গোদার ও তার চার আদি শর্টফিল্ম

426

গ্রন্থনা ও অনুবাদ । রুদ্র আরিফ

‘নিউ ওয়েভ’ বিপ্লবযুগের আবির্ভাব ঘটানোর আগে, গোটা পাঁচেক শর্টফিল্ম বানিয়ে নিজেকে ঝালাই করেছিলেন মহান গোদার। এরমধ্যে একটা বানিয়েছিলেন তার দমের দোস্ত ত্রুফোর সঙ্গে, যৌথপরিচালনায়; ‘অ্যা স্টোরি অব ওয়াটার’ [১৯৫৮] নামের সেই শর্টফিল্মটি বাদ দিয়ে, গোদারের একক পরিচালনার চারটিকে হাজির করা হলো, চার ভিন্ন মুনী বা সমালোচকের বয়ান থেকে…


জ্যঁ-লুক গোদার
অপারেশন কংক্রিট
ফিল্মমেকার । জ্যঁ-লুক গোদার

অপারেশন কংক্রিট

লিখেছেন । স্টিভ পুলাস্কি

অপারেশন কংক্রিট
Opération béton
ফিল্মমেকার, স্ক্রিনরাইটার, ন্যারেটর, এডিটর । জ্যঁ-লুক গোদার
সিনেমাটোগ্রাফার । আদ্রিয়াঁ পর্শে
রানিংটাইম । ২০ মিনিট
ভাষা । ফ্রেঞ্চ
দেশ । সুইজারল্যান্ড
নির্মাণকাল । ১৯৫৫

সিনেমার সবচেয়ে কিংবদন্তি সত্তাগুলোর অন্যতম পুরোধা– জ্যঁ-লুক গোদারের প্রথম মুক্তি পাওয়া সিনেমা– অপারেশন কংক্রিট। সিনেমাটির শুটিং হয়েছে ১৯৫৫ সালে– যখন গোদার একজন নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে, আরও অগুনতি শ্রমিকের সঙ্গে কাজ করছিলেন সুইজারল্যান্ডের একটি বাঁধ নির্মাণকাজে। এই ২০ মিনিট দৈর্ঘ্যরে শর্টফিল্মটি সেই বাঁধটির নির্মাণ প্রক্রিয়ার ওপর ফোকাস করে দেখিয়েছে– কনভেয়ারগুলো ওপরে উঠছে, কনভেয়ারগুলো নিচে নামছে, প্ল্যাটফর্মগুলোতে কংক্রিট গোলানো হচ্ছে, অগুনতি ব্যারেল ভর্তি করা হচ্ছে কংক্রিটে, এবং বাঁধ নির্মাণের অন্যান্য প্রয়োজনীয় পদ্ধতিগুলো করা হচ্ছে অনুসরণ।

এখানে গোদার যে ক্যামেরা অ্যাঙ্গেলের ব্যবহার করেছেন, তা দুর্দান্ত। অতিকায় কনভেয়ার ও লিভারগুলোর কর্মযজ্ঞকে কখনো কখনো একেবারেই নিবিড় ও ক্লোজআপ শটে দেখানো হয়েছে। অন্যদিকে কখনো কখনো ভীষণ দূরত্ব থেকে, আরও বেশি সর্বব্যাপী দেখানো হয়েছে যন্ত্রগুলোর কর্মযজ্ঞ। গোদারের এই দুর্দান্ত ক্যামেরাওয়ার্ক তখনো অল্পজ্ঞাত এই মানুষটির কাছে কেবলই একটি আইডিয়া হয়ে ধরা দিয়েছে, যেটির বিস্তরণ তিনি পরবর্তীকালে, সেই ১৯৬০ দশকের নিজের সিনেমাগুলোতে সম্পূর্ণ আয়ত্ব করতে পেরেছেন– যে পর্যায়টিকে ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভ নামে ডাকা হয়। সিনে-সমালোচক হিসেবে যাত্রা শুরু করা গোদার, ‘ছোঁয়া যাবে না’– এমন ফরাসি ক্লাসিক সিনেমাগুলোর ওপর যারপরনাই বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন। ফলে আচারনিষ্ঠ ন্যারেটিভ ও টেকনোলজিক্যাল প্র্যাকটিসের জায়গায় প্রয়োগ করেছিলেন বৈচিত্র, নিরীক্ষা ও দ্ব্যর্থকতা। অপারেশন কংক্রিট বানানোর মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই গোদার নির্মাণ করেন তার অফিসিয়াল ফিচার লেন্থ ডিরেক্টরিয়ার ডেব্যু ব্রেথলেস। তারপর থেকে, যেকোনোকিছুই সম্ভব হয়ে উঠেছে।


