সাক্ষাৎকার । ওমর শাহেদ
সিনেমার পোকা ছিলেন। সে ভালোবাসা থেকেই অভিনয় করেছেন বাংলাদেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশ-এ [১৯৫৬]। প্রথম বাংলা ছবির অন্যতম নায়িকা পিয়ারী বেগমের কথা বলছি। ২০ মে ২০১৬, ঢাকার উত্তরায় আলাপ হলো তার সঙ্গে…
ওমর শাহেদ
অভিনয়ে আগ্রহ কীভাবে হলো?
পিয়ারী বেগম
ছোটবেলায় আমরা থাকতাম পুরনো ঢাকার আগামসি লেনে। কোথাও গান, নাচ, থিয়েটার হবে জানলে ওদের সঙ্গে অংশ নিতাম। সমবয়সী পাড়া-প্রতিবেশী মিলে স্টেজ বানিয়ে নাটক করতাম। মা-বাবা, অভিভাবকরা দেখতেন। উৎসাহই দিতেন; খুব একটা আপত্তি করতেন না। আমার অভিনয়ের দিকে আকর্ষণ ছিল। টিকাটুলির কামরুন্নেসা গার্লস হাই স্কুলে এইটে পড়ার সময় একদিন খবরের কাগজে দেখলাম, টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে আরপি [রণদাপ্রসাদ] সাহার ভারতেশ্বরী হোমসে সাইকেল চালানো শেখায়, প্যারেড শেখানো হয়, নাটকও হয়। নাইনে ভর্তি হলাম। হোস্টেলে থাকতাম। খুব আগ্রহ নিয়ে রিহার্সালে যেতাম। প্রতি বছর দুর্গাপূজায় নাটক হতো। সেখানে নটীর পূজাসহ কয়েকটি নাটকে প্রধান চরিত্র, পার্শ্ব চরিত্র করেছি। আরপি সাহা নাটক খুব পছন্দ করতেন। তিনি খুব উৎসাহ দিতেন, ‘খুব ভালো করেছ।’ ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে ঢাকায় চলে এলাম। ইন্টারমিডিয়েটে ইডেন কলেজে ভর্তি হলাম। কলেজে অবশ্য তেমনভাবে নাটকে যুক্ত ছিলাম না।
ওমর শাহেদ
সিনেমা দেখার শুরু?
পিয়ারী বেগম
ছোটবেলায় সিনেমা দেখতে খুব পছন্দ করতাম। আগামসি লেন থেকে তাজমহল আর নিউ পিকচার হাউজ [সিনেমা-হল] খুব কাছে ছিল। তাজমহলেই সিনেমা বেশি দেখতাম। মহিলাদের আলাদা আসন ছিল। সিক্স-সেভেনে স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে যদি দেখতাম, মধুবালা, সুরাইয়া, নার্গিসের কোনো ছবি এসেছে, জেদ ধরে হলেও ছোট ভাইকে [আবদুল গফুর] নিয়ে সিনেমা দেখতে যেতাম। কখনো বান্ধবী জহরত আরা থাকত। সেও মুখ ও মুখোশ-এ ছিল, দারোগার বউ হয়েছিল। ওদের অভিনয় দেখে মনে মনে আফসোস করতাম দুজনে, ইশ, আমাদের এখানে যদি এ রকম হতো, আমরাও তো অভিনয় করতে পারতাম! ওদের মতো হলে গিয়ে সবাই আমাদের অভিনয় দেখত!

ওমর শাহেদ
কীভাবে মুখ ও মুখোশ-এর কথা জানলেন?
পিয়ারী বেগম
চিত্রালীতে বিজ্ঞাপন দেখি– [তৎকালীণ] পূর্ব পাকিস্তানে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হবে। তারা শিল্পী, নায়িকা খুঁজছেন। অফিসের ঠিকানাও আমাদের বাড়ির কাছেই– নবাব কাটরায়। একদিন দুই বান্ধবী, বান্ধবীর বাসায় যাব বলে বাসায় মিথ্যা বলে চলে গেলাম। ইকবাল ফিল্মসের অফিস খুঁজে বের করলাম। ভেতরে যাওয়ার পর দেখি, জব্বার সাহেব, ছবির ক্যামেরাম্যান কিউ. এম. জামান, শাহজাহান নামে তাদের সঙ্গের আরো একজন বসে আছেন। জব্বার সাহেব আমাদের এটা-সেটা জিজ্ঞেস করলেন। অভিনয় সম্পর্কেও জিজ্ঞেস করলেন। যেটুকু পারি, জানি, নিজেরা করেছি– বললাম। তারপর বললাম, কার্জন হলে নাটক মঞ্চস্থ হবে, তাতে সেকেন্ড হিরোইনের রোল করছি। কবে হবে জেনে তিনি দেখতে গিয়েছিলেন। বোধহয় রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী ছিল; চরিত্রের নাম ভুলে গেছি।
ওমর শাহেদ
আপনার অভিনয় তার পছন্দ হয়েছিল?
