লিখেছেন । বেলায়াত হোসেন মামুন
মান্টো
Manto
স্ক্রিনরাইটার ও ফিল্মমেকার । নন্দিতা দাস
প্রডিউসার । ভিকরান্ত বাত্র, অজিত আন্দারে, নম্রতা গোয়াল, নন্দিতা দাস
সিনেমাটোগ্রাফার । কার্তিক বিজয়
মিউজিক । জাকির হোসেন [ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর]; স্নেহা খানওয়াকার, রাফতার [গান]
ফিল্ম-এডিটর । শ্রীকর প্রসাদ
কাস্ট [ক্যারেক্টার] । নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী [সা’দত হাসান মান্টো]; রাসিকা দুগাল [সাফিয়া]; তাহির রাজ ভাসিন [শ্যাম]; জাভেদ আখতার [আবিদ আলী আবিদ]; রাজশ্রী দেশপান্ডে [ইসমত চুগতাই]; চন্দন রয় স্যান্যাল [আহমেদ নাদিম কাসমি]; দিব্যা দত্ত [কুলভান্ত কৌর]
কালার । রঙিন
রানিংটাইম । ১১৬ মিনিট
ভাষা । হিন্দি; উর্দু
দেশ । ভারত
রিলিজ । ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৮
অ্যাওয়ার্ড । বেস্ট অ্যাক্টর [নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী; এশিয়া প্যাসিফিক স্ক্রিন অ্যাওয়ার্ড; ২০১৮]

মায়ের কবর জিয়ারত করে ফিরে আসছেন সা’দত হাসান মান্টো এবং তাঁর স্ত্রী সাফিয়া। কবরস্থান থেকে বেরুতে বেরুতে একটি পুরাতন কবরের সামনে দাঁড়িয়ে মান্টো বলছেন তাঁর স্ত্রীকে, ‘এখানে শুয়ে আছেন সা’দত হাসান মান্টো। তাঁর সঙ্গে কবরে গিয়েছে গল্প লেখার সমস্ত শিল্প এবং রহস্য। তাল তাল মাটির নিচে শুয়ে সে এটাই ভাবছে, সবচেয়ে মহান গল্প লেখকটি আসলে কে? সে নিজে নাকি আল্লাহ’…
ভারতীয় অভিনয়শিল্পী এবং চলচ্চিত্রকার নন্দিতা দাস নির্মিত দ্বিতীয় চলচ্চিত্র মান্টোর একটি দৃশ্যে আমরা সিকোয়েন্সটি দেখতে পেলাম। চলচ্চিত্র মান্টো উপমহাদেশের প্রখ্যাত লেখক সা’দত হাসান মান্টোর জীবন ও সৃষ্টিকর্ম অবলম্বনে নির্মিত।
চলচ্চিত্রটি ভারতে মুক্তি পেয়েছে ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৮। অবশ্য এর আগে মে মাসে ফ্রান্সের কান চলচ্চিত্র উৎসবে মান্টোর উদ্বোধনী প্রদর্শনী হয়। মান্টো কেবল নন্দিতা দাসের চলচ্চিত্র হিসেবেই আলোচিত হচ্ছে তা নয়। যাঁর জীবন ও সৃষ্টিকর্ম অবলম্বনে চলচ্চিত্রটি নির্মিত তাঁর কারণেও চলচ্চিত্রটি উপমহাদেশের সিরিয়াস চলচ্চিত্রপ্রেমীদের আগ্রহের বিষয় হয়ে উঠেছে। লেখক সা’দত হাসান মান্টো উপমহাদেশের সবচেয়ে আলোচিত ও ‘বিতর্কিত’ কথাসাহিত্যিক হিসেবে সবসময়ই চর্চিত হয়ে আসছেন। উপমহাদেশের করুণ ও কঠিন সময়ের সবচেয়ে সত্য চিত্র তাঁর গল্পে ফুটে উঠেছে বলে মনে করেন এখনকার সাহিত্য গবেষক ও লেখকগণ। মান্টো এমন একজন লেখক যাঁকে ভারত এবং পাকিস্তান উভয়েই ‘তাদের’ অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক বলে দাবি করেন। অথচ আফসোসের বিষয় হলো জীবিতকালে মান্টো এই দুই দেশের কারো কাছেই সমাদর পাননি। এমন একজন বহুল আলোচিত লেখকের জীবন অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মিত হলে তা নিয়ে উৎসাহ ও আগ্রহ স্বাভাবিক বিষয়।

ফিল্মমেকার । নন্দিতা দাস
১.
নন্দিতা দাসের চলচ্চিত্র মান্টোর আলোচনায় যাওয়ার আগে সা’দত হাসান মান্টো বিষয়ে আরেকটু আলাপ করতে চাই। সা’দত হাসান মান্টো একজন বহুলপ্রজ লেখক। তিনি মাত্র ৪২ বছরের আয়ুস্কালে লিখেছেন তিন শতাধিক গল্প, লিখেছেন উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, পত্রিকার জন্য কলাম এবং চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য। মান্টো জন্মগ্রহণ করেছিলেন তৎকালিন অখণ্ড ভারতবর্ষের পাঞ্জাবের লুধিয়ানার সামরালা গ্রামের এক মুসলিম পরিবারে। পাঞ্জাবে জন্মগ্রহণ করলেও মান্টোর পরিবারের আদি নিবাস ছিল কাশ্মিরে। মান্টোর পিতা একজন বিচারক ছিলেন এবং তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্য আইনজীবী বা ওকালতি পেশার সাথে যুক্ত ছিলেন।
…
জীবনের
শেষ দিন
পর্যন্ত মান্টো
তাঁর লেখক সত্তার
স্বাধীনতার জন্য লড়ে গেছেন
…
মান্টো ২১ বছর বয়সে লেখালেখি শুরু করেন এবং পরবর্তী ২১ বছরে তিনি উপমহাদেশের অন্যতম আলোচিত ও সমালোচিত লেখক হয়ে ওঠেন। ভারত ভাগ হওয়ার আগে ব্রিটিশ শাসনামলে মান্টোর লেখা গল্প তিনবার অশ্লীলতার দায়ে ‘নিষিদ্ধ’ হয় এবং ভারত ভাগ হওয়ার পর স্বাধীন পাকিস্তানে আরও তিনবার তাঁর লেখা গল্প অশ্লীলতার দায়ে ‘নিষিদ্ধ’ হয়। মান্টোর লেখা ঠাণ্ডা গোশত গল্পটির জন্য মান্টোকে পাকিস্তানি আদালত আর্থিক জরিমানার দণ্ড দেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মান্টো তাঁর লেখক সত্তার স্বাধীনতার জন্য লড়ে গেছেন। যে লড়াই ব্রিটিশ ভারত ও স্বাধীন পাকিস্তানে তাঁকে একই রকমভাবে লড়তে হয়েছে। আর এই লড়াই তাঁর স্মরণীয় সকল সাহিত্যকর্মের পাশাপাশি তাঁকে আজও প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয় করে রেখেছে।
২.
এমন একজন কথাসাহিত্যিকের জীবনের ওপর চলচ্চিত্র নির্মাণ সহজ কাজ নয়। যে লেখক যাত্রা করেছেন এই উপমহাদেশের সবচেয়ে ঘটনাবহুল সময়ের ভেতর দিয়ে, রচনা করেছেন সময়ের সবচেয়ে সৃষ্টিশীল প্রামাণ্য দলিল। যা তাঁর গল্প, তাঁর উপন্যাস এবং তাঁর গদ্য সাহিত্য। তাই চলচ্চিত্রকার নন্দিতা দাসকে নির্বাচন করতে হয়েছে তিনি কতটুকু বলবেন বা কতটুকু তিনি দেখাতে চান। এই নির্বাচনে নন্দিতা খুব যত্নবান হয়েছেন, বিবেচনা করেছেন এবং তিনি সা’দত হাসান মান্টোর মতোই সৃষ্টিশীল হয়েছেন। নন্দিতার চলচ্চিত্র মান্টো নন্দিতার সৃষ্টিশীলতার স্মারক হতে পেরেছে।

ফিল্মমেকার । নন্দিতা দাস
৩.
