লিখেছেন । আকরাম খান
এই লেখাটি মূলত ওজুর চলচ্চিত্রের জগত ও উপাদান নিয়ে।
কাঠামো আর শৈলী নিয়ে পরবর্তী সময়ে আরেকটি লেখা লিখার ইচ্ছা আছে।
–আকরাম খান

জাপানি চলচ্চিত্রকার ইয়াসুজিরো ওজু ১২ই ডিসেম্বর ১৯০৩ সালে জাপানে জন্মগ্রহণ করেন। তার জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো তার চলচ্চিত্রের গল্পগুলোর মতোই নিচুতারে বাঁধা এবং অনাড়ম্বর : যেমন, স্কুলে স্বল্পস্থায়ী শিক্ষাগ্রহণ, চাকুরি নিয়ে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে ঢোকা, ১৯৩৪ সালে বাবার মৃত্যু, সরকারি হুকুমে যুদ্ধে যোগদান, ১৯৬২ সালে মায়ের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মায়ের সাথে বসবাস। ১৯৬৩ সালের ১২ই ডিসেম্বর ক্যান্সারে ওজুর জীবনবসান ঘটে।
জাপানিরা মূলত দু’ধরনের স্মৃতিকাতরতায় ভোগে। প্রথমত : গ্রামের বাড়ির প্রতি, যে গ্রাম বা মফস্বল ছেড়েই বর্তমান নাগরিকরা বড় জোর তিন-চার প্রজন্ম আগে শহরে এসেছে। দ্বিতীয়ত : সুরুচিপূর্ণ কসমোপলিটান শহর টোকিওর প্রতি। ওজু ছিলেন এই দ্বিতীয় সারির স্মৃতিকাতর লোকদের দলে। তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ছয়টি দশক কেটেছে জাপানের আধুনিকতার মধ্যে। তিনি যে সময়ে প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছেন, সে সময়ে জাপানে বড় আকারে শিল্পায়ন চলছে, ঘটেছে সামরিক উত্থান আর জাপান সবদিক থেকে গ্রহণ করেছে পাশ্চাত্যের নাগরিক সংস্কৃতি। ওজুর প্রজন্মই প্রথম দেখে, জাপানি পুরুষদের চুল ছোট করে ছাঁটা, স্যুট পরা, বেসবল খেলা; আর স্বাদ গ্রহণ করে গরুর মাংস ও পাউরুটির। ১৯১২ থেকে ১৯২৬-এর মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তনের আশাবাদ, মধ্যবিত্তের প্রসার, শিক্ষা ও তর্ক-বিতর্কের প্রতি আগ্রহের এই সময়কালকে ‘তাইশো’ যুগ নামে উল্লেখ করা হয়।
হোস্টেল থেকে যখন তাকে বের
করে দেওয়া হয়, তখন ‘সিনেমা
দেখার জন্য অনেক বেশি সময়
পাওয়া যাবে’– এই ভেবে
তিনি খুশিই হয়েছিলেন
১৯২৩-এর সেপ্টেম্বরে ওজু টোকিও শহরে থেকে প্রত্যক্ষ করেন ভয়াবহ কান্তো ভূমিকম্প। এই ভূমিকম্পে ১৩০ হাজার বিল্ডিংয়ের সাথে তার বাবার সার কারখানাও ধ্বসে পরে। ১৯৩০ সালে যুবক ওজু দেখতে পান জাপানে যুদ্ধভিত্তিক অর্থনীতি ও সামরিক শক্তির প্রসার জাপানিদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে দুঃখজনক নিয়তির দিকে। ওজু তার ৩৪তম জন্মদিন ‘নানকিঙে’ যুদ্ধরত অবস্থায় উদযাপন করেন এবং ১৯৪৫ সালের শরৎ ওজু হাজার হাজার জাপানি যুদ্ধবন্দীর সাথে কাটান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ওজু লক্ষ লক্ষ জাপানি নাগরিকের সাথে আমেরিকার অধীনে জীবন অতিবাহিত করেন আর উপভোগ করেন নতুন গড়ে ওঠা ভোগী সমাজের অর্থনীতি। তিনি যখন বার্ধ্যকে পা রাখেন, তখন জাপানে এমন একটি অর্থনৈতিক অবস্থা বিরাজ করছিল যে, প্রতি ৭ বছরে আয় দ্বিগুণ বেড়ে যাচ্ছিল।

