লিখেছেন । আদুর গোপালকৃষ্ণন ।। অনুবাদ । রুদ্র আরিফ
জন আব্রাহাম • ভারতীয় ফিল্মমেকার। জন্ম : ১১ আগস্ট ১৯৩৭; চেন্নামকারি, কুত্তানাড়ু, আলাপপুজা, কেরালা, ভারত। প্রয়াণ : ৩১ মে ১৯৮৭; কজিকোড়ে, কেরালা, ভারত। মালাইয়ামভাষী মাস্টার ফিল্মমেকার। ‘ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট’-এর ‘টপ ১০ ইন্ডিয়ান ফিল্মস” তালিকায় একমাত্র সাউথ ইন্ডিয়ান ফিচার ফিল্ম হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে তার ‘রিপোর্ট টু মাদার’ [Amma Ariyan, ১৯৮৬]। অন্যান্য ফিচার ফিল্ম : দিস ওয়ে, স্টুডেন্টস [Vidhyarthigale Ithile Ithile; ১৯৭১]; ডাঙ্কি ইন অ্যা ব্রাহ্মণ ভিলেজ [Agraharathil Kazhuthai; ১৯৭৭]; ক্রুয়েলটিস অব চেরিয়াচান [Cheriyachante Kroora Krithyangal; ১৯৭৯]।
আদুর গোপালকৃষ্ণন • ভারতীয় ফিল্মমেকার। জন্ম : জুলাই ১৯৪১; মানাড়ি, আদুর, ত্রেভাঙ্কর, কেরালা, ভারত। মালাইয়ামভাষী মাস্টার ফিল্মমেকার। নির্বাচিত ফিল্মোগ্রাফি : ওয়ান’স ঔন চয়েস [Swayamvaram; ১৯৭২]; অ্যা ওম্যান অ্যান্ড টু মেন [Oru Pennum Randaanum; ২০০৮]; দ্য র্যাট ট্র্যাপ [Elippathayam; ১৯৮১]; ফেস টু ফেস [Mukhamukham; ১৯৮৪]।

আমাদের ভালোবাসার মানুষ– জন আব্রাহাম আমাদের ছেড়ে গেছেন বহুদিন হলো। এই বিরল প্রতিভাবানকে কোনো বিশেষণ কিংবা পদসমষ্টিতে সীমাবদ্ধ করার যেকোনো প্রচেষ্টাই এক অনভ্যস্ত পরিস্থিতিতে পড়ে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে যায়। চরম কোনো বন্ধু বা শত্রু– জনের কোনোদিনই ছিল না। কেউ যদি এমনটা থাকার দাবী তোলেন, তাহলে সেটিকে সন্দেহ করাই ন্যায্য। অসাধারণ রকমের অত্যুচ্চ পর্বতসমান আসনে অধিষ্ঠিত কোনো প্রফেট হিসেবে যদি কেউ তাকে অভিহীত করে, তাহলে তা মেনে নিতে রাজি আছি আমি।
যদিও বড় ছিলেন বয়সে, তবু পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে তিনি ছিলেন আমার তিন বছরের জুনিয়র; তামিল নাড়ুর কুম্বাকোনাম শহরের এল.আই.সি.র [লাইফ ইন্স্যুরেন্স করপোরেশন; ইন্সুরেন্স কোম্পানি, ভারত] চাকরি ছেড়ে, এখানে এসে ভর্তি হয়েছিলেন। যেকোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই সাধারণত প্রথমবর্ষের ছাত্রছাত্রীদের নবশিক্ষার্থী হিসেবে উপেক্ষা করে থাকে তাদের সিনিয়রেরা। তবুও সম্ভবত নিজ চিত্তহারী ব্যক্তিত্বগুণেই জন আমাদের মনোযোগ ও স্নেহ কেড়ে নিয়েছিলেন। গ্রন্থিবদ্ধ জন’কে সবসময়ই ঘিরে রাখত একদল সঙ্গী-সাথী। নাটক, চিত্রকলা, সঙ্গীত, সাহিত্য– এ রকম যেকোনো বিষয়েই তার ছিল এক অসামান্য উপলব্ধি ও উদ্দীপনা। প্রাণোচ্ছ্বাস-ভরা হাসিমুখের এ মানুষটি যেকোনো বির্তর্কেই একটি সহজাত পাঞ্চ-লাইনের আঘাত হানতে জানতেন।

…বলতে শুনেছি, নিজের
সকল ছাত্রের ভেতর
জনের মধ্যেই সবচেয়ে