লেখাটি শুরু করেছিলাম নন্দিতা দাসের চলচ্চিত্র মান্টোর একটি সিকোয়েন্সকে কোট করে। যেখানে মান্টো তাঁর সমাধির ফলকের লেখা বা এপিটাফ লিখে রেখে যাচ্ছেন। সেই এপিটাফে তিনি নিজেকে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার সাথে শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হচ্ছেন। একজন ‘মুসলিম’ মানুষ মায়ের কবর জিয়ারত শেষে কবরস্থানে দাঁড়িয়ে এমন কথা বলছেন যা প্রচলিত ‘মুসলিম শরিয়া মতে’ শিরকের মতো গুরুতর অপরাধ। তবে কি তিনি নিজেকে ‘মুসলিম’ মনে করেন না? যদি না করেন তবে তিনি ‘মুসলমানত্বের’ কারণে বোম্বাই ছেড়ে লাহোরে দেশান্তরি হলেন কেন? যদিও চলচ্চিত্রে এরও ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা আছে। বন্ধু শ্যামের জিজ্ঞাসায় তিনি বলেন, ‘আমি মুসলমান কি-না তা বিবেচনার বিষয় নয়; আমার নামই আমাকে হত্যার জন্য যথেষ্ট’। নিজের নামের ‘মুসলমানিত্বের’ ভয়ে প্রাণ রক্ষায় মান্টো বোম্বাই থেকে ১৯৪৮ সালে লাহোরে চলে গেলেন। এতে মান্টোর প্রাণ হয়তো রক্ষা পেল, কিন্তু মান্টো কি রক্ষা পেলেন? এই দ্বিধা না মান্টোর কখনও কেটেছে আর না আমাদের। নন্দিতার চলচ্চিত্রও এই দ্বিধার কোনো সমাধানসূত্র দিতে পারেনি।
নন্দিতা দাসের মান্টো চলচ্চিত্রে সা’দত হাসান মান্টোর জীবনের মাত্র চার বছরের সময়কাল দেখানো হয়েছে। ১৯৪৬ থেকে ১৯৫০। মান্টো প্রয়াত হয়েছেন ১৯৫৫ সালে। মান্টো ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানে চলে যান। সে হিসেবে মান্টোর জীবন ব্রিটিশ ভারতে কাটে ৩৫ বছর। আর পাকিস্তানে জীবনের শেষ ৭ বছর। মান্টোর জন্ম এবং বিকাশ সবই ঘটে ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাব ও বোম্বাই শহরে। বোম্বাই শহর মান্টোর সাহিত্যিক জীবনের সবচেয়ে সক্রিয়তার আবাসস্থল এবং প্রেমও। বোম্বাই শহরের প্রতি তাঁর এই প্রেমকে নন্দিতা তুলে এনেছেন চলচ্চিত্রে। বোম্বাইয়ের সাথে মান্টোর বিচ্ছেদ মান্টো কখনও মেনে নিতে পারেননি। প্রচণ্ড সংবেদনশীল মান্টোর অন্তর বিদীর্ণ হয়েছে এই বিচ্ছেদের বেদনায়। লাহোরে মান্টোর জীবন যেন উদ্বাস্তু জীবনের খণ্ড খণ্ড চিত্র। সেখানে তিনি কখনও স্থির হতে পারেননি। বরং যেন পরিব্রাজকের মতো লাহোরে ঘুরে ঘুরে মান্টো লিখে গেছেন বাস্তুছেঁড়া, বিদীর্ণ মানুষের অন্তরের ক্ষতচিহ্ন।
…
নন্দিতা দাসের
মান্টো
দেশভাগে বিপর্যস্ত
অগণন মানুষের বিপর্যয়ে
জর্জরিত
মান্টো
…
মান্টো বাস্তবকে রাঙাননি। বাস্তবকে তিনি বাস্তবের কঠিন, ধূসর রঙেই এঁকেছেন। মান্টোর সেই সমাজ ও মানুষের চিত্র সমকাল গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিল না। তাই মান্টো বারবার আঘাত পেয়েছেন। উর্দুভাষার সবচেয়ে শক্তিমান গল্পকার সা’দত হাসান মান্টো উর্দুভাষায় লিখেছেন দেশভাগ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, মানুষের অমানুষিক বিপর্যয়ের গল্প। অখণ্ড ভারত ভাগ হয়েছে। ভারত ভাগের সাথে মান্টোর স্মৃতি এবং সত্তা মিশে আছে। অখণ্ড ভারতবর্ষের বাংলা এবং পাঞ্জাব ভাগ হয়ে যাওয়া বিশ শতকের বড় মানবিক বিপর্যয়ের জন্ম দিয়েছে। মানুষকে বাস্তুচ্যুত করেছে। এই অঞ্চলের মানুষের অস্তিত্বকে দ্বি-খণ্ডিত করেছে। মান্টো জন্মেছেন পাঞ্জাবে আর তাঁর আদিনিবাস কাশ্মীর। ফলে মান্টো আক্রান্ত হয়েছেন সমগ্র সত্তায়। কিন্তু নন্দিতা দাসের মান্টো কেবল এই ভূ-রাজনীতিতে অস্তিত্ব হারানো মান্টো নয়। নন্দিতা দাসের মান্টো দেশভাগে বিপর্যস্ত অগণন মানুষের বিপর্যয়ে জর্জরিত মান্টো।
৪.
নন্দিতা দাসের চলচ্চিত্রের গল্পটিতে একটু ভ্রমণ করে আসা যাক এখন। নন্দিতা দাস গল্প শুরু করেন ১৯৪৬ সালের মান্টোকে নিয়ে। যে মান্টো বোম্বাই শহরে বসবাস করেন। সমাজের সবচেয়ে খ্যাতিমান সাহিত্যিক, চলচ্চিত্রকার, চলচ্চিত্রশিল্পী, গায়ক, নায়কদের সাথে নিত্য যাঁর সাক্ষাৎ, আড্ডা এবং কাজ। সে সময়ের আলোচিত লেখক ইসমত চুগতাই, অভিনেতা অশোক কুমার, অভিনেতা ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু শ্যাম চাড্ডার সাথে আড্ডায় মদপানে বোম্বাই শহর চষে ফিরছেন মান্টো। পার্টিতে যাচ্ছেন, রঙিন জমকালো জীবনের প্রবাহে ভাসছেন। কিন্তু সে ভাসমান পরিস্থিতিতেও মান্টো লিখছেন; তবে তা রাজনৈতিক কথিকা নয়। বরং লিখছেন কোনো এক গণিকার জীবনের গভীর নিজস্ব মনোজগতের আলো আঁধারির বিশ্লেষণ। এই লেখা ঠিক ঐ সময়ের সময়োচিত চিত্র কি-না তা নিয়ে আড্ডায় বাকবিতণ্ডা হতে দেখা যায়। কারণ ভারত তখন স্বাধিকার আন্দোলনে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় তুমুল সংগ্রামে লিপ্ত। এই সংগ্রামের উত্তেজনায় মান্টোর অংশগ্রহণ দেখা যায় না। মান্টো জনতার মিছিলের বাইরের বিচ্ছিন্ন, ভগ্ন, ক্ষয়ে যাওয়া মানুষের ছোট ছোট সজীবতার গল্প ধরে রাখতে চেষ্টা করছেন। আপাতভাবে এই ‘বিচ্ছিন্ন মানুষ’ জাতীয় সংগ্রামের হিস্যা নন। তবে জাতীয় সংগ্রাম এই মানুষগুলোর ‘বিচ্ছিন্নতার’ অন্যতম কারণ তা বর্তমান গবেষকগণ গবেষণালব্ধ জ্ঞানে তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় হাজির করছেন।

ফিল্মমেকার । নন্দিতা দাস
