লিখেছেন । তাসমিয়াহ্ আফরিন মৌ
কবি স্বামীর মৃত্যুর পর আমার জবানবন্দি
Statement After My Poet Husband’s Death
স্টোরি, স্ক্রিপ্ট রাইটার, ফিল্মমেকার । তাসমিয়াহ্ আফরিন মৌ
প্রডিউসার । রুবাইয়াত হোসেন
সিনেমাটোগ্রাফার । ইমরানুল ইসলাম
ফিল্ম এডিটর, সাউন্ড ডিজাইনার । সুজন মাহমুদ
এক্সিকিউটিভ প্রডিউসার । মোস্তাক আহমেদ টিটু
মিউজিক স্কোর । এস কে শান
আর্ট ডিরেক্টর । আওলাদ রিন্টু
প্রোডাকশন কোম্পানি । খনা টকিজ
কাস্ট [ক্যারেক্টার] । দিলরুবা হোসেন দোয়েল [রুবি], আলী আহসান [রুবির স্বামী], মারিয়া [শিশু রুবি], রাইতা [রুবির কন্যা], আইরিন পারভীন [রুবির মা]
ফরম্যাট : এইচডি
কালার । সাদা কালো
জানরা । ড্রামা [মনোলগ]
রানিংটাইম । ১৫ মিনিট
ভাষা । বাংলা
দেশ । বাংলাদেশ
রিলিজ । নভেম্বর ২০১৬
অ্যাওয়ার্ড । তারেক শাহরিয়ার বেস্ট শর্টফিল্ম অ্যাওয়ার্ড [ইন্টারন্যাশনাল শর্ট অ্যান্ড ইনডিপেনডেন্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, বাংলাদেশ, ২০১৬]; স্পেশাল জুরি মেনশন অ্যাওয়ার্ড [থার্ড আই এশিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল মুম্বাই, ভারত, ২০১৬]; সিলভার বোধিসত্ত্ব অ্যাওয়ার্ড [বোধিসত্ত্ব ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, পাটনা, ভারত, ২০১৭]; ফার্স্ট প্রাইজ [উইমেন ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, পাকিস্তান, ২০১৭]; ক্রিটিক অ্যাওয়ার্ড ফর বেস্ট শর্ট ফিকশন [সাউথ এশিয়ান শর্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, ভারত, ২০১৮]; বেস্ট ডিরেকশন [বাংলাদেশ শর্ট অ্যান্ড ডকুমেন্টারি ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বাংলাদেশ, ২০১৮]
কবি
স্বামীর
মৃত্যুর
পর
আমার
জবানবন্দি

প্রধান চরিত্র
রুবি
সাধারণ মধ্যবিত্ত শিক্ষিত একজন নারী। বয়স ৩১-৩২। পেশায় ফিচার রাইটার। পত্রিকায় কাজ করে। আর দশজন সাধারণ নারী থেকে তার চেহারা আলাদা করা যায় না; কিন্তু তার ব্যক্তিত্বের প্রকাশ চোখে পড়ে। শ্যামবর্ণ, শান্ত চুপচাপ রুবি কোনো এক সময় প্রবল রোমান্টিকতার ঘোরে বাস করলেও আজ আর তা নেই। সে তার কবি স্বামীকে মোহান্ধ হয়ে ভালোবেসেছিল। ভেবেছিল বুঝি সে অন্যদের থেকে আলাদা, প্রগতিশীল। কবি তার স্বামী না হয়ে বন্ধু হবে, সঙ্গী হবে। কিন্তু তার স্বামী স্বামীই হয়ে রইল, বরং অন্য দশজনের থেকেও বেশি। নিজেদের পরিচয়ে তাদের বিয়ে। কিন্তু তার প্রতি তার স্বামীর কোনো মায়া নাই, হয়তো একসময় ছিল। তাদের মধ্যে কোনো প্রেম নাই। বরং সবসময় রুবি স্বামীর থেকে অবহেলা পেয়েছে। তারপরও রুবি কখনো প্রতিশোধপরায়ন হয়ে উঠেনি। তার স্বামী ভালো থাকুক– এই কামনাই করেছে। রুবির মা আছেন। মায়ের সাথে তার আচরণে এবং বিশ্বাসে তেমন মিল না থাকলেও আত্মিক সম্পর্ক আছে।
কবি
ফর্সা, লম্বা, ঋজু দেহের খুব সুন্দর একজন মানুষ। ঘন কালো চুল এবং টানা চোখ। তার মাখনের মতো কপালের দিকে তাকালে মনে হয় ছুরি দিয়ে চেছে মাখন তোলা যাবে। তার বয়স ৩৬-৩৮-এর মধ্যে। সে কবিতা লেখে এবং পত্রিকায় ফিচার এডিটর হিসেবে চাকরি করে। যদিও কবি হিসেবেই সে পরিচিত হতে চায়। কবির কোনো কিছুই দীর্ঘদিন ভালো লাগে না। তা হোক কোনো মানুষ বা বস্তু। সে হাঁপিয়ে উঠে। বাহ্যিক সৌন্দর্য নয় বরং আভ্যন্তরীন সৌন্দর্য তাকে টানে। যদিও সে আভ্যন্তরীন সৌন্দর্য বা গুণাগুণে বেশিদিন মুগ্ধ থাকতে পারে না। ফলে তার সত্যিকারের কোনো বন্ধু নাই। সে একা এবং বিষণ্ন। সে রুবির লেখা পড়ে তার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠে, হয়তো প্রেমেও পড়ে; কিন্তু তা স্থায়ী হয় না। তার মুগ্ধতা কাটার সাথে সাথে সে রুবির সাথে প্রেমহীনভাবে একটি ঘরে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করে। সে প্রগতিশীল দাবী করে নিজেকে। কিন্তু রুবির ডিভোর্স নিতে চাওয়ার বিষয়টা গ্রহণ করতে পারে না; তবে আলাদা বাস করার বিষয়ে আপত্তি নাই তার। তার বাবা মা মারা গেছেন, কোনো আত্মীয়ের সাথে যোগাযোগ নাই।
