Ballads for Chandrabati ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় চলচ্চিত্র অনুদানপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্র ১০৫ মিনিট ৪ কে-ডিজিটাল চিত্রনাট্য ও পরিচালনা : এন. রাশেদ চৌধুরী
লিখেছেন । এন. রাশেদ চৌধুরী
ষোড়শ শতাব্দীর কোনো এক সময়ে ময়মনসিংহের গীতিকবি চন্দ্রাবতীর জন্ম হয়েছিলো কিশোরগঞ্জের পাতুয়ারী গ্রামে। বাবা মনসা মঙ্গল-এর অন্যতম কবি দ্বীজবংশী দাসের ঔরশে। বাবার কাছেই পড়ালেখার হাতেখড়ি। চন্দ্র্রাবতী’র নিজের কথায়ই আছে, তাঁর বাবার গান শুনে হাওরের ভয়ংকর দস্যু কেনারাম তাঁর শিষ্যে রূপান্তরিত হয়েছিলেন। বাবা দেবী মনসার ভাসান গান গাইলে, বনের পশু পাখি সে গান শুনতে জড়ো হতো। ওদের ঘরে বাবার গান গেয়ে পাওয়া ভেটের অন্নে সংসারে দুবেলা অন্ন হয়তো জুটতো, কিন্তু বৃষ্টিতে ঘরের চালার ফুটো বেয়ে ঝরতো বরিষণের জল। এমন পরিবারে বেড়ে ওঠেন চন্দ্রা– বাবার লেখার সহযোগী হয়ে। কৈশোরে প্রেম হয় বাবার আরেক শিষ্য, ছেলেবেলায় বাপ-মা হারা কবি জয়ানন্দের সাথে। ঘটনাচক্রে দুজনের বিয়েও ঠিক হয়। কিন্তু হায়, বিধি বাম! কোনো এক অজ্ঞাত কারণে, জয়ানন্দ ঠিক বিয়ের আগের দিনই গ্রামের আরেক মুসলমান মেয়ে আসমানীকে বিয়ে করে মুসলমান হয়ে যান। হতবিহবল চন্দ্রা মূষড়ে পড়েন এ ঘটনায়। পিতার পূনঃবিবাহের আশ্বাস ঠেলে দিয়ে সুকঠিন সিদ্ধান্ত নেন, জীবনে আর কখনও বিয়ে করবেন না। আজীবন আইবর থাকবেন। বাবাকে স্মরণ করিয়ে দেন, পূর্বপ্রতিশ্রুতি অনুযায়ী শিব মন্দির গড়ে দিতে, যেখানে বসে তিনি রচনা করবেন তাঁর রামায়ণ।

এভাবেই নির্মাণ শেষ হয় চন্দ্রাবতীর শিব মন্দিরের, আর চন্দ্রাও একদিন উঠে পড়েন সেই মন্দিরে। লিখতে শুরু করেন তাঁর রামায়ণ। রচিত হয় বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারী কবি’র রামায়ণ– যাকে রামায়ণ না বলে অনেক বিদ্যৎজ্জন বলছেন– সীতায়ণ! কারণ, এতে রামের কোনো অস্তিত্ব নেই। এর সবটা জুড়ে রয়েছে শুধু সীতার দুঃখ গাথা।
মন্দিরবাসের কয়েক বছরের মাথায়ই, কবি চন্দ্রাবতী মৃত্যুবরণ করবারও অন্তত ৫০ বছর পর, নয়ানচাঁদ ঘোষ নামক আরেকজন স্থানীয় কবি, জনশ্রুতির ভিত্তিতে ওঁকে নিয়ে রচনা করেন– চন্দ্রাবতী নামের একটি পালা। এর আগে থেকেই অবশ্য বংশ-পরম্পরায় গ্রামের নারীদের মুখে মুখে ফিরতো চন্দ্রাবতী’র রামায়ণ– যা আজ অবধি প্রবহমান। এখনও শ্রাবণ মাসের যেকোনো সময়ে কিশোরগঞ্জ বা নেত্রকোনার অঁজো পাড়া-গাঁ’র পল্লীবালার কণ্ঠে ভেসে আসে সেই গীতল রামায়ণের সূর ও বাণী।