পিয়ারী বেগম
দেখে এসে তিনি বললেন, ‘তোমাকে ভালোই লেগেছে।’ আমাদের তো খুব টেনশন হাচ্ছিল, সিলেক্ট হলাম কী হলাম না, তিনি কিছুই তো বললেন না। তারা আরেক দিন ডেট দিলেন। আমরা আবার গেলাম। গিয়ে দেখি, কিউ. এম. জামান, জব্বার সাহেব, কলকাতা থেকে আসা ক্যামেরাম্যান মুরলি মোহন, সিনেমায় দাড়িওয়ালা ডাকাতের ভূমিকায় অভিনয় করা ইনাম আহমেদ সাহেব আছেন। তারা আমাদের প্রশ্নের পর প্রশ্ন করলেন।
ওমর শাহেদ
কী জিজ্ঞাসা করেছেন?
…সিনেমা দেখেই
আগ্রহ জন্মেছে। এখানে
সে রকম সুযোগ
ছিল না বলে
এতদিন
চুপচাপ ছিলাম…
পিয়ারী বেগম
‘অভিনয় কেমন লাগে, কীভাবে আগ্রহ জন্মেছে?’ আমরা বলেছি, সিনেমা দেখেই আগ্রহ জন্মেছে। এখানে সে রকম সুযোগ ছিল না বলে এতদিন চুপচাপ ছিলাম। জানতে চাইলেন, ‘অভিনয় করতে পারবে?’ বললাম, নির্বাচিত হলে পারব। পরে মুরলিবাবুকে পার্সোনালি বলেছি, ‘তারা তো কিছু বলেননি, আপনি কলকাতা থেকে এসেছেন, আপনি কী বলেন?’ তিনি বললেন, ‘তোমাদের ক্যামেরা-ফেস হবে কি-না– সে তো জানি না।’ তখন তাকে বললাম, ‘আমার তো বিশেষ করে সিনেমায় অভিনয়ের খুব ইচ্ছা। আমি কি সুইটেবল?’ তিনি জানালেন, ‘হ্যাঁ, ঠিক আছে। সত্যি বলতে কি, তোমাদের দুজনকে সিলেক্ট করার জন্য আমরা জব্বার সাহেবকে বলেছি।’ এবার অন্যরকম আগ্রহ দেখালাম, ‘আচ্ছা, অভিনয়ের এই অভিজ্ঞতা নিয়ে কি টালিগঞ্জে অভিনয় করতে পারব?’ তিনি বললেন, ‘দেখো, তুমি এখনো ছেলেমানুষ, জ্ঞানবুদ্ধিও অনেক কম। চলচ্চিত্র-জগৎটি খুব কঠিন। সেভাবে কাজ করতে চাইলে বড় হও। পড়াশোনা করো, জ্ঞানবুদ্ধি হবে; তখন দেখা যাবে। এসব চিন্তা এখন বাদ দাও। এখানে জব্বার সাহেব একটি ছবি করছেন, অভিনয় করো। তারপর দেখা যাবে।’ এই বলে তিনি সান্ত্বনা দিলেন। ফিরে এলাম। মাঝখানে অনেক দিন তারা যোগাযোগ করলেন না। ভাবলাম, আমাদের হয়তো তারা গুরুত্ব দিচ্ছেন না। এদিকে জহরত আরার ভাই মোসলেহ উদ্দিন মিউজিক ডিরেক্টর ছিলেন। তার সঙ্গে রেডিওর কর্মকর্তা মোবারক হোসেন খানের পরিচয় ছিল। তার ভাই নাকি চাচা বাহাদুর হোসেন খান বোম্বেতে মিউজিক ডিরেক্টর। একবার তিনি ঢাকায় বেড়াতে এলেন। তখন আমরা শুনেছিলাম, রাজ কাপুর নতুন মুখের খোঁজ করছেন। দুই বান্ধবী তাকে গিয়ে বললাম, ‘আমরা কী বোম্বেতে গিয়ে অভিনয় করতে পারব? বাহাদুর ভাই, বোম্বেতে গেলে আপনি তার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে পারবেন? আমরা অভিনয় করতে চাই।’ তিনি তো অবাক, ‘কীভাবে যাবে?’ বললাম, ‘বাসা থেকে অনুমতি নিয়েই যাব।’ তখন বললেন, ‘তিনি তো নতুন মুখ খুঁজছেন, বলা যায় না– যদি পছন্দ হয়, নিতেও পারেন।’ কিন্তু আমরা যে হিন্দি ভালোভাবে বলতে পারি না– তখনো এই জ্ঞানটি হয়নি!
