লিনো ব্রোকা জন্ম । ৩ এপ্রিল ১৯৩৯; পিলার, সরসগন, ফিলিপাইনস মৃত্যু । ২১ মে ১৯৯১; কুয়েজোন সিটি, ম্যাট্রো ম্যানিলা, ফিলিপাইনস
মূল । নোয়েল ভেরা ।। অনুবাদ । রুদ্র আরিফ
লিনো ব্রোকা সম্ভবত ফিলিপাইন সিনেমার সর্বকালের সবচেয়ে বিখ্যাত ও সবচেয়ে ভালোবাসার ফিল্মমেকার। একজন দুর্দান্ত ড্রামাটিস্ট [মঞ্চনাটকের ঐতিহ্য থেকে আবির্ভূত] হিসেবে তিনি নিজের সহকর্মীদের অভিনয়মান, চমৎকার সিনেমাটোগ্রাফি ও দাপুটে স্ক্রিপ্টগুলো বোঝার প্রেরণা অর্জন করে, সিনেমায় নানাবিধ উপাদানের প্রবাহ ঘটাতেন। আর সেই সময়ে ফিলিপিনো মানুষেরা যে সমস্ত সংঘাতের [হোক তা ব্যক্তিগত কিংবা রাজনৈতিক] সম্মুখিন ছিল, তার সিনেমা কথা বলত তা নিয়ে। নিজের এই মেলোড্রামাগুলোতে [একচেটিয়াভাবে মেলোড্রামায় কাজ করার বাইরে তিনি কাজ করেছেন সামান্যই], তিনি ফিলিপিনো মানুষের অন্তঃস্থলের আবেগ করে গেছেন প্রকাশ। আমি বলতে চাই, ফিলিপিনো সিনেমার এই হৃৎপিণ্ডটি মূলত মেলোড্রামাটিক। তার সিনেমাগুলো মেলোড্রামাকে দুর্দান্তভাবে উপস্থাপন করেছে। আর ব্রোকার রিয়েলিজম সেন্স ও তাড়না [মনে রাখা ভালো, তিনি এই সিনেমাগুলো থিয়েটারের বাইরে শুট ও নিষ্কৃত করেছেন, তবু এগুলো বড়পর্দার বাষ্পে সরাসরি ভেজা] এইসব মেলোড্রামাকে নিখাঁদ সত্য হিসেবে বিক্রয় করতে সাহায্য করেছে। রাজনৈতিক স্পষ্টভাষী [১৯৮০ দশকে তিনি শুটিং প্রায়শ শুধু রাতেই করতেন, যেন দিনের বেলা মার্কোসবিরোধী (ফার্দিনান্দ মার্কোস; ফিলিপাইনের একনায়ক; শাসনকাল : ১৯৬৫-১৯৮৬) মিছিল-সমাবেশগুলোতে অংশ নিতে পারেন] ও প্রকাশ্য সমকামী এই মানুষটিকে স্বদেশি ফিল্মমেকার খান দে লা ক্রুজ [১৯৭৩-] যথার্থই অভিহীত করেছেন– ‘ফিলিপাইন সিনেমার চূড়ান্ত আইকন’ হিসেবে।

…প্রজন্মের পর
প্রজন্ম ধরে এমনসব
ফিল্মমেকার তিনি গড়ে
দিয়ে গেছেন, যারা
হয়তো তার সঙ্গে
কাজ না করলেও তার
সিনেমা দেখে নিয়েছেন
পাঠ…

