লিখেছেন । ইমতিয়ার শামীম
একদিন আমাদের মৃত্যু শুরু হলো।
আরসব দিনের মতোই সেদিন। চরাচর পুড়িয়ে চলা রোদের হলকা আমাদের টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে ক্ষিপ্ত সিড্রাগনের উগড়ে দেয়া আতংকের বুকপকেটে, সমুদ্রের জলজফেনা শুষে নিতে নিতে রোদের অদৃশ্য শুঁড় তখন এত দ্রুত ওঠানামা করছে যে আমরা তা অনুভবও করতে পারছি না। এক কাপ চায়ের জন্যে আমাদের কেউ হয়ত তখন অফিসের এদিক থেকে ওদিক খুঁজে বেড়াচ্ছি কোনও পিওনের স্বস্তিকর অস্তিত্ব, আর কেউ কেউ চাকরিই নেই কিংবা করি না বলে বইয়ের পাতা ওল্টানো তারুণ্যের একাগ্র দুপুর থেকে সরে এসে অযথাই রিমোট কন্ট্রোলের নব ঘুরাতে ঘুরাতে কখনও এইচবিও কখনও ন্যাশনাল জিওগ্রাফি কখনও বিবিসি দেখে নিচ্ছি। দাবদাহের মধ্যে দিয়ে রিকশায় যেতে যেতে ট্রাফিক জ্যামে কেউ কেউ খুব অস্থির আর ভয়ানক ক্ষিপ্ত।
আমাদের মৃত্যু শুরু হলো এরকমই একদিন।
…
মুহূর্তে
আমরা এক
দ্বান্দ্বিক অনুভূতির
মধ্যে হাবুডুবু খাই, দেখি
কিংবা
অনুভব
করতে থাকি
শিশুর মতো বিরল
হাসিতে অভ্যস্ত আমাদের
তারেকের শরীরে মহেশখালীর
বাঁকে
বাঁকে
ছড়ানো
লোনা বাতাস
হুড়মুড় করে ঢুকে
পড়ছে, তাপে তাপে
অস্থির করে তুলছে তাকে
এবং
তার হাসি
থামিয়ে দিতে
একেবারে ভেতরে
ছড়িয়ে দিচ্ছে সমুদ্রের অথৈ শূন্যতা
…
তাও এই নগরীতে নয়, যে নগরে আমরা সবাই থাকি; মৃত্যু তার রূপ দেখালো নগর থেকে অনেক দূরে, সমুদ্র থেকে উপড়ে ওঠা লোনা বাতাসে ভর করে মহেশখালির এক অজপাড়াগাঁয়ে। মৃত্যু হলো তারেক শাহরিয়ারের, আমাদের তারেক কিংবা তারেক ভাইয়ের। আবাল্য জেনে এসেছি, নিঃশ্বাস রুদ্ধ করতে শিশুর মুখের ভেতর ঠেলে দেয়া হয় লবণ; তবে এরকম ভাগ্য নিয়ে জন্মায় কেবল অনাকাঙ্ক্ষিত শিশুরাই। মুহূর্তে আমরা এক দ্বান্দ্বিক অনুভূতির মধ্যে হাবুডুবু খাই, দেখি কিংবা অনুভব করতে থাকি শিশুর মতো বিরল হাসিতে অভ্যস্ত আমাদের তারেকের শরীরে মহেশখালীর বাঁকে বাঁকে ছড়ানো লোনা বাতাস হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ছে, তাপে তাপে অস্থির করে তুলছে তাকে এবং তার হাসি থামিয়ে দিতে একেবারে ভেতরে ছড়িয়ে দিচ্ছে সমুদ্রের অথৈ শূন্যতা,– বিশ্বাসই হতে চায় না। মফঃস্বল শহরের ছিমছাম আড্ডায় জন্মবদলের সূত্রে আমরা যারা পথ ও প্রান্তরের বৈভিন্নতার মধ্যে দিয়েও প্রোথিত হই লক্ষ্যের একই মাটিতে, বাঁধা পড়ি অভিন্ন স্বপ্নে, তারপর ফের এক মহানগরে গিয়ে এক ও অভিন্ন থেকেও বহুধায় বিভক্ত হই, ছড়িয়ে পড়ি ধর্মপুরাণের ব্যাবিলনবাসীদের মতো সারা বিশ্বে, তাদের সবাইকে আবারও এক মোহনায় নিয়ে আসতে তারেকের এই অভিযাত্রার মধ্যে দিয়ে অকস্মাৎ আমরা জানতে পারি, এবার মৃত্যু শুরু হলো আমাদের।
অথচ খুব বেশি দূরে ছিল না তারেকের আরেক জন্মদিন। জুনের পাঁচ থেকে আগস্টের ১৫, কতই বা দেরি ছিল আর!

তারেককে দিয়েই যে কেন আমাদের মৃত্যু শুরু, তাও ভেবে পাই না। কেউ কেউ নিষ্প্রাণ স্বরে সংবাদ ফেরি করে যায় [তোয়াক্কাও করে না সেই ফেরিওয়ালামার্কা হাকডাক শুনতে আমাদের কেমন লাগছে জানার], ‘টাঙ্গাইলে বেশ কয়েকদিন একটানা শুটিং করে ঢাকায় ফিরে মাত্র একদিন বিরতি দিয়ে আবারও সেই দূরের মহেশখালীতে গিয়ে…’ শুনতে শুনতে মনে হয় ডেথভ্যানের কাচ ভেঙে ফেলে দেই সিনেমার গুরুত্বহীন ডামিদের মতো নিখুঁত ড্রাইভ দিয়ে। অনেককেই চিনতে পারি না, তবে তারেক নিশ্চয় চিনত, আমাদের কাছে যেমন, তেমনি এইসব অনেকের কাছেও নিশ্চয়ই প্রিয় ছিল সে। আমাদের নিরাপদ মনে করে তারেককে না-কি ‘খুব খারাপ ব্যবহার করে’, ‘ভাব দেখায়’ বলে যারা অভিযোগ করত তাদের অনেককেই দেখি কী নির্বিকার কণ্ঠে ‘ওর মৃত্যুতে অপরিসীম অপূরণীয় ক্ষতি হওয়ার’ কথা বলছে।
দেখতে দেখতে একসময় কিছুই আর দেখতে পাই না। কেবলই খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করি সেই প্রাণতা– যা কী ভীষণ ঘন হয়ে বসে আছে ওর চোখের পাতায়। একবার মনে হয়, মহাকাশের প্রবল ঘূর্ণি আমাদের নিয়ে গেছে দূর অতীতের মফঃস্বল এক শহরে; সেই এক ব্যক্তিগত পাঠাগারে বসে আছি ঠাঠা দুপুর বেলা। সামনে কালো চুল আর কাচাপাকা গোঁফর সঙ্গে বেমানান ধবধবে সাদা জামা আর সাদা লুঙ্গি পরে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বারী ভাই কেন যেন হাসছেন। আর তারেক লিখতে লিখতে আড়মোড়া ভাঙছে, কখনও টেবিলে হেলান দিয়ে বেসুরো গলায় গান গাইছে, ‘তুমি এসেছিলে পরশু-উ-উ-উ-উ-উ-উ… কাল কেন আসোনি…’। এইভাবে লিখতে লিখতে বলছে, এত তাগাদায় লেখা যায় না-কি! কিন্তু ঠিকই লিখছে। তবে সে গল্পেও ছিল না কোনও মৃত্যুচেতনা। ওর আর কোনও গল্পের কথাও মনে পড়ে না যাতে মৃত্যুচেতনা উদ্বাহুনৃত্যরত।