অন্যান্য ‘তাইশো শহুরে’ যুবকের মতো ওজুও পাশ্চাত্য সংস্কৃতি পছন্দ করতেন– বিশেষ করে হলিউডের চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তার মতো ‘সিনেমা পাগল’ চলচ্চিত্রকার বিরল। শৈশবে স্কুল পালিয়ে হলিউডের সিনেমা দেখতেন। হোস্টেল থেকে যখন তাকে বের করে দেওয়া হয়, তখন ‘সিনেমা দেখার জন্য অনেক বেশি সময় পাওয়া যাবে’– এই ভেবে তিনি খুশিই হয়েছিলেন।
১৯৪৩ থেকে ১৯৪৫– ওজু সৈনিক হিসাবে সিঙ্গাপুরে ছিলেন। তখন তিনি তার চিত্রগ্রাহক আটসুটার সাথে হলিউডের সিটিজেন কেইন, দ্য গ্রেপস অব র্যাথ-এর মতো বিখ্যাত ধ্রূপদী চলচ্চিত্রের আটককৃত প্রিন্ট একাধিকবার দেখেছেন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ওজু তার পছন্দের চলচ্চিত্রগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিতে পারতেন।
১৯২০ থেকে ১৯৩০ সালে যখন ওজুর কর্মজীবন শুরু হয়, তখন জাপানি প্রতিষ্ঠানগুলোর বৈশিষ্ট্য ছিল–
- পিতৃতুল্য মালিক/ম্যানেজার
- হোয়াইট কলার অথবা বাবু চাকুরিজীবীদের কঠিন অনুশাসন ও কর্মশৃঙ্খলায় চাকরির নিরাপত্তা আর পদোন্নতির বিনিময়ে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠানে সঁপে দেওয়া
- কর্মস্থলের বাইরে কলিগদের সাথে মদ্যপান ও খাওয়া-দাওয়া করতে যাওয়া
- আড্ডা মারা, সিনেমা দেখা, গলফ খেলা ইত্যাদি।

‘শোচিকু স্টুডিও’তে ওজু প্রথমে সহকারী চিত্রগ্রাহক হিসাবে যোগদান করেন। পরবর্তীকালে তার সহকারী পরিচালক থেকে পরিচালকে পদোন্নতি ঘটে। ১৯২০ সালে ‘শোচিকু স্টুডিও’ খুবই কর্মতৎপর ও শক্তিশালী ছিল। ওজু তার সহকর্মীবৃন্দ অর্থাৎ চিত্রগ্রাহক, সম্পাদক, সমবয়সী পরিচালকদের সাথে একই বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। অন্য প্রতিষ্ঠানের চাকুরিজীবীদের মতো তারা কেবলমাত্র ঘড়ি ধরে প্রতিষ্ঠানের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতেন না; বরং শুটিংয়ের সেটে দীর্ঘসময় কাটানোর পর তারা মিলিত হতেন নতুন কোনো সিনেমা দেখার জন্য, চিত্রনাট্যের কোনো সমস্যা নিয়ে আলোচনার জন্য অথবা সিনেমার ‘লক্ষ্য’ নিয়ে বাক-বিতণ্ডার উদ্দেশ্যে। সবদিক থেকেই ‘শোচিকু স্টুডিও’ বাবু চাকুরিজীবী প্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রেষ্ঠ উদাহরণ ছিল। আর ‘তাইশো’ শিক্ষায় শিক্ষিত টোকিওবাসী হিসাবে, সৈনিক হিসাবে, পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রেমিক, সর্বোপরী প্রতিষ্ঠানের বিশ্বস্ত চাকুরীজীবী হিসাবে ওজু ছিলেন একজন সাধারণ জাপানি নাগরিকের আদর্শ উদাহরণ।
