন এই চলচ্চিত্রের মানুষগুলোর জীবনকে প্রতিকায়িত করে চলে। তাদের জীবনের প্রাত্যহিক যাপন ক্রমাগত বিষাদময় হয়ে ওঠে। চলচ্চিত্রের প্রতিটি চরিত্র ক্রমাগত জড়াতে থাকে বেঁচে থাকার নামে দুঃসহ যাপনের ঘূর্ণিপাকে। প্রতারণা, অবিশ্বাস, মাদক, লোভ আর বাসনার হাতছানিতে এই শহর তাদের টানতে থাকে চোরাবালির খপ্পরে নাকি মানুষগুলো অবচেতনে এই নিম্নস্রোতে হাজির হয় নিয়তির অমোঘ অভিশাপে?

লাইভ ফ্রম ঢাকা
লাইভ ফ্রম ঢাকা

নির্মাতা আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের চরিত্রগুলো সব আমাদের চারপাশের পরিচিত মানুষ। আমরা হয়তো প্রতিদিন তাদের দেখি অথবা দেখি না। হয়তো আমার পাশের সিটে বসেই আজ ঘরে ফিরেছেন অন্য কোনো সাজ্জাদ। হয়তো আমার হাঁটা পথের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি আরেক রেহানা অথবা নেশাগ্রস্ত তরুণ মাইকেল যে আজ বসে ছিল বাসস্ট্যান্ডের স্টিলের বেঞ্চিতে। আমি অথবা আমরা নিজেদের যাপনের টানাপড়েনে তাদের দেখি না, হয়তো দেখার আসলে কিছু নেইও। কারণ সাজ্জাদ, রেহানা, মাইকেলের পয়েন্ট অব ভিউ থেকে দেখলে হয়তো আমরাও এক একজন সাজ্জাদ, রেহানা, মাইকেল!

চলচ্চিত্র যখন আটপৌড়ে জীবনের গল্প বলে তখন চলচ্চিত্র নির্মাণ চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে। কারণ আটপৌড়ে জীবন যতটা সহজে ফ্রেমবন্দি করা সম্ভব বলে মনে হয়, ততটা সহজ নয় এই জীবনকে চলচ্চিত্র করে তোলা। আটপৌড়ে জীবন এমনি সাদাসিদে যে এই জীবনের চরিত্রে অভিনয় করা অথবা অভিনয় করিয়ে নেওয়া উভয়ই কঠিন কাজ। সেই কঠিন কাজটি সফল করে তোলার ট্র্যাকরেকর্ড বাংলাদেশে খুব সমৃদ্ধ নয়। সেই গুটিকয় সফলদের সাফল্যের তালিকায় অবশ্যই আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের নাম অর্ন্তভুক্তি হলো। লাইভ ফ্রম ঢাকায় আমরা রাজধানী শহরের কয়েকটি সাধারণ মানুষকে আজ আবিষ্কার করলাম চলচ্চিত্রের বিশাল পর্দাজুড়ে, আবিষ্কার করলাম তাদের বিষাদগ্রস্ত জীবনের বমিউদ্রেককারী কয়েকটি দিন।


অসুস্থ
আসলে কে–
সাজ্জাদ নাকি সাজ্জাদের
বসবাসের
শহর!

ঢাকাবাসী মস্তিষ্কে প্রেসার কুকারের চাপ নিয়ে বসবাস করেন। যেমন সাজ্জাদ নামের চরিত্রটি এই চলচ্চিত্রের আগাগোড়া একটি চলমান প্রেসার কুকার যেন। তার শারীরিক সীমাবদ্ধতার [খুঁড়িয়ে হাঁটা] সাথে সাথে তার ঔষুধ খাওয়ার ঘন ঘন দৃশ্য মানুষটিকে পর্দায় অসহনীয় করে তোলে। পরিস্থিতির চাপ যখন যখন অসহনীয় হয়ে ওঠে তখন সাজ্জাদের বমির উদ্রেক হয় বা বমি হয়। পরিস্থিতির চাপকে ডিনাই করবার এই মেটাফরিক উপস্থাপন চলচ্চিত্রে এমনভাবে গাথা যেন তা স্বাভাবিক মনে হয়। মনে হয় সাজ্জাদ হয়তো সত্যিকারের অসুস্থ। কিন্তু পুরো ছবি শেষে প্রশ্ন জাগে মনে– অসুস্থ আসলে কে সাজ্জাদ নাকি সাজ্জাদের বসবাসের শহর!