সাহিত্যিকদের না-কি কম বয়সে মৃত্যুবিলাস থাকে, যত বয়স পেরয় ততই তা কমতে থাকে। তাই রবীন্দ্রনাথ কম বয়সে লেখেন, ‘কিছুই তো হলো না পাওয়া’, আর শেষ বয়সে লেখেন, ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে’। মানিক কম বয়সে লেখেন দিবারাত্রির কাব্য, বয়স বাড়লে লেখেন চতুষ্কোণ। তাহলে তারেক মৃত্যুর কথা কখনও ভাবত না! কখনও সে সেই কম বয়সেই ছিল না! একটুও না!? মুক্তিযুদ্ধের টনটনে কৈশোরকস্মৃতির মধ্যে দিয়ে মৃত্যুর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিল সে খুব কম বয়সেই? ওই যে গুনগুনিয়ে গান গাইছে, থামছে, আবার লিখতে লিখতে কাগজ ফুরালে আমাদের ক্লাসখাতা থেকে পাতা ছিঁড়ে নিচ্ছে নির্দয়ভঙ্গিমাতে, আবার লেখা থামিয়ে হঠাৎ বলছে, ‘ইমতিয়ার, তাড়াতাড়ি যাও, শিরিন বইঘরে সলবেলোর শ্রাবণরাজার প্রথম সংস্করণের দুইটা কপি এখনও আছে, ব্যাটারা অযত্নে ফেলে রেখেছিল তাকের পেছনটায়, আমি একটা কিনে এনেছি পানির দামে’। তারেকের চকচকে চোখ দেখেই বইয়ের দোকানের সমঝদার সেলার বুঝতে পেরেছিল এ বই এত কম দামে বেচা ঠিক নয়; তাই কলম দিয়ে আগের দাম কেটে ১৯৮২ সালের উপযোগী দাম লিখে রাখে সে তারেক বই কিনে নিয়ে যাওয়ার পরেই। তারেককে তাই আবারও উঠতে হলো, সকালে নিজে কত দামে বইটা কিনেছে জানিয়ে দিতে, তারপর মোটা নিবের কলম দিয়ে নতুন কেনা বইয়ের মধ্যে নামও লিখে দিল। ও তো মোটা নিবের কলমেই লিখতে ভালবাসে। পড়তে পড়তে আন্ডারলাইনও করে, হুশ থাকে না বইয়ের মালিক কে।
একবার আমাদের হোস্টেলের রুমে এসে ও নিয়ে গেল শহীদ হবিবর রহমান স্মারকগ্রন্থটা। তখনও তারেক এমএনরায় আর তাঁর রেডিক্যাল হিউম্যানিজম নিয়ে বিস্তারিত কোনও লেখা পড়েনি। বইটায় একটা লেখা ছিল আলী আনোয়ারের, এমএন রায়ের তত্ত্বতালাশ আর রেডিক্যাল হিউম্যানিজম আন্দোলনের ওপর। পরে বোঝা গেল ওই একটা লেখাই পড়েছে সে যত্ন করে, কেননা মোটা নিবের কলমে সেটায় এত বেশি দাগাদাগি করা হয়েছে যে আমরা পড়তে পড়তে নিজেদের মতো চিন্তা করার আগেই ওর দাগ দেয়া বাক্যে প্রভাবিত হয়ে পড়ব। মোটা নিবের কলমে লিখুক, তাতে কোনও আপত্তি ছিল না আমাদের কারও; কিন্তু ওর এ রকম পাঠপ্রতিক্রিয়ার নির্দয় শিকার হতে রীতিমতো অনিচ্ছুক ছিলাম আমরা সবাই। দাগাদাগির এই কাজটা তারেক ভাই প্রয়োজনে যে কোনও ধরনের কলম বা পেন্সিলেই চালিয়ে নিত। কিন্তু বারী ভাই, আমাদের সবার বারী ভাইয়ের কাছে ও বরাবরই প্রশ্রয় পেয়েছে, নিজের পছন্দের কোনও কিছু থেকে ওকে তাই রিবত থাকতে হয়নি আমাদের আসঙ্গে।

এইভাবে আমরা লিখতে শিখি, পড়তে শিখি; কখনও ঘরে, কখনও পুকুরপাড়ে, কখনও মাঠের ঘাসে। জীবন তো তখনও এখনকার মতো একরৈখিক নয়। তবে ওই লেখার ভঙ্গির কথা এখনও আমরা ভুলতে পারি না, পারবও না। লিখতে লিখতে আড়মোড়া ভাঙছে, বারী ভাইয়ের ‘ব্যক্তিগত পাঠাগারে’ একদম সিগারেট খাওয়া যায় না জন্যে বারবার আমাদের কাউকে না কাউকে নিয়ে বাইরে বেরুচ্ছে। আমরাও তাতে আপত্তি করছি না, তাও যদি গল্পটা লিখে শেষ করে দেয়– এই প্রত্যাশাতে। মোটা নিব দিয়ে মোটা হরফে লেখা সিরাজগঞ্জপর্বের ওই একটি গল্পই তারেক ওর প্রথম গল্পের বইয়ে রাখতে চেয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা গল্প, কুয়াশার অন্তর্গত। একঅর্থে তা হয়ে উঠেছিল পাঠাগারের সবার যৌথ লেখা। কিন্তু সেই গল্পেও তো মৃত্যু ছেনে ছেনে উঠে আসছে মৃত্যুর অধিক উচ্চকিত জীবন। অনেক অনেক রাতে কুয়াশার আস্তরণ ভেঙে যখন পর পর দুটো বুলেট বিকট শব্দে আকাশ ভেঙে ফেলতে চাইছে, তখন জন্ম নিচ্ছে এক নতুন শিশু। যুদ্ধ চলছে সিরাজগঞ্জ রেলব্রিজে, যেটি ছিল তারেকের বাড়ির খুবই কাছে। তারেকের সেই গল্পে এক অভিন্ন সূত্রে গাঁথা ছিল এই শিশু আর আসন্ন বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস। যে শিশু পৃথিবীর মুখ দেখছে, সে জানে না যে সে জন্মই নিচ্ছে এতিম হয়ে। যে বাংলাদেশ জন্ম নিচ্ছিল সেও তো তখন জানত না যে