সিক্রেট ব্যালট Ra'ye Makhfi স্ক্রিনরাইটার, এডিটর ও ফিল্মমেকার । বাবাক পায়ামি প্রডিউসার । মার্কো মুলার সিনেমাটোগ্রাফার । ফারজাদ জাদাত মিউজিক কম্পোজার । মাইকেল গ্যালাসো কাস্ট [ক্যারেক্টার] । নাসিম আবদি [নারী], সাইরাস আবিদি [সৈনিক] রানিংটাইম । ১০৫ মিনিট ভাষা । ফার্সি দেশ । ইরান, ইতালি, কানাডা, সুইজারল্যান্ড মুক্তি । ২০০১ অ্যাওয়ার্ড । ফিপ্রেস্কি অ্যাওয়ার্ড-- স্পেশাল মেনশন [লন্ডন ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল]
লিখেছেন । তানভীর পিয়াল
১৯১৫ সন, ডি. ডব্লিউ. গ্রিফিথ বানালেন বার্থ অব অ্যা নেশন। সেই থেকেই চলচ্চিত্রে রাজনীতি কিংবা রাজনৈতিক চলচ্চিত্রের যাত্রা শুরু। রাজনৈতিক ঘটনা, তত্ত্ব– এসব কিছুরই প্রয়োগ এবং প্রকাশ যে ফিল্মে, বিশেষত ফিচার ফিল্মে হতে পারে, তার নজির এরপর বহু নির্মাতাই দেখিয়ে গেছেন। ফিল্মে রাজনৈতিক ঘটনা নিয়ে কাজ করা সহজ হলেও, রাজনৈতিক তত্ত্বের প্রকাশ কিংবা প্রয়োগ ততটা সহজ নয়। তবে তা অসম্ভবও যে নয়, তাও নানা আঙ্গিকের সিনেমায় দেখিয়েছেন নির্মাতারা।
নিরীক্ষামূলক গণতন্ত্রের উপর একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের কথা ভেবেছিলেন প্রখ্যাত পরিচালক মোহসেন মাখমালবাফ। তার সেই আইডিয়ারই পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রিক রূপায়ন হলো– সিক্রেট ব্যালট। ২০০১ সালে মুক্তি পাওয়া ইরানি পরিচালক বাবাক পায়ামির এই সিনেমা ইরানি নিউ ওয়েভ আন্দোলনেরই এক উজ্জ্বল ফসল। ডকুফিকশন ঢঙের এই সিনেমায় সেই অর্থে নিটোল কোনো গল্প নেই, বরং ঘটনাই মুখ্য। দুর্গম এক দ্বীপে শহুরে এক নারী ইলেকশন এজেন্ট এবং তাকে সহায়তা করার জন্য নিয়োগ দেওয়া এক গোড়া সৈনিকের নির্বাচনের দিনে সম্মুখীন হওয়া ঘটনার সমষ্টিই মূলত সিক্রেট ব্যালট।
সিক্রেট ব্যালট-এর নাম থেকেই অনুমেয়, এই সিনেমা নির্বাচনকেন্দ্রিক কোনো ঘটনা নিয়ে নির্মিত। মূলত, গণতন্ত্রের অন্যতম ভিত্তি নির্বাচনী ব্যবস্থা এবং তাতে আস্থার দুর্বল ও নাজুক দিকগুলো চিহ্নিত করার মাধ্যমে সামগ্রিক ব্যবস্থাটিকেই এক অনাবিল নির্লিপ্ততায় বিদ্রূপ করেছেন পায়ামি, এই সিনেমায়। সিক্রেট ব্যালট আদতে এক চূড়ান্ত স্যাটায়ার।
…
পুরো সিনেমাতেই ইলেকশন
এজেন্টের জিপ খুঁজতে
থাকে ভোটারদের,
ভোটাররা
ইলেকশন
এজেন্টকে
…
জনবিরল এক মরুভূমির মাঝখানে, যেখানে সারা বছর একটাও গাড়ি চলে কি-না সন্দেহ, সেখানে পুঁতে রাখা আছে ট্রাফিক সিগনাল পোস্ট, যাতে জ্বলে আছে লাল বাতি! আবার ইলেকশন এজেন্ট ও তার সহযোগী সৈনিকটিকে বয়ে নিয়ে চলা আর্মি জিপটি দুপুর পর্যন্ত চলার পর আর স্টার্ট নেয় না। কেননা, একদিনে এতটা পথ পাড়ি দেওয়ার অভ্যাসই যে নেই! নির্বাচনের আগের রাতে বিমান থেকে প্যারাসুটের মাধ্যমে সৈনিকদের কাছে ছুঁড়ে দেওয়া হয় ব্যালট বক্স ও নির্দেশনাবাহী চিঠি। সিনেমার শেষে ইলেকশন এজেন্টকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য মরুভূমিতেই নেমে আসে বিমান! পুরো সিনেমাতেই ইলেকশন এজেন্টের জিপ খুঁজতে থাকে ভোটারদের, ভোটাররা ইলেকশন এজেন্টকে!