কখনো কখনো
ভীষণ দূরত্ব থেকে,
আরও বেশি সর্বব্যাপী
দেখানো হয়েছে যন্ত্রগুলোর কর্মযজ্ঞ

অপারেশন কংক্রিট কম-বেশি সিনেপ্রেমী ও গোদারের সহযোদ্ধাদের মধ্যে কৌতূহল তৈরি করেছিল– যারা তাদের সবার কাজ দেখার আকাঙ্ক্ষা রাখছিলেন তখন। এটি তার পরবর্তী সিনেমাগুলোর মতো দার্শনিক অনুষঙ্গ এবং সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদের ইন্টারওয়ার্কিং বা অন্তঃসলিল-ক্রিয়ার মধ্যে ঝাঁপ দেওয়ার মতো কোনো থিম বা আইডিয়ার প্রতি সমবর্তিত হয়নি; বরং হয়ে উঠেছে সুন্দর এবং বিচক্ষণ ফ্রেমিং ও সামগ্রিক সিমপ্লিসিটির জাদুময়। এই সিনেমাটি যিনি বানিয়েছেন, তিনিই পরবর্তীকালে সবচেয়ে বৈপ্লবিক কিছু সিনেমার নির্মাতা– এ কথা ভাবতে গেলে অবশ্য স্রেফ গভীর অতলে হারিয়ে যেতে হয়!

স্টিভ পুলাস্কি। ফিল্ম ক্রিটিক, যুক্তরাষ্ট্র
সূত্র : লেটারবক্সড। অনলাইন ফিল্ম জার্নাল। ১০ এপ্রিল ২০১৪

জ্যঁ-লুক গোদার
অ্যা ফ্লার্টেশাস ওম্যান
ফিল্মমেকার । জ্যঁ-লুক গোদার

অ্যা ফ্লার্টেশাস ওম্যান

লিখেছেন । জে আরভিং

অ্যা ফ্লার্টেশাস ওম্যান
Une femme coquette
ফিল্মমেকার, স্ক্রিনরাইটার, সিনেমাটোগ্রাফার, এডিটর । জ্যঁ-লুক গোদার
উৎস-গল্প । দ্য সিগনাল/ গ্যি দু মোপাসাঁ
কাস্ট [ক্যারেক্টার] । মারিয়া লিসাদ্রেঁ [নারীটি]; রোলাঁ তোলমা [পুরুষটি]
রানিংটাইম । ৯ মিনিট
ভাষা । ফ্রেঞ্চ
দেশ । ফ্রান্স
রিলিজ । ১৯৫৫

তিনি জ্যঁ-লুক গোদার। বিখ্যাত ফরাসি ফিল্মমেকার। তার সিনেমা আমার সত্যিই প্রিয়। তার প্রথম সিনেমাটি ছিল সুইজারল্যান্ডের একটি বাঁধ নির্মাণের ওপর ডকুমেন্টারি। এর পর তিনি কয়েকটি শর্ট ফিকশনাল ফিল্ম বানিয়েছেন। তারপর শুরু করেছেন ফিচার ফিল্ম নির্মাণের যাত্রা।

গোদারের প্রথম দিকের একটি শর্টফিল্ম অ্যা ফ্লার্টেশাস ওম্যান। লো-বাজেটে বানানো এই সিনেমাটিতে স্বয়ং গোদারকেও পর্দায় হাজির হতে দেখা যায়। ফরাসি সাহিত্যিক গ্যি দু মোপাসাঁর দ্য সিগন্যাল [Le signe] গল্প অবলম্বনে বানানো হয়েছে এটি।