মান্টো বয়ে চলেন এই স্বাধীনতা সংগ্রামের ভেতর দিয়ে। নন্দিতা দাসের মান্টো একজন পরিবারকেন্দ্রিক মানুষ। তিনি স্ত্রী সাফিয়াকে প্রচণ্ড ভালোবাসেন। ভালোবাসেন তাঁর সন্তানদের। মান্টো প্রচুর মদপান করেন আর প্রচুর ধূমপান করেন। মান্টো লিখেন চারপাশ নিয়ে। যা তিনি দেখেন, শোনেন। মান্টো গভীর মনোযোগ দেন চারপাশের খুব সাধারণ মানুষের কথকতায়, জীবনে। এই মনোযোগ তাঁর লেখার উপকরণ তুলে দেয় তাঁর পেন্সিলের শীষে।
মান্টো দেখেন তাঁর আশেপাশেই ‘হিন্দু’ ধর্মাবলম্বীরা মানুষ থেকে ‘হিন্দু’ হয়ে যাচ্ছেন, ‘মুসলমান’ ধর্মাবলম্বীরা মানুষ থেকে ‘মুসলমান’ হয়ে যাচ্ছেন। আর ‘অন্য’ ছোট ছোট সংখ্যার ধর্মাবলম্বীরা এই দুই ‘ধার্মিক সম্প্রদায়ের’ আস্ফালনে আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন। দেশের স্বাধীনতার আন্দোলন এক প্রবল সাম্প্রদায়িক রক্তারক্তিতে পরিণত হচ্ছে দেখে সংবেদনশীল মান্টো অস্থির, আতঙ্কিত হয়ে পড়তে থাকেন। তিনি পকেটে হিন্দুদের ‘হিন্দু টুপি’ এবং মুসলমানদের ‘মুসলিম টুপি’ রাখতে শুরু করেন। বন্ধু অভিনেতা অশোক কুমারের নিরাপত্তায় আতঙ্কিত হয়ে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা এড়াতে চেষ্টা করেন– যাতে ‘হিন্দু’ অশোক কুমারের কোনো ক্ষতি না হয়। নন্দিতা দাস তাঁর চলচ্চিত্রে দেখান এই সাম্প্রদায়িক উগ্রতায় বাস্তবিক পরিস্থিতির চেয়েও মান্টো বেশি মাত্রায় ‘আতঙ্কিত’ হয়ে আছেন। এই আতঙ্কজনক পরিস্থিতিতে থেকেও মান্টো স্বাধীনতার আনন্দ পরিবারের সাথে ভাগ করে নেন। ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির রাতের আনন্দ ও আতশবাজি ঘুমন্ত স্ত্রী সন্তানদের জাগিয়ে তুলে দেখান। স্ত্রীর গর্ভের উপর হাত রেখে অনাগত সন্তানকে ‘অভিনন্দন’ জানান যে তাঁর সন্তান ‘স্বাধীন ভারতে’ জন্ম নিতে যাচ্ছে।
কিন্তু এই আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হয় না। পাঞ্জাব ভাগ হওয়ায় বন্ধু শ্যাম চাড্ডার পরিবারের সাথে ঘটে যাওয়া ভয়ঙ্কর ঘটনা বন্ধু শ্যাম চাড্ডাকে মুসলমানবিরোধী মন্তব্য করতে বাধ্য করে। গভীর রাতের ট্রেনে শোকাহত, ক্রোধান্বিত বন্ধুর মুসলমান হত্যার ‘পণ’ শুনে মান্টো গভীরভাবে আহত হন। সংবেদনশীল মান্টো এর কিছুদিন পরেই বোম্বাই থেকে লাহোর অভিমুখে যাওয়া এক জাহাজে আরও হাজার হাজার মানুষের সাথে বোম্বাই ত্যাগ করেন। শুরু হয় মান্টোর লাহোরে বসবাসের সংগ্রাম।
…
অসুস্থ
সন্তানের
প্রেসক্রিপশন
পকেটে নিয়ে মান্টো
মদে বেহুঁশ হয়ে থাকেন
…
মান্টো লাহোরে আর্থিক সঙ্কটে পতিত হন। ‘অশ্লীল গল্প’ লেখার অপরাধে তাঁর বিরুদ্ধে আদালতে মামলা চলতে থাকে। অন্যদিকে অতিরিক্ত মদ্যপান তাঁকে অসুস্থ করে তোলে। আশ্রিত জীবন, শিশু সন্তান ও স্ত্রীর জন্য সম্মানজনক জীবিকা নির্বাহ করতে না পারার চাপ মান্টোকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। আদালতের পাশাপাশি স্থানীয় মানুষ, পত্র পত্রিকা মান্টোর লেখার বিরুদ্ধে বিষদগার করতে থাকে। মান্টো যত বেশি চাপগ্রস্থ হতে থাকেন, ততই মদে আরও বেশি আসক্ত হতে থাকেন। সস্তা মদে আসক্ততা তাঁকে অসুস্থ করে তোলে। জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ কেটে যায়। অসুস্থ সন্তানের প্রেসক্রিপশন পকেটে নিয়ে মান্টো মদে বেহুঁশ হয়ে থাকেন। যখন হুঁশ ফেরে তখন বুঝিবা সংবেদনশীল মান্টোও ফেরেন। পূর্ণ সজ্ঞান ফিরে পান। নিজের কাছে লজ্জিত, বিব্রত মান্টো স্ত্রীর কাছে মদ ছেড়ে দেয়ার অঙ্গীকার করেন। নিজেকে হাসপাতালে বন্দি করেন। হাসপাতালে নিজেকে ফিরে পাওয়ার এই লড়াইয়ের মাঝে শেষ হয় নন্দিতা দাসের মান্টোর চলমান দৃশ্যমালা। যে দৃশ্যে চলচ্চিত্র মান্টোর সমাপন হয় তা মান্টোর গভীর চাহনি ক্যামেরা তথা দর্শকের চোখের বরাবর। যে চাহনিতে বিষন্নতা আছে, স্থিরতা আছে আর আছে জিজ্ঞাসা। অর্ন্তভেদী লক্ষ্যভেদী দৃশ্য। যেন অর্জুনের গাণ্ডীব থেকে ছোঁড়া কোনো লক্ষ্যভেদী বাণ।

ফিল্মমেকার । নন্দিতা দাস
৫.
নন্দিতা দাস একজন প্রথাবিরোধী চলচ্চিত্রশিল্পী। চলচ্চিত্রযাত্রার শুরু থেকেই তিনি তাঁর অভিনয়ে সে প্রথাবিরোধিতার চিহ্ন রেখেছেন। চলচ্চিত্র নির্মাণযাত্রায় নন্দিতা দাস আরও বলিষ্ঠ, আরও সংহত। চলচ্চিত্রের জন্য মান্টো একটি কঠিন বিষয়। সে কঠিন বিষয়টিকে নন্দিতা এতটা সক্ষমতার সাথে মোকাবেলা করবেন তা ভাবিনি। নন্দিতা দাসের মান্টো চলচ্চিত্রের ট্রিটমেন্ট খুবই বুদ্ধিবৃত্তিক ও উপভোগ্য এবং অস্বস্তিকর।
বুদ্ধিবৃত্তিক, কারণ মান্টো চলচ্চিত্রে নন্দিতা মান্টোর জীবনের ঘটনাগুলোকে গেথে দিয়েছেন মান্টোর সৃষ্টি ফিকশনাল চরিত্র ও ঘটনার মিশেলে। যে চলচ্চিত্র দর্শক মান্টোর সাহিত্য সম্পর্কে অজ্ঞান, তাঁরা এই মিশেলে হারিয়ে যাবেন সত্য ও কাল্পনিক চরিত্রসমূহের প্রামাণিক উপস্থাপনায়। বুঝতে পারবেন না কোথায় চলচ্চিত্র গল্পে আর কোথায় ইতিহাসের বাস্তব সড়কে হাঁটছে! তবে তাতে দর্শকের মান্টোকে অনুভব করতে অসুবিধা হবে না। তাঁরা বরং মান্টোকে জানবেন আরও গভীরভাবে। হয়তো সামগ্রিকভাবে।
…
যে সময়ের
গল্প মান্টো লিখেছেন
আর নন্দিতা যা আমাদের দেখাতে
চেয়েছেন.
