কুরোসাওয়ার আত্মজীবনী মূল শিরোনাম (ইংরেজি) : সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি মূল : আকিরা কুরোসাওয়া অনুবাদ: রুদ্র আরিফবাংলাদেশি সংস্করণ প্রকাশক: ঐতিহ্য প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৮ প্রচ্ছদ: দেওয়ান আতিকুর রহমান পৃষ্ঠাসংখ্যা : ৩০৪ মূল্য: ৫০০ টাকা
ভারতীয় সংস্করণ প্রকাশক: প্রতিভাস প্রকাশকাল: ২০১৮ মূল্য: ৫০০ রুপি
লিখেছেন । পান্থ বিহোস
অস্কারজয়ী জাপানি চলচ্চিত্র পরিচালক ও স্ক্রিপ্টরাইটার আকিরা কুরোসাওয়ার লেখা সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি ১৯৮১ সালের জুন মাসে প্রকাশ হলে চলচ্চিত্রমহলে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। একই বছর বইটি চলচ্চিত্র-গবেষক অডি বকের অনুবাদে ইংরেজিতে প্রকাশ পায়।
ইংরেজি থেকে বাংলায় বইটি অনুবাদ করেছেন চলচ্চিত্র-লেখক-গবেষক ও কবি রুদ্র আরিফ, কুরোসাওয়ার আত্মজীবনী নাম দিয়ে। শুরুতেই আমি বলব, এটি একটি অসাধারণ অনুবাদ বই। কেন, সে কথা এখানে বিস্তারিত লেখার চেষ্টা করা হবে।
আকিরা কুরোসাওয়া– তাকে বলা হয় মাস্টার ফিল্মমেকার। ১৯৯০ সালে তিনি পেয়েছেন একাডেমি পুরস্কার বা অস্কার। এই সম্মান তাকে দেওয়া হয়েছে তার সমগ্র চলচ্চিত্রকর্মের বিবেচনায়। অথচ এই তিনিও অস্কার প্রদান মঞ্চে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করে দিয়েছেন– তিনি এখনও চলচ্চিত্র ভালো করে বুঝেন না। কী অদ্ভুত না! তিনিই নির্মাণ করেছেন বিশ্ববিখ্যাত রশোমন, সেভেন সামুরাই, নো রিগ্রেটস ফর আওয়ার ইয়ুথ, সানশিরো সুগাতা, সেভেন সামুরাই ইত্যাদি চলচ্চিত্র।
বইটির ইংরেজি ভার্সন আগে পড়া ছিল। ফলে এই বাংলা অনুবাদটি পড়তে পড়তে আমি অসম্ভব আনন্দিত হয়ে পড়ছিলাম বারবার। এত সহজবোধ্যভাবে অনুবাদ সম্ভব– তা রুদ্রের এই বই না পড়লে জানা হতো না বোধহয়।
কুরোসাওয়ার আত্মজীবনী বইটি আমার কাছে নিছকই একটি আত্মজীবনীমূলক বই মনে হয়নি। এতে উঠে এসেছে সমসাময়িক, অতীত এবং ভবিষ্যতের কথাও। বিশেষ করে জাপান এবং প্রাসঙ্গিক সমাজব্যবস্থা– এ বিষয়গুলো অত্যন্ত যত্নের সাথে তুলে আনা হয়েছে এই বইয়ে।

শিক্ষাব্যবস্থা, চলচ্চিত্র নির্মাণ, স্ক্রিপ্টরাইটিং থেকে শুরু করে সিনেমা প্রদর্শনী, সিনেমাপ্রতিষ্ঠান, লেখক-প্রকাশক-পরিচালক-প্রযোজক, প্রায় প্রত্যেকটি বিষয়ই আকিরা কুরোসাওয়া যত্নের সাথে তুলে এনেছেন তার বইটিতে। আমরা যদি বইটিকে বড় দাগে কয়েকটি ভাগে দেখি, তাহলে এভাবে হতে পারে–
• চলচ্চিত্রের বাইরের জগৎ
• চলচ্চিত্রের শুরু
• ব্যক্তিগত জগৎ
• চলচ্চিত্রের জগৎ
একটা ব্যাপার লক্ষ্যণীয়, কুরোসাওয়া একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কখনোই ভাবেননি তিনি চলচ্চিত্র পরিচালক হবেন। চেয়েছিলেন বিরাট বড় একজন চিত্রশিল্পী হবেন। বিশ্বের বড় বড় শিল্পীদের আঁকা তাকে প্রচণ্ডভাবে টানত। জীবিকা নির্বাহ করতেও চেয়েছিলেন এই আঁকাআঁকির ওপর নির্ভর করেই। বড়ভাইয়ের প্রভাবও ছিল যথেষ্ট। বাবার ভূমিকা তো ছিলই। তবে আকিরার ভাষায়, মায়ের অবস্থান ছিল সবচেয়ে উপরে। তবে সেটা ছিল খুব সূক্ষ্মভাবে, দৃঢ়ভাবে। আকিরার মা ছিলেন একজন দৃঢ়চেতা মহিয়সী মহিলা।
কিন্তু জীবন চালাতে গিয়ে কুরোসাওয়া যখন চাকরি খুঁজতে ব্যস্ত, তখনই পত্রিকায় একটা বিজ্ঞাপন দেখে প্রথমবারের মতো চলচ্চিত্রের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। আকিরার ভাষ্যে, সেটা অবশ্য চলচ্চিত্রের প্রতি টান থেকে নয়, বরং চাকরির প্রয়োজনেই।যদিও তিন ধাপ বাছাইপর্ব– প্রাথমিক পরীক্ষা, লিখিত পরীক্ষা এবং মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চাকরিতে প্রবেশ করেও, আকিরা প্রথমে হতাশ হয়ে গিয়েছিলেন চলচ্চিত্রের নির্মাণ ব্যবস্থা দেখে। চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছিলেন, যতক্ষণ না তিনি সেই সময়ের বিখ্যাত পরিচালক ইয়ামা সানের দেখা পেয়েছিলেন। আকিরার স্বীকারোক্তিতে আসে– ইয়ামা সান-ই তার চলচ্চিত্রগুরু। তিনিই আকিরাকে চলচ্চিত্রের আসল পাঠ দিয়েছিলেন। যদিও ইয়ামা সান বলতেন– “আমি কেবল আকিরাকে শিখিয়েছি, কীভাবে ড্রিঙ্ক করতে হয় সুন্দরভাবে।”
তো ‘চলচ্চিত্রের বাইরে জগৎ’ বলতে আমি বুঝিয়েছি, যখন আকিরা পিসিএল [ফটো ক্যামিকেল ল্যাব] প্রতিষ্ঠানে সহকারি পরিচালক হিসেবে যোগ দেননি। অর্থাৎ ২৪ বছর বয়স পর্যন্ত আকিরা নিজেকে ঐ জগতের বাসিন্দা বলে ভাবেননি। এই সময়ে তিনি আঁকিয়ে হওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন। সর্বহারা পত্রিকায় কাজ করেছেন। বাউণ্ডুলে হয়ে ঘুরে বেরিয়েছেন। বেকার জীবন কাটিয়েছেন।
…
সিনেমা-হলে ট্রাজেডি
সিন দেখে যিনি
হাউমাউ করে
কাঁদতেন
...