ব্রোকা এমন সব শিল্পী ও অভিনেতার [মেল চিয়োঙ্গলো (১৯৪৬-), পেক গালাগা (১৯৪৩-), তিকয় আগুইলুজ (১৯৫২-), মাইক দে লিয়ন (১৯৪৭-), মারিও ও’হারা (১৯৪৬-২০১২) এবং আরও অনেকেই] বিকাশ ঘটিয়েছেন বা তাদের সঙ্গে কাজ করেছেন, যারা পরবর্তীকালে নিজ পরিচয়েই প্রধান প্রধান ফিল্মমেকার হয়ে উঠেছেন– তার নিজেরই মেলোড্রামাটিক রিয়েলিজমকে হয় ধারণ, নয়তো এটির বিরোধিতা করার মধ্য দিয়ে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এমনসব ফিল্মমেকার তিনি গড়ে দিয়ে গেছেন, যারা হয়তো তার সঙ্গে কাজ না করলেও তার সিনেমা দেখে নিয়েছেন পাঠ : রেমন্ড রেড [১৯৬৫-] তার পাম দি’অর’জয়ী শর্টফিল্ম আনিনো [Anin0, ২০০০] বানিয়েছেন ম্যানিলা ইন দ্য ক্লজ অব লাইট [Maynila Sa Mga Kuko Ng Liwanag; ১৯৭৫] ফিল্মটির সরাসরি অনুপ্রেরণায়; জেফ্রে জেতুরিয়ানের [১৯৫৯-] ফেচ অ্যা পাইল অব ওয়াটার [১৯৯৯] ফিল্মটি ব্রোকার স্ল্যাম-ড্রামাগুলোর [বা, বস্তিকাহিনি] একটি ট্রাজিকমিক বিকল্পপ্রকাশ; যে সিনেমাটির জন্য ব্রিলান্তে মেন্ডোজা [১৯৬০-] আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিমান এবং যে সিনেমাটি তার এ পর্যন্ত সমগ্র ফিল্মোগ্রাফির নেপথ্যে ভূমিকা রেখেছে– সেই স্লিংশট [Tirador; ২০০৭] আসলে ব্রোকার রিয়েলিজমের একটি তীক্ষ্ণ ও অপেক্ষাকৃত অধিক সমকালীন রিদমে সৃষ্টি। ফিলিপিনো ও বিদেশি সমালোচকেরা ব্রোকাকে ফিলিপাইনের সর্বশ্রেষ্ঠ ফিল্মমেকার হিসেবে গণ্য করে থাকেন।

…প্রত্যেকেই নিজেদের
পরিচয় ব্রোকার ফিল্ম-বৈশিষ্ট্যের
বাইরে দাঁড় করাতে চেয়ে,
নিজেরাই তার কাজগুলোর
মহিমার প্রতি
পরোক্ষভাবে জানিয়েছেন
শ্রদ্ধাঞ্জলি…

এমনকি ব্রোকার কাছে শিল্পগত ঋণী থাকার কথা যেসব ফিল্মমেকার স্বীকার করেন না, তাদের কাজেও তার ছাপ স্পষ্ট; যেমন ধরুন, লাভ দিয়াজের [১৯৫৮-] কিলোমেট্রিক কাজগুলো ব্রোকাধর্মী মেলোড্রামাকে সর্বাত্মকভাবে এড়িয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টায় বাণিজ্যিক রানিংটাইম ও টিউন কমিয়ে বরং একটি অপেক্ষাকৃত অধিক ধ্যানমগ্ন হয়ে ওঠার পথ বেছে নিয়েছে; মেলানকলিক অটোবায়োগ্রাফিক্যাল ফিল্ম অ্যাশে নিয়ে জন তোরেসের [১৯৭৫-] এক্সপেরিমেন্টগুলো ব্রোকা-গন্ধী প্রচলিত ন্যারেটিভকে সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে গেছে; রায়া মার্টিনের [১৯৮৪-] সিনেমাগুলো এমন এক আমুদে নির্বাক-ফিল্ম গীতিময়তায় আচ্ছন্ন– যা কিনা ব্রোকার কাজে পাওয়া যায় না। এরা প্রত্যেকেই নিজেদের পরিচয় ব্রোকার ফিল্ম-বৈশিষ্ট্যের বাইরে দাঁড় করাতে চেয়ে, নিজেরাই তার কাজগুলোর মহিমার প্রতি পরোক্ষভাবে জানিয়েছেন শ্রদ্ধাঞ্জলি। ‘সংস্কৃতির সঙ্গে একাকার হয়ে আছেন লিনো ব্রোকা; তার কাছ থেকে পালানোর পথ নেই,’— ২০০৯ সালে ভিয়েনা ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের [অস্ট্রিয়া] ব্রোকা রেট্রোস্পেকটিভে এক অনানুষ্ঠানিক গোলটেবিলে মার্টিন, খান ও কিদলাত তাহিমিকের [১৯৪২-] সঙ্গে আলোচনায় এমনটাই বলেছিলেন দিয়াজ। খানের মন্তব্য ছিল– ‘আমরা তাকে কপি করি না; আমরা স্রেফ স্যালুট করি তাকে। এমনকি তার গৌণ কাজ, তার মেলোড্রামা– এগুলোও গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের মনস্তত্ত্বের অংশ হয়ে আছে এগুলো।’

…ঠিকই জানতেন, কী
করে দর্শকের মনোযোগ
ধরে রাখা যায়, এবং কী
করে আসল বিষয়টি
দেখিয়ে নেওয়া যায়…
একজীবনে পঞ্চাশটিরও বেশি সিনেমা বানিয়েছেন ব্রোকা; অনেকগুলোই প্রিন্টের ত্রুটির কারণে এখন আর দেখানো সম্ভব নয়। কাজ করেছেন তিনি বহু ধারায়– নিওরিয়ালিজম, মেলোড্রামা, ন্যোয়া, পলিটিক্যাল ক্রিটিক– এমনকি একই সিনেমায়ই। খুব বেশি এক্সপেরিমেন্ট তিনি করেননি; তবে ঠিকই জানতেন, কী করে দর্শকের মনোযোগ ধরে রাখা যায়, এবং কী করে আসল বিষয়টি দেখিয়ে নেওয়া যায়।