লাইভ ফ্রম ঢাকার দৃশ্যের সাধারণত্বে মুগ্ধ হয়েছি। বাংলাদেশের মহান আলোকচিত্রশিল্পী ও সিনেমাটোগ্রাফার আনোয়ার হোসেন বলতেন, ‘যে চলচ্চিত্রে চোখে পড়বার মতো আলাদা কোনো দৃশ্য মনে গেঁথে থাকবে না অথচ পুরো ছবিটিই মনে পড়বে, চলচ্চিত্রটি হন্ট করতে থাকবে, তখন বুঝবে সেই চলচ্চিত্রটি হয়েছে। নির্মাতা ও সিনেমাটোগ্রাফার দৃশ্য দিয়ে সত্য নির্মাণে সফল হয়েছে…’।

লাইভ ফ্রম ঢাকা
লাইভ ফ্রম ঢাকা

লাইভ ফ্রম ঢাকার রঙের ট্রিটমেন্ট, পুরো চলচ্চিত্র দৃশ্যায়নে এমন পরিমিতিবোধ আমরা শেষবার কবে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে দেখেছি তা চট করে মনে পড়ছে না। লাইভ ফ্রম ঢাকা দেখতে দেখতে তুরস্কের চলচ্চিত্রকার নুরি বিলগে জিলানের উজাক চলচ্চিত্রটির কথা বারবার মনে পড়ছিল। মনে হচ্ছিল উজাক-এ নুরির নিয়ন্ত্রিত সিনেমাটোগ্রাফি আর তার অভিনেতা মুজাফফর ওজেমীর ও মেহমেদ এমিন তোপরাকের অভিনয় যেমন অদ্ভূত এক ঘোরের জন্ম দিয়েছিল, ঠিক তেমনি আজ সাদ তার সিনেমাটোগ্রাফার তুহিন তমিজুরকে সাথে নিয়ে তুখোড় অভিনেতা মোস্তফা মনওয়ার, তাসনোভা তামান্নার রিয়েল লাইফ লাইক অ্যাক্টিংয়ের ভেতর দিয়ে মনকে তুমুল আলোড়িত করেছেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র দেখার পর এমন অনুভূতি সচরাচর হয় না। যদি কেবল দৃশ্য নির্মাণের সক্ষমতার কথা বলি তবে লাইভ ফ্রম ঢাকার সাফল্য বিস্ময়কর। খুব সাধারণ একটি গল্পের অথবা প্রায় গল্পহীন কিছু ঘটনার দৃশ্যত খুব সাধারণ চিত্রমালায় গভীর সংবেদনশীল চলচ্চিত্র লাইভ ফ্রম ঢাকা

চলচ্চিত্রে নির্মাতা সাদ সঙ্গীতের আবহে দুইবার পপসঙ্গীতের গুরু আজম খানের দুটি গানের অংশবিশেষ ব্যবহার করেছেন। তার গল্পের বুনট তৈরিতে তিনি টেলিভিশন সংবাদ ও রেডিওর সংবাদকে ব্যবহার করেছেন। সাদ খুব যত্নের সাথে ঢাকার রাতের অবয়ব ধরেছেন। ধরেছেন অনাত্মীয় শহরে বিষাদগ্রস্ত বড় ভাই আর নেশাগ্রস্ত ছোট ভাইয়ের অদ্ভুত, বাস্তব, নিরুপায় সর্ম্পকের টানাপোড়েন। শহরের যে দানবীয় যান্ত্রিক চরিত্র তার ভেতর চিরেচ্যাপ্টা হতে থাকা মানুষের ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলোর এমন ক্ষয়ে ক্ষয়ে বিলীন হয়ে যাওয়া আর বিলীন হয়ে যাওয়া সম্পর্কের জন্য মানুষের বিলাপ, হাহাকার, কান্না এবং শেষে পিতা-মাতার কবরের সামনে দাঁড়িয়ে করা স্বীকারোক্তি ‘আমার যা করা সম্ভব ছিল, আমি করেছি, আমাকে মাফ করে দিয়েন’।


