লিখেছেন । খন্দকার সুমন
লাইভ ফ্রম ঢাকা
Live From Dhaka
স্ক্রিনরাইটার, ফিল্ম এডিটর ও ফিল্মমেকার । আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ
প্রডিউসার । শামসুর রহমান আলভী
সিনেমাটোগ্রাফার । তুহিন তমিজুর
আর্ট ডিরেক্টর । উজ্জ্বল আফজাল
কাস্ট [ক্যারেক্টার] । মোস্তফা মনওয়ার [সাজ্জাদ]; তাসনোভা তামান্না [রেহানা];’ তানভীর আহমেদ চৌধুরী [মাইকেল]; মীর মোশাররফ হোসেন [মীর]; শিমুল জয় [শাহেদ]
রানিংটাইম । ১ ঘণ্টা ৩১ মিনিট
ভাষা । বাংলা
দেশ । বাংলাদেশ
প্রিমিয়ার । ২ ডিসেম্বর ২০১৬ [সিঙ্গাপুর]
রিলিজ । ২৯ মার্চ ২০১৯ [বাংলাদেশ]

জাদুর শহর ঢাকা। সেই জাদুর শহর বর্তমানে শুধুই কালাজাদুর শহর। মানুষের অমঙ্গলে কালাজাদুর ব্যবহার পৌরাণিক কাহিনিগুলোতে পাওয়া যায়। কালা জাদু এক প্রকারের ফাঁদ। এই ফাঁদ মানবতাকে বন্দি করে অমানবিক নরকে পরিণত করে। জাদুর শহর ঢাকা বর্তমানে একটি ফাঁদ, আর ফাঁদে আটকা পরা মানুষগুলো বর্তমানে নরকবাসী।
বাংলাদেশের অর্থনীতি শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় প্রতিদিন হাজার মানুষ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ছুটছে ঢাকার দিকে। অন্ধকারে আচ্ছন্ন বাংলাদেশে শুধু ঢাকা শহরই কীট-পতঙ্গ নিধন ফাঁদের বাতির মতো জ্বলজ্বল করছে। মানুষ এই বাতির মোহে ছুটছে ঢাকার দিকে শ’য়ে-শ’য়ে, হাজারে-হাজারে!
“লেখাপড়া করে যে, গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে”– এমনই বিলাসি স্বপ্নের বীজ দিয়ে তৈরি বাংলাদেশের শিক্ষানীতি। সেই বিলাসি স্বপ্ন পূরণের একমাত্র শহর ঢাকা।
চলচ্চিত্র লাইভ ফ্রম ঢাকার কেন্দ্রীয় চরিত্র সাজ্জাদ একই স্বপ্ন বুকে নিয়ে গ্রাম বা মফস্বল শহর থেকে ঢাকায় আসা একজন মানুষ। ঢাকায় আসার পর তার স্বপ্নের পথে ঠিকঠাক এগোচ্ছিল। ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারে, স্বপ্নের দিকে সফল পথটুকু আসলে টোপ। টোপের কাছাকাছি পৌঁছেই বুঝতে পারে, সে আসলে ফাঁদের মাঝখানে পৌঁছে গিয়েছে। পৃথিবীর সকল প্রাণীই ফাঁদে আটকে যাওয়া বুঝতে পেরে সেখান থেকে মুক্তির জন্য ছটফট করে। এমনই মুক্তির আকাঙ্ক্ষা সাজ্জাদের মাঝেও দেখা যায়। সাজ্জাদ হয়তো সেই ফাঁদ থেকে মুক্তি পায় অথবা ফাঁদে আটকা পরা অন্য সব প্রাণীর মতো সেও নিয়তি হিসেবে মেনে নিয়ে নিজেকে সমর্পণ করে– এমন রহস্য রয়ে যায় লাইভ ফ্রম ঢাকা চলচ্চিত্রটিতে।

লাইভ ফ্রম ঢাকা কোনো গল্পনির্ভর চলচ্চিত্র নয়। এর গল্প লিখতে গেলে একলাইনের পুরোটা ব্যবহার হবে না। গল্প একটি কাঠামো। সেই কাঠামো চাইলে একটি চলচ্চিত্রে ব্যবহার করা যায়; তবে ব্যবহার না করলে তা চলচ্চিত্রটির গুণগত মানে কোনো সমস্য করে না, বরং চলচ্চিত্রটিকে বৈচিত্রময় করে তোলে। লাইভ ফ্রম ঢাকা চলচ্চিত্রে তাই সেই বৈচিত্রতা পাওয়া যায়।
