লিখেছেন । বেলায়াত হোসেন মামুন
মানুষের অনেক জীবন থাকে। বাইরের ও ঘরের। মানুষের অনেক পরিচয় থাকে। অনেক রকম কাজের অনেক রকম পরিচয়। মুহম্মদ খসরুর জীবন একটাই ছিল। তা চলচ্চিত্রে সমর্পিত। তিনি জীবনকে চলচ্চিত্রে অর্পণ করে নিজেই হয়ে উঠেছেন চলচ্চিত্র। মুহম্মদ খসরুর ঘরও চলচ্চিত্র, বাহিরও চলচ্চিত্র ছিল। যে জীবন তিনি যাপন করেছেন পাকিস্তান ও বাংলাদেশ সময়কালে– তা কেবল চলচ্চিত্রকে ভালোবাসবার জন্য এবং চলচ্চিত্রকে এই দেশের মানুষকে ভালোবাসাবার জন্য নিবেদিত ছিল। তিনি সংগঠক ছিলেন, ছিলেন লেখক, ছিলেন বাংলাভাষার অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র পত্রিকার সম্পাদক। আর এসব কাজই তিনি করেছেন চলচ্চিত্র-সংস্কৃতির জন্য। চলচ্চিত্রকে আমাদের দেশে ‘সংস্কৃতি’ করে তুলবার যে লড়াই, তা মূলত কিছু মানুষের জীবনব্যাপি কাজের পুণ্যফল। সেই গুটিকয় মানুষের মাঝে মুহম্মদ খসরু হলেন অন্যতম দিকপাল।

জন্ম । ১৯৪৬ [মতান্তরে, ১৯৪৮]
প্রয়াণ । ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯
[ছবি : মীর শামছুল আলম বাবু]
১.
মুহম্মদ খসরু গত শতাব্দীর উত্তাল ষাটের দশকে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন শুরু করেন। পূর্ব-বাংলায় চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন বা ফিল্ম সোসাইটি মুভমেন্ট শুরু করার বিষয়ে যারা উদ্যোগী হয়েছিলেন, তারা প্রায় সকলেই ছিলেন চলচ্চিত্রপ্রেমী ব্যস্ত মানুষ। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৩ এর মধ্যে ঢাকায় বেশ কিছু উদ্যোগের খতিয়ান আমাদের সামনে হাজির করেছেন চলচ্চিত্র গবেষক অনুপম হায়াৎ। তাতে যাদের নাম আমরা দেখি, তারা আর যাই হোন, ‘চলচ্চিত্র আন্দোলন’ করবার অভিপ্রায়ে তৎপর ছিলেন না। তারা ‘সুস্থ’ চলচ্চিত্র দেখতে ও দেখাতে তৎপরতার জন্য চলচ্চিত্র সংসদ করবার চিন্তা করেছিলেন। সেইসব উদ্যোগের অনেকগুলোই স্বল্পায়ু ছিল। মাত্র একটি উদ্যোগ পরবর্তীকালে দাঁনা বেঁধে উঠেছিল। আর তা হলো ‘পাকিস্তান চলচ্চিত্র সংসদ’। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর যা ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ’ নামে সুপরিচিত। ১৯৬৩ সালের ২৫ অক্টোবর এ সংসদটি গঠিত হয়। গঠনকালে যাঁদের নাম পাওয়া যায়, তারা সেইকালের প্রতিষ্ঠিত সব মানুষ। যাঁদের কেউই চলচ্চিত্র সংসদ ‘আন্দোলন’ করবার সময় ও শ্রম দেওয়ার অবস্থায় ছিলেন না। এইসব প্রতিষ্ঠিত ও ব্যস্ত মানুষ প্রতিটি সংগঠনেই থাকেন। যারা মূলত সেইসব সংগঠনগুলোর শোভা ও আর্থিক সহযোগিতার কেন্দ্ররূপে বিবেচিত হন। কিন্তু সকল সংগঠনেই সত্যিকারের কাজ করেন কিছু ‘অন্য’ মানুষেরা। যারা তুলনামূলকভাবে বয়সে ছোট, তরুণ, নতুন এবং আবেগে টইটম্বুর। এসব প্রাণিত তরুণদের শ্রম, ঘাম এবং সময়ের কাঁধে চড়ে বাংলার সংগঠনগুলো বড় হয়, সক্রিয় থাকে এবং গড়ে তোলে সাংগঠনিক ঐতিহ্যের শক্ত আবরণ। পাকিস্তান ফিল্ম সোসাইটির ক্ষেত্রেও এমনই ব্যাপার ঘটেছিল। সেই সময়কার দৈনিক পত্রিকার প্রতিবেদনে যাদের নাম প্রকাশিত হয়েছিল, তাদের কাউকেই পরবর্তীকালে চলচ্চিত্র সংসদ ‘আন্দোলনে’ সক্রিয়ভাবে দেখা যায়নি। দেখা গেছে যাকে, সেই ‘অন্য’ মানুষ হলেন মুহম্মদ খসরু।
বয়সে তখন অনেক তরুণ মুহম্মদ খসরু। ১৯৪৬-কে [যদিও জন্ম তারিখটি নিশ্চিত নই। কারণ কোনো কোনো সূত্রে মুহম্মদ খসরুর জন্মসাল হিসেবে ১৯৪৮-এর উল্লেখ পাওয়া যায়] মুহম্মদ খসরুর জন্মসাল ধরলে ১৯৬৩ সালে মুহম্মদ খসরুর বয়স দাঁড়ায় ১৭ বছর এবং ১৯৪৮ জন্মসাল ধরলে বয়স দাঁড়ায় মাত্র ১৫ বছর। ‘পাকিস্তান ফিল্ম সোসাইটি’র জন্মলগ্নে থেকেই মুহম্মদ খসরু নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ছিলেন– এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। এই সংসদটির উদ্যোক্তা হিসেবে যাদের নাম আলোচিত, তাতে সদ্যতরুণ মুহম্মদ খসরুর নীতিনির্ধারকের ভূমিকায় থাকতে পারাটা একটু বিস্ময়কর লাগে। ধারণা করি ১৯৬৩-তে যাত্রা শুরু করে বেশ খানিকটা সময় এই সংসদের তেমন কোনো সক্রিয় কার্যক্রম না থাকায় পরবর্তীকালে তরুণতর মুহম্মদ খসরুর শরণাপন্ন হন তুলনামূলক জেষ্ঠ্য সদস্যগণ। মূলত মুহম্মদ খসরুর দায়িত্বগ্রহণের পর থেকেই সক্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করে ‘পাকিস্তান চলচ্চিত্র সংসদ’। ১৯৬৮ সালে মুহম্মদ খসরুর চলচ্চিত্র পত্রিকা ধ্রুপদীর প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। তখন মুহম্মদ খসরুর বয়স মাত্র ২২ বছর।

[ছবি সংগৃহীত; ফটোগ্রাফারের নাম জানা গেলে জুড়ে দেওয়া হবে]
২.