…আমার মাঝে
উন্মোচিত হয়ে পড়ে
এক বিরল গীতিকবিদের
জগৎ আর তাঁদের
জীবন…
আজ থেকে সাতবছর আগে আমারও পড়া হয় চন্দ্রাবতী’র রামায়ণ। সেই সাথে প্রায় একনিঃশ্বাসে পড়ে শেষ করি, দীনেশ চন্দ্র সেনের দুই খণ্ডের ময়মনসিংহ গীতিকা। আমার মাঝে উন্মোচিত হয়ে পড়ে এক বিরল গীতিকবিদের জগৎ আর তাঁদের জীবন। যাঁরা দু’শো বছরেরও অধিক সময়ব্যাপী লিপিবদ্ধ করে গেছেন নিজেদের সুখ-দুঃখ-আনন্দ বেদনার কাব্য, নিজেদেরই রচিত পালায়। বিবৃত করেছেন নিজেদের নিয়তিবাদী ট্র্যাজিক জীবনের গল্প-গাঁথা। ভেবেই অবাক লেগেছিল, ৮০০ বছরের প্রচলিত বৈঞ্চব সাহিত্যের আড়ালে লুকিয়ে ছিলো তবে এই চিরন্ময়, অমৃত রসধারা-সেই মিসিং লিংক। আর সঙ্গত কারনেই আমার কাছে এর মূল্য হয়ে দাঁড়ালো অপরিসীম। আমার সম্মুখে মূহূর্তেই যেন আবিস্কৃত হলো, বাংলা সাহিত্যের সেই মিসিং লিংক– যার হদিস আধুনিক সাহিত্য বিশ্লেষকগণ কখনও ধর্তব্যে আনেননি। আর ময়মনসিংহ গীতিকা তো ব্রাত্যজনের রচনা! তারওপর আবার ওরাল লিটারেরি ফর্ম। মুখে মুখে বা স্মৃতিপরম্পরায় যা বেঁচে আছে শত শত বছর।

সিনেমা নির্মাণের অদম্য বাসনা থেকেই চন্দ্রাবতী কথার চিত্রনাট্য লেখার কাজ শুরু হয়। অনেকগুলো ড্রাফট হবার পর বেশ কিছু বিষয় সেই স্ক্রিপ্টকে রিয়ালাইজেশনের ব্যাপারে বাধা হয়ে দাঁড়ায় :
• আনুমানিক ৩ শত বছরেরও বেশি সময় আগের পটভূমিতে চন্দ্রাবতীর সমসাময়িক প্রেক্ষাপট বিনির্মাণ
• সময়কালের বিশ্বাসযোগ্যতা
• সাংস্কৃতিক আচরণ ও জীবনাচার
• কাহিনীর বিস্তার ও পরিধি
• সর্বোপরি, অভিনয়রীতি
চন্দ্রাবতী কথা চলচ্চিত্রটি আমাদের ব্যালাড-কবি চন্দ্রাবতীকে নিয়ে। তাই ছবিতে ব্যালাডের মতো করে ছোট ছোট কাহিনী-পরম্পরায় এর গল্প এগিয়েছে। এছাড়া ব্যালাডগুলোতে কাহিনীর অতিপ্রাকৃততা ও চরিত্রদের নিয়তিনির্ধারিত পরিণতি এদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবাহিত। তাই সময়ের পুনঃনির্মাণে আমরা এদের ব্যবহারে প্রবৃত্ত হয়েছি। এবং তা আমাদের ছবির সার্বিক ন্যারেটিভ স্টাইল বিনির্মাণে সহায়ক হয়েছে নিঃসন্দেহে।