ওমর শাহেদ
মুখ ও মুখোশ-এর কী হলো?
পিয়ারী বেগম
নবাব কাটরা থেকে ইকবাল ফিল্মস সেগুনবাগিচায় চলে গেল। ছবিতে অভিনয়ের জন্য নির্বাচিত হওয়ার পরেও আমরা কিন্তু বাসায় জানাইনি। কিছুদিন পরে চিত্রালী আমার, মানে নায়িকা রাশিদার পুরো পাতাজুড়ে ছবি ছাপাল। ছবিটি দেখে আব্বা [আবদুল মালেক] জিজ্ঞেস করলেন, ‘ছবিটি তো তোমার? কখন কী করলে না করলে, কিছুই তো জানতে পারলাম না। আমাদের সমাজে এ তো কেউ ভালো চোখে দেখে না। কাজটি যে করেছ, আমাকে জানাওনি, ঠিক করোনি। আমি তোমাকে পারমিশন দিচ্ছি না। পড়াশোনাই করো, এসব লাইনে যাওয়ার দরকার নেই।’ দু-একটি মঞ্চ নাটকে অভিনয় করতাম, তাতে তিনি খুব বাধা দিতেন না। রেডিওতে নাটক-প্রোগ্রাম করতাম, তাতেও বাধা দিতেন না। ওই আমলেও কোনোদিন বোরকা পরিনি। এখন যেমন, তখনো তেমন ছিলাম। কিন্তু সমাজ তো চলচ্চিত্রের অনুকূলে ছিল না। এদিকে তারা সব রেডি করেছেন, শুটিং শুরু হতে বাকি। জব্বার সাহেব বলেছেন, শুটিংয়ের ডেট জানাবেন। মহাবিপদে পড়ে দুই বান্ধবী চুপিচুপি জব্বার সাহেবের সঙ্গে দেখা করে বললাম, আব্বা তো রাজি নন। তিনি বললেন, ‘রাজি না হলে তো মুশকিল। এমনিতেই অনেক পিছিয়ে গিয়েছি, আরো পিছিয়ে যাব। আবার শিল্পী খুঁজতে হবে। ঠিক আছে, আমিই তোমার আব্বার কাছে যাব।’ বললাম, আপনি যদি কনভিন্স করতে পারেন, খুব ভালো হয়। তিনি আব্বার সঙ্গে দেখা করে বললেন, ‘এখন আপনি যদি ওর অভিনয় বন্ধ করে দেন, তাহলে আমার অনেক ক্ষতি হবে, অনেক পিছিয়ে যাব। আপনার মেয়ে, আমার মেয়ে’– এ কথাটি বলে তিনি বলেছিলেন, ‘কোনো চিন্তা করবেন না। ওর অভিনয়টুকু করার পরে আমি মেয়েকে আপনার কাছে দিয়ে যাব। এটুকুন বিশ্বাস করে মেয়েকে আমাকে দেন।’ আব্বা আর না করলেন না। বললেন, ‘আপনি যখন এসে বলছেন, ঠিক আছে।’ ভাইবোনেরাও সবাই আমার সমর্থনে ছিল। ছোটভাই তো দু-একবার এদিক-সেদিক সঙ্গেও গিয়েছে।

ওমর শাহেদ
মহরত হলো কোথায়?