এইরকম নানা অসঙ্গতির ছবি পুরো সিনেমাজুড়েই। এই অসঙ্গতি মূলত প্রান্তিক অঞ্চলের সাথে মেট্রোপলিটন শ্রেণির, শাসকশ্রেণির যে মানসিক-স্থানিক দূরত্ব ও বিচ্ছিন্নতা, তারই প্রতীক। এই দূরত্ব এতটাই প্রকট যে, দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্ট, নির্বাচনের দিন-তারিখ কবে– সেই তথ্যই জানে না গ্রামবাসী, এমনকি জানে না সরকারিভাবে নিয়োগকৃত দুজন সৈন্যও! দিন-তারিখ দূরে থাক, ভোটারদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে নির্বাচনের দিনই ইলেকশন এজেন্টকে বোঝাতে হচ্ছে– ভোট কী এবং কেন! ১০ জন প্রার্থীর কাউকেই চেনে না সাধারণ ভোটাররা। অথচ এই নির্বাচনী ব্যবস্থাই, এই গণতন্ত্রই ঠিক করে দিচ্ছে– সাধারণ মানুষদের শাসনকর্তা হয়ে বসবে কে!
সিক্রেট ব্যালট-এ পরিচালক তার বক্তব্য চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন দুই প্রধান চরিত্রের দ্বান্দ্বিকতায়। একজন ইলেকশন এজেন্ট ও তার সহযোগী সৈন্যই এই চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্র। এরা বক্তব্যে ও আদর্শে দুই মেরুর। সৈনিকটি বিশ্বাস করে, বন্দুকের জোরেই সমাজে পরিপূর্ণ শৃঙ্খলা আনা সম্ভব; অন্যায় এবং অসঙ্গতি নিশ্চিহ্ন করার শ্রেষ্ঠ উপায় হলো অস্ত্র। অন্যদিকে ইলেকশন এজেন্টটি মনে করে, নমনীয়তা ও সৎপরামর্শই সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা আনতে পারে; বন্দুকের নল কখনো শান্তি আনে না, বরং বিরোধী শক্তির সৃষ্টি করে, অসহযোগিতা ও অনিশ্চয়তার জন্ম দেয়। সৈনিকটি সাধারণ পথচারীকেও সন্দেহ করে, আক্রমণ করে, অকারণে গুলি ছোঁড়ে। অস্ত্রবাহী এই সৈনিকটিকে সহ্য করতে পারে না সাধারণ গ্রামবাসী; আর্মি জিপ দেখলে দৌড় দেয় সাধারণ পথচারীটি। অন্যদিকে ইলেকশন এজেন্ট নিরস্ত্র করার চেষ্টা করে সৈনিকটিকে, অহিংসার বাণী শুনিয়ে।
চিন্তা ও মানসিকতার এই দূরত্ব কেবল এই দুই চরিত্রের নয়, পৃথিবীর সব মানুষের যোগাযোগ এবং সম্পর্কের দূরত্বের কারণ। আবার এই দুই চরিত্রের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়ন দেখা যায়, যখন দেখি এজেন্টটি হাত ধুতে সাহায্য করে সৈনিকটিকে, একসাথে দুপুরের খাবার খায়। সহযোগিতা, বিশ্বাস ও বন্ধুত্বই যে এখনো এই পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে রেখেছে, তাই মনে করিয়ে দেয় এই দৃশ্য।
…
যেন
গণতন্ত্র
নিজেই
হয়ে
আছে
নির্বাক
…
চলচ্চিত্রটির শেষ দৃশ্যে, বাবাক পায়ামি যেন চাললেন তার শেষ চাল। চলে যাবার আগে এজেন্টটি সৈনিকের ভোট যখন নেয়, দেখে, সৈনিকটি ব্যালটে কোনো প্রার্থীর নাম না লিখে, বরং ইলেকশন এজেন্টের নামটাই লিখে দিয়েছে। তা দেখে ইলেকশন এজেন্ট বলে, “আমি তো প্রার্থী না। আপনি যেকোনো দুজন প্রার্থী, যাদের চেনেন, তাদের নাম লিখবেন ব্যালটে।” সৈনিকটি তখন জবাব দেয়, “আমি তো আপনাকে ছাড়া আর কাউকে চিনি না।” এজেন্টের জবাব, “আপনি তো যাকে-তাকে ভোট দিতে পারেন না!” এবং এরপর দুজনই নীরব। যেন গণতন্ত্র নিজেই হয়ে আছে নির্বাক!