তারও আগে একেবারে জন্মলগ্ন থেকে শুরু করে [আকিরার ভাষায়– “ওয়াশটাবে ন্যাংটো ছিলাম আমি।”) সেই ২৪ বছর সময় পর্যন্ত আমরা আকিরাকে দেখি চলচ্চিত্রের বাইরে জগতের একজন হিসেবে। যেখানে তিনি জাপানের পরিবার, সমাজ, স্কুল, অর্থনীতিসহ আরও অনেক বিষয় তুলে এনেছেন। আকিরা নিজেকে ছোটবেলায় ‘ছিচকাঁদুনে’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন বারবারই। সিনেমা-হলে ট্রাজেডি সিন দেখে যিনি হাউমাউ করে কাঁদতেন। স্কুলের পড়া শিখে, শিক্ষক-ছাত্রদের সাথে মিশতে না পেরে কান্নাকাটি করতেন। শারীরিকভাবে ছিলেন খুবই দুর্বল। মানসিকভাবে আরও ভঙ্গুর। অথচ এই আকিরাই নিজেকে এমনভাবে গড়ে তুলেন যে, সকালবেলা স্কুলে যাওয়ার আগে টানা এক ঘণ্টা ২০ মিনিট হেঁটে তিনি শিক্ষকের কাছে পড়তে যেতেন; আবার মন্দিরে প্রার্থনা সেরে সেই এক ঘণ্টা ২০ মিনিট হেঁটে বাসায় ফিরতেন। কী অদ্ভুত না!
এ রকম লেখাগুলোই বইটিকে অন্য রকম এক মর্যাদায় আসীন করেছে। যেখানে আমরা শুধু চলচ্চিত্র বিষয়েই জানতে পারি না, রয়েছে আরও আরও বিষয়। নিজেকে উদ্বুদ্ধ করে তোলার, নিজেকে আরও শক্তিশালী হিসেবে গড়ে তোলার সামগ্রিক রসদ রয়েছে বইটার মধ্যে। সেই দিক বিবেচনায়, শুধু চলচ্চিত্রপ্রেমী পাঠকরাই যে এই বই পড়ে উপকৃত হবেন, তা নয়। সামগ্রিক পাঠকের জন্যই বইটা তাই হয়ে উঠেছে অবশ্যপাঠ্য।
…
পরিচালক, সম্পাদক এবং সহকারি
পরিচালকের বিষয়গুলো খুব
সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে বর্ণনা
করেছেন আকিরা
কুরোসাওয়া
তার এই
বইয়ে
…
তারপর পিসিএলের মাধ্যমে আকিরা যখন ক্যারিয়ার শুরু করেন, সেই জীবনটা হয়ে উঠেছে আরেকটু অন্য রকম। একেবারেই আলাদা এক জগৎ। সেটা আবার দুইভাবে বিভক্ত করা যায়। সহকারি পরিচালক আর পরিচালক হিসেবে কাজ করার সময়কাল। দুটি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রতিজন চলচ্চিত্রনির্মাতা এবং প্রাসঙ্গিক জড়িত ব্যক্তিদের বইয়ের এই অংশটা অবশ্যপাঠ্য হওয়া উচিত। বিশেষ করে পরিচালক, সম্পাদক এবং সহকারি পরিচালকের বিষয়গুলো খুব সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে বর্ণনা করেছেন আকিরা কুরোসাওয়া তার এই বইয়ে।

উল্লেখ্য, আকিরা কুরোসাওয়া বিদেশি কোনো ভাষা জানতেন না। জাপানি ভাষা-ই ছিল তার একমাত্র ভাষা। এমনকি অস্কার অনুষ্ঠানেও তার স্বাগতবক্তব্য ছিল জাপানি ভাষায়। সেটি দোভাষী অনুবাদ করে ইংরেজিতে শুনিয়েছেন উপস্থিত শ্রোতাদের। যে কারণে এ কথা বলা, তো এই আকিরা নিজের এই বই জাপানি ভাষায় লিখেছেন। সেখান থেকে ইংরেজি হয়েছে। তারপর সেটা বাংলায় অনুবাদ করেছেন রুদ্র আরিফ। উল্লেখ করার বিষয় হলো, অনুবাদটা এত প্রাঞ্জল আর ঝরঝরে হয়েছে, এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলা আসলে সম্ভব নয়, কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক তেমনই। যদিও বইয়ের বিষয়বস্তু গুরুত্বের দিক বিবেচনায় একই প্যারা বা পৃষ্ঠা বারবার পড়তে হয়। পড়ে আনন্দ পাওয়া সম্ভব। খেয়াল করুন, কিভাবে আকিরা তাঁর লেখায় হাস্যরস তৈরি করেছেন এবং সেটা সঠিকভাবে অনুবাদ হয়েছে :
‘আজকে সকালে আমি সূর্যপূজা করছিলাম। আমার চোখের সামনে, প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে একটা গুটানো তোশক উড়ে এলো। দেখি, তোশকের মাঝখানে মোড়ানো অবস্থায় উড়ে এলেন আমার প্রতিবেশী ভদ্রলোকটিও। বুঝলেন তো, বাসা পরিষ্কার করার সময় তার বউটি সাক্ষাৎ পাষাণ হয়ে ওঠেন!’ এ কথার জবাবে আরেকজন বলে উঠলেন, ‘বা; আমি বরং বলব বউটি অনেক দয়ালু। তার স্বামী যেন ব্যথা না পান, সে জন্যই তো তাকে মুড়িয়ে দিয়েছিলেন বেচারী!’