তা সমাজ
ও সময়ের গায়ে
লেগে থাকা আমাদের অতীত কৃতকর
…
এই চলচ্চিত্র ভীষণ উপভোগ্য এবং অস্বস্তিকর। উপভোগ্যতা তৈরি হয়েছে নির্মাণ কুশলতায়। চিত্রনাট্যের সরসতায়। গল্প এবং বাস্তব মান্টোর উপস্থাপনার নান্দনিক বৈভব চলচ্চিত্রটির বিশাল সম্পদ। এক মুহূর্তও চোখকে ক্লান্ত করে না। মনোযোগকে ব্যহত করে না। অথচ যা দেখবার তা দেখার বাসনা চোখকে বিরাম দেয় না, দেখা হয়ে গেলে শ্রুতি-দৃশ্যগুলো মননে গভীর আঘাতরূপে হাজির হয়। মানুষের বিচিত্র জীবন আর বিচিত্রতর তার মনোজাগতিক আঘাত। চলচ্চিত্রটি দেখা হলে না ভেবে আপনার উপায় নেই। চোখের সামনে যখন দৃশ্যগুলো উপস্থিত হবে, তখন তা না দেখে আপনার বাসনার তৃপ্তি নেই। এমনি এক দৃশ্য-শব্দমালার দুনিয়া গড়েছেন নন্দিতা দাস।
চলচ্চিত্রটি অনেকখানি অস্বস্তিকর। অস্বস্তিকর, কারণ যে সময়ের গল্প মান্টো লিখেছেন আর নন্দিতা যা আমাদের দেখাতে চেয়েছেন তা সমাজ ও সময়ের গায়ে লেগে থাকা আমাদের অতীত কৃতকর্ম। আমরা শোভন কাপড়ে অনায়াস ভঙ্গিতে যে সভ্যতার চেকনাই দেখাই তা গড়ে উঠেছে অগণন মানুষের অশ্রু, রক্ত আর অস্থিমজ্জায় ঢালাই হয়ে; অথচ সে দমন পীড়নের শেষ হ নি। আজও একইভাবে একই রকম অশ্রু, রক্ত আর মানুষের হাড় পড়ে থাকে রাজপথে, গলিতে, গ্রামে, শহরে।

ফিল্মমেকার । নন্দিতা দাস
৬.
নন্দিতা দাসের চলচ্চিত্র মান্টো অনেক সুন্দর ঠাসবুনোটে গড়া। গবেষণা ও চিত্রনাট্য উভয় কাজটি নন্দিতা করেছেন অধিকতর যত্নে এবং দক্ষতায়। মান্টো চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি সা’দত হাসান মান্টোর পরিবার। মান্টো সমাজের সাথে লড়েছেন, মান্টো আদালতে লড়েছেন– এসব সকলেই জানে। সকলে মান্টোর গল্প পড়ে। মান্টোর সৃষ্ট চরিত্রগুলোকে মানুষ খুব ভালো করেই জানে।
গত অর্ধ-শতাব্দিকাল ধরে উপমহাদেশের ও বিশ্বের পাঠকগণ মান্টোর মনোজগতের অলি-গলি ঘুরে এসেছেন, বিশ্লেষণ করেছেন এবং করে চলেছেন। কিন্তু কেউ নন্দিতা দাসের মতো এত দরদ দিয়ে সা’দত হাসান মান্টোর স্ত্রী, সন্তানদের যাপনের এমন বিশ্বস্ত দৃশ্যমালা তৈরি করেননি। মান্টোর স্ত্রী সাফিয়াকে আমরা এমনভাবে পেয়েছি সম্ভবত নন্দিতা দাসের কারণেই। নন্দিতা দাস সত্যিকারের অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে মান্টোর অবয়ব তুলে ধরতে চেয়েছেন। একজন লেখক কেমন করে লিখে চলেন তাঁর অসাধারণ সৃষ্টিকর্ম? লেখকও তো মানুষ। আর মানুষ বলেই তাঁর অনেক কিছুর প্রয়োজন হয়। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় অনুপ্রেরণা ও সাহস। প্রয়োজন হয় লিখতে পারার মতো, ভাবতে পারার মতো অনুকূল পরিবেশ। মান্টোর জন্য তা গড়ে দিয়েছেন তাঁর স্ত্রী সাফিয়া। মান্টোর জীবনে তাঁর স্ত্রীর ভূমিকা মানুষের দেহের মেরুদণ্ডের মতো। চলচ্চিত্রটিতে তা বারবার দেখা গেছে। মান্টোর সৃষ্টিশীল যাপনের ভরকেন্দ্ররূপে সাফিয়া হাজির থেকেছেন পুরো সময়জুড়ে। নন্দিতা দাস মান্টো তৈরিতে বাহিরের পাশাপাশি এই যে গৃহের দিকেও গেলেন সমান গুরুত্ব দিয়ে, তাতে চলচ্চিত্রটি পূর্ণতা পেয়েছে। দর্শক হিসেবে আমরা মান্টোকে তাঁর সামগ্রিকতাসহ অনুভব করতে পেরেছি।

ফিল্মমেকার । নন্দিতা দাস
৭.
নন্দিতা দাসের গল্প বলার পদ্ধতি সুন্দর। চলচ্চিত্র মান্টো শুরু হয় একজন কিশোরী যৌনকর্মীর একটি গল্প দিয়ে। গল্পটির নাম দশ রুপিয়া। সা’দত হাসান মান্টোর লেখা একটি বিখ্যাত গল্প। কিশোরীকে একদিনের জন্য ভাড়া করেন তিন জন ‘সাহেব’ পুরুষ। প্রতিজন কিশোরীকে দশ রুপি করে দেবেন। দিন শেষে যখন কিশোরীকে তাঁর গলিতে ফিরিয়ে দিতে আসেন পুরুষ তিনজন, তখন একজন যিনি গাড়িটি চালাচ্ছেন তিনি ছাড়া অন্য দুই পুরুষ ‘দলিত-মথিত ক্লান্ত’ হয়ে গাড়ির পেছনের আসনে ঘুমাচ্ছিলেন। সামনের আসন থেকে নামার সময় কিশোরী তাঁর কোমরে গোঁজা দশ টাকার একটি নোট বের করে গাড়ি চালক পুরুষটির দিকে ছুঁড়ে দিয়ে হাসতে হাসতে গলির ভেতরে ঢুকে যায়। পরের দৃশ্যে আমরা দেখি একটি ‘দলিত-মথিত ক্লান্ত’ দশ টাকার নোট গাড়ির সামনের খালি সিটে পড়ে আছে। গাড়িচালক পুরুষটি একবার টাকার নোটটিকে দেখে আর একবার দেখে পেছনের আসনে আলুথালু হয়ে ঘুমন্ত দুই পুরুষকে। সিকোয়েন্সটি শেষ হয়।
কিশোরী একজন প্রাণোচ্ছল নারীর এই যে টাকা ফিরিয়ে দেওয়া– এ খুব সরল দৃশ্য নয়। টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার এই দৃশ্যের পর ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্কটি আর আগের মতো থাকে না। কে কার ‘সেবা’ কিনে নিলো তা অনুচ্চারিত থাকলেও তা সরলভাবে দর্শকের বোধে ‘ধাক্কা’ দেয়। এই ‘ধাক্কা’টি আজ থেকে প্রায় ৬০/৭০ বছর আগে সা’দত হাসান মান্টো দিয়েছিলেন এই উপমহাদেশে। সেই ‘ধাক্কা’ সামলানো কি আজও সম্ভব হয়েছে উপমহাদেশের প্রবল পুরুষতান্ত্রিক সমাজমননে?
…
একজন
লেখকের জীবনের
পারিপার্শ্বিক ঘটনাগুলো
লেখককে কিভাবে
আক্রান্ত করে
তা
ছোট ছোট
দৃশ্যঘটনায়
গেঁথে একটি সুবিন্যস্ত
মালা গেঁথেছেন নন্দিতা দাস
…
নন্দিতা দাস এভাবে একের পর এক সা’দত হাসান মান্টোর গল্পের চরিত্রকে হাজির করেছেন মান্টোর জীবনের নানা বাঁকে। মাত্র পৌনে দুই ঘন্টায় নন্দিতা মান্টোর ৪ বছরের যাপনের ঘটনাবলির রেখাচিত্রের সাথে সাথে মান্টোর মনোজগতের প্রায় অধিকাংশ চরিত্রকে মান্টোর সাথে এবং আমাদের সাথে দেখা করিয়ে দেন। একজন লেখকের জীবনের পারিপার্শ্বিক ঘটনাগুলো লেখককে কিভাবে আক্রান্ত করে তা ছোট ছোট দৃশ্যঘটনায় গেঁথে একটি সুবিন্যস্ত মালা গেঁথেছেন নন্দিতা দাস। এ কেবল যদি মান্টোর জীবনী হতো, তবে হয়তো আমরা মান্টোর মনোজগতের খোঁজ কখনও পেতাম না। মান্টোর খুলির ভেতরে নিউরনে কি অনুরণন চলছে তা দেখানোর জন্যই নন্দিতা আমাদেরকে মান্টোর সৃষ্ট চরিত্রগুলোর সাথে সাক্ষাৎ করান। সেই সাক্ষাৎপর্ব আমাদের জন্য মনোমুগ্ধকর হয়েছে।
৮.
