সাক্ষাৎকার । কেনেথ টাইনান
অনুবাদ । রুদ্র আরিফ
অরসন ওয়েলস [৬ মে ১৯১৫–১০ অক্টোবর ১৯৮৫]। আমেরিকান মাস্টার ডিরেক্টর ও অভিনেতা। থিয়েটার, রেডিও ও সিনেমা– তিন মাধ্যমেই সৃজনী শিল্পগুণের কারণে তিনি বিখ্যাত। তার ‘সিটিজেন কেইন’কে অনেকেই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সিনেমা হিসেবে গণ্য করে…

প্রথম কিস্তি
কেনেথ টাইনান
আপনি তো ৩০ বছর ধরে [১৯৬৭ সালের হিসেবে] সেলেব্রিটি। এ সময়ের মধ্যে, আপনার সম্পর্কে কারও দেওয়া সবচেয়ে নির্ভুল বর্ণনা কোনটি?
অরসন ওয়েলস
আমি চাই না আমার সম্পর্কে কোনো ‘বর্ণনা’ই নির্ভুল হোক; বরং তা চাটুকারধর্মী হোক– এমনটাই আমার চাওয়া। যে মানুষগুলোকে পেটের ভাতের জন্য গলাবাজি করতে হয়, তাদের বর্ণনা কখনোই সত্য হবে বলে আমি মনে করি না– তা সেটি ছাপার অক্ষরেই হোক না কেন। আমাদেরকে [সিনেমার] টিকেট বেচতে হয়; ফলে প্রশংসামূলক রিভিউগুলো আমাদের দরকার পড়েই।
কেনেথ টাইনান
ব্যক্তিগত আলাপচারিতায়, নিজের সম্পর্কে শোনা কোন কথাটি আপনাকে সবচেয়ে বেশি খুশি করেছে?
অরসন ওয়েলস
রুজভেল্ট [ফ্র্যাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট : মার্কিন প্রেসিডেন্ট] বলছিলেন, আমার পক্ষে নাকি তুখোড় একজন রাজনীতিবিদ হওয়া সম্ভব ছিল। ব্যারিমোর [লায়নেল ব্যারিমোর : মার্কিন অভিনেতা] বলেন, চ্যাপলিন আর আমি জীবিত অভিনেতাদের মধ্যে সবচেয়ে দুর্দান্ত। বলছি না, এসব কথা আমি ‘বিশ্বাস’ করি; তবে আপনি ‘খুশি’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন বলেই বললাম। যে জিনিসগুলোর সঙ্গে আমি মূলত কিংবা এমনকি পেশাগতভাবেও সম্পৃক্ত নই– নিজের কাজের উপরিভাগ নিয়ে এমন চাটুকারধর্মিতা আমি সত্যিকারঅর্থেই উপভোগ করি। যখন কোনো বুড়ো বুলফাইটার আমাকে বলেন, ষাড়গুলোকে বুঝতে পারা গুটিকয়েক মানুষের মধ্যে আমি একজন, কিংবা যখন কোনো জাদুকর আমাকে বলেন আমি একজন ভালো জাদুকর– তা আমার অহমে এমন এক সুড়সুড়ি দেয়, যেটির সঙ্গে বক্সঅফিসের কোনোই সম্পর্ক নেই।
কেনেথ টাইনান
আপনাকে নিয়ে যত মন্তব্য করা হয়েছে– লিখিত কিংবা মৌখিক– এর মধ্যে কোনটি আপনাকে সবচেয়ে বেশি অসন্তুষ্ট করেছে?