একদিন তার অভ্যুদয়ের ইতিহাস হয়ে পড়বে ‘বিতর্কিত’। যুদ্ধে পিতৃহীন শিশুর ভবিষ্যত অনুভব আর আসন্ন বাংলাদেশের আগামী ইতিহাসের এই অভিন্নতা তারেক তার গল্পে এত বেশি পরোক্ষে রেখে দেয় যে আমরা সেসবের রূপক সৃষ্টির ক্ষমতাও খুঁজে পাই না হঠাৎ করে। তখন ডিসেম্বর, যুদ্ধ শেষ হতে চলেছে, আর সেই সময়ের সমান্তরালে এ গল্পের কাহিনীতে তরুণ বয়সের লেখনরীতির তীব্র ঝাঁঁ থাকলেও তারেক তার ডিটেইলিংয়ে কোনও ঘাটতি রাখেনি, সংলাপে সংলাপে লেখা ভরিয়ে তুলে গল্পের দুর্বলতা এড়িয়ে যেতে চায়নি। তারেক ডিটেইলিং পছন্দ করত, কিন্তু অবশ্যই তা দস্তয়েভস্কি কিংবা আখতারুজ্জামান ইলিয়াস স্টাইলের ডিটেইলিং নয়। এই গল্পে কেবলই রাত বাড়তে থাকে, রেলব্রিজের নিচে নিরীহ মানুষের হাড়-খুলি জমতে জমতে যেন ব্রিজকে অনাবশ্যক করে ফেলার চেষ্টা করে চলে, হাশেম খালুর চিৎকারে সব আলো নিভে যেতে থাকে, কেবল ভায়ের পাশে দাঁড়ানো একেবারেই কিশোরী বোন এক অদম্য কৌতূহলে বলে বসে, ভাইয়া বিহারীরা দেখতে কেমন? মানুষের জীবন প্রশ্নবোধক হয়ে উঠলেও জীবনের জিজ্ঞাসা একটুও টোল খায় না। কিন্তু ভাই তার কিশোরী বোনের প্রশ্নের জবাব দেয় না, হাতের মধ্যে একটি ঠাণ্ডা শীতল ছুরির শীতলতা স্পর্শ করতে করতে শহরের দিকে ট্রেন [কিংবা মৃত্যুই] এগিয়ে আসার শব্দ শুনতে থাকে। কিন্তু তবু আশা শেষ হয় না আমাদের কিংবা তারেক শাহরিয়ারের। গল্পের শেষে তারেক লেখে :
“ঘরের মধ্যে গতরাতে পৃথিবীতে আসা শিশুটা কেঁদে ওঠে। তার কান্নার শব্দ পৃথিবীকে জানায়, শত প্রতিকূলতার মধ্যেও জীবন আসে, জীবন বেড়ে ওঠে, জীবন টিকে থাকতে চায়।”
…
আমি
বাজি ধরে
বলতে পারি,
আখতারুজ্জামান
ইলিয়াসের চেয়ে অনেক
অনেক বেশি খুঁতখুঁতে ছিল ও
লেখার চূড়ান্ত কপি তৈরির ব্যাপারে
…
নিশ্চয়ই তারেক বইয়ে দেয়ার আগে গল্প লেখার শুরুর সময়ের নানা দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলতে গল্পটায় নানা কাটাছেঁড়া করত। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে যে ও মৃত্যুচিন্তাকে প্রশ্রয় দিত সেরকমও মনে হয় না। তাই এরও অনেক পরে, ছোটকাগজে যে গল্প লিখে তারেকের ঢাকাকেন্দ্রিক উত্থান, সেই পাপ কিংবা সম্ভাবনার গল্পতেও মৃত্যুবিলাসিতা দূরে থাক, মৃত্যুচেতনার ধারেকাছে যায় না তারেক। তাই গার্মেন্টেসের সেই অন্তঃসত্ত্বা মেয়েটি মৃত্যুর ঠিক আগে অবচেতনে শুনতে থাকে, ‘পাপের নির্ধারক কে? পাপ বলে কিছু নেই।’ যে মেয়ে নিজেকে স্থাপন করতে চায় মৃত্যুর মধ্যে, সেই মেয়েই দেখি শেষমুহূর্তে স্বনির্মিত দড়িবৃত্তের নির্যাতনের মধ্যে থেকে পাঠ নেয়, দেহের ভেতর পাপ নয়, সম্ভাবনাই বেড়ে উঠছে। বোধহয় আমাদের মধ্যে কেবল তারেক শাহরিয়ারই লিখতে গিয়ে একেবারে সচেতনভাবে গ্রাম থেকে দূরে থেকেছে, নগরের মধ্যে থেকে গ্রামের যন্ত্রণাকে স্পর্শ করার চেষ্টা চালিয়ে গেছে। একেবারে শেষের দিকে ওর গল্পে নগর কিংবা নগরায়ণচিন্তার এই ঝোঁক আরও আরও স্পষ্ট, যেন ও প্রতিটি ইটপাথরকে স্পর্শ করছে নিজেরই প্রাণভোমরা উদ্ধারের মমতা নিয়ে। যে গ্রাম থেকে, যে মফঃস্বল শহর থেকে ওর অভিযাত্রা আরও অনেক দূরের নগর আর মহানগরের দিকে, দেশ ছাড়িয়ে দেশান্তরে, সেই নিরুপায় গ্রাম ও মফস্বঃল শহরকে নগর আর মহানগর, দেশ আর দেশান্তর হাঙরের মতো গ্রাস করছে, গ্রাস করতে করতে অবশেষে এতকালের ‘ম্লেচ্ছ, অস্পৃশ্য’ বাউলচেতনাও লুট করে নিচ্ছে দেখে তারেক এতই ক্ষুব্ধ ছিল যে ওর বড় বড় চোখ ক্রমশ অপলক হয়ে ওঠে, নিজের চোখের পাতা কেটে ফেলে দিয়ে সে প্রতিযোগিতায় নামে– আমি শুধু নির্লজ্জের মতো দেখব, কত নির্লজ্জ হতে পারে এই নগরনায়ণের প্রক্রিয়া। নাগরিক দর্শন ওর মনোজগতের এত বেশি আয়ত্তে ছিল যে নগরায়ণকে এত সাহস নিয়ে দেখতে আর লিখতে একটুও দ্বিধা করেনি। ওর লেখার এই স্বাদ শেষবারের মতো আমরা নিতে পেরেছিলাম বৈশম্পায়ন-এর আষাঢ় ১৪০৩ [জুলাই ১৯৯৬] সংখ্যায় লেখা গল্প স্ট্রাইকার থেকে। এই গল্পটা ও সেই সংখ্যায় শেষ করতে পারেনি। বারবার তাগাদা দেয়ার পরেও যখন কিছুতেই গল্পের শেষভাগ আসছে না, বারবার কাটছে, বারবার লিখছে, গল্পের প্রথমাংশের প্রুফ দিলে বানান ঠিক করার বদলে প্যারার পর প্যারা পুনরায় লিখে ঠিক করে দিচ্ছে [আমি বাজি ধরে বলতে পারি, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের চেয়ে অনেক অনেক বেশি খুঁতখুঁতে ছিল ও লেখার চূড়ান্ত কপি তৈরির ব্যাপারে], তখন আনুষ্ঠানিকভাবে ওর কাছ থেকে আমরা প্রায় জোর করে অনুমতি নেই যে গল্পটি অসমাপ্ত অবস্থায়ই ছাপা হবে, তাছাড়া ওকে আর প্রুফ দেখতেও দেয়া হবে না। সেই গল্পের শুরুটাই বলে দেয় ওর গল্পের নির্মাণভঙ্গি :