মান্টো একটি সুনির্মিত চলচ্চিত্র। একেবারে নিখুঁত নয়। তবে সুনির্মিত। একমাত্র নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী ছাড়া বাকি প্রায় সকলেই ভীষণ পরিমিত অভিনয় করেছেন। ভারতের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের বড় বড় তারকার এমন ছোট ছোট কার্যকর চরিত্রে অভিনয় আর কখনও দেখিনি।
ঋষি কাপুর, পরেশ রাওয়াল এবং নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকীর মতো মেইনস্ট্রিম চলচ্চিত্রের তারকাদের সমাবেশ মান্টোকে ‘বিকল্প’ চলচ্চিত্রের অভিধা পেতে দেয়নি। মান্টো অবশ্যই ভারতের মেইনস্ট্রিম চলচ্চিত্র। বলিউডে স্বয়ং নন্দিতা দাসের যে স্টারডর্ম তাতে তিনি আমাদের বললেও আমরা আস্থাবান হবো না যে তিনি একটি ‘বিকল্প’ পথের অনুসারী। ভারতের মেইনস্ট্রিম সিনেমার এমনসব রাঘব-বোয়ালদের নিয়েও নন্দিতা দাস একটি সৎ চলচ্চিত্র নির্মাণের পথে হেঁটেছেন এবং সেই পথে তিনি সফলও হয়েছেন। এটাই চলচ্চিত্র মান্টোর জন্য এক বিশাল সাফল্য।

ফিল্মমেকার । নন্দিতা দাস
লেখক হিসেবে সা’দত হাসান মান্টো যে পরিমাণ বিতর্কিত এবং তাঁর রচনাসমূহ মেইনস্ট্রিম সাহিত্যিক বাজারে যে পরিমাপে অস্বস্তি উৎপাদন করে, তার পরেও নন্দিতা দাস তাঁকে নিয়ে মেইনস্ট্রিম চলচ্চিত্র কাঠামোকে ব্যবহার করে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে ফেলেছেন– এটা ভারতের বর্তমান প্রবল সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতাপের বাতাবরণে একটি বড় চলচ্চিত্র অ্যাকটিভিজম বলে মনে করি। উপমহাদেশের ধর্মীয় রাজনীতির মেরুকরণে নন্দিতা দাসের মান্টো স্বয়ং এক ডিসকোর্সরূপে হাজির হবার যোগ্যতা রাখে। কেননা ব্যক্তি মান্টো তাঁর লেখনিতে এবং আইনি লড়াইয়ে এই ধর্মভিত্তিক রাজনীতির অসাড়তা এবং জাতীয়তাবাদের কাঠামোকে বারবার চ্যালেঞ্জ করেছেন। মান্টো ব্যক্তিমানুষের নিরঙ্কুশ স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে গেছেন। তাঁর সেই লড়াইকে বিবেচনা করলে আজ উপমহাদেশের তিনটি দেশ [ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ] ব্রিটিশ অখণ্ড ভারতের চেয়ে বেশি পরিমাণে অসহিষ্ণু, ধর্মীয় দিক থেকে বেশি পরিমাণে গোঁড়া এবং ব্যক্তির বাক ও চিন্তার স্বাধীনতা আজ আরও বেশি পরিমাণে রুদ্ধ।
নন্দিতা দাসের মান্টো থিসিস তাই যতখানি মান্টোকে খোঁজার অভিপ্রায়ে চালিত হয়েছে, তারচেয়ে অধিক অভিপ্রায় সম্ভবত বর্তমান ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতি ও সমাজনীতির দিকে দৃষ্টি রেখে তৈরি হয়েছে। তাতে চলচ্চিত্রটি প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। ইতিহাসের আয়নায় নিজেদের ‘উন্নয়ন’ আর ‘বিকাশ’-এর প্রকৃত স্বরূপখানি নিরীক্ষা করবার সুযোগ পাওয়া গেছে। সেজন্য নন্দিতা দাসকে আমরা ধন্যবাদ তো দিতেই পারি!
৯.
নন্দিতা দাসের মান্টোতে অভিনয় করেছেন বহু মানুষ। উপরে যেমনটি বলেছি যে নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী ছাড়া বাকি সকলেই অত্যন্ত কার্যকর অভিনয় করেছেন। অল্প সময়ের জন্য পরেশ রাওয়াল গণিকার দালালের যে চরিত্রটি করেছেন তা দেখে এই আফসোস তো উঠবেই যে পরেশ রাওয়ালকে ব্যবহার করবার মতো চলচ্চিত্র নির্মাতা হয়তো এখনও খুব বেশি পাওয়া গেল না। কি নিষ্ঠুর আর রুক্ষ একটি চরিত্র তিনি করেছেন। তেমনিভাবে দিব্যা দত্তের অভিনয়টুকু ঠিক ততখানি আবেদনময় ও আগ্রাসী হয়েছে যতখানির বর্ণনা মান্টো লিখেছেন তাঁর অতি বিখ্যাত ঠাণ্ডা গোশত-এর গল্পে। শ্যাম চাড্ডার ভূমিকায় তাহির রাজ বাসিন এবং ইসমত চুগতাইয়ের ভূমিকায় রাজেশ্বরী দেশপান্ডে মনে রাখবার মতো নিখুঁত অভিনয় করেছেন। ইসমত চুগতাইয়ের ভূমিকায় রাজেশ্বরী দেশপান্ডে খুব সামান্য সময় পেয়েছেন পর্দায় উপস্থিতির, কিন্তু ওইটুকু সুযোগকেই তিনি দৃষ্টির কটাক্ষ, স্মিত হাসি আর তীর্যক বাক্যবাণে মাত করে ছেড়েছেন। মাত্র একটি সিকোয়েন্সে পর্দায় দেখা গেছে জাভেদ আখতারকে, কোর্টে মান্টোর পক্ষে সাফাই সাক্ষি হিসেবে। তাঁকে কি চেনা যায় হঠাৎ করে? কি চমৎকার অভিনয়! চলচ্চিত্র মান্টোজুড়ে মুগ্ধ হয়েছি এমন অনেক ছোট ছোট দৃশ্য নির্মাণের কুশলতায়।
নন্দিতা দাসের মান্টোতে সবচেয়ে নিখুঁত, সবচেয়ে সুন্দর আর সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর অভিনয় করেছেন রাসিকা দুগাল। মান্টোর স্ত্রীর ভূমিকায় তিনি অনবদ্য অভিনয় করেছেন। মান্টো চলচ্চিত্রে তাঁর অভিনয় ‘মেথড অ্যাকটিং’-এর দারুণ উদাহরণ হয়ে থাকবে।
…
অনেক
বড় বড়
সংলাপ একটানা
নওয়াজ যেভাবে বলেছেন
তাতে
আবৃত্তির
সুখ পেয়েছি,
কিন্তু মান্টোর পীড়া,
মান্টোর দ্রোহ, মান্টোর
ক্ষোভ তাতে বিচ্ছুরিত হয়নি
…