রুবির সন্তান
চার/পাঁচ বছর বয়সী মিষ্টি একটা মেয়ে। বাবার সাথে বেশি মিল চেহারায়, যদিও বাবার আদর সে তেমন পায়নি। কাঁধ পর্যন্ত বড় চুল, ফর্সা, শান্ত মেয়েটি মা যা বলে তাই করে। সে বাবাকে বেশ ভয় পায়।
রুবির মা
সাধারণ শক্তিশালী একজন মা। যিনি সবসময় সন্তানের বিপদে পাশে দাঁড়ান, সন্তান মেয়ে বলে যেকোনো সমস্যায় তাকে দোষারোপ করেন না বরং সাহস যোগান। মোটামুটি শিক্ষিত সংসারী মা। বয়স ৫২-৫৪ বছর। তার স্বামী নাই, নিজ সংসারে একা থাকেন।
কিশোরী রুবি
চোখে কৌতূহল নিয়ে নিজের চারপাশের সাথে মিশে বেড়ানো এক কিশোরী। প্রায় একা একা বেড়ে ওঠা, নিজের জগৎ নিয়ে কল্পনায় মগ্ন এক সাধারণ কিশোরী। ১০-১২ বছর বয়সী রুবি, বর্তমান রুবির কল্পনায় মাঝে মাঝে পুরানো সময় নিয়ে হাজির হয়।
অন্যান্য চরিত্র
রুবির বাড়িতে মৃত কবিকে উপলক্ষ করে আসা ২০-২৫ জন নর-নারী:
- তরুণ হুজুর– যে কোরআন শরীফ তেলাওয়াত করে
- মধ্যবয়স্ক দুইজন পুরুষ
- মধ্যবয়স্ক দুইজন নারী
- ২৫-৩০ বছর বয়সী একজন নারী
- ৩০-৪০ বছর বয়সী তিনজন পুরুষ
- একজন নারী সেলিব্রেটি মডেল বা অভিনেত্রী
- একজন পুরুষ সেলিব্রেটি
- ফটো সাংবাদিক [ক্যামেরাসহ] তিনজন পুরুষ
- রুবি’র বান্ধবী
- কবি’র অফিস বস
- কবি’র অফিসের কান্নারত তরুণী কলিগ
- আরো পাঁচজন নানা বয়সী সাধারণ মানুষ
কবির বাসায়:
- একজন মধ্যবয়স্ক কাজের মহিলা

স্ক্রিপ্ট
দৃশ্য ১
এক্সটেরিয়র,
নদী
বিকাল, গোধূলী
শান্ত পানিতে একটি বছর তিরিশের মেয়ে ভাসছে। মেয়েটি রুবি। তার পরনে বিয়ের সাজ-পোশাক। তার কপালে বড় টিপ। টিপটা দেখে হঠাৎই দূর্গার তৃতীয় নয়নের কথা মনে পড়ে। রুবির বিষন্ন মুখ, বিষন্ন চোখ আমরা দেখি। যেন সে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত। তার বুকের নিচ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত দেখা যায়। সে ধীরে ধীরে ডুবে যায়। পানিতে মৃদু কম্পন থেমে যায়। চারপাশে পানি ছাড়া আর কোনো প্রাণ বা ভাসমান কিছুই চোখে পড়ে না। [হাইস্পিড]
মিউজিক : নৈশব্দ
সাউন্ড : বাতাস, ডুবে যাবার পর পানির বুদবুদ…
দৃশ্য ২
এক্সটেরিয়র,
বড় বড় গাছপালাসহ খোলা জায়গা
বিকাল
১০-১২ বছরের রুবি একটা রাজহাঁসের পেছনে দৌঁড়াচ্ছে। তাকে পেছন থেকে দেখা যায়। তার মুখ হাসি খুশি। হঠাৎ সে থমকে দাঁড়ায়। তার মুখ হতবিহ্বল এবং বিষণ্ন হয়ে উঠে। তার পিওভি-তে দেখা যায় একটা মৃত ছোট পাখি। রাজহাঁস পালিয়ে যায়। রুবি আকাশের দিকে তাকায়।
মিউজিক : টাইটেল মিউজিক কন্টিনিউ…

দৃশ্য ৩
এক্সটেরিয়র, রুবির মা’র বাড়ির ছাদ
দিন, বিকাল
খোলা আকাশ। আকাশে এক ঝাঁক পায়রা উড়ে যায়। কেউ মাটিতে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে এমন পিওভি-তে চোখের সামনে একটা বই নিচ থেকে উপরে উঠে আসে। টপ থেকে দেখা যায় ছোট রুবি ছাদে পাটি বিছিয়ে শুয়ে আছে। তার মুখ দেখা যায় না; কেননা তার চোখের সামনে বই ধরা। গাছের ডাল-পাতার ছায়া রুবির শরীরে আলপনা তৈরি করেছে। তার একপাশে আচারের বোয়াম রাখা। সে একসময় মুখের সামনে থেকে বইটা সরিয়ে বুকে রাখে।
মিউজিক: টাইটেল মিউজিক কন্টিনিউ…
দৃশ্য ৪
ইন্টেরিয়র, রুবির মা’র বাড়ি
দিন,
সকাল
একটা পর্দা উড়ছে হালকা চালে। পর্দার মাঝ দিয়ে ওপাড়ে দেখা যায় একজন মহিলা সুর করে কোরআন শরীফ পড়ছেন। তিনি রুবির মা। ক্যামেরা তার দিকে ধীরে এগিয়ে যায়। কাউন্টার শটে ছোট রুবিকে পর্দার এপারে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। তার মুখে একটা মুখোশ ধরা। সে মুখোশটা মুখ থেকে সরায়। কিছুটা স্বচ্ছ পর্দা তার মুখ বারবার ঢেকে দেয়।
