মৃণাল সেনের আত্মজীবনী [২]

1285
Mrinal Sen

লিখেছেন । মৃণাল সেন

মৃণাল সেন। সদ্যপ্রয়াত মাস্টার ফিল্মমেকার। তাঁর মহাজীবনের পাঠ নিতে, আত্মজীবনী তৃতীয় ভুবন-এর ‘চতুর্থ অধ্যায়’টি এখানে তিন কিস্তিতে পুনমুর্দ্রণ করা হলো…

filmfree

তৃতীয় ভুবন
লেখক । মৃণাল সেন
প্রথম প্রকাশ । ২০০৪
প্রথম আনন্দ প্রকাশ । এপ্রিল ২০১১
প্রকাশক । আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড
প্রচ্ছদ । সোমনাথ ঘোষ
পৃষ্ঠাসংখ্যা । ২৬৮
মূল্য । ৩০০ রুপি

আগের কিস্তি পড়তে এ বাক্যে ক্লিক করুন

কিস্তি । ২ [৩]

বেশ একটা দীর্ঘ সময় কেটে গেল, যে সময়ের কোনও শেষ নেই, কোনও সীমারেখা নেই। ইতিমধ্যে ১৯৯০ সালে সাতচল্লিশ বছর বাদে আমি ও আমার স্ত্রী সেই ফরিদপুর শহরের সেই বাড়িটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, বাড়িটাকে দেখলাম। সাতচল্লিশ বছর আগে আমি এ দেশ ছাড়ি। এখন এই আমার নিজের মাতৃভূমি যে দেশে সেই দেশটার নাম বাংলাদেশ। একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র।

এ বাড়িটিতেই আমার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে। এই সাতচল্লিশ বছরে এই বাড়িটার মালিকানা একবারই বদলেছে।

আমার বাবার কাছ থেকে যে ভদ্রলোক বাড়িটি কিনেছিলেন তিনি কথা রেখেছিলেন। সেই পুকুরপাড়ে রেবার স্মৃতিসৌধ সযত্নে রক্ষা করেছিলেন। তিনি আবার বাড়িটাকে অন্য একজনকে বিক্রি করে দিয়ে করাচি চলে যান।

সাতচল্লিশ বছর পরে বিস্ময়ের সঙ্গে ভাবি– আমি আমার সেই দূরের ফেলে আসা অতীতকে একটিবারের জন্যও ভাবিনি, পেছন ফিরে তাকাইনি। একবারও ভাবিনি দেশভাগের কথা। কিন্তু এখন কেন ভাবছি!

মৃণাল সেনগীতা সেন

যদি তাই হয় তাহলে এখন কেন আমার মন সেকথা বলছে। বিগত পনেরো বছরে এ কথা মনে হয়নি অথচ এই কয়েক বছরে আমি আমন্ত্রিত হয়ে ঢাকায় এসেছি বেশ কয়েকবার। প্রায় আধ ডজনবার আমার সেই ফেলে আসা বাসভূমিতে যাওয়ার আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছি। সে আমন্ত্রণ ছিল ঢাকা থেকে ফরিদপুর। আবার ফরিদপুর থেকে ঢাকা। সত্যি বলতে আমার কাছে এ প্রশ্নের কোনও উত্তর নেই।

সাতচল্লিশ বছর বাদে নিজেকে প্রশ্ন করি– কেন এমন হলো, কেন আমি আমন্ত্রণ পেয়েও সেই শৈশবের কৈশোরের বাসভূমিতে গেলাম না। তখন ঢাকা থেকে ফরিদপুরে যাওয়ার পথটা ভারী সুন্দর ছিল, পুরো একদিন সময়ে চলে যেত নদীতে জাহাজে, যে জাহাজের ওপরে নীচে শোয়ার জায়গা থাকত। সেই জাহাজ আসত নারায়ণগঞ্জ থেকে। জাহাজগুলোর নাম ছিল এমু অথবা অস্ট্রিচ– এরকম ধরনের। নদী তখন বর্ষায় ভয়ংকর। সে নদী হলো পদ্মা। তারপর ছোট্ট ডিঙির মতো নৌকায় চড়ে, ফেরিতে চড়ে, যার নাম ছিল ডামডিম, সরু খালের ভেতর দিয়ে যেতে হতো খালের দু’পাশে ধান আর পাটের খেত শেষ করে সোজা ফরিদপুর।

