চলচ্চিত্র ‘দেবী’ বাজার অভিমুখী চলচ্চিত্র: সরকারি অনুদানপ্রথার বাজে উদাহরণ

959

লিখেছেন । বেলায়াত হোসেন মামুন

দেবী
স্ক্রিন-রাইটার ও ফিল্মমেকার । অনম বিশ্বাস
উৎস-উপন্যাস । দেবী/ হুমায়ুন আহমেদ
প্রডিউসার । জয়া আহসান
[সরকারি অনুদানে নির্মিত]
সিনেমাটোগ্রাফার । কামরুল হাসান খসরু
আর্ট-ডিরেক্টর । সামুরাই মারুফ
মিউজিক । প্রবুদ্ধ ব্যানার্জি
এডিটর । সজল সরকার
ডিস্ট্রিবিউটর । জাজ মাল্টিমিডিয়া
কাস্ট [ক্যারেক্টার] । জয়া আহসান [রানু]; চঞ্চল চৌধুরী [মিসির আলী]; অনিমেষ আইচ [আনিস]; ইরেশ যাকের [আহমেদ সাবের]; শবনম ফারিয়া [নিলু]
রানিংটাইম । ১০৬ মিনিট
ভাষা । বাংলা
দেশ । বাংলাদেশ
রিলিজ । ১৯ অক্টোবর ২০১৮


বাজার করতে বেরিয়েছেন একজন নারী। সুন্দরী এবং তরুণী। বাজারের পথে তিনি হাঁটছেন। তার হাঁটার মধ্যে পথ চিনতে না পারার সরলতা উপস্থিত। হাঁটতে হাঁটতে তিনি কি গল্প করছেন কারো সাথে? দেখে মনে হচ্ছে তিনি একজন শিশু। হাত নেড়ে নেড়ে কিছু বলছেন, কিছু বুঝতে না পেরে ঠোঁট ওলটাচ্ছেন, সুন্দর চোখ দুটো ঘুরিয়ে তাকাচ্ছেন খুব সরল শিশুসুলভ ভঙ্গিতে।

এই যে তার হাঁটা এবং একা একা কথা বলার অভিনয়ের দৃশ্যটুকু– একে ভালো না বেসে উপায় নেই। কারণ তা এতটাই মনগ্রাহী। কিন্তু এই তরুণী যদি আমাদের অতি চেনা জয়া আহসান না হতেন, যদি এই তরুণী অতখানি সুন্দর না হতেন তবে হয়তো এই সিকোয়েন্সটুকু আমরা অন্যভাবে বিবেচনা করতাম। হয়তো একে একজন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধি মানুষের সহজাত যাপনের চিত্র বলেই মনে হতো। তখন হয়তো দৃশ্যটুকুকে হুট করে ভালোবাসা সম্ভব হতো না; বরং বুদ্ধিপ্রতিবন্ধি মানুষটির জন্য একটু দরদবোধ করতাম।


অপরিচিত মানুষের অভিনয়
আমাদের যাপনের
কোনো অতীত
স্মৃতিকে
ট্রিগার
করে

একজন অতি পরিচিত অভিনয়শিল্পীর ‘অভিনয়’টুকু আমাদের চোখে কেবল অভিনয় না হয়ে নৈপুণ্যরূপে উপস্থিত হয়। কিন্তু একজন অপরিচিত মানুষের অভিনয় আমাদের যাপনের কোনো অতীত স্মৃতিকে ট্রিগার করে। তখন আমরা অপরিচিত মানুষের অভিনয়টুকুকে জীবনের অংশই মনে করি। চট করে তার প্রেমে পড়ে যাই না।

বলছিলাম বাংলাদেশের চলচ্চিত্র দেবীর একটি দৃশ্য নিয়ে। নির্মাতা অনম বিশ্বাস দেবী চলচ্চিত্রের পরিচালক। চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে বাংলাদেশের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাস দেবী অবলম্বনে। উপন্যাসটি আমি চলচ্চিত্রটি দেখার আগে পড়িনি। চলচ্চিত্রটি দেখার পর উপন্যাসটি পড়ার ইচ্ছে হয়।

এই ইচ্ছে হওয়ার বিষয়টি একটু অদ্ভুত। দেবী দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল আমি তো এমন একটি কাহিনীর চলচ্চিত্র দেখেছি। কিন্তু তখনি মনে পড়ছিল না ঠিক কোন চলচ্চিত্রটি দেবীর মতো?

ছবি দেখা শেষে বাড়ি ফিরে একটু ভাবতেই মনে পড়ল পশ্চিম বাংলার একটি চলচ্চিত্রের নাম। চলচ্চিত্রটির নাম ইএসপি : একটি রহস্য গল্প। এই চলচ্চিত্রটির পরিচালক ভারতের নির্মাতা শেখর দাস। মনে পড়তেই তড়িৎ গেলাম গুগলে। একটু খোঁজ নিতে। খোঁজের দরকার পড়ল; কারণ এই ছবিটি পুরো দেখা হয়নি। ভালো লাগেনি। মাঝপথে দেখা বন্ধ করেছিলাম। তাই মনে পড়তে একটু সময় গেল। যাহোক খোঁজ নিয়ে দেখলাম চলচ্চিত্র ইএসপি : একটি রহস্য গল্প-এর কাহিনীকারের নাম শিবাষিস রায়!

পড়ে গেলাম আরও জটিলতায়। তারপরই পড়তে ইচ্ছে হলো প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের খুব গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস দেবী। সেই রাতেই পড়ে ফেললাম। পড়ে প্রথমে যা বুঝলাম তা হলো, ভারতের চলচ্চিত্র ইএসপি : একটি রহস্য গল্প-এর নির্মাতা এবং কাহিনীকার– উভয়ই স্রেফ চুরি করেছেন। তারা বাংলা সাহিত্যের নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের জনপ্রিয় একটি উপন্যাসকে ব্যবহার করে খুব বাজে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। চলচ্চিত্রটির কোথাও প্রকৃত লেখকের প্রতি কোনো ঋণস্বীকার করা হয়নি।

ইএসপি : একটি রহস্য গল্প এবার পুরো দেখলাম। এই দেখার অনুভূতির কথা অন্য সময়ের জন্য তোলা রইল। এখন অনম বিশ্বাসের দেবীর দিকে দেখি।