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্বে পূর্ব-পাকিস্তানে মাত্র দুটি চলচ্চিত্র সংসদ সক্রিয় ছিল। পাকিস্তান ফিল্ম সোসাইটি ও ঢাকা সিনে ক্লাব। একটির নেতৃত্বে ছিলেন ওয়াহিদুল হক ও মুহম্মদ খসরু আর অন্যটির নেতৃত্বে ছিলেন আলমগীর কবির। যদিও আলমগীর কবির লন্ডন থেকে ঢাকায় আসার পর ১৯৬৭ সালে ‘পাকিস্তান ফিল্ম সোসাইটি’র সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এর মাত্র দুই বছর পর ১৯৬৯ সালে আলমগীর কবির [এবং লায়লা সামাদ] ‘ঢাকা সিনে ক্লাব’ প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দান করেন।
মূলত পূর্ব-বাংলায় চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন সত্যিকারের আন্দোলনে রূপ নেয় বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর। মুক্তিযুদ্ধের পর সদ্যস্বাধীন দেশে তরুণ চলচ্চিত্রকর্মীদের উদ্যোগে ও তৎপরতায় চলচ্চিত্রকে চিন্তা ও মননশীলতার সর্বাধুনিক মাধ্যমরূপে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়। আর এই প্রক্রিয়াটি রাতারাতি হয়নি। কিছু মানুষের জীবন নিঃশেষ করে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ‘সংস্কৃতি’রূপে কিছুটা স্থান করে নিতে পেরেছে আজকের বাংলাদেশে। স্বাধীনতার পর যখন একের পর এক অনেকগুলো চলচ্চিত্র সংসদ গঠিত হয় এবং তারুণ্যের উদ্দীপনার নানাবিধ কার্যক্রমে সক্রিয় হয় তখন পৃথক চলচ্চিত্র সংসদগুলোকে একত্র করে একটি ফেডারেশন গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ফেডারেশন গঠনের উদ্যোগের কারণ ছিল প্রধানত চলচ্চিত্র সংসদগুলোর কাজকে সমন্বয় করা। প্রতিটি পৃথক চলচ্চিত্র সংসদের কার্যক্রমকে সমন্বয় ও গতিশীল করার চিন্তা থেকেই ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশ [এফএফএসবি] গঠিত হয় ১৯৭৩ সালে। আর এই ফেডারেশন গঠনের প্রধান উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন আলমগীর কবির, মুহম্মদ খসরু ও বাদল রহমান। এ সকল চিন্তা ও তৎপরতার ক্ষেত্রে সর্বক্ষেত্রে মুহম্মদ খসরুর ভূমিকাকেই প্রধান ভাবতে হবে। কারণ মুহম্মদ খসরু ছিলেন একমাত্র ‘ফুলটাইমার’ চলচ্চিত্র সংসদ নেতা ও কর্মী। ফলে যে কোনো উদ্যোগে সর্বপ্রথম তিনিই সক্রিয়তম মানুষ ছিলেন।

তারুণ্যে
[ছবি সংগৃহীত; ফটোগ্রাফারের নাম জানা গেলে জুড়ে দেওয়া হবে]
…
মুহম্মদ খসরু
ছিলেন একমাত্র
‘ফুলটাইমার’ চলচ্চিত্র
সংসদ নেতা ও কর্মী।
ফলে
যে কোনো
উদ্যোগে সর্বপ্রথম
তিনিই সক্রিয়তম মানুষ ছিলেন
…
চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের প্রাথমিক সেই পর্বে গুটিকয় উদ্যমী মানুষের উদ্দীপনাময় কর্মকাণ্ডেই গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র-সংস্কৃতির বাতাবরণ। দুঃখজনক যে, সে বাতাবরণে সবসময় ঐকমত ও একতা স্থায়ী হয়নি। মতবিরোধ ও ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ সবসময় এই আন্দোলনকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ফেডারেশনের ইতিহাস এই মতবিরোধের সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ। ১৯৭৩ সালে গঠিত ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশ-এর [এফএফএসবি] নেতৃবৃন্দদের সাথে মতবিরোধকে কেন্দ্র করে ১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে কয়েকটি চলচ্চিত্র সংসদ একত্রিত হয়ে পৃথকভাবে গঠন করে বাংলাদেশ ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ [বিএফএফএস]। বাংলাদেশ ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ [বিএফএফএস] গঠনে নেতৃত্ব প্রদান করেন সৈয়দ হাসান ইমাম এবং মাহবুব জামিল। খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে দুটি পৃথক ফেডারেশন গঠিত হওয়ায় সদ্য স্বাধীন দেশে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের জাতীয়ভাবে বৃহত্তর ঐক্যের কর্মসূচি প্রণয়নের পথ বাধাপ্রাপ্ত হয়। ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয় বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের সবচেয়ে বড় ক্ষতিটি করেছিলেন এই দ্বিতীয় ফেডারেশন গঠনের উদ্যোক্তাগণ। আন্দোলনের মাঝে হাজারও মত-ভিন্নতা থাকতে পারে, ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দ থাকতে পারে; কিন্তু তাতে পুরো আন্দোলনটিকে ভাগ করে ফেলার মধ্য দিয়ে জাতীয় পর্যায়ে আন্দোলনের চেতনা চূড়ান্ত অর্থে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এই ক্ষতি আর কখনও পূরণ হয় না। যেমন হয়নি বাংলাদেশে। আজও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন ১৯৭৫ সালের সেই ক্ষতির দায় বয়ে যাচ্ছে প্রাত্যহিক সুদসমেত।
বাংলাদেশে স্বতন্ত্র ও স্বাধীন চলচ্চিত্র সংসদের পাশপাশি পৃথক চলচ্চিত্র সংসদগুলোর সমন্বয়ে ফেডারেশন আরও শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারে– এমন ভাবনার শুরুটা মুহম্মদ খসরুই করেছিলেন। এই ভাবনার জন্য উদাহরণ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন ভারতের ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজের তৎপরতাকে। আর মুহম্মদ খসরু সম্মিলিত সেই উদ্যোগের নামটিও রেখেছিলেন ভারতীয় চলচ্চিত্র সংসদ ফেডারেশনের নামের অনুরূপ। ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশ। ‘অব বাংলাদেশ’-এর জায়গায় ‘অব ইন্ডিয়া’ বসিয়ে দিলে এই নামটিই ভারতীয় ফেডারেশনের নাম হয়ে যায়।
বাংলাদেশে চলচ্চিত্র সংসদগুলোর জন্য একটি ফেডারেশন গঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা মুহম্মদ খসরু গত ১৯ ফেব্রুয়ারি [২০১৯] ‘কাট’ বলে তার নিজস্ব চলচ্চিত্রযাপনের ইতি টেনেছেন।

