বাস্তব-অবাস্তবের দ্বান্দ্বিকতা ও আব্বাস কিয়ারোস্তামির ‘ক্লোজ-আপ’

922
filmfree

লিখেছেন । লাবণ্য দে

ক্লোজ-আপ
nema-ye nazdik

স্ক্রিপ্টরাইটার, এডিটর ও ফিল্মমেকার । আব্বাস কিয়ারোস্তামি
প্রডিউসার । আলী রেজা জারিন
কাস্ট । হোসেন সাবজিয়ান, মোহসেন মাখমালবাফ
সিনেমাটোগ্রাফার । আলী রেজা জারিনদাস্ত
রানিংটাইম । ৯৮ মিনিট
ভাষা । ফার্সি
দেশ । ইরান
রিলিজ । ১৯৯০

filmfree
ক্লোজ-আপ

দেশটির নাম ইরান। এশিয়ার পশ্চিমপ্রান্তে অবস্থিত এই দেশটির নাম শুনলেই মনে আসে গোঁড়া ইসলামি আচার-আচরণের কথা। ধর্মীয় মৌলবাদ যেখানে প্রভাবিত করে শিল্পমাধ্যমকেও, সিনেমার সেন্সরশিপ নির্ধারিত হতে থাকে এই মৌলবাদী নিয়মনীতির দ্বারা। সেন্সরশিপের অদ্ভুত নিয়মনীতিতে মোড়া এই দেশে যেখানে হিজাব ছাড়া মেয়েদের পর্দায় দেখানো যাবে না, দেখানো যাবে না পুরুষ-নারীর শারীরিক সামান্য সংযোগও, সেই দেশে যখন সিনেমা তৈরি হয়, তখন এই সিনেমা তৈরির সিদ্ধান্তই হয়ে ওঠে রাজনৈতিক।

এই রকম নিষেধের বেড়াজালে মোড়া সিনেমার দুনিয়ায় দেখা যায় কিছু আশ্চর্য উদাহরণ। নিষেধকে অতিক্রম করলে যেখানে কঠিন শাস্তি, তখন নিষেধকেই ছবির ভাষা করে নেন পরিচালক কিয়ারোস্তামি। প্রেমিক-প্রেমিকার ঘনিষ্ঠতা দেখানো যাবে না বলে তাদের মিলনদৃশ্যে বহুদূর থেকে ক্যামেরা তাদেরকে দেখতে থাকে, যেখানে বিন্দু হয়ে প্রকৃতির সাথে মিশে যায় দুটো শরীর [থ্রু দ্য অলিভ ট্রি]। আবার গৃহের অন্তরদৃশ্যে ব্যক্তিগত পরিসরে মেয়েদের হিজাব পরে দেখালে তা অসামঞ্জস্যপূর্ণ হবে বলে কিয়ারোস্তামি সেট হিসেবে বেছে নেন চলন্ত গাড়ির অন্দর, যার মধ্যে মেয়েদের কথোপকথনেই তৈরি হয় ব্যক্তিগত স্পেস। নিষেধের কঠোরতার মধ্যে থেকে কিয়ারোস্তামির ভাষা নির্ধারিত হতে থাকে, তা ক্রমশ পৌঁছে যায় অন্য এক মাত্রায়। কঠোরতা বাধাবিপত্তি অসন্তোষের বাঁধন পেরিয়েও যে ইরানের এক সজীব প্রাণ আছে, জীবনীশক্তি আছে– তার আরাধনা করেছেন কিয়ারোস্তামি। হোসেন সাবজিয়ানের মতো চরিত্র তাই তার কাছে অনুপ্রেরণা, যিনি তার জীবনের সকল দুঃখ-কষ্টের মুক্তি খোঁজেন শিল্পে, সিনেমায়।

