মূল : জোসেফ ফাহিম । অনুবাদ : রুদ্র আরিফ
২০১৬ সালের কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের [ফ্রান্স] ব্যবচ্ছেদ করতে গিয়ে, বিশ্লেষকেরা উজ্জ্বল অনুপস্থিতি লক্ষ্য করেন বর্তমান ফরাসি বিতর্কগুলোর সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক থিমটির : এ বছরের নভেম্বরে প্যারিসে সন্ত্রাসবাদী হামলার পর ফ্রান্স ও আরববিশ্বের মধ্যকার সম্পর্কটির কথা বলছি। কান ফেস্টিভ্যাল হয়ে রয় একটি বর্জনকারী ক্লাব, দুনিয়ার সবচেয়ে বিশিষ্ট ফিল্মমেকারদের জন্য থাকে হয়ে ‘প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত’– এদের অধিকাংশই আবার কানের এলামনাই– কেন লোচ [১৯৩৬-; যুক্তরাজ্য], অলিভিয়্যে অ্যাসায়াস [১৯৫৫-; ফ্রান্স], পেদ্রো আলমোদোভার [১৯৪৯-; স্পেন], ক্রিস্তিয়ান মুনজিও [১৯৬৮-; রোমানিয়া] প্রমুখ। উৎসবটির নানাবিধ সাইডবার তৈরি করেছিল এই বিভ্রান্তিটির– দশটি প্যান-আরব ফিল্মের প্রদর্শনী, যেগুলোর অধিকাংশই দ্বিতীয় প্রজন্মের ফ্রেঞ্চ-আরবদের বানানো।
এ বছরের কানে আরব প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেওয়া সিনেমা– মিসরীয় ফিল্মমেকার মোহাম্মদ দিয়াবের [১৯৭৮-] ক্ল্যাশ; ২০১৩ সালে মিসরে মোহাম্মদ মোরশির [সাবেক রাষ্ট্রপতি] পরাজয়কে অনুসরণ করা একটি পুলিশের গাড়িকে সম্পূর্ণ কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছে নানাবিধ চরিত্রের নাটকীয়কতার এ সিনেমা। দিয়াবের সঙ্গে এ আসরে যোগ দিয়েছেন ফিলিস্তিনি ফিল্মমেকার মাহা হাজ [১৯৭০-], তার অভিষেক ফিচার ফিল্ম পারসোনাল অ্যাফেয়ারস নিয়ে; দাম্পত্যজীবন নিয়ে জর্জরিত, স্বপ্নভঙ্গের শিকার ও নির্বাসিত তিনটি আলাদা প্রজন্মের তিন দম্পতিকে ঘিরে একটি পারিবারিক নাটকীয়তার কাহিনি এটি। উৎসবের ডিরেক্টরস’ ফোর্থনাইট সাইডবারে ফরাসি-মরোক্কান ফিল্মমেকার হুদা বেনিয়ামিনা [১৯৮০-] হাজির করেছেন ডিভাইনস সিনেমাটি; একটি মুসলিম অধ্যুষিত শহরতলিতে একজন অদম্য তরুণী মাদকবিক্রেতাকে ঘিরে এ এক কমিক ড্রামা। অন্যদিকে, অভিনেতা থেকে ফিল্মমেকার হয়ে ওঠা ফরাসি-আলজেরিয়ান– রশিদ জায়দানি [১৯৭৪] তার ২০১২ সালের প্রশংসিত ড্রামা-ফিল্ম হোল্ড ব্যাক-এর ধারাবাহিকতায় এবার হাজির করেছেন ফ্রেঞ্চ ট্যুর [Tour de France]; নিজের ফরাসি সুইমিং-টিচারের সঙ্গে একজন অল্পবয়সী আরব র্যাপারের সম্পর্ক ঘিরে এর কাহিনি। ক্রিটিকস’স উইক সেকশকে লেবাননী ফিল্মমেকার ভাৎসে বুলগোরিয়ান [১৯৭৫-] হাজির করেছেন নিজের অভিষেক সিনেমা– ত্রামোঁতানে [Tramontane]; হারানো জন্ম-তথ্যের খোঁজে লেবাননের গ্রাম্যাঞ্চল চষে বেড়ানো একজন অন্ধ মিউজিশিয়ানকে নিয়ে এই রোড-মুভিটি।