দৃশ্যগুলোর ভেতরের আর্তি
আমাদের বুকটাকে চিরে
দিচ্ছে, আমরা আহত
হচ্ছি, আমরা
আক্রান্ত
হচ্ছি

সবই খুব সহজ, সবই খুব সরল আর বাস্তব। কিন্তু ইমেজগুলো যখন প্রায় নিখুঁতভাবে গেঁথে দেয়া অ্যামবিয়েন্স, আবহসঙ্গীতের সাথে পর্দায় চলতে থাকে তখন এই অতিচেনা দৃশ্যগুলোও আমাদের কাছে বড্ড মায়াময় লাগে। মনে হয় দৃশ্যগুলোর ভেতরের আর্তি আমাদের বুকটাকে চিরে দিচ্ছে, আমরা আহত হচ্ছি, আমরা আক্রান্ত হচ্ছি। চলচ্চিত্র যখন শেষ হয় তখনই তাই আমরা দৃশ্যগুলো নিউরণ থেকে সরাতে পারি না, মাথায় চেপে দৃশ্য-শব্দগুলো আমাদের ঘরে চলে আসে, আমাদের বিছানায় আমাদের ঘুমাতে দেয় না। অন্ধকার ঘরে আমরা দৃশ্যগুলোর ভেতরের দৃশ্য আর দৃশ্যের কারিগর সাদের মনকে বিশ্লেষণের বাসনা বোধ করতে থাকি।

সাদ সমাজকে বোঝাপড়ার যে বক্তব্য দেন , সেখানে একটু তাকাতে চাই। সাদ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কাজিনকে বাসায় ডেকে আনেন। ডেকে এনে বড় ভাইয়ের মনোযোগী সেবাকারি ছোট ভাইটিকে দিয়ে কেন অস্ত্রের হাতবদল করতে দেখান? আবার সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পথে গিয়ে ছাত্রদের বিক্ষোভের মাঝে সাজ্জাদের গড়িটি পোড়ানোর দৃশ্য তৈরি করেন। গাড়ি পোড়ানোর সিকোয়েন্সটিতে কি সাজ্জাদের ঘরে আসা কাজিন অথবা তার বন্ধুদের কাউকে দেখা যায়? চট করে ধরতে পারিনি।

লাইভ ফ্রম ঢাকা
লাইভ ফ্রম ঢাকা

সাজ্জাদের জন্য এমন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে [ব্রেকআপ হয়ে যায় যায় এমন পরিস্থিতিতে প্রেমিকার সাথে সাক্ষাতের সিডিউল রক্ষার টাইমলাইন] তার গাড়িটি পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনার জন্ম দিয়ে সাদ কী বলতে চান? তিনি কি বলেন যে জনগণের বিক্ষোভে জনতার জীবন ও সম্পদই ক্ষতিগ্রস্ত হয়? কারণ ছাত্র তো জনতা বর্হিভূত কোনো বর্গ নয়। আবার ছাত্রের বিপদে মানে পুলিশি ধরপাকড়ে ছাত্রকে আশ্রয় দেওয়া বড় ভাইও [সাজ্জাদ] তো জনতারই প্রতিনিধি। নয় কি? তবে থিসিসটা দাঁড়াল কী? জনতার মুখোমুখি জনতা? আন্দোলন করে জনতা এবং মারে ও মরেও জনতাই! এই বক্তব্যে রাজনীতিবিমুখ তারুণ্যের রাজনীতিহীনতার বয়ানের জোর স্পষ্ট হয় না কি?