“নগরায়ণ একটি প্রক্রিয়া। প্রতিটি প্রক্রিয়াই বক্ররৈখিক। নগরায়ণের সময় এ রকম ঘটে। প্রকৃত সন্ত্রস্ত হয়। সারিবদ্ধ পিঁপিলিকার দল পথ পরিবর্তন করে। লতাগুল্ম চিরতরে উধাও হয়। শেকড় ও মাটির গভীর বন্ধুত্ব ভাঙে। কাতর বৃক্ষসমূহ প্রার্থনার ভঙ্গিতে উবু হয়। উš§ুল পাখির ঝাঁক উড়ে যায় অন্য কোথাও। রড সিমেন্টের দোকান গড়ে ওঠে।…”
কাব্যিকতার অস্পষ্ট অবয়ব আর বাক্যের ঋজুতার সহবাসে গড়ে ওঠা ওর এই স্ট্রাইকার গল্পের মধ্যে রয়েছে আপাতদ্বিধা : তাহলে কোত্থেকে শুরু এই গল্পের। কিন্তু এই আপাতদ্বিধার ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আসা ছেলেটি আসলে বারবার তার জন্মবদলের কথা বলে। সৃজনশীলতার জন্যে নির্মোহ মানুষকেও তো জীবনযাপন করতে হয়। সে জীবনযাপনের জন্যে জীবিকার সঙ্গে সৃজনশীলতার সংঘাতে ম্রিয়মান কিন্তু একরোখা এই স্ট্রাইকার যেন তারেক নিজেই– অসমাপ্ত এক স্বাপ্নিক।
কখনও লেখালেখি, কখনও রাজনীতি, কখনও সিনেমা– এ রকম কত শত স্বপ্ন দেখতে দেখতে অভিন্ন এক যাত্রা শুরু হয় আমাদের। সে স্বপ্ন বিনির্মাণের– কখনও রাষ্ট্র-সমাজের, কখনওবা সংস্কৃতির। তারেক থিতু হয়েছিল এসবের শেষটায়; লেখালেখি দিয়ে শুরু করেছিল, শেষে চলে গিয়েছিল পুরোপুরি চলচ্চিত্রে। সিরাজগঞ্জে ছোটকাগজের জন্যে আমরা যা করেছি তাতে তো বটেই, ঢাকায় ১৯৯৬তে আমরা যখন নতুন করে বৈশম্পায়ন-এর কাজ শুরু করলাম, সেটার পেছনেও তারেক শাহরিয়ারের ছিল এক বড়সড় অভিনব ভূমিকা। ও-ই বলেছিল, বিজ্ঞাপনের জন্যে আমাদের চিন্তা করতে হবে না। আর সেই নিশ্চয়তা পেয়ে আমরা নিয়মিত দুটো সংখ্যা বের করার পর আবার সামান্য হতাশা আর কৌতুক মেশানো কণ্ঠে বলেছিল, ‘ছোটকাগজ এত নিয়মিত বের হলে আর ছোটকাগজের মানসম্মান থাকে?’
…
আড্ডায়,
তর্কেবিতর্কে,
পানপাত্রে ওষ্ঠ
ছোঁয়ানোর মুহূর্তে
নির্জনতাকে ধরে রেখেছে
কেবল এই একটি লেখা, লোরকার
বিষণ্নতার
সবটুকু পান
করে সে সৃজন
করেছে এই চিত্রনাট্যটি
…
বৈশম্পায়ন-এর জন্যে বিজ্ঞাপন নিয়ে এসে দেয়া ছাড়াও এক অসাধারণ চিত্রনাট্য লিখল ও, ওর ঢাকার বন্ধুরা সে চিত্রনাট্যের কথা জানি কি না– জানি না আমি। স্বপ্ন বিনির্মাণ : সিনেমা ও আমার মা নামের ওর এই ছোট চিত্রনাট্যটা শেষ করাতে কী যে ভীষণ ভুগতে হয়েছিল তা জানে আমার আরেক বন্ধু রাশেদ উন নবী। তারেক ভাই তো কথা বলতে ভালোবাসত, অনর্গল আমাদের শোনাত তার বিখ্যাত ‘মিনিং ক্যারি থিওরি’। আর ভালোবাসত স্বপ্নের কথা শোনাতে : ‘শোন, আর বেশিদিন কষ্ট করতে হবে না। আমি বুঝলে একটা ইনস্টিটিউট বানাবো, তোমাদের মতো মানুষদের জন্যে। মাসে মাসে টাকা পাবে, ইচ্ছা হলে লিখবে, ইচ্ছা না হলে লিখবে না।’ কিন্তু তারেক ভাইয়ের লেখার ইচ্ছা থাক বা না থাক, তার চিত্রনাট্য লেখার কথা শোনার পরেই আমরা মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম সেটা ছাপানোর জন্যে। তারপর তাগাদা আর তাগাদার ঠেলায় কখনও অর্ধেক ছেঁড়া কাগজে, কখনও মোচড়ানো কাগজে, খানিকটা সিগারেটের রাংতার উল্টোপিঠে, খানিকটা হয়তো কম্পিউটারের বাতিল লেজারপ্রিন্টেপেপারের উল্টোদিকে– এইভাবে অনেক অনেক সময় নিয়ে আমাদের হাতে পৌঁছে সেটা। আমি জোর দিয়ে বলতে পারি আড্ডায়, তর্কেবিতর্কে, পানপাত্রে ওষ্ঠ ছোঁয়ানোর মুহূর্তে নির্জনতাকে ধরে রেখেছে কেবল এই একটি লেখা, লোরকার বিষণ্নতার সবটুকু পান করে সে সৃজন করেছে এই চিত্রনাট্যটি। সিনেমা, তারেকের মা কিংবা সিনেমাপাগল বাবা, শৈশব আর কৈশোর, প্রিয় সেই মফঃস্বল সিরাজগঞ্জ শহর, তারেকের অন্তর্গত বেদনা স্পর্শ করতে করতে আমরা অতঃপর হারিয়ে যাই সিনেমার চেয়েও এক বিস্ময়কর সৃষ্টির মধ্যে।
