সাক্ষাৎকার । শিবকুমার শ্রীনিবাসন
অনুবাদ । সংহিতা সেন
অনুবাদকের নোট
ভারতীয় সাংবাদিক শ্রীনিবাসন শিবকুমার সদ্যপ্রয়াত চলচ্চিত্র পরিচালক মৃণাল সেনের এই সাক্ষাৎকারটি ১৯৮২ সালে চেন্নাইতে নিয়েছিলেন যা মুম্বাইয়ের একটি ট্যাবলয়েড পত্রিকায় ছাপা হয়। গত তিরিশে ডিসেম্বর মৃণাল সেনের প্রয়াণের পর শিবকুমারের শ্রদ্ধাঞ্জলিতে ব্যক্তি মৃণাল সেন সম্পর্কে বেশ কিছু কথা তুলে ধরেন– যা একেবারে অজানা না হলেও, মৃণাল সেনের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থানগত যাপনকে প্রকাশ করে। আশির দশকে ঝাঁ চকচকে স্টুডিও এবং ছবি প্রক্রিয়াকরণের কারিগরি কুশলতার কারণে দক্ষিণ ভারতের মাদ্রাজ চলচ্চিত্র সংক্রান্ত কাজকর্মের মক্কা হয়ে উঠেছিল। রাজকাপুর, নন্দমুড়ি তারক রামারাও, প্রেম নাজির প্রমুখ ভারতীয় চলচ্চিত্রের নামজাদা তারকারা তাদের ভক্তবাহিনীর নজর এড়াতে এখানেই থাকতেন। তারকাদের উপযোগী গা ঢাকা দেবার আশ্রয় ছাড়াও এই শহরের অহংকার করার মতো প্রতিভাবান প্রযুক্তিবিদদের একটা দল ছিল যারা মৃণাল সেন এবং সত্যজিৎ রায়ের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রপরিচালকদের ছবি সৃষ্টির কল্পনাকে নিপুণ ধাত্রীর দক্ষতায় বাস্তবায়িত করেছেন।
শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত, মূল্যের দিক থেকে সাশ্রয়ী এবং শহরে সবচেয়ে ভালো ইডলির গর্বিত প্রাপ্তিস্থান হিসাবে হোটেল পামগ্রোভ শহরের দর্শনার্থীদের কাছে আকর্ষণীয় থাকার জায়গা ছিল। হোটেলের লবিতে অপেক্ষারত অবস্থায় সহজেই কোকিলা মোহন, সোমায়াজুলু অথবা মৃণাল সেনের মতো মানুষদের সাথে দেখা হয়ে যাওয়াটা জলভাত ছিল। হোটেলের ঠিক পাশেই অবস্থিত জেমিনি ছিল মৃণাল সেনের সবচেয়ে পছন্দের ল্যাবরেটরি। হোটেলের পরিষেবাকর্মীদের কাছে দারুণ জনপ্রিয় ছিলেন মৃণাল সেন, এইজন্যে নয় যে এই কর্মীরা তার ছবির গভীর অনুরাগী ছিলেন বা তিনি এই কর্মীদের প্রচুর বখশিশ দিতেন। তার জনপ্রিয়তার কারণ ছিল এদের সাথে তার মানবিক ও সহমর্মী ব্যবহারের জন্যে। তিনি এদের খোঁজ রাখতেন এবং এমনভাবে আপন করে নিয়ে আড্ডা দিতেন যেন মনে হতো যিনি এদের কতকাল ধরে না যেন চেনেন। তবে এই কর্মীরা সকলেই জানতেন যে মৃণাল সেন একজন বিখ্যাত চিত্র পরিচালক।
শিবকুমার যখন প্রথম মৃণাল সেনের সাথে দেখা করতে হোটেল পামগ্রোভে যান, মৃণাল সেন যে এই হোটেলেই উঠেছেন, সে খবর তিনি এমন একজন পরিষেবাকর্মীর কাছ থেকেই পেয়েছিলেন। কোকিলা মোহনের সাথে সাক্ষাতের সময় মৃণাল সেনের নাম ওঠাতে যে ওয়েটার ওনাদের খাবার পরিবেশন করছিলেন, তিনি বলেছিলেন যে সেন ওখানেই আছেন। আরেকজন কর্মী বলেছিলেন, “ইনি বিদেশে দেশের চেয়েও বেশি নামজাদা পরিচালক।” মৃণাল সেনের মৃত্যুর পর শিবকুমারের