লিখেছেন । প্রসূন রহমান
চলচ্চিত্রে লিঙ্গ-সমতার ধারনাটি বাংলাদেশে অদ্যাবধি অনালোচিত থাকলেও পাশ্চাত্যে এর চর্চা শুরু হয়েছে প্রায় ২ দশক আগে। বেকডেল টেস্ট হিসেবে পরিচিতি পাওয়া এর প্রাথমিক ভাবনাটি আসে বহুল প্রচারিত ও জনপ্রিয় একটি কমিক স্ট্রিপ থেকে। ১৯৮৫ সালে মার্কিন কার্টুনিস্ট অ্যালিসন বেকডেলের কমিক স্ট্রিপ– ডাইক্স টু ওয়াচ আউট ফর সিরিজের একটি সংখ্যায় দুজন নারী চরিত্রের কথোপকথনের মাধ্যমে প্রথম এই ভাবনাটির প্রকাশ ঘটে। পরবর্তীকালে বিষয়টি ব্যাপক আলোচনায় এলে ভাবনাটি একটি গ্রহণযোগ্য ধারণায় রূপ পেতে থাকে এবং ক্রমে একটি তত্ত্ব ও মান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হযে যায়, যা এখন হলিউডসহ ইউরোপের অনেক ইন্ডাস্ট্রিতে প্রায়োগিক পদ্ধতি হিসেবে অনুসরণ করা হচ্ছে।
ডাইক্স টু ওয়াচ আউট ফর সিরিজের সে কমিক্স স্ট্রিপের একটি পর্বের নাম ছিল– দ্য রুল। সেখানে দেখা যায়, মো এবং জিঞ্জার নামে দুজন নারী কথা বলতে বলতে একটি প্রেক্ষাগৃহ এলাকা পেরিয়ে যাচ্ছে। তাদের একজন বলছে, “আমি সেই চলচ্চিত্রটিই দেখতে যাই, যেটি আমার প্রত্যাশিত ৩টি শর্ত পূরণ করে। সেখানে অন্তত দুটি নারী চরিত্র থাকবে, যারা নিজেদের মধ্যে কথা বলে, যেখানে তাদের কথা বলার বিষয় পূরুষ নয়।
চলচ্চিত্রে নারীর উপস্থিতি ও সক্রিয়তা নিয়ে প্রকাশিত ও আলোচিত এই ধারণাটিই পরবর্তীকালে বেকডেল টেস্ট হিসেবে পরিণতি ও পরিচিতি পায়। যা প্রথম দিকে বেকডেল-ওয়ালেস রুল নামেও পরিচিত হয়েছিল। কারণ, এলিসন বেকডেল বলেছিলেন, তিনি আসলে এই রুল এর বিষয়ে তার বন্ধু কারাতে ট্রেইনার লিজ ওয়ালেসের কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। কিন্তু লিজ ওয়ালেস আবার এক লেখায় জানিয়েছেন, অ্যালিসন বেকডেল আসলে অনুপ্রাণিত হয়েছেন ভার্জিনিয়া উলফের অ্যা রুম অব ওয়ান্’স ওন বই থেকে।
প্রসঙ্গত, ভার্জিনিয়া উলফের অ্যা রুম অব ওয়ান্’স ওন বইটি ১৯২৯ সালে প্রকাশিত তার লেখা বেস্ট ননফিকশনগুলোর একটি বলে বিবেচিত হয়। ১৯২৮ সালে ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে ওমেন অ্যান্ড ফিকশন বিষয়ে তার দেয়া ২টি বক্তব্যের উপর নির্ভর করে লেখা একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ রয়েছে বইটিতে। যেখানে তিনি বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, ঐতিহাসিকভাবেই কী করে সকল মাধ্যমে নারীকে ক্ষমতার বাইরে নিষ্ক্রিয় রাখা হয়েছে।
…যেসব চলচ্চিত্র ও অনলাইন
ভিডিও ফিকশনগুলো
বেকডেল টেস্ট উত্তীর্ণ হতে
পারছে না, সেগুলো লিঙ্গ-সংবেদনশীল
নয় বলে সমালোচনার
মুখে পড়ছে অন্য
মাধ্যমে…