…তখন আসল নামে
ছবি করলে লোকে
মন্দ বলতে পারে– এই
আশঙ্কায় জব্বার সাহেব
আমার নাম বদলে
রাখলেন ‘নাজমা’…
পিয়ারী বেগম
মহরত হয়েছিল ঢাকার শাহবাগ হোটেলে [বর্তমান, বিএসএমএমইউ হাসপাতাল]। উদ্বোধন করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক। আমি, আমার বাবা, জহরত আরা, তার বাবা– আমরা এই চারজন কলাকুশলীদের পক্ষ থেকে গিয়েছিলাম। মহরতের পর জব্বার সাহেব শেরেবাংলার সঙ্গে ‘আমাদের সিনেমার নায়িকা’ বলে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তেমন কথাবার্তা হয়নি। এটি ১৯৫৪ সালের কথা। মাঝেমধ্যে যখন দরকার হতো, জব্বার সাহেব বাসা থেকে গাড়িতে নিয়ে গিয়ে রিহার্সেল করাতেন। অফিসে তিনি সেট করেছিলেন। অনেক দিন পর তারা বললেন, অমুক জায়গায় শুটিং হবে। প্রথম শুটিংয়ের দিন প্রযোজক নুরুজ্জামান বাসা থেকে নিয়ে গেলেন। তার হাতে একটি বন্দুক ছিল। বন্দুক নিয়ে তিনি আমার সঙ্গে রসিকতাও করলেন, ‘আপনি তো নায়িকা মানুষ। আপনি সামনে বসেন। আমি বডিগার্ড হিসেবে পেছনে বসি।’ তখন আসল নামে ছবি করলে লোকে মন্দ বলতে পারে– এই আশঙ্কায় জব্বার সাহেব আমার নাম বদলে রাখলেন ‘নাজমা’।
ওমর শাহেদ
সম্মানী পেয়েছেন?
পিয়ারী বেগম
জব্বার সাহেব কাকে কী পেমেন্ট করেছেন, জানি না। শুনেছি, তিনি সবাইকে পেমেন্ট করেছেন। তবে আমি আর জহরত আরা অ্যামেচার হিসেবে কাজ করেছি। আমাদের এত শখ ছিল যে ওদিকে খেয়ালই করিনি, আলাপও হয়নি। কী বলবো, মুখ ও মুখোশ-এ অভিনয় করে কোনো উপহার পাইনি, কোনোকিছুই পাইনি। এ নিয়ে আমাদের আক্ষেপও নেই। কারণ, আমরা তো চুক্তিবদ্ধ হইনি!
ওমর শাহেদ
প্রথম শুটিং?
পিয়ারী বেগম
টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে প্রথম শুটিং হলো। সেদিন আমার, রহিমা খালা আর বিনয় বিশ্বাসের শুটিং ছিল। সিনেমায় বিনয়বাবু, রহিমা খালা আমার মা-বাবা ছিলেন। আমাদের শট হলো– নৌকা দিয়ে নদী পার হবো। ডায়লগগুলো বলে আমরা নৌকায় উঠলাম। পরে দেখিয়েছিল, নৌকাটা অনেক দূরে যাচ্ছে। শুটিং করে খুব ভালো লেগেছিল, খুব তৃপ্ত হয়েছিলাম। মুখ ও মুখোশ-এ যারা ছিলেন, সবাই প্রশংসা করেছেন। বলেছেন, আমার চেহারার সঙ্গে চরিত্রটি মিলে গেছে, অভিনয়ও খুব ভালো হয়েছে। ওখানে আমি দারোগার [আলী মনসুর] বোন, তার বাসায় থাকতাম। ভাবি [জহরত আরা] খুব দজ্জাল। আরো দুটি নারী চরিত্র ছিল– পূর্ণিমা সেন [কুলসুম] জব্বার সাহেবের শালা সাইফুদ্দিন সাহেবের বিপরীতে, বিলকিস বারী বাড়ির চাকর।
ওমর শাহেদ
এরপরের শুটিং?
…পুকুরে গান গাইতে
গাইতে গোসল
করছি। বিলকিস ঘাটে
বসে আছে। ঘাটের
ওই পাড়ে এক
ডাকাত ছদ্মবেশে
আমাদের দেখছে…
পিয়ারী বেগম
একদিন এই দৃশ্য, আরেকদিন আরেকটি– এভাবে শুটিং হয়েছে। আরেকদিন বলল, আজকে গানের শুটিং হবে। নিয়ে গেল কমলাপুর [বাসাবো বৌদ্ধবিহার] পুকুরঘাটে। গিয়ে দেখি, ইনাম সাহেব, বিলকিস বারীর মেকআপ নেওয়া আছে। আমাকে মেকআপের পরে লিপসিং করতে হবে বলে একটু রিহার্সাল করাল। খুব ভালো একজন গায়িকা, আগে খান আতাউর রহমানের স্ত্রী ছিলেন– মাহবুবা [হাসনাত] আপা গানটি গেয়েছেন। ক্যাসেটে গানটি টেপ করা ছিল। দৃশ্যটি হলো– পুকুরে গান গাইতে গাইতে গোসল করছি। বিলকিস ঘাটে বসে আছে। ঘাটের ওই পাড়ে এক ডাকাত ছদ্মবেশে আমাদের দেখছে। গান শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে পরি, ফুলপরি, এই পরি– এসব বলতে লাগল। মারহাবা, মারহাবা আওয়াজ শুনে ভয় পেয়ে চোখ ওদিকে চলে গেল। তাড়াতাড়ি পুকুর থেকে উঠে বিলকিসকে বললাম, দেখ তো লোকটা কে? বলে তাড়াতাড়ি দুজনে চলে এলাম।

ওমর শাহেদ
এটি তো বাংলা ছবিতে প্রথম গোসলের দৃশ্য। কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি?
