বাহাস অসম্পূর্ণ রেখে চলে গেলেন আমজাদ হোসেন

602
আমজাদ হোসেন

লিখেছেন । বেলায়াত হোসেন মামুন

কথা হচ্ছিল নায়করাজ রাজ্জাক স্মরণে আয়োজিত স্মরণসভায়। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সেমিনার কক্ষে। বলছিলেন, চলচ্চিত্র সংসদ থেকে ইন্ডাস্ট্রির কোনো চিত্রতারকার স্মরণে এটাই প্রথম স্মরণসভা। খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন সেদিন। নায়করাজ রাজ্জাকের প্রয়াণ ওনাকে অনেকখানি দুর্বল করে দিয়েছে বলছিলেন। আর আমি ভাবছিলাম নায়করাজ রাজ্জাকের পর আমজাদ হোসেন ছাড়া আর কেউ নেই এমন অভিভাবকতুল্য ব্যক্তিত্ব যাঁকে চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি সামনে রাখতে পারে। দুঃখজনক হলো, যখন শুনলাম আমজাদ হোসেন আর নেই– তখন প্রথমেই আমার সেই কথাটিই মনে পড়লো। আমজাদ হোসেনের প্রয়াণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি বড়মাপের তারকা এবং নির্মাতার ব্যক্তিত্বপূর্ণ অবয়বের অভিভাবক হারালো।

আমজাদ হোসেন
১৪ আগস্ট ১৯৪২–১৪ ডিসেম্বর ২০১৮

আমজাদ হোসেন একজন কীর্তিমান মানুষ। সৃজনশীলতার অনেক শাখায় তিনি তাঁর মননশীলতার চিহ্ন রেখেছেন। অর্জন করেছেন অনেক মানুষের ভালোবাসা এবং সম্মান। এক জীবনের এসব অর্জন খুব সামান্য নয়। চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন করি বলে আমজাদ হোসেনকে কখনও অবহেলার ধৃষ্টতা দেখাইনি। এটা সত্য যে চলচ্চিত্রকে শিল্প [আর্ট] অর্থে যেভাবে আমরা ভালোবাসি এবং চর্চা করি তাতে ইন্ডাস্ট্রির সাথে আমাদের চিন্তার শুদ্ধতার দিক দিয়ে একটি সাংঘর্ষিক অবস্থান রয়েছে।

বিনোদন আমাদের
ইন্ডাস্ট্রিতে বিকারে
পরিণত হয়েছিল
মাত্র কিছু দিন
আগেই

চলচ্চিত্র কেবলমাত্র বিনোদনের পসরা নয়। ইন্ডাস্ট্রির শতকরা ৯৯ ভাগ মানুষ বিশ্বাস করেন, চলচ্চিত্রের কাজ ‘বিনোদন’ দেওয়া। এর মাঝে কিছু লোক বিনোদনকে একপ্রকার রগড়ে পরিণত করতে তৎপর। বিনোদন আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে বিকারে পরিণত হয়েছিল মাত্র কিছু দিন আগেই। এসব ৯৯ ভাগ মানুষের বাইরের মানুষ ছিলেন আমজাদ হোসেন। মুক্তিযুদ্ধের পর ইন্ডাস্ট্রিকে ‘ইন্ডাস্ট্রি’ হিসেবে রূপ দিতে খান আতাউর রহমান, আমজাদ হোসেনদের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে যে ইন্ডাস্ট্রি দেখে গেছেন, সে ইন্ডাস্ট্রি দেখবার প্রত্যাশায় তারা এই ইন্ডাস্ট্রিতে জীবনব্যয় করেননি। এ কথা আমজাদ হোসেন বলেছিলেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে প্রয়াত নায়করাজের স্মরণসভায়।

সুন্দরী
ফিল্মমেকার । আমজাদ হোসেন

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অসামান্য নির্মাতা জহির রায়হানের সাথে আমজাদ হোসেন কাজ করেছেন ঘনিষ্ঠভাবে। মুক্তিযুদ্ধের আগের পর্বে জহির রায়হানের প্রায় সকল কাজেই আমজাদ হোসেন যুক্ত থাকার সুযোগ পেয়েছেন। জহির রায়হানের মতো চেতনাঋদ্ধ মানুষের সাথে কাজের এই যূথবদ্ধতা আমজাদ হোসেনের পরবর্তী জীবনে বড় প্রভাব রেখেছে বলে মনে করি। কারণ আশির দশক পর্যন্ত সময়ে আমজাদ হোসেনের নির্মিত প্রায় সকল চলচ্চিত্রে দেশ, সমাজ এবং মানুষের যে সচেতন দৃশ্যায়ন– তা সুভাষ দত্তের কাজের বাইরে আর কারও কাজে দেখা যায় না। আমজাদ হোসেনের চলচ্চিত্রে বাংলাদেশের সত্তর ও আশির দশকের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট প্রবলভাবে হাজির আছে।