নন্দিতা দাসের মান্টোতে মান্টো চরিত্রে নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকীর অভিনয় দারুণ কার্যকর হয়েছে। মান্টো চরিত্রে নওয়াজ খুব ভালোও করেছেন। কিন্তু কেন যেন নওয়াজের এই অভিনয় ছবিজুড়ে কোথাও কোথাও ক্লান্তি তৈরি করেছে। নওয়াজের অভিনয় কোথাও কোথাও টিপিঁক্যাল নওয়াজের মতো উপস্থিত হয়েছে। নওয়াজের সংলাপ থ্রোয়িং যতখানি অভিঘাত তৈরি করতে পারার কথা ততখানি হয়নি। অনেক বড় বড় সংলাপ একটানা নওয়াজ যেভাবে বলেছেন তাতে আবৃত্তির সুখ পেয়েছি, কিন্তু মান্টোর পীড়া, মান্টোর দ্রোহ, মান্টোর ক্ষোভ তাতে বিচ্ছুরিত হয়নি। এ কথা ঠিক যে অবয়বের দিক থেকে নওয়াজ অনেকখানি মান্টোর কাছাকাছি পৌঁছেছেন। কিন্তু মান্টোর সৃষ্টিশীল ব্যক্তিত্বের রেশ নওয়াজ ততখানি ধারণ করতে পেরেছেন বলে মনে হয়নি। সন্দেহ নেই নওয়াজ ভালো অভিনয় করেছেন। অনেক ভালো অভিনয় হয়েছে। কোথাও কোথাও যেমন নওয়াজের অভিনয় ক্লান্তি তৈরি করেছে, ঠিক তেমনি কোথাও কোথাও নওয়াজের অভিনয় নওয়াজকে ছাড়িয়ে গেছে কিন্তু মনে যেন অতৃপ্তিটুকু ঠিকই টের পেয়েছি। নওয়াজের আরও কিছু হয়তো করার ছিল। হয়তো তাঁর আরও একটু যত্নশীল চেষ্টা চরিত্রটিকে চিরকালীন করতে পারত। এখন যে মান্টো হয়েছে, তাতে এটা নওয়াজের সেরা অভিনয়শৈলীর উদাহরণ– এমনটি বলতে পারছি না।
এই যে এত এত খ্যাতিমান প্রবীণ- নবীন অভিনয়শিল্পীদের সমাবেশ, তা কি নির্মাতা নন্দিতা দাসের স্টারডম নয়? আর তাদের ব্যবহারের এবং তাদের প্রত্যেকের ম্যানারিজমকে বাদ দিয়ে কেবলমাত্র চরিত্রের প্রয়োজনটুকু বুঝে অভিনয় আদায় করা, এটা কি নির্মাতার নিজের অভিনয়ের সাথে দীর্ঘকাল যুক্ততার কারণেই নয়? মান্টো দেখা শেষে যখন ভাবতে বসেছি, তখন মনে হয়েছে নন্দিতা দাসের নামের পাশে ‘সোস্যাল অ্যাক্টিভিস্ট’-এর সিরিয়াসনেসটুকু, তাঁর ‘পারফেশনিস্ট আর্টিস্ট’-এর সুনামটুকু এবং বলিউডের নামজাদা স্টার হিসেবে তাঁর সম্মানটুকু চলচ্চিত্রকার নন্দিতা দাস খুব দক্ষতার সাথে ব্যবহার করতে পেরেছেন। একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের প্যাশন থেকে তিনি তাঁর সবটুকু দক্ষতা, যোগ্যতার এমন সম্মিলিত ব্যবহার করতে পেরেছেন যে, তা সব মিলিয়ে একটি মনে রাখবার মতো চলচ্চিত্রের জন্ম দিয়েছে।

ফিল্মমেকার । নন্দিতা দাস
১০.
চলচ্চিত্রকার আদতে এক জাদুকর। তিনি সময়কে নির্মাণ করতে পারেন। ২০১৮-তে জাদুকর নন্দিতা দাস আমাদের দেখান ১৯৪৬ থেকে ১৯৪৮-এর বোম্বাই এবং ১৯৪৮ থেকে ১৯৫০-এর লাহোর। বোম্বাই শহরের অলিগলি, বাড়িঘর, দোকানপাট, রেল স্টেশন, জাহাজঘাঁটা, আলো ঝলমলে চল্লিশের দশকের পার্টি, কফিশপ, মদের দোকান, ফুটপাতের পানের দোকান, ঘোড়ার গাড়ি, চল্লিশের সব মোটরগাড়ি, মানুষজন, তাদের পোশাক-আশাক আরও কি নয়! আস্ত দুটো শহর আমাদের চোখের সামনে মূর্ত হয়ে ওঠে। আশ্চর্য্যের বিষয়, সবকিছু ভীষণ বিশ্বস্ত; সবকিছু ভীষণ সত্যের মতো! কিন্তু আমরা জানি এসব কোনোটাই সত্য নয়। এগুলো সব বানানো। সত্যের প্রয়োজনে চলচ্চিত্রকারগণ এভাবে মিথ্যা তৈরি করেন। বিভ্রম তৈরি করেন সত্য দেখাবেন বলে। তাই এসব খুব পরিকল্পিতভাবে বানানো হয়েছে। একে প্রোডাকশন ডিজাইন বলে। মান্টো চলচ্চিত্রে এই কাজটি করেছেন রীতা ঘোষ। তিনি এ চলচ্চিত্রের জন্য বোম্বাই ও লাহোর শহর তৈরি করেছেন। প্রোডাকশন ডিজাইনের পাশপাশি অত্যন্ত ভালো কাজ করেছেন এই চলচ্চিত্রের কস্টিউম ডিজাইনার শীতল শর্মা এবং মেকআপ আর্টিস্টগণ। ছবিটিকে বিশ্বস্ত করে তুলতে এই কাজগুলো অভিনয়শিল্পীদের পাশাপাশি একই রকম ভূমিকা রেখেছে।
মান্টো ছবির সিনেমাটোগ্রাফারের কাজটি করেছেন কার্তিক বিজয়। নির্দিষ্ট করে এমন কোনো দৃশ্য নেই যেখানে কার্তিক বিজয় ব্যর্থ হয়েছেন অথবা খুব চমকপ্রদ কিছু করেছেন। চলচ্চিত্রটির যে আবহ তৈরি হয়েছে তাতে তাঁর ভূমিকা অশেষ। এই যে চমকে দেবার মতো কোনো দৃশ্য ছবিটিতে নেই– এটাই কার্তিক বিজয়ের সাফল্য। যদিও তাঁর এই কাজটি মোটেও সহজ ছিল বলে মনে করি না। কারণ মান্টো কোনো সরলরেখা ধরে অগ্রসর হয় না। এর গল্পবলার ভঙ্গিটি এমনি যে, তাতে দৃশ্য পরিকল্পনার ধারাবাহিক সরলতা রক্ষা একটু জটিল হবারই কথা। চলচ্চিত্রটি দেখবার কালে মনে হয়েছে, এইসব ঘটনাস্থলে দর্শক হিসেবে আমি উপস্থিত আছি। দশর্কের জন্য এমন সুবিধাজনক দৃষ্টিকোণ বেছে নেওয়া নির্মাতা ও সিনেমাটোগ্রাফারের চমৎকার যুগলবন্দি সাফল্য।

নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী, নন্দিতা দাস এবং ক্রু
মান্টোর সম্পাদনা সিনেমাটোগ্রাফারের কাজের মতোই জটিল হবার কথা। কিন্তু তেমন বড় রকম কিছু চোখে পড়েনি যা খুব আনাড়ি কাজ মনে হতে পারে। গল্পের প্রয়োজনে অনেক কিছু রাখতে হয়েছে চলচ্চিত্রে, নাহলে হয়তো আরও কিছু দৃশ্য ফেলা দেওয়া যেত– এমন কিছু দৃশ্য ছবিটিতে আছে। তবে তার দায় চলচ্চিত্রটির সম্পাদক শ্রীকর প্রাসাদের নয়। দৃশ্য রাখা বা না রাখার দায় চলচ্চিত্র নির্মাতার। তাই চলচ্চিত্র সম্পাদক শ্রীকর প্রাসাদের সম্পাদনা যে চলচ্চিত্রটির গাঁথুনিকে মজবুত করতে পেরেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
চলচ্চিত্র মান্টোর সঙ্গীত এবং আবহসঙ্গীতের পরিমিত ব্যবহার ভীষণ ভালো লেগেছে। বিশেষ করে আবহসঙ্গীতের মৃদু ও কার্যকর প্রয়োগ চলচ্চিত্রটির দৃশ্যগত অভিঘাতকে জোরালো করতে পেরেছে। চলচ্চিত্রে সঙ্গীতের অত্যাধিক ব্যবহার ভারতের চলচ্চিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অন্যতম স্মারক। কিন্তু মান্টোতে এই স্মারকের ব্যবহার কান ও মনকে পীড়া দেয়নি। যতটুকু প্রয়োজন ঠিত ততটুকুই হয়তো ব্যবহার হয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে। ব্যক্তির রুচি ও সহ্য ক্ষমতার মাত্রাভেদে এই ‘যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকু’র মান নির্ণয় হয়।