মূলগল্পের প্লট ছিল এ রকম : নিজের পতিতা নয়, এমন এক নারী দেখতে পায় পতিতারা জানালায় দাঁড়িয়ে থেকে কীভাবে আঙ্গুলের ইশারায় পুরুষ খদ্দেরদের আহবান করছে। সে নিজেও এমনটা করার চেষ্টা চালায়। মুহূর্তেই এক পুরুষ পথিকের কাছ থেকে সাড়াও পায়। লোকটির জেদ চেপে যায়। নারীটি তখন সত্যিকারের পতিতা হিসেবে অভিযুক্ত হওয়ার ভয় পায়– যেটি, নিঃসন্দেহে অপরাধ হিসেবে গণ্য। ফিল্ম ভার্সনটিতে দেখা যায়, ঘটনাগুলো আউটডোরে ঘটছে; এটির শেষ হয় একটি চেজ-সিনের মধ্য দিয়ে : লোকটি যখন গাড়ি চালিয়ে পিছু নেয়, নারীটি তখন দৌড়ে লুকিয়ে পড়তে চায় অন্ধকারে।

গোদারের জীবন ও সিনেকর্মের ওপর লেখা আলোচনামূলক গ্রন্থ এভরিথিং ইজ সিনেমায় রিচার্ড ব্রডি লিখেছেন : ‘অ্যা ফ্লার্টেশাস ওম্যান এমন একজনের কাহিনি, নিজের দেখা একটি ইশারাভাষা যে ব্যবহার করার চেষ্টা চালায়, যা তাকে প্রলুব্ধ করেছে– সেটিকে চায় অনুকরণ করতে, এবং যে সেই অনুকরণটিকে বাস্তবে রূপান্তর করে। তাকিয়ে দেখার, যা দেখেছে– সেটির মধ্যে জীবনযাপনের, এবং সেটি করতে গিয়ে স্বভাবজাত বিপদে পড়ার ব্যাপার নিয়ে এই সিনেমা। এ হলো ভয় ও বিব্রতবোধ-বিষয়ক, এবং কোনোকিছু করে ফেলার অপরাধবোধের ভেতর নিজের মতোই জীবনযাপন চালিয়ে যাওয়া নিয়ে সিনেমা। এ হলো টাকা-বিষয়ক, এবং অসুস্থ উপায়ে তা উপার্জন নিয়ে সিনেমা। এই সিনেমা পতিতাবৃত্তি-বিষয়ক : যে কাজটি ভালোবাসার জন্য করাটাই যথাযোগ্য, সেই কাজটিই টাকার জন্য করা নিয়ে সিনেমা। এবং এ ব্যাপারে কোনো পেশাদারের ইশারাভাষাকে স্রেফ অনুকরণ করতে গিয়ে কীভাবে একজন অজান্তেই এই চর্চাটি করে ফেলে– সেই বিষয়ক সিনেমা।’

এতসব গুরুতর বিষয়ে একটি শর্টফিল্মের মধ্যেই জায়গা করে দিতে পারাটা সত্যিই মনোমুগ্ধকর ব্যাপার। ‘যে কাজটি ভালোবাসার জন্য করাটাই যথাযোগ্য, সেই কাজটিই টাকার জন্য করা’– ব্রডির এই বর্ণনাটি আমার ভালোলেগেছে।


যে পৃথিবীতে সবকিছুকে টাকা
দিয়ে মাপা হয়, যেখানে সব
সম্পর্ক ও মিথষ্ক্রিয়াকে
‘সম্পদ সৃষ্টির’
বর্মসজ্জার
একটি
সুযোগ
হিসেবে গণ্য
করা হয়, সেখানে
যারা অন্তত জানে তারা
কী করছে– সেই যৌনকর্মীরা নয়,
বরং
আমরা,
বাকিরাই তো
‘পতিতা’ হয়ে উঠেছি

একটি কথা বলে নিচ্ছি, এই লেখাটিকে যৌনকর্মীদের প্রতি কোনো আক্রমণ হিসেবে যেন কেউ না ভাবেন। কারণ, এটি আসলে তা নয়। কম-বেশি সহনশীল, কম-বেশি কলঙ্কজনক কর্মকাণ্ড হিসেবে পশ্চিমা সংস্কৃতিতে পতিতাবৃত্তি সবসময়ই জায়গা করে আছে। যদি রূপকঅর্থেও ব্যবহার করা হয়, সে ক্ষেত্রেও এটির মাধ্যমে খারাপ কিছুই বোঝানো হয়ে থাকে। ‘মিডিয়া হোর’ আজকালের খুবই কমন একটি গালি।

