লিখেছেন । সোহেল তৌফিক
মগবাজারের অলি-গলি এফোঁড়-ওফোড় করে যখন কাঁটা দ্য ফিল্ম-এর ব্যানার সামনে পড়ল, মনে স্বস্তি এলো, বুঝলাম আমি অডিশন স্পটে চলে এসেছি। ভেতরেই ছোট, বড়, বয়স্ক নানান কিসিমের মানুষের সমাগম। সবার সাথে আমিও বেঞ্চির উপর বসে আছি। কিছুক্ষণ একজন টুলে বসে সিনেমা নিয়ে অনেক কথা বললেন, কিন্তু কিছুই মাথায় ঢুকল না। একটু পরেই অডিশনের জন্য ডাক পড়ল। অডিশনরুমে অনেক বিচারক বসে আছেন। কিন্তু অধিকাংশ প্রশ্ন করলেন সেই লোকটা। মনে মনে ভাবলাম, ইনিই হয়তো ডিরেক্টর। ক্যামেরার ফ্ল্যাশ জ্বলতে থাকে আমাকে লক্ষ করে। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘শহীদুল জহিরের কাঁটা গল্পে তুমি কোন চরিত্রে অভিনয় করতে চাও’? আমি বললাম, ‘সুবোধ’। আমার উত্তরে তিনি যেন হাসিতে গলে পড়লেন। পরবর্তীকালে ফেসবুক সহায়তায় নিশ্চিত হই, তিনিই ‘টোকন ঠাকুর’। সুবোধ-স্বপ্নার রুপকার। পুরান ঢাকার অলিতে-গলিতে যিনি কাঁটা চিত্রনাট্যে দৃশ্যের মালা গেঁথেছেন। ভূতের গলির ৩৬ নাম্বার বাড়িতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার তোপের মুখে যিনি তিন জোড়া কপোত-কপোতীর [সুবোধ ও স্বপ্না] প্রেম রুপায়ণ করেছেন।

ফিল্মমেকার । টোকন ঠাকুর
মগবাজার রেলগেটের পাশেই ‘কাঁটা ক্যাম্প ওয়ানে’ গ্রুমিংয়ের জন্য ডাক পড়ে। এখানে থিয়েটার গেমসসহ নানা শারীরিক কসরত ও অভিনয় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। গ্রুমিং পর্বের অন্যতম বিষয় ছিল ডিরেক্টরিয়াল ডিম্যান্ড পুরণ করা। তিনিই জানেন কখন একটি চরিত্র মুচকি হাসি দিলে দৃশ্যটি আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে, কখন নায়িকার চোখে জল আসলে দর্শকের চোখও ছলছল করে উঠবে। সিনেমা একটি মা শিল্প। প্রায় সকল শিল্পের উপস্থিতিই এখানে বিদ্যমান। একজন শিল্পী শুধু একজন মানুষই নন, তিনি ‘ঈশ্বর’।
গ্রুমিংয়ের জন্য ক্লাস ফাঁকি দিয়ে রাজশাহী থেকে ঢাকা কয়েকবার যাতায়াত করতে হয়। সেখানে অনেক বড় বড় অভিনেতা, চলচ্চিত্র নির্মাতারা আসতেন। তারা আমাদের মতো নবীন আর্টিস্টদের চলচ্চিত্র এবং অভিনয় সম্পর্কে জ্ঞান দিতেন। এরই মধ্যে দাদা [টোকন ঠাকুর] সেলফোনে নিশ্চিত করলেন ১৯৬৪ সালের সুবোধ চরিত্রটি আমিই করছি। উত্তেজনার শেষ নেই। তখনও স্ক্রিপ্ট হাতে পাইনি। সুবোধ চরিত্রের আদ্যোপান্ত অজানা থাকায় ভেতরে ভেতরে যন্ত্রণা বোধ করলাম। ভাবতে থাকলাম সুবোধ চরিত্রটি আসলেই কেমন? কি আছে চরিত্রের ভেতরে এবং বাহিরে, এমনকি চোখে? দাদা আমাকে সুবোধের গল্প শোনালেন। শোনালেন, ১৯৬৪ সালে নারায়্ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসা সদ্য বিবাহিত দম্পতির [সুবোধ-স্বপ্না] গল্প। তারপর থেকেই শুরু হলো সুবোধ হয়ে ওঠার কর্মযজ্ঞ। পরিচালকের চাহিদা অনুযায়ী ওজন কমাতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রের ছাপ চেহারা থেকে মুছে ফেলতে হবে। ওজন কমানোর সঠিক পদ্ধতি না জানা থাকায় নানা বিড়ম্বনায়ও পড়তে হয়। এক বন্ধু একদিন বলেই বসল, তুই কি না খেয়ে খেয়ে মারা যাবি?

