সিনেমা: শিল্প এবং পুঁজি

651
kaanta

লিখেছেন  টোকন ঠাকুর


বির সুবিধা, কবিতা কোনোভাবেই পুঁজি কেন্দ্রিকতায় বিকশিত নয়। কবিও ততটা স্বাধীন। চিত্র, যদি সেটি হয় চিত্রকলা, চিত্রকরও অনেকটাই পুঁজির প্রতাপ এড়িয়ে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু যদি প্রসঙ্গ হয় সিনেমা, পুঁজিকে এড়িয়ে গিয়ে তো সিনেমাই হবে না। কারণ, সিনেমা নির্মাণের সঙ্গে অসংখ্য মানুষের শ্রম জড়িত, রুটিরোজি বেঁচে থাকা জড়িত। সিনেমা পুরোটাই টেকনোলজির ব্যবহার সাপেক্ষে নির্মিত। টেকনোলজির পেছনেও কাজ করছে পুঁজি। অর্থাৎ পুঁজিকে এড়িয়ে সিনেমা শিল্পের বিকাশ কল্পনা আশা করা মুশকিল। যদিও ইন্ডাস্ট্রি সিনেমার দূরত্বে দাঁড়িয়ে স্বাধীন সিনেমা নির্মাণের প্রচেষ্টাও অব্যাহত আছে। একটি স্বাধীন সিনেমা নির্মাণের পেছনেও যে অর্থ লগ্নি করতে হয়, শিল্পকলার আর কোনো মাধ্যমে শিল্পীকে এত বিনিয়োগ ভাবনা ভাবতে হয় না। তাই ভাল সিনেমা হওয়ার পথে পুঁজি যেমন প্রয়োজন, পুঁজি সংকটে পড়েও সিনেমা না হয়ে উঠার রেকর্ড আছে। প্রচলিত প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে নির্মিত সিনেমার জন্যে পুঁজি সংগ্রহ যথেষ্ট কঠিন ব্যাপার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পৃথিবীর খুব ভাল সিনেমাগুলো প্রচলিত প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের বাইরে দিয়েই হয়ে আসছে। হয়ত সেসব সিনেমায় জনপ্রিয় তারকার ব্যবহার নেই, প্রেক্ষাগৃহে পর্যাপ্ত প্রদর্শনী নেই, গণমাধ্যমে বিশেষ ফোকাস নেই, তাতেও কিন্তু স্বাধীন সিনেমার অহংকারে জৌলুসে ঘাটতি নেই।

kaanta
দৃশ্য । কাঁটা

আমি একটি সিনেমা করছি। সিনেমার নাম কাঁটা। আমার তেমন পুঁজি নেই। কিন্তু সিনেমা বানাবার তুমুল ইচ্ছে আছে। এই ইচ্ছেকেই পুঁজি করে কাঁটা সিনেমার তিন-চতুর্থাংশ শ্যুটিং এডিটিং সম্পন্ন করেছি। এখন তত্ত্ব কথার বিপরীতে সিনেমার বাস্তবতা যেটি, অর্থশিল্পের ঘাটতি পূরণ করে বাকি কাজ শেষ করে আনার জন্য ধ্যান মগ্ন আছি, দিনরাত পরিশ্রম করছি।


ছোট্ট বউটি ঘর থেকে
বেরিয়ে উঠোনের
কুয়োর পাড়
ঘেঁষে গিয়ে
দাঁড়াল
kaanta
শুটিং । কাঁটা

কাঁসার থালার মতো একটি চাঁদ– সেই চাঁদ উঁকি দিল কুয়োর জলের ভেতর। ছোট্ট বউটি ঘর থেকে বেরিয়ে উঠোনের কুয়োর পাড় ঘেঁষে গিয়ে দাঁড়াল। কুয়ো থেকে ডাক দিল চাঁদ কিম্বা কুয়োর জলে ভাসমান চাঁদকে ধরতে গেল স্বপ্নারানী দাস। বউকে উদ্ধার করতে চেয়ে স্বপ্নার স্বামী সুবোধচন্দ্র দাস লাফিয়ে পড়ল কুয়োর মধ্যে। পরদিন মহল্লার লোকেরা একজোড়া লাশ ওঠালো কুয়ো থেকে, পুলিশে সেই জোড়া লাশ নিয়ে গেল থানায়। এই হচ্ছে নির্মাণাধীন কাঁটা সিনেমার অংশ। এরকম আরো দুইজোড়া লাশ ওঠানো হবে কুয়ো থেকে। তাদেরও নাম সুবোধচন্দ্র দাস ও স্বপ্নারানী দাস। বারবার সুবোধ ও তার বউ স্বপ্না মরে মরে যায়, কাঁটায়। পিরিওডিক্যাল ছবি কাঁটার শ্যুটিং প্রায় ৭৫ ভাগ সম্পন্ন হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে আমরা কাঁটা টিমের মেম্বররা সবাই আছি পুরোনো ঢাকার নারিন্দায়। এ ছবির ৯৫ ভাগ লোকেশন ষাটের দশকের পুরোনো ঢাকা, যে সময়ের শহর প্রায় নেইই। সেট অনেকটাই ঠিকঠাক করে নিতে হচ্ছে, কারণ, নতুন নতুন বিল্ডিংয়ে ভরে গেছে ঢাকা শহর। পুরোনো বাড়িঘরদোর এখনো কিছু টিকে আছে বটে, কিন্তু শ্যুটিংয়ের জন্যে তা প্রায় উপযোগী নয়। ষাটের দশকের প্রপস-কস্টিউম জোগাড় করাও অনেকটা দুষ্প্রাপ্য যদিও আমরা সেটা করতে বাধ্য। ছবির পাত্রপাত্রী দু’শতাধিক। মূলত একটি মহল্লার মানুষের অসহায়ত্ব, আত্মগ্লানি ও বিভ্রান্তির গল্প কাঁটা। এখন শ্যুটিং চলছে। ৭৫ ভাগ শ্যুটিং সম্পন্ন হয়েছে, শ্যুটিং লোকেশনেই সম্পাদনার কাজ অব্যাহত রয়েছে।