মৃণাল সেন

এখন সেখানে যাতায়াতব্যবস্থা যথেষ্ট উন্নত। সেখানে মোটরগাড়ি এসে জায়গা করে নিয়েছে। ফরিদপুরের ভেতরটা ভেতরেই রয়েছে। শুধু একটা ফেরি করে পদ্মা নদী পার হয়ে আবার মোটরগাড়ি। অনেক কম সময়ে ফরিদপুর পৌঁছে যাওয়া যায়। ১৯৯০ সালে আমি ও আমার স্ত্রী গীতা যখনই ঢাকা পৌঁছলাম আমরা ঠিক করলাম ফরিদপুর যাব। সেটা যদি কয়েক ঘণ্টার জন্য হয় তাও। আমরা দু’জনে ঢাকায় তিনদিন ছিলাম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। ঠিক করলাম চারদিনের দিন আমরা ফরিদপুর যাব। আমাদের সঙ্গে ছিল অল্পবয়সি যুবক ক্যামেরাম্যান শশী আনন্দ। শশী আনন্দের বাবা ও মা দেশ বিভাগের পর চলে আসেন এদেশে। যখন তাঁরা এদেশে আসেন তখন তাঁরা বাস্তুহারা। এটা হলো পশ্চিম পাঞ্জাব থেবে পূর্ব পাঞ্জাবে। তখন কিন্তু শশী জন্মায়নি। শশী জন্মেছে ভারতে। এই শহর কলকাতাতে। আমার মতোই সে এখানেই বড় হয়েছে। শশী তাঁর বাবা আর মায়ের মুখে দেশ বিভাগের পর দেশের বাড়ির অনেক ঘটনা, অনেক কাহিনি শুনেছে। সেটা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। তাই সে পূর্ব পাকিস্তানে, অধুনা বাংলাদেশে আমার দেশের বাড়ি দেখতে উৎসাহী হলো।

সে স্মরণীয় যাত্রা, যে যাত্রা ভোলা খুব কঠিন। আমরা তিন বিদেশি, আমি, আমার স্ত্রী গীতা আর শশী আনন্দ। আমাদের পথপ্রদর্শক ও সঙ্গী খয়ের খাঁ, এক মজার মানুষ।

আমরা
যখন সেই
ফরিদপুর শহরের
কাছাকাছি এসে গেছি
তখন আমি খুব উত্তেজিত,
উত্তেজনার আগুন পোহাচ্ছি

আমরা যখন সেই ফরিদপুর শহরের কাছাকাছি এসে গেছি তখন আমি খুব উত্তেজিত, উত্তেজনার আগুন পোহাচ্ছি।
‘সামনে কী?’ যেন অনেকটা পড়া ধরার ভঙ্গিতে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন খয়ের সায়েব।
‘কেন, সেই খালটা!’ আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বললাম। অবাক করে দেওয়ার জন্য বললাম, ‘কেন, সামনেই কাঠের সেই পোল।’
‘কাঠের সেই সেতুটা আর নেই। সেখানে এখন কংক্রিটের বাঁধানো সেতু। কাঠের সেতুটা ভেঙে পড়বার আগেই এটা তৈরি হয়েছিল। সেটাও প্রায় বছর পনেরো হয়ে গেলো।’ খয়ের সাহেবের এই কথার সঙ্গে সঙ্গে আমরা সেই কংক্রিটের সেতুর কাছে এসে পড়লাম। আমাদের গাড়িটা সেতুটি পার হলো এবং সোজা বেরিয়ে একটা লম্বা রাস্তায় পড়ল। সাজানো ফিটফাট, সভ্যতার ছোঁয়া লেগেছে এখানে। সেই সময়ে যখন আমি নেহাতই ছোট, তখন এই জায়গাটা একটি নিষিদ্ধ পল্লী ছিল। গাড়িটা হঠাৎ একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। আমরা গাড়ি থেকে নামলাম।

মৃণাল সেন

যেখানে নামলাম সেখানে উষ্ণ অভ্যর্থনা, প্রশংসা আর ভালোবাসা। তারপর ভালোমন্দ খাওয়া। একটু বিশ্রাম নিলাম। তারপর পায়ে হেঁটে এগোতে লাগলাম সেই অতীতের খোঁজে। সেই দেশের ফেলে আসা বাড়ির দিকে।