ক্লোজ-আপ

হোসেন সাবজিয়ান, পেশায় একজন ছাপাখানার নিম্নবেতনের কর্মী, নেশায় সিনেমাপ্রেমী। তেহরানের এক অভিজাত আহানখাহ পরিবারে তিনি নিজেকে পরিচালক মাখমালবাফ বলে পরিচয় দেন। সেইসূত্রে ওই পরিবারের লোকজনকে নিয়ে একটি ছবি বানানো ও তাদের বাড়িটিতেই তা সংক্রান্ত মহড়া দিতে থাকেন। একজন সাংবাদিকের সূত্রে জানাজানি হয়ে যায় এই নকল মাখমালবাফের ঘটনা, হোসেন সাবজিয়ানকে জেলে বন্দী করা হয়। একজন অত্যন্ত সাধারণ মানুষের এই সিনেমাপ্রীতি আকর্ষিত করেছিল পরিচালক কিয়ারোস্তামিকে। তিনি তার তখনের শুটিংয়ের সিডিউল বদলে উৎসাহী হয়ে পড়েন সাবজিয়ানের ঘটনায়। সাবজিয়ানের মিথ্যে কথা বলে লোক ঠকানোর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে তার ছবিসংক্রান্ত প্রেম। যে ছবিপাগল মানুষটা নিজের অস্তিত্ব ছাপিয়ে একজন পরিচালকের অস্তিত্ব বহন করে চলেন, তার মনন সন্ধানে উৎসাহী হয়ে পড়েন কিয়ারোস্তামি। ক্লোজ-আপ সাবজিয়ানের ব্যতিক্রমী অপরাধের থেকেও মনোযোগী হয়ে পড়ে চরিত্রের দার্শনিক বিচার-বিশ্লেষণে।

কিয়ারোস্তামি
সত্য এবং সত্যের
পুনর্গঠনের সংজ্ঞাকে
ঘেঁটে দিতে থাকেন
ক্রমশ

ক্লোজ-আপ

ছবিটি দেখলে মনে হয় তা ডকুমেন্টারি ও ফিকশন জঁরের সংমিশ্রণ। যেন ছবিটির এক অংশ হোসেন সাবজিয়ানের আদালতের বিচারপর্বকে রেকর্ড করে এবং অপর অংশ লজিকাল এক্সটেনশানের জন্য সাবজিয়ানের ঘটনাকে সত্যিকারের চরিত্রদের নিজ নিজ চরিত্রাভিনয়ের দ্বারা শুট করে। এই দুই পার্থক্য পরিচালক অত্যন্ত সচেতনভাবে করেন। সিনেমার অন্যান্য অংশে যেমন ঝকঝকে চিত্র, সেখানে আদালতের সিনে দেখা যায় অপেক্ষাকৃত কমদামি ক্যামেরায় তা শুট করা হচ্ছে এবং ছবিটি যথেষ্ট পরিমাণ গ্রেনে ভরপর, এমনকি স্ক্রিনে বুম মাইক ও ক্যামেরার উপস্থিতিও বিদ্যমান। অর্থাৎ আদালতের বিচারের ঘটনাকে যে রেকর্ড করা হচ্ছে, তা অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্তভাবে বুঝিয়ে দেন কিয়ারোস্তামি। অর্থাৎ, আদপে ছবিটিকে দেখে মনে হয় তা একটি ডকু-ফিকশন, কিছু অংশ সরাসরি রেকর্ড করা, বাকিটা পরে ঘটনাক্রম সাজাতে স্ক্রিপ্ট তৈরি করে শুট করা। মজার বিষয়, সারা পৃথিবী, এমনকি কিয়ারোস্তামির ছেলে আহমাদ কিয়ারোস্তামিও এটাই জেনে এসেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে আমেরিকান সিনেমা সমালোচক গডফ্রে চেশারের সাথে পরিচালকের কথোপকথন ও চেশারের লেখাপত্রের মাধ্যমে জানা যায়, বিচারের দৃশ্যকে দেখে আপাতভাবে সত্য ঘটনাকে ক্যামেরা দিয়ে রেকর্ড করা মনে হলেও সেটি আসলে স্ক্রিপ্টটেড। সাবজিয়ানের আসল বিচারের পর সকল চরিত্রকে তাদের চরিত্র থেকেই অভিনয় করান কিয়ারোস্তামি। সাবজিয়ান বা অন্যদের বয়ান আসল ঘটনার অনুসারী এবং অবলম্বনকারী হলেও তা মূলত হয়ে পড়ে কিয়ারোস্তামির স্ক্রিপ্টের বয়ান। এই যে পর্দায় আদালতের দৃশ্য দেখে দর্শকের মনে হতে থাকে তারা আসল বিচার দেখছে, এই ভ্রম, এই ইলিউশান কিয়ারোস্তামি অত্যন্ত সুচারু ও বুদ্ধিদীপ্ত মুন্সিয়ানায় তৈরি করেন। প্রত্যেকে তাদের নিজ নিজ চরিত্রে অভিনয় করায় এই ইলিউশান হয়ে ওঠে আরো বিশ্বাসযোগ্য; কিয়ারোস্তামি সত্য এবং সত্যের পুনর্গঠনের সংজ্ঞাকে ঘেঁটে দিতে থাকেন ক্রমশ।

