খলনায়কের খোসামুদি

399
filmfree

লিখেছেন বিধান রিবেরু


 

The more successful the villain, the more successful the picture.
−Alfred Hitchcock

The better the villain, the better the picture… that’s an excellent formula!
−François Truffaut

 

দানিং স্বয়ং গল্পই হয়ে উঠছে চলচ্চিত্রের নায়ক বা খলনায়ক। তারপরও চলচ্চিত্রে সেই পুরনো ধাচের খলনায়কদের উপস্থিতি কিন্তু এখনো চোখে পড়ার মতো। হলিউড, বলিউড, টলিউড, ঢালিউড– সর্বত্রই তাদের দাপট বিরাজমান। তাদেরকে চলচ্চিত্রে প্রকট করে তোলা হয় নায়কের প্রবল হাজিরার মাধ্যমে। বা অন্যভাবে বললে নায়কের মহিমা প্রতিষ্ঠায় খলনায়কের সমান্তরাল অস্তিত্ব প্রয়োজন হয়। যদিও শেষ পর্যন্ত নায়কেরই জয় হয়। তবে শেষ জয়ের আগ পর্যন্ত খলনায়ক সমান তালে পাল্লা দিয়ে যায় নায়কের সঙ্গে। মাঝে আবার নায়ক পরাস্ত হয়, কিন্তু পরাজয় স্বীকার করে না। ভাঙে কিন্তু মচকায় না।

হলিউডের ছবিতে আমরা জোকার [ব্যাটম্যান, দ্য ডার্ক নাইট], ডার্থ ভ্যাডার [স্টার ওয়ার্স ইউনিভার্স], হানিবল লেক্টের [দ্য সাইলেন্স অব দ্য ল্যাম্বস], লর্ড ভোল্ডেমোর্ট [হ্যারি পটার ইউনিভার্স], নরম্যান বেটস [সাইকো], এজেন্ট স্মিথ [দ্য ম্যাট্রিক্স ইউনিভার্স] প্রভৃতি চৌকস, বুদ্ধিমান ও নৃশংস খলচরিত্রের দেখা পাই। এরা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে স্বতন্ত্র স্থান দখল করে আছে। নায়কের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে এরা চলচ্চিত্রের পর্দাকে টানটান করে রাখে বলেই দর্শক টানাপড়েনের মধ্যে পড়ে যায়।

filmfree
ভিলেন চরিত্র । গাব্বার সিং

একই রকম খলচরিত্রের জয়জয়কার বলিউডেও। গাব্বার সিং [শোলে], সুখি লালা [মাদার ইন্ডিয়া], রবার্ট [অমর আকবর অ্যান্থনি], মোগাম্বো [মিস্টার ইন্ডিয়া], কাঞ্চা [অগ্নিপথ], ক্যাপ্টেন এন্ড্রু রাসেল [লগন]– এমন আরো নাম আপনি তালিকাভুক্ত করতে পারবেন। একই রকমভাবে ওপার বাংলার চলচ্চিত্রেও সৃষ্টি হয়েছে কালজয়ী খলচরিত্র, যেমন– হীরক রাজা [হীরক রাজার দেশে]। সত্যজিতের সৃষ্টি এই চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন কিংবদন্তী অভিনেতা উৎপল দত্ত। তিনি টলিউডের অন্য ছবিতেও সফলভাবে খলচরিত্রে অভিনয় করেছেন।

…এখানে চলচ্চিত্রের
খলচরিত্র খ্যাতি পায়
না, খ্যাতি পায় ওই
চরিত্রে অভিনয় করা
ব্যক্তিটি…