সত্যিকারঅর্থেই ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো, সততার প্রশ্নে আমাদের বাদবাকি মানুষের তুলনায় যৌনকর্মীরা কিন্তু সৎ। টাকার জন্য তারা সেক্স করে। আমরা বাকিরা অন্য যা যা করি, বেশিরভাগ সময়ই তা কিন্তু টাকার জন্য নিজেদের বিক্রি করে দেওয়াই; অথচ কোনো না কোনোভাবে নিজেদেরকে যৌনকর্মীদের চেয়ে নৈতিকভাবে উন্নত ভাবতে পছন্দ করি আমরা। আমরা কি সত্যি তা-ই?

‘যে কাজটি ভালোবাসার জন্য করাটাই যথাযোগ্য, সেই কাজটিই টাকার জন্য করা।’ ভালোবাসার জন্য কোন কাজটি করা উচিত আমাদের? নিজ সন্তানদের লালন করা। পরিবার পরিজনের জন্য টুকিটাকি কাজ করা। বাগান করা, হয়তোবা। নিজেদের শখগুলো মেটানো। কিন্তু আমাদের চাকরি? কাজের বিনিময়ে আমাদের টাকা দেওয়াটা কি কোনো সমস্যা? কোনো ট্রাকের ক্যাবে কোনো যৌনকর্মীর হ্যান্ডজবের মতোই, টাকার বিনিময়ে শ্রম দেওয়া কি আমাদের কর্মঅভিজ্ঞতাকে খাটো করে দেয়? ভালোবাসার সম্পর্কে রয়েছে– এমনটা ভেবে যৌনকর্মীর কোনো খদ্দের যেমন নিজেকেই বোকা বানায়, ঠিক তেমনিভাবে আমরা কি নিজেদের কাজকে অর্থবহ ভেবে নিজেদেরই বোকা বানাচ্ছি? যে পৃথিবীতে সবকিছুকে টাকা দিয়ে মাপা হয়, যেখানে সব সম্পর্ক ও মিথষ্ক্রিয়াকে ‘সম্পদ সৃষ্টির’ বর্মসজ্জার একটি সুযোগ হিসেবে গণ্য করা হয়, সেখানে যারা অন্তত জানে তারা কী করছে– সেই যৌনকর্মীরা নয়, বরং আমরা, বাকিরাই তো ‘পতিতা’ হয়ে উঠেছি। এর কি কোনো বিকল্প আছে?

জে আরভিং। ব্লগার; অস্ট্রেলিয়া
সূত্র : মংগ্রেল সিটিজেন। ওয়ার্ডপ্রেস ব্লগ। ১ জুলাই ২০১২

জ্যঁ-লুক গোদার
অল দ্য বয়েজ আর নেমড প্যাট্রিক
ফিল্মমেকার । জ্যঁ-লুক গোদার

অল দ্য বয়েজ আর নেমড প্যাট্রিক

লিখেছেন । শন ডাফি

অল দ্য বয়েজ আর নেমড প্যাট্রিক
Tous les garçons s’appellent Patrick
ফিল্মমেকার । জ্যঁ-লুক গোদার
স্ক্রিনরাইটার । এরিক রোমের
মিউজিক-উৎস । লুদভিগ ফন বিটোফেন
সিনেমাটোগ্রাফার । মিশেল লাতুশে
এডিটর । সিসিলা দুকুগি
কাস্ট [ক্যারেক্টার] । জ্যঁ-ক্লুদ ব্রিয়ালি [প্যাট্রিক]; আনা কোলেত [শার্লট]; নিকোল বার্গা [ভেরোনিকা]
রানিংটাইম । ২১ মিনিট
ভাষা । ফ্রেঞ্চ
দেশ । ফ্রান্স
রিলিজ । ১৯৫৭