অথবা যে সময়ে গাড়িটি পোড়ানো হয় সে সময়ের কিছু ইঙ্গিত নির্মাতা করেছেন। সে সময়টা কি শাহবাগ আন্দোলনের [২০১৩] টাইমলাইন? যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার সেই গণজাগরণে ছাত্ররা কোথাও কি কোনো ভাংচুর করেছিল? তেমন কোনো ঘটনার নজির মনে পড়ছে না। গাড়ি পোড়ানো, মানুষ পোড়ানোর রাজনীতি শাহবাগ আন্দোলনে নয়, তারপরের টাইমলাইনকে [২০১৪ সালের নির্বাচনের পরের সহিংস দিনগুলো] মনে আসে।


যদি
সাদ শাহবাগ
আন্দোলনের টাইমলাইন
এই ছবিতে দেখিয়ে থাকেন
তবে তিনি ভুল
করেছেন

লাইভ ফ্রম ঢাকায় এই ছাত্রদের গাড়ি পোড়ানোর এই দৃশ্যমালার আগে পরে সেই সময়ের যে ইঙ্গিত দেওয়া হয় তাতে এ কথা স্পষ্ট নয় যে, এই গাড়ি পোড়ানোর দায় কোন সময়ের, কার মাথায় বর্তায়। যদি সাদ শাহবাগ আন্দোলনের টাইমলাইন এই ছবিতে দেখিয়ে থাকেন তবে তিনি ভুল করেছেন। সেই ভুল অবশ্যই ছোট নয়। তখন কেবল এই একটি গাড়ি পোড়ানোর দৃশ্য, ছাত্রদের এমন ভয়ঙ্কর রূপ [সাজ্জাদকেসহই গাড়ি পোড়ানোর চেষ্টা করা] রাজনৈতিকভাবে ভুল বার্তা দেবে।

যেহেতু শাহবাগ আন্দোলনের টাইমলাইনে ছাত্রদের কোনো সহিংস ঘটনার ইতিহাস নেই, তাই এই সিকোয়েন্স সাদের মতাদর্শিক অবস্থানকে চিহ্নিত করবে। আর তা অবশ্যই শাহবাগ আন্দোলনে আস্থাশীল মানুষের অবস্থান নয়। আর যদি তিনি দেখাতে চান এটাই ঢাকার নিয়মিত প্রকৃত চেহারা, তবে তাও ছাত্রদের বাদ রেখে করতে পারতেন। কারণ ছাত্রদের গাড়ি পোড়ানোর দৃশ্যে ছাত্ররা চালকসহ গাড়িতে আগুন দিচ্ছে– এই দৃশ্য গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ এই ঘটনা ঢাকায় বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এরিয়াতে ঘটতে দেখা যায় না।

চলচ্চিত্রে যখন কোনো দৃশ্য বাস্তবিক সময়ের টাইমলাইন উল্লেখ না করে দেখানো হয়, তখন সেই দৃশ্য একধরনের সাধারণীকরণের দায়ে দুষ্ট হয়। এমন দৃশ্য যদি রাজনৈতিক মতাদর্শিক দিক থেকে ভুল হয় তবে চলচ্চিত্রটির ভুল ব্যাখ্যার দায়ও নির্মাতাকেই নিতে হয়। লাইভ ফ্রম ঢাকার গাড়ি পোড়ানোর সিকোয়েন্সটি তাই বিতর্কিত ভাবনার জন্ম দেয়।

লাইভ ফ্রম ঢাকা

চলচ্চিত্রে দুটি সম্পর্কের বুনোটের গভীরে যাওয়ার চেষ্টা ছিল নির্মাতার। প্রথমটি অবশ্যই সাজ্জাদ ও মাইকেলের। মানে দুই ভাইয়ের। দ্বিতীয়টি সাজ্জাদ ও রেহানার। সাজ্জাদ এই দুই ক্ষেত্রেই প্রবল পুরুষ হয়ে ওঠেন। ছোট ভাইয়ের ক্ষেত্রে তিনি বড় ভাই সুলভ যতটা কেয়ারিং মনোভাব দেখান, ঠিক ততটা কেয়ারিং নন তিনি তার প্রেমিকা রেহানার প্রতি। উপরন্তু তিনি রেহানাকে শারীরিকভাবে আঘাত করেন, অপশব্দ বলেন এবং তাকে সচেতনভাবে প্রতারিত করেন। এসব কি রেহানা ‘নারী’ বলে?