চরিত্রগুলোর অভিজ্ঞতা আরও
লক্ষ লক্ষ জাপানির যন্ত্রণার
অভিজ্ঞতার প্রতিধ্বনী তোলে
বলেই দৃশ্যগুলোকে এত
শক্তিশালী মনে হয়
কিন্তু ব্যতিক্রম ছাড়া তার চলচ্চিত্রে আমরা লক্ষ্য করি প্রধান চরিত্রগুলো ওজু যখন যে বয়সে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছেন, ঠিক সে বয়সী। প্রথমদিকের চলচ্চিত্রে দেখি কলেজ পাশ ও কমবয়সী অভিভাবকদের প্রাধান্য, তিরিশের চলচ্চিত্রে দেখি কর্মজীবী পিতামাতাদের। জীবন অভিজ্ঞতায় পরিপক্ক পুত্র ও কন্যাদের দেখা যায় চল্লিশ দশকের ছবিতে। যুদ্ধপরবর্তী চলচ্চিত্রে দেখি মধ্যবয়স্ক শিক্ষাবিদ ও ব্যবসায়ীদের। কিন্তু তারপরেও ওজুর চলচ্চিত্রগুলোকে কোনোভাবেই তার ব্যক্তিজীবনীমূলক বলা যাবে না। ওজুর ব্যক্তিজীবন ছবিতে গুরুত্বপূর্ণ শুধু সেই অংশেই, যেখানে তা বেশিরভাগ জাপানি নাগরিকের জীবনের মতো। যখন আমরা তার চরিত্রগুলোকে যুদ্ধপূর্ব বা যুদ্ধকালীন সময়ের স্মৃতিচারণ করতে দেখি, তখন সে দৃশ্যের প্রাণ শুধু ওজুর সে সময়ের অভিজ্ঞতার কারণেই প্রতিষ্ঠিত হয়– বিষয়টি তা নয়। বরং চরিত্রগুলোর অভিজ্ঞতা আরও লক্ষ লক্ষ জাপানির যন্ত্রণার অভিজ্ঞতার প্রতিধ্বনী তোলে বলেই দৃশ্যগুলোকে এত শক্তিশালী মনে হয়।

ওজুর চলচ্চিত্রগুলোর প্রেক্ষাপট তার সমকালীন আধুনিক শহুরে জাপানি জীবন। তার ছবিতে সে সময়ের জনপ্রিয় সংস্কৃতির ছায়া কোনো না কোনোভাবে আমরা দেখতে পাই। ১৯৪৫ সালের পূর্বে পাসিং ফেন্সি, ফ্লোটিং উইডস, অ্যান ইন. ইন টোকিও চলচ্চিত্রগুলোতে জীর্ণ বাড়ি, উঠোনে শুকোতে দেওয়া ছেঁড়া কাপড়ের সারি, সরুগলির দৃশ্য এবং এসব পাড়ায় বসবাস করা দরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষ আমাদের মনে করিয়ে দেয় ১৯৩০ সালের জাপানকে– যা ছিল দরিদ্র শ্রমজীবীদের উন্নয়নের সময়কাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের চলচ্চিত্রে আমরা ওজুর এই দরিদ্র শ্রেণিকেই দেখি স্বল্প পুঁজির ব্যবসায়ী হয়ে ওঠতে।