তুলনামূলক কম আকর্ষণীয় বড় ভাইটির বিনিময়ে নিজের সুদর্শন তরুণ পুত্রটিকে কীভাবে তারকাখ্যাতির [স্টারডমের] মধ্যে বড় করে তোলা যায়– বিনোদন জগতের এমন একজন মায়ের গল্প নিয়ে ব্রোকার প্রথমদিকের মেলোড্রামা–স্টারডম [Stardoom; ১৯৭১]। অনেকের মতে, জাগুয়ারই [Jaguar; ১৯৭১] ব্রোকার সবচেয়ে চমৎকার ন্যোয়া; নিজের সামাজিক মর্যাদার উন্নতি ঘটানোর আশায় একজন ধনী লোকের ‘গার্ডিয়া’ বা দেহরক্ষি হয়ে ওঠা এক তরুণকে গিয়ে এই থ্রিলারটি। অ্যাকটিভিস্ট জোসে ‘পিট’ লাকাবার [১৯৪৫-] স্ক্রিপ্ট অবলম্বনে এক জোড়া স্পষ্টতই পলিটিক্যাল ড্রামা বানিয়েছেন ব্রোকা : একটি প্রিন্টিং প্রেসের ধর্মঘট ঘিরে নির্মিত দিস ইজ মাই কান্ট্রি [Bayan Ko; ১৯৮৯] হলো মার্কোসের শাসনামলে বানানো সেই স্বল্প কয়েকটি সিনেমার একটি– যেখানে শাসনব্যবস্থাটির বৈষম্যপূর্ণ সামাজিক অবস্থাকে ফুটিয়ে তোলার দুঃসাহস দেখানো হয়েছে; অন্যদিকে, ফাইট ফর আস [Orapronobis; ১৯৮৯] সম্ভবত একমাত্র ফিলিপিনো ন্যারেটিভ ফিচার ফিল্ম– যেখানে মার্কোসের তুমুল জনপ্রিয় উত্তরসুরি, প্রেসিডেন্ট কোরাজন আকুইনোকে [১৯৩৩-২০০৯] সুস্পষ্টভাবে নিন্দা করা হয়েছে। দুটি সিনেমাই মূলত ‘আজিটপ্রপ’ [প্রোপাগান্ডা (মূলত কমিউনিস্ট) ধারা]; তবে দুর্দান্ততম ধরনের আটিটপ্রপ : সাদামাটা ও সুতীব্র; তাড়নার বোধ থেকে এমন দুর্নিবারভাবে সৃষ্ট– যেটি সৃষ্টি করার ক্ষমতা খুব কম ফিল্মমেকারই রাখেন। রোমাঞ্চকর ম্যাচো ডেন্সারই [Macho Dancer; ১৯৮৮] সম্ভবত পশ্চিমাবিশ্বে তার সবচেয়ে পরিচিত সিনেমা; অনিঃশেষ হোমোইরোটিক ডেন্সে পরিপূর্ণ এটি একটি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে হিট হয়েছিল ঠিকই, তবে প্রদর্শনের নিরন্তর দেহে নিজ সহকর্মী পুরুষ নৃত্যশিল্পীর প্রেমে নৈরাশ্যজনকভাবে এক নৃত্যশিল্পীর পড়ে যাওয়ার মনোমুগ্ধকর সাবপ্লটটি জুড়ে দেওয়া হয়েছে এখানে। ব্রোকা আসলে এমনই : প্রোডাকশন কতটা বাণিজ্যিক কিংবা তাড়াহুড়োর হলো, সে ব্যাপারে মাথা না ঘামিয়ে, হৃদয়গ্রাহী ও বলিষ্ঠ কিছু জুড়ে দিতেন তিনি।

