ফিল্মমেকারের স্মৃতিতে ফিল্মমেকার অথবা আমার ফাসবিন্ডার: মার্গারিটা ফন ট্রোটা

304

মূল । মার্গারিটা ফন ট্রোটা
অনুবাদ । রুদ্র আরিফ

রাইনার ভের্নার ফাসবিন্ডার [৩১ মে ১৯৪৫–১০ জুন ১৯৮২]। জার্মান মাস্টার ফিল্মমেকার। আরও পরিচয়– অভিনেতা, নাট্যকার, থিয়েটার ডিরেক্টর, কম্পোজার, সিনেমাটোগ্রাফার, ফিল্ম এডিটর, প্রাবন্ধিক। ‘নিউ জার্মান সিনেমা‘ সিনে-আন্দোলনের অন্যতম অগ্রসেনা। ‘লাভ ইজ কোল্ডার দ্যান ডেথ’, ‘কাৎসেমাখার’, ‘গডস অব দ্য প্লেগ’, ‘বিওয়্যার অব অ্যা হলি হোর’, ‘এইট আওয়ারস ডোন্ট মেক অ্যা ডে’, ‘ইন অ্যা ইয়ার অব থার্টিন মুনস’, ‘দ্য ম্যারিজ অব মারিয়া ব্রাউন’, ‘লোলা’ প্রভৃতি সিনেমার এই নির্মাতা আজন্ম অ্যানার্কিস্ট হিসেবে খ্যাত। তাকে স্মরণ করেছেন তারই সতীর্থ, ‘নিউ জার্মান সিনেমা’র অন্যতম ‘লিডিং ফোর্স’ হিসেবে খ্যাত ফিল্মমেকার ও অভিনেত্রী মার্গারিটা ফন ট্রোটা [২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৪২–]। জুলিয়ান লরেঞ্জ সম্পাদিত কেওয়াজ অ্যাজইউজুয়াল : কনভারসেশনস অ্যাবাউট রাইনার ভের্নার ফাসবিন্ডার বইয়ে সাক্ষাৎকার হিসেবে ছাপা হওয়া সেই স্মৃতিকথা এখানে গদ্য আকারে হাজির করা হলো..


রাইনার ভের্নার ফাসবিন্ডার
রাইনার ভের্নার ফাসবিন্ডার

বাল [১৯৭০] সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্রে রাইনারকে অভিনয় করাতে চেয়েছিলেন, [রাইনার করেওছিলেন] ফিল্মমেকার ফয়কা শ্লানডর্ফ [১৯৩৯–]। [আমি সেই ছবিতে কেন্দ্রীয় নারী চরিত্রে (সোফি) অভিনয় করেছি।] ফয়কার মাধ্যমে সেখানেই রাইনারের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। [বলা হয়ে থাকে, এই সিনেমার আগে ফয়কারের দুটি শর্টফিল্মে অভিনয় করেছিলেন রাইনার, এবং বাল-এর নামভূমিকায় অভিনয়ের জন্য ফিল্মমেকারের কাছে মিনতি করেছিলেন।] আমি যতদূর জানি, এ কথা সত্য নয়। বাভারিয়ায়, কামার্সপিলা থিয়েটার ওয়ার্কশপে আমি আর ফয়কার অ্যানার্কি [নাটক] দেখেছিলাম। এর আগেই লাভ ইজ কোল্ডার দ্যান ডেথ দেখেছি আমরা, যেটি আমাদের মনে, বিশেষত রাইনারের অভিনয়ের কারণে গভীর ছাপ ফেলেছিল। যখন আমরা ওর সঙ্গে দেখা করলাম, তখন ‘বাল’ চরিত্রটিতে ওকে অভিনয় করানোই যে আমাদের উদ্দেশ্য ছিল– এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। [চরিত্রটির জন্য] অন্য কারও কথা ফয়কা কখনোই কল্পনাও করেননি। মানুষ সম্পর্কে দারুণ আন্দাজশক্তি ছিল তার, এবং মুহূর্তেই ফাসবিন্ডারের সম্ভাবনাময়তাকে সণাক্ত করতে পেরেছিলেন। রাইনার মোটেও চরিত্রটি করার ব্যাপারে ফয়কার কাছে মিনতি করেননি। বরং নিজের অ্যান্টিথিয়েটার বন্ধুদের মধ্যে যত বেশি সম্ভব চরিত্রকে হাজির করার প্রচেষ্টা তার মধ্যে ছিল।