তবে ঢালিউডের ক্ষেত্রে বিষয়টি কিঞ্চিত ভিন্ন। এখানে চলচ্চিত্রের খলচরিত্র খ্যাতি পায় না, খ্যাতি পায় ওই চরিত্রে অভিনয় করা ব্যক্তিটি। এর কারণ, ছবিতে যে ব্যাক্তিটি খলচরিত্রে অভিনয় করেন, সেই ব্যক্তিটি একাধিক ছবিতে একইরকম চেহারাসুরৎ বা স্বভাবচরিত্র ও প্রায় একই রকম সংলাপ নিয়ে হাজির থাকেন। এতে করে নির্দিষ্ট ছবির কোন খলচরিত্র খ্যাতি পায় না। ধরুন ঢাকাই ছবির খলচরিত্রে অভিনয় করা হুমায়ূন ফরিদীর কথা। তাঁকে দিয়ে প্রায় সকল ছবিতেই একইরকম অভিনয় করানো হয়েছে। এ কারণে ব্যক্তির প্রতিষ্ঠা হয়েছে, চরিত্রের পরিচিতি বাড়েনি। একই ঘটনা ঘটেছে বা ঘটছে ঢাকাই অন্য অভিনেতাদের বেলাতেও।

হুমায়ূন ফরীদি

আমরা যদি খলিল, রাজীব, মিজু আহমেদ, জাম্বু, আদিল, এটিএম শামসুজ্জামান, আহমেদ শরীফ, মনোয়ার হোসেন ডিপজল, সাদেক বাচ্চু, ডন, মিশা সওদাগর, ড্যানি সিডাক– সকলের করা ছবিগুলোর চরিত্র বিচার করি, তাহলে দেখব এই অভিনেতারা একাধিক ছবিতে প্রায় একইরকম গৎবাঁধা অভিনয় করে গেছেন। নির্দিষ্ট কোনো ছবির জন্য আলাদা করে কোনো প্রস্তুতি বা একটি ছবির খলচরিত্রকে স্বতন্ত্র করে ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস নেই বললেই চলে। আর ঢাকাই ছবিগুলো কখনো ভিলেনকে সেভাবে ভাবেনি। এসব ছবির পরিচালকেরা বলতে গেলে কোনো কিছু নিয়েই সেভাবে ভাবেন না। একটি বাধাধরা নিয়মেই তারা চরিত্র ও চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। খলচরিত্র কেন, মূল চরিত্ররাও তাই থেকে গেছে ভীষণরকম বৈচিত্রহীন। আর ভালো-খারাপের দ্বন্দ্ব তাই যেন মনে হয় ঢালিউডের বাণিজ্যিক ছবির শ্বাশত ব্যাপার। টলিউডের বাণিজ্যিক ছবির চিত্রও খুব একটা অভিন্ন নয়। শুধু ঢালিউড বা টলিউড নয়, গোটা বিশ্বের চলচ্চিত্রেই এই চেনা পথের দেখা মিলবে।