কোলরিজের উদ্ধারচিহ্নযুক্ত উদ্ধৃতি শব্দহীন অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে পর্দায় তুলে আনতে আনতে তারেক তার এই চিত্রনাট্য শুরু করে। এই মহানগরে থেকে তারেক আমাদের আবারও নিয়ে যায় ছোট্ট সেই শহরটাতে, নির্জন রাস্তা, ওষুধের দোকান থেকে ছিটকে পড়া আলো, পেপারের পাতায় নিমগ্ন দোকানে বসা ব্যক্তি, জীপের চলে যাওয়া ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে তারেক তার সিনেমার নাম তুলে আনে, সিনেমা অ্যান্ড মাই মাদার— যে সিনেমা কেবল তারেকের মায়ের নয়, মফঃস্বল শহরের প্রৌঢ়ত্বের প্রান্তছোঁয়া প্রায় প্রতিটি মধ্যবিত্ত নারীর। অফ ভয়েসে বোধহয় আমরা তারেকেরই কণ্ঠ শুনি : “মা, তুমি বিভিন্ন সময়ে আমাকে সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতার কথা বলেছ। সে কথাগুলোই আবার নতুন করে শুনতে চাই…।”
তারেক যদি এই চিত্র নির্মাণ করে যেতে পারত, আমার তো মানে হয় বাংলাদেশের সিনেমা নতুন কোনও অভিযাত্রা শুরু করত এখান থেকেই। একজন নারী, যে চোখে দেখে তার শ্বশুর বাড়ির সমস্ত বেড়া ভেঙে কাচারিঘরের সামনে জড়ো করে আগুন জ্বালাচ্ছে আর চিৎকার করে বলছে ‘যে বাড়ির মেয়েমানুষের গলা বাইরেে থকে শোনা যায় সে বাড়িতে আবরুর কোনো দরকার নেই’– সে নারীই বয়সের ফারাকে ভীত হলেও স্বামীর সঙ্গে টকি দেখতে দেখতে একসময় স্বাভাবিক দম্পতি হয়ে ওঠে। দীর্ঘশ্বাসের মতো প্রলম্বিত স্বরে মা যখন বলে ওঠেন, ‘মনে হয় এই সেদিনের সব ঘটনা। কোথায় গেল সেইসব দিন।’ তখনই দৃশ্যানু ধেয়ে আসে ঢাকের শব্দ নিয়ে, যেন নতুন সিনেমা রিলিজ হলো সিনেমা হলে, ঢুলি আসছে তার ঘোষণা দিতে কিংবা শুরু হবে চড়কপূজা, তাই কাটা কলাগাছ মাটির গর্তে পোঁতা হচ্ছে, একজন মানুষের পিঠে বড়শি গাথছে আরও ক’জন মানুষ। কিন্তু কেবল তো এই সিনেমা দেখাই নয়, সিনেমার মতো অবাস্তব কত ঘটনাও ঘটে তারেকের সেই মায়ের জীবনে। দেশভাগ হয়, শশীর মা মালতির মা ভাসার মায়ের মতো আরও কয়েকজন মিলে মায়ের সেই সিনেমা দেখতে যাওয়া দল ভেঙে যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অবিকল জাপানিদের মতো দেখতে এক শিশুকে কুড়িয়ে পায় তারেকের মা, কোলেপিঠে করে মানুষ করে তোলার পর এক সন্ধ্যায় হঠাৎ সেই পনের বছরের ছেলে উধাও হয়ে যায়। তারেকের ‘সিনেমা নিয়ে তুমি আর কি কিছু বলতে চাও?’ প্রশ্নের জবাবে তাকে ফিরে পাওয়ার আকুতি নিয়ে মা তাই কেবল বলে, ‘আমি তো আর তোদের মতো ছবি বানাতে জানি না। জানলে শেকড়সুদ্ধ উপড়ে পড়া গাছের মতো মানুষদের কষ্ট নিয়ে ছবি বানাতাম।’
…
তারেক কি
সিনেমা ও আমার মা
লিখতে গিয়ে নিজের মার
ভেতরেই শেকড়শুদ্ধ উপড়ে পড়া
গাছের
মতো মানুষের
প্রতিকৃতি খুঁজে পেয়েছিল?
…
তারেক কি সিনেমা ও আমার মা লিখতে গিয়ে নিজের মার ভেতরেই শেকড়শুদ্ধ উপড়ে পড়া গাছের মতো মানুষের প্রতিকৃতি খুঁজে পেয়েছিল? সময়ের মধ্যে দিয়ে যে কেবলই বয়ে চলেছে, কোথাও স্থিরতা নেই তার, কেবল সিনেমা দেখার সামান্য ইচ্ছাটুকু ছাড়া। এই ইচ্ছার মধ্যে থেকেই বেরিয়ে আসে মায়ের এক অবচেতন পর্যবেক্ষণ, একটি কাল, একটি যুগ ও যুগসন্ধিক্ষণ– ‘উত্তম কুমারকে যেন আল্লাহ নিজের হাতে তৈরি করেছে। আমার কাছে তাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর পুরুষ বলে মনে হতো।’ অফ ভয়েসে আমরা প্রশ্ন শুনি, ‘বাবাও তো দেখতে বেশ সুন্দর ছিল।’ আর মা তখন বলে, ‘কিন্তু সে তো আর উত্তম কুমার ছিল না।’ বলেই বিব্রত হয়, মাথা নিচু করে। তারপর মুটিং দেখা, বেহুলা-লখিন্দর সুচন্দা আর রাজ্জাককে বাসায় দাওয়াত করে খাওয়ানো, বেহুলা বা সুচন্দার হাতধরা ঘোরলাগ বিস্মিত মার ক্লোজশটের মধ্যে দিয়ে তারেক ছোটবেলায় তার নিজের সিনেমার প্রতি আগ্রহের কথা জানতে চেয়ে শোনে–
“ছোটবেলায় তুই তো ছিলি একটি দুষ্টের শিরোমণি। সিনেমার প্রতি তোর তেমন কোনও আগ্রহ ছিল না। বরং সিনেমায় যাবার সময় যতসব উল্টাপাল্টা কাণ্ড করতিস তুই। আর এর সবকিছুই করতিস পয়সা আদায়ের জন্য। মনমতো পয়সা না পেলে রিকশার পিছে পিছে ছুটতিস। রিকশা থামিয়ে পয়সা না দেয়া পর্যন্ত এ রকম চলত। মনে পড়ে একদিন রিকশা থামিয়ে কষে চড় মেরেছিলাম, আর তুই রাস্তায় হাত পা ছুড়ে চিৎকার করে সে কি কান্না। তোর কান্নায় রাজ্যের মানুষ জড়ো হয়েছিল।…”
কিন্তু এই সিনেমা শেষ পর্যন্ত অন্যদিকে মোড় নেয়। চিত্রনাট্যে আছে সাউন্ড ট্র্যাকে মার কথা ফেড-আউট হওয়ার পর সোনালী প্যাকেট থেকে তারেক একটা সিগারেট ধরাচ্ছে আর সাউন্ড ট্র্যাকে আত্মকথন ফেড-ইন হচ্ছে :
