ডেভিড লিঞ্চের নোটবুক

524
ডেভিড লিঞ্চ

মূল । ডেভিড লিঞ্চ
ভূমিকা ও অনুবাদ । রুদ্র আরিফ

প্রকাশক । ঐতিহ্য
প্রকাশক । প্রতিভাস

ডেভিড লিঞ্চের নোটবুক
মূলগ্রন্থ । CATCHING THE BIG FISH by DAVID LYNCH
অনুবাদ । রুদ্র আরিফ
প্রথম প্রকাশ । ফেব্রুয়ারি ২০১৯
পৃষ্ঠাসংখ্যা । ১৪৪
বাংলাদেশি সংস্করণের প্রকাশক । ঐতিহ্য
ভারতীয় সংস্করণের প্রকাশক । প্রতিভাস


নোট । মূল বই থেকে ভূমিকার প্রথমাংশ এবং পাঁচটি নোট এখানে প্রকাশ করা হলো…


অনুবাদকের ভূমিকা

লিঞ্চের পৃথিবী লিঞ্চের ধ্যান

ডেভিড লিঞ্চ। ডেভিড কিথ লিঞ্চ। পেইন্টার, মিউজিশিয়ান, অভিনেতা, ফটোগ্রাফার। সব ছাপিয়ে ‘ফিল্মমেকার’ পরিচয়ই সবচেয়ে জ্বাজ্বল্যমান। জন্মসূত্রে আমেরিকান হলেও বস্তুত সমগ্র সিনেপৃথিবীর নাগরিক। দাপুটে ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ান তাকে অভিহীত করেছে ‘এ যুগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফিল্মমেকার’ হিসেবে। বিখ্যাত ওয়েবসাইট অলমুভির বিচারে তিনি ‘আধুনিক আমেরিকান ফিল্মমেকিংয়ের রেনেসাঁ-মানব’। নির্মাণ করেছেন ইরেজারহেড [১৯৭৭], দ্য এলিফ্যান্ট ম্যান [১৯৮০], ডুন [১৯৮৪], ব্লু ভেলভেট [১৯৮৬], ওয়াইল্ড অ্যাট হার্ট [১৯৯০], টুইন পিকস : ফায়ার ওয়াক উইথ মি [১৯৯২], লস্ট হাইওয়ে [১৯৯৭], দ্য স্ট্রেট স্টোরি [১৯৯৯], মুলহোল্যান্ড ড্রাইভ [২০০১] ও ইনল্যান্ড এম্পায়ার [২০০৬] শিরোনামের দুর্ধর্ষ সব ফিচার ফিল্ম। সিক্স মেন গেটিং সিক [সিক্স টাইমস] [১৯৬৭], অ্যাবসার্ড এনকাউন্টার উইথ ফিয়ার [১৯৬৭], ফিকটিসাস অ্যানাকিন কমার্শিয়াল [১৯৬৭], দ্য অ্যালফাবেট [১৯৬৮], দ্য গ্র্যান্ডমাদার [১৯৭০], দ্য অ্যামপুটি [১৯৭৪], দ্য কাউবয় অ্যান্ড দ্য ফ্রেঞ্চম্যান [১৯৮৮], প্রিমনিশন ফলোয়িং অ্যান ইভল ডিড [১৯৯৫], ডার্কেনড রুম [২০০২], অ্যাবসুর্দা [২০০৭], বোট [২০০৭], বাগ ক্রাউলস [২০০৭], ল্যাম্প [২০০৭], ইন্ডাস্ট্রিয়াল সাউন্ডস্কেপ [২০০৭], ইন্টারভ্যালোমিটার এক্সপেরিমেন্টস [২০০৭], মোর থিংস দ্যাট হেপেনড [২০০৭], ব্যালেরিনা [২০০৭], ড্রিম #৭ [২০১০], লেডি ব্লু সাংহাই [২০১০], দ্য থ্রি আর’স [২০১১], আইডেম প্যারিস [২০১৩] ও হোয়াট ডিড জ্যাক ডু? [২০১৭]– এই শর্টফিল্মগুলোও তারই নির্মাণ। টিভি পর্দায় প্রথম জনপ্রিয় পরাবাস্তববাদী ড্রামা সিরিয়াল– টুইন পিকসও [১৯৯০-৯১] তারই সৃষ্টি। বানিয়েছেন দুটি কনসার্ট ফিল্ম– ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিম্ফনি নং. ১ [১৯৯০] ও ডুরান ডুরান [২০১৪]। নির্মাণ ভাণ্ডারে আছে বেশ কিছু বিজ্ঞাপনচিত্র, ডকুমেন্টারি ও মিউজিক ভিডিও।

