লিখেছেন । সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়
কিয়ারোস্তামির সিনে-রাস্তা
[ইরানি ফিল্মমেকার আব্বাস কিয়ারোস্তামিকে নিয়ে গদ্য, তার সাক্ষাৎকার ও সব ফিল্মের রিভিউ]
গ্রন্থনা ও অনুবাদ । রুদ্র আরিফ
পৃষ্ঠাসংখ্যা । ৪৩২

বাংলাদেশি সংস্করণের প্রকাশক । ভাষাচিত্র
প্রথম প্রকাশ । ফেব্রুয়ারি ২০১৭
মূল্য । ৬৭৫ টাকা

ভারতীয় সংস্করণের প্রকাশক । প্রতিভাস
প্রথম প্রকাশ । জুলাই ২০১৭
মূল্য । ৫০০ রুপি
এই দেখা এক বিশেষ ধরনের দেখা। ইরানের চলচ্চিত্রস্রষ্টা আব্বাস কিয়ারোস্তামি যেভাবে নিসর্গ ও মানুষকে সপ্তসিন্দু দশদিগন্তে অবিচ্ছিন্ন দেখেন, তা বিশেষভাবেই প্রাচ্যের দেখা। রবীন্দ্রনাথ শকুন্তলা প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, মিরান্দা ও শকুন্তলার মধ্যে অন্যতম বৃহৎ ব্যবধান নিসর্গের উপলব্ধিতে। জনহীন দ্বীপ থেকে শেক্সপিয়র তাঁর নায়িকাকে বিচ্ছিন্ন করলেও তার সৌন্দর্যের ততখানি হানি হবে না কিন্তু তপোবনবিচ্ছিন্না কালিদাস-দুহিতাকে চিন্তা করাও অসম্ভব। সে প্রকৃতিরই সম্প্রসারণ। যেমন মিজুগুচি, যেমন ঋত্বিক ঘটক, তেমন আব্বাস কিয়ারোস্তামিও প্রাচ্যের আত্মার স্বরলিপি। চলার পথে [১৯৪০-২০১৬] তিনি পরমাণু থেকে মহাকাশ, কিছুই অবজ্ঞা করেন না। সবচেয়ে আন্তর্জাতিক হয়েও তিনি স্বদেশচেতনার তুমুল গহনে চলে যান, যেমন ঋত্বিকের কোমল গান্ধার-এ রূপসি বাংলা, তেমন ভূমিকম্প-উত্তর ইরানের প্রাণলক্ষ্মী, অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন ভুদৃশ্য হয়ে, কিয়ারোস্তামির দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে।
ঈশ্বর আমাদের অলৌকিকতা দিয়েছেন। তাতে পৌষ মাসে গোলাপ ফুটে ওঠে, স্রষ্টা ছাড়া আর কে সুন্দরের স্তব্ধ দৃষ্টিপাতে সাড়া দিতে পারে? ভোরের আলোয়, মধ্যাহ্নে বা প্রদোষে কী করে যে সত্যের মুখ দেখতে পেলেন আব্বাস কিয়ারোস্তামি! দৃশ্য আর ধ্বনির মিথুন-প্রতিমা কী করে যে স্বর্গাভিযানে চলে গেল! বার্গম্যানের শতবর্ষ উদযাপন করতে-করতেই মনে হয় এই আর-একজন সিনেমার জনয়িতা, যাঁর বিষয়ে বলা যায়, তিনি দার্শনিক। আব্বাস কিয়ারোস্তামি বার্গম্যান-গোদার–তারকোভস্কি-উত্তর যুগে একমাত্র চলচ্চিত্রস্রষ্টা যিনি দৃশ্যের অত্যাচার পার হয়ে চিত্রপ্রতিমাকে আধ্যাত্মিক করে তোলার দুঃসাহস দেখাতে পারেন।
…
কিয়ারোস্তামির
চলচ্চিত্রের অন্দরমহলে
উঁকি দেওয়ার জন্য এই সাক্ষাৎকার
সমূহের ভূমিকা
পাসওয়ার্ডের
মতো
…