kaanta
শুটিং । কাঁটা

সরকারি কোষ থেকে প্রাপ্ত ১০ লাখ
টাকার বিপরীতে আরও যে
৭৫ লাখ টাকা খরচ হয়ে
গেল, তা এসেছে দুয়েকজন
শুভাকাঙ্ক্ষী, অন লোকেশন
লোন ও আমার পারিবারিক ব্যবস্থাপনায়

কাঁটার গল্প শহীদুল জহিরের, চিত্রনাট্য আমার, নির্মাতা আমি। কিন্তু ছবির প্রযোজক কে? বলতেই হবে, কাঁটা প্রডিউসড্ বাই আওয়ার পিপল। সরকারের রাজস্ব থেকে কাঁটা নির্মাণের প্রথম অর্থ সাপোর্ট পেয়েছি। যদিও ঘোষিত সরকারি অনুদানের ৩৫ লক্ষ টাকার ১০ লক্ষ টাকা পেয়েছিলাম পাঁচ বছর আগে। এবং গতবছর অক্টোবর থেকে অক্টোবর ২০১৮ পর্যন্ত কাঁটার আনুষ্ঠানিক প্রি-প্রডাকশন ও প্রডাকশন ওয়ার্ক চলছে। ৭৫ ভাগ শ্যুটিং ও সম্পাদনা এগিয়ে নিতে নভেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত খরচ হয়ে গেছে প্রায় ৮৫ লাখ টাকা। সরকারি কোষ থেকে প্রাপ্ত ১০ লাখ টাকার বিপরীতে আরও যে ৭৫ লাখ টাকা খরচ হয়ে গেল, তা এসেছে দুয়েকজন শুভাকাঙ্ক্ষী, অন লোকেশন লোন ও আমার পারিবারিক ব্যবস্থাপনায়। ছবির শ্যুটিং আরও ২৫ ভাগ বাকি। এ মুর্হূতে প্রডাকশনের বাজেট শূন্যের কোঠায়। কিন্তু কাঁটা টিম এবং আমি বদ্ধপরিকর ছবির শতভাগ শ্যুটিং সম্পন্ন করার দায়বদ্ধতায়। এ পর্যায়ে কী করতে পারি?

kaanta
শুটিং । কাঁটা

উই আওয়ারস্ সিনেমা প্রতিষ্ঠানটি এগিয়ে এলো কাঁটার পাশে। এই প্রতিষ্ঠানের সংগঠক খন্দোকার মোঃ জাকির আমার দীর্ঘ দিনের পরিচিত, বিশ্বস্ত। জাকির নিজেও একজন তরুণ সিনেমা নির্মাতা। কামার আহমেদ সাইমন এর শুনতে কি পাও ছবির অনলাইন ডিস্ট্রিবিউটর হিসেবে কাজ শুরু করেছেন। এছাড়াও সিনেমার বিস্তার, নির্মাণ, ডিস্ট্রিবিউশন ইত্যাদি নিয়ে জাকিরের মাথায় নানারকম পরিকল্পনা কাজ করছে। কাঁটায় ক্রাউড ফান্ডিং নিয়ে বিস্তারিত আলাপ হলো কাঁটা টিম মেম্বরদের সঙ্গে। তিনদফা আলাপের পর কাঁটা টিম ও উই আওয়ারস্ সিনেমা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ক্রাউড ফান্ডিং নিয়ে চুক্তিনামা হয়। চুক্তি মোতাবেক উই আওয়ারস্ সিনেমার ওয়েবসাইটে কাঁটার ক্রাউড ফান্ডিং ক্যাম্পেইন শুরু হয়েছে মাত্র ২৫ দিনের জন্য। কারণ শ্যুটিং চলছে। অনেকটা রোগীকে ওটিতে রেখে ঔষুধ কিনতে যাওয়ার মতো। নির্মাতা হিসেবে আমার জন্য ব্যাপারটি তাই। কারণ কাঁটার দু’শোজন পাত্রপাত্রী ও ব্যাকগ্রাউন্ড টিম নিয়ে সক্রিয় থাকা একটি কঠিন প্রকল্প।