দেবী
দেবী

ছবির গল্প

দেবীর গল্প তো অধিকাংশ মানুষই জানেন বলে মনে হয়। উপন্যাসের গল্প নতুন করে এখানে পুনরাবৃত্তি করতে তেমন আগ্রহবোধ করছি না। কারণ কোনো সাহিত্য থেকে চলচ্চিত্র নির্মিত হওয়ার পর সাহিত্যের সাথে চলচ্চিত্রের তুলনামূলক বিচার করার চেষ্টাকে যথাযথ কাজ বলে মনে হয় না। সাহিত্য একটি শিল্পফর্ম এবং চলচ্চিত্র আরেকটি পৃথক ফর্ম। প্রতিটি শিল্পমাধ্যমের নিজস্বতা রয়েছে। তাই একটি অন্যটির অনুপ্রেরণা হতে পারে; কিন্তু হুবহু অনুকরণ হতে পারে না। তবুও এ কথাও বলে রাখি যে এই আলোচনার শেষে আমি হুমায়ুন আহেমেদের উপন্যাসের মুলসুরে প্রবেশ করতে চাইব। কিন্তু তা এখনই নয়।

অনম বিশ্বাসের দেবী চলচ্চিত্রের গল্পটির কেন্দ্রীয় চরিত্র রানু। তিনি একজন বিবাহিত নারী। বয়সে তরুণী। তিনি এবং তার স্বামী আনিস ভাড়া থাকেন একটি বাড়িতে। বাড়িটি দোতলা। বাড়ির নিচতলায় থাকেন বাড়ির মালিক। বাড়ির মালিকের দুই মেয়ে। নিলু এবং বিলু। নিলু বয়সের দিক থেকে রানুর প্রায় সমবয়সী। বিলু কিশোরী।

গল্পটি গল্প হয়ে ওঠে রানুর অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার কারণে। রানু যা স্বপ্নে দেখেন বা বলেন তা ঘটে যায়। রানু অনেক ধরনের শব্দ শুনতে পান। অদৃশ্য থেকে কেউ তার নাম ধরে ডাকে। রানু ভয় পান। রানু অদৃশ্য কাউকে দেখতে পান এবং অদৃশ্য সেই অবয়বের সাথে তিনি কথা বলেন, গল্প করেন। এসব ‘অস্বাভাবিকতা’ দেখে রানুর স্বামী আনিস ভয় পান। তিনি চিন্তিত হয়ে তার একজন সহকর্মীর পরামর্শে একজন মনোচিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়। আনিস যার কাছে আসেন, তিনি কোনো পেশাদার মনোচিকিৎসক নন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন খণ্ডকালীন শিক্ষক। পড়ান মনোবিদ্যা। তিনি মিসির আলী। বিনাঅর্থে তিনি অনেকটা শখের বসে নানারকম মনোসমস্যার সমাধান করে থাকেন। যা প্রকৃত অর্থে একসময় মনে হয় রহস্যময়, তাকে মিসির আলী বিজ্ঞানমনস্ক যুক্তিতে সাধারণ সমস্যায় পরিণত করেন।

মিসির আলী আনিসের কাছে রানুর সমস্যা শোনেন। এরপর রানুকে নিয়ে আসতে বলেন। রানুর কাছ থেকে মিসির আলী রানুর প্রথম ভয় পাওয়া গল্পটি শোনেন; কিন্তু রানুর কথায় পুরোপুরি আশ্বস্থ হতে পারেন না। তিনি রানুদের গ্রামের বাড়ি গিয়ে রানুর ভয় পাওয়ার ঘটনার অনুসন্ধান করেন এবং ঘটনার প্রকৃত কারণ উন্মোচন করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাতে তিনি সম্পূর্ণ সফল হয়েছেন– চলচ্চিত্র তা বলে না। যাহোক গল্প বলা শেষ করি। রানু তার ‘অলৌকিক’ ক্ষমতার অনেক উদাহরণ দিতে থাকেন চলচ্চিত্রে।

এদিকে নিলু, মানে বাড়িওয়ালার বড় মেয়ে অপরিচিত একজন যুবকের প্রেমে পড়েন যা পরবর্তীকালে বিপদ ডেকে আনে। কারণ সেই অপরিচিত যুবক মানসিকভাবে অসুস্থ এবং সে নিলুকে হত্যা বা নির্যাতনের চেষ্টা করে। রানু চলচ্চিত্রের অন্তিমে তার অলৌকিক ক্ষমতায় সেই বিপদ থেকে নিলুকে রক্ষা করেন। মোটামুটি এই হলো গল্পের সরলরেখা।

দেবী
দেবী

গল্প-শুরুর গল্প

চলচ্চিত্রটির গল্প শুরু হয় ১৭৫৭ সালের টাইমলাইনে। দেখা যায় ১৭৫৭ সালে বিশাল এক প্রাসাদের মতো বাড়ির উঠোনে বা মন্দিরের চাতালে গভীর রাতে একজন কিশোরীকে বলি দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। দৃশ্যগুলোর রঙ সাদাকালোয় দেখানো হয়। প্রস্তুতির এক পর্যায়ে অদৃশ্য থেকে বলিদাতার মুণ্ডুচ্ছেদ করা হয় এবং মুণ্ডুখানা বলির বেঁদির নিচে এসে পড়ে। যেখানে ক্যামেরা লো এঙ্গেলে ধরা ছিল। তাতে ক্যামেরার পয়েন্ট অব ভিউ থেকে দেখলে মুণ্ডুটি ছিটকে এসে ফোরগ্রাউন্ডে পড়ে আর ব্যাকগ্রাউন্ডে দেখা যায় বলির জন্য প্রস্তুতকৃত কিশোরীর ভয়ার্ত অবয়ব। বলি হওয়া থেকে বেঁচে যাওয়া কিশোরী সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠে। আমরা দেখি একটি দেবীমূর্তি। দৃশ্য শেষ হয়। ছবির শুরুর টাইটেল উঠতে শুরু করে।

এ থেকে আমরা বুঝি, এটা অতীতের গল্প। কেবল সাল তারিখের জন্য নয়। দৃশ্যের রঙের পরিবর্তনও এই কারণেই। কিন্তু টাইমলাইন কেন ১৭৫৭ সাল? পুরো চলচ্চিত্র দেখেও এই প্রশ্নের কোনো মীমাংসা পাই না।

১৭৫৭ উপমহাদেশের ইতিহাসে খুব গুরুত্বপূর্ণ বছর। আর বিশেষ করে এই সাল বাংলার জন্য সবচেয়ে ঐতিহাসিক। পলাশীর যুদ্ধ এবং বাংলার পরাজয় কেবল নয়; ১৭৫৭ সাল হলো উপমহাদেশে ইংরেজ শাসনের শুরুর সাল। এইসব বিবেচনায় এই সালটি পর্দায় দেখানোর সাথে এই গল্পের কি সম্পর্ক তার কারণ অনুসন্ধানে বাস্তবে একজন মিসির আলীর প্রয়োজন হতে পারে!