শ্রদ্ধাঞ্জলিতে তার সঙ্গে তার মৃণালদার প্রথম সাক্ষাতের সূত্রে তিনি এই গল্পগুলো স্মরণ করেছেন। ওই স্মৃতিচারণেই ওনার ১৯৮২ এবং ১৯৮৪ সালে নেওয়া সাক্ষাৎকার দুটির কথা জানতে পারি। এক শুভানুধ্যায়ীর সাহায্যে কপাল ঠুকে ওনাকে একটা বৈদ্যুতিন চিঠি লিখে জিজ্ঞেস করি যে ওনার কাছে সেই সাক্ষাৎকার দুটি আছে কিনা। ওনাকে এও জানাই, আমি ৭০-এর দশকের ভারতীয় বাংলা রাজনৈতিক ছবি নিয়ে কাজ করি এবং সাক্ষাৎকারগুলো আমার গবেষণার কাজে লাগতে পারে। পরের দিনই তার উত্তর পাই এবং এর পরের দিন তিনি আমাকে সাক্ষাৎকার দুটি স্ক্যান করে পাঠান। আমি মাননীয় শিবকুমার শ্রীনিবাসনের কাছে কৃতজ্ঞ আমাকে সাক্ষাৎকারটির কপি পাঠানোর জন্যে।
পড়তে পড়তে আমার মনে হোলো যে সাক্ষাৎকার দুটির বঙ্গানুবাদ করলে আরেকটু বেশি পাঠকের কাছে ওনার ভাবনাগুলোকে পৌঁছে দেওয়া যাবে। রুদ্র মৃণাল সেনের প্রয়াণের পরের দিন থেকেই ওনার লেখা এবং ওনাকে নিয়ে নানান লেখা ফিল্মফ্রিতে প্রকাশ করছে দেখে ভাবলাম, এই মঞ্চের জন্যেই অনুবাদটা করি। উপমহাদেশের এবং আন্তর্জাতিক তৃতীয় সিনেমা চর্চার অন্যতম এই পথিকৃৎ চলচ্চিত্র নির্মাতার প্রতি এ আমার শ্রদ্ধাজ্ঞাপন।

সাক্ষাৎকারকের নোট
আমি যখন কমল হাসানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ওনার আভাল আপ্পাদিথন [১৯৭৮] ছবিটির সাফল্যের নেপথ্যে ছবিটিকে মৃণাল সেনের প্রভূত প্রশংসার করার কোনও ভূমিকা আছে কিনা, কমল ঝটিতি প্রতিপ্রশ্ন করেছিলেন, “মাদ্রাজে মৃণাল সেনকে চেনেটা কে?” কমল যা বলেছিলেন তা সম্পূর্ণ সত্যি। ভারতীয় সিনেমার পরম দুর্ভাগ্য যে আমাদের কিছু শ্রেষ্ঠতম পরিচালককে তার নিজের দেশেই বিভিন্ন জায়গায় অনেকাংশে অপিরিচিতই থেকে যান। একজন দক্ষিণ ভারতীয়ের নিজেকে ভাগ্যবান মনে করার কথা যদি এই প্রতিভাবান কিন্তু আপসহীন পরিচালক মৃণাল সেনের অন্ততঃ কয়েকটি ছবিও তার পক্ষে দেখা সম্ভব হয়, গুরুত্বের নিরিখে যার স্থান সত্যজিৎ রায়ের [ইনিই-বা কে?!] পাশাপাশিই।
সেন মাদ্রাজে এসেছিলেন ওনার সাম্প্রতিকতম ছবির [খারিজ; ১৯৮২] কাজ শেষ করতে। অপরিচিতির বাধা অনায়াসে দুর করে দেবার একটা অনাবিল ক্ষমতা ছিল ওনার। আমাদের চেনাজানা কিছু খাদি-পরিহিত দাড়িগোঁফ-শোভিত ছদ্ম বুদ্ধিজীবীদের মেকি বাক্য-বিন্যাস ওনার কথাবার্তার মধ্যে লক্ষণীয়ভাবে অনুপস্থিত ছিল। সাদা চুড়িদার আর কুর্তা পরিহিত মৃণালদা যখন কথা বলতেন, তার মুখ থেকে অনর্গল সিগারেটের ধোঁয়ার কুণ্ডলী বেরোতেই থাকত। দেখা হতে আমাকে প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন, “কমল হাসান সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?” আমার উত্তরের পৃষ্ঠে তিনি বললেন, “ছেলেটির অভিনয় আমার বড় ভালো লাগে। আমি ওর কয়েকটা ছবি দেখেছি [আভাল আপ্পাদিথান এবং কোকিলা] যাতে ও অসাধারণ অভিনয় করেছে। আমার মনে হয় এই বাণিজ্যিক ছবির জগৎ ওকে কোনোভাবেই প্রভাবিত করতে পারবে না, কারণ ও কি করছে সে বিষয়ে ও সম্যকভাবে অবহিত।”