একজন নাগরিক গণসঙ্গীত
শিল্পীর জীবনের গল্পবলার
ভেতর দিয়ে তিনি
বাংলাদেশের স্বাধীনতার
সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ
এবং
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী
দেশের মানুষের
সামাজিক-অর্থনৈতিক
শ্রেণী বৈষম্যের চিত্র
তুলে ধরতে
চেয়েছেন

ব্যক্তিগতভাবে আমি আমজাদ হোসেন নির্মিত জন্ম থেকে জ্বলছি চলচ্চিত্রের প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হই এর সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে। একজন নাগরিক গণসঙ্গীত শিল্পীর জীবনের গল্পবলার ভেতর দিয়ে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী দেশের মানুষের সামাজিক-অর্থনৈতিক শ্রেণী বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরতে চেয়েছেন। ভাত দে চলচ্চিত্রে তিনি রাজনৈতিক মতাদর্শের বাইরে গিয়ে দেখাতে চেয়েছেন একজন গ্রামীণ শিল্পীর পারিবারিক জীবনকে দারিদ্র কতটা ছিন্নভিন্ন করে। গোলাপী এখন ট্রেনে চলচ্চিত্রে তিনি বলতে চেয়েছেন সামাজিক গ্রাম্যশৃঙ্খলের বিরুদ্ধে নারীর স্বাধীনতার কথা। এসব চলচ্চিত্র ভীষণভাবে দর্শকনন্দিত। এসব চলচ্চিত্রের গানগুলো বিপুল শ্রোতাপ্রিয়। এই জনপ্রিয়তা নিঃসন্দেহে তার গুরুত্বপূর্ণ অর্জন।

জন্ম থেকে জ্বলছি
ফিল্মমেকার । আমজাদ হোসেন

আমজাদ হোসেনকে বলতাম ‘আমজাদ ভাই’। তিনি খুব স্নেহ করতেন। আর স্নেহ করতেন বলেই তার এসব দর্শকনন্দিত চলচ্চিত্র নিয়ে প্রবল বাহাস করতাম তার সাথে। বলতাম, “আমজাদ ভাই, আপনার এসব চলচ্চিত্র শেষ পর্যন্ত দর্শককে সমাজ সম্পর্কে সচেতন করে না। এসব চলচ্চিত্র শেষ পর্যন্ত ভীষণ মেলোড্রামাটিক করুণ আবহে দর্শককে ‘বিনোদিত’ করে। চলচ্চিত্রগুলোর কনন্টেন্ট যতই সমাজের রুঢ় বাস্তবকে সামনে আনুক না কেন, পর্দায় উপস্থিত চিত্রল দৃশ্যাবলি, মনমুগ্ধ করা গীতল গানগুলো সেই বাস্তবের রুঢ়তাকে ‘হালকা’ করে দেয়। বাস্তবের চাবুক দর্শকের মনে আঘাত করে না। বাস্তবের দৃশ্যগুলো দর্শকের কাছে ‘নাটকীয়’ মনে হয়। দর্শক বরং গোলাপীরূপী ববিতার নারীর প্রথাগত সামাজিক সংস্কারভাঙার দ্রোহকে নায়িকার ‘সাহসী অভিনয়’ ভাবতে শুরু করে।”

আমজাদ ভাইকে একবার বলেছিলাম, জন্ম থেকে জ্বলছিকে যদি বাংলাদেশের আজকের রাজনৈতিক মেরুকরণের ইতিহাসের সাথে মিলিয়ে দেখি, তবে এই চলচ্চিত্রটিকে একটি প্রবলভাবে রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট চলচ্চিত্র বলে মনে হয়। আমার কৈশোরকালে দেখা এই চলচ্চিত্রের প্রতি আমার যে আবেগ, তা পরিণত বয়সের দেখায় সম্পূর্ণ উবে গিয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের নির্মাণ ইতিহাসকে নতুন রাজনৈতিক চিন্তায় দেখতে উৎসাহিত বোধ করায়।