…দুনিয়ার সবচেয়ে
মর্যাদাপূর্ণ ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল
হিসেবে গণ্য হওয়া এ উৎসবের
একেবারেই যাত্রাশুরুর সময়
থেকেই, এর ওপর
আরব সিনেমার একটি
অনস্বীকার্য প্রভাব পড়েছে ও
গুরুত্ব রয়েছে…
আরব কাহিনিগুলোর ওপর ফোকাস করার ক্ষেত্রে বার্লিনালের [বার্লিন ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, জার্মানি] পদচিহ্ন অনুসরণ করেছে কান : বহুকাল পর অবশেষে আরব সিনেমার ক্রমবর্ধমান লক্ষণীয়তার পর্যবেক্ষণের এক ইশারা এ যেন। কানে একটি অঞ্চলের পৌনঃপুনিক উপস্থাপনের ইতিহাসটির দিকে গভীরভাবে তাকালেই বোঝা যায়, দুনিয়ার সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল হিসেবে গণ্য হওয়া এ উৎসবের একেবারেই যাত্রাশুরুর সময় থেকেই, এর ওপর আরব সিনেমার একটি অনস্বীকার্য প্রভাব পড়েছে ও গুরুত্ব রয়েছে। কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে এ পর্যন্ত [২০১৬ সালের হিসেবে] প্রদর্শিত আরব সিনেমাগুলোর মধ্য থেকে সেরা ১০-এর এ তালিকাটি তৈরি করা হলো থিম, নন্দনতত্ত্ব ও ন্যারেটিভের ওপর ভিত্তি করে। লুক্কায়িত মাস্টারপিসগুলোর একটি উজ্জ্বলতর বৈচিত্রময় গ্রুপ নিশ্চিতভাবেই রয়েছে আবিষ্কারের অপেক্ষায়, যে গ্রুপটি একটি সুপ্রসারিত, ঋদ্ধ, ও ব্যাপকভাবে শ্রেণিকরণ-উর্ধ্ব সিনেমার এক এন্ট্রি পয়েন্টের প্রতিনিধিত্ব করে।

১০.
দ্য সিন
Al Haram । হেনরি বারাকাত । মিসর । ১৯৬৫
নারী-প্রধান মেলোড্রামা ফিল্মের তুখোড় মিসরীয় মাস্টার ফিল্মমেকার হেনরি বারাকাত [১৯১৪-১৯৯৭] কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে নিজের অদ্বিতীয় উপস্থিতি ঘটিয়েছিলেন ধর্ষণের শিকার হওয়া এবং পরবর্তীকালে গর্ভবতী হয়ে পড়ার বিষয়টি নিজ নিন্দাপ্রিয় শহুরে মানুষগুলোর কাছ থেকে লুকাতো বাধ্য হওয়া একজন পরাভূত ও লজ্জাপীড়িত কিষাণীর ওপর ভিত্তি করা এই সহসাই-সচকিত করে দেওয়া ও অপ্রতিহত নীতিবাদী কাহিনিটি নিয়ে। কেন্দ্রীয় চরিত্রে আরব সিনেমার কিংবদন্তি অভিনেত্রী ফাতেন হামামার [১৯৩১-২০১৫; মিসর] আবেগাত্মকভাবে নিজের সবচেয়ে উন্মুক্ত পারফর্মগুলোর একটির নেতৃত্বে, বারাকাতের সবচেয়ে দাপুটে সিনে-প্রত্যাখ্যানগুলো ফুটে উঠেছে এ সিনেমায় : আশাহত এক নির্দয় দুনিয়ার উৎপীড়নের প্রতি একটি নিয়ন্ত্রিত ও গোথিক-ধর্মী মিজ-আন-সিনের প্রতিফলন ঘটাতে গিয়ে তিনি অভ্যস্ত ধীরগতির পথ থেকে সরে এসেছেন এখানে। দাম্পাত্যজীবনের নিবিড় আবেগকে ফুটিয়ে তোলার বেলায়, মিসরীয় ড্রামা-কাহিনির ক্ষেত্রে ভীষণ শিল্পদক্ষতা ও সুতীক্ষ্ণ সমাজভাষ্যের মাধম্যে বিরল এক উদাহরণ হয়ে আছে দ্য সিন।

৯.