তবে আমরা যদি বিষয়টাকে এভাবে দেখি যে, বলি হতে প্রস্তুত কিশোরী বা বালিকা বাংলার রূপক, বলিদাতা হলেন বাংলার নবাবী মুসলমানী শাসন এবং বালিকাকে বলি হতে রক্ষাকারী অলৌকিক শক্তির শ্বেত পাথরের দেবীপ্রতিমা অর্থাৎ শ্বেতাঙ্গ ইংরেজ শাসন– তাহলে কি আমরা এই বিষয়ে অতিদূর কষ্ট-কল্পনা করছি?

এই সিকোয়েন্সকে রূপক ধরে নিয়ে যদি বলি বাংলা ১৭৫৭ সালে পরাজিত হয়নি, বরং বিদেশি মুসলমান নির্যাতনকারী শাসকদের থেকে ইংরেজদের হাতে সুরক্ষা পেয়েছিল– তবে কি তা খুব ভুল রিডিং হবে? যদি বলেন, হ্যাঁ ভুল রিডিং হবে, তবে এই চলচ্চিত্রের সাথে উপমহাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই তারিখটি ব্যবহারের বিষয়টিও আমার কাছেও অতিদূর কল্পনা বলেই মনে হয়েছে। তারিখটি যদি ১৭৫৪ বা ১৭৫৯ হত তাহলে এমনটা মনে হত না। কিন্তু কেন ১৭৫৭ সাল?

দেবী

চলচ্চিত্রের কলকব্জা

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বাভাবিক যে মান, তারচেয়ে অনম বিশ্বাসের দেবী যথেষ্ট ভালোভাবে নির্মিত। চলচ্চিত্রটির চিত্রগ্রহণ চোখকে আরাম দেয়। দৃশ্যগঠনের পরিকল্পনা ও যত্ন চোখে পড়ে। অশরীরির ছায়ার উপস্থিতি যেমন করে বাড়ির ছাদের দৃশ্যে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে ফোরগ্রাউন্ডে রানু ও একটি লক্ষী পেঁচার বসে থাকা অতি উত্তম দৃশ্যপরিকল্পনা। খুব মনোযোগ দিয়ে না দেখলে ব্যাকগ্রাউন্ডের এই অশরীরি ছায়াদুটোর উপস্থিতি চিহ্নিত করা যায় না। কিন্তু তারা আছে। দাঁড়িয়ে।

চিত্রগ্রহণের ক্ষেত্রে আলোর ব্যবহারের দিকটি যত্নের সাথে লক্ষ্য রাখতে হয়। দেবীর কোনো কোনো দৃশ্যে আলোর ব্যবহার প্রয়োজনের তুলনায় তীব্র অথবা কম মনে হয়েছে। মিসির আলীর ঘরে রানুর উপস্থিতিতে আলোর তীব্রতা অনেক বেশি ছিল। এই তীব্রতা দৃশ্যটিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে বাঁধা দিয়েছে।

চিত্রগ্রাহক কামরুল হাসান খসরু এবং নির্মাতা অনম বিশ্বাস দেবীর দৃশ্যমালা গঠনে মনোযোগী ছিলেন, তা সহজেই বোঝা যায়। কিন্তু তারা মিসির আলীর ঘরটি কেন একটি বাড়ির ছাদে টিনের তৈরি ঘরে রূপ দিলেন, তা বোঝা গেল না। এই সময়ে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক কেন এমন একটি ঘরে থাকবেন? যুক্তি কি বলে?


দেবী
হঠাৎ করে
তামিল-তেলেগু
চলচ্চিত্রের চেহারা নিয়ে দাঁড়ায়

এই চলচ্চিত্রটি একটি মনস্তাত্ত্বিক থ্রিলার হয়ে ওঠার কথা। হয়েছে কি-না তা পরে বলব। আপাতত চলচ্চিত্রের শব্দ ব্যবহারের কথা বলি। যে কোনো মনস্তাত্ত্বিক থ্রিলারধর্মী চলচ্চিত্রে শব্দের ভূমিকা অনেক বেশি। কারণ শব্দ দিয়ে পরিবেশের রহস্য তৈরি করাটাই সবচেয়ে কার্যকর উপায়। দেবীতে অনম বিশ্বাস তা করতে পেরেছেন। চলচ্চিত্রটি দেখার সময়ে শব্দের অনেক প্রয়োগ এতটাই ভালো হয়েছে যে দর্শকদের আঁতকে উঠতে দেখেছি! দেবীর শব্দ পরিকল্পনা যতটুকু ভালোবোধ দিয়েছে ঠিক ততখানি অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছে এই চলচ্চিত্রে প্রায় জোর করে ঠেসে দেওয়া গানটি এবং গানটির দৃশ্যমালা। এই চলচ্চিত্রটির মুডের সাথে হঠাৎ অমন হাসিখুশি দম্পতির উদয় কেমন করে হয় তা বোঝা মুশকিল। এইখানটায় দেবী হঠাৎ করে তামিল-তেলেগু চলচ্চিত্রের চেহারা নিয়ে দাঁড়ায়। না হলে মনোচিকিৎসকের বাড়ি থেকে ফেরার পথে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত স্বামী এবং ‘অসুস্থ’ স্ত্রীর হঠাৎ হাসিখুশি এই রূপ এমন হুল্লোড়ময় দৃশ্যমালায় ঠাসা গীতিময় গানটি কেমন করে নাজিল হলো পর্দায়! কিছু বোঝা গেল না।

চলচ্চিত্রটির সম্পাদনার মান কোনো কোনো সিকোয়েন্সে খুব ভালো লেগেছে। যেমন রানু যখন বিলুর হাত থেকে নিয়ে নিলুকে লেখা আনিস সাবেতের চিঠিটি স্পর্শ করে, তখন অতি ছোট ছোট দৈর্ঘ্যের কতগুলো শটে একমুহূর্তে দেখানো হয় যে, রানুর বিপদের আশঙ্কা সত্যি। দেখানো হয় একটি হাত চিঠির উপরে থাকা হার্ট চিহ্নটিকে ব্লেড দিয়ে দু ভাগ করছে। এই দৃশ্য সম্পাদনা সুন্দর!