কলকাতায় আমরা তাঁর চেরির স্বাদ [টেস্ট অব চেরি; ১৯৯৭] বা হাওয়া আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যাবে [উইন্ড উইল ক্যারি আস; ১৯৯৯] জাতীয় ছবি দেখেছি। বাঙালি দর্শক তাঁর উত্তুরে ত্রয়ী হোয়্যার ইজ ফ্রেন্ডস হোম [১৯৮৭], অ্যান্ড লাইফ গোজ অন [১৯৯২], থ্রু দি অলিভ ট্রিজ [১৯৯৪] দেখেছে সাড়ম্বরে। ক্লোজ-আপ [১৯৯০] আমাদের পক্ষে হয়ে উঠেছিল হেয়াঁলির মায়াঞ্জন, কিন্তু তাঁর বিষয়ে আলোচনা ও পঠনে, সবিনয়ে বলি, আমাদের একটা কার্পণ্য থেকেই গেছে। সেই অভাব কিঞ্চিৎ পরিমাণে হলেও রুদ্র আরিফের গ্রন্থনা ও অনুবাদের সৌজন্যে কিয়ারোস্তামির সিনে-রাস্তা বইটি মেটাতে পারল। বলে নেওয়া ভালো যে, সংশ্লিষ্ট গ্রন্থ মোটেই পূর্ণাঙ্গ গবেষণা-সন্দর্ভ নয়, বরং রুদ্র সম্পাদনার সময়ে নিজেকে বিযুক্তই রাখতে চেয়েছেন। নিজে কোনও বিস্তৃত সূচনাপর্ব না লিখে অধ্যাপক হামিদ দাবাশি প্রণীত ক্লোজ-আপ : ইরানিয়ান সিনেমা– পাস্ট, প্রেজেন্ট অ্যান্ড ফিউচার বইটি থেকে কিয়ারোস্তামি প্রসঙ্গে একটি দীর্ঘ রচনা ব্যবহার করেছেন, যা গড়পড়তা পাঠকের কাছে একটি চমৎকার উপক্রমণিকা হিসেবে কার্যকর হবে। এ ছাড়া রয়েছে অন্তত চব্বিশটি সাক্ষাৎকার। কিয়ারোস্তামির চলচ্চিত্রের অন্দরমহলে উঁকি দেওয়ার জন্য এই সাক্ষাৎকার সমূহের ভূমিকা পাসওয়ার্ডের মতো। এ ছাড়া সংযোজিত হয়েছে তাঁর সৃষ্টিকর্মের আলাদা আলাদা টুকরো আলোচনা। প্রথিতযশা সমালোচকদের সঙ্গে এই সূত্রে আমরা দৃষ্টিবিনিময় করে নিতে পারি। বস্তুত, কিয়ারোস্তামির বহুস্তরিক ও বহুস্বরিক চলচ্চিত্রভাবনাকে হৃদয়ঙ্গম করার ক্ষেত্রে এই রিভিউগুলি এক ধরনের সংযোগসেতু হিসেবে কাজ করে। সঙ্গে সঙ্গে উৎসাহী পাঠকের প্রাপ্তি তাঁর পুরস্কার-প্রাপ্তি বা অন্যের ছায়াছবিতে অভিনয় ও বেশ কিছু অনালোচিত ছবি বিষয়ে তথ্যপঞ্জি, সব মিলিয়ে রুদ্র আরিফের সম্পাদনা বেশ মেদহীন ও পরিচ্ছন্ন।
অনুবাদ বিষয়ে তত প্রশংসা করতে পারব না। রুদ্র, তাঁর ‘তারকোভস্কি’ সম্পর্কিত গ্রন্থ সমালোচনার সময়ও খেয়াল করেছি, ভাষাকে সংযোগহীন সূত্র হিসেবে যেভাবে ব্যবহার করেন, তাতে আমাদের মাতৃভাষার কাব্যধর্ম ও প্রকরণ খানিকটা অবহেলিত থাকে। ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদের সময়, উভয় ভাষার বিন্যাস যে ভিন্ন প্রকৃতির, তা অবশ্য অনেকেই খেয়াল করেন না বা মতান্তরে মনে করেন অর্থ সংবহন ভাষান্তরের মূল কৃতিত্বও। আব্বাস কিয়ারোস্তামির একটি ছোট্ট জীবনপঞ্জি সংযোজিত হলে পরবর্তী সংস্করণে এই সংকলন যথার্থ কিয়ারোস্তামি-প্রবেশিকা হয়ে উঠবে। রুদ্র আরিফ, অতএব, আমাদের সমূহ ধন্যবাদ পেতে পারেন।

আসলে সিনেমা এত প্রকাশ্য বাস্তব যে, প্রায়ই তাকে জনপদবধূ মনে হয়। আমোদ ও তামাশার কুয়াশা কাটিয়ে যে সামান্য কয়েকজন শিল্পী তাঁকে জীবনের মতো পাঠ্য ভেবেছেন, আব্বাস কিয়ারোস্তামি তাঁদের অন্যতম। খুব অন্তর্যামী চেতনা থেকে কিয়ারোস্তামি প্রশ্ন করে গেছেন, অস্তিত্ব কেন? জীবন কেন? আধুনিক ইরানের রণ-রক্ত-সফলতা থেকে উপাদান সংগ্রহ করে তিনি চলে যান স্বদেশের আত্মার গহনে, যেখানে রয়েছে কাব্য। তিনি জানেন, প্রতিবেদন রচনা বা বাস্তবসম্মত ধারাবিবরণী দেওয়া তাঁর কাজ নয়। সত্যি কথা বলতে কী, কিয়ারোস্তামির ছবি অনেক শান্ত মেধা দাবি করে। জীবনের সুপক্ক ফলের স্বাদ অসহ্য বোধ না হলে একটি সংগঠিত ধর্মীয় সমাজে কেউ আত্মহননের তাৎপর্য নিয়ে ভাবে? কিয়ারোস্তামি ভেবেছেন ও সৃষ্টিকর্মকে নিয়ে গেছেন প্রায় ব্রাহ্মজিজ্ঞাসার স্তরে। আশ্চর্য কী যে, তাঁর প্রথম কাহিনিচিত্র প্রতিবেদন [দ্য রিপোর্ট; ১৯৭৭] মানুষের পাপ ও আত্মবিনাশকেই উপজীব্য করে।