নির্মাতা সাদ যেভাবে দুই ভাই সাজ্জাদ ও মাইকেলের সম্পর্কের বুনোট তৈরি করেছেন আর সাজ্জাদ চরিত্রে মোস্তফা মনওয়ার ও মাইকেল চরিত্রে তানভীর আহমেদ চৌধুরী যতটা যত্ন ও সময় পেয়েছেন, ততটা পাননি সাজ্জাদের প্রেমিকা রেহানা চরিত্রে রূপদানকারী তাসনোভা তামান্না। রেহানা চরিত্রটিকে অবহেলা না করে এই চরিত্রটির যন্ত্রণা, অসহায় অবস্থার দিকে আরও একটু যাত্রা করলে এই তিনটি চরিত্রই পূর্ণতা পেত।

লাইভ ফ্রম ঢাকা মূলত সাজ্জাদের গল্প। সাজ্জাদ শেয়ার বাজারের বিপর্যয়ে আক্রান্ত কারবারি। শেয়ার বাজারের বিপর্যয় তার বিপর্যস্ত জীবনের বিপর্যয়কে তরান্বিত করে। কারণ কেবল শেয়ার বাজারের বিপর্যয় সাজ্জাদের জীবনকে ফাঁদে ফেলে দেয়– এমন তো মনে হয় না। হয় না কারণ সাজ্জাদ তো গর্তের ভেতরে বসবাসকারী চরিত্রই। শুরু থেকে। তার গর্তের জীবন ধাক্কা খায় শেয়ার বাজার লুট হওয়ার ঘটনায়। সাজ্জাদ যে শহরে থাকে মানে ঢাকায় এই বাড়িটির ফ্ল্যাট কি সাজ্জাদের নিজের? নাকি সে ভাড়াটিয়া? বোঝা যায় না। বোঝা যায় না বাড়িটিতে সাজ্জাদ ছাড়া আর কোনো মানুষ থাকে কি-না? বোঝা যায় না সাজ্জাদ কেন একরাত পথে ঘুমায়? পাওনাদারের ভয়ে? পরদিন ঘরে ফেরা সাজ্জাদের ঘরের দরজা খোলা থাকে, কে ঢোকে তার ঘরে? পাওনাদার? পুলিশ? পুলিশও তো হতে পারে; পারে না? সাজ্জাদের কাজিন [বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র] অস্ত্র রাখে, বিশ্ববিদ্যালয়ের মারামারিতে সে যুক্ত [সংলাপে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষের আলাপ] ছিল, তাকে ধরতে আসতে পারে না পুলিশ? এসবের মীমাংসা নেই কোনো। সাজ্জাদের ঘর ছেড়ে শেষবারের মতো বের হয়ে যাওয়াটাও যেন আবাসিক হোটেলের কক্ষ ত্যাগ করার মতো ঘটনা! বোঝা গেল না সাজ্জাদের সাথে ঘরের, বাড়ির সংযোগের ধরণ।

সাজ্জাদের ভাই মাইকেল মৃত অবস্থায় পড়ে থাকে বস্তিতে এক ঘরে। পরের দৃশ্য জানাজার। তারপরের দৃশ্য দাফনের। ঠিক আছে। তবে বস্তিতে কারো মৃতদেহ পড়ে থাকবে আর তা পুলিশি কোনো ঝামেলা ছাড়াই সাজ্জাদ গ্রামে নিয়ে দাফন করে ফেলছে– এতটা কি সহজ ঢাকার-জীবন? সাজ্জাদ মাসে মাসে টাকা দেয় পাওনাদারকে। কোথায় পায়? তার জমানো টাকা? হতে পারে? চলচ্চিত্রে সব দেখাতে হবে এমন কোনো দায় নেই, তবে কিছু ইঙ্গিত রাখা যেত না?