[ছবি সংগৃহীত; ফটোগ্রাফারের নাম জানা গেলে জুড়ে দেওয়া হবে]
৩.
বাংলাদেশে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের বয়স ৫৬ বছর চলমান। আমরা এই দীর্ঘ যাত্রাপথের উত্তরাধিকারমাত্র। বাংলাদেশে চলচ্চিত্র শিক্ষা এখন প্রাতিষ্ঠানিক অবয়বে রূপ নিচ্ছে। বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ বহুকাল ভাড়া বাড়ির যাত্রা শেষ করে আগারগাঁওয়ে নিজস্ব ভবনে যাত্রা শুরু করেছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বহুকালের চাওয়া ‘চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট’। আজকের বাংলাদেশে বহুমানুষের জন্য এই সকল ‘অগ্রগতি’র প্রকৃত যোদ্ধাদের খুঁজে পাওয়া একটু মুশকিলের বটে। কারণ যোদ্ধাদের অবয়ব প্রতিষ্ঠান সংরক্ষণ করে না। প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার পর যোদ্ধাদের প্রয়োজন ফুরিয়ে আসে। আর সেল্ফলেস যোদ্ধারা একটু আবেগি, অভিমানপ্রবণ হবেন– এটাই স্বাভাবিক। অবশ্য ‘অভিমানী’ বা ‘আবেগী’ বলে আমরা যোদ্ধাদের স্বাভাবিক প্রতিবাদকেও সহনশীল আর বাতিল করে তুলি। সমাজ এমনই। সে ‘প্রতিবাদী’ চরিত্রকে সহ্য করতে পারে না। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রিক সকল প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার প্রাথমিকপর্বে মুহম্মদ খসরু এবং আরও কিছু মানুষের স্বপ্ন মৌলিক ছিল। কোনো কিছু পাওয়ার চিন্তা না করে নিজের জাতির মানুষের জন্য তারা ‘শিল্প’ চেয়েছেন। এই ‘শিল্প’ হয়তো মানুষকে আরও একটু উন্নত ‘মানুষ’ করে তোলে।
…
রাষ্ট্রকে
চলচ্চিত্র
শিল্পের
বর্ণমালা শিখিয়েছেন
মুহম্মদ খসরু,
আলমগীর কবির,
বাদল রহমানের
মতো
কিছু
মানুষ
…
রাষ্ট্র হিসেবে আমরা তখন কেবলমাত্র শিশুরাষ্ট্র। সদ্যজাত শিশুরাষ্ট্রকে তখন আমাদের সকল শব্দ, বর্ণমালা শেখাতে হয়েছে। রাষ্ট্রকে চলচ্চিত্র শিল্পের বর্ণমালা শিখিয়েছেন মুহম্মদ খসরু, আলমগীর কবির, বাদল রহমানের মতো কিছু মানুষ। কিন্তু রাষ্ট্র কি তাদের সেই সেল্ফলেস কাজের সম্মানটুকু যথাযথভাবে দিয়েছে?

মধ্যবয়সে
[ছবি সংগৃহীত; ফটোগ্রাফারের নাম জানা গেলে জুড়ে দেওয়া হবে]
৪.
মুহম্মদ খসরুর জীবনভর লড়াইয়ের সবচেয়ে বড় অর্জন কী? আমার মতে, তিনি চলচ্চিত্রকে নিজে প্রথমে বুঝেছেন; এরপর আশেপাশের মানুষকে ধরে ধরে তা বুঝিয়েছেন।
এমনিতে চলচ্চিত্র একটু সফিসটিকেটেড শিল্পমাধ্যম। চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনও একটি সফিসটিকেডেট আন্দোলন। আন্দোলন বললেই যেমনটি আমরা বুঝি, লক্ষ লক্ষ জনতার বিপুল সমারোহ– তা চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনে কোনোকালে কোথাও ঘটেনি। দূর থেকে মনে হতে পারে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের এ এক গভীর দুর্বলতা। বাস্তবে কিন্তু তা নয়। বাস্তবতা হলো, এই আন্দোলন গুটিকয় সমৃদ্ধ, ঋদ্ধ মানুষের শিল্পচর্চার আন্দোলন। গণমানুষের কাছে এই আন্দোলনকে নিয়ে যাওয়ার বহু প্রয়াস নেওয়া হয়েছে বহুবার। কখনো তা সফলতা পেয়েছে, কখনো তা পায়নি। শিল্পচর্চার এই পথ তাই রয়ে গেছে স্বল্প মানুষের উচ্চতম মননশীল চর্চার ব্যক্তিগত ঘর ও অলিন্দে।