…
যদি
চেরির স্বাদ
ছবিটির দিকে তাকাই
তবে বোঝা যাবে কিয়ারোস্তামি
জীবনের মূল প্রশ্নটিকে কীভাবে ছলনার
কিনারায় ঠেলে দিয়ে তাকে পুনরাবিষ্কৃত
করেন
…
কিয়ারোস্তামি পিকাসোর মতোই ভাবেন যে, শিল্প সত্য নয়, কিন্তু এক মহৎ মিথা, যা আমাদের পৌঁছে দেয় সত্যের দ্বারপ্রান্তে। পিকাসোকে প্রায় প্রতিধ্বনিত করে তিনি বলেন– ‘He can never get close to the truth except through lying’। যদি চেরির স্বাদ ছবিটির দিকে তাকাই তবে বোঝা যাবে কিয়ারোস্তামি জীবনের মূল প্রশ্নটিকে কীভাবে ছলনার কিনারায় ঠেলে দিয়ে তাকে পুনরাবিষ্কৃত করেন। অথচ এই ছবি ইসলামিক দুনিয়ার কাঠামোয় তৈরি বলে বার্গম্যানের সেভেন্থ সিল-এর চেয়ে কত আলাদা হয়ে যায়। কী সব তুলনারহিত প্যানোরামিক লং শট! আঙ্গিকের দিক থেকে আব্বাস কিয়ারোস্তামির অবস্থান তো অভূতপূর্ব কথোপকথনের, দৃশ্যগ্রহণের। তিনি অনেক দূর থেকে দীর্ঘক্ষণ আত্মহত্যাপ্রয়াসী মানুষটির লং শট নেন। কিন্তু শব্দকে দূরাগত রাখেন না, বরং সম্মুখবর্তী করেন। হয়তো পণ্ডিতরা পারস্য বা ইরানের সাহিত্যধর্মের প্রাচুর্যকে এই রীতির সঙ্গে যুক্ত করবেন, কিন্তু চিত্র ও ধ্বনির এই দু’টি স্তরে বিপরীতমুখী প্রয়োগ একরকমের দুঃসাহসিক অভিযান।

এই অভিযানের সূচনা তাঁর প্রথম ছবিটি থেকেই। ১৯৭০ সালের ছোট এই ছবিতেই প্রথম কিয়ারোস্তামি প্রমাণ করেন যে, তিনি বাস্তবকে স্বয়ম্ভরতা দিতে চান। দ্য ব্রেড অ্যান্ড অ্যালি নামে এই ছবির ক্যামেরাম্যান স্বভাবতই প্রচলিত চলচ্চিত্ররীতি অনুযায়ী চাইছিলেন আলাদা আলাদা শটে তিনটি দৃশ্য ধৃত থাক। অন্যদিকে তরুণ কিয়ারোস্তামি চাইছিলেন একটি শটে অখণ্ড থাক দৃশ্যটি, তার মহিমা হবে সুদূরপ্রসারী। আজ দেখি সেদিনের অঙ্কুর মহীরুহে পরিণত হয়েছে।
লাইফ অ্যান্ড নাথিং মোর… ছবিতে কিয়ারোস্তামির মন্তব্য ছিল, চলমান চিত্রমালা কোনও প্রতিরূপায়ণ বা প্রতিবেদন নয়, বরং সাক্ষ্যদান। সকলেই দেখেন কিন্তু দার্শনিক হওয়ার নিয়তি সামান্য কয়েকজনের। তেমন একজন আব্বাস কিয়ারোস্তামি। রুদ্র আরিফ যে এই আলোকসামান্য দ্রষ্টার সঙ্গে বাঙালি চলচ্চিত্রপ্রেমিকদের আলাপ করিয়ে দিলেন, তার জন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানাই। তাঁর সূত্রেই বাংলা ভাষায় চেনা হল কিয়ারোস্তামির করুণ রঙিন পথ।
মূল প্রকাশ :
বইয়ের দেশ। ত্রৈমাসিক গ্রন্থ-ম্যাগাজিন, কলকাতা, ভারত; অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০১৮ সংখ্যা