সে
যেন
তার নিজ
দেশের নিজ শহরে
আশ্রিত রিফিউজি

সাজ্জাদ একা মানুষ। স্বার্থপর। এই শহরে কে নয়? তবে সবাই তো সাজ্জাদও নয়। সাজ্জাদ পালাতে চায়। সে স্বপ্ন দেখে, কল্পনা করে রাশিয়ার তুষারবৃত পথঘাট, গাছপালা… সে সম্ভাব্য শীত কল্পনা করে ওভারকোট কেনে। ওভারকোট গায়ে দিয়ে রাশিয়ান ভাষায় কথা বলে। ঘুমাতে ঘুমাতে স্বপ্ন দেখে তার ঘরের বাইরে তুষার পড়ছে। তার রাশিয়া যাওয়া তো হয় না। হতাশ সাজ্জাদ পালাবার চেষ্টা থেকে বিরত হয় না। সে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করতে শুরু করে। সাজ্জাদ কি কল্পনায় বসবাস করা চরিত্র? তার বাস্তব বড্ড ফ্যাকাশে। কল্পনা বর্ণময়। সে যে ঘরে, যে শহরে থাকে তাকে সে গ্রহণ করে না, সে যেন তার নিজ ঘরে উদ্বাস্তু, সে যেন তার নিজ দেশের নিজ শহরে আশ্রিত রিফিউজি।

সাজ্জাদের গাড়িটি শহরের পথে বেমানান। পুরোনো। সাজ্জাদের চরিত্রটির মতোই সাজ্জাদের গাড়ি আলাদা। খাপ না খাওয়া। সাজ্জাদের এই শহরে বিচরণ আগন্তুকের মতো। শহরের পথে তার নিরপত্তাহীনতার বোধ, তার ভয়, তার ক্রোধ, তার বিরক্তি সবই গর্তজীবী মানুষের নিজস্ব কমফোর্টজোন হারাবার পরের প্রতিক্রিয়ার মতো। সাজ্জাদের এই পলায়নপর স্বভাব উদযাপন করবার মতো কোনো যাপন নয়। তাড়া খাওয়া এমন মানুষ সমাজে বিস্তর আছে, আর আছে বলেই তাদের থাকায় অথবা না-থাকায় সমাজের কোনো হেলদোল হয় না।

শহরের পিছিয়ে পড়া দরিদ্র মানুষের বসবাসের বস্তি এলাকাতেই মাদকের বিস্তার– এমন সরল ক্লিশে বক্তব্যে না গেলেই পারতেন নির্মাতা সাদ। রেললাইন সংলগ্ন বস্তির একটি ছাপড়া ঘরের চৌকিতে অতিরিক্ত মাদক গ্রহণে মৃত মাইকেলের লাশ পড়ে থাকার দৃশ্যটি ক্লিশেই লাগে। এমন দৃশ্য বাংলাদেশের দৃশ্যমাধ্যমে নতুনতর কিছু নয়। যদিও মাদকের বিস্তারের যে গল্পগাঁথা চলমান, তাতে বস্তির মানুষের চেয়ে সমাজের, শহরের বিত্তবানদের চেহারাই বেশি দেখা হয় দৈনিকগুলোর পাতায়। বাস্তবিক এই সত্য নির্মাতার বয়ানে শ্রেণীগত দৃষ্টিহীনতার শিকার বলে মনে হয়েছে।

