মৃণাল সেনের আত্মজীবনী [৩]

938
মৃণাল সেন

লিখেছেন । মৃণাল সেন

মৃণাল সেন। সদ্যপ্রয়াত মাস্টার ফিল্মমেকার। তাঁর মহাজীবনের পাঠ নিতে, আত্মজীবনী তৃতীয় ভুবন-এর ‘চতুর্থ অধ্যায়’টি এখানে তিন কিস্তিতে পুনমুর্দ্রণ করা হলো…

filmfree

তৃতীয় ভুবন
লেখক । মৃণাল সেন
প্রথম প্রকাশ । ২০০৪
প্রথম আনন্দ প্রকাশ । এপ্রিল ২০১১
প্রকাশক । আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড
প্রচ্ছদ । সোমনাথ ঘোষ
পৃষ্ঠাসংখ্যা । ২৬৮
মূল্য । ৩০০ রুপি

আগের কিস্তি পড়তে এ বাক্যে ক্লিক করুন

কিস্তি । ৩ [৩]

এই প্রসঙ্গে চট করে বলে নিই বাবার সঙ্গে আমার অদ্ভুত বোঝাপড়ার কথা। কখনও সম্মানার্থে তাঁকে আমি সম্ভ্রমসূচক বর্ণনায় রাখছি, আবার কখনও অন্তরঙ্গতায় বন্ধুদের মতো করেই বলছি তার কথা। কখনও ‘তিনি’ বলেছি, কখনও বা ‘তুমি’।

‘সময় বদলেছে, আমিও বদলে গিয়েছি।’ এটা আমার বাবার কথা। ১৯৪৮ সালে ঠিক দেশ বিভাগের এক বছর বাদে এই কথাটি বলেছিলেন আমাকে আর আমার বন্ধুদের। সলিল চৌধুরী, ঋত্বিক ঘটক, তাপস সেন, কলিম শরাফী এবং আমাদের সকল বন্ধুর বন্ধু নৃপেন গঙ্গোপাধ্যায়কে। ওরা আমাদের পার্ক সার্কাসের বাড়িতে প্রায় রোজই আসত। চারটে ঘরের মধ্যে সবচাইতে ছোট ঘরটায় যেটায় আমি থাকতাম সে ঘরটায় আরামের সঙ্গে, মজার সঙ্গে আড্ডা চলত। আমার মা চায়ের পর চা পাঠিয়ে দিত আর বাবা হঠাৎ হঠাৎ ঘরে ঢুকে পড়ত আমাদের না জানিয়ে। এসে এসে আমাদের গল্পগুজব আড্ডা শুনত। তখন আমরা হয়তো আমাদের যৌবনের উন্মাদনা নিয়ে আলোচনায় মগ্ন। কেউ থিয়েটার নিয়ে, কেউ সিনেমা নিয়ে। আরও অনেক কিছু নিয়ে।

বাবা আড্ডা পছন্দ করত, ভালোবাসত, কিন্তু তাঁর উপস্থিতিতে আমাদের অসুবিধে হতো। ‘আমাকে তোমরা বাস্তুহারা ভেব না। আমি তোমাদেরই একজন।’ বাবা সমসময় বলত ‘আমি কিংবা আমার স্ত্রী কেউই দুঃখ পাই না তোমরা আমাদের সম্পর্কে যা-ই ভাব না কেন। আমরা বাস্তুহারা নই, আমরা রিফিউজি নই।’

দীনেশ চন্দ্র সেন
মৃণাল সেনের বাবা

আমার বাবা সাহসী মানুষ ছিল। সাধারণভাবে মৃত্যু সম্পর্কে তার কোনও ভাবলেশই ছিল না। এসব নিয়ে ভাবতই না। বাবা চলে যায় এ পৃথিবী ছেড়ে ১৯৫৪ সালে।

দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার খ্যাতনামা সম্পাদক বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় আমার বাবার মৃত্যুর পর বাবাকে শ্রদ্ধা জনিয়ে সম্পাদকীয়তে গুরুত্ব দিয়ে লিখলেন। সে সময় এ পত্রিকাটি বহুল প্রচারিত ছিল। এটাই আমার বাবার জীবনের অন্তিম কাহিনি।