ইরানের গ্রামাঞ্চলে বিরাজমান ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার, সমাজ কাঠামোয় নারীর অবস্থান বয়ান করে এ চলচ্চিত্র। ইলেকশন এজেন্ট হিসেবে যে মেয়েটি আসে, তার চালচলন ও কথাবার্তায় যে স্বতঃস্ফূর্ততা দেখা যায়, চলচ্চিত্রে অন্য যেসব নারী চরিত্র দেখা যায়– তাদের মধ্যে তা পরিলক্ষিত হয় না। সীমান্তে চোরাচালান প্রতিরোধে নিয়োজিত যে সৈনিকটির ঘাড়ে দায়িত্ব পড়ে নির্বাচনে এজেন্টকে সহায়তা করার, সেও একজন নারীকে এজেন্ট হিসেবে মেনে নিতে পারে না। কারণ, তার পুরুষতান্ত্রিক চিন্তার ভিত্তিই হচ্ছে– নারী কেবল ঘরের কাজের জন্যই; অন্য কোনো কাজ নারীর জন্য নয়। সৈনিকটি যখন ভোট সংগ্রহে বের হয়, তখন তার পাশেই ব্যালট বাক্সটি রাখে, যেন নারী এজেন্ট তার পাশে বসতে না পারে। শুরু থেকেই ভোটগ্রহণে সৈনিকটির যাবতীয় অসহযোগিতার একমাত্র কারণও এটিই। এমনকি এক পর্যায়ে কথা প্রসঙ্গে সৈনিকটি এজেন্টটিকে ‘সিটি গার্ল’ বা ‘শহুরে মেয়ে’ বলে বিদ্রূপও করে ফেলে। এইসবই ঐ অঞ্চলে, সমাজে নারীর অবস্থান সম্পর্কে আমাদের জানিয়ে দেয়।
এক দৃশ্যে আমরা দেখি, ইলেকশন এজেন্টকে খুঁজতে থাকা ভোটারবাহী ট্রাকটি আসার পর সেখান থেকে যারা নামে, তারা প্রত্যেকেই নারী এবং বিবাহিতা। কিন্তু তাদের মধ্যে অনেকেরই বয়স ভোটারাধিকার প্রাপ্তির বয়স– ষোল থেকেও কম। তারা ভোট দিতে যখন পারছে না, তখন যে ট্রাক ড্রাইভার তাদেরকে নিয়ে আসে, সে প্রশ্ন করে বসে– বারো বছর বয়সে যদি মেয়েরা বিয়ে করতে পারে, তবে কেন ভোট দিতে পারবে না! এবং অবশ্যই ইলেকশন এজেন্ট এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি। অর্থাৎ, পৃথিবীর সব অনুন্নত অঞ্চলগুলোর মতো ওখানেও বিয়ের ক্ষেত্রে নারীদের বয়স কোনোভাবেই বিবেচনা আনা হয় না; নারীকে জোর করে ‘মহিলা’ বানিয়ে রাখা হয়– যা মূলত মধ্যযুগীয় সমাজব্যবস্থাকেই নির্দেশ করে। সোলার প্যানেলের এক কর্মচারীর কাছে ভোট চাইতে গেলে সে সাফ জানিয়ে দেয়, আল্লাহর প্রতিনিধি ছাড়া আর কাউকে সে ভোট দেবে না!