মিউজিক : টাইটেল মিউজিক ধীরে ধীরে ফেড আউট
সাউন্ড : কোরআন তেলাওয়াত

দৃশ্য ৫
ইন্টেরিয়র,
বাথরুম,
রুবির মা’র বাড়ি
দিন, বিকাল
টপ শটে রুবি বাথটাবের পানিতে ভেসে আছে। আগে তার দেহের যতটুকু অংশ দেখা গেছে, এখন প্রায় তেমন অংশই দেখা যায়। সে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে।
বাথরুমের আয়নার সামনে দাঁড়ায় সে। আয়নায় বাষ্প জমে রুবির মুখের প্রতিচ্ছবি ঠিকমত বোঝা যায় না। মনে হয় সে যেন সামান্য হাসে। সেটা আমাদের চোখের ভ্রমও হতে পারে।
সাউন্ড : পানির শব্দ, নিশ্বাসের শব্দ
মিউজিক : টাইটেল মিউজিক শুরু। স্মৃতি রোমন্থন করে– এমন সুর…
সিনেমার টাইটেল ঃকবি স্বামীর মৃত্যুর পর আমার জবানবন্দি
বর্তমান সময়
দৃশ্য ৬
ইন্টেরিয়র, রুবির মা’র বাড়ি, ড্রইংরুম
দিন, বিকাল
কাঠের জানালার খড়খড়ি ভেদ করে পড়ন্ত বিকালের মিষ্টি আলো উঁকি দেয়। সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ একজন হুজুর সুরেলা কন্ঠে কোরআন শরীফ পাঠ করে। ক্যামেরা সেখান থেকে ধীরে মানুষের ছোট জটলাগুলোর ভেতর দিয়ে শান্তভাবে স্টেডি করে। ঘরে দাঁড়িয়ে বসে থাকা মানুষগুলো আলাদা আলাদা দলে বিভক্ত হয়ে আছে। তাদের কেউ কেউ নিজেদের মাঝে ফিসফিস করছে আবার কেউ কেউ পরস্পরের দিকে চুপ করে তাকিয়ে আছে। অনেকে যেন মনোযোগ দিয়ে নিজের হাতের রেখা দেখছে। নতুন করে কেউ এসে ঘরে ঢুকে। অন্যজনের সাথে হাত মিলায় এবং মৃতের জন্য হাহাকার করে। তাদের কেউ কেউ ফিসফিস করে কথা বলে, এমবিয়েন্ট সাউন্ডের মতো কথাগুলো হালকা শোনা যাবে।
“ওর প্রথম বইটা আমি ছেপেছিলাম, পড়েছিলেন নাকি?”
“জ্বি পড়েছিলাম।”
“আমাদের লেখকদের মধ্যে ওর মতো এত অল্প বয়সে কেউ সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক হয়নি।”
“বাচ্চাটাকে দেখছো? ও বুঝতেই পারেনি বাবা মারা গেছে…!”
“এত ভালো লিখতো…”
“এত ছোট বাচ্চা নিয়ে কীভাবে সামলাবে? ও তো পুরা পাথর হয়ে গেছে…”
“দাফন কোথায় হবে?”
ঘরের কোণার দিকে একটি ছেলের এবং একটি মেয়েকে দেখা যায়। তাদের চেহারা অন্যদের মাঝে বেমানান। তাদের মুখে মেকআপের আভাস পাওয়া যায়। তারা টিস্যুপেপার বের করে ঘাম মুছে এবং চোখের কোণায় চেপে ধরে। তারা সেলিব্রেটি।
মেয়েটি বলে, “উনার মতো এত বড় কবি মারা গেলেন, টিভি ক্যামেরা আসেনি?”
ছেলেটি শ্রাগ করে, “বুঝতেছি না।”
মৃদুস্বরে কোরআন শরীফ তেলাওয়াত করছে সুরেলা কন্ঠস্বরটি। মাটিতে বসে থাকা রুবির দিকে ক্যামেরা এগিয়ে যায়, রুবির মুখে এসে স্থির হয়। রুবি সেলিব্রেটিদের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিল। সে চোখ সরিয়ে তার সামনের মেঝেতে রাখা কিছুর উপর দৃষ্টি স্থির করে। তার মুখ ভাবলেশহীন।
রুবির মাথায় কাপড় নাই। তার পরনে একটা সাধারণ সুতির সালোয়ার কামিজ ওড়না। সাজহীন রুবির শান্ত মুখ থেকে ক্যামেরা ধীরে ধীরে ট্র্যাক-ব্যাক হয়। ধীরে ধীরে রুবির সামনে রাখা একটা পুরুষ মৃতদেহ ফ্রেমের মধ্যে ঢুকতে থাকে। লাশটি রুবির মৃত স্বামীর। চাদর দিয়ে লাশটির গলা পর্যন্ত ঢাকা, শুধু মুখ দেখা যায়। অতি সুপুরুষ একজন শেষ তিরিশের মানুষ। তার কপাল মাখনের মতো পেলব আর তার ভ্রু এবং চুল উজ্জ্বল কালো। এ সময় ফোকাস রুবির মুখ থেকে মৃত মানুষটির মুখে এসে স্থির হয়।
রুবির মনোলগ :
“আপনাদের সমবেদনা আর হাহাকারে আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছে। কারণ আমার কোনো কষ্ট হচ্ছে না । বরং খুবই অশ্লীলভাবে মুক্তির স্বাদ পাচ্ছি। আমার কী-বা করার আছে?”