“এ পর্যন্ত প্রথম পর্বের শুটিং শেষ। দ্বিতীয় পর্বে মার বর্তমান সিনেমা ও ভিসিআর দেখার অভিজ্ঞতা চিত্রায়নের পরিকল্পনা ছিল। নানাবিধ জটিলতায় শুটিং পিছিয়ে যায়। এ সময়কালে অকস্মাৎ মার মৃত্যু হয়। দীর্ঘশ্বাসের মতো অনুবাদহীন, প্রতিশব্দহীন সে শোক আমার নিজস্ব।
প্রথমে সিদ্ধান্ত নেই, এই যে আপনারা আমাকে দেখছেন আত্মকথনহীন– এটাই হবে শেষদৃশ্য। হঠাৎ দ্বিতীয় একটি ধীকল্প চিন্তায় স্থাপিত হয়। সিনেমার প্রথাগত টাইম স্পেসের ধারণা না মেনে একটি দীর্ঘ ট্র্যাকিং শট জুড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নেই।”
এই ট্র্যাকিং শটের কথা যখনই চিন্তা করি, তখন আমি আমাদের সেই মফঃস্বল শহরে ফিরে যাই, নিজের মধ্যে নিজেই পরিভ্রমণ করি, এক সড়ক পেরিয়ে আরেক সড়ক, এক দোকান থেকে আরেক দোকান, সিনেমার পোস্টার, আমাদের আড্ডা দেয়ার সেই ইলিয়ট ব্রিজ এবং তা পার হলেই চিরচেনা সিনেমা হল… আমি স্মৃতি ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ি, যদিও তারেক শাহরিয়ারের সঙ্গে আমরা কোনওদিনই সেই সিনেমা হলে সিনেমা দেখিনি। কিন্তু অফ ভয়েসে উপড়ানো গাছের যন্ত্রণা ধরে তারেকের মায়ের অফ ভয়েস ভেসে আসতে থাকে,
“সিনেমা দেখার একটা দল ছিল আমাদের। নতুন কোনো ছবি এলে সবাই মিলে আলাপ করতাম। ছবিতে কে কে অভিনয় করছে, কাহিনী কেমন হতে পারে, কবে যাওয়াটা সবার জন্য সুবিধার হবে ইত্যাদি আলাপ আলোচনা করে ছবি দেখার দিন ঠিক করতাম।”
তারেক আমাদের জন্যে তার উন্মুল মাকে নিয়ে যে সিনেমা বিনির্মাণ করতে চেয়েছিল সেই সিনেমা অতঃপর অসমাপ্তই থেকে যায়।
…
আমাদের
কেউ সিনেমা
বানানোর স্বপ্ন
দেখতে থাকে আর
পার্টির কাজ ফেলে
ঝিঁঝি পোকা কিংবা মোরগের
ডাক ক্যাসেটবন্দি করতে থাকে,
সেইসবও ওই তারেক
ভাইয়ের
‘সঙ্গদোষে’
…
সেই মফঃস্বল শহরে যা হয়, বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন মতাদর্শে বিভিন্ন রাজনীতিতে বিভক্ত থাকলেও সাংস্কৃতিক আবহ আর বইপড়ার মধে দিয়ে খানিকটা হলেও নৈকট্যে চলে আসে, আমরা তারচেয়েও অনেক নৈকট্যে চলে এসেছিলাম। আমাদের মধ্যে কেউ এসেছিল একেবারেই অজপাড়াগাঁ থেকে, কেউ শহরতলী থেকে, কেউ আর সব জেলাশহরে বাবার বদলির চাকরির ঝাইঝক্কিতে কৈশোর পার করে, কেউ শহরে থেকেও বইয়ের আলোয় যেটুকু মুখ উদ্ভাসিত না হলে সিনিয়র সংস্কৃতিমনা কারও বন্ধু হয়ে ওঠা যায় না– সেটুকু আলো মুখে করে। কখনও ব্যক্তিগত পাঠাগারের ভেতর বসে, কখনও কলেজমাঠে, জয়নাল কিংবা ভোলার দোকানের সিঙ্গারা মুখে পুরে অথবা যমুনার পাড়ে বসে তারেক আমাদের নিয়ে লিটল ম্যাগাজিনের স্বপ্ন দেখেছিল। আমাদের কেউ সিনেমা বানানোর স্বপ্ন দেখতে থাকে আর পার্টির কাজ ফেলে ঝিঁঝি পোকা কিংবা মোরগের ডাক ক্যাসেটবন্দি করতে থাকে, সেইসবও ওই তারেক ভাইয়ের ‘সঙ্গদোষে’।
আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে সে খুব তাড়াতাড়ি প্রেম আর বিয়েও করে ফেলে। আমরা তখন সমাজ তো অবশ্যই রাষ্ট্র আর পৃথিবীকেও পাল্টে ফেলতে উদ্যমী, তাই তারেক লেখক শিবিরের সংগঠক হলেও নৈকট্যে আসতে কোনও সমস্যাই হয়নি আমাদের। সিরাজগঞ্জ তখন সবচেয়ে উর্বর রাজনীতি আর নাটকে। নাটকের আগে দোর্দণ্ড প্রতাপে রাজত্ব করা ছোটকাগজের মাহেন্দ্র দিনগুলো ফিরিয়ে আনার চেষ্টা শুরু হয়েছিল তখন বেশ জোরেশোরে। তারেক ততদিনে পড়াশোনার জন্যে ঢাকাবাসী। কিন্তু তাতে কোনও সমস্যা হয়নি, প্রলম্বিত ‘এরশাদ ভ্যাকেশন’ তারেককে ঘনঘনই আমাদের মধ্যে নিয়ে আসত। আমাদের প্রথম ছোটকাগজ এইদিন সেইদিন-এ তারেকের কোনও লেখা না থাকলেও সুন্দর নামের ছোটকাগজটি বের করার সময় সে বেশ ঘনিষ্ঠভাবেই জড়িয়ে পড়ে ওই উদ্যোগে। এই পত্রিকায় ও একটি গল্প লিখেছিল দৌড় নামে। আর তারপরই বের হলে সবুজ অনীকের সম্পাদনায় অবলোকন।

১৯৮০’র দশকে
এই অবলোকন-এর কথা বিশেষভাবে বলতে হয় এ কারণে যে,‘সুন্দর বের করতে গিয়ে এবং তারপর সেটি বিক্রি করতে গিয়ে আমরা বেশ বিব্রতকর বিভিন্ন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই। তারেক শাহরিয়ার ও সবুজ অনীক সেসব অভিজ্ঞতা নিয়ে অবলোকন-এ একটি লেখা লেখে। সম্ভবত এটাই তারেকের তেমন একমাত্র লেখা যাতে ছোটকাগজ নিয়ে ওর নিজস্ব অনুভূতি, ধারণা ও চেতনা ফুটে উঠেছে। লিটল ম্যাগাজিন সংক্রান্ত দৃশ্যাবলী এবং প্রাসঙ্গিক কথা নামের এই লেখাতে তারেক শাহরিয়ার আর সবুজ অনীক লিটল ম্যাগাজিনকে ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত থেকেও দাঁড় করান। নিবন্ধের কতক জায়গা তুলে ধরা বোধহয় খুবই প্রাসঙ্গিক :