অরসন ওয়েলস
মুখের কথার সঙ্গে কোনো লেনদেন নেই আমার। আমি কেবল লিখিত কথাকেই গোণায় ধরি। যেমন ধরুন, আমাকে নিয়ে এ পর্যন্ত ওয়াল্টার কের [আমেরিকান সমালোচক] যা যা লিখেছেন। নিজের সম্পর্কে খারাপ যা কিছুই পড়ি, তা যে সত্য নয়– সেটি নিজেকেই বিশ্বাস করাতে ভীষণ প্রচেষ্টার মধ্যে আমাকে ঠেলে দিই আমি। মুদ্রিত লেখার প্রতি একটি মৌলিক শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে আমার– নিজের সম্পর্কে, বিশেষত নেতিবাচক কোনো কিছু যখন লেখা হয়। মনে পড়ে, যখন আমি ডেনভারে [যুক্তরাষ্ট্রের কলোর্যাডো রাজ্যের রাজধানী] থাকি, ১৮ বছর বয়সে ক্যানডিডায় [মঞ্চনাটক; জর্জ বার্নার্ড শ; ১৮৯৪] মার্চব্যাঙ্কস চরিত্রে আমার অভিনয় নিয়ে লেখা হয়েছিল, ‘যেন বাসো প্রোফান্দোতে [ব্যতিক্রমধর্মী লো-রেঞ্জে গান গাওয়া কোনো বেজ গায়ক] কোনো সামুদ্রিক গরু ঘোঙাচ্ছে’। এটি ৩০ বছরেরও আগের কথা; সেই রিভিউটি এখনো আমার অক্ষরে অক্ষরে মনে আছে। ভালো কোনো রিভিউ আমি মনে করতে পারি না কখনো। হয়তো খারাপগুলো ভীষণ রকম ব্যথা দেয় মনে, আর ভীষণ বিষাদগ্রস্ত করে তোলে; বোধহয় এ কারণেই এতটা পথ পাড়ি দিয়ে আসতে হয়েছে আমাকে। রেডিও, সিনেমা ও থিয়েটারে আমি অ্যাকটর-ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেছি; ফলে আমার সম্পর্কে যা কিছু লেখা হয়, তা আমার অর্থনৈতিক নির্ভরতার ওপর সরাসরি একটি প্রভাব ফেলে। এ কারণে এগুলো কতটুকু অস্বাস্থ্যকর প্রভাব ফেলতে পারে, সেই ভাবনায় উদ্বিগ্ন হই আমি। কিংবা এটি হয়তো অত্যধিক সংবেদনশীলতার পক্ষে কোনো সাফাইমাত্র।

কৈশোরে
কেনেথ টাইনান
সমালোচকদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে আপনি একবার অভিযোগ তুলেছিলেন : ‘তারা আমার কাজের নয়, বরং আমারই রিভিউ করেন।’ আপনার কি মনে হয়, এ কথা এখনো সত্য?
অরসন ওয়েলস
হ্যাঁ। তবে আমি মনে করি, এ ব্যাপারটি নিয়ে আমার না ঘাটানোই ভালো। আমার সম্পর্কে এইসব হাস্যকর মিথ চালু আছে বলেই তো আমি বেশ ভালো উপার্জন করি, আর প্রচুর পরিমাণ কাজ পাই করার জন্য। কিন্তু এর দাম আমাকে দিতে হয় তখন, যখন আমি সিরিয়াস কিছু করার চেষ্টা করি, এমন কিছু– যেটির প্রতি আমার যত্ন রয়েছে, আর প্রচুরসংখ্যক সমালোচক আসলে সেই বিশেষ কাজটি নয়, বরং অনেকাংশে আমাকে নিয়েই রিভিউ লিখেন। নিজেদের মানদণ্ডে অরসনের নমুনা নিয়ে লিখেন তারা। হোক সেটি ভালো নমুনা কিংবা খারাপ– তাদের মানদণ্ডে পড়ে যায় উভয়ই।
কেনেথ টাইনান
স্পেশালাইজেশন ক্রমবর্ধনের এ যুগে আপনি প্রায় প্রতিটি শিল্পমাধ্যমেই নিজেকে প্রকাশ করেছেন। কখনোই কি স্পেশালাইজ হতে চাননি?
…
আমি
মনে করি
না আমাদের
যুগের সকল ফাটল
সারিয়ে দেওয়ার কাজটি
স্পেশালিস্টের ওপরই নির্ভর করে
…
অরসন ওয়েলস
না; নিজেকে সীমাবদ্ধ করে দেওয়ার কথা ভাবতেও পারি না আমি। এ ভীষণ লজ্জার ব্যাপার, আমরা স্পেশালিস্টের যুগে বসবাস করছি; আমি মনে করি, তাদেরকে [স্পেশালিস্ট বা বিশেষজ্ঞ] আমরা অতিরিক্তই শ্রদ্ধা জানাই। এ জীবনে আমি চার-পাঁচজন অসাধারণ ডাক্তারকে চিনি-জানি; তারা আমাকে সবসময়ই বলে আসছেন, ঔষধ এখনো রয়ে গেছে আদিম পর্যায়ে, এবং এটি সম্পর্কে তাদের জানাশোনা নিতান্তই কম। জীবনে আমি অসাধারণ ক্যামেরাম্যান মাত্র একজনকেই চিনি– গ্রেগ টোল্যান্ড [আমেরিকান সিনেমাটোগ্রাফার]– যিনি সিটিজেন কেইন-এ ক্যামেরা চালিয়েছেন। তিনি বলেছিলেন, আমাকে চার ঘণ্টায় ক্যামেরার সবকিছু শিখিয়ে দিতে পারবেন; তিনি তা পেরেছেনও। আমি মনে করি না আমাদের যুগের সকল ফাটল সারিয়ে দেওয়ার কাজটি স্পেশালিস্টের ওপরই নির্ভর করে।

অ্যাকটর ও ফিল্মমেকার । অরসন ওয়েলস
কেনেথ টাইনান
আজকাল কি কারও পক্ষে রেনেসাঁ-মানব হওয়া সম্ভব– যে শিল্প ও বিজ্ঞান– উভয় সম্পর্কেই সমান জ্ঞান রাখবে?