রুবির এক্সট্রিম ক্লোজআপে দেখা যায় সে ধীরে ধীরে জোরে একটা শ্বাস নেয়। আবেশে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসে।
রুবির মনোলগ :
“আমার নি:শ্বাস নিতে সুবিধা হচ্ছে। আতরের গন্ধে আমার মন ভরে উঠছে…”
ক্লোজশটে দেখা যায়, লাশের মাথার দিকে বসে লাশের উপর মুখ ঝুকিয়ে একটি ৪-৫ বছরের শিশু বসে আছে। ছোট্ট মেয়েটির চেহারায় কোনো ভয় বা কান্না নেই। সে তার ছোট্ট আঙ্গুল দিয়ে লাশটির মাখনের মতো কপাল স্পর্শ করতে যেয়েও থেমে যায়, রুবির দিকে তাকায়। শিশুটি বলে উঠে, “মা…!”
রুবির মনোলগ : [যখন থেকে শিশুটিকে দেখা যায়]
“…মৃত্যু মানুষকে কাছে টেনে আনে। কিন্তু এমন কাউকে কাছে টানতে পারে, যে কাছেই ছিল?”
লাশটির কপাল আর চুলের কিছু অংশ ক্যামেরার ফোরগ্রাউন্ডে ডিফোকাস অবস্থায় থাকে। ব্যাকগ্রাউন্ডে দেখা যায, বাচ্চাটি লাশের সামনে থেকে উঠে রুবির কোলে বসে পড়ে। রুবি তাকে জড়িয়ে ধরে।
রুবির এক্সট্রিম ক্লোজ শটে দেখা যায়, তার মুখে কেমন একটা স্মিত হাসি ফুটে উঠে।
রুবির মনোলগ :
“… মৃতের সাথে দূরত্বটুকু আমি উপভোগ করি।”
সাউন্ড : এ্যামবিয়েন্ট সাউন্ড। কোরআন শরীফ তেলাওয়াত এবং সাধারণ মানুষজনের কথা। মনোলগ সবকিছুর উপরে প্রধাণ্য বিস্তার করবে।
মিউজিক : নাই। এখান থেকে হালকা কোনো সুর আরম্ভ হতে পারে।
কাট টু
ফ্ল্যাশব্যাক
দৃশ্য ৭
ইন্টেরিয়র, রুবির মা’র বাড়ি
রাত
অন্ধকার ফ্রেম ভেদ করে একটা রূপালি ঝিলমিল কাচের পাইপ বের হয়ে আসে। পাইপের ওপারে ছোট রুবির চোখ। রুবির হাতে একটা কাচের পাইপের খেলনা। তাতে স্বচ্ছ তেলের ভেতর রুপালি জরি খেলা করে। রুবি চোখের সামনে তা নানা ভঙ্গিতে ঘুরিয়ে দেখে। তার চোখে বিস্ময়। মোমবাতির আলোতে দেয়ালে তার ছায়া খেলা করে। ইলেকট্রিসিটি নাই।
দৃশ্য ৮
ইন্টেরিয়র, রুবির মা’র বাড়ি, ড্রইং রুবির ঘর
দিন
ছোট রুবি বিছানার ঠিক মাঝখানে পায়ের গোড়ালি রেখে ঘুরতে থাকে। চাদরে একটা ঘূর্ণির মতো তৈরি হয়। রুবি ছড়া কাটতে থাকে-
“আতাগাছে তোতা পাখি ডালিম গাছে মৌ
এত ডাকি তবু কথা কয় না কেনো বৌ?”
ছোট রুবির পেছন থেকে মা ধমকের সুরে অফ ভয়েসে ডাকেন, “রুবি!”
রুবি চমকে পেছনে তাকায় [ক্যামেরার লেন্সে]। ক্লিক-এর শব্দে ছবিটি স্থর হয়ে যায়।
কাট টু
বর্তমান সময়

দৃশ্য ৯
ইন্টেরিয়র, রুবির মা’র বাড়ি, টেরাস/সিঁড়ি
দিন, বিকাল
ক্লোজশটে একজন ফটোসাংবাদিক ক্যামেরায় ছবি তুলছেন। একজন সাংবাদিক চোখ থেকে ক্যামেরা নামায়। সে তার মনিটরে ছবির প্রিভিউ দেখে। সেখানে দেখা যায় ঘরের ভেতরে বসে থাকা রুবির চেহারা এসেছে, সে তাকিয়ে আছে ক্যামেরার দিকে। কিন্তু ছবিটা ভালো হয়নি, ফ্রেম অর্ধেক ঢেকে গেছে কারো শরীরে। [মরা বাড়িতে সাংবাদিক কিছুটা দূর থেকে রুবির ছবি তুলছিলেন।] সিড়িতে আরো কয়েকজন সাংবাদিক এবং ফটোগ্রাফার।
রুবির প্রোফাইল। পেছনে সিড়িটা দেখা যায়। ফটোগ্রাফাররা দাঁড়ানো। তারা ছবি তুলতে গেলে অন্য একটি মেয়ে এসে তাদের বাঁধা দেয়। বলে, “আপনারা জানাজার সময় ছবি নিয়েন। এখন না প্লিজ…”
পরের সিকোয়েন্সের শব্দ শোনা যেতে থাকে। একটা পাতা উল্টানোর শব্দ…
ফ্ল্যাশব্যাক
দৃশ্য ১০
ইন্টেরিয়র, পত্রিকা অফিস, কবির ঘর
দিন, বিকাল
একটা পত্রিকার পাতায় কালী-মহাদেবের ছবি স্থিরচিত্র হিসেবে ছাপা, সাথে একটা ফিচার। কবির পেছন দিক থেকে ক্যামেরা ধরা। তার পিঠের কিছু অংশ, চুল আর ডান হাতে ধরা পত্রিকার পাতাটা দেখা যাচ্ছে। রুবি কাঁচে ঢাকা বড় একটা জানালার দিকে মুখ করে আছে। তার দৃষ্টি ঢাকার ইটের বড় বড় বাড়িগুলো ছাপিয়ে আকাশ স্পর্শ করে। আমরা তাকে পেছন থেকে দেখি। কিছু সময় পর সে আমাদের দিকে ফিরে। তার চোখে কাজল, কপালে ছোট টিপ। মিষ্টি, সুন্দর লাগছে তাকে। বয়সটাও চার-পাঁচ বছর কম মনে হচ্ছে।
কবি তাকে বলে, “বাহ্! ফিচারটা ভালো হয়েছে! নিয়মিত লেখালেখি চালিয়ে যাও।”
রুবির ওভার দ্যা শোল্ডার শটে দেখি কবি তার টেবিলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে হেঁটে রুবির কাছাকাছি এগিয়ে আসে।
কবি বলে, “কবিতা পড়ো? মাসুদ খান পড়েছো? আমার অসম্ভব প্রিয়!”