পিয়ারী বেগম
ছবির সবাই খুব খুশি হয়েছেন। তবে খারাপ কথা কখনো শুনিনি।
ওমর শাহেদ
আর কোনো উল্লেখযোগ্য দৃশ্য?
পিয়ারী বেগম
বাড়িতে দুটি মেয়ে, মা-বাবা কথা বলছে। সেখানে আমি আর জহরত আরা অভিনয় করেছি। ইকবাল ফিল্মসের অফিসের একপাশে সেট তৈরি করে মাইক্রোফোন ফিট করে টেক করেছিলেন। যে কয়টি দৃশ্যের শুটিং করেছি, সবাই খুব তৃপ্ত ছিলেন। স্ক্রিপ্ট মুখস্থ করতে হতো, মাঝে মাঝে শট কাট করত। ইকবাল ফিল্মস অফিসের একপাশে সেট তৈরি করেছিল। সেখানে ইনডোর শুট হতো। এখানেই আরেকটি দৃশ্যে হয়েছিল– আমাকে ডাকাতরা ধরে নিয়ে গিয়ে বন্দি করে রাখল। ঘরে মাটিতে বসে আছি। ডাকাতটি ঘরে ঢুকে আমাকে ধরতে চাচ্ছে। ওকে দেখেই ভয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। যখন কাছে আসতে লাগল… ইনাম আহমেদ সাহেবের এমন মেকআপ দিয়েছিল যে, দেখে সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে গেলাম। তিনি যখন ধরতে এলেন, ‘এই খবরদার আমাকে ধরবি না, ধরবি না, সরে যা, সরে যা…’ বলে চিৎকার করে সত্যি সত্যি সেট থেকে বেরিয়ে গেলাম। কিন্তু আমার বের হবার কথা ছিল না। তার চেহারা, অ্যাকশন এমন ছিল যে, দৃশ্যটি মনে পড়লে এখনো ভেতরটা কেঁপে ওঠে। পরে কিছু অংশ, সংলাপ রিটেক করল। জব্বার সাহেব বললেন, ‘তুমি এত ভয় পেয়ে গিয়েছিলে যে সেটের বাইরে চলে গিয়েছ?’ বললাম, তিনি যে এভাবে ধরতে আসবেন, ভাবতে পারিনি। কোনোদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত শুটিং হতো। মাঝে ইকবাল ফিল্মস সেগুনবাগিচা থেকে শান্তিনগরে চলে গেল। যেদিন রিহার্সাল থাকত, আমাদের নিয়ে যেত। কাজ শেষে আবার পৌঁছে দিত। দুই-তিনবার রিহার্সালের পরে টেক হতো।
ওমর শাহেদ
জব্বার খান কোন চরিত্র করেছেন?
