২০১৭ ও কয়েকটি সিনেমা

585

লিখেছেন ইশতিয়াক আহমেদ হৃদয়


২০১৭ পার হয়ে চলে এসেছি ২০১৮ সালে। ২০১৭ সালে প্রচুর সিনেমা রিলিজ পেয়েছে– যা  স্বাভাবিক। সব সিনেমা তো  আর দেখা সম্ভব না। বেশ কিছু সিনেমা দেখার পরে ২০১৭-এর কিছু মুভির বর্ণনা নিচে তুলে ধরা হলো। গুরুত্বপূর্ণ অনেক সিনেমাই হয়তো আমাদের চোখ এড়িয়ে গেছে। মূলধারার সিনেমার মধ্যে এসব সিনেমা যেন স্মৃতিতে থেকে যায়, এজন্যেই মূলত এই লিস্ট…

দ্য ঈগল হান্ট্রেস

দ্য ঈগল হান্ট্রেস একটি ডকুমেন্টারি। ডিরেক্ট করেছেন অটো বেল। এই ডকুমেন্টারিটি নির্মিত হয়েছে আইশোলপান নামের তের বছরের এক মেয়েকে ঘিরে। এই ডকুমেন্টারিটি মঙ্গোলিয়ার কাযাখ ভাষায় নির্মিত। ডকুমেন্টারিটি ‘সানড্যান্স ইনস্টিটিউট ডকুমেন্টারি ফিল্ম প্রোগ্রাম’-এর  ফান্ডে বানানো।

আইশোলপান মঙ্গোলিয়ার নরডিক গোত্রের মেয়ে। নরডিক জাতির সংস্কৃতির একটি অন্যতম অংশ হচ্ছে গোল্ডেন ঈগলের সাহায্যে শিকার। তারা কয়েকশো বছর ধরে এই কাজটা করে আসছে, এবং ঈগলগুলোকে মূলত পাহাড়ি শিয়াল ধরতে কিংবা প্রতিযোগিতার জন্য ব্যবহার করে থাকে। তারা ঈগলগুলোকে ছোট অবস্থাতে পাহাড় থেকে নিয়ে আসে, আর ট্রেনিং করায় শিকার ও প্রতিযোগিতার জন্য।

কিন্তু নরডিকদের নিয়মানুযায়ী একটি ঈগলকে ৭ বছরের বেশি রাখা যায় না। সুতরাং একজন মানুষ আর একটি ঈগলের মধ্যে সম্পর্ক থাকে ৭ বছর। প্রকৃতির এই সুন্দর নৈপুণ্যে বাঁধা নরডিক আদিবাসী সম্প্রদায়। কিন্তু আইশোলপান তাদের গোত্রের মধ্য প্রথম মেয়ে যে ঈগল-শিকারি হয়ে ওঠেছে।

…একজন মেয়ে
হিসেবে ঈগল-শিকারি
হয়ে ওঠাতে তার
অবস্থান, তার
বিপ্লব, তার
কষ্ট তুলে ধরা হয়েছে
অসাধারণভাবে…

গল্পে মূলত একজন সাধারণ মেয়ের ঈগল-শিকারি হয়ে ওঠার গল্প তুলে ধরা হয়েছে। একজন মেয়ে হিসেবে ঈগল-শিকারি হয়ে ওঠাতে তার অবস্থান, তার বিপ্লব, তার কষ্ট তুলে ধরা হয়েছে অসাধারণভাবে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, আইশোলপান যখন প্রথম প্রতিযোগিতায় যায়, তখন সে বড় বড় শিকারিদের হারিয়ে প্রথম হয়।

স্টার ওয়ার্স ফ্রাঞ্চাইজির নতুন জেডাই-এর চরিত্রের অভিনেত্রী ডেইজি রিডলি এ ডকুমেন্টারিতে ন্যারেটর হিসেবে কাজ করেছেন। মজার ব্যপার হচ্ছে রিডলি এ প্রজেক্টের সাথে প্রথমে যুক্তই ছিলেন না; কিন্তু এটির ফার্স্ট-কাট দেখে তার এতই ভালো লেগে যায়, তিনি নিজেই যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব রাখেন। পরিণামে তাকে এক্সকিউটিভ প্রডিউসার ও ন্যারেটর হিসেবে যুক্ত করা হয়।