আমার বন্ধুরা বা আমাদের দলটা শুধু পাঁচজনের নয়। আরও অনেকেই ছিল তখন। নিজের নিজের স্বপ্ন নিয়ে আমরা চলছি, আমাদের আড্ডাও চলছে সমানে, একটা ছোট্ট চায়ের দোকানে। দোকানটার নাম ছিল ‘প্যারাডাইস কাফে’। ওই দোকানটার যিনি মালিক ছিলেন তিনি ঘোড়ার রেস খেলায় এত ব্যস্ত থাকতেন যে দোকানটিতে তিনি নজরই দিতে পারতেন না। আমাদের বুঝতে পেরে ভদ্রলোকটি দোকানটি আমাদের দায়িত্বে চাপিয়ে দিয়ে চলে যেতেন।

আমরা চা কম খেতাম কারণ চা খেতে গেলে পয়সা লাগে। কিন্তু চুটিয়ে আড্ডা মারতাম যে আড্ডাতে কোনও খরচ নেই। যে আড্ডা চলত একনাগাড়ে পাঁচ ঘণ্টা ছ’ঘণ্টা।

সলিল চৌধুরী, ঋত্বিক ঘটক, তাপস সেন, কলিম শরাফী, নৃপেন গঙ্গোপাধ্যায় এবং হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়

একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়। নিউ থিয়েটার্স স্টুডিয়োতে চাকরি করত। আর বাদবাকি আমরা সবাই বেকার। আমাদের বাস্তবিক পক্ষে কোনও কাজই ছিল না। শুধু আমরা আমাদের স্বপ্ন নিয়ে নাড়াচাড়া করতাম।

একদিন আমি অনেক খোঁজাখুঁজি করে আমেরিকান কমিউনিস্ট পার্টির একটি পত্রিকার দুর্লভ সংস্করণটি জোগাড় করলাম। পত্রিকাটির নাম, মাসেস অ্যান্ড মেইনস্ট্রিম। আমি পেয়েছিলাম একেবারে নতুন এবং টাটকা এক সংস্করণ। এই সংস্করণে পাবলো নেরুদার একটি দীর্ঘ কবিতা ছিল। নাম, দ্য ফিউজিটিভ, লেখা আমেরিকার কোনো একটি জায়গা থেকে– ‘ফ্রম সামহোয়্যার ইন আমেরিকা’স’। কোনও শহরের নাম ছিল না, উত্তর না দক্ষিণ আমেরিকা– সেটাও গোপন রাখা হয়েছিল। কারণ চিলির এই কবিকে সবসময় স্বেচ্ছা নির্বাসনে থাকতে হতো; শাসকদের চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য। অথচ এর আগে চিলিরই রাষ্ট্রদূত হিসাবে ঘুরে বেড়িয়েছেন এদেশ-ওদেশ। পরে আবার নোবেল পুরস্কারও পান। আশ্চর্য জীবন! এটা পেয়ে আমি সময় নষ্ট না করে প্যারাডাইস কাফেতে ছুটে গেলাম, সেখানে তখনও জমজমাট আড্ডা। আমার মুখ থেকে পত্রিকা আর পাবলো নেরুদার কথা শুনে সকলে হইহই করে উঠল। কবিতাপাঠ আমার একেবারেই আসে না, তবু কবিতাটা পাঠ করবার লোভ সামলাতে পারলাম না। এক গেলাস জল খেয়ে, গলাটা ঝেড়ে নিয়ে ধীরে ধীরে পড়তে শুরু করলাম।

দীর্ঘ প্রায় আট থেকে দশ পাতা। যখন আমি কবিতাটি পড়ছি তখন সবাই আমাকে ঘিরে মনোযোগ দিয়ে শুনছে। উৎফুল্ল হয়ে শুনছে। এই কবিতাটিতে একটি লাইন আছে যে গরমে তৃষ্ণার্ত হয়ে ‘ফিউজিটিভ’ এলোমেলোভাবে ঘুরতে ঘুরতে অনেকক্ষণ বাদে একটা দোকানে গিয়ে এক বোতল ‘কোকাকোলা’ কিনে খেল।