অরসন ওয়েলস
এটি সম্ভব, এবং এটি আসলে দরকারও; কেননা, সংশ্লেষণই আমাদের সামনে আজকাল বড় সমস্যা হয়ে ঝুলছে। এ সকল বিক্ষিপ্ত জিনিসপত্র আমাদেরকে একসঙ্গে জড়ো করতে, এবং এগুলোকে অর্থবহ করে তুলতে হবেই। কোনো একমুখী রাস্তায় উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়ানো তো সবচেয়ে বুনো উন্মাদনার সামিল। আমাদের ব্যক্তিগত মনোদিগন্তকে যতটা সম্ভব প্রশস্ত করে তোলা কেবল ব্যক্তিমানুষেরই নয়, বরং সমাজের জন্যও মঙ্গল। সত্যিকারঅর্থেই জীবিত ও প্রকৃতই কৌতুহলী– এমন কোনো সাধারণ বুদ্ধিমান মানুষ যদি কোনোকিছু শিখতে না পারে, তাহলে সেই শিক্ষাটির আসলেই কোনো মূল্য নেই। যেমন ধরুন, এলিজাবেথিয়ান পিরিয়ডের নাটক সম্পর্কে কিছু জানার তুলনায়, আমি মনে করি, পরমাণু বিভাজনের মূলতত্ত¡গুলোর ব্যাখার ওপরও ছুরি মারতে চালাব আমি– তা হবে আজকের দুনিয়ায় বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট ভালো এক ছুরিকাঘাত। আমি স্রেফ বলব না : ‘এই রহস্যটি কেবল বিজ্ঞানীদের ওপরই ছেড়ে দেওয়া উচিত।’ নিশ্চয়ই বলছি না, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার কোনো মুখ্য পদে অধিষ্ঠ হওয়ার জন্য আমি প্রস্তুত রয়েছি।
কেনেথ টাইনান
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে, আপনি বেশির ভাগ সময় আমেরিকার বাইরেই কাজ ও বসবাস করছেন। নিজেকে কি একজন ‘দেশান্তরি’ বলে ডাকবেন?
অরসন ওয়েলস
এই শব্দটি আমার পছন্দ নয়। শৈশব থেকেই নিজেকে সবসময় এমন এক আমেরিকান হিসেবে গণ্য করি– যে কোনো স্থানে বাস করার অধিকার যার রয়েছে। ‘দেশান্তরি’ [‘এক্সপেট্রিয়েট’] একটি সেকেলে শব্দ– বিশেষ করে ১৯২০ দশকের প্রজন্মের, এবং বিদেশে বসবাসকারীর প্রতি একটি রোমান্টিক মনোভাবের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এ রকম ঘটনার চেয়ে বরং এই শব্দটির বিরুদ্ধে আমি পক্ষপাতদুষ্ট। একজন আমেরিকান নাগরিক হিসেবে কোনো একদিন আমি হয়তো ভীষণ ভালোভাবেই ক্ষান্ত হতে পারতাম; তবে এ স্রেফ এ কারণে, যে, আপনি যদি ইউরোপে কোনো প্রোডাকশন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন, তাহলে এটি আপনাকে একজন ইউরোপিয়ান হয়ে ওঠতে অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করবে। নিজের দেশের জন্য সৈন্য হিসেবে নিয়োজিত হওয়ার মতো যথেষ্ট তরুণ আমি আর এখন নই; ফলে যেখানে ভালোলাগে এবং যেখানে আমি কাজ বেশি পাই– সেখানেই কেন থাকব না? সবচেয়ে বড় কথা, লন্ডন তো হাঙ্গেরিয়ান, জার্মান ও ফরাসি মানুষে ভরা; আর আমেরিকা তো ‘সবাই’তে [সব দেশের মানুষে] ভরা– ‘ তাদের’কে তো দেশান্তরি বলে ডাকা হয় না।
কেনেথ টাইনান
আপনার ১৯৪৬ সালের ব্রডওয়ে প্রোডাকশন অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ-এর কারণে আপনি যে লোকসানের মুখে পড়েছেন, সেটির ট্যাক্স কমানোর প্রস্তাব আমেরিকান সরকার প্রত্যাখ্যান করেছে বলেই আপনি ইউরোপে থাকছেন– এ কথা কি সত্য নয়?