অসাধারণ ভিজুয়াল, মার্জিত ডকুমেন্টেশন এবং সুন্দর ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর দেওয়া হয়েছে এই গল্পে। আর অসাধারণ সব ল্যান্ডস্কেপের সাহায্য অবশ্যই দেখার মতো ফিল্ম হয়ে উঠেছে এটি।

থ্রি বিলবোর্ড আউটসাইড এবিং, মিসৌরি

এটি একটি ক্রাইম ঘরানার সিনেমা। সিনেমাটি লিখেছেন ও ডিরেক্ট করেছেন মার্টিন ম্যাকডোনাহ। সিনেমার সারমর্ম করলে দাঁড়ায়– একজন মা ব্যক্তিগতভাবে স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে চ্যালেঞ্জ করে যখন তার অপরাধীকে ধরতে ব্যর্থ হয়, তখন সে নিজের মেয়ের হত্যাকারীদের ধরার চেষ্টা চালায়।

২০১৭ সালের হলিউডের সিনেমাগুলোর মধ্যে আমার সবচেয়ে পছন্দের সিনেমা এটি। এই সিনেমায় আছেন ফার্গো ফিল্মে অসাধারণ অভিনয়ের জন্য অস্কারজয়ী ফ্রান্সেস ম্যাকডর্ম্যান্ড। অন্যান্য চরিত্রে আছেন স্যাম রকওয়েল, ল্যান্ড্রি জোনস, উডি হ্যারেলসন প্রমুখ।

…অবিচার সম্পর্কে বলার
জন্য কয়েকটি শব্দে অনুভূতি
প্রকাশ এবং কয়েকটি শব্দ
ছাড়াও খুব সাধারণভাবে অনেক
বড় কিছু করা যায়– এখানে
তা সুস্পষ্ট করে তুলে
ধরা হয়েছে…

সিনেমাটির গল্প এগিয়েছে এক মায়ের চরিত্রকে ঘিরে– যে কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া তার মেয়ের হত্যার বিচার চায়। হত্যার অনেক দিন পেরিয়ে গেলেও মেলে না হত্যাকারীর খোঁজ। তখন এবিংয়ে পড়ে থাকা তিনটি বিলবোর্ডকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে সে নিজের মেয়ের হত্যাকারীর বিচারের দাবিতে। তখনই ঘটতে থাকে বিভিন্ন ঘটনা। একজন মা যেভাবে মেয়ের হত্যাকারীদের খুঁজে পায়, এ যাত্রায় তা দেখানো হয়েছে খুব সুন্দরভাবে।

অবিচার সম্পর্কে বলার জন্য কয়েকটি শব্দে অনুভূতি প্রকাশ এবং কয়েকটি শব্দ ছাড়াও খুব সাধারণভাবে অনেক বড় কিছু করা যায়– এখানে তা সুস্পষ্ট করে তুলে ধরা হয়েছে। একটি দৃঢ় ভিত্তি তৈরি করে এবং একটি মর্মান্তিক বিপর্যয়ের সাথে সত্যিকারের অনুপ্রাণিত পরিস্থিতিগত কাহিনিতে অক্ষরগুলির মিল স্থাপন করা হয়েছে এখানে।

অবিচ্ছিন্ন সম্ভাবনার সঙ্গে একটি ভূমিকা কোনো সীমা ছাড়াই একজন মায়ের শপথ এবং ককটেল নিক্ষেপ ও প্রতিবাদের মাধ্যমে নিজের অনন্য শৈলী বুঝিয়ে দেওয়াটাই এ ফিল্মের লিড ক্যারেক্টারটির শক্তি। ফ্রান্সেস ম্যাকডর্ম্যান্ড এই চরিত্রটি ফুটিয়ে তুলেছেন অসাধারণভাবে। অস্কার জেতার দৌড়ে তাই সামনের সারিতেই থাকবেন তিনি। তবে আমার বাজি অবশ্য স্যাম রকওয়েলের ওপর! তার ক্যারেক্টারটি সিনেমাতে অদ্ভুতভাবে উপস্থাপন করেছেন ডিরেক্টর। সাপোর্টিং ক্যারেক্টারে তাই তার পুরষ্কার প্রাপ্তির সম্ভাবনা অনেক বেশি।

এই সিনেমার যে ব্যাপারটি দেখার মতো, তা হলো, ক্যারেক্টারগুলো। এগুলোর পোর্ট্রেট এমনভাবে করেছেন ডিরেক্টর, এদের নিয়ে না ভেবে উপায় নেই।

মাদার!