পাঁচ-ছয় জন অ্যান্টিথিয়েটার লোককে যুক্ত করতে রাজি হয়েছিলেন ফলকা। এদের মধ্যে ছিলেন হানা শিগুলা কুর্ট রাব, ইর্ম হেরমান এবং রুডলফ্ ভালডেমার ব্রেম।

রাইনার ভের্নার ফাসবিন্ডার
বাল
ফিল্মমেকার । ফয়কা শ্লানডর্ফ
অ্যাকট্রেস-অ্যাকটর । মার্গারিটা ফন ট্রোটা, রাইনার ভের্নার ফাসবিন্ডার

[রাইনারকে প্রথম দেখার স্মৃতিটি এখনো মনে আছে।] একটা টেবিলে বসে ছিলেন তিনি। মুখে একটা শব্দও উচ্চারণ করেননি ঠিকই, তবে ভেতরে যে এক দুর্নিবার আলোড়ন চলছে– সেটা অনুভব করতে পেরেছিলাম। বাল-এর শুটিংয়ের সময় তার অশেষ কর্ম-সামর্থ্য দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গেছি। একইসঙ্গে কত কি যে করতে পারতেন তিনি! জানেনই তো, বাল চরিত্রটি একটি মনুমেন্টাল টেক্সট জাহির করা এক অ্যাবসুলট লিডিং ক্যারেক্টার। এই টেক্সটটি মোটেও সাধারণ কিছু নয়। প্রতিটি পঙক্তি অবশ্যই মুখস্থ রাখতে হয়েছে। তিনি কখনোই ছোটখাট একটা ভুল-ভ্রান্তিও করেননি।

তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ মাপের সুশৃঙ্খল অভিনেতা, যিনি রাতের বেলা নিজের [পরিচালিত] সিনেমা কাৎসেমাখার-এর এডিটিং করতেন, এবং রেডিওর জন্য একটা নাটকও লিখতেন। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আমাদের শুটিংয়ের দিনগুলোতে তিনি এসব কাজও করতেন।


এ রকম
মানুষ তো
আসলেই আছেন,
যারা বুদ্ধিবৃত্তিক কিংবা
শিল্পগত বন্ধাত্বে পর্যবসিত
হয়ে ওঠা ছাড়াই মুক্তভাবে,
অনেকটাই ঘোরগ্রস্তের মতো,
নিজেদের যৌনতার রাশ টানতে পারেন

আমরা যখন সোরেন্তোতে [ইতালি] বিওয়্যার অব অ্যা হলি হোর-এর শুটিং করছিলাম, তখন তিনি তিন থেকে চার ঘণ্টা ঘুমোতেন। ঠিক যেন পাসোলিনির মতোই। এ রকম মানুষ তো আসলেই আছেন, যারা বুদ্ধিবৃত্তিক কিংবা শিল্পগত বন্ধাত্বে পর্যবসিত হয়ে ওঠা ছাড়াই মুক্তভাবে, অনেকটাই ঘোরগ্রস্তের মতো, নিজেদের যৌনতার রাশ টানতে পারেন। নিজেদের এই অপরিমিতি থেকে তারা সবিশেষ আধ্যাত্মিক ও সৃজনশীল শক্তি আরোহণ করতে পারেন। পাসোলিনি বদ্ধ-উন্মাদের মতো সারাদিন লিখতেন আর শুটিং করতেন; আর রাতের বেলা ছুটে যেতেন পুরুষসঙ্গীদের কাছে। মাঝে মধ্যে অবাক হয়ে ভাবি, এই মানুষগুলো যদি জানতেন তাদের জীবন খুবই ছোট হবে, তাহলে হয়তো তাদের হাতে থাকা মোমবাতিগুলোকে দুদিক থেকেই জ্বালাতে বাধ্য হতেন, প্রতিটি মুহূর্তেটিতে উন্মাদগ্রস্তভাবে বাঁচার জন্য।