…যখন পরাজয় ঘটে
অন্ধকারের, তখন
দর্শক যেন সেই
আলোর
ভাগীদার হয়ে ওঠে…

নায়ক ও খলনায়কের ভেতর দিয়ে ভালো ও মন্দের এই যে ডায়কোটোমি [dichotomy] বা দ্বিবিভাজন, এটার মধ্যে সরলীকরণ যেমন আছে, তেমনি আছে বাধাধরা সূত্র বা ছক। এই বিভাজন নিছক নয়। মুনাফাই এর পেছনের মূল কারণ। মানুষ সবসময় অন্ধকারকে জয় করতে চায়। মানুষ চায় তার প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে। মানুষ চায় বিদ্যমান ব্যবস্থার ভেতর সে যে বৈষম্য ও অন্যায়ের শিকার হচ্ছে, সেখান থেকে মুক্তি, নিষ্কৃতি। অন্যায় ও বৈষম্যের বিনাশ চায় সে। ছবিতে খারাপের দমনের মধ্য দিয়ে মানুষ নিজের ভেতরকার ক্ষোভ, দুঃখ ও বঞ্চনার বোধকে নিষ্ক্রান্ত করতে চায়, ক্যাথারসিস ঘটাতে চায়। আর এই বিষয়টিকে বেশ ভালো করেই চিহ্নিত করতে পেরেছে বাণিজ্যিক ছবিগুলো। তাই তারা দর্শককে সক্রিয় করার বদলে নিষ্ক্রিয় আমোদ দিতে চায়, ভেতরের জমাট বাধা ক্ষোভকে প্রশমন করতে চায় নির্ধারিত দুই-আড়াই ঘন্টার ভেতরেই। এ কারণেই প্রেক্ষাগৃহে তুমুল হাততালি আর উল্লাস চোখে পড়ে– যখন খলচরিত্র মার খায় নায়কের হাতে। যখন পরাজয় ঘটে অন্ধকারের, তখন দর্শক যেন সেই আলোর ভাগীদার হয়ে ওঠে। সেও যেন বিজয়ী। সেও যেন কোনঠাসা করে ফেলে প্রতিপক্ষকে। পেয়ে ফেলে সকল না-পাওয়াকে। ইচ্ছাপূরণের খেলায় এক নকল প্রলেপ পড়ে দর্শকের মনের কোণে থাকা আহত বাসনার ওপর।

গডফাদার

বাধাধরা ছক হলেও একটু ঘুর পথেও ভিলেন অর্থাৎ খলনায়কদের উপস্থাপনের নজির চলচ্চিত্রে আছে। সাদা চোখে খলনায়ক তারাই, যারা সমাজে অনৈতিক ও নিষিদ্ধ কাজের সঙ্গে জড়িত থাকে। তাদের শায়েস্তা করে নায়কেরা। কিন্তু সমাজের অনৈতিক ও নিষিদ্ধ কাজ করা লোকেরাও অনেক সময় চলচ্চিত্রের নায়ক হয়ে ওঠে বৈকি। এখানে নায়ক ঠিক নয়, বলতে হবে মূলচরিত্র বা প্রোটাগনিস্ট [protagonist]। তাদের বিপরীতে থাকে আরো একদল খারাপ মানুষ– এন্টাগনিস্ট [antagonist]– প্রতিপক্ষ। এখন এই প্রথম দলকে এমনভাবে চিত্রিত করা হয় যে দর্শক তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠে। আমরা তো ফ্রান্সিস ফোর্ড কোপোলার গডফাদার ছবিটির কথা জানি। এ যেন মধুসূদনের মেঘনাদ বধ কাব্য। সাধারণ বিচারে যে খারাপ, সেই হয়ে ওঠে কাহিনী বা কাহিনীচিত্রের মূলচরিত্র। তাদের প্রতিই লেখক ও নির্মাতা তৈরি করেন পক্ষপাত। পাঠক-দর্শকও হেলে পড়েন ওইদিকে। হলোই বা খারাপকে ভালো, আর ভালোকে খারাপ করে নির্মাণের খেলা, এই খেলাতেও কিন্তু সেই দ্বিবিভাজনই উপস্থিত। শুধু দাবা খেলায় এতদিন সাদা ঘুঁটি নিয়ে খেলতেন স্রষ্টা, এবার একটু পাল্টে নিলেন কালো ঘুঁটি। পক্ষ আর প্রতিপক্ষ কিন্তু ঠিকঠাকই থাকছে। শুধু বদলে যাচ্ছে পক্ষপাতিত্ব।