২০ জানুয়ারি ১৯৪৬, যুক্তরাষ্ট্রের মন্টালা রাজ্যের মিজুলা শহরে জন্ম নেওয়া লিঞ্চ ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন পেইন্টার হিসেবে। এখনো ছবি আঁকেন। সময় পেলে ডিজিটাল ভিডিওতে ইচ্ছেমতো এক্সপেরিমেন্টাল শুট করেন, মূলত নিজের ওয়েবসাইটের [www.davidlynch.com] জন্য। মগ্ন থাকেন মিউজিক নিয়ে। আর, দীর্ঘকাল ধরে তিনি যে ট্রেনসেনডেন্টাল মেডিটেশনের একজন নিয়মিত চর্চাকারী, সে কথা নিশ্চয় অনেকেরই জানা।

বাস্তব ও কল্পনার দোলাচলে, থাকা না-থাকার কুহকী খেলায়, পরাবাস্তবতার তীক্ষ্ণ ইমেজে সিনেমায় নিজস্ব স্বর আবিষ্কার তিনি করতে পেরেছেন বলেই, সিনেবিশ্বে ‘লিঞ্চিয়ান’ টার্মটি এখন ভীষণ গুরুত্ববহ। হ্যাঁ, পাঠক, তার ধারার সিনেমাকে এ নামেই ডাকা হয়। অক্সফোর্ড অভিধানেও জায়গা পেয়েছে শব্দটি। বাংলায় এটিকে আমরা হয়তো ‘লিঞ্চধর্মী’ ডাকতে পারি। ধ্যানী এই সিনে-মাস্টার, প্রকৃতই ধ্যানচর্চার পাশাপাশি, নিজ জীবন ও সিনে-দর্শন লিখে রেখেছেন ছোট ছোট নোট আকারে। সেই লেখাগুলো বই হিসেবে মলাটবদ্ধ হয়েছে ক্যাচিং দ্য বিগ ফিশ : মেডিটেশন, কনসাসনেস, অ্যান্ড ক্রিয়েটিভিটি শিরোনামে। ২৮ ডিসেম্বর ২০০৬, যুক্তরাষ্ট্রের ট্যারচারপেরিজি প্রকাশনী থেকে ছাপা হওয়া সেই বইটির এই প্রথম ও পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদের নাম রাখা হলো– ডেভিড লিঞ্চের নোটবুক। জানামতে, বাংলাভাষায় ছাপার অক্ষরে ডেভিড লিঞ্চকে নিয়ে এটিই প্রথম কোনো পূর্ণাঙ্গ কাজ।


ইরেজারহেড

‘ডেভিড লিঞ্চের নোটবুক’ থেকে

শুরুর গল্প

আমার শুরু হয়েছিল স্রেফ একজন সাধারণ মানুষের মতোই; বড় হয়ে উঠেছি নর্থওয়েস্টে। বাবা ছিলেন কৃষি বিভাগের একজন গবেষণা বিজ্ঞানী; বৃক্ষ নিয়ে গবেষণা করতেন। ফলে বহুদিন অরণ্যে কেটেছে আমার। আর, শিশুর কাছে অরণ্য তো জাদুর মতো। যে জায়গাটিতে আমরা থাকতাম, লোকে সেগুলোকে ছোট-শহর বলে ডাকে। আমার দুনিয়া ছিল একটি কিংবা হয়তো দুটি সিটি-ব্লকের ভেতর। সেই জায়গাটিতে সবকিছুই ঘটত। সেই ছোট্ট পৃথিবীতে আমার সকল স্বপ্ন, সকল বন্ধুরই ছিল বসবাস। তবে আমার কাছে সেটি ছিল বিশাল বড় ও জাদুকরী। স্বপ্ন দেখার ও বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য প্রচুর সময় ছিল সেখানে।