দ্য স্মল স্ট্রেঞ্জার
Le Petit Étranger । জর্জেস নাসের। লেবানন। ১৯৬২
লেবানিজ সিনেমার প্রতিষ্ঠাতা-জনক জর্জেস নাসের [১৯২৭-] দ্বিতীয়বারের মতো পাম দি’অর-এর নমিনেশন পেয়েছেন যে সিনেমাটির জন্য, সেটির কাহিনি ভবিষ্যৎকালের এক আদর্শবাদী তরুণকে ঘিরে– লেবাননের গৃহযুদ্ধপূর্ব সময়ের দুর্নীতিগ্রস্ত সংস্কৃতিতে নিমগ্ন হওয়ার আগে যে পাইলট হওয়ার নিজ স্বপ্নটিকে পরিত্যাগ করে। কানের সর্বোচ্চ পুরস্কারটির জন্য মনোনীত প্রথম অ-মিসরীয় আরব ফিল্মমেকার ছিলেন এই নাসের, যার কাজগুলোর কথা এখন বলতে গেলে প্রায় সবাই ভুলেই গেছে! অনেকের মতেই, দ্য স্মল স্ট্রেঞ্জার তার সবচেয়ে চমৎকার সৃষ্টি; ১৯৬০ দশকের অন্ধের মতো উচ্চাকাঙ্ক্ষী লেবানিজ সমাজের ওপর এ এক মনোমুগ্ধকর বিবৃতি; এবং লেবানিজ আত্মার গভীরে একটি নিগূঢ় ও অন্তর্মুখী অনুসন্ধান।

৮.
অন দ্য এজ
Sur la planche । লায়লা কিলানি । মরোক্কো । ২০১১
মরোক্কান ডকুমেন্টারিয়ান লায়লা কিলানি [১৯৭০-] ন্যারেটিভ ফিল্মমেকিংয়ে পা বাড়িয়েছেন ক্যাসাব্লেঙ্কা শহরের অপরাধজগতে নিজেদের নিমজ্জিত করে ফেলে অল্পবয়সী দুই নারী কারখানা-শ্রমিকের ওপর এই সাহসী ও বিচার-উর্ধ্ব জীবনখণ্ডের ক্রাইম-ড্রামাটির মাধ্যমে। অপেশাদার অভিনেতাদের ব্যবহার এ সিনেমায় কিলানির সেইসব বহুবিধ অলংকারের একটি– যা ফিকশন ও রিয়েলিটির মধ্যকার সীমারেখাটিকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ব্লার বা ঝাপসা করে দিয়ে মরোক্কোর হাজার বছরের সংগ্রামের একটি অকৃত্রিম ও দাপুটে প্রতিকৃতি এঁকে দিয়েছে– নয়া-বিশ্বায়িত-দুনিয়াটিতে নিজের জায়গা ও আত্মপরিচয় খুঁজে পাবার প্রশ্নে।

৭.
ম্যান অব অ্যাশেজ
Rih essed । নুরি বাউজিদ । তিউনিসিয়া। ১৯৮৬
তিউনিসিয়ার ঝানু ফিল্মমেকার নুরি বাউজিদ [১৯৪৫-] নিজের এই ব্যাপক বিতর্কিত অভিষেক সিনেমাটি দিয়ে তিউনিসিয়ান সিনেমাকে বিশ্ব-সিনেমায় মানচিত্রের শীর্ষবিন্দুতে এনে দাঁড় করিয়েছেন। পুরনো মনিবের যৌননিপীড়নের প্রভাবে নিজ জীবন ও আসন্ন দাম্পত্যজীবনকে দূষিত করে ফেলা এক তরুণ ছুতারমিস্ত্রীর কাহিনি এটি। আন সার্টেন রিগার্ড বিভাগে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা বাউজিদের সংবেদনশীল, উত্তেজক ও ক্রুদ্ধ এ সিনেমাটি হাজার বছরের পুরুষতান্ত্রিক আরব মিথ’কে ভেঙ্গে ফেলে, তিউনিসিয়ার কর্দমাক্ত যৌন-রাজনীতির একটি অসাড় করে দেওয়ার মতো নীতিগর্ভমূলক রূপককাহিনি জাহির করেছে, এবং আরব সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় ট্যাবুগুলোর একটি দিয়েছে চূর্ণ করে।

৬.