রুবি লজ্জা পায়। মাথা নেড়ে ‘না’ জানায়।
কবি স্বগোক্তি করে, “কবে যে তার মতো লিখতে পারবো–
ধমনীর রক্তের চেয়ে হৃৎপিন্ডের রক্ত বেশি গাঢ়।
রক্তের সম্পর্কের চেয়ে রক্তসঞ্চালনযন্ত্রের সম্পর্ক প্রবলতর”
সাউন্ড : কবির গলার স্বরের উপর দিয়েই রুবির গলায় আবৃত্তিটা শোনা যেতে থাকবে। ওভারল্যাপ করবে।
বর্তমান সময়

দৃশ্য ১১
ইন্টেরিয়র, রুবির মা’র বাড়ি, ড্রইংরুম
দিন, বিকাল
রুবি সেই লাইন দুটো ফিসফিস করে আবৃত্তি করে। রুবির আবৃত্তি শুনে তার মেয়ে তার দিকে তাকায় এবং জড়িয়ে ধরে। রুবি তার গায়ের উত্তাপ টের পায়। কপালে হাত রাখে।
রুবি লোকজনের দিকে তাকায়, বলে,“থার্মোমিটার লাগবে।”
রুবির পিওভি-তে ঘরের লোকজনের চেহারা দেখা যায়। তারা কিছুটা বিভ্রান্ত। কিছুটা ফিসফিসানি। বেশিরভাগই রুবির দিকে তাকিয়ে আছে।
রুবির মনোলগ : [লোকজনের চেহারা থেকে শুরু হবে]
“আমার চোখে পানি না থাকায় কেউ কেউ বিভ্রমে পড়ে…।”
রুবির কোল থেকে একজন মহিলা এসে তার মেয়েকে ভিতরে নিয়ে যায়। রুবির মাথায় কাপড় তুলে দেয়। রুবির স্বামীর লাশ দেখা যায়। এক্সট্রিম ক্লোজশটে তার নাক থেকে কপালে চুলের গোড়া পর্যন্ত দেখা যায়। তার কপালটা মাখনের মতো সুন্দর মনে হয়। যেন এখনই ছুরি দিয়ে চেছে তোলা যাবে।
রুবির মনোলগ :
“…আর আমি দেখি তার মাখনের মতো কপাল, আমার একটুও স্পর্শ করতে ইচ্ছা করে না…”
ফ্ল্যাশব্যাক
দৃশ্য ১২
ইন্টেরিয়র, পত্রিকা অফিস, কবির ঘর
দিন
আউট অব ফোকাসে কবি ক্যামেরার মুখোমুখি দাঁড়ানো। সে ক্যামেরার দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দেয়। তার হাতে একটা প্লাস্টিকের টিফিন বক্স। রুবি টিফিন বক্সটা হাতে নিয়ে একটু ঝাঁকায়, কোনো শব্দ নেই। তাকে কনফিউজড মনে হয়।
কবি হাসে, কিছু বলে না। চোখ দিয়ে বক্স খোলার ইঙ্গিত করে রুবিকে। রুবি বক্স খুলে, অবাক হয়ে দেখে টাটকা সুরভিত বকুল ফুল। রুবি মুগ্ধ হয়ে কবির দিকে তাকায়।
কবি বলে, “বকুল, তোমার মতোই। ঝরকে ঝরকে ঝড়িছে বকুল, আঁচল আকাশে হতেছে আকুল।”
রুবি চোখ বন্ধ করে। তার গলা আবেগে ব্যথা করে। চোখ থেকে টিল্ট ডাউন করে দেখি তার কন্ঠার হাড়, তির তির করে কাঁপে।
কবি রুবির দিকে মায়াভরে তাকায়। বলে, “তোমার সিমপ্লিসিটি আমার পছন্দ।”
রুবি ঢোক গিলে।
বর্তমান সময়
দৃশ্য ১৩
ইন্টেরিয়র, রুবির মা’র বাড়ি, ড্রইংরুম
গোধূলী
কালো ফ্রেম থেকে ধীরে ধীরে আলো ফুটে উঠবে। দেখা যাবে কবির মৃত ঠাণ্ডা হাতটা কাঠের মতো শক্ত হয়ে উঠেছে। রুবিকে ক্লোজশটে দেখা যায়। সে তার মাথাটা সামান্য হেলে রেখেছে একদিকে। তাকিয়ে আছে মৃতের হাতের দিকে।
কান্নার শব্দ শুনে রুবি সামনে তাকায়। দেখে, দরজা দিয়ে কবির তিন-চারজন কলিগ ঘরে ঢুকে। তাদের মধ্যে একটি তরুণী লাশটি দেখে কেঁদে উঠে। মুখে ওড়না চাপা দেয়। দলের মধ্যে একজন এগিয়ে আসেন, তার কোমর থেকে পা পর্যন্ত দেখা যায়। ইরোটিক ফ্রেম। শরীরের নিচের ভাগ দেখা যাবে তার ডায়ালগের সময়। তিনি দ্বীর্ঘশ্বাস ফেলেন এবং বলেন, “সবাই ওকে অনেক মিস করবে। তোমার বয়সও কম! জীবনটা পড়ে আছে…।”
ক্লোজশটে রুবির হাসির দমক আসে; কারণ এই লোকটির স্বভাব তার জানা। কিন্তু সে নিজেকে সামলে নেয় এবং ক্লান্ত মুখভঙ্গি করে। তার হাই আসে, সে চেপে রাখে। চোখ বন্ধ করে।
রুবির মনোলগ :
“আমার হাসি পায়। আমার হাসি লুকাতে কষ্ট হয়। কারণ আমি অভিনয় পারি না। আমার খুব ক্লান্ত লাগে। কখন যাবে এরা!”