এমনিভাবে রানুর কাজে সহযোগিতাকারী ‘কাজের ছেলে’ জিতু মিয়ার রাতে অশরীরি দুই কিশোরীকে দেখে ভয় পাওয়ার দৃশ্যটির সম্পাদনাও খুব অভিঘাতমূলক। সিনেমা-হলে এই দৃশ্যে লোকজনকে আচমকা চিৎকার করে ভয় পেতে দেখেছি। এমন কয়েকটি ভালো সম্পাদনার উদাহরণের পাশাপাশি কিছু কিছু সিকোয়েন্সের হুটহাট শুরু হয়ে যাওয়াটা বিরক্ত করেছে। আগের সিকোয়েন্সে যে মুড ছিল, তা পরে আসা সিকোয়েন্সের মুডের একেবারে বিপরীত হওয়ায় হঠাৎ ধাক্কা খেতে হয়েছে দুই তিনটি জায়গায়। এসব ক্ষেত্রে সম্পাদনায় সিকোয়েন্সগুলোর শুরুকে পূর্বের সিকোয়েন্সের মুডের সাথে সহনীয় করে সেলাই করা যেত।

শিল্প-নির্দেশনার ক্ষেত্রে দুটি প্রধান আপত্তি আছে। একটি পূর্বেই লিখেছি। মিসির আলীর ঘর। মিসির আলীর ঘর মানে ‘ঠাসাঠাসি বই’– এই চিন্তার পাশাপাশি ওনার পেশার সামাজিক গুরুত্বটুকু বিবেচনা করা উচিত ছিল। মিসির আলীর টিনের ঘরের বাইরে রাসায়নিক ল্যাবে ব্যবহৃত হয় এমন নানারকম টিউবে মানিপ্লান্টের ব্যবহার অতি কষ্ট-কল্পনা মনে হয়েছে। রহস্যপ্রিয়, বই-পড়ুয়া অধ্যাপক এবং অকৃতদার হলেই এমন হতে হবে– এটা দৃশ্য পরিকল্পনার জন্য একটু অতি সরলীকরণ।


বাংলা চলচ্চিত্রের
ভিলেনের
যেমন
একটি
আস্তানা
থাকে, ঠিক
তেমনি আনিস সাবেতের
মতো একজন সাইকোপ্যাথের
একটি ‘আস্তানা’ তো থাকবেই!

আর দ্বিতীয় প্রধান আপত্তি হলো আনিস সাবেতের ‘আস্তানা’। বাংলা চলচ্চিত্রের ভিলেনের যেমন একটি আস্তানা থাকে, ঠিক তেমনি আনিস সাবেতের মতো একজন সাইকোপ্যাথের একটি ‘আস্তানা’ তো থাকবেই! আর সেটা একটি আন্ডারগ্রাউন্ড গোডাউনের ভেতরে হতে হবে! নিলুকে বেঁধে রেখে আনিস সাবেত তার যে ‘অস্ত্র-শস্ত্র’ দেখাচ্ছিল, তাতে আমার কেবলি বাংলাদেশের অতি-ব্যবসামুখী সিনেমাগুলির ভিলেনের আস্তানা বলে মনে হচ্ছিল। খুবই দুর্বল শিল্প-নির্দেশনার কাজ। এখানে যে কেবল শিল্প-নির্দেশকের একার ব্যর্থতা, তা নয়। এ হলো চলচ্চিত্র নির্মাতার ব্যর্থতা। তিনি প্রথাগত চিন্তার বাইরে বের হতে পারেননি।

এছাড়াও এই চলচ্চিত্রের অনেক আপত্তিকর ব্যাপার চোখে পড়ে। যেমন ঘুম থেকে উঠে আসা আনিসের শার্টের ভাজহীনতা। রানুর সবসময় কালারফুল, ভাজহীন শাড়ি পরা। একজন মানসিকভাবে অসুস্থ, কিছুটা বিপর্যস্ত মানুষ নিজের চোখে কাজল দিতে কখনও ভোলেন না! অদ্ভূত লাগে না!

শিল্পনির্দেশনা ও পোশাক পরিকল্পনা– এই উভয় ডিপার্টমেন্টকে সম্ভবত নির্মাতা বলে দিয়েছেন যে, পর্দায় ‘সুন্দর’ লাগে এমন কিছুই সাজিয়ে দাও; তা চলচ্চিত্রটির গল্পের সিরিয়াসনেসের সাথে যাক বা না-যাক। সুন্দর লাগা চাই! তাই এক্ষেত্রে শিল্প-নির্দেশক বা পোশাক পরিকল্পনাকারীকে কিভাবে দোষ দেই!

দেবী

দেব-দেবীর অভিনয়

অনম বিশ্বাসের দেবী চলচ্চিত্রের পুরুষ এবং নারী অভিনয়শিল্পীগণ সকলেই খুব পরিচিত পেশাদার মানুষ। সকলেই নিজের নিজের ক্ষেত্রে জনপ্রিয়। অথচ এই জনপ্রিয় শিল্পীদের ভিড়ে একমাত্র নিলু চরিত্রে রূপদানকারী শবনম ফারিয়াকেই আমার বাস্তবানুগ অভিনয়শিল্পী মনে হয়েছে। অন্যদের কম-অভিনয়, অতি-কম-অভিনয়, নাটুকে-অভিনয় এবং অতি-অভিনয়ের ফাঁদে পড়তে দেখলাম।


মিসির আলীর ক্ষুরধার চাহনির
কোনো চিহ্ন
চঞ্চল চৌধুরী
দিতে পারেননি

চঞ্চল চৌধুরীর অভিনয় সত্যিকারের অভিনয় হয়েছে। মানে, বোঝা যাচ্ছিল তিনি ক্রমাগত অভিনয় করে যাচ্ছেন। মাথার চুল কাঁচা-পাকা করলেই অথবা একটু শ্লথ গতিতে হাঁটলে অথবা দুই পায়ে দুই রকম স্যান্ডেল পড়লেই একজন মানুষ মিসির আলী চরিত্রের বৈদগ্ধতা ধারণ করতে পারে না। মিসির আলীর ক্ষুরধার চাহনির কোনো চিহ্ন চঞ্চল চৌধুরী দিতে পারেননি। দেবীতে মিসির আলীকে ফুটিয়ে তোলা হয়নি। তবে এও ঠিক যে, চঞ্চল চৌধুরীর হয়তো চেষ্টা ছিল। তাই চঞ্চল চৌধুরীরূপে মিসির আলীকে হাস্যকর লাগেনি।