সাক্ষাৎকার
শিবকুমার শ্রীনিবাসন
আপনার নিজের জীবন সম্পর্কে কিছু বলুন।
মৃণাল সেন
বলার মতো রোমাঞ্চকর আমার কিছু নেই। চলচ্চিত্র নির্মাণে আমার এসে পড়াটা নেহাৎই আকস্মিক। কলেজের পড়াশোনা শেষ করার পরে আমার ছবির জগতে আসার সম্ভাবনার কথা প্রথম মনে হয়। এই মনে হওয়াটাও আকস্মিকই ছিল। ছবি নিয়ে খুব বিরাট কিছু করব– এ ব্যাপারেও আমি নিশ্চিত ছিলাম না। সিনেমা নিয়ে আমি যে বিশেষভাবে উৎসাহী ছিলাম, এমনটাও নয়।
শিবকুমার শ্রীনিবাসন
ঠিক কখন আপনার মনে হলো যে বাণিজ্যিক ছবির বাইরে আপনি যেমন ধরনের ছবি বানান, তাই বানাতে চান?
মৃণাল সেন
সিনেমার সাথে আমার একটা স্বাচ্ছন্দ্যের সম্পর্ক তৈরি হবার পর, আমি এই মাধ্যমকে সমাজ এবং নানা বিষয়ের প্রতি আমার নিজের প্রতিক্রিয়াকে উপস্থাপন করার জন্যে ব্যবহার করার কথা ভাবলাম।
শিবকুমার শ্রীনিবাসন
এক বিখ্যাত চিত্রপরিচালক আমায় একবার বলেছিলেন যদিও আর্টহাউস বা সমান্তরাল এবং বাণিজ্যিক এই দু’ধরনের সিনেমার সুস্পষ্ট অস্তিত্ব থাকা সত্বেও, তিনি নিশ্চিৎ নন যে সমান্তরাল ছবি কখনও ছবির বাণিজ্যিক দিকটাকে পরাভূত করে টিঁকে থাকতে পারবে। আপনার এ বিষয়ে কী মনে হয়?

ফিল্মমেকার । মৃণাল সেন
মৃণাল সেন
দেখুন আমি সিনেমার এই শ্রেণীবিভাগ একেবারেই মানি না। সিনেমাকে আমি একটা শিল্পমাধ্যম বলে মনে করি। আমার মতে শিল্পরুচিবিগর্হিত কোনো কিছুই সিনেমা থাকে না আর। আমি এভাবেই বিষয়টা দেখি। কিন্তু বাণিজ্যিক বিষয়ের কথা যদি তোলেন, তার অন্য একটা দিক আছে। আমি গরিষ্ঠ সংখ্যক দর্শকের কাছে পৌঁছতে চাই। আর যখন আমার ছবি একটা বড় সংখ্যক দর্শকের কাছে পৌঁছতে সক্ষম হয়, তা প্রয়োজনীয় অর্থসংগ্রহ করে বাণিজ্যিকভাবেও সফল হয়। কিন্তু আমি যে ধরনের ছবি বানাই তা কদাচিৎ বৃহত্তর জনতার কাছে পৌঁছয় আর আমি তার জন্যে দুঃখিত। এই কারণেই আমি সবসময়ে আমার ছবির বিষয়কে সম্প্রসারণ করার চেষ্টা করি, আরেকটু বেশিসংখ্যক মানুষ, যারা আমার ছবির দর্শক-পরিসরের বাইরে আছেন, তাদের কাছে পৌঁছনোর জন্যে। আর এইভাবেই আমার ছবিগুলো দেশ এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্র থেকে উল্লেখযোগ্য অর্থ উপার্জন করে। সাধারণত আমার ছবির জন্যে আমি অনেক দর্শক পাই, যদিও আমার নিজের দেশে অনেকেই তা দেখে না। আমার ছবিগুলোকে আমি বাণিজ্যিকভাবে সফল মনে করি; কারণ ছবিতে লগ্নিকৃত মূলধন পুনরুদ্ধার করা ছাড়াও আমার ছবি আর্থিক লাভ করে।
শিবকুমার শ্রীনিবাসন
আপনার কি মনে হয় না আপনি জনসাধারণের সাথে যোগাযোগস্থাপনে ব্যর্থ হয়েছেন?