২০১৭ সালের যে সিনেমার জন্য ব্যক্তিগতভাবে বেশি অপেক্ষা করে থেকেছি, মাদার! তার নাম। সিনেমাটি ডিরেক্ট করেছেন ড্যারেন অ্যারোনোফস্কি। অ্যারোনোফস্কির ব্ল্যাক সোয়ান দেখে, এবার প্রত্যাশাও ছিল অনেক। মাদার! হতাশ করেনি।

এটি ড্রামা ও মিস্ট্রি ঘরানার সিনেমা। এর গল্প পরিচালিত হয় একটি দম্পতিকে ঘিরে– যারা একটি সুন্দর, দূরবর্তী বাড়িতে বসবাস করে। কাহিনি শুরু হয় যখন তাদের বাসায় একজন অবাঞ্ছিত হাউস-গেস্ট আসে। তারপর এটি বাহ্যিক জগৎ থেকে অগণিত অন্যান্য গৃহবন্দিদের এবং আক্রমনের দিকে পরিচালিত করে।

সিনেমাটিতে মুখ্যচরিত্রে অভিনয় অস্কারজয়ী অভিনেত্রী জেনিফার লরেন্স, এবং জাভিয়ার বার্ডেম। এছাড়াও রয়েছেন এড হ্যারিস, মিচেল ফিফার। ফিল্মটির সিনেমাটোগ্রাফি করেছেন ম্যাথু লিব্যাটিক– যা আমার কাছে সত্যি অসাধারণ লেগেছে। এই সিনেমাটি শুট করা হয়েছে ৮ মিমি সেলুলয়েডে। এজন্য কালার গ্রেডিং ছিল দেখার মতো। আর একটা জিনিসের কথা না বললেই নয়, তা হলো গ্রেইনের ব্যবহার– যা এক কথায় অসাধারণ।

…বাইরে থেকে এটি
আশ্চর্যজনক দেখায়, যদিও
বেশিরভাগ সময় আমরা
ভিতর
থেকে টের পাই কেবল
অভিজ্ঞতা…

একেক জনের কাছে সিনেমাটি একেক রকম লাগবে, জানি। অনেকের কাছে খুব ভালো, অনেকের কাছে খুব বাজে। আমি তাই সাধারণভাবে নিজের কথায় বলব, আমার কাছে এটা কেমন লেগেছে। সিনেমা সম্পর্কে বলতে গেলে, এটি একটি বিধ্বংসী এবং আঘাতমূলক গল্পের কথা বলে। বাইরে থেকে এটি আশ্চর্যজনক দেখায়, যদিও বেশিরভাগ সময় আমরা ভিতর থেকে টের পাই কেবল অভিজ্ঞতা। বাইরের জগতের গ্লানিগুলি জানালা বা খোলা দরজা থেকে এবং একই সীমাবদ্ধভাবে আমাদের দৃষ্টিতে তার দৃষ্টিকোণ থেকে অথবা তার মুখ থেকে ফোকাস করে, এবং তার প্রতিক্রিয়া অনুভব করে, প্রায় সম্পূর্ণভাবে পরিচালিত হয়। এখানে ঘর নিজেই একটি কারাগার এবং একটি  সিঁড়ি– যা আমরা আমাদের জন্য নির্মিত, যা আমরা ব্যবহার করি এবং যা আটকে রাখে আমাদের। এই সিনেমাতে দুইটি দিক থেকে ডিরেক্টর গল্প বলতে চেয়েছেন– প্রথমটি ধর্মীয় গল্প, অন্যটি নিখাদ প্রেমের। এ ব্যাপারগুলো বুঝতে চাইলে হলে দেখতে হবে মাদার!