আমার মনের ভেতরে একটার পর একটা স্মৃতি– সেই মনের গোপন কোণে সেসব পুরনো কথা উঁকি মারছিল। প্রায় এক দেড়শো লোক আমাদের পেছন থেকে খেয়াল করছিল। ওরা আমাকে চিনতে পেরেছিল। ওদের কয়েকজন পেছন পেছন এলো, আমরা সেই বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়ালাম। প্রতিটি পদক্ষেপেই উত্তেজনা। আমি নিজের সঙ্গে নিজে লড়াই করছিলাম, একটা অনিশ্চয়তা যেন আমাকে চেপে ধরেছিল। সেই স্মৃতির উন্মোচন যেন লস্ট হরাইজন-এর হারিয়ে যাওয়া নায়ক রোনাল্ড কোলম্যানের মতো।

আমি সবাইকে কাছে ডেকে বললাম, আমি এখানে আমার নিজের মতো করে পথ চলব, তোমরা কেউ কোনও কথা বলবে না। যদি আমি কখনও ভুল করি পথ চলতে চলতে, তাহলেও নয়। আমি আবিষ্কার করলাম নতুন করে নিজেকে, সাতচল্লিশ বছর বাদে।

সে এক অভিজ্ঞতা। আমি নিজেই সব জায়গা খুঁজে পেলাম সাতচল্লিশ বছর পরেও। কিছু মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আমার দেশের বাড়ির সামনে। কেউ একটি কথাও বলল না। এক অখণ্ড অপূর্ব নীরবতা।

আমার
কান্না পেল। কিন্তু
কাঁদতে পারলাম না

গীতা কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, ‘তুমি সব জায়গাগুলো চিনতে পেরেছ! এদেরও চিনতে পেরেছ!’ আমি মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। কিছু বললাম না। গীতা আমার হাতটা চেপে ধরল। আমার কান্না পেল। কিন্তু কাঁদতে পারলাম না।

গীতা সেনমৃণাল সেন
১৯৯০ দশকে

এক ভদ্রলোক পেছন থেকে এসে বললেন, এঁরা যাঁরা সামনে দাঁড়িয়ে ওঁরাই এখন এ বাড়িতে থাকেন। ওঁরা নতুন এসেছেন।

এক মাঝবয়সি ভদ্রমহিলা, অতি সাধারণ বাড়ির বউ, একগুচ্ছ ফুল এসে গীতার হাতে দিয়ে হেসে বললেন, ‘আপনি শ্বশুরবাড়িতে এসছেন।’ বললেন, ‘আসুন। সেই পুকুর পাড়ে। যাবেন তো?’ গীতার তর সইছিল না। ও আমার কাছে রেবার কথা অনেক শুনেছে।

ভদ্রমহিলা বললেন, ‘চলুন, রেবাকে মনে পড়বে। দেখবেন, আপনাদের বাবার কথা আমরা রেখেছি। ভাঙচুর একটু-আধটু যা হয়েছে, তাও সারিয়েছি।’

কথাগুলো শুনছি আর আমরা দু’জন– আমি আর গীতা, মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি। আমি কী বলতে যাব গীতাকে, আমার গলাটা আটকে গেল।

ভদ্রমহিলা আবার বলল, ‘কী হলো? আসুন?’

রেবা
মৃণাল সেনের বোন

হঠাৎ মনে পড়ল মহাত্মা গাঁধীর কথা। মহাত্মা! যখন অনশন করা ছাড়া তাঁর কাছে আর কোনও রাস্তা ছিল না, যখন হিংসার দাবানল ছড়িয়ে পড়েছিল দিকে দিকে, তখন যদি তিনি শুনতে পেতেন আজকের এই কথাগুলো! যদি আমি আমার বাবাকে বলতে পারতাম যে তাঁর সেই ছোট্ট রেবার স্মৃতিসৌধ আজও সেই পুকুরঘাটে সুরক্ষিত! যদি আমার মাকে জানিয়ে দিতে পারতাম যে তাঁর মেয়ে রেবা এখনও সেই ঘাতক-পুকুরঘাটে বেঁচে আছে! যে ঘাটে জসীমদা সারা দুপুর, সারা বিকেল, সারা দিনটা কাটিয়েছেন একা! আর শুধুই রেবার কথা ভেবেছেন।