ক্লোজ-আপ

হোসেন সাবজিয়ান মিথ্যে মাখমালবাফ সাজেন। হোসেন সাবজিয়ান সে কথা স্বীকার করেন আদালতে। পরিচালক সেজে অভিজাত পরিবারের মানুষজনের থেকে যে সম্মান পেতে থাকেন তিনি, তা সারাজীবনেও কখনো পাননি। অর্থনৈতিকভাবে নীচুতলার মানুষের শোষণের সংজ্ঞা শুধুমাত্র অর্থনীতি দিয়েই নিয়ন্ত্রিত হয় না; বরং তারচেয়েও অনেক বেশি থাকে ক্ষমতার রাজনীতি। কম অর্থ উপার্জন, অর্থাৎ সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে কম ক্ষমতা। ক্ষমতার শোষণের এই নিম্নতলায় থাকা মানুষদের প্রতিনিধি হিসেবে সাবজিয়ান সামান্য অভিনয়ের দ্বারা ক্ষমতার উপরের সিঁড়িতে উঠতে পারেন। ক্ষমতার বর্বর বিভাজনের রাজনীতির যে বালির পাহাড়, তা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায় অভিজাত আহানখাহ পরিবারের নিম্নবিত্ত সাবজিয়ানকে মাখমালবাফ ভেবে খাতির করার মাধ্যমে। যে সাবজিয়ান জানেন, তিনি সাবজিয়ান হয়ে কখনো ওই সম্মান পেতে পারতেন না, তাই অভিনয়ের আশ্রয় নেওয়াই হয় সম্বল। তার সাথে মিশে যায় সাবজিয়ানের সিনেমাপ্রেম। যে পরিচালকের ছবি দেখে অনুপ্রাণিত হন সাবজিয়ান, তার ভূমিকায় নিজেকে কল্পনা করে এবং বিশ্বাসযোগ্য করে তুলে এক অদ্ভুত পরিতৃপ্তি পান তিনি। হোসেন সাবজিয়ান নিজ পরিচয়ে এই একই সিনেমাপ্রীতি ও সিনেমা বানানোর স্বপ্ন দেখলে যাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিতো অভিজাত সমাজ, সেই সাবজিয়ানই যখন পরিচালকের বেশে আসেন, তার সম্মান হয়ে পড়ে আকাশছোঁয়া। অভিজাত সম্প্রদায়ের মুখোশ খুলে পড়ে যায়; আভিজাত্যের অহংকার নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে খোলা আকাশের নিচে।

তাদের মধ্যে কী কথা
হলো, সেই একান্ত ব্যক্তিগত
বিষয়ে অকারণ কৌতূহল
রোধ করে কিয়ারোস্তামি
দর্শককে সাবজিয়ানের আত্মার
ছবি পড়তে উৎসাহী
করে তোলেন