…
অনেক
সময়ই
দেখা যায়,
দর্শক একটা
সিরিয়াস ছবির
তুলনায় একটা বোকা-বোকা
খারাপ ছবিকে বেশি পছন্দ করছে
…
মৃণাল সেন
ব্যর্থ কে হয়নি? চটুল ও লঘু লেখকদের সাপেক্ষে রাশভারী, ঐকান্তিক, ও গুরুতর লেখকরাও তো ব্যর্থ হন। বৃহত্তর পাঠক-সমাজের কাছে পৌঁছতে অনেক সময় তারা অসফল হন। তার মানে তো এই নয় যে তাদের লেখায় কোনো খামতি আছে। অনেক সময়ই দেখা যায়, দর্শক একটা সিরিয়াস ছবির তুলনায় একটা বোকা-বোকা খারাপ ছবিকে বেশি পছন্দ করছে। আর এ শুধু যে আমাদের দেশে হয় , তা কিন্তু নয়। এই প্রবণতা বিশ্বব্যাপী।
শিবকুমার শ্রীনিবাসন
আপনি কখনও এর কারণগুলো বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন?
মৃণাল সেন
দেখুন এটা কোনো জটিল বিষয় নয়। বেশির ভাগ দর্শকই কোনো ছবিকে সম্পূর্ণভাবে বোঝার চেষ্টা করে নিজের মাথা খাটানোতে উৎসাহী নয়। একজন পাঠক হবার জন্যে অক্ষর পরিচয়ের সবিশেষ প্রয়োজন ঠিকই, কিন্তু একজন ভালো পাঠক হবার জন্যে অক্ষর পরিচয়ের সাথে সাথে বুদ্ধিমত্তারও প্রয়োজন। একইভাবে একটা ভালো ছবিকে সঠিকভাবে তারিফ করার জন্যে নিজেকে প্রশিক্ষিত করাটা খুব জরুরি।
শিবকুমার শ্রীনিবাসন
বৃহত্তর দর্শকসমষ্টির কাছে পৌঁছতে হলে, আমার কিন্তু মনে হয়, আপনার হিন্দিতে ছবি করা উচিত।
…
নিজের
ভাষায়
ছবি করার
মতো আনন্দ
আর কিছুতেই নেই
…
মৃণাল সেন
আপনি ঠিকই বলেছেন। কারণ হিন্দি হচ্ছে আমাদের দেশে একটা আন্তঃরাজ্য যোগসূত্রের ভাষা। ছবিকে বৃহত্তর দর্শকের কাছে পৌঁছনোর জন্যে হিন্দি আদর্শ। আমি তিনটে ছবি করেছি হিন্দিতে, যার মধ্যে দুটো রাষ্ট্রপতির সুবর্ণ পদক পেয়েছে। কিন্তু নিজের ভাষায় ছবি করার মতো আনন্দ আর কিছুতেই নেই, জানেন। ভাষার খুঁটিনাটি সবটুকু আপনার জানা থাকার ফলে একটা অসম্ভব নিশ্চিন্তবোধ ঘিরে থাকে। হিন্দিতে শেষ ছবি আমি ১৯৭৬ সালে করেছি। আরেকটি করার কথাও এখন গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছি।
শিবকুমার শ্রীনিবাসন
কিছু সিরিয়াস ছবির পরিচালক বলেন, তারা আপনার মতো ছবি তৈরি করতে পারেন না, কারণ তাদের আপনার মতো স্বাধীনতা নেই। আপনি কীভাবে এটা করেন?
মৃণাল সেন
স্বাধীনতা কি উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া কিছু? একে তো অর্জন করতে হয়। যারা বলেন তাদের স্বাধীনতা নেই বা মুক্ত নন, তারা কখনও স্বাধীনতা অর্জনের চেষ্টা করেননি। আমার স্বাধীনতা আমি অর্জন করেছি।

আকালের সন্ধানের শুটিংয়ে
শিবকুমার শ্রীনিবাসন
আমাদের চলচ্চিত্রের উন্নতিকল্পে কি করা উচিত বলে আপনার মনে হয়?