এ রকম মজার করে অনুবাদ করতে পারাটা অবশ্যই একটা বড় যোগ্যতার ব্যাপার। অনুবাদ যখন সাহিত্যমানে ভরপুর হয়, সেটা অনায়াসেই সুখপাঠ্য হয়ে ওঠে। আমার বিবেচনায় রুদ্রর এই অনুবাদটা সফল একটা সাহিত্যমাননির্ভর অনুবাদ।
কিংবা ছোটবেলায় পরীক্ষার হলে ঘটে যাওয়া এই ঘটনাটি আকিরা কুরোসাওয়া কতটা রসবোধের সাথে উপস্থাপন করেছেন, সেটা দেখে অবাক হয়ে যাবেন। সত্যিই অসম্ভব আর অসাধারণ রসবোধ আকিরার। আর সেটা অনুবাদ যখন হয়েছে সর্বোতভাবে, তো পাঠের স্বাদ বেড়ে গেছে আরও কয়েকগুণ :
পরীক্ষার কোনো প্রশ্ন নিয়ে কোনো ছাত্রের মধ্যে উদ্বেগ ফুটে উঠলে, মিস্টার ইওয়ামাৎসু সেই ছাত্রের কাছে গিয়ে, কাঁধে হাত রাখতেন। তারপরের ঘটনা তো তার জন্য চিরন্তন : মিস্টার ইওয়ামাৎসু বলতেন, ‘কী হলো, তুমি পারছ না এটা? শোনো, এটা এভাবে হবে’– তিনি পুরোদস্তুর মগ্ন হয়ে যেতেন সাহায্য করতে। তারপর তিনি বলতেন, ‘এখনো বুঝতে পারলে না? বেকুব কোথাকার!’ এরপর তিনি ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে গিয়ে, পুরো উত্তরটি লিখে দিয়ে বলতেন, ‘এখন তো বুঝতে পেরেছ, নাকি?’ তার এ রকম সযত্ন ব্যাখ্যার পর, নিশ্চিতভাবেই, জগতের সবচেয়ে নির্বোধ ছাত্রটির পক্ষেও উত্তরটি পাওয়া হয়ে যেত। অঙ্কে আমি বরাবরই খারাপ, তবে মিস্টার ইওয়ামাৎসু পরীক্ষার প্রক্টর হিসেবে দায়িত্ব পেলে, সেবার একশোতে একশোই পেতাম!
চলচ্চিত্র শুরু করার ব্যাপারে আকিরা তার বইয়ে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্নরকম লিখেছেন। সেখান থেকে কয়েকটি পয়েন্ট মার্ক করা হলো :
সিনেমার প্রতি নিজের বাবার মনোভাব আমাকে আজকের এ অবস্থানে নিজেকে দাঁড় করানোর পেছনে অনুরাগ ও প্রেরণা জুগিয়েছে।
•
১৯৩৫ সালের কোনো একদিন, পত্রিকা পড়ছিলাম, একটি শ্রেণিভুক্ত বিজ্ঞাপনে চোখ আটকে গেল আমার। পি.সি.এল. [যদিও সবসময় এ নামেই ডাকা হতো, তবে এর পুরো নামটি ছিল– ফটো কেমিক্যাল ল্যাবরেটরি] ফিল্ম স্টুডিওতে অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর পদে নিয়োগ দেওয়া হবে। সেই মুহূর্তটির আগ পর্যন্ত, কখনোই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে ঢোকার কথা ভাবিনি আমি। তবে তখন বিজ্ঞাপনটি চোখে পড়তেই, এ ব্যাপারে আচমকা আগ্রহ জন্মাল। বিজ্ঞাপনে লেখা ছিল, চাকরি প্রার্থীদের প্রথম টেস্টটি হবে কম্পোজিশন লেখা। সেই নিবন্ধটির থিম হবে– জাপানি সিনেমার ভিত্তিগত ত্রুটিগুলোর ওপর। প্রার্থীকে ত্রুটিগুলোর উদাহরণ লিখে, সেগুলো সংশোধনের উপায়ও লিখতে হবে।
•
যাই হোক, সে বয়সে সিনেমার সঙ্গে আমার এই সম্পর্কের অবশ্য পরবর্তীকালে আমার ফিল্মমেকার হয়ে ওঠার কোনো যোগসূত্র রয়েছে বলে আমি মনে করি না।

সিনেমায় কাজ করা নিয়ে আকিরা কুরোসাওয়া নিজের অভিজ্ঞতা অসম্ভব সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। যেগুলো একজন সিনেমাবোদ্ধা কিংবা একজন পরিচালক বা সহকারি পরিচালক– তথা সিনেমার সাথে জড়িত প্রায় প্রত্যেকটি মানুষের জন্যই অত্যাবশ্যকীয়। কেন, তার কয়েকটা উদাহরণ টানলেই বিষয়টা আরও সুন্দরভাবে বুঝানো সম্ভব। চলুন দেখা যাক :
