লিখেছেন । টোকন ঠাকুর
সিনেমা একটি রহস্যকলা। হল ভর্তি দর্শক চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে একটি শাদা পর্দার দিকে, হলের গেইট বন্ধ হয়ে যায়, সব আলো নিভে আসে, দর্শক দেখতে পায়– শাদা পর্দার ওপরে সচল ছবি ভেসে উঠছে, শব্দ ভেসে আসছে, একটি গল্প ফুঁটে উঠছে। গল্পের মধ্যে অনেক মানুষ, গল্পের পেছনেও অনেক মানুষ। সিনেমা বহু মানুষের গল্প। পুঁজি-পাট্টা, টেকনোলোজির সমর্থন সাপেক্ষে সিনেমা একদল মানুষের শ্রম, ভালোবাসা, প্রতিশ্রুতি ও প্রত্যয়ের গল্প। আল্টিমেটলি সিনেমা এক নির্মাতার গল্প। নির্মাতার স্বপ্ন, পরিশ্রম, নির্ঘুম রাত্রির সৌধ কিংবা একটু খোলা গলায় বললে সিনেমা একজন মানুষের জীবনবাজির গল্প। মানুষটিকে মানুষের চেয়ে অধিক কিছু হয়ে উঠতে হয়ই। মানুষটিকে ঈশ্বরের দায়ভার নিতে হয়। তারপর দর্শকের সামনে হলের মধ্যে পর্দায় উপস্থিত থেকে প্রমাণ করতে হয়, হয়েছে, কি হয়নি, বা কতখানি পারা গেছে?

বাজার ব্যবস্থাপনার বাইরে দাঁড়িয়ে সিনেমা নির্মাণ খুব কঠিন একটি কাজ। বাজার ব্যবস্থাপনার বাইরে সিনেমা পরিবেশনায়ও ততোধিক কঠিন কাজ। বাংলাদেশের সিনেমা নির্মাণ হয়, হচ্ছে, হবে। বেশিরভাগই বাজারি হোটেলের তরকারির ঝোল অর্থাৎ গৎবাঁধা সেই একই গল্প এবং দর্শকও তাদের সেই একই। জীবনকে নব নব আলো-অন্ধকারে ধরা বা ধরে দেখানোর দায়িত্বটি কখনওই নেবে না বাজারি ফিল্ম। যদিও সিনেমার ‘মেইনস্ট্রিম’ বলা হয়ে থাকে বাজারি সিনেমাকেই। কিন্তু স্বাধীন পুঁজিতে স্বাধীন সিনেমাই, এক কথায় ভালো সিনেমার চেষ্টা, সব দেশেই। স্বাধীন সিনেমা চর্চা একটা ঝুঁকিও বটে। সে ঝুঁকিও কেউ কেউ নিতে ভালোবাসে। সিনে-জার্নালগুলো তাদের নাম দিয়েছে ইনডিপেন্ডেন্ট ফিল্মমেকার বা স্বাধীন নির্মাতা। তরুণ নির্মাতা অন্ত আজাদ তার প্রথম ছবি আহত ফুলের গল্প নির্মাণের মধ্য দিয়ে নিজেকে স্বাধীন নির্মাতার সারিতে দাঁড় করালেন। ছবির শ্যুটিং হয়েছিল অন্ত আজাদের নিজের বাড়ি, গ্রাম, এলাকায়। সেটি পঁচাগড় জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলার ভেতরের কোনো এক দুর্গম অঞ্চলে। সেখানে আগে কখনও সিনেমার ক্যামেরা পৌঁছেনি, স্থানীয় মানুষ কখনও শ্যুটিং দেখেনি। এমনকি সেখানে নেই কোনো সিনেমা-হলও। সেখানেই জন্ম-বেড়ে ওঠার পর স্বপ্নদর্শী তরুণ অন্ত আজাদ নিজেকে বিকশিত করেছেন দূরের শহর ঢাকায়। ঢাকাতে টিকে থাকবার নাগরিক সংগ্রামের ফাঁকে টেলিভিশনের জন্য কিছু প্রোডাকশন করলেও আহত ফুলের গল্পই আজাদের প্রথম সিনেমা।

…স্কুলে, গঞ্জের বাজারে, গ্রামে গ্রামে,
ভ্যানে ছবির পোস্টার হোল্ডিং
টাঙিয়ে প্রচারণার কাজ
করেছেন নির্মাতা
নিজেই…