মৃণাল সেন
সর্বপ্রথমে ভালো ছবির জন্যে একটা যথাযথ পরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন। যেমন ধরুন গত তিনদিন ধরে পরপর আপনি এখানে আসছেন ছবি নিয়ে আমার সাথে কিছু আলোচনা করবার জন্যে। এই বিষয়টা খুবই জরুরি। এইটা থেকে বোঝা যায়, আপনার সিনেমা নিয়ে একটা গভীর আসক্তি বা ভালোবাসা আছে। সারা দেশের নানান জায়গায় অজস্র ফিল্ম সোসাইটি আছে। এই সোসাইটিগুলোর মাধ্যমে সদস্যরা নানা ধরনের খুবই বৈচিত্রপূর্ণ ছবির সংস্পর্শে আসছেন। যা দেখছি তার সব ছবিকেই যে পছন্দ করতে হবে, তা নয়। বিষয়টা হচ্ছে, বিশ্ব চলচ্চিত্রের সাথে পরিচিতি হওয়াটা আশু প্রয়োজন; সিনেমার ভাষা, যা অতি দ্রুত উন্নত ও পরিবর্তিত হচ্ছে, তার সাথে পরিচিতি হওয়া দরকার। ভারতে এই পরিবেশ ইতিমধ্যে প্রস্তুত হয়েই আছে। বিশ বছর আগেও সিরিয়াস ছবির নির্মাতাদের গোষ্ঠীটা অতি ক্ষুদ্র ও অকিঞ্চিৎকর ছিল। ফলে আমরা কোনো দীর্ঘস্থায়ী ছাপ ফেলতে সক্ষম হইনি। কিন্তু দেখুন এখন ধীরে ধীরে সারা দেশজুড়ে তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতারা উঠে আসছেন। এইটা খুবই স্বাস্থ্যকর লক্ষণ।
…
লৌহদৃঢ়
একটা প্রতীজ্ঞায়
অবিচল থেকে আমরা
সিনেমার চূড়ান্ত বাণিজ্যকরণের
বিরুদ্ধে এককাট্টা হয়ে যুদ্ধ করি
…
এখানে আমি তাদের কথাই কেবল বলছি যারা ভালো সিনেমা নিয়ে উৎসাহী। এই সংখ্যাটা বাড়ছে। এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি দরকার হচ্ছে এইরকম ছবি বানানো এবং ইন্ডাস্ট্রির বহিরাবরণের চাকচিক্য দেখে আত্মহারা না হয়ে যাওয়া। কেবল এইভাবেই কারুর পক্ষে সিরিয়াস সিনেমার স্বার্থে প্রচুর কাজ করা সম্ভব। আমাদের দেশে এটাই হচ্ছে। অন্য আর কীভাবে আমি একটা ছবি বানিয়ে বি ভি করন্থকে তার সংগীত তৈরি করতে বলতে পারতাম? আমার তিনটি ছবিতে তিনি সংগীত রচনা করেছেন। এমন নয় যে আমরা ঝগড়া করি না। লৌহদৃঢ় একটা প্রতীজ্ঞায় অবিচল থেকে আমরা সিনেমার চূড়ান্ত বাণিজ্যকরণের বিরুদ্ধে এককাট্টা হয়ে যুদ্ধ করি।
শিবকুমার শ্রীনিবাসন
অর্থনৈতিক লাভ ছাড়া আর অন্য কোনো প্রত্যাশা নিয়ে আপনি ছবি বানান?
মৃণাল সেন
প্রাথমিকভাবে আমি আমার দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামত দর্শকদের সাথে শেয়ার করতে চাই। আমার চারপাশের বাস্তবতা আমি তাদের দেখাতে চাই। আমার ছবির মাধ্যমে আমি এটুকুই দর্শকদের কাছে পৌঁছে দিতে চাই। আর আমার ক্ষেত্রে যেমন, এ বিষয়টা আমার সহকর্মীদের ক্ষেত্রেও ঠিক ততটাই সত্যি। দর্শকের আমার দৃষ্টিভঙ্গির সাথে ঐক্যমত পোষণ করা জরুরি নয়। একটা বিতর্ক শুরু করতে পারাটাই আমার মূল উদ্দেশ্য। আমি এমন একটা পরিবেশ চাই যেখানে সামাজিক, রাজনৈতিক, এবং নৈতিক যেকোনো বিষয় বুদ্ধিমত্তার সাথে অবাধে ও অসঙ্কোচে আলোচনা করা সম্ভব। আর ঠিক এই কারণেই আমি ছবি বানাই।
শিবকুমার শ্রীনিবাসন
আপনার ছবিতে বিনোদনের এত অভাব কেন? বিনোদনের সাথে বাস্তবতা কি একেবারেই সহাবস্থান করতে পারে না?