রাইনার ভের্নার ফাসবিন্ডার
বিওয়্যার অব অ্যা হলি হোর
ফিল্মমেকার । রাইনার ভের্নার ফাসবিন্ডার
অ্যাকট্রেস-অ্যাকটর । মার্গারিটা ফন ট্রোটা, রাইনার ভের্নার ফাসবিন্ডার

[ফিল্মমেকার হিসেবে ফয়কা ও রাইনারের মধ্যে কোনো মিল নেই।] সিনেমার শুটিংয়ের শুরু থেকে ধরে, চরম খরুচে অবস্থায় শুটিং করা হয়ে, ক্যামেরায় কাটিংয়ের প্রত্যেকটি কাট পর্যন্ত আদ্যোপান্ত নিজের মাথায় বয়ে বেড়ানো ফাসবিন্ডারের তুলনায় ফয়কা একেবারেই উল্টো। নিজের উপর ফয়কার সবসময়ই দ্বিধা ছিল। এটি তার একটি বেসিক বৈশিষ্ট্য। যখনই তিনি কোনো একটি সেটআপে শুট করেন, সবসময়ই ইতস্তত থাকেন– সেটআপটি ঠিক হলো কি না; ফলে পুরো বিষয়টিকে তিনি রিভার্স করে দেন, আর শুট শুরু করেন অপজিট অ্যাঙ্গেল থেকে; আবার সেটিকেও খুব সহসাই করেন বর্জন!

[১৯৬৯ সালে, জার্মান সিনেমায় ফয়কা ছিলেন অবিসংবাদিত তারকা।] রাইনার আমাকে বলেছেন, অ্যা ডিগ্রি অব মার্ডার সিনেমাটি তিনি অন্তত দশ বার দেখেছেন। আর সম্ভবত এ কারণেই ফয়কার সঙ্গে কাজ করতে কখনোই ইতস্তত করেননি তিনি।

[তবে ফয়কার কারণেই আমি অভিনেত্রী হয়ে উঠেছি, এই ধারণাও ঠিক নয়।] রাইনারের মতোই আমাকেও তিনি একটা সিনেমায় দেখেছিলেন; আর তাই আমাকে বাল-এ অভিনয়ের প্রস্তাব দেন। শ্লানডর্ফের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হওয়ার মাত্র দুই মাস পর রাইনারের সঙ্গে দেখা হয়। আসলে আমি সবসময় ফিল্মমেকার হতেই চেয়েছি। ফিল্মমেকারদের প্রতি আগ্রহের জায়গা থেকেই তাদের সিনেমাগুলোতে ছোটখাট ভূমিকায় অভিনয় করতে রাজি হয়েছি। আমি দেখতে চেয়েছিলাম, কীভাবে তারা কাজ করেন। তাদের কাছ থেকে কিছু শেখার উদ্দেশ্য ছিল আমার। রাইনারের কাছ থেকে শেখার ছিল অনেক কিছুই; যেমন ধরুন, যেভাবে তিনি একেকটি জিনিসের নির্যাসের উপর ফোকাস করেন। তার মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিতে পারার নিশ্চিত সহজাত ক্ষমতাটি কিন্তু শেখার ফল নয়, বরং অনুমানের; সেটির প্রভাব আমরা দেখতে পাই একটি দীর্ঘ ও সিঙ্গেল সেটআপের গতিপথের ভেতর তার কোরিওগ্রাফিতে।