ভালো ও খারাপের দ্বন্দ্বে ভিন্ন স্বাদ দিতে আরেকটি কৌশলের আশ্রয়ও নিতে দেখা যায় নির্মাতাদের। সেখানে দেখা যায় সাধারণত যারা নায়ক চরিত্রে অভিনয় করেন, তারা হোন খলনায়ক আর খলনায়ক হয়ে যান নায়ক। হলিউডের ফেস অফ ছবিতে জন ট্রাভোল্টা ও নিকোলাস কেইজকে দেখা যায় নায়ক ও খলনায়কের ভূমিকায় অদল-বদল করতে। বলিউডের ধুম সিরিজের ছবিতে নায়ক জন আব্রাহাম, হৃতিক রোশন ও আমির খান খলচরিত্রে অভিনয় করেছেন। ঢালিউডে একসময়ের খলনায়ক জসিম নায়ক হয়েই ক্যারিয়ারের ইতি টেনেছেন। বা ডিপজলের কথা যদি বলি, খলচরিত্রে সফল এই ব্যক্তি পরবর্তী সময়ে চাচ্চু বা দুলাভাই জিন্দাবাদ নামের ইত্যাদি ছবিতে করেছেন নায়কের চরিত্রে অভিনয়।

কেবল পুরুষরাই যে খলচরিত্রে সফল, তা কিন্তু নয়। হলিউডে অ্যাঞ্জেলিনা জলি স্লিপিং বিউটি ছবিতে মেলিফিসেন্ট চরিত্রে সফল। এমন আরো নামকরা নারী খলচরিত্রের দেখা মেলে হলিউডে: মিস্টিক [এক্স-ম্যান], ও-রেন ইশি [কিল-বিল], তালিয়া আল গুল [ব্যাটম্যান: ডার্ক নাইট রাইজেস], অ্যালেক্স ফরেস্ট [ফ্যাটাল অ্যাট্রাকশন] এবং আরো অনেক। বলিউডে অবশ্য খুব বেশি নারী খলচরিত্র দেখা যায় না। তারপরও সাম্প্রতিক সময়ে এই ধরনের চরিত্র চলচ্চিত্রে দেখা যাচ্ছে, যেমন– গালিওঁ কি রসলীলা: রাম-লীলা ছবিতে ধানকর-বা চরিত্রটি, যেটাতে অভিনয় করেছেন সুপ্রিয়া পাঠক কাপুর। এছাড়া ভারতীয় চলচ্চিত্রে নিয়মিতভাবে খলচরিত্রে পর্দায় দেখা গেছে নাদিরা ও বিন্দুকে। প্রিয়াঙ্কা চোপড়া [এইতরাজ], বিদ্যা বালান [ইশকিয়া], কঙ্গনা রানৌতের [কৃষ] মতো প্রতিষ্ঠিত নায়িকারাও অভিনয় করেছেন খলচরিত্রে।

rawshan zamil
রওশন জামিল । ফিল্ম : জীবন থেকে নেয়া

ঢাকাই ছবিতে নারী খলচরিত্র বলতেই চোখের সামনে ভেসে উঠবে রওশন জামিলের মুখ। জহির রায়হান পরিচালিত জীবন থেকে নেয়া চলচ্চিত্রে রওশন জামিলের খলচরিত্র ভোলার মতো নয়। এছাড়া সুমিতা দেবী, রানী সরকার, মায়া হাজারিকা, শবনম পারভীন, রিনা খান, দুলারী, অরুণা বিশ্বাস বেশ দাপটের সঙ্গেই দেশের বড় পর্দায় খলচরিত্রে অভিনয় করেছেন। বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ছবিতে আরেক ধরনের খলচরিত্রের নারী দেখা যায়, যারা থাকে ছবির মূল খলচরিত্রের সহচরী হিসেবে। মূল খলনায়ককে যৌনসুখ দেয়াই যেন তাদের একমাত্র কর্তব্য। তাদেরকে এ ধরনের ছবিতে অনেকটা নিশাচর প্রাণীরূপেই চিত্রায়িত করা হয়। এদের দেখা মিলবে হয় রাতের নাইটক্লাবে, নয়তো ভিলেনের বাংলোতে, সেই রাতের বেলাতেই।

…জীবনের যে ধূসর অংশ
আছে, বা কালো ও সাদার
যে নানা ধরনের মাত্রা ও বৈচিত্র
থাকে, সেটাকে তুলে ধরাও
সাহিত্য বা চলচ্চিত্রের
কাজ…