…আমি তো অজ্ঞান। তিনি
সত্যি সত্যি কোলে
করে নিয়ে নিলেন; নিচে
রাখলেন না। চিরদিনের
জন্য নিজের বুকের
মধ্যে উঠিয়ে নিলেন…
পিয়ারী বেগম
তিনি জালাল নামের এক ডাকাতের চরিত্র করেছেন। তার বিপরীতে পূর্ণিমা সেন ছিলেন। তাকেও ডাকাতরা ধরে নিয়ে গিয়েছিল। একদিন সে আমাকে বলল, ‘আজকে ওরা সব মদ খেয়ে মাতাল হবে। তুমি তো পালাতে চাইছ, এই ফাঁকে পালিয়ে যাও।’ সে একটি পিস্তলও দিল, ‘যদি কোনো বিপদ হয়, পিস্তলটি সঙ্গে রাখ।’ ডাকাতের ডেরা থেকে বেরিয়ে গেলাম। ক্ষেতের ওপর দিয়ে এপার থেকে ওপারে বাঁশের পুল পেরিয়ে যাব… ডাকাত পিছু নিয়েছে। কতগুলো গ্রাম্যযুবক আছে না, পরের উপকার করে বেড়ায়? তারাও সে পথ দিয়ে যাচ্ছিল। তাদের মধ্যে আমিনুল হকও ছিলেন। কয়েকটা লোক আমার পিছু ধাওয়া করছে দেখে তারা এগিয়ে এলেন। পুলের মাঝে এসে দেখলাম, আমাকে ধরে ফেলবে, পিস্তল দিয়ে গুলি করতে গেলাম। গুলি করতে পারিনি, ভয়ে নদীতে পড়ে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে তিন-চারজন ছেলে হইচই করে এলো দেখে ডাকাতরা পালাল। সাঁতার জানতাম, কিছুক্ষণ সাঁতার কাটলাম। তিনি [আমিনুল হক] কোলে করে উঠিয়ে এনে আমার সেবা করতে লাগলেন। আমি তো অজ্ঞান। তিনি সত্যি সত্যি কোলে করে নিয়ে নিলেন; নিচে রাখলেন না। চিরদিনের জন্য নিজের বুকের মধ্যে উঠিয়ে নিলেন। [হাসি]
ওমর শাহেদ
তার সঙ্গে কি এই প্রথম পরিচয়?
পিয়ারী বেগম
আগে থেকে তাকে চিনতাম। আমি ১৯৫৩ সাল থেকে রেডিওতে কাজ করছি। নাটক করতাম, আমার দেশ অনুষ্ঠানে মাঝেমাঝে অংশ নিতাম। সেখানে আলাপ। মাঝে মাঝে তিনি প্রযোজক হিসেবে নাটক নির্দেশনা দিতেন, সিনেমায় অভিনয় করতে গিয়ে প্রায়ই দেখা হতো। আলাপ ঘনিষ্ঠ হলো। ভালোলাগা থেকে প্রণয়। আমরা পরস্পরকে ভালোবাসতাম। কথায় কথায় একদিন বড় আপাকে [ড. আনোয়ারা বেগম] বলেছিলাম, তাকে খুব ভালোলাগে। তিনি মা-বাবাকে জানালেন। দুইপক্ষের মতামতের ভিত্তিতে ছবি মুক্তি পাওয়ার পর ১৯৫৮ সালে আমাদের বিয়ে হলো।
ওমর শাহেদ
তিনি সেখানে কোন চরিত্রে অভিনয় করেছেন?
…ছবিটির প্রথমে
নাম ছিল– ‘ডাকাত’। পরে
জব্বার সাহেব
‘মুখ ও মুখোশ’
নাম দিলেন…
পিয়ারী বেগম
গ্রাম্যযুবক– ওই এক দৃশ্যেই অভিনয় করেছেন। পরে আর সে ছবিতে ছিলেন না। তারা নাকি জব্বার সাহেবের সঙ্গে টাকাপয়সার চুক্তি করে অভিনয় করেছেন। কী হয়েছিল জানি না, পরে তিনি সরে গেলেন। ছবিতে তো নায়ক-নায়িকার অভিনয়ই বেশি থাকে। যখন তার সঙ্গে পরিচালক মতবিরোধে চলে গেলেন, অটোমেটিক্যালি জব্বার সাহেব স্টোরি পাল্টে নিজের আর কুলসুম চরিত্রকে একটু প্রাধান্য দিয়ে দিলেন। ছবিটির প্রথমে নাম ছিল– ডাকাত। পরে জব্বার সাহেব মুখ ও মুখোশ নাম দিলেন। কেন দিলেন, বলতে পারব না। প্রধান চরিত্র ছিলেন দাড়িওয়ালা ডাকাত ইনাম আহমেদ। তাকে নিয়েই সব ঘটনা; ডাকাতরা কী করে না-করে– সেটিই কাহিনী।
ওমর শাহেদ
কারিগরি যন্ত্রপাতি কেমন ছিল?