নির্মাতা অনিমেষ আইচ একজন নিরীহ স্বামী। ‘কোনো এক অফিসের’ কর্মকর্তা। কিন্তু তিনি অভিনেতা নন। যদি অভিনেতা হতেন, তবে এমন অভিব্যক্তিহীন বা ভাবলেশহীন চেহারায় পুরো ছবিতে অভিনয় করতে পারতেন না। অনিমেষ আইচের ভাবলেশহীনতাকে ‘ভালো অভিনয়’ মনে করার কোনো কারণ নেই। এমন একটি ‘মনস্তাত্ত্বিক থ্রিলারধর্মী’ চলচ্চিত্রে এমন ভাবলেশহীন চরিত্র থাকাটা স্বাভাবিক হতেই পারে; তবে তা ‘অসুস্থতার’ পরিচায়করূপে। ভাগ্য ভালো যে এমন নিষ্প্রাণ চেহারা দেখে মিসির আলী আনিসরূপী অনিমেষ আইচকেই মানসিকরোগী ভেবে বসেননি!

আনিস সাবেত ওরফে ইরেশ যাকের ওরফে সাইকোপ্যাথ সবচেয়ে নাটুকে অভিনয় করেছেন। নিলুকে বন্দি করে তার ‘আস্তানা’য় তিনি যে সাইকোপ্যাথ সাজার চেষ্টাটুকু করেছেন তা বাংলাদেশের বাণিজ্যমুখিন চলচ্চিত্রের ভিলেনগণ বহু আগে থেকেই করে যাচ্ছেন সদর্পে। তাই তিনি তার অভিনয়ে বাড়তি কোনো স্বাদ যোগ করতে ব্যর্থ হয়েছেন।


অনেক ‘সুন্দর’ লাগলেও
জয়া আহসানময় দেবী
মিসির আলীর চলচ্চিত্র নয়

জয়া আহসান। কেবলমাত্র তার অভিনয়ের জন্যই দেবী নির্মিত হয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে। সত্যি কথা বলতে জয়া আহসানের অভিনয় দেখবার আনন্দও আছে। তবে একটি চলচ্চিত্র তো কোনো একক অভিনয়ের মঞ্চনাটক নয়। এই কারণে কোনো চলচ্চিত্রে যখন কোনো একজনের চরিত্র সবকিছু ছাপিয়ে ওঠে তা অনেক স্বাদপূর্ণ হওয়ার পরেও তা দৃষ্টিকটু লাগে। অনম বিশ্বাসের দেবীও তেমন একটি চলচ্চিত্র। জয়া আহসান সুঅভিনয়শিল্পী। কোনো সন্দেহ নেই। তবে ওনাকে সুন্দর লাগানোর জন্য একটি চরিত্রের মৃত্যু হলে তা চলচ্চিত্রের জন্য ক্ষতিই। স্বয়ং দেবী রানুর ওপর ভর করে আছেন। তাই রানুকে একটু মূর্তি মূর্তি লাগে। টানা টানা চোখ, সুন্দর চিবুক, চিকন সুন্দর ঠোঁট– এসব বর্ননা দিয়ে কি একজন ‘মধ্যবিত্ত’ চাকুরে স্বামীর স্ত্রীরূপে জয়া আহসানের রানুরূপ গ্রহণযোগ্য হয়?

তাই অনেক ‘সুন্দর’ লাগলেও জয়া আহসানময় দেবী মিসির আলীর চলচ্চিত্র নয়। এ চলচ্চিত্র রানুর। এ চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্র রানু এবং জয়া আহসান।

দেবী
দেবী

স্থূলতার চিহ্ন

মিসির আলীর চরিত্রটি নিয়ে আর নতুন কিছু বলার নেই। বাংলা সাহিত্যের এক অসামান্য চরিত্র– মিসির আলী। তাকে নিয়ে লেখক হুমায়ুন আহমেদও একটু বেশি যত্নশীল থাকতেন। তাই মিসির আলী প্রসঙ্গে ‘তাঁর’ লিখতে গিয়ে ত-এর উপর চন্দ্রবিন্দু দিয়ে সম্মানসূচক ‘তাঁর’ লিখতেন। একজন লেখক তার সৃষ্টি একটি চরিত্রকে এমন সম্মান দেওয়ার কারণ নিশ্চয়ই আছে। মিসির আলীর ব্যক্তিত্বই এই সম্মানের জোর তৈরি করে। মিসির আলীর ব্যক্তিত্বে আর যাই থাকুক, স্থূল হাস্যরস জন্ম দেওয়ার অভিপ্রায় কখনও দেখা যায়নি। কিন্তু অনম বিশ্বাসের দেবী চলচ্চিত্রে আনিস যখন প্রথমবার মিসির আলীকে খুঁজতে আসেন, তখন মিসির আলী নিজের পরিচয় গোপন করে আনিসকে একটি ‘হার্বাল মেডিসিনের দোকান’ দেখিয়ে দেন– যেখানে ‘সাধারণত’ যৌন সমস্যার চটকদার ‘ঔষুধ’ বিক্রি হয়। আনিস যথারীতি সেখানে যান এবং সেই দোকানে বসেন এবং একজন খদ্দেরের সাথে ‘অস্বস্থিকর’ আলাপের সূত্রে সেখান থেকে চলে যান।

এই সিকোয়েন্সটিতে যে স্থূল রস তৈরির মাধ্যমে লোক-হাসানো বা সুড়সুড়ি দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, তা হয়তো অন্যভাবেও করা যেত। কিন্তু মিসির আলীর চরিত্রের মধ্য দিয়ে এই স্থূল বিনোদনের পসরা সাজানোতে মিসির আলীর মতো সিরিয়াস চরিত্রের ব্যক্তিত্বের অবয়বে একধরনের স্থূলতার ছাপ পড়ে। এই ছাপ লেখকের মনন থেকে আসেনি। এসেছে নির্মাতার মনন থেকে। যা একাধারে অস্বস্থিকর এবং দুঃখজনক।