এখন খল– সে নায়ক হোক বা নায়িকা, এই নেতি আর ইতির দ্বন্দ্ব কি চলচ্চিত্রে নতুন কিছু? ভালো ও মন্দের এই দ্বন্দ্ব অনেকটা রূপক আকারে আমরা দেখি চীনা দর্শন তাওবাদে। তাওবাদ বা দাওবাদের প্রতীকে দেখা যায় একটি বৃত্তের ভেতর কালো আর সাদা অংশ দ্বিবিভাজিত। প্রতীকটিকে ডাকা হয় ইয়েন-ইয়াং [yin yang] বলে। ইয়েন ও ইয়াংয়ের আক্ষরিক অর্থ– অন্ধকার ও আলো। এই দুটি একে অপরের সম্পূরক, এদের ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার ফলেই দুনিয়া চলিষ্ণু, দুনিয়া ঘটমান, দুনিয়া গতিময়। এমন দ্বৈতশক্তির ধারণা অন্য বিশ্বাসেও পাওয়া যাবে। পবিত্র গ্রন্থ যেমন কুরআন বা বাইবেলেও কিন্তু শয়তানের বেশ শক্ত অবস্থান রয়েছে। খলচরিত্র হিসেবে ধর্মীয় গ্রন্থে এদের গুরুত্ব কম নয়। কিন্তু আমাদের যেটা বলার, সেটা হলো মানুষ এই বিষয়টিকে সহজেই চিহ্নিত করতে পারে– ভালো বনাম মন্দ। প্রাচীন দর্শন থেকে বর্তমানের নানা ভাবনাতেই ভালো আর খারাপের উপস্থিতি সাদা-কালো বৈপরীত্যের মধ্য দিয়েই তুলে ধরা হয়। কিন্তু জীবনের যে ধূসর অংশ আছে, বা কালো ও সাদার যে নানা ধরনের মাত্রা ও বৈচিত্র থাকে, সেটাকে তুলে ধরাও সাহিত্য বা চলচ্চিত্রের কাজ।

নায়ক ও খলনায়কের বাইরে গিয়ে অজস্র সাহিত্য ও চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, যেখানে গল্পের ভেতরকার যে বাস্তবতা সেটাই নায়ক বা খলনায়ক হিসেবে আবির্ভূত হয়। ধরুন দ্য বাইসাইকেল থিভস ছবিটির কথা। যেখানে দরিদ্র বাবা ভীষণরকম বাধ্য হয়ে সাইকেল চুরি করে ও ধরা পড়ে। ছেলের সামনে তাকে অপদস্থ হতে হয়। বাস্তবতা ও ভাগ্যটাই কি এই ছবির খলনায়ক নয়? আবার যদি বলি, পথের পাঁচালীর কথা। সেখানে মৃত্যুই বড় খলনায়ক। মৃত্যুর চেয়ে বড় খলনায়ক আর কে হতে পারে মানুষের জীবনে? অতএব দেখা যাচ্ছে, এমন অনেক বাস্তবধর্মী চলচ্চিত্র রয়েছে যেখানে ব্যক্তি নয়, সময় বা বাস্তবতাই হয়ে উঠছে প্রোটাগনিস্টের মূল প্রতিপক্ষ।