ছবি আঁকতে ভালো লাগত আমার। ড্রয়িং করতে ভালো লাগত। মাঝে মধ্যে ভুল করেই ভাবতাম, যখন বড় হব, ছবি আঁকা ও ড্রয়িং করা ছেড়ে দিয়ে নিশ্চয়ই আরও সিরিয়াস কিছু করব। ক্লাস নাইনে পড়ার সময় আমার পরিবার চলে এল ভার্জিনিয়ার আলেক্সান্দ্রিয়া শহরে। প্রেমিকার বাড়ির সামনের তৃণভূমিটিতে এক রাতে, টবি কিলার নামের এক ছেলের সঙ্গে পরিচয় হলো। আমরা কথা বলছিলাম। সে জানাল, তার বাবা একজন পেইন্টার। ভাবলাম, রঙমিস্ত্রি হবেন নিশ্চয়ই। কিন্তু যতই আলাপ এগোল, বুঝলাম, তিনি চমৎকার এক আর্টিস্ট।

এই আলাপটি আমার জীবন বদলে দিয়েছে। কোনো না কোনভাবে বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ ছিল; কিন্তু আচমকাই বুঝে গেলাম, আমি আসলে পেইন্টার হতে চাই। কাটাতে চাই শিল্পজীবন।

এলিফ্যান্ট ম্যান

রাতের বাগান

তার মানে, আমি ছিলাম পেইন্টার। ছবি আঁকতাম। গিয়েছি আর্ট-স্কুলে। সিনেমার প্রতি আমার কোনো আগ্রহ ছিল না। সিনেমা দেখতে মাঝে মধ্যে গিয়েছি ঠিকই, তবে সত্যিকার অর্থেই স্রেফ ছবি এঁকেই যেতে চেয়েছিলাম সারাজীবন।

পেনিসিলভানিয়া একাডেমি অব দ্য ফাইন আর্টসের এক বিশাল স্টুডিও রুমে আমি একদিন বসে ছিলাম। রুমটি ছোট ছোট কুঠরিতে ভাগ করা। আমি ছিলাম নিজের কুঠরিতে। বিকেল তখন তিনটার মতো। একটা পেইন্টিং করছিলাম– রাত্রিকালীন বাগানের ছবি। প্রচুর কালো রঙের ছড়াছড়ি। সেই অন্ধকারের ভেতর সবুজ গাছপালার উঁকি মারা আঁকছিলাম আমি। আচমকাই এই গাছগুলো নড়তে থাকল। আর শুনতে পেলাম বাতাসের শব্দ। আমি কোনো মাদক নিইনি! ভাবলাম, ‘বাহ, কী চমৎকার!’ অবাক হয়ে ভাবতে থাকলাম, সিনেমা হতে পারে পেইন্টিংকে নড়াচড়া করানোর একটি তরিকা।

প্রতি বছরের শেষে, একটি এক্সপেরিমেন্টাল পেইন্টিং ও স্কাল্পচার প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হতো। আগের বছর এই প্রতিযোগিতার জন্য কিছু একটা বানিয়েছিলাম। এবার ভাবলাম, ‘মুভিং পেইন্টিং বানানো যাক।’ একটি স্কাল্পচারড স্ক্রিন বানালাম– ছয় ফুট বাই আট ফুট। সেটির ওপর একেবারেই অমসৃণভাবে অ্যানিমেশন করা স্টপ-মোশন ফিল্ম প্রদর্শন করলাম। নাম, ‘সিক্স মেন গেটিং সিক’। আমার ধারণা, সেটিই ঘটিয়েছিল আমার ফিল্ম ক্যারিয়ারের বিস্তরণ। কেননা, এ জিনিসটি বানাতে আসলেই ভালো টাকা খরচ হয়ে গিয়েছিল আমার– ২০০ ডলার। ভাবলাম, ‘এ পথে কোনমতেই তলিয়ে যাওয়া চলবে না।’ তবে এক সিনিয়র ছাত্র এই প্রজেক্টটি দেখেছিলেন। তিনি নিজের বাড়িতে এ কাজটি বানিয়ে দেওয়ার অর্ডার দিলেন। বল এভাবেই গড়াতে শুরু করল! এরপর আমি স্রেফ সবুজ বাতিই দেখতে থাকলাম শুধু। তারপর ধীরে ধীরে, কিংবা বলা ভালো, লাফিয়ে লাফিয়ে এই মাধ্যমটির প্রেমে পড়ে গেলাম।