এই স্মৃতিগুলোই আমাকে পরবর্তী সময়ে শক খাওয়ার মুহূর্তগুলোকে সিনেমায় ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করেছে।
•
কোমিয়োজি লোকেশনে আমাদের শুটিং যখন শেষ হলো, এই মঠাধ্যক্ষের কাছে হাজির হলাম আমি, তাকে শ্রদ্ধা জানাতে। তিনি প্রবল গাম্ভীর্য নিয়ে আমার দিকে তাকালেন, আর ভীষণ গভীর অনুভূতি দিয়ে বললেন, ‘সত্যি বলতে কি, আপনি যখন মন্দিরের গাছপালা এমনভাবে কেটে ফেলছিলেন– যেন এগুলো আপনারই সম্পদ, আমরা তখন ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়েছি। তবে নিজের কাজের প্রতি এ রকম আন্তরিক উদ্দীপনা দেখিয়ে আপনি শেষ পর্যন্ত আমাদের মন জিতে নিয়েছেন। ‘দর্শককে ভালো কিছু দেখানো’– আপনার সকল কর্মশক্তির ফোকাস ছিল এটিই। নিজেকে কাজের মধ্যে বিলীন করে দিয়েছেন আপনি। আপনাকে দেখার আগ পর্যন্ত আমার ধারণাই ছিল না– সিনেমা বানানো এ রকম একটি স্বচ্ছ-স্ফটিক কর্মপ্রচেষ্টা হতে পারে। আমার মনটা একেবারেই গভীর থেকে ভরে গেছে।
•
ওয়ান ওয়ান্ডারফুল সানডে মুক্তির বেশ কিছুদিন পর আমি একটি পোস্টকার্ড পেয়েছিলাম, তাতে লেখা : ‘ওয়ান ওয়ান্ডারফুল সানডে ফিল্মটি যখন শেষ হলো, সিনেমা-হলে জ্বলে ওঠল আলো। সব দর্শক উঠে দাঁড়ালেন, বের হবেন বলে। কিন্তু সেখানে তখনো একজন বুড়োলোক বসে থেকে, ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন।…’ চিঠিটি পড়ে নিজেকে আমি খুঁজে পেলাম উচ্ছ্বাসে চিৎকাররত অবস্থায়।
•
ফিল্ম প্রোডাকশন প্রক্রিয়ায় প্রত্যেকটি দিক যদি জানা না থাকে, আপনার পক্ষে ফিল্মমেকার হওয়া সম্ভব নয়। একজন ফিল্মমেকার তো একজন ফ্রন্ট-লাইন কমান্ডিং অফিসারের মতোই। কাজটির প্রত্যেকটি শাখা-প্রশাখা সম্পর্কে তার জ্ঞান থাকা আবশ্যক। যদি তিনি প্রত্যেকটি বিভাগকে কমান্ড করতে না পারেন, তাহলে পুরো কাজটি কমান্ড করতে পারবেন না।
•
তরুণরা যদি প্রশিক্ষিত না হন এবং উন্নত আত্মার পাত্রটি পরিপূর্ণ করার মতো খাবার না পান, বয়স বাড়ার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া তো নিয়েই যাবে শক্তিক্ষয়ের পথের দিকে। যে কোনো কর্মক্ষেত্রের বেলায়ই এ কথা সত্য।
•
টেলিভিশনকে যারা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির শত্রু হিসেবে গণ্য করেন, তারা স্রেফ সিনেমার একটি অগভীর বোঝাপড়ার রোগে ভুগছেন।
এই তো গেলো আরও একটা দিক। অন্যভাবে, চলচ্চিত্রের বাইরে গিয়ে, আকিরা তাঁর লেখায় বারবার কিছু অভিজ্ঞতার কথা বর্ণণা করেছেন। সেগুলোকে সিদ্ধান্ত হিসেবেও উল্লেখ করা যায়। অর্থাৎ জীবন সম্পর্কে আকিরার সিদ্ধান্ত। সেই বিষয়গুলো প্রকৃতই অভিজ্ঞতালব্ধ ব্যাপার থেকে বেরিয়ে এসেছে, তা পাঠ করামাত্র বুঝা সম্ভব। আর প্রাণবন্ত অনুবাদের ফলে বিষয়গুলোর গুরুত্ব বেড়ে গিয়েছে আরও কয়েকগুণ। চলুন দেখা যাক আকিরার কয়েকটি সিদ্ধান্ত ধরনের কথা, কী বলেছেন তিনি?