[কথিত আছে, জন্মগত মেধাবী লোকদেরকে সর্বোচ্চ অবস্থায় পৌঁছানোর মতো ব্যবহৃত হওয়া থেকে নিবৃত্ত করতেন রাইনার।] আমি বলব, যে লোকেদের তিনি সাপোর্ট করেছেন, তার চাওয়ামতো ডেলিভারি দিতে পারছে না তারা– এমন পরিস্থিতিতে রাইনারকে অহর্নিশ পড়তে হতো। মিশায়েল ফেঙ্গলার, ক্রিস্টিয়ান হোহফ, উলি লামেল প্রমুখের মতো সহযোগীদের সক্ষমতার উপর তিনি আস্থা রাখতেন, এবং এদেরকে নিজেদের সিনেমা বানাতেও সাহায্য করেছেন। তিনি কোনো প্রমাণ চাইতেন না, বরং স্রেফ বলতেন, ‘এগিয়ে যাও।’ এটি অনভ্যস্ত ব্যাপার; সাধারণত, এটি আমাদের সমাজের ঠিক উল্টোচিত্র।


রাইনারের মতো ঐকান্তিকতা
ও শৃঙ্খলা অন্য কারও
মধ্যে দেখিনি
আমি

নিজের ওপর ও নিজের স্বপ্নের উপর পুরোপুরি আস্থা ছিল তার। এ কারণেই নিজের স্বপ্নকে সত্য করতে পেরেছেন। এ কারণেই অন্যদের উপরও আস্থা রাখতেন, এবং অন্যদেরকে তাদের নিজ নিজ স্বপ্ন পূরণে সাহায্য করতেন। [মহাকবি] গোয়্যেটের একটা উদ্ধৃতি আওড়িয়ে নিজেকে অহর্নিশ আমি ভরসা দিই : ‘ইচ্ছেগুলোই সক্ষমতার পূর্বাভাষ।’ ফাসবিন্ডার তার সহযোগীদের অনেকের মধ্যেই এইসব সক্ষমতার গুণটিকে ছড়িয়ে দিয়েছেন, এবং তাদেরকে আত্মউপলব্ধি করতে সাহায্য করেছেন; যদিও কখনো কখনো তিনি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন– এটিকে সত্য করে তুলতে যে শক্তিটি তৈরি করার প্রয়োজন ছিল– সেটি তার স্বপ্নের মতো শক্তিধর হয়ে উঠেনি, কিংবা স্বপ্নটির প্রতি যথেষ্ট অনুগামী হয়নি। রাইনারের মতো ঐকান্তিকতা ও শৃঙ্খলা অন্য কারও মধ্যে দেখিনি আমি।

ওর পরিচালনায় প্রথম যে সিনেমাটিতে আমি অভিনয় করেছি, সেই গডস অব দ্য প্লেগ-এর শেষ দিকে তিনি ডিরেকশনের ভার ফেঙ্গলারের উপর ছেড়ে দিয়েছিলেন। এ ছিল খানিকটা দ্বিধাগ্রস্ততার চেয়েও বেশি কিছু। ফাসবিন্ডারের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলাম আমরা; এই দুজন মানুষের মধ্যে মেধা ও কল্পনাশক্তির প্রশ্নে ফারাক ছিল ব্যাপক। ফলে রাইনার যখন কাছেধারে থাকতেন না, তখন নিজেদের [অভিনেতা-অভিনেত্রী] পরিত্যক্ত মনে হতো আমার। তিনি দূরে থাকলে প্রেরণা জোগানোর মতো কিছুই আর থাকত না সেটে।

 রাইনার ভের্নার ফাসবিন্ডার
বিওয়্যার অব অ্যা হলি হোর
ফিল্মমেকার । রাইনার ভের্নার ফাসবিন্ডার

[ডায়নামিক গ্রুপ হিসেবে পরিচিত তার গ্রুপটির কথা যদি বলি,] রাইনারের সঙ্গে বেশিরভাগ লোকেরই ছিল ভীষণ অস্থির ও আবেগী সম্পর্ক। সোজাসাপ্টাই বলছি, যেহেতু সেই গ্রুপটির অংশ ছিলাম না, ফলে আমি সম্ভবই তুলনামূলক একটু বেশিই স্বাধীন ছিলাম। রাইনার না থাকলে গ্রুপটি কোথায় যে হারিয়ে যেত! ওর শক্তি ও ওর কল্পনাশক্তির উপর লোকেরা নির্ভর করত ঠিকই, তবে ওরও তাদেরকে দরকার ছিলই। ওরা না থাকলে, নিজের নিসঙ্গতার কাছে খাবি খেতে হতো তাকে, এবং সেটি তার জন্য বেশ কঠিনই হতো।