দেবী
দেবী

চলচ্চিত্র ‘দেবী’র মূল সুর

চলচ্চিত্র দেবীর মূল সুর খুব সরল। এই সুরে কোনো জটিলতা বা রহস্য নেই। দেবীর প্রধান চরিত্র রানু কিশোর বয়সে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বা নির্যাতনের শিকার হওয়ার পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন। সেই নিপীড়নের কথা তিনি কখনও কাউকে বলতে পারেননি। ভাগ্যক্রমে তিনি সেইদিন ‘অলৌকিক’ভাবে নির্যাতনের হাত থেকে বেঁচে যান। কিন্তু তিনি আজীবন সেই নিপীড়ককে ভুলতে পারেননি। রানুর এই নিপীড়নের স্মৃতি ট্রিগার করে যখন তিনি একদিন নদীতে গোসল করতে গিয়ে একটি মৃতদেহের সাথে ধাক্কা খান। রানুর মনে হয় মৃতদেহটি তাকে নিচের দিকে টানছে এবং তার পায়জামা খোলার চেষ্টা করছে। এতে তিনি জ্ঞান হারান এবং পরে অন্যরা তাকে উদ্ধার করেন। এই দুই ঘটনায় তার ‘বেঁচে যাওয়া’ তার মনোজগতে স্থায়ী ট্রমায় পরিণত হয়। যা তাকে ধীরে ধীরে স্নায়ুবিক সমস্যার দিকে নিয়ে যায়। রানু যে তার কৈশোরকালের নিপীড়নের কথা ভুলতে পারেননি, সেই পরিচয় তিনি দেন, যখন মিসির আলী তাকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘রানু, সেই মৃত মানুষটার নাম কী?’ রানু চট করে বলেন, ‘জালালউদ্দিন!’

প্রকৃত-প্রস্তাবে আমরা মিসির আলীর অনুসন্ধানে পরবর্তীকালে জানব যে নদীতে পাওয়া মৃত ব্যক্তিটির নাম কেউই জানে না। মৃত ব্যক্তিটির পরিচয় উৎঘাটনের জন্য কেউ চেষ্টাও করেনি। লাশে পচন ধরামাত্র লোকজন তাকে নদী পাড়ে পুঁতে ফেলেছে। পাশাপাশি মিসির আলীর অনুসন্ধানে জানা যায়, জালালউদ্দিন হলো সেই ব্যক্তি যে রানুকে কিশোরী বয়সে মন্দিরের ভেতরে নির্যাতনের চেষ্টা করেছিল এবং সেই ঘটনার পর সে মৃত্যুবরণ করে।

প্রশ্ন হলো, তবে রানু কেন নদীতে ভেসে আসা লাশটিকে জালালউদ্দিন বলে উল্লেখ করেন? উত্তর খুব সহজ। কারণ তিনি জালালউদ্দিনের অপরাধকে কখনও ভুলতে পারেননি। তিনি জালালউদ্দিনের মৃত্যুই কামনা করেছেন সবসময়। তাই নদীতে ভাসমান নাম না-জানা লাশটি যখন তার পায়ে ধাক্কা খায় এবং এর আকস্মিক ভয় ও আতঙ্কে যখন তিনি জ্ঞান হারান, তখনও হয়তো তিনি জালালউদ্দিনের মন্দিরের সেই ভয়াবহ স্মৃতি দ্বারাই আক্রান্ত হন। আর এই আক্রান্তকারীকে জালালউদ্দিনই ধরে নেন।


অতীতে ঘটা একটি নিপীড়নের
ফল আমাদের সামনে
রানুরূপে উপস্থিত
হয়

চলচ্চিত্র দেবী রানু এবং নিলুর যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়া এবং তা থেকে বেঁচে যাওয়ার গল্প। এই গল্পে রানু যে কিশোরী বয়সের যৌন নিপীড়নের ট্রমায় আক্রান্ত। তিনি গ্রামে নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন; সেই ট্রমার কারণেই হয়তো বিপদ আঁচ করতে পারেন সহজে। তাই রানু নিলুর কোনো এক অপরিচিত পুরুষের প্রেমে পড়ার তীব্রতায় আশঙ্কাবোধ করেন। অনুভব করে শহরের তরুণী নিলু বিপদে পড়তে যাচ্ছে। নিলুকে রক্ষার চেষ্টায় রানু মৃত্যুবরণ করেন। নিলু বেঁচে যান। তিনি বেঁচে ওঠেন রানুর স্মৃতি, অভিজ্ঞতাসহ। অতীতে ঘটা একটি নিপীড়নের ফল আমাদের সামনে রানুরূপে উপস্থিত হয়। আর নিলুরূপে বর্তমানের নিপীড়নের সাথে আমাদের পরিচয় ঘটায়। তাহলে অশরীরি দেবী কি নারী শক্তির প্রতীকরূপে দেবী চলচ্চিত্রে বা উপন্যাসে হাজির হয়? উপন্যাসের দেবী নামকরণের অন্তর্গত কারণ তবে কি নারী শক্তির উদ্বোধন?

দেবী
দেবী

চলচ্চিত্র ‘দেবী’ কোথায় ব্যর্থ হলো

চলচ্চিত্র দেখতে যাওয়ার কারণ কেবল উৎসাহ। কিন্তু চলচ্চিত্রটি নিয়ে লেখার কারণ কেবল উৎসাহ নয়। বরং চলচ্চিত্রটি দেখার পর যখন মূল উপন্যাসটি পড়লাম, তখন লিখবার ইচ্ছেটি প্রবল হলো।

কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ নিজেও একজন চলচ্চিত্রকার ছিলেন। উপন্যাসটিতে তিনি যেভাবে বর্ণনা করেছেন তা অনেক সিনেম্যাটিক বর্ণনা। নির্মাতা অনম বিশ্বাস উপন্যাসের প্রতি অনেকখানি নির্ভর করেছেন। তিনি চিঠিপত্রের সময়কালকে কেবল বর্তমানের মুঠোফোন ফেসবুকের কালে এনেছেন, তা-ই নয়; তিনি উপন্যাসের অনেক অংশকে বাদও দিয়েছেন। এটা ঠিকই আছে। সাহিত্য থেকে চলচ্চিত্রায়ন করতে গেলে এমন সংযোজন-বিয়োজন অপরিহার্যই বটে। এ কোনো দোষের কাজ নয়। কিন্তু যা কেবল দোষেরই নয়, বরং অনেক বড় অপরাধ– তা হলো, কোনো সাহিত্যের মৌলিক চিন্তার কাঠামোকে ভুল পথে পরিচালিত করা। আর চলচ্চিত্র দেবীকে এমন অপরাধে দুষ্ট কাজ বলেই বিবেচনা করছি।


যা
কেবল
দোষেরই
নয়, বরং অনেক
বড় অপরাধ– তা হলো,
কোনো সাহিত্যের মৌলিক চিন্তার
কাঠামোকে ভুল পথে পরিচালিত করা

কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের দেবী অনেক গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টি বলেই মনে হয়েছে। প্রথমেই বলেছি, উপন্যাসটি আগে পড়া ছিলনা। চলচ্চিত্র দেখার পর ঘটনাক্রমে পড়তে উৎসাহিত হয়েছি। উপন্যাস দেবীতে হুমায়ুন আহমেদ আজ থেকে বহুবছর আগে একজন গ্রামীণ সরল কিশোরীর যৌন নিপীড়নের মতো ভয়াবহ ঘটনাকে হাজির করেছিলেন রহস্য-উপন্যাসের বাতাবরণে। তিনি কেবল রহস্য সৃষ্টি করেই ছেড়ে দিতে পারতেন বিষয়টিকে। কিন্তু তিনি সেই রহস্যকে বিজ্ঞানের যৌক্তিক পরিণতি দিতে চাইলেন। সৃষ্টি করলেন মিসির আলী চরিত্র। একজন গ্রাম্যকিশোরীর পুরোনো ভাঙ্গা মন্দিরের ভেতরে দেবী প্রতিমার সামনে যৌন-নির্যাতনের মতো ভয়াবহ পরিস্থতিতে পড়া এবং সেই পরিস্থিতি থেকে ‘বেঁচে যাওয়া’ এবং পরবর্তীকালে লাশের সাথে ধাক্কা খাওয়ার মতো আতঙ্কে জ্ঞান হারানোর ঘটনার ট্রমায় সেই কিশোরীর মনে কোনো দৈবিক শক্তির চিন্তা দানা বাঁধাটা স্বাভাবিক। আর যেহেতু ঘটনাক্রমও এমন যে এটা মনে না হওয়ার কোনো কারণ নেই। যেহেতু মন্দিরের ঘটনার পরপরই দেবী প্রতিমা চুরি হয় এবং নিপীড়ক মৃত্যুর পূর্বে গ্রামের লোকজনকে বলে যে, দেবীমূর্তি রানুর শরীরে প্রবেশ করে রানুকে পিশাচিনী বানিয়ে ফেলেছে এবং সেই ভয়ে, আতঙ্কে তার মৃত্যু হয়।

তাই সেই ঘটনার পরম্পরায় কিশোরী রানুর মনে এমন বোধ দানা বাঁধার যথেষ্ট সময় ও পরিবেশ তৈরি থাকায় পরবর্তীকালে পরিস্থিতি ভৌতিক আকার ধারণ করেছে। এই ভৌতিক পরিবেশকে হুমায়ুন আহমেদ শেষ পর্যন্ত যুক্তি দিয়ে মোকাবেলা করতে চেষ্টা করেছেন। সে কারণেই তিনি মিসির আলীকে সৃষ্টি করেছেন। এই উপন্যাস অবশ্যই রহস্য-উপন্যাস। তবে সেই রহস্যকে অনেক দরদ দিয়ে, যুক্তি দিয়ে মোকাবেলার কথা বলেছেন হুমায়ুন। তিনি একজন নারীর যৌন নিপীড়নের মতো পরিস্থিতিতে পড়ার ফল কি হতে পারে– তার একটি যুক্তিনির্ভর পরিবেশ তৈরি করেছেন। এখানে নারীর মনে নিপীড়নের প্রভাব কেমন ভয়াবহ হতে পারে, সেই ব্যাখ্যার দিকে হুমায়ুন যাত্রা করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি রহস্যকে ব্যক্তিমনের ট্রমারূপে বিশ্লেষণ করেন। আর যতটুকু অব্যাখ্যায় উপাদান থাকে, তা নিয়েও চিন্তা করতে অগ্রসর হন। তবুও অন্ধবোধ বা বিশ্বাসের ফাঁদে পা দেন না। অন্তত মিসির আলীর চরিত্র আমাদের সেই ব্যাখ্যাই দেয়। কিন্তু অনম বিশ্বাসের চলচ্চিত্র দেবী শেষ পর্যন্ত আর মনস্তাত্ত্বিক থ্রিলার থাকেনি। এটি হয়ে উঠেছে আমাদের অতিপরিচিত ভৌতিক চলচ্চিত্র।


এই চলচ্চিত্র
হুমায়ুন আহমেদের
যুক্তির দুনিয়া থেকে
পা বাড়ায় অন্ধবিশ্বাসের দুনিয়ায়

চলচ্চিত্রজুড়ে অশরীরি ছায়ার দিনে-রাতে বিচরণ। কেবল রানু নয়, এই অশরীরি দুই কিশোরীকে জিতু মিয়াও দেখতে পায়। কেবল যদি রানু এদের দেখতে এবং শুনতে পেত, তবে এটি হতো রানুর অসুখ। কিন্তু যখন জিতু মিয়াও দেখে দুই ‘ভূত’ কিশোরীকে, তখন এই চলচ্চিত্র হুমায়ুন আহমেদের যুক্তির দুনিয়া থেকে পা বাড়ায় অন্ধবিশ্বাসের দুনিয়ায়।

হুমায়ুন আহমেদ দেবী উপন্যাসে একজন অশরীরি কিশোরীর নুপুরের আওয়াজ আর খিলখিল হাসিতে সাইকোপ্যাথ আনিস সাবেতকে আতঙ্কগ্রস্ত করিয়ে মেরে ফেলেন; কিন্তু নির্মাতা অনম বিশ্বাস ভিলেনকে হত্যা করতে লোহার শত সূচালু খণ্ড হলিউডের ম্যাট্রিক্স সিনেমার বুলেট বাতাসে ভাসিয়ে রাখার সিকোয়েন্সের মতো বাতাসে ভাসিয়ে রেখে একটা ফ্রিজশট আমাদের উপহার দেন। ‘মহামূল্যবান’ সেই ফ্রিজশটের পর লোহার খণ্ডগুলো ভিলেনের শরীরে বিদ্ধ হয়ে ভিলেনের ভবলীলা সাঙ্গ হয়। সাথে চলচ্চিত্রটিও মননের প্রশ্নে মৃত্যুবরণ করে।

এই অদ্ভুত, ভূতুড়ে কাণ্ডখানা না করলে কি দর্শকের বিনোদন কমে যেত? অথচ এই কাণ্ডখানা করে এই চলচ্চিত্র হুমায়ুন আহমেদের দৃষ্টির জিনিয়াসনেস থেকে পতিত হয়ে একটা সস্তা ভূতবিষয়ক সিনেমায় পরিণত হয়েছে। এই চলচ্চিত্রের সাথে বীণ বাজিয়ে সাপ আনিয়ে রাজপুত্রের শরীর থেকে সাপের বীষ দূর করার অলৌকিক কর্মের শত শত বস্তাপচা গালগপ্পের চলচ্চিত্রের পার্থক্য কী রইল!