সেই সিনেমা নিয়ে আজাদ এখন দেবীগঞ্জ এলাকায় প্রচারে ব্যস্ত। স্থানীয় একটি পরিত্যক্ত হলকে সাজিয়ে গুছিয়ে প্রদর্শনীর জন্য উপযোগী করেছেন আহত ফুলের গল্পর নির্মাতা অন্ত আজাদ। দেবীগঞ্জ এলাকার স্কুলে, গঞ্জের বাজারে, গ্রামে গ্রামে, ভ্যানে ছবির পোস্টার হোল্ডিং টাঙিয়ে প্রচারণার কাজ করেছেন নির্মাতা নিজেই। বলা যায়, একটি ছবিকে এভাবে প্রদর্শনীর জন্য উদ্যোগ বাংলাদেশে এই প্রথম। ইনডিপেনডেন্ট নির্মাতা প্রয়াত তারেক মাসুদ তাঁর ছবি তাঁর মতো করে প্রদর্শনী করেছিলেন দেশের নানান জায়গায়, আমরা দেখেছি। প্রচলিত হল-মালিক ও পরিবেশকদের দ্বারস্থ না হয়ে নিজেই নিজের ছবি প্রদর্শনের এই রেওয়াজ বাংলাদেশে নতুন মনে হলেও অন্য অনেক দেশেই এরকমটি ঘটে থাকে। বিশেষ করে ইনডিপেনডেন্ট ফিল্মমেকাররাই এটি করে থাকেন। এটি একটি সাহসের ব্যাপার, যে সাহস বেশিরভাগ নির্মাতাই রাখে না। আমাদের চেনা তরুণ ফিল্মমেকার অন্ত আজাদ এ সাহস দেখালেন। তরুণ এ সিনেমার ফেরিওয়ালাকে সাধুবাদ জানাতেই হবে। তার কাছ থেকে অন্যান্য তরুণ ফিল্মমেকারদের প্রেরণা নিতে হবে। কারণ, পৃথিবীতে ফিল্ম যত মাত্রাই পৌঁছুক, বাংলাদেশি ফিল্ম এখনো ডায়াপার যুগ কাটিয়ে উঠতে পারেনি, তৈরি হয়নি গৎবাঁধা ফর্মূলা ছবির বাইরে ভিন্ন ধারার ছবির নির্মাতা, কলাকুশলি, প্রডিউসার কিংবা দর্শকও। এখনো এ দেশে অনেকে টেলিভিশন প্রোডাকশনকেই টেনেটুনে লেন্থ বাড়িয়ে সিনেমা বলে চালিয়ে থাকেন। আর ‘মেইনস্ট্রিম ফিল্ম’ বলতে যেই এফডিসি প্রোডাকশন, সেগুলো স্রেফ বাসি হয়ে যাওয়া বিরানি। কিন্তু পৃথিবীর সিনেমা কতদূর এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশে সিনেমার এখনো সামাজিকায়ন হয়নি। সিনেমা এখনো সাবালক হয়নি, যা বলছিলাম, ডায়াপার যুগ চলছে। ফলে ‘অথর ফিল্ম’ রিয়েলিটি বাংলাদেশ এখনো প্রবেশ করেনি, বলাই যায়। ‘দর্শকের মনোরঞ্জন’ করতেই পরিচালকেরা ব্যস্ত থাকেন প্রডিউসারের কর্মচারী হয়ে। এককথায় ‘দর্শক যা খান’ তাই ঢালতে থাকেন। সে কারণেই সিনেমায় তথাকথিত স্টারডম প্রচলিত আছে। চরিত্র অনুযায়ী অভিনেতা নিয়ে সিনেমা চর্চার রেওয়াজ এখনো হয়নি। অন্ত আজাদ তার আহত ফুলের গল্পতে স্টারডমে যাননি, তাতে বাজারি দর্শকের কাছে পৌঁছুনোর ঝুঁকি তিনি মেনে নিয়েছেন। গ্রামে, গঞ্জে, স্কুলে, কলেজে ঘুরে ঘুরে প্রচারণা চালিয়ে নিজের ছবির দর্শক নিজেই তৈরি করে নিচ্ছেন। এটিও সেই সাহসের ব্যাপার।

আশা করি পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ থানার বাইরেও আহত ফুলের গল্প নিয়ে অন্ত আজাদ বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকায় যাবেন, মানুষকে ছবিটি দেখাবেন। দর্শক তার ছবি দেখে তাকে ও তার ছবির টিমকে মূল্যায়ন করবেন।
আহত ফুলের গল্প সেন্সর বোর্ডে যাওয়ার আগেই ঘরোয়াভাবে আমার দেখার সুযোগ হয়েছে। উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত গ্রাম বাস্তবতার লোকেশনে চিত্রায়িত এই ছবি সমকালীন বাংলাদেশের গ্রামীণ পটভূমিতে রচিত একটি সহজ, সরল ও সত্যমুখী উপস্থাপনা। গ্রামীণ জীবনের মধ্যেও এই ডিজিটাল যুগে যেই সংকট বিদ্যমান, মানুষে মানুষে চিন্তার যে ভেদ, নারীর নিজের ইচ্ছার জায়গাটি প্রতিষ্ঠা পাওয়া না-পাওয়া– এরকম কিছু মৌলিক প্রসঙ্গ এই ছবির আলেখ্য বিষয়। ঢাকায় বসে সেই সংকট, সেই গ্রাম আমাদের চোখে পড়ে না। গ্রাম বলতে আমরা এখনো ফটোগ্রাফির ভেতর দিয়ে শাপলা ফুলের ঝিলকেই বুঝি, মাঠের কৃষককেই বুঝি, উঠোনে হাঁস-মুরগীর প্রতিপালন বুঝি, শীতকালে বাঁধের দিকে একটু কুয়াশা থমকে থাকা বুঝি, সন্ধ্যায় নদী তীরে সূর্যাস্তকে বুঝি। ঠিক অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাগত জায়গা থেকে আমরা গ্রামকে বুঝি না। ঢাকায় লেকের ধারে ছেলেমেয়েরা বসে প্রেম করে, এটাই স্বাভাবিক। গ্রামে দুটি অবিবাহিত ছেলেমেয়ে পাশাপাশি বসে সময় কাঁটাবে– কল্পনা করা যায়? এলাকায় খবর হয়ে যাবে। আহত ফুলের গল্প দেখতে দেখতে আমার পুনরায় এসব মনে হচ্ছিল।

এই মুর্হূতে আমি চাই, আহত ফুলের গল্প ছবিটি আপনারা দেখে ফেলুন, তরুণ নির্মাতা অন্ত আজাদের পাশে দাঁড়ান, তাকে আরও সাহসী হয়ে উঠতে দিন। বাংলাদেশে আর্ট-কালচার অনেকেই করে, শুধু সাহসী শিল্পকলাই হয়ে ওঠে না।
অলমতি রেস্তরেণ: জয়তু বাংলা সিনেমা।…