মুহম্মদ খসরু বাংলাদেশের প্রাথমিক পর্বে একেবারে ব্যক্তিমানুষ ধরে ধরে কিছু চলচ্চিত্রবোধে সমৃদ্ধ মানুষ গড়ে তুলেছিলেন– যারা মুহম্মদ খসরুর পাশে থেকে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কিছুদূর পথ হেঁটেছেন। এরপর জীবনের স্বাভাবিক ছন্দে কেউ কেউ অন্য কোথাও অন্য কাজে নিজস্ব সক্ষমতার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেন। এভাবে সমাজের বৃহত্তর পরিসরে নতুন নতুন মানুষের আর্বিভাব হয়েছে, যাদের অনেকেই মুহম্মদ খসরুর ‘দাবড়ানি’ খেয়ে অথবা স্নেহের ‘বকুনি’ খেয়ে পথ চলতে, পড়তে, লিখতে শিখেছেন। মুহম্মদ খসরু আদতে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর শিরোপাধারী ব্যক্তিত্ব। হয়তো এ ক্ষেত্রে ওনার সমকক্ষ কাউকে খুঁজে পাওয়া দুস্কর।
…
তিনি
ছোট পরিসরে
ব্যক্তিগত পরিচর্যা
দিয়ে এক একটি আপাত
মার্বেলকে হীরকে রূপান্তরিত
করেছেন বা করার চেষ্টা করেছেন
…
মুহম্মদ খসরু কখনও বিপুল মানুষকে নিয়ে জাতীয় পরিসরে বৃহত্তর কর্মসূচী বাস্তবায়ন করেননি। তিনি ছোট পরিসরে ব্যক্তিগত পরিচর্যা দিয়ে এক একটি আপাত মার্বেলকে হীরকে রূপান্তরিত করেছেন বা করার চেষ্টা করেছেন। সর্বক্ষণ তিনি তরুণদের সাথে মিশে তরুণদের মননশীল, পড়ুয়া, চক্ষুষ্মান করে তুলতে তৎপর ছিলেন। অনেক অগ্রজের মুখে মুহম্মদ খসরুর পথনির্দেশকের ভূমিকার বর্ণনা শুনেছি। মুহম্মদ খসরুর ‘খিস্তি’র অপমানে অনেককে বেদনাহত হতে দেখেছি। সকলে তার এ কথাবলার ‘বৈশিষ্ট্য’কে প্রশংসার যোগ্য আচরণ মনে করেন না। তদুপরি প্রায় প্রত্যেকেই বলেন, মুহম্মদ খসরু সত্যিকারের সেল্ফলেস ভিশনারি। যিনি স্বপ্ন দেখেন সংস্কৃতির উচ্চতম চর্চায় মননশীল মানুষ। গত পাঁচ দশকজুড়ে চলচ্চিত্রের বাতাবরণ নিয়ে মুহম্মদ খসরু ভিশনারি ছিলেন। হয়তো তার এই স্বপ্নময় জেদি যাপনের ভেতরেই বাংলাদেশের বৃহত্তর সংস্কৃতি জগতে তার অবদান সবচেয়ে বেশি দৃষ্টিগোচর হয়ে ওঠে।

ছবি । কামরুল মিথুন
৫.
মুহম্মদ খসরু বাংলাদেশের বিকাশকালের স্মারকচিহ্ন স্বরূপ। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি ছাড়াই তিনি হয়ে উঠেছেন চলচ্চিত্রের ‘জাতীয়’ অধ্যাপক। নিজে একটিও চলচ্চিত্র নির্মাণ না করেও হয়ে উঠেছেন তার নিজের সময়ের সবচেয়ে বড় চলচ্চিত্রিক অনুপ্রেরণা। যদিও চলচ্চিত্র নির্মাণের ইচ্ছে এবং প্রয়াস তিনি কখনো পরিত্যাগ করেননি। কিন্তু বাস্তবিক বাংলাদেশ তাকে সে সুযোগটুকু দেয়নি। মুহম্মদ খসরু নিজের সবটুকু তারুণ্য সঁপে দিয়েছিলেন চলচ্চিত্রের উৎকর্ষ কার্যক্রমে। জাতির চলচ্চিত্রিক মননকে একটু উন্নীত করতে সে এক মরণপণ জেদ। সেই জেদ অবশেষে শান্ত হয়েছে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি। প্রায় পাঁচ দশকের চলচ্চিত্রযাত্রা থেমেছে ঢাকার বারডেম হাসপাতালে।