১৯৬০ দশকে সফল ব্রেকথ্রু আনার আগে, ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভ ফিল্মমেকার জ্যঁ-লুক গোদারের প্রথমদিকের শর্টফিল্ম অল বয়েজ আর নেমড প্যাট্রিক। কাহিনি লিখেছেন আরেক নিউ ওয়েভার এরিক রোমের। এই শর্টফিল্মটির সঙ্গে গোদারের অভিষেক ফিচার ফিল্ম ব্রেথলেস ও রোমেরের সিক্স মোরাল টেলস ফিল্ম সিরিজটির বিস্ময়কর মিল রয়েছে। ফিল্মটিতে দেখা যায়, ভেরোনিকা ও শার্লট নামের দুই রুমমেট একই দিন দুপুর বেলা প্যাট্রিক নামের একই পুরুষের প্রেমের প্রলোভনে পড়ে। এরপর দুজন দুজনের প্যাট্রিকের মধ্যে তুলনার প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে, এবং তারা পরের দিন দেখে, সেই প্যাট্রিক তৃতীয় এক মেয়েকে নিয়ে ক্যাবে উঠছে; আর তারা বুঝে যায়, তারা আসলে এক প্লেবয় বা খেলারামের পাল্লায় পড়েছিল।

গোদারের সিনেজীবনজুড়ে, বিশেষ করে তার ১৯৬০ দশকের কাজগুলোতে একটি মোটিফ একেবারেই কমন– চরিত্রগুলো আমেরিকান সংস্কৃতির প্রতি আচ্ছন্ন, এবং গোদার নিজ অবস্থান থেকে সেটির নিরন্তর সমালোচনা জাহির করছেন। ব্রেথলেস-এর তিন বছর আগে বানানো, তার কেবলই দ্বিতীয় ফিকশনাল শর্টফিল্ম অল দ্য বয়েজ আর নেমড প্যাট্রিক-এর বেলায়ও এটি সত্য। ভেরোনিকা ও শার্লট রুমমেট ও পরস্পরের বেস্টফ্রেন্ড– এরা এক মুহূর্তও যেন আমেরিকান পপ-কালচারের কথা উল্লেখ না করে থাকতে পারে না। তাদের কালো সানগ্লাস থেকে শুরু করে, প্যাট্রিককে আমেরিকান পুরুষ মুভিস্টারদের অনেকের সঙ্গে তুলনা করা, ঘরের দেয়ালজুড়ে জেমস ডিন ও এলভিস প্রিসলির পোস্টার- হলিউডের প্রতি এই দুই তরুণীর সাংস্কৃতিকভাবে কৃতজ্ঞচিত্তেরই উদাহরণ।

প্যাট্রিকের প্লটটির প্রহসনটি স্বয়ং একেবারেই ক্লাসিক হলিউড কমেডির মতো। এমনকি নির্বাক যুগের কমেডিগুলোর অনুকরণ করে এখানে গোদার এই শ্রদ্ধার্ঘটি এক ধাপ বেশি প্রবল করে তুলেছেন। ফিল্মটির বেশ কিছু সিকুয়েন্স দৃশ্যমান হয়েছে লোয়ার ফ্রেম রেটে : ১২এফপিএস [ফ্রেম পার সেকেন্ড] কিংবা ১৮ এফপিএসে শুট করা ফিল্মটি ২৪ এফপিএসে প্রদর্শিত হয়ে এটিকে দিয়েছে একটি জাম্পি ও স্পেড-আপ অবয়ব। ফলে একই রকম লোয়ার ফ্রেম রেটে শুট করা নির্বাক সিনেমাগুলোরই সাদৃশ্য হয়ে উঠেছে এটি। ফিল্মটির মিউজিক স্কোর হিসেবে বিটোফেনের পিয়ানো এমনভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, মনে করিয়ে দেয় সাউন্ডট্র্যাক আবিষ্কারের আগে সাধারণত সিনেমা-হলের ভেতর থেকে যেভাবে শব্দ জুড়ে দেওয়া হতো, সেই স্মৃতি। অবশ্য, ফ্রান্সে ঠিক এ ধরনের সিনেমা দেখার পক্ষাপাতী নন গোদার।


‘আমাদের নকল কিংবদন্তিদের
ভারে ফরাসি সিনেমা
মরতে বসেছে’