লাইভ ফ্রম ঢাকার চিত্রনাট্য রৈখিক বা রেখাকার। স্বল্প বাজেট মাথায় রেখে যেহেতু চিত্রনাট্যটি রচনা করা হয়েছে, তাই এর নির্বাহ ছিল সফল এবং সুন্দর। চিত্রনাট্যে অরৈখিক কিছু বিষয় বোঝা যায় না। যেমন সাজ্জাদের ড্রাইভিং সিটের পিছনে একটি কিশোরী বসে থাকা। তার বাসায় টেবিলে বসে থাকা অবস্থায় বিদ্যুৎ চলে গেলে সে আলো জ্বালায়। দেখায় যায় রহস্যময়ী একজন নারী টেবিলের পাশের চেয়ারে বসে ভৌতিক চোখে তাকিয়ে আছে সাজ্জাদের দিকে। সাজ্জাদ ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। যেমন বোঝা যায়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আশ্রয় নেওয়া ছাত্রটি কোন মতাদর্শের রাজনীতি করে। সাজ্জাদের চলন্ত গাড়ির রেডিওর শব্দ দিয়ে যে সময়টিকে উপস্থাপন করা হয়েছে, সেই সময়ের রাজনীতির সাথে চিত্রনাট্যটির বোঝাপড়া কম বলে মনে হয়েছে। রাতে হঠাৎ চলন্ত গাড়ি থামিয়ে ছাত্ররা যে সময়ে গাড়িতে আগুন দিয়েছিল, সেই সময়টিও পরিস্কার হওয়া জরুরি ছিল চিত্রনাট্যে।
চরিত্র রচনায় চিত্রনাট্যটি সাজ্জাদকে যতটা উজার করে স্থান দিয়েছে, ততটাই স্থান কেড়ে নিয়েছে বাকি চরিত্রদের কাছ থেকে। বাংলাদেশের প্রায় প্রত্যেকটি চলচ্চিত্রে নারী চরিত্রের বাবাকে উপস্থাপন করা এক ধরনের গতানুগতিক ধারা। হয়তো একই কারণেই অপ্রয়োজনীয়ভাবে রেহানার বাবাকে চিত্রনাট্যে উপস্থাপন করা হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় দৃশ্য অপ্রয়োজনেই হিমু আর রুপার কথা মনে করিয়ে দিয়ে তা কিছু সময়ের জন্য চলচ্চিত্রটি থেকে দর্শককে অন্যমনস্ক করার সম্ভাবনা রাখে। মাইকেল চরিত্রটি যতটুকু সময় চিত্রনাট্যে এসেছিল, বেশ সুন্দরভাবেই তার মানসিক অবস্থান পরিস্কার করেছে। তবে একটি মুসলিম পরিবারের সন্তানের নাম মাইকেল হলো কেন? না কি যে নেশা করে তার নাম মাইকেল বা এলবার্ট হবে– এমন গতানুগতিক কোনো ধারা রয়েছে, পরিস্কার বোঝা যায় না। সাজ্জাদ চরিত্রটি অসমাপ্ত চরিত্র, যেমন বাস্তবে একজন মানুষের চরিত্র মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অসমাপ্ত থেকে যায়।
…
চিত্রনাট্যটির
এটাই সবচাইতে বড়
সফলতা যে, সাজ্জাদকে অনস্ক্রিনিং
এবং অফস্ক্রিনিং–
দুইভাবেই
পড়া যায়
…
চলচ্চিত্রটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সাজ্জাদের চরিত্রের নানান চয়নিক বৈশিষ্ট্য প্রকাশিত হয়– যা সময় এবং স্থান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাই সাজ্জাদকে যতটুকু দেখা যায়, সে ততটুকু না। সে প্রেম করে। নতুন পৃথিবীতে বসবাসের স্বপ্ন দেখে। সে ক্ষমা করে। সে স্বার্থপর। সে অনুতপ্ত হয়, আবার ক্ষমাও চায়। চিত্রনাট্যটির এটাই সবচাইতে বড় সফলতা যে, সাজ্জাদকে অনস্ক্রিনিং এবং অফস্ক্রিনিং– দুইভাবেই পড়া যায়। টুরস্ এন্ড ট্রাভেলস্-এর মালিক এবং কো-অপারেটিভ সোসাইটির রিকোভারিম্যানের মেলোড্রামাটিক ডায়লগ চলচ্চিত্রটির চিত্রনাট্যকে দুর্বল করেছে। চিত্রনাট্যে রেহানার অফিস থেকে বাড়ি ফেরার এবং সাজ্জাদ একা একা গাড়িতে ঘুরে বেড়ানোর সময় যানজটমুক্ত যে ঢাকা শহর দেখানো হয়েছে, সেই ঢাকা শহরের বৈশিষ্ট্য প্রায় এক দশক আগেই হারিয়েছে। এই দৃশ্যায়নে আরেকটু যত্নবান হলে আরও ভালো হতো।