লোকেরা যতই ওর উপর
নির্ভর করত, তিনি
ততই খারাপ
আচরণ
করতেন তাদের সঙ্গে

রাইনার যথেষ্ট নিন্দনীয়ও ছিলেন। লোকেরা যতই ওর উপর নির্ভর করত, তিনি ততই খারাপ আচরণ করতেন তাদের সঙ্গে। তাদের এই নির্ভরশীলতা তার হয়তো দরকার ছিল, কিন্তু সেজন্য তিনি ওদের অবজ্ঞাও করতেন। আমার কিংবা হানার সঙ্গে কিন্তু তিনি ও-রকম করতেন না। হানা কখনোই নিজেকে সম্পূর্ণ গ্রুপভুক্ত করতে দেননি। আমি আর তিনিই একমাত্র সেই মানুষ– যাদের সঙ্গে শ্রদ্ধা বজায় রেখে আচরণ করতেন রাইনার; কারণ তিনি জানতেন, যদি একটাও নোংরা ফাঁটল ধরে, তাহলে আমরা দরজার বাইরে চলে যাব। ভীষণ তীক্ষ্ণ অনুমানশক্তি ছিল তার। কোন লোকের সঙ্গে ঠিক কতটুকু আগাবেন, তা গভীরভাবেই জানতেন; যদিও যে মানুষগুলো তার উপর নির্ভর করত, তাদের প্রতি সবিশেষ মুগ্ধ থাকতেন, এবং তাদের উপরই নিজের খেয়ালী বদমেজাজ দেখাতেন। তার সিনেমাগুলো ছিল ‘ভালোবাসার ভেতর দিয়ে অবজ্ঞা’ ফুটিয়ে তোলা বিষয়ক। এই মাকড়সার জালের খেলা, ক্ষমতা ও অসহায়ত্বের এই মহোত্তম খেলার আতঙ্ক বরং আমাকে ঘিরে ধরত। আমি মনে করি, আমার কখনোই গ্রুপটির অংশ হতে না চাওয়ার এটি একটি কারণ।

স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে, শুটিং শুরু হওয়ামাত্রই, একটি দলবদ্ধতা, একটি সবিশেষ দলীয় আচার-আচরণ শুরু হয়ে যায়। দিনটি ফুরোলে আপনি বাড়ি ফিরতে চাইবেন না কিংবা দেখা করতে চাইবেন না এমন কারও সঙ্গে– যার এই সিনেমাটির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। তবু, প্রত্যেক মানুষেরই রয়েছে আলাদা ব্যাকগ্রাউন্ড ও নিজের একটা জীবন। রাইনারের প্রথমদিকের সিনেমাগুলোর বেলায়, কাজের শেষে গ্রুপটিও একসঙ্গেই থাকত। তাদের মধ্যে এমন বহু কিছুই চলত, যেগুলো ঘটত কেবলই অগভীর ও বিক্ষিপ্তভাবে, যেগুলোর প্রকাশ বলতে গেলে হতোই না। তবে এরমধ্যে ঠিক যেন কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো ধুকপুকানির একটা ব্যাপার বরাবরই ছিল। কখনো কখনো চাপা উত্তেজনা এতই প্রবল হয়ে উঠত, রাইনারের পক্ষেও সামলানো মুশকিল হতো তখন। নিজেকে নিরাপদ রাখা ও নিজ মেধাকে সুরক্ষিত রাখার অবস্থা থেকে সরে গিয়েছিলেন তিনি। এ রকম একজন অতিমাত্রায় মেধাবী মানুষের উপস্থিতিতে নিজেকে অবিরাম নিযুক্ত রাখা সবসময় সহজ ছিল না। নিজ গ্রুপের লোকেরা তার গুণকীর্তন করত ঠিকই, কিন্তু একই সঙ্গে তারা ওকে ক্রুদ্ধও করত; কেননা, তাদের নিজস্ব হীনমন্যতা কিংবা সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে তাদেরকে তিনি সচেতন করেছিলেন। এটা তার দোষ ছিল না; তবু নিজেদের সীমাবদ্ধতার জন্য তারা ওকেই দোষারোপ করতেন, যেন তিনিই সেই প্রভু– যিনি ওদেরকে অসাধারণ কোনো উপহার দিতে অস্বীকার করেছেন।