নেরুদার
মতো মানুষ
যখন তেষ্টায়
এক ঢোক কোকাকোলা
খেয়ে গলা ভিজিয়ে নিলেন,
আমরা,
প্যারাডাইস
কাফে’র দলবল,
ভারী মুশকিলে পড়ে গেলাম

কোকাকোলা! বন্ধুরা সব হইহই করে উঠল। বলল– হতেই পারে না। তখন এমন একটা সময়, যখন ম্যাকার্থি সদলবলে সর্বত্র চষে ফেলছে কমিউনিস্টদের ধরবার জন্য, ঠিক যেভাবে ফাঁদ পেতে শিকার ধরে। এমনকী চ্যাপলিনও ছাড়া পেলেন না, তাঁর বিরুদ্ধে বিশাল রিপোর্ট তৈরি করল এফবিআই, নানাভাবে তাঁকে হেনস্তার চেষ্টা চালিয়ে যেত লাগল। এ কোনও সভ্য দেশে ঘটে না, সারা পৃথিবী তোলপাড় হলো, প্রতিবাদ আসতে লাগল প্রতিটি কোণ থেকে। এই পরিস্থিতিতে কেউই চুপ করে থাকতে পারে না, এদেশেও পারেনি, কমিউনিস্টরা তো নয়ই। তার ওপর তারা যদি কট্টর হয়। সেই কট্টর কমিউনিস্টরাই আমেরিকান পানীয়কে বয়কটের ডাক দিল, গলা মেলাল নরমপন্থীরাও। আমিও ভিড়ে গেলাম, যদিও আমি কখনওই কমিউনিস্ট পার্টির কার্ড-হোল্ডার ছিলাম না। এই যখন অবস্থা, কোকাকোলাকে দূরে ঠেলা ছাড়া আমাদের আর কোনও রাস্তা ছিল না। অথচ পাবলো নেরুদার মতো মানুষ যখন তেষ্টায় এক ঢোক কোকাকোলা খেয়ে গলা ভিজিয়ে নিলেন, আমরা, প্যারাডাইস কাফে’র দলবল, ভারী মুশকিলে পড়ে গেলাম। আর কোকাকোলাকে বর্জন করার পথ রইল না। নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলেও নেরুদার পছন্দের এই পানীয়টি দিয়ে গলা ভেজানোর কোনও সুযোগ কিন্তু আমরা পেলাম না। কোকাকোলা কিনব, খাব, গলা ভেজাব… কিন্তু পয়সা কোথায়!

এরকম অনেক গল্প আমার স্মৃতিতে আজও রয়েছে।

এসব কাহিনি বা গল্প গীতাও জানত। আমি গীতাকে সবই বলেছিলাম। গীতাও তখন এসব ঘটনা বা গল্পের ভেতর ঢুকতে শুরু করেছে, বুঝতে চেষ্টা করছে। মজাও পাচ্ছে।

একদিন একটা বই গীতাকে উপহার দিলাম। আমার ভালোবাসার প্রথম চিহ্ন। এ বইটার লেখক জুলিয়াস ফুচিক। চেকোস্লোভাকিয়ার রাজনৈতিক কর্মী। হিটলারের নাৎসিবাহিনী এঁকে গ্রেপ্তার করে। মারাত্মক অত্যাচার হয় তাঁর ওপর। তাঁকে পাঠানো হয় কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে।