…ম্যানিলার টন্ডো অঞ্চলে,
যেন উত্তপ্ত কড়াইয়ে
জীবনযাপন করা এক
তরুণী, তার মা ও মায়ের প্রেমিকের
কাহিনি এটি; তাদের ভালোবাসা,
লালসা, ঈর্ষা ও ঘৃণায় এমন
এক ভয়াবহ সংমিশ্রণ
তৈরি হয়– যা শুধু
বিপজ্জনকই নয়, বরং প্রাণঘাতিও…
ব্রোকার সবচেয়ে চমৎকার চারটি সিনেমা সম্পর্কে অল্প কিছু কথা বলা যেতে পারে, যা বলা হয়নি আগে। অল্পকালের যে অভিনেতাটিকে এক মধ্যবিত্ত বালিকা আরাধনা করে, তার [অভিনেতা] জন্য তার [বালিকা] দুর্ভোগ ও অপমান সয়ে যাওয়া– আত্মবিসর্জনের এক মাস্টারফুল প্রতিকৃতির নাম বোনা [১৯৮০]। চূড়ান্ত ভালোবাসা, এবং এটির [ভালোবাসার] সবচেয়ে সৃষ্টিছাড়া রূপের নিদর্শন এই সিনেমাটি। ম্যানিলা ইন দ্য ক্লজ অব লাইট সম্ভবত তার সবচেয়ে বিখ্যাত সৃষ্টি; এ হলো গ্রাম থেকে শহরে, নিষ্কলুষতা থেকে দুর্নীতিতে, স্বর্গ থেকে ঠিক এর বিপরীতে একটি গ্রামের ছেলের রূপকধর্মী অভিযাত্রা। উইহেড বাট ফাউন্ড ওয়ান্টিং [Tinimbang Ka Ngunit Kulang; ১৯৭৪] হলো ব্রোকার সোশ্যাল এপিক; নিজ জনগোষ্ঠীর হতদরিদ্র সামাজিক অবস্থার প্রতি করুণা বোধ করা একটি ব্যঙ্গাত্মক ছোট্ট-শহুরে জীবনের ক্যারিকেচারের এক টেপেস্ট্রি এটি। অন্যদিকে, ইনসিয়াংকে [Insiang; ১৯৭৬] ধরা হয় ব্রোকার ওথেলো হিসেবে : ম্যানিলার টন্ডো অঞ্চলে, যেন উত্তপ্ত কড়াইয়ে জীবনযাপন করা এক তরুণী, তার মা ও মায়ের প্রেমিকের কাহিনি এটি; তাদের ভালোবাসা, লালসা, ঈর্ষা ও ঘৃণায় এমন এক ভয়াবহ সংমিশ্রণ তৈরি হয়– যা শুধু বিপজ্জনকই নয়, বরং প্রাণঘাতিও।

এই হলো ব্রোকার সিনেমার এক ক্ষুদ্র ঝলক। তাকে প্যারোডি করা সহজ : ১৯৬০ ও ১৯৭০ দশকের প্রথমভাগে বেড়ে ওঠা ব্রোকা ও তার দর্শকরা সে সময়কার রেডিও নাটকগুলো থেকে যেন সরাসরি নিংড়ে নিচ্ছেন চিল-চিৎকার, আর টানছেন চুল! তবে বর্তমানের অপেক্ষাকৃত অধিক স্বার্থান্বেষী ও অধিক পলায়নপ্রবণ সময়ে তার বিশেষত্ব সণাক্ত করতে পারা বোধহয় অত সহজকর্ম নয়। তবু বিশ্বাস করি, এখনো আমাদেরকে তার কিছু বলার আছে : হতে পারে কথাটি হলো– আমরা সবাই আমাদের নিজ পরিস্থিতির শিকার; কেননা, কোনোকিছু ভালো কী করে করতে হয়– এটি যেহেতু কখনোই শিখিনি, একমাত্র এ কারণেই বিচক্ষণতা কিংবা এমনকি যুক্তিবোধ ছাড়াই নিজ মর্যাদাকে প্রায়শই সমর্থন জুগিয়ে যাই আমরা। তবে পরিণামে যে কোনো ধরনের একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে, একটি নির্দিষ্ট শব্দ কিংবা ইশারা কিংবা সঙ্কেতে এসে দাঁড়াতে হয়– যখন আমাদের নিশ্চুপ ক্ষমাশীল থাকার ধৈর্যের বাধটি ভেঙে যাইয়, আর আমরা ফেটে পড়ি! মহাপ্রভুর করুণায়, তারপর আমাদের দীর্ঘকাল দমিয়ে রাখা ক্রোধের সমাপ্তির ফল ভোগ করতে দাঁড়িয়ে যায় যে কেউ [হয়তো কোনো ব্যক্তি, কোনো দল, কিংবা কোনো সরকার]।
নোয়েল ভেরা
লেখক, সিনে-সমালোচক; ফিলিপাইন। গ্রন্থ : ক্রিটিক আফটার ডাক : অ্যা রিভিউ অব ফিলিপাইন সিনেমা
সূত্র । সেন্টার ফর এশিয়ান আমেরিকান মিডিয়া [সিএএএম]। জার্নাল। ৭ মার্চ ২০১৭