বস্তুতপক্ষে, যখন কোনো মানবপ্রাণী আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে, তখন সে নির্বোধ হয়ে ওঠে।
•
আপনি যখন নিজের কাজ সৃষ্টিতে নিয়োজিত, তখন অন্য কাউকে সাহায্য করার সময়কার চেয়ে সেটি একেবারেই আলাদা হয়ে ধরা দেবে।
•
সময়ের বলি হওয়া কোনো অপদার্থ আমলার চেয়ে বিপজ্জনক আর কিছুই হতে পারে না।
•
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো– আপনি যখন এডিট করবেন, তখন নিজের কাজের প্রতি নিরপেক্ষ মনোভাব প্রকাশের বুদ্ধিমত্তা আপনার ভেতর থাকা আবশ্যক।
•
জীবন যে বেদনা বয়ে আনে– সেটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতেই আমি এক সবল ব্যক্তিত্বের মুখোশটি পরে থাকি; অন্যদিকে, জীবনের বয়ে আনা বেদনাকে লালন করতেই দুর্বল মানুষের মুখোশ পরে থাকে উয়েকুসা।
•
স্ক্রিনপ্লে লেখার প্রচুর অভিজ্ঞতা থেকে, আমি অবশ্য একটি জিনিস শিখে গিয়েছিলাম : এ রকম অন্ধকারাচ্ছন্নতা ও নৈরাশ্যের মুখোমুখি হলে, জেন সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা– বোধিধর্মের কৌশল আয়ত্ব করা। নিজের চলার পথে কোনো দেয়াল দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে তিনি সেটির দিকে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকতেন, নিজের পা একেবারেই কর্মশক্তিহীন হয়ে পড়ার আগপর্যন্ত, কোনো একটা রাস্তা খুলে যাওয়ার অপেক্ষায়।
•
কোনো ফালতু লোক যদি কোনোকিছুকে ফালতু বলে থাকে, তাহলে প্রমাণ হয়ে যায়, সেটি আদৌ ফালতু নয়; আর কোনো বোরিং লোক যদি কোনো কিছুকে বোরিং বলে থাকে, তাহলে প্রমাণ হয়ে যায়, সেটি আসলে ইন্টারেস্টিং কাজ।
•
এরপর থেকে আমি নানা ধরনের মানুষকে পর্যবেক্ষণ করেছি– টাকার জন্য খুন করা বা খুন হয়ে যাওয়া প্রবঞ্চক মানুষ, জোচ্চুর…। এরা সবাই দেখতে ঠিক স্বাভাবিক মানুষদের মতোই। ফলে এ ব্যাপারে আমি দ্বিধান্বিত। বস্তুতপক্ষে, ‘স্বাভাবিক’ মানুষের চেয়েও এই মানুষগুলোর চেহারা বেশি সুন্দর; আর তারা বেশি সুন্দর সুন্দর কথা বলে। ফলে এ সব ব্যাপারে আরও বেশি দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ি আমি।
•
মানুষ আদতে যা, তা বলা তার জন্য বস্তুতপক্ষে ভীষণ কঠিন হয়ে পড়ে।
•
মানুষ নিজের সম্পর্কে নিজের কাছেই সৎ হতে পারে না। অলঙ্কার শোভিত না করে নিজেদের সম্পর্কে বলতে পারে না তারা। এই স্ক্রিপ্টটি এ রকম মানুষদেরই ফুটিয়ে তুলেছে– যে মানুষেরা সত্যিকারঅর্থে যে রকম, তার চেয়ে ভালো রূপে নিজেদের ব্যাখ্যা করার মিথ্যের আশ্রয় না নিয়ে জীবন কাটাতে পারে না। এটিও এও দেখায়, কবরে যাওয়ার আগে মিথ্যেবাদিতার চাটুকারিতার এই পাপাচারী প্রয়োজনটি তাদের দরকার পড়ে; এমনকি মরে যাওয়া চরিত্রটিও কোনো মাধ্যমের সহায়তায় জীবিতের সঙ্গে কথোপকথনেও নিজের এ রকম মিথ্যেকে ছেড়ে আসতে পারে না। অহমিকা এমনই এক পাপ, যেটি মানুষ তার জন্মলগ্ন থেকেই ধারন করে আসছে; ফলে এ থেকে মুক্ত হতে পারাটাই সবচেয়ে কঠিন বিষয়। এই ফিল্মটি এমনই এক আজব পিকচার স্ক্রল, যেটি অহমিকার মাধ্যমে নিজেকে উন্মুক্ত ও প্রদর্শন করেছে।
•
আতঙ্কগ্রস্ত মানুষমাত্রই অন্ধকারের দানবদের সমতুল্য।
•
মনুষ্য স্বভাবের মধ্যে, আতঙ্ক থেকে মানুষের বেরিয়ে আসার বিষয়টিই আসলে আতঙ্কজনক ব্যাপার।
•
তবে যে কাজটি আপনার ভালোলাগবে না, সেটিকে নিশ্চয়ই ভালোবাসতেও পারবেন না আপনি?