লস্ট হাইওয়ে

সিনেমা

সিনেমা– একটি ভাষা। এটি কথা বলতে পারে– বড়, বিমূর্ত সে কথামালা। সিনেমার এ বিষয়টি আমি ভালোবাসি।

আমি সবসময় ঠিকঠাক কথা বলতে পারি না। কিছু লোক কবি; তারা শব্দ দিয়ে খুব চমৎকার কথা সাজাতে জানেন। কিন্তু সিনেমার রয়েছে নিজস্ব ভাষা। আর তা দিয়ে অনেক বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারবেন আপনি; কেননা, সেজন্য সময় ও সিকুয়েন্স পাবেন। সেজন্য আপনার রয়েছে সংলাপ। আপনার রয়েছে মিউজিক। আপনার রয়েছে সাউন্ড ইফেক্ট। প্রচুর হাতিয়ার রয়েছে আপনার জন্য। ফলে এর মাধ্যমে আপনি কোনো অনুভূতি ও ভাবনা এমনভাবে প্রকাশ করতে পারবেন, যেটি অন্য কোনো তরিকায় সম্ভব নয়। এ এক জাদুকরী মাধ্যম।

সময় ও সিকুয়েন্সের মধ্যে একইসঙ্গে এইসব ছবিমালা ও শব্দগুচ্ছের প্রবাহমানতা নিয়ে ভাবতে, কেবলমাত্র সিনেমার পক্ষেই সম্ভব– এমন কিছু বানিয়ে তুলতে আমার খুব চমৎকার লাগে। এ স্রেফ শব্দমালা কিংবা মিউজিক নয়– এ সমস্ত উপকরণই একত্রিতরূপে প্রকাশ হয়ে এমন কিছু একটা সৃষ্টি করে তোলা– যেটির অস্তিত্ব আগে ছিল না। এটি কাহিনি শোনায়। এটি একটি দুনিয়াকে, একটি অভিজ্ঞতাকে উদ্ভাবন করে– যা সিনেমাটি দেখার আগে দর্শকের পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব নয়।

যখন আমি সিনেমার কোনো আইডিয়া লুফে নিই, সেটিকে কীভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারব– সেই প্রেমে মত্ত হয়ে উঠি। বিমূর্ততা ধারণ করা কাহিনি আমার ভালো লাগে; আর সে কাজটি করতে পারে সিনেমাই।

ওয়াইল্ড অ্যাট হার্ট

সাউন্ড

কখনো কখনো মিউজিক শোনার সময়, সেটি স্ক্রিপ্টের কোনো দৃশ্যের সঙ্গে একাকার হয়ে যায়। শুটিংয়ের সময়, সংলাপটি শোনার বেলায় হেডফোন কানে দিয়ে আমি সেই মিউজিকটি প্রায়ই শুনি। যা চলছে, যেমন ধরুন– সঠিক স্পিড ও লাইটিং– সেই কর্মযজ্ঞের স্রেফ একটি প্রতিপাদন হয়ে কাজ করে এই মিউজিক শোনা। আপনি অরিজিনাল আইডিয়াটিকে অনুসরণ করছেন এবং সেটির প্রতি সত্যবান থাকছেন– এ বিষয়টি নিশ্চিত করার এটি স্রেফ আরেকটি হাতিয়ার। ফলে দৃশ্যগুলো ঠিকঠাক কাজ করছে কিনা তা বোঝার জন্য কিছু মিউজিক চালিয়ে দেওয়া আসলেই বেশ কাজের।