অরসন ওয়েলস
ট্যাক্স-সংক্রান্ত ঝামেলাগুলো তখন শুরু হয়েছে ঠিকই, তবে আমার ইউরোপে পাড়ি জমানোর কারণ এটি নয়। যত টাকা লোকসান করেছি, তা সরকারকে মিটিয়ে দিয়েই এতগুলো বছর আমি ইউরোপে কাটিয়েছি; ভুল-ভাল হিসাবরক্ষণের কারণে এটিকে তারা আমাকে লোকসান হিসেবে লিখতে দেয়নি। ইউরোপে বাস করতে ভালোলাগে আমার; আমি কোনো শরণার্থী নই।
কেনেথ টাইনান
আপনি তো ক্যাথলিক নন, তবু দুটি ভীষণ রকম ক্যাথলিক রাষ্ট্রে থাকারই সিদ্ধান্ত নিলেন– প্রথমে ইতালিতে, আর এখন স্পেনে। কেন?
…
স্বাভাবিক
ফূর্তি ছাড়া,
মৃত্যুর উপস্থিতিকে
অবলীলায় নিতে জানা
ছাড়া যদি কোনো সমাজ থেকে
থাকে,
সেখানে
আমি যথেষ্ট
স্বস্তিবোধ করি না
…
অরসন ওয়েলস
এর সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের সংস্কৃতি অপেক্ষকৃত অধিক উদার; কম-পীড়িত। স্বাভাবিক ফূর্তি ছাড়া, মৃত্যুর উপস্থিতিকে অবলীলায় নিতে জানা ছাড়া যদি কোনো সমাজ থেকে থাকে, সেখানে আমি যথেষ্ট স্বস্তিবোধ করি না। ইংমার বারিমনের মতো শিল্পীদের একেবারেই উত্তরাঞ্চলীয়, একেবারেই প্রোটেস্ট্যান্ট জগতটিকে আমি দোষারোপ করি না; বরং আমি স্রেফ এমন কোথায়ও থাকি না– এই যা। সুইডেনে ঘুরতে যেতে অবশ্য খুবই মজা লাগে আমার। তবে বারিমনের সুইডেন আমার কাছে সবসময়ই ইবসেনের [হেনরিক ইবসেন : নরওয়েজিয়ান নাট্যকার] নরওয়ে সম্পর্কে হেনরি জেমস [আমেরিকান-ব্রিটিশ লেখক] যা বলেছিলেন, সে কথাটি মনে করিয়ে দেয়; মানে, এ ‘পরমার্থিক মোমবাতির ঘ্রাণে’ একেবারেই ঠাসা। এটির প্রতি এমনই করুণাবোধ করি আমি!
কেনেথ টাইনান
জন্মানোর জন্য যদি যে কোনো সময়কাল ও রাষ্ট্র বেছে নিতে পারতেন, তাহলে ১৯১৫ সালের আমেরিকাকে কি বেছে নিতেন?
অরসন ওয়েলস
আমার তালিকায় এটি অতটা নিচের দিকে না থাকলেও, সেভাবে ভাবলে কেউ নিশ্চয়ই গ্রিসের স্বর্ণযুগে, পঞ্চদশ শতকের ইতালি কিংবা এলিজাবেথান যুগের ইংল্যান্ডে জীবনযাপন করার কথা ভাবতেই পারে। আরও কিছু স্বর্ণযুগও ছিল। পারস্যের একটি ছিল, আর চীনের ছিল চার-পাঁচটি। আমাদেরটি এক অসাধারণ যুগ ঠিকই, তবে এটিকে আমার কাছে দেখতে রৌপ্যযুগও মনে হয় না। আমার ধারণা, অন্য কোনো যুগে ও স্থানে জন্মালেই বোধ হয় আমি আরও বেশি হাসিখুশি ও আরও বেশি তৃপ্ত থাকতে পারতাম– এমনকি আমেরিকার সে যুগটিতেও, যখন আমরা তাঁবুর বদলে মাথার ওপর ছাউনি তুলতে শুরু করেছিলাম।
কেনেথ টাইনান
আমেরিকান ইতিহাসের কোনো ব্যক্তিত্বের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পান?