•
মানুষের সব প্রচেষ্টাই শেষ পর্যন্ত কবরের ওপর করা নৃত্যের মতো অসার।
•
লোকটি আমাকে বলেছিলেন, ‘এ রকম এক খুপড়ি ঘরে জীবন কাটানোর আর নোংরা খাবার খাওয়ার মধ্যে ইন্টারেস্টিং কী-ই-বা থাকতে পারে– তা ভেবে হয়তো তোমার অবাক লাগবে। দেখো, আমি বলি কি, স্রেফ বেঁচে থাকাটাই তো ইন্টারেস্টিং এক ব্যাপার।’
•
জগতের যে প্রান্তেই যাই না কেন, যদিও আমি কোনো বিদেশি ভাষায় কথা বলতে পারি না, তবু সেটিকে আমার ‘বিদেশ’ বলে মনে হয় না। আমি মনে করি, সারা দুনিয়াটাই আমার দেশ। সবাই যদি এভাবে ভাবতে পারত, তাহলে মানুষ বুঝতে পারত, এইসব আন্তর্জাতিক সংঘাত কী যে হাস্যকর জিনিস; আর তারা পারত এ সবের শেষ টানতে।
•
‘তুমি যদি আতঙ্ক-জাগানিয়া কোনো কিছু দেখে চোখ বন্ধ করো, তাহলে ঘুমের মধ্যেও আতঙ্কে ভুগবে। যদি তুমি সবকিছু সোজা চোখে দেখো, তাহলে তাতে ভয় পাওয়ার কিছুই নেই।’
আকিরা ছিলেন একজন সফল স্ক্রিপ্টরাইটার। একসময় শুধু স্ক্রিপ্ট লিখেও জীবিকা নির্বাহ করেছেন তিনি। সহকারি পরিচালক হিসেবে কাজ করার সময়ও প্রতিদিন তিনি স্ক্রিপ্ট লিখতেন দুইপাতা-তিনিপাতা করে। কারণ তার গুরু ইয়ামা-সান তাকে বলেছিলেন : “যদি ফিল্মমেকার হতে চাও, তোমাকে আগে স্ক্রিপ্ট লিখতে হবে।’ তাই আকিরা সবসময়ই লেখালেখিকে প্রচণ্ড গুরুত্ব দিতেন। সমসাময়িক থেকে শুরু করে পুরাতন লেখকদের লেখা পড়তেন। আকিরার বেশিরভাগ স্ক্রিপ্টই উপন্যাস বা গল্প থেকে তৈরি করা হয়েছে।
আকিরা মনে করতেন, চমৎকার একটি স্ক্রিপ্ট না হলে কখনোই সেটি দিয়ে ভালো একটি চলচ্চিত্র হতে পারে না। তাই তিনি স্ক্রিপ্টে অনেক অনেক সময় দিতেন। স্ক্রিপ্টের লেখার ভিজ্যুয়ালাইজেশনটা চোখের সামনে না দেখা পর্যন্ত তিনি সেটা নিয়ে শুটিং করতে সেটে যেতেন না। এই ব্যাপারটাও তিনি রপ্ত করেছেন গুরু ইয়ামা-সানের কাছ থেকেই। মূলত ইয়ামা-সানের সান্নিধ্যেই কুরোসাওয়া সত্যিকার অর্থে সিনেমা জগতে আসেন। তিনি প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন পিসিএল তথা চলচ্চিত্র জগতের ক্যারিয়ার। কিন্তু তার সহকর্মীদের অনুরোধে পিসিএলে চাকরি জীবনের দ্বিতীয় এসাইনমেন্ট নেন এবং আকিরার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। আকিরার ভাষায় ব্যাপারটা এরকম :
তাদের কথা আমি শুনেছি; দ্বিতীয় অ্যাসাইনমেন্টটি গ্রহণ করেছি, এবং সেটি করেছি ইয়ামা-সানের সঙ্গে। তারা ঠিকই বলেছিলেন। সেখানে আমি শিখেছি– সিনেমা বহু ধরনের হয়, এবং ফিল্মমেকারও বহু ধরনেরই।
তা যাইহোক, আমরা বলছিলাম, আকিরার লেখালেখি নিয়ে। লেখালেখি নিয়ে আকিরার আরও দুয়েকটা বক্তব্যের রেফারেন্স এখানে টানা যাক :
অনেকেই বলেন, আলতু-ফালতু লেখালেখিতে সময় নষ্ট করার মতো পর্যাপ্ত সময় একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টরের হাতে থাকে না। সারাদিনে আপনি হয়তো একপৃষ্ঠার মতো লেখারই সময় পাবেন, কিন্তু যদি এ কাজটি প্রতিদিন করেন, তাহলে বছর শেষে আপনার হাতে ৩৬৫ পৃষ্ঠার এক স্ক্রিপ্ট হয়ে যাবে। আমি এই লক্ষ্যেই শুরু করেছিলাম– প্রতিদিন অন্তত একপৃষ্ঠা করে লেখা।
•
উপন্যাস আর চিত্রনাট্য তো, বস্তুতপক্ষে, দুটি একেবারে দুই জিনিস। উপন্যাস লেখার সময় মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে যে স্বাধীনতা ভোগ করা যায়, কোনো ধরনের ন্যারেশনের ব্যবহার ছাড়াই চিত্রনাট্যে সেটি ফুটিয়ে তোলা ভীষণ দুরূহ ব্যাপার।
এই বিষয়গুলো লেখক, স্ক্রিপ্টরাইটার, পরিচালক এবং সিনেমার সাথে জড়িত সবারই কি জানা প্রয়োজন নয়? আমি তো মনে করি, অবশ্যই প্রয়োজন। লেখার জন্য আকিরা পড়েছেনও যথেষ্ট। তার দেওয়া তালিকা এ রকম :
আমি পড়েছি জাপানি সাহিত্যিক হিগুচি ইচিয়ো, কুনিকিদা দোপ্পো, নাৎসুমে সোসেকি; এবং রাশিয়ান সাহিত্যিক ইভান তুর্গেনেভের উপন্যাস।
•
তুর্গেনেভের লেখা একটি অনুচ্ছেদ আমি কতবার যে পড়েছি; সেটি ছিল দ্য রেন্দেজভুস [১৯০৭] উপন্যাসটির শুরুর দিকের একটি দৃশ্যের বর্ণনা : ‘অরণ্যের ভেতর বৃক্ষের পাতা ঝরার শব্দের চেয়ে ভালোভাবে অন্য কোনোকিছুর মাধ্যমে ঋতুবদল টের পাওয়া সম্ভব নয়।’