ফ্ল্যাশব্যাক
দৃশ্য ১৪
ইন্টেরিয়র, কবির বাড়ি, বাথরুম
দিন
কবি চুপ করে একটা পিড়িতে বসে আছে বাচ্চাদের মতো। রুবি কবিকে গোসল করিয়ে দিচ্ছে। তার মাথায় শ্যাম্পু করে দিচ্ছে। কবি লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গিতে হাসে।
দৃশ্য ১৫
ইন্টেরিয়র, কবির বাড়ি, বেডরুম
রাত
বিয়ের কয়েকদিন পরের কোনো রাত। রুবি নতুন শাড়ি পরে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে। তার চোখে কাজল, কপালে টিপ। ক্যামেরার ফোরগ্রাউন্ডে বসে কবি কবিতা লেখে। দেয়ালে একটা যুগল ছবি। দুজনেই প্রোফাইল, হাসিখুশি। ছবিতে কবি রুবির টিপ ঠিক করে দিচ্ছে।
রুবির মনোলগ :
“সবার মতো আমারও স্বপ্ন ছিলো, ভেবেছিলাম, শিশুর মতন এই কবির সাথে আনন্দে কাটাবো জীবন!”

দৃশ্য ১৬
ইন্টেরিয়র, কবির বাড়ি, বারান্দা
দিন
কবি ফোনে কারো সাথে হেসে নিচু গলায় কথা বলছে। রুবি এসে তাকে ভাত খেতে ডাকে। কবি রুবির দিকে বিরক্ত মুখে তাকিয়ে ফোন কানে রেখেই তাকে ধমক দেয়, “যাও তো!”
কবি মুখ ঘুরিয়ে ফোনে কথা বলতে থাকে। অপমানে রুবির মুখ শুকিয়ে যায়। রুবি চলে যায়। ক্যামেরার ফোর গ্রাউন্ডে কবি দাঁড়িয়ে কথা বলছে। রুবির দেহ উল্টো দিকে যেতে যেতে ছোট হতে থাকে।
কবি ফোনে কথা বলতে থাকে, “সরি, আর বলো না! … না না, আমি বলছি তো তুমি খুব ভালো লেখো।… আমার অফিসে এসো তোমার কবিতা নিয়ে। তুমি অনেক বড় লেখিকা হবে….”
কাট টু
দৃশ্য ১৭
ইন্টেরিয়র, কবির বাড়ি, বেডরুম
রাত
স্টপগেট শট। বিছানায় রুবি চুপ করে বসে আছে। কবি বিছানায় রুবির দিকে পিছন ফিরে বসে থাকে আর সিগারেটের ধোঁয়া তার মাথার ওপর উড়তে থাকে।
কাট টু
রুবি বিছানায় আগের মতো চুপ করে বসে আছে। কবি অন্য ঘরে পড়ছে।
রুবির মনোলগ :
“আমার সিম্পিসিটি তার কাছে একঘেয়ে লাগে, আর সে দেয়াল তুলতে থাকে।”

দৃশ্য ১৮
ইন্টেরিয়র, কবির বাড়ি, ড্রইংরুম
রাত
কবি পাশের রুমে শুয়ে আছে। রুবি দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো।
রুবির মনোলগ :
“আমি তাকে দেখি, কিন্তু স্পর্শ করতে পারি না।”
দৃশ্য ১৯
এক্সটেরিয়র, পাখির দোকান
দিন
পাখির দোকানে খাঁচায় পাখির ডানা ঝাপটানোর ছবি তোলে রুবি।
দৃশ্য ২০
ইন্টেরিয়র, পত্রিকা অফিস, রুবির ডেস্ক
দিন/রাত
রুবি অফিসে তার ডেস্কে বসে পাখির ছবিটা নিয়ে একটা ফিচার লিখছে। কম্পিউটারে তার লেখা কম্পোজ করছে। সম্মিলিত হাসির শব্দ শুনে সে মুখ তুলে কবির রুমের দরজার দিকে তাকায়।
দৃশ্য ২১
ইন্টেরিয়র, কবির বাড়ি, বেডরুম
রাত
রুবি বিছানায় বসে আছে। তার শাড়ি এলোমেলো। তার মুখ বিষাদময়। পাশে কবি খালি গায়ে উপুড় হয়ে ঘুমাচ্ছে। ঘড়ির টিক টিক শব্দ চলছে।
রুবির মনোলগ :
“আমার মনে হয়, এই মানুষটাকে আমি চিনি না!”