বিসর্জন

আমার এই লিস্টে একমাত্র বাংলা ছবি– বিসর্জন। ডিরেক্ট করেছেন কৌশিক গাংগুলি। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে যত ডিরেক্টর রয়েছেন, অনেকের মতে, তার মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরভাবে স্টোরিটেলিং করতে পারেন কৌশিক। তার প্রতিটা গল্পের বিষয় এত সহজ, কিন্তু এই সহজ গল্পকে নিজের মতো সাজিয়ে বলাটায় তার স্কিল। শব্দ, ল্যাপটপ কিংবা খাদ দেখলেই তা সহজে বোঝা যাবে।

যাহোক, বিসর্জন-এর কথায় আসি। বাংলাদেশের এক বিধবার সঙ্গে কলকাতার এক ব্যবসায়ীর প্রেমের কাহিনি এটি। এই সিনেমার মূল ফোকাস প্রেমে থাকলেও পুরোটা অংশ জুড়ে রয়েছে একদা এক হয়ে থাকা ‘দুই বাংলা’র মাঝে কাঁটাতারের কারণ কিংবা কী কী বিভেদ, কেনই-বা বিভেদ ইত্যাদি। সিনেমার মুখ্যচরিত্রে অভিনয় করেছেন জয়া আহসান, আবীর ও কৌশিক গাংগুলি। এতে অসাধারণ মিউজিক করেছেন কালীকাপ্রসাদ।

মা,
ওপারে ইন্ডিয়া
এপারে বাংলা,
আমাদের ইছামতী নদী
কই?…

কাহিনি শুরু হয় ভারতের এক ব্যবসায়ী বর্ডার গার্ডের তাড়ায় আহত হয়ে বাংলাদেশে চলে আসার মধ্য দিয়ে। এক বিধবা তাকে পেয়ে সেবা-যত্ন দিয়ে সুস্থ করে তোলে। তাকে তার দেশে ফেরত পাঠানোর মাঝেই যতসব ঘটনা ঘটে যায় তার জীবনে। জয়া আহসানের দুর্দান্ত অভিনয়, এবং অন্যসবার অসাধারণ অভিনয় নতুন মাত্রা দিয়েছে সিনেমাটিকে। সিনেমার যে বিষয়ে বিশেষভাবে কথা না বললেই নয়, তা হলো– অসাধারণ সব ডায়ালগ।উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সিনেমার শুরুতেই এক বাচ্চা তার মাকে বলছে– “মা, ওপারে ইন্ডিয়া এপারে বাংলা, আমাদের ইছামতী নদী কই?” কতটা আবেগ দিয়ে এসব লেখা, সিনেমাটি না দেখলে বোঝা যাবে না।

বাংলাভাষী কয়েকজন ফিল্মমেকারের কিছু বিশেষ ব্যাপার রয়েছে। তারা নিজের সিনেমায় ‘দুই বাংলা’র মাঝখানের যে দূরত্ব– সেটা সবসময় দেখানোর চেষ্টা করেন। তাদের স্ক্রিপ্ট যেমনই হোক না কেন, এ সংক্রান্ত দু-একটা লাইন থেকেই যায়। এর মধ্য দিয়ে তাদের নিজ অবস্থান থেকে যে বিপ্লব, সেটা বোঝা যায়। এই সিনেমাটিও কৌশিকের অবস্থান থেকে বিপ্লব।

ভাইসরয়স হাউস

ভাইসরয়স হাউস মূলত ১৯৪৭ সালের দেশভাগের গল্প নিয়ে নির্মিত। এটি ডিরেক্ট করেছেন গুরিন্দার চান্দা। তার কাজের ক্ষমতা প্রকাশ পায় ২০০২ সালের প্রথম কমেডি মুভি বেন্ড ইট লাইক বেকহ্যাম-এ। গুরিন্দারের গল্প বলার সিগনেচার মূলত জানা-গল্প ভিন্ন-লোক দিয়ে বলানো, যেখানে গল্পটি পায় এক অন্য মাত্রা।