একটা
মুখ হঠাৎ
ভেসে উঠল, আমার
সামনে এসে দাঁড়াল।
ঋত্বিক।
ঋত্বিক ঘটক।
মৃত মানুষটা আমার
সামনে! মৃত, কিন্তু কয়েকটা
ছবি এখনও ভীষণভাবে জেগে
রয়েছে, দেশ হারানোর
বেদনা ছবিগুলোতে

মনে পড়ছে মায়ের সঙ্গে জসীমদার শেষ দেখা কবে। সেও এক ঘটনা। মা তখন খুবই অসুস্থ, শয্যাশায়ী। জসীমদাকে তখন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে হয়েছে সাম্মানিক ডি. লিট উপাধি পাওয়ার জন্য। পরে কয়েকটা দিন কলকাতায় কাটিয়ে যাবেন ঠিক করলেন। রোজই আমার খোঁজ করছিলেন। আমি তখন কলকাতার বাইরে ছিলাম। ফিরে আসতেই আমাকে ডেকে পাঠালেন, বললেন, কতদিন মায়ের সঙ্গে দেখা হয়নি, এবার দেখা না করে ঢাকায় ফিরে যাবেন না। জসীমদাও আমাদের ভাইদের মতো আমাদের মাকে মা বলে ডাকতেন। বললেন, “চল, আমাকে এখনই নিয়ে চল, তোর জন্যেই আমি এ ক’দিন বসে আছি।” সঙ্গে সঙ্গে আমি মাকে আর আমার সেজদাকে জানিয়ে দিলাম আমরা আসছি। আর আধ ঘণ্টার মধ্যেই নাকতলায় পৌঁছে গেলাম। বাড়ির দরজার পাশে এসে গাড়িটা যখন গর্জন করে থেমে গেল, মা তখন উঠোনে ছুটে এলেন ডাক্তারের নির্দেশ না মেনেই। সমস্ত শক্তি দিয়ে মা ডেকে উঠলেন : ‘জ-সী-ম!’ গাড়ির দরজা খুলে ছুটে গেলেন জসীমদা। জড়িয়ে ধরলেন দু’জন দু’জনকে, উঠোনের মাঝখানে, মা আর জসীমদা। দু’জনেই তখন কাঁদছেন, শিশুর মতো কাঁদছেন। বারান্দার এক কোণে বসে আমি দেখছিলাম। দেখছিলাম ইতিহাস। একটা মুখ হঠাৎ ভেসে উঠল, আমার সামনে এসে দাঁড়াল। ঋত্বিক। ঋত্বিক ঘটক। মৃত মানুষটা আমার সামনে! মৃত, কিন্তু কয়েকটা ছবি এখনও ভীষণভাবে জেগে রয়েছে, দেশ হারানোর বেদনা ছবিগুলোতে।

পরের কিস্তি পড়তে এ বাক্যে ক্লিক করুন

Print Friendly, PDF & Email
মাস্টার ফিল্মমেকার; ভারত । জন্ম : ১৪ মে ১৯২৩; ফরিদপুর, বাংলাদেশ । মৃত্যু : ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮; কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত ।। ফিচার ফিল্ম : রাত ভোর; নীল আকাশের নীচে; বাইশে শ্রাবণ; পুনশ্চ; অবশেষে; প্রতিনিধি; আকাশ কুসুম; মাটির মণীষা; ভুবন সোম; ইন্টারভিউ; এক আধুরি কাহানি; কলকাতা ৭১; পদাতিক; কোরাস; মৃগয়া; ওকা উরি কথা; পরশুরাম; একদিন প্রতিদিন; আকালের সন্ধানে; চালচিত্র; খারিজ; খণ্ডহর; জেনেসিস; একদিন আচানক; মহাপৃথিবী; অন্তরীণ; আমার ভুবন । শর্টফিল্ম : ইচ্ছাপূরণ; তসবির আপনি আপনি; অপরাজিত; কাভি দূর কাভি পাশ; সম্ভার; আয়না; রবিবার; আজকাল; দো বাহেনে; জিত; সালগিরা; শাল; আজনবি; দশ সাল্ল বাদ । ডকুমেন্টারি : মুভিং পারসপেকটিভস; ত্রিপুরা প্রসঙ্গ; সিটি লাইফ-- কলকাতা মাই এল দোরাদো; এন্ড দ্য শো গোজ অন

2 মন্তব্যগুলো

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here