মান্টোয় গান ব্যবহারের ক্ষেত্রে নন্দিতা দাস নিঃসন্দেহে লোভ সংবরণ করতে পেরেছেন। কেননা উপমহাদেশে গত শতাব্দীর চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে হিন্দি-উর্দু গানের যে মহাসমারোহ হয়েছে, এমনটা আর কখনই হয়নি। সা’দত হাসান মান্টো গল্পকার, চিত্রনাট্যকার হিসেবে চলচ্চিত্র দুনিয়ার ভেতরের মানুষই ছিলেন। সে কারণে মান্টোয় আট-দশটি গানের পূর্ণ বা আংশিক অংশ দিয়ে বাজার ধরার একটি চেষ্টা হতে পারত। কিন্তু স্বস্তির বিষয় এটাই যে, তা হয়নি। যা হয়েছে তা চলচ্চিত্রটির সাথে খুব ভালোভাবে গিয়েছে এবং দর্শকদের জন্য চলচ্চিত্রটির ভাব অনুভবে সহজতা এনেছে।
মান্টোয় মোট ৫টি গানের অংশবিশেষ ব্যবহৃত হয়েছে। খুব স্বল্পভাবে গানগুলোর পুরোনো ভাব ও গায়কী বজায় রেখে সঙ্গীত পরিচালনার জন্য স্নেহা খানওয়ালকার ধন্যবাদ পাবেন। পাশপাশি আবহসঙ্গীতের এমন সুন্দর পরিকল্পনা ও প্রয়োগের জন্য জাকির হোসেনও ধন্যবাদ পাবেন। আর মান্টো চলচ্চিত্রে শব্দগ্রহণ ও শব্দবিন্যাসের এমন চমৎকার কাজের জন্য অস্কারজয়ী রসূল পুকুট্রিকে স্যালুট জানাতে হবে। সার্বিকভাবে চলচ্চিত্রটির শব্দবিন্যাস ভালো হয়েছে। দুুই একটি দৃশ্যে শব্দের ব্যবহার এমন চমৎকার অনুভূতি দিয়েছে যে প্রকৃতঅর্থে দৃশ্যটির দ্যোতনায় বাড়তি অনুভব যুক্ত হয়েছে। একটি দৃশ্যে ‘নওয়াজরূপী মান্টো’ যখন সিগারেটে জোরে টান দেন, তখন স্পষ্ট শুনতে পেলাম সিগারেটের ভেতরের তামাকপাতা পোড়ার মৃদু অথচ নিখুঁত শব্দ!
ঢাকার বাংলা একাডেমির প্রধান মিলনায়তনে নিশ্চয়ই চলচ্চিত্রের উপযোগী সাউন্ড সিস্টেম থাকবে না। তেমনটা আশাও করি না। কিন্তু এই মিলনায়তনের শব্দযন্ত্রেই যদি এমন শব্দের ইফেক্ট পেতে সক্ষম হই, তবে আমি নিশ্চিত এই চলচ্চিত্রের প্রকৃত রস্বাসাদনের জন্য প্রকৃত উন্নতমানের সিনেমা-হলে চলচ্চিত্রটি দেখবার অপেক্ষায় থাকতে হবে।

ফিল্মমেকার । নন্দিতা দাস
১১.
চলচ্চিত্র মান্টো নন্দিতা দাসের স্টেটমেন্ট। যা মান্টোর লেখায়, মান্টোর জীবনের জার্নিতে তিনি খুঁজে পেয়েছেন। মান্টো প্রকৃতঅর্থে কোন দেশের মানুষ? মান্টো কোন ধর্মের নিষ্ঠাবান অনুসারী? এসব বিষয়ে মান্টো দেশ, ধর্মের সীমানা ভাঙ্গতে চেয়েছেন। কিন্তু ভাঙ্গতে পারেননি। মান্টোকে তাঁর লিখবার স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে হয়েছে বোম্বাই এবং লাহোরে। মান্টোকে মামলা লড়তে হয়েছে দেশকে ভাগ করার আগে এবং পরে। মান্টো কি মুক্তি পেয়েছেন শেষ পর্যন্ত?
নন্দিতা দাস তেমন কোনো মীমাংসা দেখাননি। দেখানো তাঁর কাজও নয়। যেমনটি মান্টোও মনে করেন। মান্টো বলেন, তাঁর লেখা সমাজের জন্য আয়নাস্বরূপ। সেই আয়নায় সমাজ তার মুখ দেখতে পায়। যদি সমাজের মুখ কুৎসিত হয়, তবে আয়নার কি দোষ? মান্টো বলেন, সমাজের কাপড় খোলা তাঁর কাজ নয়। সমাজ আগে থেকেই ন্যাংটো হয়ে আছে। তিনি সমাজের কাপড় পরানোর দায় নিতে রাজি নন।
…
মান্টো
সময়কে
প্রতিনিধিত্ব
করেছেন মানুষের
অন্তর্গত বেদনায় সঙ্গী
হয়ে। আজকের দিনের নন্দিতা দাস
তাই
তাঁর
জীবনের
জার্নিতে নিজস্ব
লড়াইয়ের শক্তি খুঁজে পান
…
মান্টোর লেখা সহ্য করতে না পারা সমাজ আজ কি মান্টোকে সহ্য করতে পারছে? মান্টো তাঁর সমকালে রাজনৈতিক উত্তাপের গল্প লেখেননি। তিনি লিখেছেন মানুষের একান্ত নিজস্ব দুঃখ, বেদনা, হাহাকারের গল্প। সেই যুগের রাজনৈতিক উত্তাপ বহু আগেই মিটে গেছে। রয়ে গেছে মান্টোর লেখা মানুষের গল্পগুলো। মান্টো সময়কে প্রতিনিধিত্ব করেছেন মানুষের অন্তর্গত বেদনায় সঙ্গী হয়ে। আজকের দিনের নন্দিতা দাস তাই তাঁর জীবনের জার্নিতে নিজস্ব লড়াইয়ের শক্তি খুঁজে পান।
বাংলাদেশেও মান্টো ভীষণ প্রাসঙ্গিক। আজকের দিনের বাংলাদেশে যদি মান্টো বেঁচে থাকতেন, তবে তাকে লিখবার অপরাধে মামলা লড়ার সুযোগ দেওয়া হতো না। তার আগেই তার মাথা কেটে নিত ধর্মীয় উগ্রবাদীরা। অথবা বিনাবিচারে জেলে পুরে দিত রাষ্ট্রযন্ত্র বা সরকার। আর যদি এসব থেকে মান্টো বাঁচতে চাইতেন, তবে মান্টোকে ঢাকা বা চট্টগ্রাম বা বাংলাদেশের যেকোনো শহর ছেড়ে পালাতে হতো ইউরোপ অথবা আমেরিকার কোনো দেশে। যেমন পালাতে বাধ্য হয়েছেন এ যুগের মান্টোরূপী বাংলাদেশের লেখক, কবি, সাহিত্যিক বা ব্লগারগণ।
মান্টো ভারতেও আজ ভীষণ প্রাসঙ্গিক। লেখার অপরাধে ভারতেও খুন হচ্ছেন মানুষ। জেলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন বা পালাতে বাধ্য হচ্ছেন ভারতের অনেক প্রগতিশীল লেখক, কবি, অ্যাকটিভিস্ট। যেমন পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন সেই যুগের মান্টো। প্রিয় আলো ঝলমলে শহর বোম্বাই ছেড়ে, প্রিয় বন্ধুদের ছেড়ে মান্টোকে চলে যেতে হয়েছে ধূসর লাহোরে। নন্দিতা দাস তাঁর চলচ্চিত্রের রঙের বিন্যাসে এই টিট্রমেন্ট ব্যবহার করেছেন। খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলে চোখে পড়ে মান্টোর জীবনের লাহোর পর্বের ধূসরতা এবং বোম্বাই পর্বের বর্ণাঢ্য রঙ।