লাইভ ফ্রম ঢাকা চলচ্চিত্রটির চিত্রগ্রহণ নান্দনিক। নান্দনিক চিত্রগ্রহণ বলতে যা সাধারণত বোঝা যায়, ঠিক তা নয়। সুন্দর মেপে মেপে ঝকঝকে ছবি– এমন নয় চলচ্চিত্রটির দৃশ্যধারণ। সাজ্জাদ তার স্থান-সময়কে যেভাবে ধারণ করে, তা চিত্রগ্রহণের মাধ্যমে ঠিকঠাক পরিবেশন হয়েছে। অনেকটা ফাঁদে আটকা একটি মানুষের পয়েন্ট অব ভিউ থেকে। কখনো ফোকাসড, আবার কখনো ডিফোকাসড। প্রায় পুরো চলচ্চিত্রটি সম্ভবত একটি ৫০ মিলিমিটার লেন্স দিয়ে ধারণ করা হয়েছে– যা চলচ্চিত্রটির ছবিকে সঠিকভাবে নির্বাহ করেছে। বিশেষ করে গাড়ির দৃশ্যধারণের এঙ্গেল এবং ক্যামেরা মুভমেন্ট বিশেষভাবে প্রশংসাযোগ্য। চিত্রহণের সঙ্গে প্রশংসা দাবি রাখে লাইটিং বা আলোকসম্পাত। পরিমিত আলোর মধ্য দিয়ে চিত্রগ্রহণ এক রকমের সাহসী সিদ্ধান্ত যা লাইভ ফ্রম ঢাকায় সফলভাবে নির্বাহ হয়েছে।
চলচ্চিত্রটির মানের সাপেক্ষে সব চাইতে দুর্বল দিক শিল্প নির্দেশনা। পুরো চলচ্চিত্রটিজুড়ে সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রপ্স এবং সেট হচ্ছে একটি পুরাতন মডেলের প্রাইভেট কার। গাড়িটি সম্ভবত টয়োটা স্টারলেটের অনেক পুরাতন মডেল। গাড়ির নম্বর প্লেটে লেখা ‘ঢাকা মেট্রো ঘ ৩৪১৫’। বাংলাদেশে ‘ঘ’ সিরিজের নম্বর প্রাইভেটকারের জন্য নয়, শুধু ফোর হুইলার বা এসইউভি বা জিপের জন্য ব্যবহার হয়।

শেয়ার ব্যবসা রমরমা থাকার সময় হয়তো সাজ্জাদ গাড়িটি কিনেছিল। কাচা টাকা হাতে থাকা একজন মানুষ সাধারণত টয়োটা ব্রান্ডের এক্স বা জি সংস্করণের করোলা মডেলের একটি গাড়ি বা সেই সময়ের বাজার চলতি একটা গাড়ি কেনা স্বাভাবিক। আবার যদি সাজ্জাদ চরিত্রটি শৌখিন এন্টিক লাভার হয়ে থাকে, তাহলে তার এই ‘ঢাকা মেট্রো ঘ’ সিরিজের গাড়িটিও চলত; তবে তার ঘরের আসবাবপত্রে সেইরকম কিছুর ছাপ পাওয়া গেলে বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হতো। তেমন এন্টিক কোনো আসবাবপত্র তার ঘরে দেখা যায়নি। মাইকেল এবং সাজ্জাতের ঘরভর্তি বই থাকলেও তাদের ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সেগুলো একদমই বেমানান। তাদের দুইজনের একজনকেও দেখে মনেই হয় না তারা একাডেমিক পড়াশোনার বাইরে পড়াশোনা করা ব্যক্তিত্ব।
লাইভ ফ্রম ঢাকা চলচ্চিত্রের চরিত্রগুলোর কস্টিউম চলচ্চিত্রটিকে যথাযথভাবে সার্ভ করেছে। কখনই কোনো চরিত্রের কস্টিউম দেখে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে মনে হয়নি।
বাংলাদেশের কোনো পেক্ষাগৃহে চলচ্চিত্র দেখে উক্ত চলচ্চিত্রের শব্দ নিয়ে আলোচনা করার চাইতে বিজ্ঞানী এরিক ভন দানিকেনের অবৈজ্ঞানিক মতবাদ নিয়ে আলোচনা করা বেশি শ্রেয়!