মৃণাল সেন
বিনোদন বলতে আপনি কী বলতে চাইছেন, তা আমার কাছে পরিষ্কার নয়। বিনোদন বলতে আপনি যদি নিছক রঙ্গ-তামাশার কথা বলেন, তাহলে বলব আমি তার জন্যে প্রস্তুত নই। বিনোদনের ধারণাকে আপনি ব্যাখ্যা করবেন ঠিক কীভাবে? কোনো সার্বজনীন ধারণা তো নেই। যেমন ধরুন, সিরিয়াস কিছু দেখলে আমি উদ্দীপ্ত বোধ করি এবং আমার তাতে বিনোদন হয়। আমি চেষ্টা করি আমার ছবিতে যা কিছু আছে তা যেন কোনো না কোনোভাবে মানুষের অভিজ্ঞতাপ্রসূত হয়। মানুষের অভিজ্ঞতা বা অনুভবের বাইরে আর কিচ্ছু পাবেন না আপনি আমার ছবিতে। রঙ্গ-তামাশার, কৌতুক বা হাস্যরসই তো বিনোদনের একমাত্র মাপকাঠি হতে পারে না।
শিবকুমার শ্রীনিবাসন
সিরিয়াস সিনেমার প্রতি আপনি কতটা দায়বদ্ধ?
…
সিনেমা ছাড়া
আমি আর
কিছুই জানি না
…
মৃণাল সেন
সিনেমা আমার সমস্ত সত্তা জুড়ে আছে। আমার বেঁচে থাকা, কথা বলা, স্বপ্ন দেখা সমস্তটা সিনেমাকে ঘিরে। সিনেমা ছাড়া আমি আর কিছুই জানি না।
শিবকুমার শ্রীনিবাসন
সত্যজিৎ রায়ের ছবি সম্পর্কে আপনার কী মূল্যায়ন?

মৃণাল সেন
দেখুন, এই মানুষটা এক অর্থে পথপ্রদর্শক। ওনার আগে ভালো ছবির নির্মাণ ছিল অনিয়মিত এবং অনির্দিষ্ট। পথের পাঁচালী তৈরির আগে পর্যন্ত ভারতীয় চলচ্চিত্র তেমন যুগান্তকারী কিছু প্রবর্তন করে উঠতে পারেনি। সে এক অপূর্ব ছবি। তারপর থেকেই তিনি ছবি বানাচ্ছেন। চলচ্চিত্র নির্মাণের পেশাগত জীবনে তিনি যা যা করেছেন তাতে আমি মুগ্ধ, যদিও তার কিছু ছবির সমালোচনাও আমি করেছি।
শিবকুমার শ্রীনিবাসন
বিনোদনের নামে দর্শকদের যে ক্রমাগত অশিষ্টতা বা অশ্লীলতা এবং হিংসা পরিবেশন করা হয়, আপনার তা নিয়ে কী অভিমত?
মৃণাল সেন
এই বিষয়টাও দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভরশীল, অর্থাৎ অশিষ্টতা বা অশ্লীলতা এবং হিংসাকে আপনি কিভাবে সংজ্ঞায়িত করেন, তার ওপর। আমি অসংখ্য ছবি দেখেছি যাতে নারী ও পুরুষ চরিত্রেরা নানাবিধ পোশাকে সম্পূর্ণ আবৃত হয়ে একে অপরের থেকে অযৌক্তিক শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা সত্বেও তাঁদের কথাবার্তা এবং অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে যে অশিষ্টতা বা অশ্লীলতার বহিঃপ্রকাশ হয়, তার থেকে অশিষ্টতর বা অশ্লীলতর আর কিছু হতে পারে না। অন্যদিকে বিশ্বচলচ্চিত্রে যৌনতাকে সরাসরি দেখানোও দেখেছি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমার এই দৃশ্যগুলোকে অর্থহীনভাবে ভোঁতা মনে হয়েছে। অনেকগুলো ক্ষেত্রে আবার দৃশ্যগুলোকে নান্দনিকঅর্থে খুব সুপ্রযোজ্য এবং আকর্ষণীয় লেগেছে। সুতরাং পুরো বিষয়টাই নির্ভর করে কেন এবং কিভাবে কেউ দৃশ্যটা ব্যবহার করছে, তার ওপর। চলচ্চিত্রে যৌনতা বা হিংসার ব্যবহারের ওপর আমি কোনো সার্বজনীন নিষেধাজ্ঞার পক্ষপাতী নই। এই বিষয়গুলো সম্পূর্ণ নির্ভর করে সামাজিক, শৈল্পিক এবং নৈতিক প্রাসঙ্গিকতার ওপর। অন্তত আমি এভাবেই দেখি।
শিবকুমার শ্রীনিবাসন
অবশ্যম্ভাবীভাবে যৌনতা হলেও আমাদের চলচ্চিত্রে কি যৌনতাকে অশ্লীলতার সমার্থক হিসাবেই দেখা হয় না?