উজ্জ্বল ভবিষ্যতের
আশা
দেখেছিলেন ঋত্বিক…
এটি সে সময়ের কথা, যখন ইনস্টিটিউটটির সকল শিক্ষার্থীই তৎকালীন ভাইস প্রিন্সিপাল ও ডিরেকশন বিভাগের প্রফেসর– ঋত্বিক ঘটকের জাদুমন্ত্রে বুঁদ হয়ে থাকত। সেই সময়কালটির প্রতি এক ধরনের মুগ্ধতা নিয়েই যে ইনস্টিটিউটটিতে জনের আগমন ঘটেছিল– মনে পড়ে আমার। স্বভাবতই শিক্ষার্থীরা যথেষ্ট ভালো করছিল। লোকজনকে আমি বলতে শুনেছি, নিজের সকল ছাত্রের ভেতর জনের মধ্যেই সবচেয়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশা দেখেছিলেন ঋত্বিক।
জনের সিনেমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক কোনটি– এ প্রশ্ন যদি কেউ তোলে, আমি গোড়াতেই তাদের বলে দিতে চাই, সেগুলোর [সিনেমা] কৌতূহলোদ্দীপক ব্ল্যাকহিউমার। স্টার্টারে প্যাডেলিং করতে থাকা মোটরসাইকেল আরোহী কেন্দ্রীয় চরিত্রটি [দিস ওয়ে, স্টুডেন্টস], বাছুরকে খড় খেতে দেওয়ার মাধ্যমে গাভীকে বোকা বানিয়ে দুধ দুইয়ে নেওয়ার চেষ্টারত দুধঅলা [ডাঙ্কি ইন দ্য ব্রাহ্মণ গেটো], ক্রুয়েলটিস অব চেরিয়াচান সিনেমার শেষদিকের ‘অ্যাসেন্ট’ শিরোনামের দৃশ্যটিতে একটি নারকেল গাছের মাথায় অভিনেতাটির চড়ে বসার লং-শটটি, এবং আপনাদের নিশ্চয় মনে আছে, এই একই সিনেমায় চেরিয়াচানের মা যে নিজ মৃত্যুর ঠিক পরপর সমাধিক্ষেত্রে স্বগতোক্তির মাধ্যমে নিজ জীবনকাহিনি বর্ণনা করে– যেন ইউনিক ন্যারেটিভ টেকনিকগুলোর মধ্যে একটি ইউনিভার্সেল ভিশনের দেহরূপ গঠনের জন্য এ সবই দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি শরীরের অন্তঃস্থলে, আত্মার মতো। মৃত ও জীবন্তকে যে শিল্পীরা লালন করেছেন, উত্তেজনা ও নিরুত্তেজের প্রশ্নে প্রশ্রয় ও মমত্বের অভিন্ন প্রখরতা আর কারও কাজে পাওয়া যাবে না– জন ছাড়া। ডাঙ্কি ইন দ্য ব্রাহ্মণ গেটোর সেই দৃশ্য, যেখানে লাশঘরে একটি কফিনের ঢাকনাটির খুলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে বারংবার অনাবৃত হয়ে যাওয়া মৃতদেহটি এবং রিপোর্ট টু মাদার-এর অনাগত শিশুটি– স্পষ্টতই আমার ওপরের কথাটির প্রমাণ।

…তার জীবন ছিল
কোনো
পরাবাস্তব দৃশ্যকল্পের
কোনো
গোলকধাঁধার মতো…
তার লাগামহীন ও নিঃসঙ্কোচ লাইফস্টাইল, এবং এর রক্ত ও ঘাম শুষে নেওয়া শিল্প– পুনরুদ্ধার-অসাধ্যভাবে ও অবধারিতরূপে নিয়তির সঙ্গে একাকার হয়ে গিয়েছিল। তার জীবন ছিল কোনো পরাবাস্তব দৃশ্যকল্পের কোনো গোলকধাঁধার মতো, যেখানে ট্র্যাজেডির একটি থিয়েট্রিক্যাল পরিবেশনার গুজব আগে থেকেই হুঁশিয়ারি দিলেও গৃহীত হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়েছে নির্দয়ভাবে। আমরা এখন সেটিকে একটি ঝাঁকুনি সহকারে উপলব্ধি করি। যখন তিনি কালিকুট মেডিক্যাল কলেজের লাশঘরে অজ্ঞাতনামা হিসেবে ছন্নছাড়ার মতো দিনের পর দিন পড়ে রইলেন, সেই জন যে নিজেরই জীবন থেকে নিজেকে রিপোর্ট টু মাদার-এ অবলম্বন করে যাননি– এ কথা কখনো কী করে বলতে পারি আমরা? জীবনের গোলকধাঁধাকে প্রথমে শিল্পের ও তারপর স্বয়ং জীবনের এবং এমনকি মৃত্যুর মধ্যেও চুইয়ে দেওয়া এই ধীমানটির অনেক কিছুই এখনো অজানা পড়ে রয়েছে অন্ধকারে।