একদিন এঁকে সেই ক্যাম্পের জেলে হিটলারের ঘাতকরা অমানুষিকভাবে মেরে, জানোয়ারের মতো হাপ পা ভেঙে ফেলে রেখে দিয়ে চলে যায়। তখন তাঁর জ্ঞান নেই, কিছুই নেই। নিয়মমাফিক ডাক্তার এলো শুধু ডেথ সার্টিফিকেট দিতে; কিন্তু পরীক্ষা করে বিরক্ত হয়ে জেলখানার নোটবুকে একটি ছোট নোট দিয়ে চলে গেল। নোটটা হলো– এই লোকটার শরীরের গঠনতন্ত্র মানুষের নয়, ঘোড়ার। ফুচিক আশ্চর্যভাবে বেঁচে যান। মারলেন না। পরবর্তীকালে সুস্থ হয়ে এই বইটি লেখেন। ফুচিকের ডায়েরি। এটা লেখেন অতীব গোপনে জেলের ভেতরে। ডায়েরিটা নাৎসিবাহিনীর এক প্রহরী চুরি করে ছাপতে দেয় এক প্রকাশককে। ডায়েরিটা প্রথমে চেক ভাষাতে ছাপা হয়। খুব তাড়াতাড়ি বিভিন্ন ভাষায় ছেপে সমগ্র পৃথিবীতে বইটা প্রকাশ পায়। বইটির নাম, নোটস ফ্রম দ্য গ্যালোজ। বাংলায় অনুবাদ হয়ে বইটির নাম হয় ফাঁসির মঞ্চ থেকে

মৃণাল সেন গীতা সেন
১৯৪০ দশক

গীতা ছিল কলকাতা থেকে কুড়ি কিলোমিটার দূরে। উত্তরপাড়ার মেয়ে। যখন আমি গীতাকে প্রথম দেখি ভিড়ের মধ্যে, আমি ওর চোখের সুন্দর একটি চাউনিতে মুগ্ধ হয়ে যাই। অসাধারণ। সেই লজ্জাজড়ানো চোখের দৃষ্টি, অথচ কী সুন্দর অভিব্যক্তি। একই চোখের চাউনি, একইরকম অভিব্যক্তি পেয়েছিলাম অনেক পরে আরও একজনের মধ্যে– স্মিতা পাতিল!

কলকাতার ঠাসা ভিড়ের মধ্যেই বারবার গীতার সঙ্গে আমার দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে, বারবার সেই ভিড়ের মধ্যে কতবার কথাও হয়েছে। ভিড়ের মধ্যেই আবিষ্কার করলাম আমরা দু’জনেই দু’জনকে ভালোবেসে ফেলেছি। যাইহোক, সাত বছর বাদে আমরা বিয়ে করলাম। মনে পড়ে বিলি ওয়াইল্ডারের সুদর ছবি। আমার এক বন্ধু আমাদের বলতেন সেভেন ইয়ার ইচ

আমার পরিষ্কার মনে আছে একটি ঘটনা, যে ঘটনা মনে রাখাটাও যথেষ্ট মূল্যবান। সেটা হলো একদিন সন্ধেবেলা আমরা আবিষ্কার করলাম যে আমাদের ভবিষ্যৎটা আমাদেরই হাতে, ভবিষ্যৎ আমরাই গড়ব।