পিয়ারী বেগম
ঢাকায় তখন চলচ্চিত্র করার যন্ত্রপাতি, মেশিনপত্র কিছুই ছিল না। একটি ছোট্ট ক্যামেরায় শুটিং করা হতো। আউটডোরে একটি সোনালি-রুপালি সোনালি কাগজে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হলে আলো মুখে এসে পড়ত, তখন তারা ক্যামেরা চালাতেন। সূর্য না উঠলে আউটডোর হতো না। সব শুটিংই দিনে হতো। রাতের কোনো শুটিং হয়নি। আউটডোরে লোকজন শুটিং দেখতে আসত; কিন্তু কেউ কোনো মন্তব্য করত না। ডায়ালগ সরাসরি ক্যাসেটে রেকর্ড করে নিত। দুই-একবার এফডিসিতে ডাবিং করতে গিয়েছি। তখন এফডিসির অবস্থাও শোচনীয় ছিল।
ওমর শাহেদ
শিল্পী-কলাকুশলীর সম্পর্ক কেমন ছিল?
পিয়ারী বেগম
ছবিটির ব্যাপারে আমাদের সবারই খুব আগ্রহ ছিল। সবাই সবাইকে খুব সহযোগিতা করেছেন। সবাই সময়মতো আসতেন; তাদের সৌহার্দ্যপূর্ণ মনোভাব ছিল। আমরা সবাই আপনজনের মতো ছিলাম। কারো বিপদে, অসুবিধায় আরেকজন ঝাঁপিয়ে পড়তাম। সবাই এত ভদ্র, এত ভালো ছিলেন যে, কারো সঙ্গে কারো মতবিরোধ আমার চোখে পড়েনি।
ওমর শাহেদ
ছবিটি শেষ হলো কীভাবে?
পিয়ারী বেগম
পুরোপুরি শেষ করতে দুই বছর লেগেছে। জব্বার সাহেবকে বলতে শুনেছি, লাহোর থেকে ছবি প্রিন্ট করে এনেছেন। ছবিটির বিষয়ে আমাদের সঙ্গে তিনি তেমন আলাপ করতেন না। একটু রাশভারী লোক ছিলেন তো, নিজেকে আড়াল করে রাখতেন। যতক্ষণ সেটে থাকতেন, ততক্ষণ তার সঙ্গে কথা হতো। আর্থিক ব্যাপারেও কিছু বলতেন না।

ওমর শাহেদ
কবে মুক্তি পেল?
…১৯৫৬ সালের ৩ আগস্ট
মফস্বলের কয়েকটি হল
এবং
সদরঘাটের রূপমহল
সিনেমা হলে ‘মুখ ও মুখোশ’
মুক্তি পেয়েছিল…
পিয়ারী বেগম
আগাম ছবি মুক্তির খবর চিত্রালীতে ছাপা হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় পোস্টারিংও হয়েছে। তাতে আমাদের ছবি ছিল। ডাকাতের বিকট চেহারা এমনভাবে দিয়েছিল যে, সবার চোখে পড়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম বাংলা ছবি রিলিজ হয়েছে–এটি কিন্তু বেশ ভালোভাবে প্রচার করা হয়েছিল। লোকজনও ভালো হয়েছে। ১৯৫৬ সালের ৩ আগস্ট মফস্বলের কয়েকটি হল এবং সদরঘাটের রূপমহল সিনেমা হলে মুখ ও মুখোশ মুক্তি পেয়েছিল। রিলিজের আগে জব্বার সাহেব দাওয়াত দিয়ে বললেন, ‘তুমি আসবে’। বোনরাসহ গিয়েছিলাম, জহরত আরাও গিয়েছিল। হলে গিয়ে দেখি, মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা আলাদাভাবে বসে আছেন। আমার অভিনয় নিজের কাছে ভালো লেগেছে। আশপাশের মানুষও বলেছে, খুব ভালো হয়েছে। যখন বেরিয়ে এলাম, পর্দায় যাদের দেখেছে, তারাই আমরা কিনা– দেখার জন্য চারদিকে ভিড় জমল। ভিড় ঠেলে বাড়ি ফিরেছি।
ওমর শাহেদ
আরো অনেক বিখ্যাত লোক ছবিটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
পিয়ারী বেগম