জন ছিলেন একজন অমোঘ পর্যটক– কোনো রকম জিনিসপত্র ছাড়াই, বেশিরভাগ সময় স্রেফ এক কাপড়ে। সচেতন কিংবা অবচেতন পর্যায়, প্রমত্ত কিংবা প্রশান্ত, দলবদ্ধ কিংবা একা– সর্বত্রই পাওয়া যাবে খুঁজে জন’কে। আমরা দুজন একসঙ্গে কেবল একবারই বিদেশভ্রমণ করেছিলাম– ইতালিতে, পেসসারো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের জন্য।
…শোয়ের শেষে ও ডিনারে
যখন বাকি সবাই নিজেদের
বেডরুমে ফিরে গিয়ে উষ্ণতা
নিতো, এই মানুষটি তখন
থাকতেন পূর্ণজাগ্রত, আর হেঁটে
বেড়াতেন শহরজুড়ে– সেটির
নৈশজীবন থেকে ছন্দ, শব্দ
ও উপাদান নিংড়ে
নেওয়ার উদ্দেশে…
ওদিসা [ওদিসা ছিল একটি আভাঁ-গার্দ ফিল্ম মুভমেন্ট– যেটি অর্থবহ সিনেমার জন্য রসদের ব্যবস্থা করত এবং সারাদেশে ফিল্ম সোসাইটি ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে নিয়োজিত ছিল] সংগঠকরা তাকে যে এক জোড়া নতুন জুতা এনে দিয়েছিল, সেটি তার পায়ের মাপের ছিল না। তবু সেগুলো পরেই মুম্বাই এয়ারপোর্টে হেঁটে গেছেন তিনি। বিমান ছাড়তে তখন মাত্র কয়েক মিনিট বাকি, আমরা খেয়াল করে দেখলাম, ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স নেননি জন; তাকে না যাওয়ার জন্য নিরুৎসাহিত করা হচ্ছিল; অবশেষে বিমানে ওঠাতে সাহায্য করতে উচ্চপদস্থ কর্তৃপক্ষ যখন তাকে একপাশে নিয়ে এলেন, সে দৃশ্যগুলো ভোলার মতো নয়। পেসসারোর হাড় কাঁপানো শীতের ভয়ে সবাই যেখানে পশমী পোশাক সঙ্গী করেছিল, সেখানে জনের পরনে ছিল সুতির কাপড়; সেটির ওপর পরার জন্য আমি একটি সুয়েটার দিতে চাইলেও নেননি তিনি। শোয়ের শেষে ও ডিনারে যখন বাকি সবাই নিজেদের বেডরুমে ফিরে গিয়ে উষ্ণতা নিতো, এই মানুষটি তখন থাকতেন পূর্ণজাগ্রত, আর হেঁটে বেড়াতেন শহরজুড়ে– সেটির নৈশজীবন থেকে ছন্দ, শব্দ ও উপাদান নিংড়ে নেওয়ার উদ্দেশে। পেসসারোতে আমাদের সাতদিন থাকার কথা থাকলেও, জন ছিলেন প্রায় চৌদ্দদিন। কয়েকদিনের মধ্যেই আমরা বুঝে গিয়েছিলাম, এই ইতালীয় শহরটিতে আমরা যারা অংশগ্রহণকারী– তাদের মধ্যে জনই সবচেয়ে জনপ্রিয়, বিখ্যাত ও পছন্দের মানুষ। এটি অর্জন করতে ইতালিয়ান ভাষা ব্যবহার করার প্রয়োজন পড়েনি তার।