লাইভ ফ্রম ঢাকা
লাইভ ফ্রম ঢাকা

লাইভ ফ্রম ঢাকার সম্পাদক নির্মাতা স্বয়ং। হয়তো এ কারণেই ছবিটি দেখার সময়ে সম্পাদকের কাঁচি বা জোড়াতালির কোনো ধাক্কা লাগেনি চোখে। ছোট ভাইকে দাফন করে গ্রাম থেকে সাজ্জাদের ফেরার দৃশ্যগুলো যেভাবে জাম্প করে করে এগিয়ে যায় অথবা পুরো ছবিজুড়েই দৃশ্যের পর দৃশ্য যেভাবে জাম্প করে এগিয়ে যায় তা চোখে না লাগাটা একটু বিস্ময়কর, প্রতিটি দৃশ্যের গতিকে সমান্তরাল রেখে এভাবে সম্পাদনা করতে পারাটা খুব দক্ষ সম্পাদকের কাজ। পুরো ছবিটায় কার্যত একবারই প্রবল ধাক্কা লেগেছে আর তা ছবিটির শেষ দৃশ্যে। যখন গল্পটির ক্লাইমেক্স শীর্ষবিন্দু ছুঁয়ে ফেলে ঠিক তখন ওভাবে ছবিটা শেষ হবে– এমনটা ভাবতে পারিনি। শেষটা ধাক্কা দিয়েছে। আর ধাক্কা দিয়েছে বলেই হয়তো ছবিটা নিয়ে ভাবছি।

ভাবছি সাজ্জাদ কি মালয়েশিয়া চলেই যাবে? যেতে পারবে? ট্রাভেল এজেন্সির দালালটি সাজ্জাদকে ধোঁকা দেবে না তো? ধোঁকা তো দেবেই, কারণ ছবির আবহে আমাদের শোনানো হয়েছে মালেশিয়াগামী মানুষের প্রতারিত হওয়ার খবরের অংশ বিশেষ। আবার ভাবছি, প্রতিবার মানসিকচাপে পিষ্ট সাজ্জাদ পরিস্থিতি সামলাতে না পেরে বমি করে বা তার বমির উদ্রেক হয়। রেহানা অ্যাবরশন করেনি, রেহানা সাজ্জাদের সন্তানকে পৃথিবীতে আনতে চায় এমন কথা শুনেও সাজ্জাদের মধ্যে বমির ভাব আসে না। বরং এই দৃশ্যে বমি করে বা বমির উদ্রেক হয় রেহানার! যে রেহানা পুরো ছবিতে ভীষণ ফোকাসড। স্থির। সে ছবির শেষ সিকোয়েন্সে অস্থির। তার বমি হয়। ছবির গল্প বলে প্রেগনেন্সিজনিত বমি। অথচ এখানে সাজ্জাদ স্থির। ফোকাসড। সে রেহানাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে হাঁটতে শুরু করে। ছবি শেষ হয়, হঠাৎ!


লাইভ ফ্রম ঢাকায়
কার্যত চলচ্চিত্রটাকে
পাওয়া যায়– যা
বাংলাদেশের
আলো
বাতাসে
ইদানিং খুব
একটা পাওয়া যাচ্ছিল না

লাইভ ফ্রম ঢাকায় নির্মাতা হিসেবে আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের মননশীল চরিত্রকে পাওয়া যায়। পাওয়া যায় ভালো অভিনয়। ভালো সিনেমাটোগ্রাফি। পরিমিতভাবে শব্দ ও সঙ্গীতের ব্যবহার। লাইভ ফ্রম ঢাকায় আর্ট ডিরেক্টর বা শিল্প নির্দেশকের কাজ পাওয়া যায় এবং সবচেয়ে বেশি সন্তোষের বিষয় হলো এগুলোর কোনোটাই পৃথকভাবে চোখে পড়ে না। লাইভ ফ্রম ঢাকায় কার্যত চলচ্চিত্রটাকে পাওয়া যায়– যা বাংলাদেশের আলো বাতাসে ইদানিং খুব একটা পাওয়া যাচ্ছিল না।