নন্দিতা দাসের মান্টো শেষ হয় মান্টোর লেখা অবিস্মরণীয় গল্প টোবা টেক সিং-এর মর্মান্তিক দৃশ্যমালা দিয়ে। চলচ্চিত্রে দেখা যায়, মান্টো তখন মদের আসক্তি দূর করতে লাহোরের এক মানসিক হাসপাতালে ভর্তি আছেন। সেখানে হঠাৎ আসে একদল পুলিশ। সাথে ট্রাক। হাসপাতালের মানসিকভাবে অসুস্থ হিন্দুদের ভারতে পাঠাতে পুলিশ হিন্দু পাগলদের ধরে ধরে ট্রাকে তুলতে থাকে।

ফিল্মমেকার । নন্দিতা দাস
পাকিস্তান ও ভারতের মাঝে দুই দেশের মুসলমান ও হিন্দু পাগল বিনিময় কর্মসূচির অংশ হিসেবে তাদের ভারতে পাঠানো হবে। লাহোর মানসিক হাসপাতালে একজন পাগল আছেন। যাঁর নাম বিষাণ সিং। তিনি টোবা টেক সিং গ্রামের মানুষ। তিনি ভারত বা পাকিস্তান চেনেন না। আর টোবা টেক সিং গ্রাম কোথায় তাও কেউ জানে না। পুলিশ তাঁকে জোর করে ট্রাকে তুলে দেয়। বিষাণ সিংকে ভারতের কাছে হস্তান্তরের সময় বিষাণ সিং ভারতের সীমান্তরক্ষীকে জিজ্ঞাসা করেন– ‘টোবা টেক সিং’ কোথায়; ভারতীয় রক্ষী বলেন, টোবা টেক সিং পাকিস্তানে। আর পাকিস্তানের সীমান্তরক্ষী বলেন, টোবা টেক সিং ভারতে। এই দোলাচালে বিষাণ সিং একবার ভারতের দিকে আর একবার পাকিস্তানের দিকে দৌড়ে হঠাৎ মাঝামাঝি জমিতে পড়ে মারা যান। না তিনি ভারতের অংশে মারা গেছেন, আর না তিনি পাকিস্তানের অংশে। তিনি মারা গেছেন নো ম্যানস ল্যান্ডে। তাই কেউই বিষাণ সিংয়ের লাশের দায় নিতে অগ্রসর হয় না। বিষাণ সিং পড়ে থাকেন দুই দেশের সীমানার মাঝ বরাবর। তাঁর দুটি পা দুই দেশের দিকে ছড়ানো থাকে। দৃশ্যটি টপশটে প্রলম্বিত হয়। একটা বিষণ্ন আবহ তৈরি হয় দৃশ্যজুড়ে। এই প্রলম্বিত দৃশ্যের পর আমরা দেখি ভাঙ্গাচোরা চেহারার সা’দত হাসান মান্টো ক্যামেরার দিকে তাঁর তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছেন। চলচ্চিত্রটি শেষ হয় এই দৃষ্টিবানে বিদ্ধ হয়ে।
দর্শক হিসেবে আমরা কোথায় দাঁড়াই? বিষাণ সিং আর সা’দত হাসান মান্টোকে আলাদা করা যায় কি? ভারত ভাগ কি বিষাণ সিংয়ের মতো সা’দত হাসান মান্টোকেও উদ্বাস্তু করেনি? মান্টোর অন্তর পড়ে রয় বোম্বাই শহরে আর মান্টো শারীরিকভাবে থাকেন লাহোরে। মান্টোর জীবন ‘টোবা টেক সিং’ গ্রামের মতো অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে ভারত ও পাকিস্তানে। যখন মান্টোর ‘জীবন’ ছিল, তখন ভারত আর পাকিস্তান ছিল না। মান্টো পাকিস্তানের নাগরিক হন আর তাঁর জীবনের পুরোটা জুড়ে থাকে পাঞ্জাব, বোম্বাই– যা তখন অন্য কোনো দেশ। বিদেশ।
নন্দিতা দাস এক শেকড়চ্যুত মানুষের মর্মবেদনার গভীরে যেতে চেয়েছেন। সম্ভবত আমরা বাংলার মানুষেরা এই মর্মবেদনার স্বরূপ আরো আগেই দেখেছি দেশভাগের যন্ত্রণায় দগ্ধ বাঙালি চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক কুমার ঘটকের চলচ্চিত্রে। মান্টো আর ঘটক যেন একই বেদনার ভারবাহী। একজন বাংলাভাগের যন্ত্রণায় দগ্ধ হন আর অন্যজন পাঞ্জাব এবং ভারত ভাগের যন্ত্রণায়।
চলচ্চিত্রকার নন্দিতা দাস সমকালীন উপমহাদেশের সকল প্রবণতার জবাবে মান্টো গড়ে তুলেছেন। মান্টো আজকের উপমহাদেশের মানুষের জন্য এক অসামান্য মানবিক চলচ্চিত্র। আর এভাবেই সা’দত হাসান মান্টোও পুনরুজ্জীবিত হলেন নন্দিতা দাসের নান্দনিক শৈল্পিক নির্মাণে।
মান্টো নির্মাতা নন্দিতাকে ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা!

ফিল্মমেকার । নন্দিতা দাস
পুনশ্চ :
বাংলাদেশের বৃহত্তর দর্শকের জন্য এ অনেক দুঃখের যে আপনারা সিনেমা-হলে মান্টো দেখতে পারবেন না। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ব্যবসায়ীরা সস্তা, চটুল আজেবাজে চলচ্চিত্র আমদানি করবে, কিন্তু নন্দিতা দাসের মান্টো আমদানি করবে না। আর উপমহাদেশের ভাষায় নির্মিত চলচ্চিত্র বাংলাদেশে মুক্তির বিধিনিষেধ আরোপকারী যে আইন বা অধ্যাদেশ আছে সেটাও এ ধরনের চলচ্চিত্র বাংলাদেশের দেখার ও দেখানোর জন্য একটি প্রতিবন্ধকতা। এই বাজে আইন বা অধ্যাদেশটি বাতিল করা প্রয়োজন। সারা পৃথিবীর এবং উপমহাদেশের সকল চলচ্চিত্রের জন্য আমাদের ঘরের দরজা খুলে দেওয়া দরকার। নিজেদের ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে কূপমুন্ডুকতায় আর কতদিন?
এ ধরনের চলচ্চিত্র পাইরেসি করা লো রেজুলেশনের ফাইল ল্যাপটপ বা ডেস্কটপে দেখার জন্য নয়। ভালোমানের সিনেমা-হলে ঠিকঠাক প্রজেকশন ও সাউন্ড সিস্টেমে এ ধরনের চলচ্চিত্র দেখার যে মননগত অভিঘাত– তা ল্যাপটপ বা ডেস্কটপে হয় না। বরং অনেক ভালো কাজ ওভাবে দেখার ফলে চলচ্চিত্রটির স্বাদ বিস্বাদে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এসব দিক বিবেচনায় বাংলাদেশের মানুষের উচিত চলচ্চিত্র দেখবার অধিকারের প্রশ্নে সরব হওয়া। চলচ্চিত্র কেবল চলচ্চিত্র ব্যবসায়ীদের জন্য নয়। চলচ্চিত্র দর্শকেরও অধিকারের বিষয়। আমরা তেমন অধিকারবোধ সম্পন্ন চলচ্চিত্র দর্শকের প্রত্যাশা করি।
অত্যন্ত মূল্যবান আলোচনা। বাংলা ভাষায় চলচ্চিত্র চর্চার একটি অবশ্যপাঠ্য রচনা।
খুব মূল্যবান আলোচনা। সমালোচনা ও বিশ্লেষণ যথাযথ হয়েছে। ভালো থাকবেন।