ব্যক্তিগত বিষয়ে আকিরা ছোটবেলার সময়টাকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশের পর ব্যক্তিগত জীবনকে খুব কমই টেনেছেন। বিশেষ করে নিজের অর্থনৈতিক অবস্থা, ঘর-সংসার-পরিবার বিষয়ে খুবই কম এসেছে বইয়ে। হয়তো আকিরা এগুলো পছন্দ করতেন না। কিংবা প্রয়োজনীয় মনে করেননি, তাই বলেননি হয়তো।

বিয়ের কথা এসেছে। তিনি নিজেই লিখেছেন। দ্য মোস্ট বিউটিফুল সিনেমার এক অভিনেত্রীকে বিয়ে করেছেন আকিরা কুরোসাওয়া। এক বন্ধু-শুভাকাঙ্ক্ষির পরামর্শে অভিনেত্রী ইয়োকো ইয়াগুচিকে বিয়ের প্রস্তাব করেন। যদিও সেই অভিনেত্রী সাথে সাথে রাজি হননি। বইয়ে ব্যাপারটা এসেছে এভাবে :
জবাব ছিল, সে ভেবে দেখবে এ ব্যাপারে। সবকিছু যেন সহজভাবে হয়ে যায়, এ কারণে আমার পক্ষ থেকে তার সঙ্গে মধ্যস্থতা করার জন্য আমারই খুবই ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুকে দায়িত্ব দিলাম।
আর স্ত্রীর সাথে পরিচয় এবং স্ত্রীর পরিচয় দিতে গিয়ে আকিরা লিখেছেন নিচের কথাগুলো :
পরবর্তীকালে যদিও আমি, এই প্রমীলা স্বেচ্ছাসেবী সৈন্যদলের অধিনায়িকার চরিত্রের অভিনেত্রী ইয়োকো ইয়াগুচিকে বিয়ে করেছি, তবে তখন সে ছিল স্রেফ অভিনেত্রীদের প্রতিনিধি, এবং তাদের পক্ষ নিয়ে আমার সঙ্গে হরহামেশাই তর্ক বাঁধাত। ভয়ানক একগুঁয়ে ও আপসহীন এক মানুষ ছিল সে। ফলে আমাদের দুজনের মধ্যে সংঘর্ষ বেঁধে যেত যথন-তখন। কেবল তাকাকো ইরিয়ের হস্তক্ষেপের মধ্য দিয়েই শান্তিপূর্ণ সমাধান ঘটত সেইসব লড়াইয়ের; যদিও কাজটি ইরিয়ের জন্য সহজ ছিল না মোটেও।
বিয়ের শুরুর সময়টা ছিলো কঠিন। বিশেষ করে যখন আকিরার স্ত্রী জানতে পারলেন, পরিচালক সাহেবের মাসিক বেতন তার নিজের চেয়েও কম। সেটা যারপরনাই হতাশাজনক হলেও, ইয়াগুচি নিজ অভিনয় ক্যারিয়ার জলাঞ্জলি দিয়ে, আঁকড়ে ধরেছিলেন আকিরার সংসারের হাল।
আমার স্ত্রী আর আমি আমাদের দাম্পত্য জীবন শুরু করার পর, তা আমার স্ত্রীর জন্য এক ধ্বংসাত্মক অভিজ্ঞতা বয়ে আনলো। বিয়ে করার কারণে অভিনেত্রী হিসেবে নিজের ক্যারিয়ার বিসর্জন দিলো সে। তবে যে বিষয়টি সে জানত না, তা হলো– আমার বেতন ছিল তার বেতনের তিনভাগের একভাগেরও কম। কোনো ফিল্ম ডিরেক্টরের বেতন যে এত কম হতে পারে– এ কথা সে স্বপ্নেও ভাবেনি আগে কখনো। আর আমাদের জীবন হয়ে ওঠল, ‘কোনো জ্বলন্ত ঘোড়ার গাড়িতে ভ্রমণ করার মতো’।
এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু, যাকে বিয়ের দায়িত্ব দিয়েছিলেন, তার চুগলখুরির কারণে আকিরার বিয়ে ভেস্তে যাচ্ছিল। কিন্তু এটার মধ্যস্থতা হয় আকিরার হবু শাশুড়ির মাধ্যমে। সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা মেয়েকে তিনি চমৎকার একটি কথা বলেছিলেন। যেটা আকিরা পরে স্ত্রীর কাছে জানতে পারেন। কথাগুলো সবক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আমরা আসলে কাকে বিশ্বাস করব? যে অন্যজনের নামে কুৎসা রটায়– তাকে, নাকি যার নামে কুৎসা রটানো হয়– তাকে?
নিজের মেয়েকে তিনি বলেছিলেন, ‘কার ওপর আস্থা রাখবে– যে লোকটি নিজের বন্ধুর নামে কুৎসা রটায়? নাকি নিজের নামেই কুৎসা রটানো লোকটিকে যে লোক বিশ্বাস করে?’
এরপর আর বিয়ে কিংবা ব্যক্তিগত জীবনের বিষয়ে আকিরা তেমন একটা মুখ খুলেননি। শুধু আমরা একবার দেখতে পাই, যখন আকিরা রশোমন-এর জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি পুরস্কার পান।
তবে সবিশেষ এসেছে ছোটবেলার কথা। এত বিস্তারিতভাবে আকিরা সেই সময়টা বর্ণনা করেছেন, যেন আমি ঠিক দেখতে পাচ্ছি সেই পাহাড়সারি, স্কুল, আকিরার বাড়ি, মন্দির– এসব। অদ্ভুত বর্ণনা আকিরার, আর বইয়ের অনুবাদও সেভাবেই যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে সহজ-সাবলীলভাবে করা হয়েছে। আকিরার ছোটবেলার কিছু ব্যাপার জানা যাক তার বইয়ের রেফারেন্স থেকেই :
প্রথম যখন শুরু করেছিলাম, বারের যতই কাছাকাছি পৌঁছেছি, বিদ্রূপহাসির স্বর ততই বাড়তে শুনেছিলাম; ফলে অবাস্তব কিছু একটা করে দেখানোর দরকার ছিলই আমার। এ ঘটনাটির কথা এখন ভাবতে গেলে, এখনো সত্যিকারঅর্থেই কিছু বুঝে ওঠতে পারি না। এ কি কোনো স্বপ্ন ছিল? যে বালকটি শারীরিক শিক্ষার ক্লাসে সবসময়ই হাসাহাসির পাত্র হতো, সে কি শেষ পর্যন্ত স্বপ্নেই তা সফল করে দেখিয়েছে?