সে সময়ে আমরা দু’জনে ভিড় এড়িয়ে চলতাম। একদিন একটা ঘটনা ঘটল। কলকাতায় এসে গীতা পিসিমার বাড়িতে সপ্তাহ দুয়েক থাকবে কথা ছিল। একটি থিয়েটার গ্রুপে নাটকের মহড়া দেওয়ার জন্য ওকে এখানে থাকতে হয়। নাটকে গীতার ছিল প্রধান চরিত্র। কথা ছিল যে আমি হাওড়া স্টেশন থেকে একটি লোকাল ট্রেন ধরে সোজা উত্তরপাড়ার বাড়ি থেকে ওকে নিয়ে কলকাতায় পিসিমার কাছে পৌঁছে দেব। সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল। আমিও ঠিক সময়মতো হাওড়া স্টেশনে চলে এলাম। ট্রেনে ওঠার আগে হুইলার-এর স্টল থেকে একটা পেঙ্গুইন-এর বই কিনলাম। তখন পেঙ্গুইন-এর বই খুব সস্তা ছিল। বইটার নাম আ কেস ফর কমিউনিজম। লেখকের নাম গ্যালাচার। উনি হাউজ অব কমন্স-এর একমাত্র কমিউনিস্ট সদস্য ছিলেন। দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বইটায় চোখ বোলাচ্ছিলাম। আমার হাতঘড়িতে দেখলাম সময়টা। ছুটে উঠলাম চলন্ত ট্রেনে। সঙ্গে সঙ্গে বুঝলাম ভুল ট্রেনে উঠেছি যেটি লুপ লাইন ধরে চলছে। বলাবাহুল্য মেইন লাইন দিয়ে ট্রেনটা চলছে না। আমি সঙ্গে সঙ্গে পরের স্টেশনে নেমে অন্য ট্রেন ধরে অর্থাৎ মেইন লাইন ধরে চলতে শুরু করলাম। যখন গীতার উত্তরপাড়ার বাড়িতে পৌঁছলাম তখন দেরি হয়ে গিয়েছে। সূর্য তখন ধীরে ধীরে পশ্চিম আকাশে ডুবে যাচ্ছে। গীতাকে সঙ্গে নিয়ে ফেরবার সময় তাড়াতাড়ি আসবার জন্য গঙ্গা পার হয়ে এলাম। ঠিক করলাম গঙ্গার ওপর যে ব্রিজটা আছে সে ব্রিজটা পায়ে হেঁটে পার হব। ব্রিজের ওই প্রান্ত থেকে বাস ধরে কলকাতায় চলে আসব। সূর্যাস্তের অপূর্ব দৃশ্য সেটাও গঙ্গার ওপর ব্রিজের ওপর হাঁটতে হাঁটতে উপভোগ করার লোভ সামলাতে পারলাম না।

হাঁটতে হাঁটতে ব্রিজের মাঝখানে এলাম আমরা। একটু থামলাম ব্রিজের রেলিংটার কাছে। দূরের দৃশ্য দেখলাম, নীচের দিকে গঙ্গাবক্ষে চোখ মেললাম। গঙ্গার স্রোত বইছে আর ছোট ছোট ঢেউগুলো ব্রিজের বড় বড় পিলারগুলোর ওপর আছড়ে পড়ছে জলের ধাক্কা খাওয়ায় ছলাৎ ছলাৎ সুন্দর শব্দ কানে আসছে। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে, কোনওদিকে কোনও ফিসফিস শব্দও নেই। চারিদিকে শান্ত নীরবতা বিরাজ করছে। এ নীরবতাকে অনুভব করার লোভ সামলানো যায় না।


প্রচণ্ড
নার্ভাস
ছিলাম,
ঠোঁটটা গিয়ে
পড়ল ওর নাকের
উপর, আর আমার
হাতটাত কেঁপে আ কেস
ফর কমিউনিজম বইটা
সেই
অসতর্ক
মুহূর্তে হাত
ফসকে গঙ্গার
জলে গিয়ে পড়ল

সুন্দর মুহূর্তগুলো চলে যাচ্ছে। তখনই সেই অবশ্যসম্ভাবী ঘটনা ঘটল। আমি এই প্রথম গীতার হাতদুটো দু’হাত দিয়ে ধরতে গেলাম। এর আগে আমরা কখনও ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করিনি, কিন্তু সেদিন আমি গীতার হাত ধরে ওকে চুমু খাওয়ার চেষ্টা করলাম। প্রচণ্ড নার্ভাস ছিলাম, ঠোঁটটা গিয়ে পড়ল ওর নাকের উপর, আর আমার হাতটাত কেঁপে আ কেস ফর কমিউনিজম বইটা সেই অসতর্ক মুহূর্তে হাত ফসকে গঙ্গার জলে গিয়ে পড়ল। আমার প্রথম চুম্বনের সঙ্গে কমিউনিজমের সপক্ষে গ্যালাচারের যুক্তিজাল গঙ্গায় ভেসে গেল।