মার্গারিটা ফন ট্রোটা, ফলকা শ্লানডর্ফ
ফিল্মমেকার দম্পতি

আমার নিজের জীবনেও এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে। তখনকার দিনে শ্লানডর্ফের স্ত্রী নয়, বরং অভিনেত্রী হিসেবে আমার পরিচয় ছিল; আমি ছিলাম তারই ‘একটা অংশ’। ফাসবিন্ডার আর [হারবার্ট] আখটার্নবুশ ছাড়া খুব কম মানুষই, ফয়কার মধ্যস্থতা ছাড়া আমার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করার সাহস দেখিয়েছেন। তারা নিশ্চয়ই ভাবতেন, আমার পেছন থেকে তাদের উপর নজর রাখছে শ্লানডর্ফের চোখগুলো। আমি নিশ্চিত, ফাসবিন্ডারকে ঘিরেও একই আতঙ্ক স্পষ্ট ছিল : ফাসবিন্ডার নজর রাখছেন; তিনি একজন জিনিয়াস; নিজেকে যতটা দক্ষ ভাবি হয়তো আমি ততটা নই, এবং নিজেকে আমার ওর পরীক্ষার সামনে না ফেলাই বোধহয় ভালো।

[আমি একেবারেই রাজনৈতিক সিনেমাগুলো বানিয়েছি। প্রশ্ন উঠতে পারে, রাইনার তার সিনেমাগুলোতে কী করে রাজনীতির ভাষান্তর করতেন?] একটি ব্যক্তিগত সাক্ষ্য কী করে একটি রাজনৈতিক বিবৃতিতে ভাষান্তরিত হতে পারে, সেটির সবচেয়ে সফল উদাহরণ– জার্মান ইন অটাম-এর [নন-ফিকশনাল ডকুমেন্টারি] রাইনারের এপিসোডটি। যে ঘটনা আমাদের সবারই জানা, ১৯৭৭ সালে আমাদের শ্বাসরুদ্ধকর আতঙ্কের মধ্যে ঠেলে দিয়েছিল যে ঘটনা, অর্থাৎ বেছে বেছে বামপন্থী ভাবাপন্নদের নিধন করা– সেই আবহমণ্ডলের বর্ণনা তিনি দিয়েছিলেন; আর সেটি যতটা না একটি ডকুমেন্টারি, তারচেয়ে বেশি তার নিজের আতঙ্কের একটি ডকুমেন্টেশন হয়ে উঠেছে। এটি সত্যিকারঅর্থেই সবাইকে বেশ নাড়া দিয়েছে। নিজের আতঙ্ককে প্রকাশ করতে তিনি ভয় পাননি।


একবার
যদিও তিনি
আমাকে ‘প্রস্তাব’
দিয়েছিলেন; তবু
আমার বিশ্বাস, তিনি
জানতেন প্রস্তাবটি নিরাপদেই
দিতে পারবেন; কেননা
আমি তাকে এ
বিষয়টি আগ
বাড়াতে
দেব
না