ভাইসরয়স হাউস-এর গল্প আবর্তিত হয়েছে উপমহাদেশের শেষ ভাইসরয়– লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে ঘিরে। উপমহাদেশের বিভক্তির শেষ সময়ে রাজনীতিকে ফোকাস করেছে মূলগল্পটি। মাউন্টব্যাটেনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন হিউ বনভিলা এবং লেডি মাউন্টব্যাটেনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন গিলিয়ান অ্যান্ডারসন। অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন মণীষ লায়াল, হুমা কোরেশি, ওম পুরি প্রমুখ। সিনেমাটির মিউজিক করেছেন এ.আর. রহমান।

…গুরিন্দারের গল্প
বলার অ্যাঙ্গেলটি আলাদা, তিনি
জানা-গল্প
অন্যভাবে বলতে চান…

যেমনটা  প্রথমেই বলা হয়েছে, গুরিন্দারের গল্প বলার অ্যাঙ্গেলটি আলাদা, তিনি জানা-গল্প অন্যভাবে বলতে চান। ঠিক তেমনিভাবে দেশভাগের কাহিনি আমাদের সবার জানা। কিন্তু তৎকালীন ভাইসরয়ের বাসার পরিস্থিতি কী ছিল, সেখানে তার কর্মচারীদের মধ্যকার অবস্থার আলোচনা রয়েছে এখানে। পূর্বেকার উপমহাদেশীয় আচার অনুযায়ী হিন্দু-মুসলমান– উভয় ধর্মের মানুষ সেখানে কাজ করত, কিন্তু যখনই দেশভাগ শুরু হয়, তখনই দেখা যায় সম্প্রীতিতে ফাটল। উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ভাইসরয়স হাউস। তাছাড়া এই সিনেমার রাজনীতির মাঝে এক ভালবাসার গল্প পাবেন সবাই, যা  বাসার চাকর জিত কুমার ও বাসার রেজিস্টার আলিয়ার মধ্যে ঘটে। কিন্তু দেশভাগের কারণে গল্পের মোড় কোনদিকে যায়, সেটাই দেখার বিষয়।

গল্পের সমোলোচনা বলতে একটা ব্যাপার থেকেই যায়, প্রতিটি ডিরেক্টর দেশভাগের সিনেমা বানানোর সময় গান্ধী কিংবা নেহেরুর ক্যারেক্টার নিয়ে ব্যস্ত থাকেন যে, মাউন্টব্যাটেনের চেহারার প্রতি নজর থাকে না। ঠিক তেমনিভাবে এ গল্পেও আসল ভাইসরয়ের সাথে এই ভাইসরয়ের মিল পাওয়া যায় না। আরেকটি ব্যাপার না বললেই নয়, এই গল্পে দেশভাগের মানচিত্রের ব্যাপারে এক নতুন তথ্য জানা যায়– যা সাধারণত আগের এ বিষয়ক চলচ্চিত্রগুলো দেখা যায়নি। কী সেটা, জানতে হলে দেখতে হবে সিনেমাটি!

পূর্ণা

পূর্ণা সিনেমাটি রাহুল বোস পরিচালিত দ্বিতীয় সিনেমা। প্রথম সিনেমা বানিয়েছিলেন ১৬ বছর আগে। তার দ্বিতীয় সিনেমার গল্প মূলত মাউন্ট এভারেস্ট জয়ের অভিযান ঘিরে– যা জয় করে ১৩ বছর ১১ মাস বয়সের পূর্ণা মালাভাথ। সে সবচেয়ে কম বয়সে বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ স্কেল করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। তার মাউন্টেইনার হওয়ার জার্নি নিয়েই তৈরি হয়েছে গল্পটি।

যে ব্যাপারটি সবচেয়ে ভালো লেগেছে, রাহুল বোস কোনো অপ্রয়োজনীয় মুহূর্ত কিংবা অহেতুক বিশৃঙ্খলা ছাড়াই সহজ একটি সিনেমা সম্পূর্ণ করতে পেরেছেন। তিনি পূর্ণা ও তার বিশাল অর্জনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেই অতিরঞ্জিত কোনোকিছু দেখাননি। গল্প শুরু হয় পূর্ণার দারিদ্র্য ও নিজের চাচাতো বোনের সঙ্গে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ঘিরে। তারপর তৎকালীণ তেলেঙ্গানা প্রদেশের মেয়েদের দারিদ্র্যতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বাচতে হয় তাকে। রাহুল বোস সিনেমাকে বোঝান এমনভাবে, যেন তা গ্ল্যামারকে অতিক্রম করে গল্প ও ক্যারেক্টারের দিকে পাড়ি দেয়।