যাহোক, আলোচ্য এই বেকডেল-ওয়ালেস রুল থেকে পরিবর্তিত হওয়া বেকডেল টেস্ট-এর ভাবনাটি ১৯৮৫ সালে আত্ম্রপ্রকাশ করলেও, দীর্ঘ আালোচনা-সমালোচনার শেষে ২০০০ সাল থেকে এটি সবক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্যতা পায়। এখন এই বেকডেল টেস্ট শুধু চলচ্চিত্রে নয়, পাশ্চাত্যের গল্প-উপন্যাসের ক্ষেত্রেও অনুসরণ করা হয়ে থাকে। এখন বেশ জোড় দিয়েই অনুসরণ করা হচ্ছে ভারতীয় চলচ্চিত্রে, এমনকি ওয়েব সিরিজসহ সোশ্যাল মিডিয়ার জন্যে করা ভিডিও স্কিডেও। যেসব চলচ্চিত্র ও অনলাইন ভিডিও ফিকশনগুলো বেকডেল টেস্ট উত্তীর্ণ হতে পারছে না, সেগুলো লিঙ্গ-সংবেদনশীল নয় বলে সমালোচনার মুখে পড়ছে অন্য মাধ্যমে। চলচ্চিত্রবিষয়ক নানা পোর্টালে রীতিমতো ঘটা করেই বছরওয়ারি তালিকা প্রকাশিত হচ্ছে– কোন চলচ্চিত্রগুলো বেকডেল টেস্ট উত্তীর্ণ আর কোনগুলো নয়।
তবে গণমাধ্যমের গবেষণা এবং চলচিচত্রবিষয়ক ডাটাবেজগুলোর তথ্য-উপাত্তে দেখা যায়, এখনো প্রায় ৫০ শতাংশ চলচ্চিত্র এই বেকডেল টেস্ট উত্তীর্ণ হয় না। পূরুষ-প্রধান চলচ্চিত্রে বেশির ভাগ সময়েই দেখা যায় নারী চরিত্রগুলো আসে অলঙ্কারিক হিসেবে। যাদের বেশির ভাগেরই কোনো নাম থাকে না। বেকডেল টেস্ট সেইসব চলচ্চিত্রকে অনায়াসে লিঙ্গ-সংবেদনশীল নয় বলে নির্ধারণ করতে পারে এবং চলচ্চিত্র ও গল্প-উপন্যাসে নারী চরিত্রের নিষ্ক্রিয় উপস্থিতি– জেন্ডার ইনেকুয়ালিটি ইন ফিকশন হিসেবে বিচার্য হয়।
২০১৭ সালে আমেরিকার ‘গ্রিন ডেভিস ইনিস্টিটিউট অন জেন্ডার ইন মিডিয়া’ পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সারাবিশ্বের বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রি থেকে নির্মিত উল্লেখযোগ্য মোট ১৯০টি চলচ্চিত্রের মধ্যে উপস্থাপিত নারী চরিত্রের শতকরা ৩১ ভাগ চরিত্রের নাম রয়েছে। মোট ২৩ শতাংশ চলচ্চিত্রের প্রোটাগনিস্ট বা কো-প্রোটাগনিস্ট চরিত্র হচ্ছে নারী। আর নারী নির্মাতা রয়েছেন মাত্র ৭ শতাংশ চলচ্চিত্রে।
…২০০৭ থেকে ২০১৬ সাল
পর্যন্ত নির্মিত ব্যবসাসফল
৭০০ চলচ্চিত্রের মধ্যে
মাত্র ৩০% শতাংশ
নারী চরিত্রের সংলাপ
রয়েছে…
একই বছরের আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০৭ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত নির্মিত ব্যবসাসফল ৭০০ চলচ্চিত্রের মধ্যে মাত্র ৩০% শতাংশ নারী চরিত্রের সংলাপ রয়েছে। আর ২০১৬ সালে পরিচালিত অপর একটি গবেষণায় মোট ২০০৫টি চিত্রনাট্য বিভাজন করে দেখা গেছে, শতকরা ২২ ভাগ গল্পে নারী চরিত্রের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সংলাপ রয়েছে।