“…সাহিত্য নামক একটি কর্মকে এরা ‘নোভালজিন’ ট্যাবলেটের মতো উপাদান হিসাবে দেখতে ভালোবাসেন। তাই মাথা ব্যথায় যেমন ‘নোভালজিন’ দ্রুত উপশম দেয়, তেমনি সাহিত্য থেকে এরা দ্রুত লাভের আশা করেন। অথচ চীন দেশের এক যুবক, এই শতাব্দীর প্রথমার্ধে জাপানে চিকিৎসা বিজ্ঞান পড়তে এসে তার দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে অনুভব করেন যে, তার দেশের মানুষের শারীরিক সুস্থতার চেয়ে অধিক প্রয়োজন মানসিক সুস্থতা আর তাই মানুষের মানসিক বিকাশের জন্য তিনি সাহিত্যকে মাধ্যম হিসাবে বেছে নেন। এই যুবকই লা’সুন, চীনের মহান সাহিত্যিক।… এ প্রসঙ্গে উলেখযোগ্য যে, লু’সুনের যাত্রা শুরু হয়েছিল লিটল ম্যাগাজিনের মাধ্যমেই।
গত শতাব্দীর প্রথমার্ধে যখন গদ্য নিজের পায়ে দাঁড়াবার জন্য আতিপাতি করছিলো, তখন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ গোষ্ঠীর সঙ্গে রামমোহন রায় সম্পাদিত পত্রিকার দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক যে গদ্য বিকাশে কতখানি সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিলো, তা আমরা গভীরভাবে অনুধাবন করলে লিটল ম্যাগাজিনের শক্তি সম্পর্কে আরো আশাবাদী হয়ে উঠবো। ১৯৫২ সনের ভাষা আন্দোলন এদেশের সর্বপ্রথম গণতান্ত্রিক আন্দোলন, বাঙালী জাতীয়তাবাদ উন্মেষের প্রথম ধাপ। এই আন্দোলনের রেশ বুদ্ধিবৃত্তিক পর্যায়ে চির সবুজ করে রাখবার জন্য লিটল ম্যাগাজিনের ভূমিকা সর্বজনবিদিত।”
গল্প না-লেখার, ছোটকাগজ বের না-করার বেদনা ও তাপপরিতাপ উবে গেলেও শেষদিকে তারেক আবারও লিখতে শুরু করেছিল, আবারও একটু একটু করে ফিরে আসছিল গল্পে, সাহিত্যে। হতাশাচ্ছন্ন হয়ে পড়লেও হতাশা তাকে শেষ পর্যন্ত গ্রাস করতে ব্যর্থ হয়েছে, যদিও সেজন্যে ওকে অনেক মূল দিতে হয়েছে। এখনও আমাদের বন্ধুদের মধ্যে প্রবাদতুল্য ওর ‘মিনিং ক্যারি থিওরি’। ‘রেহমান সোবহানের অসুখ হয়েছে তো কি হয়েছে, আমার কাছে তা কোনও মিনিং ক্যারি করে না, কিন্তু রাশেদার সামান্য জ্বর হলেও সেটা আমার কাছে মিনিং ক্যারি করে’– এভাবে প্রায়প্রতিটি ব্যাপারেই মিনিং ক্যারি করা কিংবা না-করার মুদ্রাদোষে আমাদের বেধে রেখেছিল ও, যদিও আমাদের দেখা না-হওয়াটাই হয়ে উঠেছিল একেবারে স্বাভাবিক।
…
হৃদরোগের অমন ধকল ওকে
বেদম ক্লান্ত করে ফেললেও
২০০১-এ এসে দেখা গেল
ও কী ভীষণ ঘুরে
দাঁড়িয়েছে,
বাংলাদেশ
একটা আন্তর্জাতিক
পুরস্কারের মুখ দেখল
দৃশ্যচিত্রমাধ্যমে, ইরানের
আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র
উৎসব থেকে ও নিয়ে এলো
প্রাামাণ্যচিত্রের
শ্রেষ্ঠ পুরস্কার
…
এখন মনে হয়, আমাদের জন্যই ও শেষ মুহূর্তে ঝলসে উঠেছিল। চোখের সামনেই তো দেখছিল আমাদের কারও কিছুই হচ্ছে না, যেমনটা হওয়ার কথা। তাই ও-ই আমাদেরই প্রতীক হয়ে উঠল। হৃদরোগের অমন ধকল ওকে বেদম ক্লান্ত করে ফেললেও ২০০১-এ এসে দেখা গেল ও কী ভীষণ ঘুরে দাঁড়িয়েছে, বাংলাদেশ একটা আন্তর্জাতিক পুরস্কারের মুখ দেখল দৃশ্যচিত্রমাধ্যমে, ইরানের আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র উৎসব থেকে ও নিয়ে এলো প্রাামাণ্যচিত্রের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। ওর এই পুরস্কারের জন্য কালিঘর নিয়ে যতটুকু কথা হওয়ার কথা তার কানাকড়িও হলো না। প্রতিষ্ঠিত পরিবারবৃত্তের বাইরে থেকে এসে যত প্রতিভাই দেখানো যাক না কেন এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক এই দেশে। তবু কালিঘর-এর স্বীকৃতি ওকে পাল্টে দিয়েছিল। প্রচণ্ড সক্রিয় হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশ শর্টফিল্ম ফোরামের সভাপতি হিসেবে। কাজ শুরু করেছিল আরও একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের। মধুপুরের মান্দাই নৃ-গোষ্ঠীর জীবনযুদ্ধ ও স্বপ্ন নিয়ে নির্মিতব্য এই আমা নিয়ে ছিল ওর প্রচণ্ড উচ্ছাস। নিজে বারবার কাটাছেঁড়া করে পরিকল্পনা আর চিত্রনাট্য তৈরি করার পরও বন্ধুদের কাউকে পেলেই এ নিয়ে কথা বলতে শুরু করত। ঋত্বিক ঘটকের সেই গাছ গল্প নিয়েও একটি কাজ করার ইচ্ছা ছিল ওর।