[বলা হয়ে থাকে, জার্মান সরকার হয়তো মোগাদিশু যুদ্ধের প্রতিশোধ নিতে শুরু করবে– এ সময়ে তার কেবল এই ভয়টিই কেবল ছিল না, বরং ব্যক্তিগত সম্পর্ক ভেঙে পড়ার ভয়েও তিনি আতঙ্কগ্রস্ত ছিলেন। ফলে তিনি নিজের এই উভয়ভীতিকে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন। যখন তার সঙ্গে পরিচয়, তখন কি রাইনারকে ব্যক্তিগত, বিশেষত নারীদের সঙ্গে সম্পর্কগুলো বজায় রাখতে অক্ষম দেখেছি?] না, বিষয়টিকে আমি এভাবে দেখিনি কখনোই। একবার যদিও তিনি আমাকে ‘প্রস্তাব’ দিয়েছিলেন; তবু আমার বিশ্বাস, তিনি জানতেন প্রস্তাবটি নিরাপদেই দিতে পারবেন; কেননা আমি তাকে এ বিষয়টি আগ বাড়াতে দেব না। যে নারীরা তার সঙ্গে লেগে ছিল, তাদের উপর চড়ে বসার প্রয়োজনটা নিশ্চিতভাবে তার ছিলই।

[একবার কাগজে আলাদা করে চিরকুট লিখে রেখেছিলেন রাইনার– ‘যখন ভালোবাসবে, তখন ক্রুসবিদ্ধ হয়ে যাবে তুমি।’ ইন অ্যা ইয়ার উইথ থার্টিন মুনস-এ সোল-ফ্রিয়েদা চরিত্রটিকে দিয়ে এক দৃশ্যে এই উদ্ধৃতিটি তিনি করিয়েছিলেন।] মানুষ সবসময়ই যে রকম ভালোবাসার স্বপ্ন দেখে, সেই মুক্ত ও স্বাধীন ভালোবাসার হয়তো আসলে কোনো অস্তিত্ব নয়।

[আমি কি পারি ভালোবাসা ছাড়া কাজ করতে?] মোটেও না। তবু ভালোবাসায় জয়ী হবার চেষ্টা করে মানুষ– দুজনই, যে যার তরিকায়। যে মানুষদের সঙ্গে আমি কাজ করি, তাদের একজনকে অন্যজনের বিপরীতে অভিনয় করিয়ে নয়, বরং তাদেরকে একসঙ্গে থাকার ও একসঙ্গে কাজ করার মতো সক্ষম করে তোলার প্রচেষ্টার ভেতর দিয়ে, তাদের ভালোবাসা পাবারও চেষ্টা করি আমি

Print Friendly, PDF & Email
সম্পাদক: ফিল্মফ্রি । ঢাকা, বাংলাদেশ।। সিনেমার বই [সম্পাদনা/অনুবাদ]: ফিল্মমেকারের ভাষা [৪ খণ্ড: ইরান, লাতিন, আফ্রিকা, কোরিয়া]; ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো: প্রেম ও দেহগ্রস্ত ফিল্মমেকার; তারকোভস্কির ডায়েরি; স্মৃতির তারকোভস্কি; হিচকক-ত্রুফো কথোপকথন; কুরোসাওয়ার আত্মজীবনী; আন্তোনিওনির সিনে-জগত; কিয়ারোস্তামির সিনে-রাস্তা; সিনেঅলা [৪ খণ্ড]; বার্গম্যান/বারিমন; ডেভিড লিঞ্চের নোটবুক; ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার চান্তাল আকেরমান; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার বেলা তার; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার নুরি বিলগে জিলান; ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; বেলা তার; সের্গেই পারাজানোভ; ভেরা খিতিলোভা; সিনেমা সন্তরণ ।। কবিতার বই: ওপেন এয়ার কনসার্টের কবিতা; র‍্যাম্পমডেলের বাথটাবে অন্ধ কচ্ছপ; হাড়ের গ্যারেজ; মেনিকিনের লাল ইতিহাস ।। মিউজিকের বই [অনুবাদ]: আমার জন লেনন [মূল : সিনথিয়া লেনন]; আমার বব মার্লি [মূল: রিটা মার্লি] ।। সম্পাদিত অনলাইন রক মিউজিক জার্নাল: লালগান

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here