মৃণাল সেন
না, অবশ্যম্ভাবীভাবে যৌনতা কখনোই অশ্লীল নয়। তবে আমাদের ছবিতে যেভাবে তা দেখানো হয় তা খুবই খারাপ। আসলে কি জানেন, যৌনতা ছবিকে বিক্রি করার জন্যে একটা পণ্য হিসাবে ব্যবহার করা হয়। আমাদের বিজ্ঞাপনেও তো নারীদের একটা বিক্রয়যোগ্য পণ্য হিসাবেই গণ্য করা হয়। এই প্রবণতাটা ভয়াবহ এবং তা চলতে দেওয়া উচিত না। আর এই প্রবণতাটাকেই আমার অশ্লীল বলে মনে হয়।
শিবকুমার শ্রীনিবাসন
কেন্দ্রীয় সরকার আমাদের সিনেমার উৎকর্ষসাধনের জন্যে কী কী পদক্ষেপ নিচ্ছে?
মৃণাল সেন
ভালো ছবি তৈরির লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় সরকার বেশ কিছু নীতি গ্রহণ করেছে। যেমন ধরুন, আগে যা ফিল্ম ফিন্যান্স করপোরেশন বা চলচ্চিত্র অনুদান আয়োগ ছিল তা এখন জাতীয় চলচ্চিত্র উন্নয়ন পর্ষদ। আগে কেবল তারাই চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্যে আর্থিক অনুদান পেতেন, যারা জমি অথবা অন্যকোনো সম্পত্তি দাখিল করে লগ্নিকৃত অর্থ ফেরত দেবার অঙ্গীকার করতে সক্ষম ছিলেন। সুতরাং এই আর্থিক সাহায্য কেবল অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধিশালী পরিচালকদেরই আয়ত্বাধীন ছিল। ১৯৬৮ সালে একজন অকিঞ্চিৎকর ব্যক্তি চলচ্চিত্র অনুদান আয়োগে গিয়ে দেড় লক্ষ্ টাকার অর্থসাহায্য চায় একটা সাদা কালো ছবি বানানোর জন্যে। সে পরিষ্কার বলে যে তার পক্ষে কোনো সম্পত্তি বা জমি জামিন হিসাবে দেখানো সম্ভব নয়। এটি একটি খুবই ক্ষুদ্র উদ্যোগ ছিল যা পরবর্তীতে বাণিজ্যিকভাবেও সফল হয়। ছবিটার নাম ছিল ভুবন সোম আর আমি ছবিটা বানিয়েছিলাম। কিন্তু সেটাই প্রথম কোনোরকম জামিন ছাড়া কোনো আবেদন ছিল। জাতীয় চলচ্চিত্র উন্নয়ন পর্ষদ এখন চলচ্চিত্র প্রদর্শশালা নির্মাণের কথাও ভাবছেন– যাতে এই ঘরানার ছবিগুলো মুক্তি পায় এবং প্রদর্শিত হয়।

শিবকুমার শ্রীনিবাসন
এটেনবরোর গান্ধী ছবিটাকে সরকারি সাহায্য দেওয়া নিয়ে আপনার কী অভিমত?