সম্পাদনা! লাইভ ফ্রম ঢাকা বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র, যে চলচ্চিত্রের প্রায় পুরো সময়জুড়ে জাম্প কাট দিয়ে দিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে। ওয়ার্ল্ড সিনেমায় সম্পাদনার এই কৌশলের ব্যবহার অনেক পুরাতন হলেও বাংলাদেশের বিজ্ঞাপনচিত্রের পর এই প্রথম জাম্প কাটে সম্পাদনার কৌশলে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র লাইভ ফ্রম ঢাকা সম্পাদিত। নিজের ভাষায় চলচ্চিত্রে আন্তর্জাতিক কোনো কৌশল প্রয়োগের উদাহরণ থাকলে শিক্ষানবিশ চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং সাম্পাদকদের জন্য বিষয়টি অনেক অনুপ্রেরণার উদাহরণ হয়।
এত এত হাইডেফিশনের ছবির দুনিয়ায় লাইভ ফ্রম ঢাকা চলচ্চিত্রটির ছবি নয়েজি [noisy] এবং সাদা কালো! একটি চলচ্চিত্রে কোনো কিছুই এমনি-এমনি থাকে না। নানান উপাদানের যৌক্তিক ব্যবহারই চলচ্চিত্রটিকে নান্দনিক এবং সফল করে তোলে। লাইভ ফ্রম ঢাকার নয়েজি এবং সাদা কালো ছবি আর্টিস্টের ফ্রিডম অব চয়েস নয়, বরং বিষয়টি এপ্রোপিয়েট সিনেমা ল্যাঙ্গুয়েজ।

লাইভ ফ্রম ঢাকা চলচ্চিত্রের সাজ্জাদ চরিত্রে অভিনয় করেছেন মোস্তফা মনওয়ার। তিনি ভালো অভিনয় করেছেন। চলচ্চিত্রটির চিত্রনাট্যও তাকে সেই সুযোগটি দিয়েছে। মাইকেল চরিত্রে অভিনয় করেছেন তানভীর আহমেদ চৌধুরী। চরিত্রের ব্যাপ্তির সাপেক্ষে তার অভিনয় সবচাইতে ভালো ছিল। রেহানা চরিত্রে অভিনয় করেছেন তাসনোভা তামান্না। তিনি ভালো অভিনয় করেছেন, যদিও চিত্রনাট্যে ভালো করার তেমন সুযোগ ছিল না।
একটি চলচ্চিত্র নানা পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যখন সফল হয়, তখন তাকে সফল চলচ্চিত্র বলে। চলচ্চিত্র ভালো না মন্দ– এর বিচার কেবল সময়ই সঠিকভাবে করে থাকে। একটি শিল্প ভালো বা মন্দ– মাত্র এই দুটি বাইনারি মন্তব্য শিল্পের জন্য যথেষ্ট নয়। ২০১৬ সালে নির্মিত চলচ্চিত্রটি ২০১৯ সালে এসেও ভাবনা তৈরি করে। এটা শুভ লক্ষণ।
লাইভ ফ্রম ঢাকা একটি সফল চলচ্চিত্র হিসেবে বাংলাদেশের ইতিহাসে সফল চলচ্চিত্রের তালিকায় সম্মানের সাথে স্থান করে নেবে, সেই আশা করাই যায়।
[…] গেরিলা কায়দাতেই বলে দিয়েছেন সাদ। লাইভ ফ্রম ঢাকা নামের এক […]
[…] লাইভ ফ্রম ঢাকা আদতে একটি স্বাধীন চলচ্চিত্র। স্বাধীন চলচ্চিত্রের সকল গুণাগুণ এই চলচ্চিত্রে দৃশ্যমান। বাংলাদেশে স্বাধীন চলচ্চিত্রের পথচলায় লাইভ ফ্রম ঢাকা মননশীল সংযোজন। চলচ্চিত্রের নির্মাণশৈলীর ভেতর নির্মাতার গল্পবলার যে দক্ষতা আমরা খুঁজতে থাকি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে তা সাদের লাইভ ফ্রম ঢাকার প্রতিটি দৃশ্যে উপস্থিত আছে। সন্দেহ নেই বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে অপ্রাপ্তির প্রবল খরার মৌসুমে এইটুকু প্রাপ্তি অনেক আনন্দের ঘটনা। […]