১৯২৮ থেকে ১৯৩৬ সালে ওজুকে দেখা যায় কালেজের ছাত্রদের নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে। চলচ্চিত্রগুলো হলিউডের আদর্শে নির্মিত হলেও সমকালীন জাপানের প্রসঙ্গে ভরা ছিল– যা দেখে সমসাময়িক দর্শকরা চরিত্রগুলোর সাথে একাত্মবোধ করত। ১৯২০ সালে জাপানে খুব দ্রুত স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সে সময় ষাট হাজারের বেশি ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করত। কলেজে ভর্তি পরীক্ষা খুব প্রতিযোগিতামূলক হলেও একবার ভর্তি হতে পারলে ডিগ্রি নিশ্চিত। কলেজ শিক্ষা ছিল খুবই পাশ্চাত্য ঘেঁষা। দুই ধরনের ছাত্রছাত্রীরা এসব কলেজে পড়ত। প্রথমত : যারা জীবনের ব্যাপারে সিরিয়াস, এবং পড়াশোনা করে যারা সমাজের পরিবর্তন করতে চায়; দ্বিতীয়ত, অরাজনৈতিক– কোনো রকম কলেজটা পার করে দিতে পারলে বাঁচে– এ ধরনের ছাত্ররা। ওজুর কলেজনির্ভর হাসির চলচ্চিত্রগুলোর চরিত্র ছিল মূলত এই দ্বিতীয় ধরনের।
ইয়াসিজুরো ওজুর প্রথমদিকের চলচ্চিত্রে কলেজ হচ্ছে দায়িত্বহীনতা, খেলাধুলা, প্রেম ও মদ্যপানের জায়গা। ছাত্রদের কেবল বিপদে পড়তে হয় পরীক্ষা এলে এবং তখন নকল করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। পরবর্তী চলচ্চিত্রগুলোতে আমরা কলেজ ও ইউনিভার্সিটি পাশ বেকার ও চাকুরিজীবী চরিত্রগুলোকে দেখি কলেজ জীবন নিয়ে স্মৃতিকাতরতায় ভুগতে। ১৯৩০ সালে ছাত্রদের নিয়ে যে জনপ্রিয় কল্পনা ছিল, তা হচ্ছে– ছাত্ররা উচ্ছৃঙ্খল, ভেগাবন্ড। প্রথমদিকে ওজু জাপানে গুন্ডা ও মাস্তানদের নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, যে চলচ্চিত্রগুলো দেখলে বোঝা যায় সেগুলো আমেরিকার গ্যাংস্টার চলচ্চিত্রের কিছুটা পরিবর্তিত রূপ; যদিও চরিত্রগুলোর শক্তিশালী ভিত্তি সমকালীন জাপানের চোর ও বাটপারদের জীবন। এই চলচ্চিত্রগুলো জাপানে সত্যিকারের নাইটক্লাবগুলোতে চিত্রায়িত হয়েছিল। ওজুর বেশিরভাগ চলচ্চিত্রে বেতনভোগী চাকুরিজীবীদের সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দুই দশকে জাপানে যে আধুনিকায়ন প্রক্রিয়া চলতে থাকে, তা থেকে জন্ম নেয় একটি নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণি। কলম পেঁষা এই শ্রেণিটাই ‘হোয়াইট কলার ওয়ার্কার’ নামে পরিচিত। টোকিওর জনপ্রিয় শহুরে সংস্কৃতি এই চাকুরিজীবী ও তাদের পরিবারকে ঘিরেই গড়ে ওঠতে থাকে। এদের মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যেই প্রকাশিত হয় নানা রকম পত্রিকা, নির্মিত হয় রেস্টুরেন্ট, কার, পার্ক, চলচ্চিত্র ইত্যাদি। টাইপিস্টের পদে দপ্তরে মহিলাকর্মীদের প্রাধান্য সেই সময় লক্ষণীয়। ওজুর ওয়াক চিয়ারফুলি ও ড্রাগনেট গার্ল চলচ্চিত্র দুটিতে আমরা এ ধরনের নারী চাকুরিজীবী চরিত্রদের দেখতে পাই।

