লিখেছেন । বিধান রিবেরু

আদম সুরত
The Inner Strength
[শিল্পী এস এম সুলতানের ওপর ডকুমেন্টারি]
ডিরেক্টর ও প্রডিউসার । তারেক মাসুদ
ভাষা । বাংলা
রানিংটাইম । ৫৪ মিনিট
দেশ । বাংলাদেশ
রিলিজ । ১৯৮৯
“এইসব সাধারণ মানুষকে অসাধারণ করে দেখার ক্ষমতাই সুলতানের ছবির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই ছবিসমূহের মধ্য দিয়ে শিল্পী একটি ‘মেসেজ’ পাঠিয়েছেন। সুলতানের ছবি যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা সজ্ঞানে অতটা অনুভব না করতে পারলেও অন্তরে অন্তরে মেসেজটি গ্রহণ করতে কোনো বেগই পেতে হয়নি। বাংলার মানুষের প্রতি সুলতানের স্বতোৎসারিত ভালোবাসা এবং অগাধ শ্রদ্ধাবোধ থেকেই সৃষ্টি হয়েছে এই ‘মেসেজ’।”
–[রাজ্জাক ২০১৪: ৬৭]
জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের এই মন্তব্য শিল্পী শেখ মোহাম্মদ সুলতানের ছবির ভেতর গ্রামবাংলার মাটি ও মানুষের প্রতি ভালোবাসার বার্তাকে রাষ্ট্র করে, তবে তারেক মাসুদের প্রামাণ্যচিত্র আদম সুরত [১৯৮৯] সেই ভালোবাসার খোঁজ করেনি শুধু, অনুসন্ধান করে বের করেছে যে বাংলাদেশের বুর্জোয়া ও পেটিবুর্জোয়া শ্রেণী সকল ভোগ-বিলাস ত্যাগ করা এক শিল্পীকে এরইমধ্যে নিজেদের শিল্পতৃষ্ণা নিবারণের বস্তু করে ফেলেছে। এটা তারা করেছে কারণ সুলতান ও তাঁর কাজের যে শৈল্পিক মূল্য সৃষ্টি হয়েছে, সেই কাল্ট-ভ্যালু বা ‘অরা’র ভাগিদার হতে চায় এই বুর্জোয়া শ্রেণী। তারা নিজেদের ডিসকোর্সে সুলতানকে আবদ্ধ করে শিল্পবোদ্ধা ও সংস্কৃতমনা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে চায়। এতে করে সমাজে আর দশটা লোকের কাছে তাদের কদর বাড়ে। অথচ শিল্পীর সৃষ্টিকর্মের বাণী এরকম বুর্জোয়া শ্রেণী চেতনার বাইরের বস্তু।

[১০ আগস্ট ১৯২৩–১০ অক্টোবর ১৯৯৪]
পূর্ববাংলায় জাতীয়তাবাদের উন্মেষপর্ব থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পর পর্যন্ত সুলতান ছবির মধ্য দিয়ে বলতে চেয়েছেন, শহুরে বড়লোকেরা চিরকাল গ্রামের গরীব কৃষকদের ছোট চোখে দেখে এসেছে, উপহাস করেছে, তাদের প্রাপ্য সম্পদ লুটপাট করেছে, বঞ্চিত করেছে, এমনকি গ্রামের লোকসঙ্গীতকেও নাগরিক গতে ফেলে বিকৃত করেছে আর মুনাফা লুটেছে। কিন্তু গাঁয়ের এই বঞ্চিত, শোষিত ও কর্মঠ নারী-পুরুষরা দুর্বল নন, তারা আত্মশক্তিতে বলিয়ান, কারণ শহরের মানুষ নিজেদের খাদ্য নিজেরা উৎপাদন করতে পারে না; গ্রামের মানুষ স্বয়ংসম্পূর্ণ, তারা ফসল ফলাতে জানে। এ কারণেই সুলতান ওদের দেহ অতোটা পেশীবহুল ও শক্তিশালী করে এঁকেছেন। গ্রামের মানুষের এমন দৃশ্যায়নে দেশের সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষের প্রতি যেমন মমতা ধরা পড়ে, তেমনি শিল্পীর মাটিসংলগ্ন থাকার বাসনাও পরিস্ফূট হয়। তিনি পাখির দৃষ্টিতে নয়, ব্যাঙের চোখে দেখতে চেয়েছেন এই প্রকৃত উৎপাদনশীল মানুষদের।
…
তিনি পাখির দৃষ্টিতে নয়,
ব্যাঙের
চোখে
দেখতে
চেয়েছেন
এই প্রকৃত উৎপাদনশীল মানুষদের
…