মুহম্মদ খসরু চলচ্চিত্র পত্রিকা সম্পাদনায় কিংবদন্তিতুল্য। ধ্রুপদী ছাড়াও তিনি সম্পাদনা করেছেন সাময়িকী– চলচ্চিত্রপত্র। চলচ্চিত্রপত্রের ‘ক্যামেরা যখন রাইফেল’, ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ সংখ্যা মুহম্মদ খসরুর বিষয়ভিত্তিক চলচ্চিত্র সাময়িকী সম্পাদনার আলোচিত মাইলফলক।
মানুষ মরে গেলে মানুষ কি মনে রাখে? দেশের গণমাধ্যম কীভাবে একজন মানুষের মূল্যায়ন করে? এসব বিবেচনায় নিলে মুহম্মদ খসরু আদতে একজন অপ্রাতিষ্ঠানিক মানুষ। কারণ মানুষের মনে রাখবার বাসনাকে তিনি স্বয়ং চুরমার করতে ভালোবাসতেন। তিনি নিজস্ব পরিসরের ভেতর তৎপর থাকতে ভালোবাসতেন। খোঁজ রাখতেন দুনিয়ার সর্বশেষ জ্ঞানকাণ্ডের। পড়তেন খুব। মুহম্মদ খসরুর পাঠ্যাভাস তুলনারহিত। সকলেই তার চন্ড রাগের কথা জানেন। অবশ্য বহুমানুষ তার ভেতরকার শিশুসুলভ কোমল মানুষটার খবরও জানেন। তবুও সংখ্যাগরিষ্ঠ দুনিয়া জানে তার ‘খিস্তি-খেঁউরের’ কথা। শ্রাব্য ভাষায় যা খুব শ্লীল– তেমন ভাষায় তিনি আক্রমণ করে আরাম পেতেন না। তিনি স্বভাবসুলভ কটুভাষী ছিলেন। তার কাছে ‘শব্দ’– আণবিক বোমাস্বরূপ। যা তিনি ক্ষণে ক্ষণে নিক্ষেপ করতেন নিজস্ব আক্রমণের ছন্দে!
…
তিনি
স্বভাবসুলভ
প্রতিষ্ঠানবিরোধী মানুষ
ছিলেন। কিন্তু নিজে সারাজীবন
করে গেছেন সংগঠন, গড়ে
তুলবার চেষ্টা করেছেন
প্রতিষ্ঠান, জীবনের
বেশির ভাগ
সময়জুড়ে
লিখেছেন
রাষ্ট্রীয় নানা
চলচ্চিত্রিক প্রতিষ্ঠান
গড়ে তুলবার প্রয়োজনীয়তার কথা
…
তার এই নিজস্ব আক্রমণের ছন্দ তার জীবনব্যাপি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবার লড়াইকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল কি-না– তা ভাববার অবকাশ নিশ্চয়ই আছে। তিনি স্বভাবসুলভ প্রতিষ্ঠানবিরোধী মানুষ ছিলেন। কিন্তু নিজে সারাজীবন করে গেছেন সংগঠন, গড়ে তুলবার চেষ্টা করেছেন প্রতিষ্ঠান, জীবনের বেশির ভাগ সময়জুড়ে লিখেছেন রাষ্ট্রীয় নানা চলচ্চিত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবার প্রয়োজনীয়তার কথা। তার ব্যক্তিগত যাপনের এই স্ববিরোধ কেন, তা জানবার বহু প্রয়াস করেছি বহুবার। নানাবিধ জিজ্ঞাসার আগ্রহে তার সাক্ষাৎকার ধারণের আগ্রহ প্রকাশ করেছি বহু অবসরে। কিন্তু তিনি কখনই রাজি হননি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে। ফলে আজ অপরের ব্যাখ্যায়, স্মৃতিকথায় অথবা খণ্ডিত অবয়বে জানবার চেষ্টা করা ছাড়া তাকে আর পাওয়া যাবে না আমাদের প্রাত্যহিক তৎপরতার মানচিত্রে।

সম্পাদক । মুহম্মদ খসরু
৬.