যে কোনো মহৎ চলচ্চিত্রের একটি সামগ্রিক কাঠামো থাকে। সেই কাঠামো কেবল তারাই রচনা করতে পারেন যাদের তেমন মননগত শুদ্ধতা এবং দেখবার মতো চোখ থাকে। দুঃখজনক হলো, এই সক্ষমতা অনেক দুষ্প্রাপ্য!

দেবী

এই চলচ্চিত্রকে কেন সরকারি অনুদান প্রদান করা হলো

এমন একটি ভৌতিক কাহিনীপ্রবণ চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যকে কেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আর্থিক অনুদান প্রদান করা হলো? যারা চিত্রনাট্য পড়েছিলেন তারা কি এই বিষয়টি লক্ষ্য করেননি যে এই চিত্রনাট্যটি শেষ পর্যন্ত একটি অন্ধবিশ্বাসকে অনুসরণ করছে? নাকি চিত্রনাট্যটি প্রথমে উপন্যাস অনুরাগী ছিল, পরে নির্মাণকালে ছবিটির চিত্রনাট্য পরিবর্তন করা হয়েছে?

যদি নির্মাণকালেও অনুদানপ্রাপ্ত চিত্রনাট্যের পরিবর্তন হয়ে থাকে, তবে তো তা নিরীক্ষা করবার সুযোগ ছিল। সেন্সরবোর্ড কি কেবল স্বাধীন-ভিন্নধারার চলচ্চিত্র আটকানোর আখড়া? বলছি না চলচ্চিত্র দেবীকে আটকানো উচিত ছিল। বলছি, এই চলচ্চিত্রটি জনগণের অর্থে নির্মিত হবার যোগ্য নয়। এই দিকটিতে সংশ্লিষ্ট লোকজন সচেতন না থেকে নিজেদের কতর্ব্য কাজে অবহেলা এবং কাণ্ডজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছেন।

বাংলাদেশের মানুষ বড্ড বিস্মৃতিপ্রবণ। কি কারণে চলচ্চিত্রে অনুদান প্রথার দাবি করা হয়েছিল এবং কি কারণে এই অনুদান প্রথা শুরু হয়েছিল– তা এখন প্রায় সবাই ভুলতে বসেছেন। চলচ্চিত্রে অনুদান প্রদানের ব্যবস্থা এখন অনেক বেশি ভুল পথে যাচ্ছে।

অনেকে অনুদান পান, কিন্তু চলচ্চিত্র নির্মাণ শেষ করেন না। অনেকে অনুদান পাবার পর দায়সারাভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। আর অনেক জেষ্ঠ্য মানুষ অনুদানের জন্য বারবার আবেদন করে জাতির লজ্জার কারণ হন। নিরীক্ষাপ্রবণ তরুণ চলচ্চিত্রকারদের অনুদান পাবার এবং অনুদান দেয়ার প্রয়োজন। তা না করে রাজনৈতিক বিবেচনায়, মুখ চেনা বিশিষ্ট মানুষের প্রতাপে অথবা প্রবল লবিংয়ের গুণে এমনসব লোকজন প্রতিবছর অনুদান পাচ্ছেন আর এমনসব চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন তাতে সেদিন খুব দূরে নয়, যেদিন আমরাই দাবি তুলব পাবলিকের টাকার এই শ্রাদ্ধানুষ্ঠান বন্ধ করুন।


বিএফডিসির মতো একটি
শ্বেতহস্তি পোষা হবে
বিনোদনের মৌতাত
দেওয়ার জন্য, আবার
চলচ্চিত্রের অনুদানও
সেই মৌতাতে শামিল
হবে– এমনটা আমরা প্রত্যাশা করি না

গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে শুদ্ধ চলচ্চিত্রের জন্য পাবলিকের টাকার এই অনুদান প্রথার দাবি করা হয়েছিল। যদি বিনোদনের পসরা সাজানো অনুদান প্রদানের উদ্দেশ্য হতো, তবে বিএফডিসি বন্ধ করে বছরে কেবলমাত্র ৫/৬টি অনুদানই প্রদান করা হলেই হয়। বিএফডিসির মতো একটি শ্বেতহস্তি পোষা হবে বিনোদনের মৌতাত দেওয়ার জন্য, আবার চলচ্চিত্রের অনুদানও সেই মৌতাতে শামিল হবে– এমনটা আমরা প্রত্যাশা করি না। নিজেদের এবং জনগণের বিনোদনের জন্য যেকোনো একটি রাখুন। আর অন্যটিকে মানুষের জন্য মননের মধু এবং শৈল্পিক শুদ্ধতার আবাদ করতে ছেড়ে দিন। না হলে এভাবেই সবসময় শিব গড়তে বাঁদর গড়ে তুলবেন!

Print Friendly, PDF & Email
লেখক; চলচ্চিত্র নির্মাতা; চলচ্চিত্র সংগঠক। ঢাকা, বাংলাদেশ। সাধারণ সম্পাদক, ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশ। সভাপতি, ম্যুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটি। নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র : অনিবার্য [ পোশাক শ্রমিক আন্দোলন; ২০১১]; পথিকৃৎ [চলচ্চিত্রকার বাদল রহমানের জীবন ও কর্মভিত্তিক; ২০১২ (যৌথ নির্মাণ)]; সময়ের মুখ [জাতীয় অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলামের জীবন অবলম্বনে; ২০১৮]। সম্পাদিত ফিল্ম-ম্যাগাজিন : ম্যুভিয়ানা; চিত্ররূপ। সিনে-গ্রান্থ : চলচ্চিত্রপাঠ [সম্পাদনা]; চলচ্চিত্রের সাথে বোঝাপড়া; স্বাধীন চলচ্চিত্র আন্দোলনের ইশতেহার : বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ; চলচ্চিত্রকথা [তারেক মাসুদের বক্তৃতা ও সাক্ষাৎকার; সম্পাদনা]। পরিকল্পক ও উৎসব পরিচালক : নতুন চলচ্চিত্র নতুন নির্মাতা চলচ্চিত্র উৎসব

১টি কমেন্ট

  1. লেখাটা ভাল লেগেছে। লেখার শেষাংশই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। জনগণের টাকার শ্রাদ্ধ আর কতদিন চলবে?

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here