যে শিল্পী শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের পক্ষে এভাবে তুলি ধরেন, যার তুলির আঁচড়ে বুর্জোয়াবিরোধী দামামা দ্রিম-দ্রিম করে বেজে ওঠে, সেই বুর্জোয়ারাই এখন এস এম সুলতানকে তাদের বৈঠকখানার দেয়ালে সাজিয়ে রাখতে চায়। এস এম সুলতানের শিল্প বিশ্লেষণ করে তাঁকে একটি খোপে আটক করতে চায়। কিন্তু আধাসেরের পাত্রে দশসের ওজনের বস্তু আঁটে কি? বুর্জোয়া এলিট শ্রেণীর জীবনকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি আর সুলতানের ভাবজগত একেবারে ভিন্ন, বরংবলা ভালো শত্রুভাবাপন্ন। সুলতান যদি চাইতেন, তাহলে আমেরিকা বা ইউরোপে থেকে যেতে পারতেন অনায়াসেই, কাটাতে পারতেন বিলাসী জীবন; কিন্তু তিনি ফিরে এসেছিলেন জন্মভূমিতে। স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছিলেন অতি সাধারণ জীবনযাপন। কারণ তিনি সাধারণ জীবনকেই দেখতে চেয়েছিলেন, উপলব্ধি করতে চেয়েছিলেন ভেতর থেকে। আর সেজন্যই সুলতান হৃদয় দিয়ে দেখতে পেয়েছিলেন গ্রামের এই সহজ-সরল মানুষগুলোকে সাহায্য করার নাম করে শহরের কিছু মানুষ বিদেশি ত্রাণ মেরে দিয়ে ধন-সম্পদের মালিক হচ্ছে। আরেকদল মানুষ তাদের সহজ শর্তে ঋণের জালে ফাঁসিয়ে করে দিচ্ছে সর্বস্বান্ত।
এস এম সুলতান বলেন,
“একটা প্রহসন চলছে এদের নিয়ে। …আমিও ততোই এদের মাস্লস বড় করি, আর মজবুত করি। ‘তোমরা মোটেও ভয় পাবা না, তোমরা টিকে থাকবে কিন্তু। তোমরাই মাটির প্রকৃত অধিকারী, মাটির সঙ্গে সম্পর্ক তোমাদের, ওদের নয় যারা তোমায় উপহাস করে’।”
[আদম সুরত ২০১৪: ৪৫]
আহমদ ছফার জবানীতে,
“সুলতানের কৃষকেরা জীবনের সাধনায় নিমগ্ন। তারা মাটিকে চাষ করে ফসল ফলায় না। পেশির শক্তি দিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গম করে প্রকৃতিকে ফুলে-ফসলে সুন্দরী সন্তানবতী হতে বাধ্য করে। এইখানে জীবনের সংগ্রাম এবং সাধনা, আকাঙ্ক্ষা এবং স্বপ্ন, আজ এবং আগামীকাল একটি বিন্দুতে এসে মিশে গিয়েছে। সুলতানের কৃষকেরা নেহায়েত মাটির করুণা কাঙাল নয়। রামচন্দ্র যেমন অহল্যাপাষাণীকে স্পর্শ করে মানবী রূপদান করেছিলেন, তেমনি তার মেহনতি মানুষদের পরশ লাগামাত্রই ভেতর থেকে মাটির প্রাণ সুন্দর মধুর স্বপ্নে ভাপিয়ে উঠতে থাকে।
[ছফা ২০১১:১৬৫]
গ্রামের মেহনতি কৃষকদের নিয়ে সুলতানের এই যে মুগ্ধতা ঠিকরে বেরোয় তুলির প্রতিটি টানে, এতে করেই বোঝা যায় শোষিত মানুষের শ্রেণী-চরিত্রের সঙ্গে একাত্মবোধ করেন সুলতান। আর বিষয়টি বুর্জোয়াদের অজানা নয়। তারপরও তারা বেহায়ার মতো, যেভাবে গ্রামের খেটে-খাওয়া মানুষদের উৎপাদনকে লুট করে, সেভাবে গ্রামের আত্মাকে ধারণ করা সুলতানের চিত্রকর্মকেও আত্মসাৎ করতে চায়। তারেক মাসুদ প্রামাণ্যচিত্রে শ্রেণী-চরিত্রের এই বৈশিষ্ট্যকে ধরতে চেয়েছেন গুরুত্বের সঙ্গে।

ছবির ধারাবর্ণনায় তাই তারেক মাসুদ আমাদের বলেন,
“পরিহাসের বিষয় যে, শিল্পী বুর্জোয়া চিত্রশিল্পের সকল বন্ধন ছিন্ন করে চিত্রকলার পণ্যকরণের বিপরীতে নিজেই দাঁড় করিয়েছেন এক মহৎ দৃষ্টান্ত, আজ তাঁর শিল্পকর্মের প্রতিই লক্ষ করা যাচ্ছে চিত্র-ব্যবসায়ীদের লোলুপদৃষ্টি। দীর্ঘকাল পর বুদ্ধিবৃত্তিক মধ্যবিত্ত সমাজ শহরবিমুখ এই শিল্পীর সৃষ্টির প্রতি হঠাৎই আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এই অতি উৎসাহের পেছনে হয়তো রয়েছে বৃহত্তর জীবন ও জনগোষ্ঠীর এই রূপকার ও তাঁর সৃষ্টিকে মধ্যবিত্ত সংস্কৃতির গণ্ডির মধ্যে নতুন করে আবদ্ধ করার প্রবণতা।”
[আদম সুরত ২০১৪: ৫৪-৫৫]