•
বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর, কোনোখানে কোনো রকম না থেমেই, টানা হেঁটে, এক ঘণ্টা বিশ মিনিটের পথ পাড়ি দিয়ে আসতে হতো আমাকে।
•
হাস্যকর একটি ঘটনাও ঘটেছিল তখন। তারা আমাদের বলে দিয়েছিলেন, আমাদের বাড়ির কাছের নির্দিষ্ট একটি কূপ থেকে যেন পানি না খাই। এর কারণ, সেই কূপটির দেয়ালে সাদা চক দিয়ে আজব ধরনের কথা লেখা ছিল। তাদের ধারণা, এ কথাগুলো নিশ্চয়ই কোনো কোরিয়ান কোড– যার মাধ্যমে এই কূপের পানিতে বিষ মেশানোর ইঙ্গিত লেখা আছে। এ কথা শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। সত্য হলো এই যে, এই আজব ধরনের কথাগুলো ছিল আসলে আমারই নিজের লেখা হিজিবিজি। বড়দের এমনতর আচরণ দেখে, তখন কিছুই বলতে পারিনি; অবাক হয়ে ভেবেছি, কী করে এমন হয় মানুষ!
•
আমার ধারণা, এ সময়েই জীবনের প্রথম সিনেমা কিংবা ‘মোশন পিকচার’টি আমি দেখেছিলাম।

ভালো লাগেনি
ভালো লাগা বিষয়ের সাথে সাথে মন্দ লাগা বিষয়ও জড়িত। এতক্ষণ বইয়ের ভালো দিকগুলোই তুলে ধরা হয়েছে। কিংবা বলা যায় বইয়ের প্রয়োজনীয় অংশগুলো। কিন্তু অবাক হলেও সত্যি, এই বইয়ে মন্দ লাগা বিষয় তেমন চোখে পড়েনি বললেই হয়। বইয়ের কোয়ালিটি ভালো, ছাপা ভালো, অনুবাদ তো অবশ্যই-অবশ্যই ভালো। চোখে পড়েছে নাম্বারের সাহায্যে রেফারেন্স দেওয়ার বিষয়টি। বারবার বইয়ের পেছনে তাকাতে হয়েছে বিষয়টা আরও ক্লিয়ার হওয়ার জন্য। আমার মনে হয় এটা নাম্বারিং না করে ব্রাকেটেই ব্যাখ্যাটা লিখে দেওয়া যেত, যেমন করা হয়েছে সহকারি পরিচালক হিসেবে কাজে যোগ দেওয়ার সময় বেতনের মূল্যমান বুঝাতে অনুবাদক ব্রাকেটে বলে দিয়েছেন ‘এই সময়’ বলতে আসলে কোন সময় বুঝানো হয়েছে। কারণ এটা কোনো পিএইচডি’র থিসিস নয়। বইটা ফিকশন হিসেবেই পড়া হচ্ছে। সুতরাং এই বিষয়টা বিবেচ্য হতে পারত।
এছাড়া আর চোখে তেমন কিছু পড়েনি। ও-হ্যাঁ, আরেকটা বিষয় বিরক্তিকর মনে হয়েছে, সেটা হচ্ছে– বইয়ের জ্যাকেট কভার আলাদা থাকার বিষয়টা সত্যিই বিরক্তিকর। পড়ার সময় বারবার ফসকে যায়। এটা অবশ্য অনুবাদকের নয়, বিষয়টা বর্তায় প্রকাশকের ওপরেই। কিন্তু যেহেতু বই নিয়ে লিখছি তাই বিষয়টা উল্লেখ করা হলো।
বইয়ে ভুল?
এই বিষয়টা সত্যিই অসাধারণ ছিল। এতবড় একটা বই কিন্তু ভুল নেই বললেই হয়। যা দুয়েকটা চোখে পড়েছে, তা খুবই সাধারণ মানের। বড় কোনো ভুল নয়। কিন্তু যেহেতু ভুল হচ্ছে ভুল, তাই এখানে দুয়েকটা উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হলো। পরবর্তী মুদ্রণে এগুলো হয়তো ঠিক করা যেতে পারে। যেমন :
• এক জায়গায় অ্যাসিস্ট্যান্ট বানানটি অ্যাসিস্ট্যাস্ট হয়ে আছে। [পৃষ্ঠা : ১৭৩]
• আমরা ধারণা হবে আমার ধারণা। [পৃষ্ঠা : ২৬৩]
• হয়ে পেরেছিলাম হবে হয়ে পরেছিলাম। [পৃষ্ঠা : ২৫৪]
• অন্য অন্যকিছুর? একটি বাড়ত অন্য রয়েছে! [পৃষ্ঠা : ২৩২]
• এমননি হবে এমনকি। [পৃষ্ঠা : ২২৬]
• কহলটি হবে কলহটি [পৃষ্ঠা : ২২৪]
• ট্র্যাডেজির হবে ট্র্যাজেডির। [পৃষ্ঠা : ২১৭]
• এই প্রধান কুকুরটির কম্পমান পা দেখে, মনে খুব চোট পেয়েছিলাম— বাক্যটি এখানেই শেষ হবার কথা, অথচ এর শেষে করায় শব্দটি উটকোভাবে মুদ্রিত হয়ে অনর্থ করে তুলেছে! [পৃষ্ঠা : ৬৭]

সবিশেষ
সব শেষে বলতে হয়, বারবার পড়ার মতো একটি বই। অনুবাদ অসাধারণ। বিশেষ করে ভাষার ব্যবহার অসম্ভব ভালো লেগেছে। যাইহোক, ওভারঅল বইয়ের র্যাংকিং হিসেব করলে ৮.৫০ প্রাপ্তি আছে এই বইয়ের জন্য, ১০ থেকে।