ক্রনিকলস অব দ্য ইয়ারস অব ফায়ার
Waqāʾiʿu sinīna l-jamri । মোহাম্মদ লাখদার-হামিনা । আলজেরিয়া । ১৯৭৫
আলজেরিয়ার মুক্তিযুদ্ধের ওপর স্বদেশে নির্মিত প্রথম বড়মাপের এ ইতিহাসনির্ভর প্রোডাকশনটির মাধ্যমে, মার্টিন স্করসেজি [১৯৪২-; যুক্তরাষ্ট্র], ভের্নার হেরজোগ [১৯৪২-; জার্মানি] ও মিকেলাঞ্জেলো আন্তোনিওনির [১৯১২-২০০৭; ইতালি] মতো মাস্টার ফিল্মমেকারদের হারিয়ে, সমগ্র আরব সিনেমাকে প্রথমবারের মতো পাম দি’অর পদক এনে দিয়েছেন আলজেরিয়ান বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর মোহাম্মদ লাখদার-হামিনা [১৯৩৪-]। একজন অবনমিত হালচাষী ও একজন দ্রষ্টাধর্মী গ্রাম্যপাগলের সমান্তরাল বিবেচনার ভেতর দিয়ে, অস্ত্র হাতে আলজেরিয়ানদের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বাধ্য হওয়ার কারণগুলো লাখদার-হামিনার সবচেয়ে স্মরণযোগ্য এ কাজটিতে বর্ণিত হয়ে আছে হলিউড এপিক সিনেমাগুলোর ছদ্মাবরণে একটি সোভিয়েত বিত্তহীন শিল্পকর্ম হিসেবে যেন। মুক্তি পাবার পরপর ফরাসি ডানপন্থিদের ভয়ঙ্কর আক্রমণের শিকার হলেও, ফিল্মটি হয়ে আছে আরব সিনেমার ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি সৃষ্টিকর্ম।

৫.
আউট অব লাইফ
Hors la vie । মারোউন বাগদাদি । লেবানন । ১৯৯১
লেবাননের গৃহযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত সিনেমাগুলোর মধ্যে জিয়াদ দুয়েইরির [১৯৬৩-; লেবানন] ওয়েস্ট বৈরুতই [১৯৯৮] সম্ভবত সবচেয়ে বিখ্যাত; তবে প্রয়াত মারোউন বাগদাদির [১৯৫০-১৯৯৩], জুরি প্রাইজ বিজয়ী আউট অব লাইফ সিনেমাটি তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি পরিপক্ক। বৈরুতে একজন লেবানিজ মিলিশিয়ার হাতে অপহৃত ও নির্যাতিত হওয়া এক ফরাসি ফটোগ্রাফারের সত্য ঘটনার ওপর ভিত্তি করে এ কাহিনিটি যুদ্ধ ও পুরুষতান্ত্রিকতার ওপর বাগদাদির প্রামাণ্য এক দলিল– যে থিমটি কিনা এ ফিল্মমেকারের শিল্পস্বরেরই প্রতিনিধি। সংঘাতের দিনগুলোতে সাংবাদিকতার ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এ ফিল্মমেকার, একটি দেশের একেবারেই উন্মত্ততায় পর্যবসিত হওয়ার নৈরাজ্য ও দ্বিধা-দ্বন্দ্বকে দুর্দান্তভাবে ক্যামেরাবন্দি করেছেন। মুক্তির প্রায় ২৫ বছর পরও, আউট অব লাইফ হয়ে আছে সেই ট্রাজেডিটির বিশুদ্ধ ডকুমেন্ট– যেটি লেবানিজদের মনস্তত্ত্বকে এখনো তাড়িয়ে বেড়ায়।

৪.