সেসময়ে ব্যবহার্য পোষাক-পরিচ্ছদ, অলঙ্কার, আসবাব, লেখনীর সরঞ্জামাদি– এসবের সাথে সাথে তাই আবাসস্থল, নৌকা-সহ নানান সেট-সামগ্রী, প্রপস নির্বাচন, উপরোক্ত একই কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। আর এগুলোই আসলে নির্ধারণ করে দিয়েছিলো আমাদের চরিত্রসমূহের আচরণবিধি, জীবনাচরণ! তখন আর বেশি বেগ পেতে হয়নি এদের গতিপ্রকৃতি নিয়ে। ততক্ষণে তারাও আসলে হয়ে উঠেছেন আমাদের একই তরণীর যাত্রী। তবে এসব ক্ষেত্রে সৈয়দ জামিল আহমেদ স্যারের উপদেশাবলি আমাদের খুব তাড়াতাড়ি বুঝে নিতে শিখিয়েছে যে, কতটা অবধি আমাদের এই জীবনাচরণের পেছনে ছোটা উচিত। এসবের উদাহরণ এখনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আমাদের চেনা চৌহদ্দিতে, শিল্পকর্মে। ইয়ুঙ-এর কালেকটিভ আনকনশাস তো সাথেই বয়ে নিয়ে চলেছি আমরা, বাঙালিরা, হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে, আমাদের জীন-সংকেতে বহন করার মতো করে।
…স্টোরি রিসার্চের জন্য
যতবার
হাওর অঞ্চলে গিয়েছি,
ততোবারই মনে হয়েছে,
হাওর ছাড়া ময়মনসিংহ গীতিকার
কোনো অস্তিত্ব
নেই…
চন্দ্রাবতী কথার লোকেশন নির্বাচনও তাই আমাদের কাছে ছিলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। প্রথমদিকে স্টোরি রিসার্চের জন্য যতবার হাওর অঞ্চলে গিয়েছি, ততোবারই মনে হয়েছে, হাওর ছাড়া ময়মনসিংহ গীতিকার কোনো অস্তিত্ব নেই। এগুলোকে তাই হাওরে গীতিকাও বলা হয়ে থাকে। হাওরের জীবনযাত্রাতেই এর বিস্তার সম্ভব। খাঁচা কাঁধে কোড়া পাখি শিকারি এখনও হাওরের যেকোনো প্রান্তরেই চোখে পড়বে। আমাদের সন্দেহ ছিলো, ওই কোড়া শিকারিরা কি এখনও আছেন? পোষা কোড়ার খাঁচা কাঁধে নিয়ে যারা সেকালে নিয়ত বেরিয়ে পড়তেন কোড়া শিকারে! তাই পরবর্তী সময়ে আমাদের গল্পের কোড়াশিকারি বিনোদকে অ্যাড্যপ্ট করতে আর বেশি বেগ পেতে হয়নি। পালাগুলোয় বহুল ব্যবহৃত সেই চৌকোনা পুস্কুরিণী, বিস্তীর্ণ হাওর, পুরানো মাজার, জীর্ণ মন্দির, দেওয়ানী মসজিদ, মনসা পূজা– এসবও যেন আমাদের অপেক্ষাতেই এতোদিন টিকে ছিলো! তবে এরজন্য অনেকটা ভেতর অব্দি ঢুকতে হয়েছিলো আমাদের। এতটাই যে, সেসব গ্রামে এখনও বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি।

আমাদের গল্পে সমসাময়িক বাস্তবতা আরও বেশি করে চর্চিত হয়েছে, এর কাহিনীকে বিশ্বাসযোগ্য রূপ দিতে। গল্পে বিক্রমপুর অঞ্চল থেকে জীবন বাঁচাতে কামরূপে পালিয়ে যেতে উদ্দত নাথপন্থি বৌদ্ধ যুবক, পটুয়া অশোক ও তার ধর্মগুরু বৃদ্ধ কত্তা তাই এসে আমাদের গল্পে সামিল হয়েছেন, চিরতরে মাতৃভূমি ছেড়ে যাবার বেদনা লাঘবে স্থির করেছিলেন, আরও ক’দিন যদি থেকে যাওয়া যায়, গারো পাহাড়ের পাদদেশে আমাদের জলা-জংলা বেষ্টিত নদীমাতৃক পটভূমিকায়।