সিনেমাকে অনুভব করার ক্ষেত্রে সাউন্ড খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একটি রুমের সঠিক হাজিরাটি পেতে, বাইরে থেকে সঠিক অনুভূতিটি পেতে, কিংবা কোনো মিউজিক্যাল ইনস্ট্রূমেন্ট বাজানোর মতো করেই সঠিক শব্দে উচ্চারিত সংলাপ পেতে [এটি কাজ করে]। এই ‘সঠিক’ জিনিসটি পাবার জন্য আপনাকে প্রচুর এক্সপেরিমেন্টের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। আর তা বোঝা যায় সাধারণত সিনেমাটি ‘কাট’ করার পরই। আমি একে ‘জ্বালানি’ বলে ডাকি। একে সবসময়ই জড়ো করার চেষ্টা চালাই। ফলে কাজটি করার জন্য নানা জিনিসের স্তূপ সাজাই, আর পরখ করি– সেগুলো কাজে লাগবে কিনা। আপনাকে একটি সাউন্ডের স্রেফ একটি ঝঙ্কার শুনেই বুঝে ফেলতে হবে, ‘ওহ, এ তো ঠিক মানাচ্ছে না!’

ব্লু ভেলভেট

কাস্টিং

কে কত দুর্দান্ত অভিনেতা– তাতে কিচ্ছু যায়-আসে না; যখন কাস্ট করবেন, আপনাকে ঠিক সেই মানুষটিকেই বেছে নিতে হবে– যে চরিত্রটির সঙ্গে মানানসই, যে চরিত্রটি ফুটিয়ে তুলতে পারবে।

আমি কখনোই অভিনেতাদের জোর করে স্ক্রিপ্ট পড়াই না। আমার ধারণা, এতে তারা যন্ত্রণাভোগ করেন। আমি তাদের কিছুই শেখাই না। বরং এমনিতেই তাদের নিয়ে রিহার্সেল শুরু করে দিতে হয়তো পারি। প্রত্যেক অভিনেতাকে আলাদা আলাদা রিহার্সেল করতে নিশ্চয় দীর্ঘ থেকে সুদীর্ঘ সময় লেগে যাবে। আমি তাই তাদের সঙ্গে শুধু কথা বলি। তারা যখন বলেন, তখন তাদের দিকে স্রেফ তাকিয়ে থাকি। তারা কথা বলার সময়, আমি নিজের মাথায় থাকা স্ক্রিপ্টটির নিরিখে তাদের চালাতে থাকি। কখনো কখনো তা কিছুদূর এগিয়ে থেমে যায়। তারপর এগুলোর কোনো একটা চলতে থাকে পুরোটা পথ, এবং আমি তা ঠিক জেনে যাই।

ব্লু ভেলভেট-এর কাস্টিং ডিরেক্টর ছিলেন জোহান্না রে। আমরা দুজন মিলে ডেনিস হপারের কথা ভাবলাম। কিন্তু বাকি সবাই বলল, ‘না, না; ডেনিসের সঙ্গে কাজ করতে পারবেন না। ওর অবস্থা একদমই ভালো না; শুধু গোলমাল বাধানো ছাড়া আর কোনো কাজেরই না তিনি।’ ফলে আমরা নতুন লোকের সন্ধান জারি রাখলাম। কিন্তু একদিন ডেনিসের এজেন্ট ফোন করে জানালেন, ডেনিসের অবস্থা এখন পুরোপুরি ভালো ও নম্র, এবং তিনি ইতোমধ্যেই আরেকটি সিনেমায় কাজ করেছেন, ওর অবস্থা যাচাই করতে আমি চাইলে সেই ফিল্মমেকারের সঙ্গে আলাপ করতে পারি। তারপর ডেনিস ফোন করে বললেন, ‘ফ্র্যাঙ্ক চরিত্রটিতে আমাকেই অভিনয় করতে হবে; কেননা, আমিই তো ফ্র্যাঙ্ক।’ এ কথা শুনে আমি কাঁপুনি খেলাম; আঁৎকে উঠলাম।