যাই হোক, শুটিং শুরুর কিছুদিন আগে ‘কাঁটা ক্যাম্প টু’ অর্থাৎ পুরান ঢাকায় শুটিংয়ের জন্য নির্ধারিত বাড়িতে ডাক পড়ল। পুরাতন একটা শতবছরের দোতলা ভবন। গল্পে উল্লেখিত আব্দুল আজিজ ব্যাপারীর বাড়ি এটাই। এই বাড়িতেই দোতলার চিলেকোঠায় ভাড়া থাকে সুবোধ-স্বপ্না। আর গল্পকে চলচ্চিত্রে রুপ দিতে যে যোদ্ধারা প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে যাচ্ছেন, তারা বর্তমানে এই বাড়িতে থেকেই সেট নির্মা্ণের কাজ করে যাচ্ছেন। গল্পের প্রয়োজনে বিড়াল ও কবুতরও পোষা হচ্ছে। প্রত্যেকটি মানুষ নিজের প্রতি যতটা না যত্নশীল, তারচেয়েও বেশি যত্নশীল এই বিড়াল, কবুতরের প্রতি। অর্থাৎ সিনেমায় যা থাকবে। আমাকেও এই বাড়িতে থাকতে হবে বিড়াল বা কবুতর হয়ে। বাড়ির প্রতিটি ইট, কাঠ, ঘাস, তুলছিগাছের প্রতি আমাকেও যত্নশীল হতে হবে, শুধু সিনেমার প্রয়োজনেই নয় চরিত্রের প্রয়োজনেও। প্রতিটি মানুষের তার নিজ বাড়ির সাথে একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেই সম্পর্কটি তার কথা বলা, হাঁটা-চলা, বসবার ধরণ ইত্যাদিতে ফুটে ওঠে। তাই আমাকেও এই বাড়িতে থাকতে হয়।
…
বিরহের
গোপন আনন্দে
ভেজা দুটি কবুতর
[সুবোধ ও স্বপ্না] সিঁড়ি দিয়ে
ঘরের ছাদে
উঠে পড়ে
…
একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি লেখক আনোয়ারা সৈয়দ হক এসে উপস্থিত। দাদা তার মাধ্যমে আমার হাতে পাণ্ডুলিপি তুলে দিলেন। পান্ডুলিপি পড়ে আমার ভেতরে একটা শিহরণ খেলে গেল। একটা লাইন বুকের ভেতর দাগ কেটে রয়ে গেল, ‘বিরহের গোপন আনন্দে ভেজা দুটি কবুতর [সুবোধ ও স্বপ্না] সিঁড়ি দিয়ে ঘরের ছাদে উঠে পড়ে’। মনে হলো, আমি একটা ভলো সিনেমার অংশ হতে যাচ্ছি। স্ক্রিপ্ট সুপারভাইজার তুরা বললেন, ‘ডায়ালগগুলো মুখস্থ করে ফেল’। কয়েকবার স্ক্রিপ্টটা পড়লাম কিন্তু ডায়লগ মুখস্ত করবার জন্য নয়, সিনগুলো আত্মস্থ করার জন্য। নিজের অজান্তেই কখন ডায়ালগ মুখস্ত হয়ে গেছে, টের পাইনি। দাদা জিজ্ঞেস করলেন, কোন ডায়লগটা বেশি ভালোলাগছে? আমি বললাম, যখন স্বপ্নাকে বলি ‘ভেজো, বৃষ্টিতে আরো ভেজো’। সবাই হো হো করে হেসে ওঠে্ন।

সকল প্রস্তুতিই প্রায় শেষ। শুটিংও শুরু হয়ে যায়। কয়েকটি শ্লটে শুটিং হয়। প্রতিবারই শুটিং শুরুর দুই-একদিন আগে রাজশাহী থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হই। কিন্তু একবার পরীক্ষার কারণে শুটিংয়ের আগের রাতে রওনা দিতে হলো। যানজটে আটকা পড়ে সময়মতো শুটিং স্পটে পৌঁছাতে পারি নাই। দাদা বললেন, ‘একটা সিন ভিজুয়ালি দেখতে খারাপ হলে স্ক্রিনে লিখে দিতে পারব না আর্টিস্টের অসুস্থতা কিংবা পরীক্ষা থাকার কারণে সিনটা খারাপ হয়েছে। যেহেতু লিখে দিতে পারব না, সেহেতু এইসব বলাও অবান্তর’। দুনিয়ার কোনো কিছুর সাথেই শুটিংয়ের তুলনা চলে না। বাবা মারা গেলেও ক্যামেরার সামনে এসে হাসতে হাসতে ডায়ালগ দিতে হয় এবং দিতে হবেই। এটাই শুটিংয়ের নিয়ম।
প্রায় আড়াইশো জন নতুন কলাকুশলী নিয়ে এরকম শুটিংতান্ত্রিক নিয়মের মধ্য দিয়ে গমন করা কম কষ্টসাধ্য নয়। সেই গমন পথের প্রায় চূড়ান্তে এসে পৌঁছেছে যুদ্ধরত ‘কাঁটা টিম’। যুদ্ধ শেষ হলেই যুদ্ধোত্তর ফলাফল দর্শকের সামনে হাজির হবে।
এখন শুধু অপেক্ষা করার পালা। আমরা অপেক্ষা করছি ‘কাটার জন্যে, কামিং সুন কাটা’…।
ছবি । হোসেইন আতাহার