গীতা সেন মৃণাল সেন
১৯৭০ দশক

আমার বাবার সঙ্গে গীতার একটা সুন্দর সম্পর্ক ছিল। বাবা গীতাকে পছন্দ করত বেশ কতকগুলো কারণে। গীতার যুক্তিবাদী মানসিকতা, গীতার গল্প বলার সুন্দর সপ্রতিভ ভঙ্গি, গীতার কবিতা পড়ার ভঙ্গি ও উচ্চারণ। এতগুলো মহৎ কারণের জন্য গীতাকে খুবই পছন্দ করত। বাবা গীতাকে কল্যাণী নামে ডাকত। বাবার নিজের পছন্দের নাম। এসব ঘটনা আমাদের বিয়ের আগে। একদিন বাবা কোনও একটি বিশেষ দিনে গীতাকে নিজের কাছে ডেকে পাঠাল একান্ত ব্যক্তিগত কারণে। গীতাকে তার জীবনের কিছু গোপন কথা বলল। সে গোপন কথা বা কাহিনি হলো বাবা তার যৌবনে বাবার বিধবা অল্পবয়সি কাকিমাকে ভালোবাসতেন। যে কাকিমা বাবার চাইতে বয়সে ছোট ছিলেন। ভারী মিষ্টি দেখতে ছিল বাবার কাকিমা। কাকিমা খুব অল্প বয়সে বিধবা হন। কিন্তু সেই সময়ে সামাজিক বিধিনিষেধের জন্য সে ভালোবাসাটা দানা বাঁধে না, কোনও রূপ নেয় না। তবুও বাবা গীতার কাছে স্বীকার করেছিল যে সেই ভদ্রমহিলাকে বাবা ভোলেনি। গীতাকে বলেছিল এ কথা তুমি কাউকে বলবে না। এমনকী জানতেও দেবে না। ” Not to tell her, never to let her know. “

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল এই ইংরেজি বাক্যটা কার লেখা জানো কি?

গীতা কথাটা বুঝতে পারল না। বাবা বলল, এটা এনক আর্ডেন কবিতার একটি লাইন। কবি টেনিসনের একটি অসামান্য সৃষ্টি। তারপর বলল এনকের গল্পকথা। বাবা টেনিসনকে ভালোবাসত এবং এ লাইনটাকেও। “Not to tell her, never to let her know. “

এ ঘটনা আমাদের বিয়ের এক বছর আগের ঘটনা। গীতা এ কথা গোপন রেখেছিল। বাবার মৃত্যুর পর গীতা এ কথা আমাকে বলেছিল। বাবার একান্ত গোপন ভালোবাসার কথা, লুকিয়ে লুকিয়ে চুপিচুপি ভালোবাসার কথা।

মৃণাল সেন গীতা সেন
১৪ মে ২০১৫ । মৃণালের ৯২তম জন্মদিনে

বাবা খুব আশা করেছিল গীতাকে মঞ্চে একবার দেখবে, গীতার অভিনয় দেখবে। সে সুযোগ বাবার আর আসেনি।

Print Friendly, PDF & Email
মাস্টার ফিল্মমেকার; ভারত । জন্ম : ১৪ মে ১৯২৩; ফরিদপুর, বাংলাদেশ । মৃত্যু : ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮; কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত ।। ফিচার ফিল্ম : রাত ভোর; নীল আকাশের নীচে; বাইশে শ্রাবণ; পুনশ্চ; অবশেষে; প্রতিনিধি; আকাশ কুসুম; মাটির মণীষা; ভুবন সোম; ইন্টারভিউ; এক আধুরি কাহানি; কলকাতা ৭১; পদাতিক; কোরাস; মৃগয়া; ওকা উরি কথা; পরশুরাম; একদিন প্রতিদিন; আকালের সন্ধানে; চালচিত্র; খারিজ; খণ্ডহর; জেনেসিস; একদিন আচানক; মহাপৃথিবী; অন্তরীণ; আমার ভুবন । শর্টফিল্ম : ইচ্ছাপূরণ; তসবির আপনি আপনি; অপরাজিত; কাভি দূর কাভি পাশ; সম্ভার; আয়না; রবিবার; আজকাল; দো বাহেনে; জিত; সালগিরা; শাল; আজনবি; দশ সাল্ল বাদ । ডকুমেন্টারি : মুভিং পারসপেকটিভস; ত্রিপুরা প্রসঙ্গ; সিটি লাইফ-- কলকাতা মাই এল দোরাদো; এন্ড দ্য শো গোজ অন

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here