প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণ ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল আয়োজনের জন্য ইতালি বিখ্যাত। প্রতিটি শহরেই একাধিক ফেস্টিভ্যাল আয়োজিত হয়ে থাকে। যতদূর আমি জানি, সেগুলোর অন্তত ডজন-খানেক থেকে আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন জন। তারুণ্যময় ও উদ্যমী আয়োজকরা চাইতেন, জনের সিনেমা যদি হাতের কাছে না-ও থাকে, তবু যেন তিনি হাজিরা দেন। পেসসারোতে ডাঙ্কি ইন দ্য ব্রাহ্মণ গেটোর প্রদর্শনীর পর জন যখন মঞ্চের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন সিনেপ্রেমীদের প্রশ্নের জবাব দিতে, তখন নিজের বুকের ওপর হাত ভাঁজ করে রেখে, দম আটকে, তার দিকে তাকিয়ে থাকা মধ্যবয়সী দীপ্তিময় চেহারার বার্টেন্ডারের যে ছবিটি আমি দেখেছি– সত্যি অবিশ্বাস্য। সেই জাদুকরি মুহূর্তটির কথা আমি কোনোদিনই ভুলতে বা মন থেকে মুছতে পারব না।
ফেস্টিভ্যালের শেষ দিন, রোম ভ্রমণের জন্য একটি গাড়ি দেওয়া হয়েছিল আমাদের। শহরটি যেন জন’কে ঘুরিয়ে দেখাতে পারি, সেজন্য গাড়িটি সারাদিন সঙ্গে রাখার অনুমতি আমি নিয়ে রেখেছিলাম। যেহেতু এর আগে সেখানে তিনবার গিয়েছি, ফলে এই দায়ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলাম আমি। এর পরের ছবিগুলো আমি মনে গেথে রেখেছি। ভ্যাটিকানের সেন্ট পিটার’স বাসিলিকার ভেতরে ঢুকে এবং শত-শত বছরের ঘনীভূত জাদুময়ী, দেদীপ্যমান ও পবিত্র মহিমায় প্রাণভরে দম নিয়ে, চোখে-মুখে গর্ব ও এক ধরনের দুষ্টুমির ইশারা ফুটিয়ে জন স্বীকার করে নিয়েছিল :
“এখানে দাঁড়িয়ে যদি কোনো খ্রিস্টান মরদ খানিকটা ধৃষ্টতা অনুভব করে, আপনি তাকে দোষ দিতে পারবেন না কিছুতেই।”
…কে তোমাকে
মরে যেতে বলেছে,
প্রিয় জন?…
জার্নিটির জয়জয়কার এবং পূর্ণতা ও সন্তুষ্টির নির্মেঘ পবিত্রতা আমার দিকে তার [জনের] মুচকি হাসি দিয়েছিল ছড়িয়ে। পরে আমি বুঝতে পেরেছি, পেসসারো ছিল জনের জন্য একটি বড়মাপের প্রাণশক্তি অর্জন। এরপরই তিনি রিপোর্ট টু মাদার-এর কাজ শেষ করেছেন। প্রোডাকশনের প্রতিটি স্তরে প্রচুরসংখ্যক এক্সপেরিমেন্ট করেছেন তিনি। রোজেল্লিনির [রোবের্তো রোজেল্লিনি; ফিল্মমেকার, ইতালি] ছেলে জিল-সহ আরও কতজনকে যে জন কথা দিয়ে এসেছিলেন, নতুন সিনেমা নিয়ে ফিরে আসার? আমি-সহ প্রত্যেকেই– যারা তাকে গ্রাহ্য করতাম, আমরা সত্যিকারঅর্থেই বিশ্বাস করেছিলাম, শৈল্পিক উপক্রমের একটি নতুন ধাপে তিনি কেবলই প্রবেশ করেছেন। মালায়ালাম সিনেমার জন্য দুর্ভাগ্য, ভাগ্য বলে যেটিকে ডাকা হয়– যেটির ওপর কিছু মানুষের বিশ্বাস আছে, আবার কারও কারও নেই– সেটি তা হতে দিলো না।

দীর্ঘ বিরতি শেষে জন একবার আমার বাসায় হাজির হলেন আবারও। আমার মেয়েকে বললেন :
“কে তোমাকে বড় হয়ে যেতে বলেছে, শুনি?”
উত্তরে তাকেই আমি জিজ্ঞেস করতে যদি পারতাম :
“কে তোমাকে মরে যেতে বলেছে, প্রিয় জন?”
গ্রন্থসূত্র : সিনেমা, লিটারেচার অ্যান্ড লাইফ/আদুর গোপালকৃষ্ণন
[…] তাহলে শ্যাম বেনেগালকে কোথায় রাখব? আদুর গোপাল কৃষ্ণান বা অরবিন্দম, তাদের ছবিতে কী রস, তা পাব […]