Pather Panchali
পথের পাঁচালী

এখন বাণিজ্যিক ছবিতে যেভাবে খলচরিত্রদের আঁকা হয়, সেটা নিয়ে বিস্তর সমালোচনা রয়েছে। এটা ঠিক যে ছবির খলনায়ক যত বেশি চৌকস, সেই ছবি তত ব্যবসা সফল হওয়ার সম্ভাবনা রাখে। আবার এটাও তো ঠিক, খলনায়কের ভয়ঙ্কর চেহারা আরো ভয়ঙ্কর করে তুলতে গিয়ে নির্মাতারা সামাজিক অন্যায় ও অপরাধের এমন সব বিষয় বড় পর্দায় নিয়ে আসেন– যা গ্রহণযোগ্য হয় না। উদাহরণ হিসেবে বলতে গেলে বলা যায় বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে ধর্ষণ দৃশ্যের কথা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ধর্ষণের একটি রাজনীতি আছে। রাজনীতি বলি আর বিকৃত মানসিকতাই বলি, এটার ‘ক্রেতা’ও আছে, তাই ‘বিক্রেতা’ও আছে। ছবিওয়ালারা সেটাই বিক্রি করতে চান। ধর্ষণটাও তাদের কাছে একটি বিনোদন মাত্র। আর এটা যে বিনোদন সেটা কিছুদিন আগেও প্রকাশ পেয়েছে এক টেলিভিশন অনুষ্ঠানে।

ঢাকাই ছবির নায়িকা পূর্ণিমা, খলচরিত্রে অভিনয় করে খ্যাতি পাওয়া মিশা সওদাগরকে ওই টিভি অনুষ্ঠানে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তিনি ছবিতে কয়বার ধর্ষণ করেছেন? কাকে ধর্ষণ করতে ভালো লাগে? ইত্যাদি। মিশা উত্তরে বলেছিলেন, তিনি এখন সিনিয়র ভিলেনের রোলে অভিনয় করেন, তাই এখন আর ধর্ষণ দৃশ্যে অভিনয় করতে হয় না। যখন জুনিয়র ছিলেন, তখন প্রচুর এমন ধর্ষণ দৃশ্যে অভিনয় করেছেন। আর এই দৃশ্যে তিনি নায়িকা মৌসুমী আর পূর্ণিমার সঙ্গেই বেশি স্বাচ্ছন্নবোধ করেন। এই টিভি অনুষ্ঠানটি নিয়ে তখন সমালোচনার ঝড় ওঠে।

misha sawdagor
মিশা সওদাগর

কথা হলো খলচরিত্র সমাজের অবৈধ ও অন্যায় কাজ করবে, কিন্তু সেটা কতটুকু দেখানো উচিত, আর কতটুকু উচিত নয়, সেই ঔচিত্যবোধ কজনের আছে? নয়তো মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রেও ধর্ষণ কেন বিনোদন বিক্রি ও মুনাফা লাভের নিমিত্তে ব্যবহৃত হবে?

যাহোক, শেষ কথা হলো, চলচ্চিত্রকে চেনা ছকে ফেলে বেগবান করতে খলচরিত্রের হয় তো জুড়ি নেই, তবে এটাও খেয়াল করতে হবে, যেটা বলছিলাম একটু আগে, জীবন শুধু সাদা ও কালো রঙ দিয়ে গঠিত নয়। এখানে নানা রঙের খেলা চলে। জীবনঘনিষ্ঠ চলচ্চিত্র সেটাই যেখানে রঙের বৈচিত্র পাওয়া যায়। নায়ক-খলনায়কের রশি টানাটানি, ধুন্ধুমার ব্যবসায়িক ছবি সাময়িক উত্তেজনা দিতে পারলেও, সেটি শেষ পর্যন্ত মানুষের আটপৌরে জীবনের অংশ হতে পারে না।


বোধিনী
১. François Truffaut, Hitchcock: The definitive study of Alfred Hitchcock by François Truffaut, with collaboration of Helen G. Scott, Simon & Schuster Paperback (1983), New York, page-191
২. উদ্বৃত
Print Friendly, PDF & Email
লেখক, সাংবাদিক, সিনে-সমালোচক। ঢাকা, বাংলাদেশ। সিনে-গ্রন্থ : চলচ্চিত্র পাঠ সহায়িকা; চলচ্চিত্র বিচার; বলিউড বাহাস; উসমান সেমবেনের চলচ্চিত্র হালা

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here