১৯৩৭ সালের পূর্বের চলচ্চিত্রে তার চরিত্ররা বেকারত্বের ভয়ে তাড়িত ছিল, যা সেই সময়ের একটি নিষ্ঠুর বাস্তবতা। অসংখ্য চাকুরিজীবী চাকুরিচ্যূত হয় ১৯২৭ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত বিরাজ করা অর্থনৈতিক মন্দায়। ছাত্রদের অবস্থা ছিল সবচেয়ে করুন। মাত্র এক-তৃতীয়াংশ ছাত্র স্নাতক পাশ করে চাকুরি পেত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবকিছু দ্রুত পরিবর্তিত হতে থাকে। অর্থনৈতিকভাবে উন্নত নতুন জাপানে বেকারত্ব কোনো হুমকি নয়। নতুন জাপানে শিল্প-কারখানা প্রসারের সাথে সাথে বেতনভোগী শিক্ষিত চাকুরিজীবীরা আবার রাষ্ট্রের আদর্শ নাগরিকরূপে সর্বসাধারণের কাছে পরিগণিত হয়। জনপ্রিয় সংস্কৃতি আবার এদেরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। মহিলারা পার্ট-টাইম চাকুরিতে বিয়ের আগ পর্যন্ত পরিবারকে সাহায্যের উদ্দেশ্যে যোগ দেয়; ঐতিহ্যবাহী ফুল সাজানো ও চা বানানোর কোর্সে ভর্তি হয়। পুরুষ চাকুরিজীবীরা আত্মস্থ করে গলফ খেলা আর পুরো জাতি মেতে ওঠে ‘পাচিনকো’ নামের এক ধরনের জুয়া খেলায়– যা যুদ্ধের পরে আমেরিকা থেকে এসেছিল।
আধুনিক দালানকোঠা,
কোম্পানি, নির্মাণাধীন ব্রিজ,
ফ্যাক্টরির চিত্র তার ছবিতে
নতুন গড়ে ওঠতে থাকা
টোকিও শহরের
আভাস দেয়
ওজুর যুদ্ধের পরের চলচ্চিত্রগুলোর সময়কাল উপস্থাপনে এই বিষয়গুলিই প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। আধুনিক দালানকোঠা, কোম্পানি, নির্মাণাধীন ব্রিজ, ফ্যাক্টরির চিত্র তার ছবিতে নতুন গড়ে ওঠতে থাকা টোকিও শহরের আভাস দেয়। চাকুরিজীবী ছাড়াও যেসব মধ্যবিত্ত জনসাধারণকে তার চলচ্চিত্রে দেখা যায়, তারা হচ্ছে– ছোট ছোট বার, রেস্টুরেন্ট, সাকের দোকানের মালিকের মতো স্বপ্রণোদিত ব্যবসায়ী বা ঐতিহ্যগত পারিবারিক ব্যবসার মালিক, আর শিক্ষক, ডাক্তার ইত্যাদি।
আই. ই. পরিবার প্রথা জাপানের সমাজব্যবস্থার কেন্দ্রে প্রোথিত। এই প্রথা সামন্তদের সময় থেকে জাপানে প্রচলিত। ‘মেইজি’ যুগে আইন করে একে আরো শক্তভাবে কার্যকর করা হয়েছে। আই. ই. পরিবার প্রথা বড়ভাইকে তার ছোটভাই দ্বারা গঠিত অন্যান্য শাখা পরিবারগুলোর ওপর কর্তৃত্বের অধিকার দেয়। সেই সময় আই. এ. প্রথার আদর্শ ও জনসাধারণের জীবনযাপনের অভিজ্ঞতার মধ্যে ছিল বিস্তর ফারাক। মেইজি যুগের শেষের দিকে ভেঙে যাচ্ছিল একান্নবর্তী পরিবার। বেকারত্ব পরিবারে পিতার অবস্থানকে দুর্বল করে দিচ্ছিল। ছোট পরিবার গড়ে তোলার বাস্তবতা, গ্রাম থেকে শহরে আসা কনিষ্ঠ পুত্রের অর্থনৈতিকভাবে তার বড়ভাইদের চেয়ে বেশি উন্নত হওয়া এই প্রথাকে করেছিল আরও শিথিল।