এ চলচ্চিত্রে যেসব চরিত্র আমাদের সামনে এসেছে, তারা শুধু ঐ অঞ্চলটির প্রতিনিধি নয়, বরং তারা ইরান এবং পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর অনুন্নত তথা গ্রামাঞ্চলের সমাজ ও রাজনীতির প্রতিনিধি। শহরে রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের সাথে সরাসরি জড়িত না হয়েও তারা নিয়ত-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি করে নিয়েছে জীবন নির্বাহের নিজস্ব রাজনীতি। ছোট একটি চরিত্র– ফেরিওয়ালার বক্তব্যই আমাদের এই সত্য জানান দেয়। ইলেকশন এজেন্ট যখন ফেরিওয়ালার কাছে তার পরিচয়পত্র খোঁজে, তখন সে জানায়, কেবল তার কাছ থেকে কিছু কিনলেই সে তার পরিচয়পত্র দেখাবে। ইলেকশন এজেন্ট তখন ভোট সংগ্রহের তাগিদে তার কাছ থেকে একটি পুতুল কেনে। কিন্তু ইলেকশন এজেন্ট তার পরিচয়পত্র খুলে আবিস্কার করে, সে ইরানের নাগরিকই নয়!
…
প্রতিটি চরিত্রই
নিজ নিজ
কাজের প্রতি
পরিপূর্ণ সৎ
ও
দায়িত্বশীল
…
সিক্রেট ব্যালট-এ মানবিক যে ইতিবাচক দিকটি খুঁজে পাই, তা হলো– প্রতিটি চরিত্রই নিজ নিজ কাজের প্রতি পরিপূর্ণ সৎ ও দায়িত্বশীল। প্রত্যেকে আত্মায় ও অস্তিত্বে আপন কাজে নিয়োজিত– যা ছোট একটি চরিত্র– সোলার প্যানেলের টেকনিশিয়ানের কার্যক্রমে স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। সোলার প্যানেলে টেকনিশিয়ানের দায়িত্ব হলো, ঐ প্রজেক্ট যারা দেখতে আসবে, তাদের সোলার প্যানেলের কার্যকারিতা সম্পর্কে জানানো এবং সোলার হিটারে বানানো চা খাওয়ানো। ইলেকশন এজেন্ট যখন তাকে ভোটের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বোঝাচ্ছে, তখনও টেকনিশিয়ানটি নিজের মতো করে সোলার হিটারে চায়ের পানি বসাতে বসাতে বলেই যাচ্ছে বহুবার বলতে বলতে মুখস্ত হয়ে যাওয়া সোলার প্যানেলের কাজের বর্ণনা। অন্যদিকে ইলেকশন এজেন্টও সারাদিন ধরে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ভোট সংগ্রহের চেষ্টা চালায়, এমনকি ভোট সংগ্রহের জন্য কবরস্থান ও সমুদ্রে নোঙররত জেলে নৌকাতেও পৌঁছে যায়। কিন্তু দিনশেষে বেশি ভোট সংগ্রহ করতে না পারার হতাশা নিয়ে সমুদ্র তীরে অপেক্ষা করতে থাকে নৌকার জন্য। দায়িত্বের সাথে তার এই যে একাত্মতা, এর ফলেই দিনশেষে ক্লান্তিকে ছাপিয়ে তার মধ্যে কাজ করে হতাশা। ব্যাপারটি প্রকাশ পায় সে চলে যাবার আগ মুহূর্তে সৈনিকটি ভোট দেওয়ার ইচ্ছাপ্রকাশ করলে তার মধ্যে সঞ্চার হওয়া কর্মচঞ্চলতায়।

পরিচালক বাবাক পায়ামি সিক্রেট ব্যালট চিত্রায়নে তার নৈসর্গিক চেতনাকে স্থান দিলেও বাস্তবতাবোধ থেকে সরে যাননি। পারস্যের কবিতা ও সংস্কৃতি তাকে উৎসাহিত যেমন করেছে, তেমনই তাকে উৎসাহিত করে সমকালীন জীবন ও বাস্তবতা। স্টাইল ও প্রেক্ষাপট বিচারে এই চলচ্চিত্র ইরানি, কিন্তু চেতনায় নিঃসন্দেহে আন্তর্জাতিক। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি বিশ্ববাসীর যে আস্থা, তা আসলে জনসাধারণকে কতটা সম্পৃক্ত করতে পারে রাষ্ট্রযন্ত্রের সাথে, তার দিকেই পায়ামি আঙুল তুলেছেন। হয়তো গণতন্ত্রই হতে পারে রাষ্ট্রে জনগণের অংশগ্রহণের অন্যতম মাধ্যম, হয়তো না; হয়তো অন্য কোনো ব্যবস্থা এসে যাবে সময়ের সাথে সাথে। এর উত্তর আমরা জানি না; যেমন উত্তর দেয়নি সিক্রেট ব্যালটও।
প্রথম প্রকাশ । জুম ইন । ফিল্ম ম্যাগাজিন । প্রথম সংখ্যা । ২০১২