ক্লোজ-আপ

ক্যামেরা ও শব্দের ব্যবহারের দ্বারা কিভাবে হোসেন সাবজিয়ানের মনন ধরতে চেয়েছেন পরিচালক– তার কিছু নিদর্শন দেওয়া যাক। কিয়ারোস্তামি যখন জেলবন্দী সাবজিয়ানের সাথে কথা বলতে আসেন, তখন ক্যামেরা তাদের দেখতে থাকে দূর থেকে। তাদের কথোপকথনের মাঝে অসংখ্য নয়েজ আসতে থাকে; দৃশ্যে তারা দুজন ছাড়াও দৃশ্যমান হন ডেস্কে বসা পুলিশ অফিসার। কিয়ারোস্তামির পিছনে বসানো হয় ক্যামেরা, তার পিঠ দেখতে পাই আমরা, আর দেখতে পাই সাবজিয়ানের মুখ। কথোপকথন মামুলি থেকে ক্রমশ গভীর হতে থাকে। সাবজিয়ান বলেন, বাহ্যিকভাবে তাকে মিথ্যুক জোচ্চোর মনে হলেও আদপে ফিল্ম ও শিল্পের প্রতি আকর্ষণই তাকে এই কাজ করতে চালনা করেছিল। ক্যামেরা ক্রমশ এগোতে থাকে, মিডশট ক্লোজ হতে হতে সাবজিয়ানের টাইট ক্লোজআপে স্থির হয়। পর্দাজুড়ে সাবজিয়ানের মুখ, তার প্রতিটি অভিব্যক্তি, ছবি নিয়ে দেখা স্বপ্ন, ছবি দেখে তৈরি হওয়া অনুপ্রেরণা ক্যামেরায় ধরা হয়ে যেতে থাকে। ক্যামেরার এই চলন যেন ক্রমশ সাবজিয়ানের আত্মাকে ধরে ফেলার চেষ্টা করে। ঘরের সামগ্রিক চিত্র নিয়ে শুরু হওয়া ক্যামেরার শট ক্রমশ সাবজিয়ানের মুখের ক্লোজআপ আরো টাইট ক্লোজআপ নিতে থাকে, সাবজিয়ানের মুখের অভিব্যক্তি দিয়ে তার মনন অনুসন্ধানের চেষ্টা করা হয়। ক্যামেরার ভাষা হয়ে পড়ে দরদী, ব্যক্তিগত। আবার ছবিটির শেষে যেখানে হোসেন সাবজিয়ানের সাথে তার স্বপ্নের মানুষ মাখমালবাফের দেখা হয়, ছবির শব্দগ্রহণকারী যন্ত্র গণ্ডগোল করতে থাকে। তাদের দুজনের কথোপকথন আংশিকভাবে শোনা যেতে যেতে একসময় আর শোনাই যায় না। হোসেন সাবজিয়ানের সবচেয়ে ব্যক্তিগত মুহূর্তের কথোপকথনকে না শুনতে দিয়ে তাকে আরো ব্যক্তিগত করে তোলেন পরিচালক। সাবজিয়ানকে বাইকের পেছনে বসিয়ে যখন রওনা দেন মাখমালবাফ, বেজে ওঠে এক রোমান্টিক মিউজিক। তাদের মধ্যে কী কথা হলো, সেই একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়ে অকারণ কৌতূহল রোধ করে কিয়ারোস্তামি দর্শককে সাবজিয়ানের আত্মার ছবি পড়তে উৎসাহী করে তোলেন। সাবজিয়ানের চরিত্রায়ণ হয়ে ওঠে ভীষণ মানবিক।

ক্লোজ-আপ

সমাজের চোখে সাবজিয়ান অপরাধী, কারণ সে অন্য একজন মানুষের ভূমিকায় অভিনয় করেছে; সাবজিয়ান অপরাধী, কারণ সে অন্য একটা মানুষ হয়ে ওঠতে চেয়েছে। সিনেমার চোখে সাবজিয়ান মানবিক; কারণ সে অন্য একজন মানুষের ভূমিকায় অভিনয় করেছে; সাবজিয়ান মানবিক, কারণ সে অন্য একটা মানুষ হয়ে ওঠতে চেয়েছে।