বর্তমান সময়
দৃশ্য ২২
ইন্টেরিয়র, রুবির মা’র বাড়ি, ডাইনিংরুম
দিন, বিকাল
একটা বড় মাস্টার শটে দেখা যায় রুবি ডাইনিংরুমে ঢোকে। সেখানে তার মা আর দুই বা তিনজন বোন দাঁড়ানো। রুবি তাদের মধ্যে প্রবেশের জন্য আগায়। রুবি যে দরজা দিয়ে রুমটাতে ঢুকে, সেখান থেকে মহিলাদের দিকে যাওয়ার পথটুকুর মেঝেতে একটা জানালার ছায়া পড়ে। দেখে মনে হয় যেন লোহার শিক বা গরাদের ছায়া পড়েছে। রুবি সেই আলো ছায়ার গরাদ পার হয়ে মহিলাদের দিকে এগিয়ে আসে।
তারা সবাই বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। রুবি কাঁদে না। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
রুবির মনোলগ :
“লাশের শরীর ছেড়ে আমি মায়ের কাছে আসি। মায়ের শরীরের গন্ধে আমার কিছু ফুলের কথা মনে পড়ে।”
ফ্ল্যাশব্যাক

দৃশ্য ২৩
ইন্টেরিয়র, কবির বাড়ি, বেডরুম
দিন
ক্লোজশটে দেখা যায় রুবির হাত একটা বইয়ের পাতা খোলে। বইটার মাঝখানে একটা শুকনো সাদা ফুল।
রুবি মুখ দেখা যায়। সে কিছুটা মাথা ঝুকিয়ে ফুলের গন্ধ নেয়। বোঝা যায় ফুলটায় গন্ধ আছে। তারপর সে নিজের পেটের দিকে তাকায়। ক্যামেরা টিল্ট ডাউন করে রুবির পেট পর্যন্ত আসে। রুবির পেট ফোলা, প্রেগন্যাট। রুবিকে প্যান করে দেখা যায় ডাইনিংরুমে কবি একা একা বসে খাচ্ছে।
রুবির মনোলগ :
“এত কিছুর পরও আমি তাকে ভালোবাসতাম। কিন্তু অনাগত সন্তানের প্রতি আমার স্বামীর টান তৈরি হয়নি। কারণ সে ছিলো প্রথাভাঙা মানুষ।”
দৃশ্য ২৪
ইন্টেরিয়র, মন্দির
দিন
মাটির কাজ শেষ হয়েছে কিন্তু এখনো রঙ পড়েনি– এমন একটি কালী মূর্তি। কালীর চেহারা সাধারণ। গোলগাল মুখ, গোলগাল দেহ, শরীরের কোথাও মোচড় নাই। চোখ শান্ত। তার পায়ের কাছে মহাদেব পড়ে আছে। ক্লিক করে ক্যামেরার শাটার পড়ার শব্দ হয়। মহাদেবসহ কালী একটি ফটোগ্রাফে পরিণত হয়।
রুবির মনোলগ :
“বেঁচে থেকেও আমি মৃতের মতো সাদা হয়ে গিয়েছিলাম। আমার মাছের মতো চোখে কোনো প্রেম ছিলো না। আমার সন্তান ছাড়া কারো ডাকে সাড়া দিতাম না। অথচ কি অদ্ভুত! এই মানুষটাকে ভালোবেসে আমার গলা ব্যথা করতো!”
দৃশ্য ২৫
ইন্টেরিয়র, কবির বাড়ি, ড্রইংরুম
দিন
কলিংবেল বাজে। বুয়া দরজা খুলে দেয়। রুবি ঢুকে। তার বাচ্চা দৌঁড়ে আসে, “মা!”
রুবি মেয়েকে আদর করে ভেতরে নিয়ে যায়।
কাট টু
দৃশ্য ২৬
ইন্টেরিয়র, কবির বাড়ি, বেডরুম
রাত
সন্তান ঘুমাচ্ছে। রুবি তার মেয়ের চুলে হাত রেখে তার মাথার কাছে স্থির হয়ে বসে আছে। কলিংবেলের শব্দ। রুবি চমকে তাকায় দরজার দিকে। উঠে যায়।
কাট টু
দৃশ্য ২৭
ইন্টেরিয়র, কবির বাড়ি, সদর দরজা, ড্রইং
রাত
দরজার কী-হোলে কবিকে দেখা যায়। অস্থির হয়ে কলিংবেল বাজায়। রুবি চোখ সরিয়ে দরজা খোলে। কবি খোলা দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকে তার রুমের দিকে চলে যায়। রুবির দিকে তাকায় না, কোনো কথাও বলে না। রুবি দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। একই ফ্রেমে দেখা যায়, কবির হাতের এক গাদা বই।
কাট টু
সে টেবিলের উপর ধড়াম করে বইগুলো রাখে এবং বইগুলো থেকে কিছু ধূলা ছড়িয়ে যায়।
দৃশ্য ২৮
ইন্টেরিয়র, কবির বাড়ি, বেডরুম
রাত
কবি তার রুমের বিছানায় ঘুমাচ্ছে। রুবি আর তার মেয়ে পাশের ঘরের বিছানায় ঘুমাচ্ছে। ডাইনিং থেকে ট্রলি করে দুইটা বেডরুম পরপর দেখা যায়। মাঝখানে একটা দেয়াল।
দৃশ্য ২৯
ইন্টেরিয়র, কবির বাড়ি, আয়নার সামনে
দিন/রাত
রুবি ক্যামেরায় লুক দিয়ে ফ্রেমের মাঝখানে দাঁড়ানো। মনে হয় সে একটি আয়নার সামনে দাড়াঁনো। নিজের দিকে তাকিয়ে আছে।
রুবির মনোলগ :
“একসময় আমি বাঁচতে চাই। আমি ডিভোর্স চাই।”
দৃশ্য ৩০
ইন্টেরিয়র, কবির বাড়ি
দিন