সিনেমাটির শুরুতে, প্যাট্রিক যখন শার্লটকে পাকড়াও করে, তারা চলে যায় একটি স্ট্রিট ক্যাফেতে। সেখানে তাদের সামনের একটি টেবিলে যে ফরাসি লোকটি বসে অতিকায় এক পত্রিকা পড়ার ছলে নিজেকে আড়াল করছিল, সেই পত্রিকাটিতে মোটা অক্ষরে লেখা ছিল : ‘আমাদের নকল কিংবদন্তিদের ভারে ফরাসি সিনেমা মরতে বসেছে।’ ব্যাকগ্রাউন্ডে লুকিয়ে থাকা এই শিরোনামটি হয়তো সহজেই চোখ এড়িয়ে যেতে পারত; কিন্তু এটিকে স্পষ্ট দেখা গেছে, আর এটি সিনেমা প্রসঙ্গে গোদার যে মূল তর্কটি হাজির করে থাকেন, সেটিরই বিবৃতি দেয় : ফরাসিরা হলিউডকে নকল করতে উঠে পড়ে লেগেছে বলেই ফরাসি সিনেমা মরতে বসেছে। তরুণ যুগলটির দিকে অল্প কয়েকবার বিশ্রি রকমের চাহনি দিয়ে, পত্রিকা পড়া তরুণ ও শীতল লোকটি উঠে দাঁড়ায় এবং চলে যায়– শটটির ডিপ ফোকাসে এ বিষয়টি একেবারেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

এরপর, প্যাট্রিক আরেকটি স্ট্রিট ক্যাফেতে গিয়ে হাজির হয়, তবে এবার শার্লটের রুমমেট ভেরোনিকাকে নিয়ে। এ বেলা আরেকজন অচেনা লোক ওদের আলাপনে আড়ি পাতে; এই লোকটি আরেকটু বয়স্ক, এই যুগলের দিক থেকে চোখ সরাতে পারে না সে। এই লোকটির ওপর তিনবার কাট শট ব্যবহার করেছেন গোদার। প্রথম দুটি কাটে আমরা দেখি, লোকটি একটি আভাঁ-গার্দ ধরনের ফরাসি ম্যাগাজিন পড়া অবস্থা থেকে চোখ তুলে তাকাচ্ছে। পরেরবার, বস্তুত প্রায় দুই মিনিট পরেই, লোকটির কাছে ফিরে যান গোদার, এবং তাকে আমরা দেখি প্রচ্ছদে কার্টুন চরিত্র ডোনাল্ড ডাক-অলা একটি নতুন ম্যাগাজিন পড়তে।

এই দুটি লোককে গোদার ব্যবহার করেছেন সমকালীন ফরাসি মনোভাবের প্রতীক হিসেবে। পত্রিকাঅলা লোকটি তরুণ, দুঃখবাদী, এবং এটিচ্যুডে ভরপুর– সে-ই গোদার ও তার সমসাময়িকদের পক্ষের লোক। অন্যদিকে বুড়ো লোকটি ফরাসিদের বুড়ো প্রজন্মের প্রতিনিধি– যারাই দেশটির বর্তমান অনুকরণপ্রিয় রুচিগুলো তৈরি করেছে। তারা আমেরিকান সংস্কৃতির বস্তাপচা রোমান্টিসিজমে আচ্ছন্ন, এবং এমনকি ফরাসিদের দ্যূতিহীন নকলপ্রবণতার প্রতি ব্যাকুল আগ্রহী– যে বৈশিষ্ট্যগুলো ভেরোনিকা ও প্যাট্রিকের দৃশ্যটিতে টেবিলের আড়াআড়িতে ফুটে উঠেছে।

এখনো জ্যান্ত এবং ইনোভেটিভ ও কাল্ট-থ্রোট ফিল্ম বানানোতে ব্যস্ত ঠিক যেমন সাম্প্রতিক প্রশংসিত গুডবাই টু ল্যাঙ্গুয়েজ— গোদার বস্তুত সিনেমার গভীর প্রেমে আচ্ছন্ন, এবং এটির [সিনেমার] বর্তমান পরিস্থিতিতেও অব্যাহত রেখেছেন যাত্রা। যে জিনিসটির অনুকরণ ও যে জিনিসটিকে নিয়ে মজা কুড়ানো– উভয়ই করছেন বলে প্রায়শই মনে হওয়া সেই আমেরিকান সিনেমা সম্পর্কে গোদারের দৃষ্টিভঙ্গির বেলায় এই দ্বৈততা বিশেষভাবে সত্য। ক্রাইম থ্রিলার ও গ্যাংস্টার ধারার ওপর ব্রেথলেস কিংবা পিয়েরো লা ফুর টুইস্টগুলোর মতোই, অল দ্য বয়েজ আর নেমড প্যাট্রিক বস্তুত ভালোবাসা ও অবজ্ঞার সমান অংশগ্রহণ সৃষ্টির মাধ্যমে প্রহসনধর্মী কমেডির প্রতি গোদারের সপাট আক্রমণ।