দ্য সাইলেন্সেস অব দ্য প্যালেস
Samt el qusur । মুফিতা তলাৎলি । তিউনিসিয়া । ১৯৯৪
এডিটর থেকে ফিল্মমেকার হয়ে যাওয়া তিউনিসিয়ান মুফিতা তলাৎলি [১৯৪৭-] তিউনিসিয়ায় ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসনের শেষে একটি অভিজাত পরিবারে বেড়ে ওঠা এক গৃহকর্মীর কিশোরী কন্যাটির [এ চরিত্রেই পর্দায় অভিষেক ঘটে মেগাস্টার হেন্দ সাবরির (১৯৭৯-; মিসর)] ওপর এই রহস্যময় ও অস্পষ্ট কাহিনিটির মাধ্যমে আর্ট-হাউস দুনিয়ায় ঝড় তুলেছেন। নারীর অধীনতা, ক্ষমতায়ন ও আত্মত্যাগের ওপর একটি মর্মস্পর্শী ধ্যানের মাধ্যমে সৃষ্ট তলাৎলির এই সৃষ্টিকর্ম ভয়াবহ রকমের হিট হয়েছিল; দেশি সিনেমা-হলে ত্রিশ লক্ষাধিক দর্শক দেখেছেন ফিল্মটি– যা কিনা তিউনিসিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় হিট সিনেমার একটি। সিনেমাটিকে এখন আরব সিনেমার বেঞ্চমার্ক [উন্নতির চিহ্ন] হিসেবে গণ্য করা হয়; আর এটি তলাৎলির নাম এ অঞ্চলের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাববিশিষ্ট নারী ফিল্মমেকার হিসেবে নিরন্তর জায়গা করে দিচ্ছে।

৩.
ডিভাইন ইন্টারভেনশন
Yadon ilaheyya । এলিয়া সুলেইমান । ফিলিস্তিন । ২০০২
ফিলিস্তিনি যাযাবর এলিয়া সুলেইমান [১৯৬০-] হলেন সবচেয়ে খাঁটি আরব ফিল্মমেকার; এবং ডিভাইন ইন্টারভেনশন হয়ে আছে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে রেডিক্যাল আরব সিনেমাগুলোর একটি। ২০০০ সালে সেকেন্ড ইন্তিফাদার [ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি গণবিদ্রোহ] ঠিক পরপরের ঘটনাকে ধারণ করা, জুরি প্রাইজজয়ী সুলেইমানের এই সিনেমাটি অপূর্বভাবে সন্নিবিষ্ট ইন্টারকানেকটেড খণ্ডচিত্রগুলোর সঙ্গে ন্যারেশনকে ছড়িয়ে দিয়েছে– যেখানে অ্যাকশন ও সাউন্ড সুনিপুণভাবে একাকার করে তুলেছে ইসরাইলি-ফিলিস্তিনি সংঘাতের নিছক অর্থহীনতাকে। তার আগের কাজগুলোর তুলনায়, এটির টোন ভীষণ ক্রুদ্ধা, এটির হিউমার খুব তিক্ত, এবং ইমেজারি ভীষণ কল্পনাশক্তিপূর্ণ, বুনো ও পরাবাস্তব। দখলদারিত্বের প্রকৃত নির্যাসকে ধারণ করার ক্ষেত্রে এ সিনেমাটির মতো বুদ্ধিবৃত্তি, দ্যুতি ও প্রাণশক্তিতে তেজে ভরা একেবারেই একটি সত্যিকারের অনন্য শিল্পকর্ম হয়ে ওঠতে সফল হওয়া সিনেমার সংখ্যা প্রকৃতঅর্থে সামান্যই।

২.