এত কিছু যার অন্তর্গত, এত কিছু যার ভবিষ্যস্বপ্ন, সেই তারেক যে এত তাড়াতাড়ি চলে যাবে তা কি চিন্তা করাও যায়? রোগ ওকে ছুঁয়েছিল, তারপরও ও সিগারেট কিংবা পানপাত্রে মাঝে মাঝে ঠোঁট ছোঁয়াতো; কিন্তু রোগ বা অনিয়ম নয়, কাজের প্রতি একনিষ্ঠতাই যে ওর মৃত্যুর কারু হয়ে উঠল সেটাই বোধহয় আমাদের সামান্য সান্ত্বনা। সারা দেশ যখন দাবদাহে জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে, মানুষ মারা যাচ্ছে তখন একজন তারেক শাহরিয়ার তার অনিয়মিত হৃদস্পন্দন নিয়ে টাঙ্গাইল থেকে ঢাকা, ঢাকা থেকে মহেশখালী ছুটে যাচ্ছে ক্যামেরা নিয়ে, এরকম প্রাণশক্তি আমাদের আর ক’জনের আছে! প্রজাপতির ডানা, বিহাইন্ড দ্য গ্রিন রেভ্যুলুশন কিংবা কালিঘর হাতেগোণা এ ক’টি চিত্রনির্মাণের মধ্যে দিয়ে নিশ্চয়ই কেবল নিজেকেই নয়, ওর সংস্পর্শে আসা আমাদেরও বাঁচিয়ে রেখে গেল। ভাবতে অবাক লাগে, এমনকি মৃত্যুর পরও ও কত অনালোচিত রয়ে গেল! ওর যে কোনও চিত্রনির্মাণে শ্রম দেওয়ার জন্যে উন্মুখ ছিল যেকোনও তরুণ, যেকোনও ছোটকাগজের দুয়ার খোলা ছিল ওর জন্যে; ডাক্তারের অত যে বারণ, তরপরও তো তাকে ঠেলে ফেরৎ পাঠানো যেত না আড্ডা থেকে; সবকিছুই নিমেষে স্মৃতির খাতায় ঠেলে দিলো ও না-ওঠা কালির অক্ষরে।
…
সারা দেশ
যখন দাবদাহে
জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে,
মানুষ মারা যাচ্ছে
তখন একজন তারেক
শাহরিয়ার তার অনিয়মিত
হৃদস্পন্দন নিয়ে টাঙ্গাইল
থেকে ঢাকা, ঢাকা থেকে
মহেশখালী ছুটে যাচ্ছে
ক্যামেরা নিয়ে,
এরকম
প্রাণশক্তি আমাদের
আর ক’জনের আছে
…
এ তো জানাই ছিল আমাদের, সেই সিরাজগঞ্জ শহর আমরা অনেক পিছে ফেলে এসেছি। সেখানে যাওয়াও যেমন, না-যাওয়াও তেমন অনিশ্চিত। আমাদের দেখা হতো কালেভদ্রে, শাহবাগের বইয়ের দোকানে, কোনও সিনেমা দেখতে গিয়ে এবং একেবারে নিশ্চিতভাবে বলতে গেলে সারা বছরে দেখা না হলেও বছরশেষে কোনও ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে। শেষবার ও শাহবাগে রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস নিয়ে আলোচনা অসমাপ্ত রেখে খানিকক্ষণ সাধাসাধির পর পুলকদা আর তার বউয়ের সঙ্গে স্যুপ খেতে চলে গেল। সেই সাধাসাধির মূল্য বোঝার দীনতায় সারা জীবন নুব্জ্য হয়ে থাকতে হবে আমাকে।

১৯৮৪ সাল [আনুমানিক]। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের আড্ডায়
বিরল যে দু’চারজন বন্ধু আমাকে ইমতিয়ার নামে ডাকে, কখনও তুমি কখনও তুই বলে, ও হলো তাদেরই একজন। দেখা হলে আমি স্মরণ করিয়ে দিতাম বারী ভাই অপেক্ষায় রয়েছেন কবে তারেক শাহরিয়ারের গল্পের বই বেরুবে আর তারেক ভাই বারী ভাইকে নিয়ে অনেক কিংবা দু’চার কথা বলার পরই বলে উঠত, ‘ইমতিয়ার, যেকোনও বৃহষ্পতিবার রাতে আমি তোমাকে ফোন করব, শুক্রবার সকালে উঠেই আমি আর তুমি সিরাজগঞ্জে চলে যাব, সারাদিন ব্যক্তিগত পাঠাগারে আড্ডা দিয়ে আবারও ঢাকায় চলে আসব। আহ্হারে, বারী ভাইকে কতদিন দেখি না রে…! শোন্, আমি কিন্তু বারী ভাইকে নিয়ে অবশ্যই একটা ডকুমেন্টারি করব…।’
জানি, আমাদের জন্যে এখন রয়েছে কেবলই স্মৃতির তপ্ত মাঠ। জানি, সেই বৃহষ্পতিবার রাত, শুক্রবারের সকাল কোনওদিনই আসবে না। তবু হঠাৎই মনে হয় আজ টেলিফোন আসবে, কাল সকালে উঠেই আমরা সিরাজগঞ্জের বাস ধরব। সেই কলেজ মাঠ, আমতলা আর শহীদ মিনার, রাস্তার ধারে কলেজ হোস্টেলের রুম আমাদের, খলিফাপট্টির চালের আড়তের মধ্যে বসে সাইফুল ভাই আর মণিদের নিয়ে জম্পেশ সব ‘বেনামাজীদের’ শুক্রবারের দুপুর, সেই যমুনার পাড়, রেলব্রিজ, কাটাখালির সেতু, জয়নালের কিংবা ভোলা খাঁ’র সিঙ্গারা, তামান্না বুক ডিপো, সোনালী ব্যাংকের সামনের মাঠ, ভিক্টোরিয়া রোড, বাহিরগোলা রোড, ব্যক্তিগত পাঠাগার ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখব, দেখব তা কেবলই প্রজাপতির মতো ডানা ঝাাটায়, স্বল্পায়ু হয়েও দূরে সরে যায়, কিন্তু আমরা আমাদের দ্বিপ্রহর পার করে দেবো সেই প্রজাপতি ধরার মোহ ও মায়ায়…।
জীবনটা কততো ছোট, তা ছাড়া আমাদের মৃত্যুও শুরু হলো… আমরা তবু তারেককে আমৃত্যু মনে রাখব।
গ্রন্থসূত্র : মূলত মানুষ, মূলত মানস/ইমতিয়ার শামীম
প্রকাশক : নালন্দা, ঢাকা ।। প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০০৭
লেখাটির মূল শিরোনাম, আমাদের মৃত্যু হলো শুরু
লেখকের অনুমতিক্রমে পুনঃপ্রকাশিত…