উল্লেখ করা প্রয়োজন, ২০১৫ সালে অস্কারে মনোনীত ও বিভিন্ন শাখায় পুরস্কৃত ৮টি চলচ্চিত্রের মধ্যে ৬টি চলচ্চিত্রই বেকডেল টেস্ট-এ উত্তীর্ণ হয়নি। কিন্তু যেহেতু বেকডেল টেস্ট কোনো আইন নয়, তাই কোনো ইন্ডাস্ট্রি বা নির্মাতা সর্বতোভাবে এটা মানতেও বাধ্য নয়। তবে লিঙ্গ-সংবেদনশীলতার ভাবনা থেকে প্রায় সারাবিশ্বেই ধীরে ধীরে এর গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। ইতিমধ্যে সুইডিশ সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি এবং স্ক্যান্ডেনেভিয়ান কেবল টেলিভিশন চ্যানেল ভায়াস্যাট ফিল্ম বেকডেল টেস্টকে আনুষ্ঠানিকভাবে রেটিংয়ের আওতাভুক্ত করেছে, যা একইসাথে সুইডিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটও আনুষ্ঠানিকভাবে সমর্থন করে। এছাড়া ২০১৪ সাল থেকে ইউরোপিয়ান সিনেমা ফান্ড ইউরিমেজেস পুরস্কারের জন্যে চিত্রনাট্য বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বেকডেল টেস্ট উত্তীর্ণ হওয়াকেও মানদণ্ডের অংশ হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে বিবেচনা করছে।
এ মুহুর্তের ইউরোপে শুধু চলচ্চিত্রই নয়, ভিডিও গেমস, কমিকস এবং থিয়েটারেও এই বেকডেল টেস্ট অনুসরণ করা হচ্ছে। বৃটিশ অভিনেতা বেথ ওয়াটসন বেকডেল থিয়েটার নামে ২০১৫ সালে একটি ক্যাম্পেইন শুরু করেছেন, যেখানে থিয়েটারকেও নারী চরিত্রের সক্রিয় উপস্থাপনের মাধ্যমে বেকডেল টেস্ট উত্তীর্ণ হওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হচ্ছে।
বেকডেল টেস্ট-এর প্রতি সমর্থন ও সম্মান প্রর্দশনের উদ্দেশ্য ২০১৬ সাল থেকে ফিলোডেলফিয়ায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে বেকডেল টেস্ট ফিল্ম ফেস্ট নামে একটি চলচ্চিত্র উৎসব। উৎসবে উত্তীর্ণ ও নির্বাচিত চলচ্চিত্রগুলোর প্রদর্শনসহ নির্মাতাদের দেওয়া হয় বিশেষ সম্মাননা।
আগ্রহীরা বেকডেল টেস্ট সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানবার জন্যে www.bechdeltest.com ওয়েবসাইটে যেমন যেতে পারেন, তেমনি ইন্টারন্যাশনাল মুভি ডাটাবেজ আইএমডিবি-এর ওয়েবসাইট থেকেও বছরওয়ারী বিভাজনে বেকডেল টেস্ট উত্তীর্ণ ও অনুত্তীর্ণ চলচ্চিত্রগুলোর তালিকা পেতে পারেন।
আমাদের দেশে বিভিন্ন মাধ্যমে চলচ্চিত্র, নাটক, টেলিফিল্ম বা অনলাইন কন্টেন্ট হিসেবে যা নির্মিত হয়, তার বেশিরভাগই হয়তো এই বেকডেল টেস্ট উত্তীর্ণ হবে না। এর মাঝে কিছু চলচ্চিত্র, নাটক ও অন্যান্য কন্টেন্ট থাকে, যা উল্টো নারীর জন্যে অবমাননাকর। আশা করতে চাই, অসংবেদনশীলতার এ মাত্রা এখানেও কমে আসবে ক্রমে। বেকডেল টেস্ট হয়তো এখানেও একসময় আনুষ্ষ্ঠানিকভাবে অনুসরণ করা হবে। আর এই লেখার মাধ্যমেই সকলের কাছে শুরু করবার আবেদনটুকু রাখতে চাই।
প্রথম প্রকাশ । অনন্যা, ঈদসংখ্যা [ম্যাগাজিন] ২০১৮ । বাংলাদেশ
লেখকের অনুমতিক্রমে পুনঃপ্রকাশিত