১৯৫০ সালে যখন জাপানি নারীরা ভোটাধিকার পায়, আর আইন করে শাখা পরিবারদের ওপর মূল পরিবারের কর্তৃত্বের ক্ষমতা তুলে নেওয়া হয়, তখন জাপানি সমাজ ও পরিবারে পিতৃতান্ত্রিক পরিবার প্রথা প্রায় পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। আমেরিকার অধীন নতুন জাপানে অর্থনৈতিক উন্নয়নে পাশ্চাত্যের পরিবারের নমুনায় গড়ে ওঠে ছোট ব্যক্তিকেন্দ্রিক পরিবার। বিচ্ছিন্ন হয় এক প্রজন্মের আত্মীয়দের থেকে অন্য প্রজন্মের আত্মীয়রা, বন্ধ হয়ে যায় ঐতিহ্যগত পারিবারিক ব্যবসা বা পেশা। নারীরা সাবলম্বী হয়ে ওঠে, ঘরের বাইরে বের হয় অর্থ উপার্জনে। নগরের বাড়তে থাকা কর্মীরা কোম্পানির তৈরি তিন-চার রুমের ফ্ল্যাটবাড়িতে বসবাস করতে শুরু করে। কর্মীদের জন্য কোম্পানি অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, বাসস্থান ও অন্যান্য প্রয়োজন মেটানোর মাধ্যমে পরিবারে কর্তার ভূমিকা পালন করতে থাকল।
নারীর অধিকার বা বিবাহের
ক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব
পছন্দকেই মুক্তমনা
ও প্রগতিপন্থী
ওজু প্রাধান্য
দিয়েছেন
জাপানের এই নতুন অবস্থার ছাপ সবচেয়ে বেশি দেখা গিয়েছিল বিবাহ প্রথার ওপর। আই. ই. পরিবার প্রথা জীবিত রাখার একটি প্রধান উপায় ছিল পরিবারের ঠিক করে দেওয়া বিবাহ প্রথা; কিন্তু নতুন জাপানে এই রীতির বদলে প্রেমের বিয়ের হার অনেক বেড়ে যায়। জাপানে এই সামাজিক বদল শুধু রীতিনীতির সাধারণ পরিবর্তন ছিল না। তখনো বিমূর্ত আদর্শরূপে জনসাধারণের মনে আই. ই. প্রথা বেঁচে ছিল। পরিবারের ঠিক করে দেওয়া বিয়ে তখনো অনেক পরিবারের মধ্যে ছিল বেশি পছন্দের। বিশেষ করে অভিভাবকেরা তাদের কন্যাসন্তানদের প্রেম করে বিয়ের অনুমতি দেওয়ার ব্যাপারে অনাগ্রহী ছিল। ওজুর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পারিবারিক চলচ্চিত্রগুলোতে এসব বিষয়ই কাহিনীবিন্যাস ও সময়কাল নির্ধারণে প্রাসঙ্গিক হয়ে এসেছে। তার চলচ্চিত্রে জাপানি ঐতিহ্যের প্রতি জাপানিদের মৌলবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা দেখতে পাই। নারীর অধিকার বা বিবাহের ক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব পছন্দকেই মুক্তমনা ও প্রগতিপন্থী ওজু প্রাধান্য দিয়েছেন।

দ্য রেকর্ড অব অ্যা টিনামেন্ট জেন্টলম্যান
দ্য রেকর্ড অব অ্যা টিনামেন্ট জেন্টলম্যান চলচ্চিত্রটি দেখে ওজুর বন্ধুরা তাকে বলেছিলেন– চলচ্চিত্রে তিনি তার নিজস্ব স্টাইল প্রদর্শনের ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছেছেন। এ কথা শোনার পর থেকে ওজু এমন একটি বিষয় খুঁজে বের করেন, যার মধ্য দিয়ে তিনি তার স্টাইলকে আরও সূক্ষ্ম, নিখুঁত করে তুলেছিল। বিষয় হিসাবে তিনি বেছে নেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী জাপানের ‘শান্ত পারিবারিক জীবন’। ওজুর ৫৪টি চলচ্চিত্রের মধ্যে ৪৯টিরই ঘটনাস্থল টোকিও শহর। টোকিওর বাড়ি, অফিস, স্কুলের অভ্যন্তর ছাড়াও আমরা ওজুর চরিত্রদের দেখি বার, রেস্টুরেন্ট, পার্ক, রাস্তায় বিচরণ করতে– যেন টোকিও শহরের প্রতিটি দৃশ্য মুছে যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে ওজু এগুলোকে সেলুলয়েডে বন্দী করেছেন।
অতীতকে প্রতিবিম্বিত করার প্রক্রিয়া ও বর্তমানের ক্ষণস্থায়ীত্বকে স্বীকৃতিপ্রদান– এই দুটি ভাবনা ওজুর কাহিনীচিত্রে অন্যান্য উপাদানকে সাজিয়ে কাঠামো ও আঙ্গিক নির্মাণে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে।

ইয়াসুজিরো ওজুর ফিল্মোগ্রাফি
সোর্ড অব পেনিটেন্স [১৯২৭]
ড্রিমস অব ইয়ুথ [১৯২৮]
ওয়াইফ লস্ট [১৯২৮]
পাম্পকিন [১৯২৮]
অ্যা কাপল অন দ্য মুভ [১৯২৮]
বডি বিউটিফুল [১৯২৮]
ট্রিজার মাউন্টেন [১৯২৯]
স্টুডেন্ট রোমান্স : ডেজ অব ইয়ুথ [১৯২৯]
ফাইটিং ফ্রেন্ডস জাপানিজ স্টাইল [১৯২৯]
আই গ্রাজুয়েটেড, বাট… [১৯২৯]
দ্য লাইফ অব অ্যান অফিস ওয়ার্কার [১৯২৯]
অ্যা স্ট্রেটফরোয়ার্ড বয় [১৯২৯]
অ্যান ইন্ট্রুডাকশন টু ম্যারিজ [১৯৩০]
ওয়াক চিয়ারফুলি [১৯৩০]
আই ফ্লাঙ্কড, বাট… [১৯৩০]
দ্যাট নাইট’স ওয়াইফ [১৯৩০]
দ্য রিভেঞ্জফুল স্পিরিট অব ইরোস [১৯৩০]
দ্য লাক হুইচ টাচড দ্য লেগ [১৯৩০]
ইয়ং মিস [১৯৩০]
দ্য লেডি অ্যান্ড দ্য ব্রেড [১৯৩১]
বিউটি’স স্যরোস [১৯৩১]
টোকিও কোরাস [১৯৩১]
স্প্রিং কামস ফ্রম দ্য লেডিজ [১৯৩২]
আই ওয়াজ বর্ন, বাট… [১৯৩২]
হোয়ার নাউ আর দ্য ড্রিমস অব ইয়ুথ? [১৯৩২]
আনটিল দ্য ডে উই মিট অ্যাগেইন [১৯৩২]
ওম্যান অব টোকিও [১৯৩৩]
ড্রাগনেট গার্ল [১৯৩৩]
পাসিং ফেন্সি [১৯৩৩]
অ্যা মাদার শুড বি লাভড [১৯৩৪]
অ্যা স্টোরি অব ফ্লোটিং উইডস [১৯৩৪]
অ্যান ইনোসেন্ট মেইড [১৯৩৫]
অ্যান ইন. ইন টোকিও [১৯৩৫]
কলেজ ইজ অ্যা নাইস প্লেস [১৯৩৬]
কাগামাগি জিশি [১৯৩৬]
দ্য অনলি সন [১৯৩৬]
হোয়াট ডিড দ্য লেডি ফরগেট? [১৯৩৭]
ব্রাদারস অ্যান্ড সিস্টারস অব দ্য তোদা ফ্যামিলি [১৯৪১]
দেয়ার ওয়াজ অ্যা ফাদার [১৯৪২]
দ্য রেকর্ড অব অ্যা টিনামেন্ট জেন্টলম্যান [১৯৪৭]
অ্যা হ্যান ইন দ্য উইন্ড [১৯৪৮]
লেট স্প্রিং [১৯৪৯]
দ্য মুনেকেতা সিস্টারস [১৯৫০]
আর্লি সামার [১৯৫১]
দ্য ফ্লেভার অব গ্রিন টি ওভার রাইস [১৯৫২]
টোকিও স্টোরি [১৯৫৩]
আর্লি স্প্রিং [১৯৫৬]
টোকিও টুয়াইলাইট [১৯৫৭]
ইকুইনক্স ফ্লাওয়ার [১৯৫৮]
গুড মর্নিং [১৯৫৯]
ফ্লোটিং উইডস [১৯৫৯]
লেট অটাম [১৯৬০]
দ্য এন্ড অব সামার [১৯৬১]
অ্যান অটাম আফটারনুন [১৯৬২]
—–
সূত্র : উইকিপিডিয়া