মুহম্মদ খসরু বাংলাদেশে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনকে ‘আন্দোলন’-এ বিবর্তিত করেছেন। চলচ্চিত্র সংসদ কেবল নির্বিষ চলচ্চিত্র দেখা বা দেখানোর মতো আয়েশি বিলাসিতা নয়। সমাজের সাথে, মানুষের সাথে, গণমানুষের জীবনের সাথে এই আন্দোলনকে গেঁথে নেওয়ার প্রয়াস তার ছিল। সেই পথে তিনি অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করেছেন। তিনি একা করেছেন– এমন দাবি করব না। কোনো আন্দোলন কেউ একা করেন না। তবে একা কোনো মানুষকে বইতে হয় সময়ের চাপ, তাপ ও নৈতিক দায়ের বোঝা। মুহম্মদ খসরু একা একা বহুকাল বয়েছেন সেই বোঝা। তিনি এবং তারাই বাংলাদেশের চলচ্চিত্র-সংস্কৃতিকে ‘বিনোদন’ থেকে ‘শিল্পে’ উন্নীত করার পথপ্রদর্শক। যদিও সেই শিল্পময় পথে জাতি হিসেবে আমরা এখনও অপরিণত আছি বলে মনে করি। একটি জাতির শিল্পের রসে, জ্ঞানে পূর্ণ হতে যে পরিণত মনন ও বীক্ষা প্রয়োজন হয়, তা জাতিগতভাবে অর্জনের দিক থেকে আমরা বহু দূরে আছি। তবে চলচ্চিত্র-শিল্পের পথে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল যাদের নিষ্ঠায়, সাধনায়– তাদের মাঝে অন্যতম মুহম্মদ খসরুর প্রয়াণ আমাদের জন্য গভীর শোক ও দুঃখ বয়ে এনেছে।

ছবি । বিপুল জামান
৭.
মুহম্মদ খসরু অকৃতদার ছিলেন। ছিলেন একাকী এক জেনারেল। বহুকাল আগে যিনি যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে এসেছেন বলে মানুষ মনে করত। কিন্তু কাছে ও দূরে থেকে দেখেছি, মুহম্মদ খসরু নিজের মতো করে নিজের যুদ্ধ লড়ে গেছেন প্রতিটি ক্ষণে। তিনি বিরামহীনভাবে ভেবেছেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংস্কৃতির ভবিষ্যৎ। বর্তমান নিয়ে তিনি চিরকাল অসন্তুষ্ট মানুষ। অতীত নিয়ে তার ব্যক্তিগত সন্তোষবোধ ছিল। চারপাশের সার্বক্ষণিক বিচার ও বিশ্লেষণে তিনি ক্লান্তিহীন ছিলেন। পৈত্রিকভিটা কেরাণীগঞ্জের রুহিতপুরের মোহনপুর গ্রামে একা একজন মানুষের সহচর ছিল প্রচুর বই আর টেলিভিশনের সাহচর্য। নিঃসঙ্গতা যখন গভীর হতো, তখন মাঝে মাঝে তিনি তার মুঠোফোনে যোগাযোগ করতেন অথবা শব্দবোমা নিক্ষেপ করতেন পছন্দ ও অপছন্দের প্রিয়জনদের কর্ণকুহরে। যা ক্ষণিক ক্ষীপ্রতায় যেকোনো ব্যক্তির হৃদয়ে চাপ তৈরিতে সক্ষম ছিল।
তার মুঠোফোন আর কাউকে খুঁজবে না কখনো, করবে না কোনো শব্দবোমার বিস্তার।
বিদায় প্রিয় যোদ্ধা মুহম্মদ খসরু… আপনাকে প্রথম স্যালুট, শেষ তর্কের আরম্ভে!
চমৎকার লেখা। মামুনকে ধন্যবাদ।
পুনশ্চ – প্রথম ছবিটি – বইয়ের সামনে দাঁড়ানো আদুল গায়ের মুহম্মদ খসরু’র সাদাকালো ছবিটি আমার তোলা।
সুন্দর আর হৃদয়স্পশীর্ হয়েছে তোমার লেখাটা। খুব ভালো লাগলো পড়ে।
[…] […]