লাইভ ফ্রম ঢাকা
লাইভ ফ্রম ঢাকা

বাংলাদেশে ‘ভালো চলচ্চিত্রের’ জন্য আমাদের আকুলতা প্রবল। তাই আমাদের ‘ভালো চলচ্চিত্র’ দেওয়ার বাসনায় বহুমানুষ ও প্রতিষ্ঠান ‘নিবেদিত’। বহু বছরের চাওয়ায় বাংলাদেশে ভালো চলচ্চিত্রের একটি কার্যকর ‘ফর্মুলা’ তৈরি হয়েছে। গত শতাব্দীর চল্লিশ- পঞ্চাশের দশকে সৃষ্ট ইতালির ‘নব্য বাস্তববাদী’ ধারার চলচ্চিত্রের অনুকরণে গড়ে উঠেছে আমাদের ‘ভালো চলচ্চিত্রের’ ফর্মুলা। অবশ্যই এক্ষেত্রে প্রাতস্মরণীয় সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী আমাদের প্রধান অনুপ্রেরণা। আমরা পথের পাচালীর ধারে-কাছে যেতে না পারলেও আমাদের সব ভালো চলচ্চিত্রই সেই পথের অনুসারী– যা আজ সত্যিকার অর্থে একটি সঙ্কটের বিষয় হয়ে উঠেছে। কারণ আমাদের প্রায় সকল ‘ভালো চলচ্চিত্র’ পথের পাঁচালীর এক ব্যর্থ অনুকরণ ও অনুসরণ প্রয়াস ছাড়া আর কিছু নয়। সেই ঘূর্ণাবর্তে লাইভ ফ্রম ঢাকা অবশ্যই ব্যতিক্রম কাজ। যদিও বাস্তবতাকেই ধরতে চেয়েছেন নির্মাতা সাদ। তবুও এই ধরার চেষ্টা ও ধরে ফেলার মাঝে নতুনত্ব আছে।

অনেক রকম কাজ হতে পারে ঢাকার সিনেমা ফেটারনিটিতে; হয় না, সৃষ্টির বৈচিত্র এখানে অনুপস্থিত। ঢাকার প্রায় বৈচিত্রহীন চলচ্চিত্র নির্মাণপ্রয়াসে লাইভ ফ্রম ঢাকা দেখাটা একটু রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। আর এ কারণেই আমি একটু উল্লসিত, আনন্দিত। কারণ দৃশ্যত বোঝা যাচ্ছে বাংলাদেশের আগামীর নির্মাতারা অবশেষে নিজেদের পথে, নিজেদের পায়ে হাঁটতে শুরু করেছেন।

লাইভ ফ্রম ঢাকা নির্মাণদলকে তাই অভিনন্দন জানাই!

Print Friendly, PDF & Email
লেখক; চলচ্চিত্র নির্মাতা; চলচ্চিত্র সংগঠক। ঢাকা, বাংলাদেশ। সাধারণ সম্পাদক, ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশ। সভাপতি, ম্যুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটি। নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র : অনিবার্য [ পোশাক শ্রমিক আন্দোলন; ২০১১]; পথিকৃৎ [চলচ্চিত্রকার বাদল রহমানের জীবন ও কর্মভিত্তিক; ২০১২ (যৌথ নির্মাণ)]; সময়ের মুখ [জাতীয় অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলামের জীবন অবলম্বনে; ২০১৮]। সম্পাদিত ফিল্ম-ম্যাগাজিন : ম্যুভিয়ানা; চিত্ররূপ। সিনে-গ্রান্থ : চলচ্চিত্রপাঠ [সম্পাদনা]; চলচ্চিত্রের সাথে বোঝাপড়া; স্বাধীন চলচ্চিত্র আন্দোলনের ইশতেহার : বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ; চলচ্চিত্রকথা [তারেক মাসুদের বক্তৃতা ও সাক্ষাৎকার; সম্পাদনা]। পরিকল্পক ও উৎসব পরিচালক : নতুন চলচ্চিত্র নতুন নির্মাতা চলচ্চিত্র উৎসব

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here