শন ডাফি। লেখক, ফিল্মমেকার, পারফর্মার; যুক্তরাষ্ট্র
সূত্র : ফেসেটস ফিচারস। ফিল্ম ব্লগ; যুক্তরাষ্ট্র। ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫

জ্যঁ-লুক গোদার
শার্লট অ্যান্ড হার বয়ফ্রেন্ড
ফিল্মমেকার । জ্যঁ-লুক গোদার

শার্লট অ্যান্ড হার বয়ফ্রেন্ড

লিখেছেন । জেমস ট্রেভারস

শার্লট অ্যান্ড হার বয়ফ্রেন্ড
Charlotte et son Jules
ফিল্মমেকার, স্ক্রিনরাইটার । জ্যঁ-লুক গোদার
প্রডিউসার । পিয়েরে ব্রাউঁবার্গা
মিউজিক । পিয়েরে মঁসিগ্নি
সিনেমাটোগ্রাফার । মিশেল লাতুশে
এডিটর । সিসিলা দুকুগি; জ্যঁ-লুক গোদার
কাস্ট [ক্যারেক্টার] । জ্যঁ-পল বেলমদোঁ [জুলা]; আনা কোলেত [শার্লট]; জেরার্দ ব্লেইন [নতুন প্রেমিক]
রানিংটাইম । ১৩ মিনিট
ভাষা । ফ্রেঞ্চ
দেশ । ফ্রান্স
নির্মাণকাল । ১৯৫৮

সিনে-সমালোচক থেকে ফিল্মমেকার হয়ে ওঠা বন্ধু ফ্রাঁসোয়া ত্রুফোর উদাহরণ সামনে রেখে ফিল্মমেকার হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া তরুণ জ্যঁ-লুক গোদারের প্রথমদিকের উপভোগ্য শর্টফিল্ম– শার্লট অ্যান্ড হার বয়ফ্রেন্ড। এটি একইসঙ্গে নির্লজ্জরকমের একঘেয়ে ও ছোঁয়াচে রকমের আমুদে ফিল্ম। ত্রুফো এবং কাইয়্যে দু সিনেমা গ্রুপের অন্যান্য সিনে-সমালোচক– এরিক রোমের, ক্লুদ শ্যাব্রল ও জ্যাক রিভেত সহকারে, গোদার হয়ে উঠেছেন ‘ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভে’র অন্যতম অনিবার্য স্তম্ভ এবং ১৯৬০ দশকের শুরুর দিকে একটি ফিল্মিবিপ্লবকে দিয়েছেন ছড়িয়ে।

নিজের এই প্রথমদিকের সিনেমাটিতে, একটি আমুদে ও ঝরঝরে ভালোবাসাবাসির সম্পর্কের মাধ্যমে, ইনোভেশনের প্রতি গোদারের আকুল কামনা একেবারেই প্রথম দৃশ্যটি থেকে টের পাওয়া যায়। শার্লট অ্যান্ড হার বয়ফ্রেন্ড হাজির করেছে সিনেমায় অভিষিক্ত হওয়া জ্যঁ-পল বেলমর্দো অভিনীত চরিত্রটির একটি নন-স্টপ মনোলগকে– যেটিতে ভয়েসওভার দিয়েছেন স্বয়ং গোদার; আর এই কথাবার্তার উদ্দেশ্য ও মনোযোগের কেন্দ্রে থাকা নারী চরিত্রটি [এ চরিত্রে অভিনয় করেছেন হাসিখুশি আনা কোলেত] কেবলই প্রকাশ করেছে অভিব্যক্তি। এই উদ্ভট রকমের আদুরে সিনেমাটি গোদারের প্রথমদিকের কমেডি ফিচার ফিল্মগুলোর, বিশেষত অ্যা ওম্যান ইজ অ্যা ওম্যান-এর পূর্বসূরী যেন।