রুবি ফোরগ্রাউন্ডে শান্ত মুখে স্থির হয়ে দাঁড়ানো। কবি দূরে মাথা নিচু করে একটা চেয়ারে বসা। তার পেছনে উল্টোদিক থেকে আসা জানালার আলোয় রুবির ছায়া পড়ে। এমনভাবে যেন রুবি তার পাশেই দাঁড়ানো, আসলে তা নয়। কবি হঠাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। হাতের বইটা ছুড়ে মেঝেতে ফেলে সে বড় বড় শ্বাস নিতে থাকে। রুবি কিচ্ছু বলে না।

দৃশ্য ৩১
এক্সটেরিয়র, রুবির মা’র বাড়ি, উঠান, সিঁড়ি এবং বারান্দা
দিন
রুবি লাগেজ হাতে উঠানে এসে দাঁড়ায়। তার শিশু কন্যা, “নানু” ডাকতে ডাকতে দৌঁড়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে যায়। দোতলার বারান্দায় আচার শুকাতে দেয়া নানুকে সে জড়িয়ে ধরে। রুবি এসে মায়ের মুখোমুখি তাকায়। মা তার দিকে তাকায়। মায়ের মুখে অভয়ের হাসি ফুটে উঠে।
দৃশ্য ৩২
ইন্টেরিয়র, রুবির মা’র বাড়ি, রুবির ঘর
দিন
রুবি তার পুরানা ঘর গোছগাছ করে। জানালায় পর্দা লাগায়। কাঁচের বোতলে জানালায় ছোট একটা মানিপ্ল্যান্ট বসায়। পর্দাটা টেনে দেয়।
দৃশ্য ৩৩
এক্সটেরিয়র, ঢাকার রাস্তা
দিন
রুবি তার অফিসের বিল্ডিংয়ের সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায়।
কাট টু
রুবি বাসে উঠে। বাসের ভেতর থেকে শট। বাসে একা একা চুপচাপ বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে আছে।
দৃশ্য ৩৪
ইন্টেরিয়র, রুবির মা’র বাড়ি, রুবির রুম
দিন
জানালার পর্দাটা খুলে দেয় রুবি। ক্যামেরার ফোরগ্রাউন্ডে রুবি আগের কাঁচের বোতলে মানিপ্ল্যান্টের পরিচর্যা করে। গাছটা অনেকখানি বেড়ে উঠেছে। তার পিছনে বিছানায় আধশোয়া হয়ে নানু নাতনীকে গল্প শোনাচ্ছে। বাচ্চাটা নানুর শাড়ির আঁচলের কোণা ধরে চিবাচ্ছে।
রুবির মেয়ের ডায়ালগ :
“নানু তারপর কী হলো?”
রুবির মায়ের ডায়ালগ :
“এভাবেই দিন কাটতে লাগলো। ঘুটেকুড়ানি তার অভিশাপ থেকে মুক্ত হলো। আর স্বার্থপর রাজা তার প্রাসাদে দম বন্ধ হয়ে মরে গেলো।”
রুবির মেয়ের ডায়ালগ :
“তারপর?”
রুবির মায়ের ডায়ালগ :
“তারপর রাজ্যের সবাই সুখে শান্তিতে বাস করতে লাগলো।”
বর্তমান সময়

দৃশ্য ৩৫
ইন্টেরিয়র, রুবির মা’র বাড়ি, ড্রইংরুম
প্রায় সন্ধ্যা
রুবি ড্রইংরুমের জানালা ধরে দাঁড়ানো। ঘরে লাশ নেই। লাশের পাটিটা একসাইডে হেলান দিয়ে রাখা। ঘরের মধ্যে তার মা ও কোনো এক আত্মীয়া ভিন্ন স্থানে স্থির হয়ে বসে আছে। মৃত কবিকে দেখতে আসা সব লোকজন চলে গেছে।
সাউন্ড : মাগরিবের আযান শোনা যায় খুব আস্তে।
রুবির মনোলগ :
“মৃতের বহর চলে যায়। আর আমার স্বস্তি ফিরে আসে।”
দৃশ্য ৩৬
ইন্টেরিয়র, রুবির মা’র বাড়ি, রুবির ঘর
রাত
ক্লোজশটে একটা কফি মগে চামচ দিয়ে নাড়া হচ্ছে। রুবির নির্লিপ্ত স্মিত মুখ দেখা যায়, কফির ধোঁয়া উড়ে মুখের সামনে। সে মগে চুমুক দেয়। রুবির বাচ্চাটি বিছানায় ঘুমাচ্ছে। বাচ্চাটির আইবল/চোখের মণি নড়ছে।
বুকশেলফের উপর ধোঁয়া ওঠা কফির মগ রাখে রুবি। একটা বই বের করে পাতা খুলে। সেই পুরোনো শুকনো ফুলগুলো দেখা যায়। সে নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শোকার চেষ্টা করে। কিন্তু কোনো সুঘ্রাণ নেই; বরং ধূলার গন্ধ হয়ে উঠেছে।
রুবির মনোলগ :
“তার দেয়া প্রথম ফুলে আজ আর সুবাস নেই। নাকে কেবল ধূলা লাগে।”
ব্যাক টু ক্যামেরা, ফুল হাতে নিয়ে জানালার দিকে এগিয়ে যায় রুবি যেন সে জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিবে ফুল। হঠাৎ করে ক্যামেরা বরাবর অফ-ভয়েসে কোনো এক নারীকন্ঠ তাকে ডেকে ওঠে, “রুবি!”
রুবি পেছন ফিরে ক্যামেরার দিকে তাকায়। হালকা হেসে উঠে, বলে, “আমার ডাস্ট এলার্জি আছে।”
সে ফুলগুলো জানালা দিয়ে ফেলে দেয়।
দৃশ্য ৩৭
এক্সটেরিয়র, কোনো জলাধার বা জমে থাকা থাকা পানি
সন্ধ্যা
সেই ফুলগুলো পানিতে পড়ছে। এন্ড-টাইটেল পাশ দিয়ে উঠতে থাকে।