পরিশেষে, সেই জৌলুসপূূর্ণ সাহিত্যগাথার জগৎ! সেই কবিদের সাক্ষাৎ দেখতে পাওয়া– দ্বিজবংশী, জয়ানন্দ, চন্দ্রাবতী’র পাশাপাশি– সখী বিশাখা, পটুয়া অশোক, কাজী, প্রেমকাতুরে দেওয়ান, স্থানীয় বয়াতি, কোড়া শিকারি বিনোদ, বাংলার আখ্যানের সেই চিরচেনা পতিকাতর, আত্মত্যাগী স্ত্রী সোনাই, জয়া’র মুসলমান স্ত্রী আসমানীও হাজির তাঁদের স্ব-মহিমায়। আমাদের সিনেমার গল্পের সহায়ক ডালপালা হিসেবে মূল প্রেক্ষাপটে স্থান করে নিতে।
…এক্ষণে
আবারো মনে পড়ে গেলো,
ময়মনসিংহ গীতিকার
তথা বাংলা সাহিত্যের সেইসব
বিরল ‘আর্কিটাইপ’ নারী চরিত্রদের!
যাঁরা প্রেমের তরে, জীবনের
তরে আত্মত্যাগী ও নায়োকোচিত
হয়েও দৈববাদী অদৃষ্টের ইশারায়
পরিচালিত, অতঃপর ভয়ানক
ট্রাজেডির শিকার…
সর্বোপরি, কবি চন্দ্রাবতীর জীবন! বাংলার প্রথম নারীকবি, যিনি আবার সম্পূর্ণ ভারতীয় উপমহাদেশেরই প্রথম নারীবাদী লেখকও বটে। আমাদের অবহেলার অভিমানে হারিয়ে যাওয়া এই ঐতিহ্যময় চরিত্র! আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এরূপ ‘আইকনিক চরিত্র’কে পুনঃজাগরণের দায়িত্ব কাঁধে নেয়ার জন্য সর্বোত্তম অযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও, এ নিয়ে ছবি বানাবার দুঃসাহসের জন্য আমি অগ্রিম ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি! আরেকটি হীন দায়িত্বের বোঝা দুঃসাধ্য হলেও কাঁধে চেপেছিলো, আমাদের নবীন প্রজন্মের চলচ্চিত্রপ্রেমীদের নিয়ে একসাথে– আমাদের ঐতিহ্যযাত্রায় সরিক হতে– তাতে যে আমরা সম্পূর্ণ সফল, তা তাঁদের কীর্তি দেখলে আপনারাই বুঝতে পারবেন, আমি বিশ্বাস করি।

পরিশেষে, চন্দ্রাবতী কথা ছবিটি দর্শকদের কেমন সহানুভূতি পায়– তা সময়ের গহবরে সঁপে দিচ্ছি। তবে আমাদের ভারতীয় সম্পাদক ও সাউন্ড রেকর্ডিষ্ট মহোদয়রা যে এ ছবির প্রেমে মজেছেন– কাজটিকে ঘিরে তাঁদের আগ্রহই আমাদের জন্য প্রেরণাদায়ক হয়েছে নিঃসন্দেহে!
এক্ষণে আবারো মনে পড়ে গেলো, ময়মনসিংহ গীতিকার তথা বাংলা সাহিত্যের সেইসব বিরল ‘আর্কিটাইপ’ নারী চরিত্রদের! যাঁরা প্রেমের তরে, জীবনের তরে আত্মত্যাগী ও নায়োকোচিত হয়েও দৈববাদী অদৃষ্টের ইশারায় পরিচালিত, অতঃপর ভয়ানক ট্রাজেডির শিকার।
। ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১৮