পর্দায় যখন দর্শক
চলচ্চিত্রটি দেখবে, তখন
তারাও আমাদের মতো
আবেগে কাঁপুক

আমজাদ ভাই এসব ‘অভিযোগ’, ‘অভিমত’ গভীর মনোযোগে শুনতেন। বলতেন, ‘আমরা যখন চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে এসেছি, তখন চলচ্চিত্রের বিষয়ে আমাদের কোনো পড়াশোনাও ছিল না, প্রস্তুতিও ছিল না। আমরা প্রবল আবেগের সাথে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছি। চেয়েছি পর্দায় যখন দর্শক চলচ্চিত্রটি দেখবে, তখন তারাও আমাদের মতো আবেগে কাঁপুক… কি ভুল করেছিলাম আর কি সঠিক করেছিলাম তা এখন তেমন ভাবি না… তবে আমার চলচ্চিত্র যে আপনাদের মতো চলচ্চিত্র সংসদকর্মীদের ভাবাচ্ছে– এটাই তো আনন্দের’!

ভাত দে
ফিল্মমেকার । আমজাদ হোসেন

আমজাদ হোসেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের এক অসামান্য গুরুত্বপূর্ণ মানুষ ছিলেন। বিশেষ করে আমাদের চলচ্চিত্র ইতিহাসের চলচ্চিত্রের ভাবনাগত বিভিন্ন প্রবণতা ও ইন্ডাস্ট্রির উত্থান এবং বিপর্যয়ের ইতিহাস নিজস্ব মননশীল দৃষ্টিভঙ্গিতে বলতে পারার মতো শেষ প্রতিনিধি ছিলেন। জহির রায়হানের রাজনৈতিক চলচ্চিত্র জীবন থেকে নেয়ার সংলাপ রচয়িতা হিসেবে তার যে ভূমিকা, তা তো স্মরণীয় হয়ে থাকবে চিরদিন।

ব্যক্তিগতভাবে আমার দুঃখ রয়ে গেল ওনার সাথে আমার সংলাপ অসম্পূর্ণ থাকায়। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির সকল মানুষের সাথে মননশীল আলোচনা করা যায় না। তাদের অনেকে তেমন আলোচনা পছন্দও করেন না। কিন্তু আমজাদ হোসেন তেমন আলোচনাকে উৎসাহিত করতেন। চলচ্চিত্রে সকলে শুদ্ধ কবি হতে আসেন না। কেউ কেউ আসেন কবিয়াল হতে, কেউ আসেন বয়াতি হতে, কেউ আসেন একদম নিছক কবিযশপ্রার্থী হয়ে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে আমজাদ হোসেন এসেছিলেন একজন সচেতন আবেগী চলচ্চিত্রকার হতে। তিনি তা হতে পেরেছেন। এটাই তার সার্থকতা।

যেখানেই থাকবেন, ভালো থাকবেন আমজাদ ভাই। আপনার সাথে অনেক ব্যক্তিগত বাহাস অসম্পূর্ণ রইল। তবে আপনার সৃষ্টির সাথে নির্দয়, নিষ্ঠুর বাহাস চলবে। আপনি দেখবেন এবং শুনবেন।

গোলাপী এখন ট্রেনে
ফিল্মমেকার । আমজাদ হোসেন

১৭ ডিসেম্বর ২০১৮
প্রথম প্রকাশ । রঙের মেলা; কালের কণ্ঠ; ২০ ডিসেম্বর ২০১৮

Print Friendly, PDF & Email
লেখক; চলচ্চিত্র নির্মাতা; চলচ্চিত্র সংগঠক। ঢাকা, বাংলাদেশ। সাধারণ সম্পাদক, ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশ। সভাপতি, ম্যুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটি। নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র : অনিবার্য [ পোশাক শ্রমিক আন্দোলন; ২০১১]; পথিকৃৎ [চলচ্চিত্রকার বাদল রহমানের জীবন ও কর্মভিত্তিক; ২০১২ (যৌথ নির্মাণ)]; সময়ের মুখ [জাতীয় অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলামের জীবন অবলম্বনে; ২০১৮]। সম্পাদিত ফিল্ম-ম্যাগাজিন : ম্যুভিয়ানা; চিত্ররূপ। সিনে-গ্রান্থ : চলচ্চিত্রপাঠ [সম্পাদনা]; চলচ্চিত্রের সাথে বোঝাপড়া; স্বাধীন চলচ্চিত্র আন্দোলনের ইশতেহার : বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ; চলচ্চিত্রকথা [তারেক মাসুদের বক্তৃতা ও সাক্ষাৎকার; সম্পাদনা]। পরিকল্পক ও উৎসব পরিচালক : নতুন চলচ্চিত্র নতুন নির্মাতা চলচ্চিত্র উৎসব

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here