অরসন ওয়েলস
অধিকাংশ আমেরিকানের মতো আমিও কামনা করি, যদি আমার ভেতর [আব্রাহাম] লিংকনের কিছু থাকত : কিন্তু আমার তা নেই। এমন কোনো সাধুত্বের কিংবা অনুকম্পার সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে আমি ভাবতেও পারি না। আমার ধারণা, একমাত্র যে মহান আমেরিকানটির ভূমিকায় নিজেকে হয়তো ভেবে নিতে পারতাম– তিনি টম পাইন [যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা]। তিনি একজন সহজাত, একজন সত্যিকারের স্বাধীন মানুষ ছিলেন– তা অবশ্য বর্তমান সময়ের স্বাধীনতাবোধের স্বস্তিকর কোনো নিরিখে নয়, বরং প্রকৃতই মঙ্গলজনক ও দুরূহ বোধের নিরিখে– যেটির জন্য তিনি কারাগারে যেতেও ছিলেন প্রস্তুত। এ আমার ভাগ্য, হোক তা ভালো কিংবা খারাপ– আমাকে এমন কোনোকিছু বেছে নিত্যে বাধ্য হতে হয়নি।

কেনেথ টাইনান
আপনার বয়স যখন ছয় বছর, আপনার বাবা-মার বিচ্ছেদ ঘটে যায়; তবে আপনি মায়ের সঙ্গে ব্যাপক পথ ভ্রমণ করলেও, তিনি মারা যান দুই বছর পরেই। এরপর আপনি পৃথিবীর নানাপ্রান্তে বাবার সঙ্গে ঘুরে বেড়ান; আপনার ১৫ বছর বয়সে মারা যান তিনিও। অল্পবয়সের এই দুনিয়াজুড়ে চরকি খাওয়ার দিনগুলোর মধ্যে কোন জায়গাগুলো সবচেয়ে স্পষ্টভাবে মনে আছে?
অরসন ওয়েলস
১৯২৬ সাল থেকে শুরু করে তিনটি বছর বেশ ভালো কেটেছিল বার্লিনে [জার্মানি]; একই সময়ে শিকাগোর [যুক্তরাষ্ট্র] দিনগুলোও ভালোই কেটেছে। তবে সর্বশ্রেষ্ঠ শহরগুলো ছিল নিশ্চিতভাবেই– বুডাপেস্ট [হাঙ্গেরি] ও বেইজিং [চীন]। শেষ অবধি সেরা আলাপ আর বেশিরভাগ কর্মযজ্ঞ ওসব জায়গারই। তবে ১৯২০ দশকের মধ্যভাগের কোনো এক সময় টাইরয়ের [অস্ট্রিয়া] কোনো এক জায়গার এক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের কথা আমি ভুলতে পারি না। আরও কয়েকজন ছোট্ট বালকের সঙ্গে এক পদভ্রমণে বেরিয়েছিলাম আমি; আমাদের শিক্ষক আমাদেরকে বড় এক ওপেন এয়ার বিয়ার গার্ডেনে নিয়ে গিয়েছিলেন খাওয়ানোর জন্য। লম্বা যে টেবিলটি ঘিরে বসেছিলাম আমরা, সেখানে প্রচুর নাৎসিরাও ছিলেন। তারা তখন খুবই অল্প পরিচিত একদল পাগলা লোক। আমি বসেছিলাম ভীষণ অনুজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের এক ছোটখাট লোকের ঠিক পাশে। সে সময় আমার মনে কোনো ছাপ ফেলতে পারেননি তিনি; তবে পরে, যখন তার ছবিগুলো দেখেছিলাম, বুঝতে পারলাম, আমি আসলে অ্যাডলফ হিটলারের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজ সেরেছিলাম সেদিন।
কেনেথ টাইনান
[২ এপ্রিল ১৯২৭–২৬ জুলাই ১৯৮০]
লেখক ও সমালোচক । যুক্তরাষ্ট্র
উৎস ।। প্লেবয় ম্যাগাজিন । ১৯৬৭
অনুবাদটির প্রথম প্রকাশ ।। ইত্তেফাক ঈদ ম্যাগাজিন । ২০১৮
[…] প্রথম কিস্তি পড়তে, এই বাক্যে ক্লিক করু… […]