সংগীত পরিচালক সমর দাসের সঙ্গে দুই-একবার আলাপ হয়েছে। তার ব্যবহার ছিল খুব অমায়িক। আবদুল আলীম তো ভালো গায়ক ছিলেন। তার সঙ্গে পল্লীকবি জসীমউদদীন সাহেবের ভালো পরিচয় ছিল। মুখ ও মুখোশ-এর মাঝে দল হিসেবে কবির বেদের মেয়ে নাটকের অভিনয় করতে আমরা কলকাতায় গিয়েছিলাম। তাতে আবদুল আলীম, জব্বার সাহেব, আমিনুল হকসহ অনেকে ছিলেন। সঙ্গে জসীমউদদীনও ছিলেন। সেখানে আলীম সাহেবের সঙ্গে পরিচয়। তিনি বেদের গান গাইতেন, খুব ভালো মানুষ ছিলেন, খুব ভালো গাইতেন। জোড়াসাঁকোতে রবীন্দ্রনাথের বাড়িতে অভিনয় করেছি। জব্বার সাহেব বেদে, আমি বেদেনী। ওখানকার লোকেরা আমার অভিনয়ের খুব প্রশংসা করেছে, ‘খুব সুন্দর হয়েছে।’ নাটক শেষ হওয়ার পর জসীমউদদীন সাহেব আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ‘তুই এত সুন্দর অভিনয় করেছিস! তুই তো ভালো অভিনয় করিস রে।’ তাকে ‘আংকেল’ ডাকতাম। বললাম, ‘আংকেল, আপনার এত ভালো লেগেছে?’ বললেন, ‘হ্যাঁ, তুই বেদেনীর সঙ্গে মিশে গিয়েছিস।’ সে নাটকে পূর্ণিমাও ছিল। বাড়িতে সব জায়গায় অ্যালাউ করত না বলে এরপর আর পারফরমেন্স করিনি। ওখানে যাওয়ার ব্যাপারেও জব্বার সাহেবের ভূমিকা ছিল।
ওমর শাহেদ
যে মেয়েটি মধুবালা হতে চেয়েছিল, সে পরে আর কেন অভিনয় করল না?
…ইচ্ছা ছিল, নামকরা অভিনেত্রী
হবো। কিন্তু করতে
পারলাম না। কর্তাই পছন্দ
করতেন না। কেন করতেন
না– সেটি তার
ব্যাপার…
পিয়ারী বেগম
১৯৫৮ সালে বিয়ে হলো। সাহেব তো অভিনয়ের মানুষ। পাকিস্তান আমলে রেডিওতে নাটকের প্রযোজক ছিলেন, থিয়েটার করতেন। কিন্তু আমার বেলায়… মুখ ও মুখোশ দেখার পর এহতেশাম চান্দা সিনেমা করা হবে বলে ঘোষণা করলেন। তখন বিয়ে হয়েছে, ছেলেও [রাবিউল আমিন] ছোট। আমাকে নির্বাচন করে কর্তাকে বলেছিলেন, ‘পিয়ারী বেগমকে নিতে চাই।’ ও রাজি হয়নি। এক বান্ধবীর মারফত কথাটি অনেক পরে কানে এলো। বললাম, সংসার ভেঙে তো কিছু করতে চাই না। শুনেছি, মুখ ও মুখোশ-এর আগেই আসিয়ার কাজ শুরু হয়েছিল। এ ছবির পরিচালক ফতেহ লোহানীর সঙ্গে পরিচয় ছিল। কোনো ছবির জন্য তিনি বলেননি, স্ক্রিনটেস্টে ডেকেছিলেন। অ্যালাউ হইনি। ইচ্ছা ছিল, নামকরা অভিনেত্রী হবো। কিন্তু করতে পারলাম না। কর্তাই পছন্দ করতেন না। কেন করতেন না– সেটি তার ব্যাপার। বললে বলতেন, ‘কী দরকার?’ কোনোদিন তর্ক-বিবাদ করিনি। তবে ১৯৫৩ থেকে রেডিওতে নাটক করি। আমার দেশ নামের শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান করতাম। চরিত্রের নাম ‘আয়না’। মাঝে মাঝে নাটিকাও করেছি। যাওয়া-আসার অসুবিধা বলে ৮-১০ বছর হলো ছেড়ে দিয়েছি। সবকিছুরই প্রথমের আলাদা মর্যাদা আছে। আমাদের প্রথম ছবি মুখ ও মুখোশ-এ অভিনয় করতে পেরেছি– এটিই আমার আনন্দ। আমিই বাংলা ছবির প্রথম নায়িকা– এটিই জীবনের সবচেয়ে বড় সুখ।
প্রথম প্রকাশ ।। কথায় কথায় । কালের কণ্ঠ । জাতীয় দৈনিক, বাংলাদেশ । ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬
সাক্ষাৎকারক ও কালের কণ্ঠ কর্তৃপক্ষের অনুমতিক্রমে পুনঃপ্রকাশিত