আদম সুরত নির্মাতা তারেক মাসুদের তৃতীয় স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র, এর আগে তিনি সোনার বেড়ি [১৯৮৫] ও আহ্ আমেরিকা [১৯৮৫] নামের দুটি ছোটছবি তৈরি করেছেন। এস এম সুলতানকে নিয়ে তৃতীয় প্রামাণ্যচিত্রটি বানাতে তারেক মাসুদ সময় নিয়েছেন সাত বছর। ১৯৮২ সালে শুরু করে ছবির কাজ শেষ করেন ১৯৮৯ সালে। এই সাত বছর নির্মাতা শিল্পীর জীবনযাপনকে শুধু ক্যামেরায় ধারণই করতে চাননি, শিল্পীর শিল্পদর্শনকে উন্মোচন করতে চেয়েছেন। প্রাথমিকভাবে, তারেক মাসুদ বলছেন,
“একজন শিল্পীকে তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতা কীভাবে পরিবর্তিত করে তুলতে পারে, ছবিটি হবে তারই একটি সমীক্ষা।”
[মাসুদ ২০১২: ১৬]
কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছবিটি আর বাস্তবজীবন দ্বারা শিল্পীর প্রভাবিত হওয়ার খতিয়ানে আটকে থাকেনি। সেখানে শ্রেণীচরিত্রের হিসাব-নিকাশও উঠে এসেছে।
…
তথাকথিত
উন্নয়নের দৌড়ে
পিছিয়ে পড়া একটি
কৃষিপ্রধান দেশের আর্থসামাজিক
ও
সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে
সুলতানের জীবন
ও
কর্ম প্রাসঙ্গিক
ও
গুরুত্বপূর্ণ…
এই জায়গাতেই আমার মনে হয়েছে তারেক মাসুদ ভীষণভাবে রাজনীতি-সচেতন নির্মাতা। শুধু তাই নয়, তিনি দারুণভাবে শেকড়-সন্ধানীও বটে। অনেকটা যেন সুলতানেরই মতো। এ কারণেই কি তারেক মাসুদ সুলতানের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন? কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতে অবশ্য তারেক মাসুদ বলেছিলেন, এই ছবি তিনি করেছিলেন শুধু এইজন্য নয় যে সুলতান বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠশিল্পী, তিনি এই ছবি নির্মাণে ব্রত হয়েছিলেন কারণ তিনি মনে করেন,
“তথাকথিত উন্নয়নের দৌড়ে পিছিয়ে পড়া একটি কৃষিপ্রধান দেশের আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে সুলতানের জীবন ও কর্ম প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ…”।
[মাসুদ ২০১৪: ১২
এ থেকে বোঝা যায় বাংলাদেশের সমাজ-কাঠামোর ভেতরে তারেক মাসুদ সুলতানকে আবিষ্কার করতে চেয়েছিলেন, সুলতান যেমনভাবে চেয়েছিলেন কৃষক সমাজের আত্মশক্তিকে শৈল্পিক চোখে বিধৃত করতে। দুজনের কর্মই আদতে একমুখী, সেটি হলো বাংলাদেশের গ্রন্থির ভেতর দিয়ে প্রবাহিত রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ধারায় নিজের আত্মাকে অনুসন্ধান। দুজনের কাজের ভেতরই অন্তর্যাত্রার সেই অভিমুখ স্পষ্ট। আর এই কারণেই এস এম সুলতান ও তারেক মাসুদ বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ চিত্রশিল্পী ও চলচ্চিত্রশিল্পী।

পুঁজি
১. আব্দুর রাজ্জাক, [২০১৪], সুলতানের ছবি প্রসঙ্গে, আদম সুরত [প্রামাণ্যচিত্রের ডিভিডি ও লেখাপত্রের সংকলন], পৃষ্ঠা: ৬৭-৬৯, ঢাকা: বেঙ্গল ফাউন্ডেশন
২. আহমদ ছফা, [২০১১], বাংলার চিত্র-ঐতিহ্য: সুলতানের সাধনা, নূরুল আনোয়ার সম্পাদিত আহমদ ছফা রচনাবলী-১, পৃষ্ঠা : ১৫০-১৭৪, ঢাকা: খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি।
৩. তারেক মাসুদ, [২০১৪],সুলতান কেন?, আদম সুরত [প্রামাণ্যচিত্রের ডিভিডি ও লেখাপত্রের সংকলন], পৃষ্ঠা : ১০-১২, ঢাকা: বেঙ্গল ফাউন্ডেশন
৪. তারেক মাসুদ, [২০১২], চলচ্চিত্রযাত্রা, ঢাকা: প্রথমা প্রকাশনী
৫. মো. মোস্তাক খান, [ডিসেম্বর ২০১৭],জীবনপঞ্জিতে তারেক মাসুদ, অরবিন্দ চক্রবর্তী সম্পাদিত পত্রিকা মাদুলি [৭ম বর্ষ ১ম সংখ্যা: তারেক মাসুদ সংখ্যা], পৃষ্ঠা : ৫৩২-৫৫০ , ফরিদপুর
ভালো লাগলো