কখনো কখনো স্ত্রিপ্টের শুরু থেকেই কারও কারও কথা মাথায় এঁটে থাকে। মুলহোল্যান্ড ড্রাইভ-এর একটি চরিত্রের বেলায় এমনটা ঘটেছিল। তখন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার মতো বাজে; আমি আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট– সুন্দরী নারীটির ওপর হুমুক জারি করছিলাম। আলাপটি শুরু করেছিলাম একটু মজা করে। ঠিক মুলহোল্যান্ড ড্রাইভ-এর কাউবয় চরিত্রটির মতো করে কথা বলতে থাকলাম। কিছুক্ষণ আলাপ চালিয়ে নেওয়ার পর খেয়াল করলাম, এ চরিত্রে আমার বন্ধু মন্টি মন্টগোমারিই হতে পারেন যোগ্য লোক। কিন্তু তিনি তখনো অভিনেতা নন। যদিও সত্যিকার অর্থে তিনি ভীষণ তুখোড় অভিনেতা। এই চরিত্রটিতে তিনি মানিয়ে গেলেন।

আমি কয়েকজন অভিনেতার কাছে ফিরে গেলাম; যেমন ধরুন, কায়েল ম্যাকলাখল্যান। কায়েলকে আমার ভালো লাগে; সম্ভবত তিনি আমার এক ধরনের অল্টার-ইগো। তবে থাম্বসআপ নিঃসন্দেহে চরিত্রটির জন্য যথাযোগ্য লোকটির প্রতিই দেখানো উচিত। আপনাকে ঠিক এ কাজটিই করতে হবে। ফলে কায়েল আমার বন্ধু হলেও, যেহেতু তিনি চরিত্রটির সঙ্গে মানানসই নন, তাই তাকে সেটি দেওয়া হয়নি।

আপনি যখন কাউকে নিয়ে কাজ করবেন, কোনো নির্দিষ্ট চরিত্রের জন্য সেই মানুষটিকে বেছে নেওয়া সত্যিকার অর্থে ইন্টারেস্টিং। অথচ তারপর, মধ্যাহ্নভোজ কিংবা অন্যকিছুর সময় আপনি সেই মানুষটির অন্যরূপের দেখা পাবেন। আপনার সেটি মনে থেকে যাবে। ফলে আরেকটি চরিত্র এসে হাজির হলে কেউ যদি বলে বসে, ‘দেখুন, এই চরিত্রটিতে কায়েলকে মানাবে না’; আপনার যেহেতু ওর অন্যরূপটির কথা মনে আছে, ফলে আপনি বলে দেবেন, ‘হ্যাঁ, তিনিই পারবেন।’

সূচিপত্র : ডেভিড লিঞ্চের নোটবুক
Print Friendly, PDF & Email
সম্পাদক: ফিল্মফ্রি । ঢাকা, বাংলাদেশ।। সিনেমার বই [সম্পাদনা/অনুবাদ]: ফিল্মমেকারের ভাষা [৪ খণ্ড: ইরান, লাতিন, আফ্রিকা, কোরিয়া]; ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো: প্রেম ও দেহগ্রস্ত ফিল্মমেকার; তারকোভস্কির ডায়েরি; স্মৃতির তারকোভস্কি; হিচকক-ত্রুফো কথোপকথন; কুরোসাওয়ার আত্মজীবনী; আন্তোনিওনির সিনে-জগত; কিয়ারোস্তামির সিনে-রাস্তা; সিনেঅলা [৩ খণ্ড]; বার্গম্যান/বারিমন; ডেভিড লিঞ্চের নোটবুক; ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার চান্তাল আকেরমান; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার বেলা তার; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার নুরি বিলগে জিলান; ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; বেলা তার ।। কবিতার বই: ওপেন এয়ার কনসার্টের কবিতা; র‍্যাম্পমডেলের বাথটাবে অন্ধ কচ্ছপ; হাড়ের গ্যারেজ; মেনিকিনের লাল ইতিহাস ।। মিউজিকের বই [অনুবাদ]: আমার জন লেনন [মূল : সিনথিয়া লেনন]; আমার বব মার্লি [মূল: রিটা মার্লি] ।। সম্পাদিত অনলাইন রক মিউজিক জার্নাল: লালগান

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here