আমার বিশ্বাস, উপমহাদেশের
সাম্প্রদায়িক নৃশংসতার
দলিল কাঁটা নির্মাণে
দায়বদ্ধ মানুষ
সহায়তা
করবেন

আমার বিশ্বাস, উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক নৃশংসতার দলিল কাঁটা নির্মাণে দায়বদ্ধ মানুষ সহায়তা করবেন। সহায়তা বলতে আর্থিক সহায়তা। সহায়তার বিপরীতে কি থাকছে এই প্রশ্নের উত্তরে সবকিছু জানানো হয়েছে উই আওয়ারস-এর ওয়েবসাইট বেইস ক্রাউড ফান্ডিং ক্যাম্পেইনে। ৫০০ টাকা দিয়ে ক্রাউড ফান্ডিংয়ের মাধ্যমে কাঁটা নির্মাণে অংশগ্রহন করলে, তার বিপরীতে তিনি কি কি পাবেন তা যেমন জানানো আছে, তেমনি ১০০০, ৫০০০, ১০০০০ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত দিয়ে অংশগ্রহণ করে কি কি পাওয়া যাবে– সেটাও উল্লেখ আছে।

kaanta
দৃশ্য । কাঁটা

মনে রাখা দরকার, সরকারি অনুদান মানেই ছবিটির ফান্ড যুগিয়েছে এদেশের মানুষ। কিন্তু এও মনে রাখা দরকার, সরকারি টাকা নির্মাণ বাজেটের এক চতুর্থাংশ মাত্র। বাকি অর্থ আমাকে জোগাড় করতেই হবে, কেউ না কেউ আমাকে কাঁটা নির্মাণের বকেয়া অর্থ দানে এগিয়ে আসবেনই– এই বিশ্বাস আমি রাখি। ভালো একটি ছবি বানানোর দায়বদ্ধতা আমার এবং কাঁটা টিমের রয়েছে। ভালো কিছু নির্মাণের জন্য যে পরিশ্রম, ত্যাগ করতে হয়, তা আমরা করে যাচ্ছি। এই বাস্তবতায় আপনারা উই আওয়ারস সিনেমা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা অনুযায়ী নির্মাণাধীন কাঁটার পাশে দাঁড়াবেন, কাঁটা হয়ে উঠবে গণমানুষের ছবি– এ আমার চাওয়া। আমার যা চাওয়া, পাওয়া প্রয়োজন, কারও না কারও তা দেওয়া প্রয়োজন, এরকমটি ভাবি।

kaanta
প্রমোশনাল ফটো । কাঁটা

অতীত, বর্তমানের ভেতর দিয়ে ভবিষ্যতে প্রবিষ্ট হয়, কাঁটা ছবিতে ভবিষ্যত বর্তমানে ভেতর দিয়ে অতীতে অনুপ্রবিষ্ট হবে– এটি নির্মাণেই আমি এবং আমার টিম একটি গেরিলা জীবনযাপন করে যাচ্ছি নারিন্দায়, পুরোনো ঢাকায়।

Print Friendly, PDF & Email
কবি; আর্টিস্ট; ফিল্মমেকার।। ঢাকা, বাংলাদেশ।। ফিল্ম : ব্ল্যাকআউট [২০০৬]; রাজপুত্তুর [২০১৫]; কাঁটা [নির্মাণরত]।। কাব্যগ্রন্থ : অন্তরনগর ট্রেন ও অন্তরঙ্গ স্টেশন; দূরসম্পর্কের মেঘ; আয়ুর সিংহাসন; কবিতা কুটিরশিল্প; দুপুর আর দুপুর রইল না; নার্স, আমি ঘুমোইনি; কুরঙ্গগঞ্জন; টোকন ঠাকুরের কবিতা; তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না; আমি রিলেটিভ, মেসো; ভার্মিলিয়িন রেড; প্রেমের কবিতা; রাক্ষস@gmail.com; শিহরণসমগ্র; আমি পুরুষ মৌমাছি; ১ ফর্মা ভালোবাসা; নির্বাচিত ১০০ কবিতা।। গল্পগ্রন্থ : খশ্যেদ ও অন্যান্য চরিত্র; লিবিয়ান ভিসা; জ্যোতি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছিল; সুঁই ও ব্লেড।। উপন্যাস : চরৈবেতি; মধুযামিনী রে।। শিশুতোষ-গ্রন্থ : ফড়িঙের বোন; সব পাখিরাই পাখি না; মেঘলা দুপুর শীতের পুকুর; মি. টি. মি. অ অ্যান্ড মিসেস মেঘের গল্প; নিলডাউন; মমি।। ফিল্ম-প্রোডাকশন হাউস : ভার্মিলিয়ন রেড

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here