দ্য ল্যান্ড
Al-ard । ইউসেফ শাহিন । মিসর । ১৯৬৯
আরববিশ্বের সবচেয়ে সুপরিচিত ফিল্মমেকার, কিংবদন্তি ইউসেফ শাহিন [১৯২৬-২০০৮] মূলত ১৯৫৮ সালের মাস্টারপিস সিনেমা– কায়রো স্টেশন-এর জন্য বেশি খ্যাতিমান হলেও, গ্রাম্যজীবনের মহাকাব্যিক– দ্য ল্যান্ড প্রকৃতঅর্থে আরবিশ্বে তার সবচেয়ে ভালোবাসার সিনেমা হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। আবদুররহমান সরকাইয়ির লেখা, ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত মার্ক্সবাদী উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এ সিনেমায় ১৯৫২ সালের মিসর-বিপ্লবের প্রাকমুহূর্তের প্রেক্ষাপটে, পানির প্রবাহমানতা নিয়ে পৈশাচিক ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে স্বল্পকালীন কৃষকের ভূমিকায় নিজের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনয়ক্ষমতার প্রদর্শন করেছেন প্রয়াত কিংবদন্তি অভিনেতা মাহমুদ আল-মেলেগি [১৯১০-১৯৮৩; মিসর]। দৈনন্দিন কৃষিজীবনের বিশেষত স্বতন্ত্র রকমের বিশদ অলংকরণের মধ্য দিয়ে প্রকাশ্য অবাধ্যতা ও দমনপীড়ন সম্পর্কে এক দাপুটে রূপকধর্মী কাজ হয়ে ওঠা দ্য ল্যান্ড বস্তুত শাহিনের সবচেয়ে চমৎকারভাবে দৃশ্যবন্দিকৃত সিনেমাও বটে : ল্যান্ড বা জমিনের প্রতি ভালোবাসার এক হৃদয়বিদারক বন্দনা এখানে ১৯৬৭ সালে ইসরায়েলের কাছে যুদ্ধে হেরে যাওয়ার প্রেক্ষিতে সবাইকে একত্রিত হওয়ার আহবানই জানিয়েছে মূলত।

১.
লাস্ট নাইট
Al-Laylah al-Akheera । কামাল আল শেখ । মিসর। ১৯৬৪
কামাল আল শেখকে [১৯১৯-২০০৪] সবাই একনামে মিসরীয় হিচকক বলে ডেকে থাকেন। আরব সিনেমার এই একক ব্যক্তিত্বটির সিনেমাগুলো আরববিশ্বের বাইরে না দেখানোটাকে অনেকেই অপরাধ হিসেবে গণ্য করেন। ১৯৫৫ সালে বানানো তার শ্বাসরুদ্ধকর থ্রিলার– লাইফ অর ডেথ [Hayat ou maut] ছিল স্টুডিওর বাইরে শুটিংকৃত প্রথম মিসরীয় সিনেমা; সেটিই তার সবচেয়ে প্রশংসিত কাজ, যা কিনা কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের মূল প্রতিযোগিতা বিভাগে জায়গা করে নিয়েছিল; তবে তার এই মনোমুগ্ধকর মাস্টারপিসটি [লাস্ট নাইট] বস্তুত মনস্তাত্ত্বিক রহস্যকাহিনির এক নিকষ-নিখুঁত উদাহরণ। এ সিনেমায় ফাতেন হামামা অভিনয় করেছেন এক মধ্যবয়সী নারীর চরিত্রে– যে একদিন ঘুম থেকে উঠে নিজেকে আবিষ্কার করে ১৫ বছর বয়সী কিশোরীর রূপে, এবং বিয়ে করে নিজের দুলাভাইকে। কেন ও কীভাবে তার এমন পরিস্থিতি হলো– ২ ঘণ্টা রানিংটাইমের এই ফিল্মটি সে কাহিনিরই ভাঁজ খুলতে থাকে যুদ্ধের ট্রমা, দুর্দশা ও ক্ষতির ওপর একটি বহুস্তরি অনুসন্ধানের ভেতর দিয়ে। নিজের সৃজনশৈলীর এক বিস্ময়াভিভূতকর নিয়ন্ত্রণের চূড়ান্ত খেলা দেখিয়ে, এ ফিল্মমেকার লাস্ট নাইটকে পরিণত করেছেন মিসরীয় ক্ল্যাসিকেল সিনেমার এক দুর্দান্ত উদাহরণে– যে ধারার সঙ্গে পশ্চিমা ক্লাসিকের কোনো মিল নেই। বরং গভীরতর অনুভবক্ষম, অতিশয় কুশলী ও ব্যাপকভাবে বিনোদনমূলক এই স্টুডিও ফিল্মটি হয়ে আছে চিরনতুন ও চির পরাক্রমশালী।
জোসেফ ফাহিম । সিনে-সমালোচক, মিসর সূত্র । দ্য মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউট । তথ্য ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান; যুক্তরাষ্ট্র । ১৮ মে ২০১৬