বেকার পরে জানতে পেরেছিলেন, জঘন্য
কণ্ঠস্বরটি আসলে জ্যঁ-লুক গোদারের ছিল

ফিল্মটি বানানোর সময় বেলমদোঁ একদমই অখ্যাত ছিলেন; তবে গোদারের প্রথম ফিচার ফিল্ম ব্রেথলেস-এর কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন তিনি। এ ফিল্মের ডাবিংয়ে তার অংশ না নেওয়ার কারণটি বেশ ইন্টারেস্টিং। ফিল্মটির শুটিং করার পরপরই [একেবারেই অল্প বাজেটে, ছোট্ট একটা হোটেল রুমে সেটি করা হয়েছে], ফরাসি সেনাবাহিনি এই অভিনেতাকে পাকড়াও করে এবং বেতনভুক্ত সৈনিক হিসেবে তার দায়িত্ব পালন করতে বাধ্য করে। [এর বছর কয়েক আগেই সেনাবাহিনিতে যোগ দিয়েছিলেন বেলমদোঁ; কিন্তু স্থায়ী ইনজুরিতে পড়ে অকার্যকর গণ্য হয়ে পেনশনে চলে যান।] এই তারকার পোস্টিং দেওয়া হয় আলজেরিয়ায়। ফলে তার হয়ে ডাবিংয়ে অংশ নেন স্বয়ং গোদার। দুর্ভাগ্যক্রমে এটি পরবর্তীকালে বেলমেদোঁর জন্য নেতিবাচক হয়ে ওঠে। শার্লট অ্যান্ড হার বয়ফ্রেন্ড দেখে, জঘন্য কণ্ঠস্বরের কারণে নিজের দ্য হোল [le trou; ১৯৬০] সিনেমার কাস্টিং থেকে তাকে বাদ দিয়ে দেন জ্যাক বেকার; যদিও বেকার পরে জানতে পেরেছিলেন, জঘন্য কণ্ঠস্বরটি আসলে জ্যঁ-লুক গোদারের ছিল; কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে!

জেমস ট্রেভারস। ফ্রিল্যান্স রাইটার; যুক্তরাজ্য
সূত্র : ফিল্ম দু ফ্রান্স। ফিল্ম জার্নাল, ফ্রান্স। ২০০০
Print Friendly, PDF & Email
সম্পাদক: ফিল্মফ্রি । ঢাকা, বাংলাদেশ।। সিনেমার বই [সম্পাদনা/অনুবাদ]: ফিল্মমেকারের ভাষা [৪ খণ্ড: ইরান, লাতিন, আফ্রিকা, কোরিয়া]; ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো: প্রেম ও দেহগ্রস্ত ফিল্মমেকার; তারকোভস্কির ডায়েরি; স্মৃতির তারকোভস্কি; হিচকক-ত্রুফো কথোপকথন; কুরোসাওয়ার আত্মজীবনী; আন্তোনিওনির সিনে-জগত; কিয়ারোস্তামির সিনে-রাস্তা; সিনেঅলা [৪ খণ্ড]; বার্গম্যান/বারিমন; ডেভিড লিঞ্চের নোটবুক; ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার চান্তাল আকেরমান; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার বেলা তার; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার নুরি বিলগে জিলান; ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; বেলা তার; সের্গেই পারাজানোভ; ভেরা খিতিলোভা; সিনেমা সন্তরণ ।। কবিতার বই: ওপেন এয়ার কনসার্টের কবিতা; র‍্যাম্পমডেলের বাথটাবে অন্ধ কচ্ছপ; হাড়ের গ্যারেজ; মেনিকিনের লাল ইতিহাস ।। মিউজিকের বই [অনুবাদ]: আমার জন লেনন [মূল : সিনথিয়া লেনন]; আমার বব মার্লি [মূল: রিটা মার্লি] ।। সম্পাদিত অনলাইন রক মিউজিক জার্নাল: লালগান

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here