অভিনেতার চরিত্রে
অভিনয় করতে করতে
তিনি
নিজেই হয়ে ওঠলেন সিনেমা

সিনেমার পর্দা, যা কি-না ক্রমাগত এক সত্যের মায়া তৈরি করে। মিথ্যে মিথ্যে ঘটনা সাজিয়ে তাকে এমনভাবে দেখায় যা আদৌ কোনোদিন ঘটেনি বা যা শুধু ঘটছে ক্যামেরার জন্যই, বাস্তবে যাদের কোনো অস্তিত্ব নেই। অথচ দর্শকের কাছে সিনেমা এমনভাবে উপবেশনা করা হচ্ছে, যাতে দর্শক বিশ্বাস করছে সত্যিই তো ওই মেয়েটার কী কষ্ট, সত্যিই তো ওই ছেলেটার প্রেম ভেঙে গেল, সত্যিই তো লোকটার চাকরি পাওয়ার জন্য একটা সাইকেলের দরকার। ক্যামেরার মুন্সিয়ানায় বাস্তবিক আরো বাস্তবিক করে তোলা হচ্ছে সিনেমাকে, গল্পকে চরিত্রকে দর্শকমনে বিশ্বাসযোগ্য করানোর চেষ্টা চলছে। অথচ এই তৈরি করা বাস্তবের চিত্র আসলে বাস্তব নয়; বাস্তবের ইলিউশান মাত্র। যদিও এই ইলিউশানকে ব্রেশটীয় নিয়মে ভাঙার চেষ্টা করা হয়েছে বহু সিনেমায়, তবু প্রথাগত সিনেমার আদিপর্বের ইতিহাস এক বাস্তবিক হয়ে ওঠার মাধ্যমেই গড়ে উঠেছে। সিনেমার অভিনয় বাস্তব হয়ে ওঠার, সাবজিয়ানের অভিনয় সিনেমা হয়ে ওঠার। সাবজিয়ান একজন সিনেমাপ্রেমী; স্বপ্নে তিনি চিত্রপরিচালক হতে চেয়েছিলেন। চিত্রপরিচালকের অভিনয় করতে করতে তিনি আরেকজন চিত্রপরিচালকের অভিনেতা হয়ে ওঠলেন; অভিনেতার চরিত্রে অভিনয় করতে করতে তিনি নিজেই হয়ে ওঠলেন সিনেমা।

filmfree
ক্লোজ-আপ

কিয়ারোস্তামির মানবিক ছবি, না-মানবিক দিকগুলো সম্পর্কেও যথেষ্ট কৌতূহলী। ছবির মূল কেন্দ্রবিন্দু থেকে আপাত সংযোগহীন বিষয়গুলোও কিয়ারোস্তামির কাছে হয়ে ওঠে গুরুত্বপূর্ণ। তার আরেকটি ছবি উইন্ড উইল ক্যারি আস-এ যেমন বিস্তীর্ণ ক্ষেতের ওপর দিয়ে হাওয়ার চলন হয়ে ওঠে ছবির এক না-মানুষী চরিত্র, তেমন ক্লোজ-আপ-এ আকাশের বুক চিড়ে উড়ে যাওয়া জেটপ্লেন বা টিনের কৌটো ছবির চলনে যোগ করে এক নতুন মাত্রা। এই চিত্রায়ন ছবিটিতে না থাকলে ছবির মূল বিষয়বস্তু, দ্বান্দ্বিকতার পর্যালোচনায় বিশেষ ঘাটতি হতো না বটে; কিন্তু ছবিটির যথেষ্ট কিয়ারোস্তামীয় হয়ে ওঠায় ঘাটতি থেকে যেত। ময়লার স্তূপ থেকে গাড়ির ড্রাইভারের ফুল কুড়িয়ে নিতে গিয়ে গড়িয়ে পড়ে যায় টিনের ক্যান; ঢালু রাস্তা বেয়ে গড়াতেই থাকে; ক্যামেরা ড্রাইভারের কার্যকলাপ ছেড়ে ক্যানটিকে দেখতে এবং শুনতে থাকে শুধু। ক্যানটি যতক্ষণ না গড়াতে গড়াতে স্থির হয়ে যায়, ততক্ষণ পর্দায় ক্যানটিকে দেখা যায়; শোনা যায় তার গড়িয়ে যাওয়ার শব্দ। আপাত না-মানবিক শব্দ চিত্র ফ্রেমজুড়ে দেখাতে থাকেন কিয়ারোস্তামি; জীবনের না-মানবিক দিকগুলোর প্রতি আকর্ষিত হয়ে পড়ি আমরা, ফ্রেম ক্রমশ কবিতা হয়ে যায়।

এক হাতে সিনেমার বাস্তব-অবাস্তবের দ্বান্দ্বিকতা, অপর হাতে কবিতার ঝুলি সাজিয়ে ক্যামেরার পেছন থেকে মিটিমিটি হেসে কিয়ারোস্তামি আমাদের সবাইকে দেখতে থাকেন একমনে।

Print Friendly, PDF & Email
সিনেমা ও সাহিত্য প্রেমী; বর্তমানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচ্চিত্রবিদ্যা বিভাগের স্নাতকোত্তরের ছাত্রী; যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই তুলনামূলক সাহিত্যে স্নাতক ।। পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here