মৃণাল সেন
দেখুন, আমি জাতীয় চলচ্চিত্র উন্নয়ন পর্ষদের একজন অধিকর্তা এবং আমরা এই প্রকল্পটার সাথে জড়িত। ফলে আমি আপনাকে এই প্রকল্পটির বিষয়ে বিশদে কিছু বলতে পারব না। কিন্তু এটুকু বলতে পারি, আমি এত বড় প্রকল্পে সরকারের আর্থিক সাহায্য দেবার পক্ষপাতী নই। ব্যক্তিগতভাবে আমি স্বল্প খরচে ছবি তৈরি করায় বিশ্বাসী।
শিবকুমার শ্রীনিবাসন
একজন ভারতীয় পরিচালক আরো ভালোভাবে ছবিটি করতে পারতেন– এই অভিযোগ সম্পর্কে আপনার কি বক্তব্য?
মৃণাল সেন
আমার তেমন মনে হয় না। পৃথিবীতে যেকোনো ব্যক্তি যেকোনো বিষয় নিয়ে ভালো ছবি বানাতে সক্ষম। এমনকি যদি আমি হিটলারের ওপরেও কোনো ছবি বানাতে চাই, আমার তা বানাতে পারার স্বাধীনতা থাকা উচিত। রিচার্ড এটেনবরোর বিশ্বাস করেন, তার পক্ষে ছবিটি বানানো সম্ভব, আর এই কারণেই আমি ওনার এই ছবিটি বানানোর বিরুদ্ধে নই।
শিবকুমার শ্রীনিবাসন
যেমন একজন ভারতীয় ইদি আমিনের ওপর একটা ছবি বানিয়েছেন?
মৃণাল সেন
হ্যাঁ, কিন্তু আমি সেই ছবিটা সম্পর্কে কিছু জানি না। আমার সাথে ওনার দেখা হয়েছিল, কিন্তু আমি খুব একটা উৎসাহিত হতে পারিনি। সব চিত্রপরিচালকই তো আর ভালো বক্তা হন না। যে বিষয়টি মাথায় রাখার, তা হলো– সরকারের এত বড় প্রকল্পের সাথে আর্থিকভাবে জড়িয়ে পড়াটা আমার সঠিক বলে মনে হয় না।
শিবকুমার শ্রীনিবাসন
হালফিলের একঝাঁক নতুন চিত্রপরিচালক সম্পর্কে আপনার কী মনে হয়?
…
পৃথিবীর
শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের
প্রতিটা কাজেও তো
সবসময়ে
শ্রেষ্ঠত্ব
থাকে
না
…
মৃণাল সেন
তারা সকলেই দারুণ কাজ করছেন। তাদের মধ্যে একটা লড়াকু মনোভাব আছে যা দিয়ে ইন্ডাস্ট্রির তৈরি নিয়মকানুনকে তারা লঙ্ঘন করতে সক্ষম। খালি একটাই সমস্যা, প্রতিটা ছবি করার সময়ে তারা ছবিটিকে তাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম বলে মনে করেন। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের প্রতিটা কাজেও তো সবসময়ে শ্রেষ্ঠত্ব থাকে না। এই ব্যাপারটা আমার বেশ অপছন্দের।
শিবকুমার শ্রীনিবাসন
দক্ষিণের ছবি নিয়ে আপনার ভাবনা চিন্তা আমাদের একটু বলুন।
মৃণাল সেন
দক্ষিণে তৈরি ছবি আমার খুব ভালো লাগে। তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতারা এগিয়ে আসছেন, বিশেষ করে কর্ণাটক ও কেরালায়। অসাধারণ সব ছবি বানাচ্ছেন তারা।
শিবকুমার শ্রীনিবাসন
কিন্তু আপনার মনে হয়ে না এই চলচ্চিত্র আন্দোলনটি মুমূর্ষু হয়ে পড়ছে?
মৃণাল সেন
হয়তো এই মুহূর্তে তেমন লাগছে; কিন্তু এই আন্দোলন আবার প্রাণ ফিরে পাবে। তবে এর কিছু কারণও আছে। একটা সময় ছিল যখন আমি ভাবতাম, কর্ণাটকের ভালো চলচ্চিত্র পরিচালকদের মধ্যে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে নিজেদের ভেতরে একটা আলাপ-আলোচনা ও যোগাযোগের পরিসর আছে। কিন্তু আমি শুনলাম, তাদের মধ্যে একটা প্রবল সংঘর্ষের বাতাবরণও একইভাবে আছে। যাই হোক, আমি একজন সংশোধনাতীত শুভদর্শী এবং আমি জানি যে ভবিষ্যৎ আমাদেরই।