পূর্ণা চরিত্রে অদিতি ইনামদার চমৎকার। তার অভিনয়ের মধ্যে অন্যরকম সাবলীলতা রয়েছে। দেখে মনে হয়, যেন কোনো ডকুমেন্টারির শুটিং চলছে, আর পূর্ণা করে চলেছে নিজের সাধারণ কাজকর্ম। তার মনোভাব যেন অসম্ভবকে সম্ভব করার, চাচাতো বোন প্রিয়ার প্রতি তার ভালবাসা, রক ক্লাইম্বিংয়ের প্রতি আবেগ– এ সকল ব্যাপারের মিশ্রণ একজন অল্পবয়সী অভিনেত্রীর কাছ থেকে এমন দুর্দান্তভাবে পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার!

…সিনেমাটি খুবই
ভালোভাবে বিন্যস্ত,
এবং
এটির দৈর্ঘ্য
প্রয়োজনমাফিকই…

অন্যদিক থেকে দেখা গেলে, সিনেমাটি খুবই ভালোভাবে বিন্যস্ত, এবং এটির দৈর্ঘ্য প্রয়োজনমাফিকই। যেমনটি আগেও বলেছি, প্রতিটি দৃশ্য একটি উদ্দেশ্য কেন্দ্র করে করা। দৃশ্য শুরু হয় একটি ধারণা জারি রেখে, শেষও হয় ধারণা জারি রেখেই। সংলাপ– বাস্তবসম্মত ও প্রয়োজনীয়। কিছু কিছু ডায়ালগের খুবই অসাধারণ ব্যবহার করা হয়েছে এখানে।

সিনেমাটির মিউজিক করেছেন সেলিম সুলায়মান– যা খুব হাল্কাভাবেই প্রয়োজনীয় জায়গায় ব্যবহার করা হয়েছে। অতিরঞ্জিতভাবে কোনো গান ব্যবহার করা হয়নি এখানে। আমরা অনেক বায়োপিকে দেখি কিছু হাস্যকর জায়গায় গান ব্যবহার করে মুড অন্যরকম করে দেওয়া হয়; তবে এই সিনেমার এমনতর অহেতুক জিনিস থেকে মুক্ত।

পূর্ণা একটি সহজ এবং অনুপ্রেরণামূলক সিনেমা। রাহুল বোস এখানে একটি সুরক্ষিত দিক যুক্ত করেছেন সহজ নির্মাণে, যে কারণে তিনি স্ট্যান্ডিং ওভিয়েশন পাওয়ার যোগ্য!

অ্যা ডেথ ইন দ্য গাঞ্জ

এ বছরের ভারতে অনেক সিনেমা মুক্তি পেলেও, একটি সিনেমার কথা না বললেই নয়। অ্যা ডেথ ইন দ্য গাঞ্জ। ডিরেক্ট করেছেন কংকনা সেনশর্মা।  কংকনা সেন আমার অনেক পছন্দের একজন অ্যাকট্রেস। তার বানানো প্রথম সিনেমার ট্রেইলারের পর অপেক্ষায় ছিলাম অনেক দিন। প্রিয় ডিরেক্টর অপর্ণা সেনের মেয়ের প্রথম সিনেমা। আশা তো খানিকটা ছিলই। তবে প্রথম সিনেমায় তিনি জাত চিনিয়েছেন এবং তার শরীরে যে অপর্ণার মতো ভার্সেটাইল পরিচালকের রক্ত বইছে, সেটা তার গল্প বলার ধরনেই বোঝা যাবে।

যাহোক, গল্পের ব্যপারে আসি। গল্পটি অতি সাধারণ। সময়কাল ১৯৭৯। ভারতের ঝাড়খন্ডের ম্যাকালেসগঞ্জ নামক এক গ্রামের বেড়াতে যাওয়ার পর এক ছেলের জীবনের আপস-অ্যান্ড-ডাউনসের গল্প নিয়ে সিনেমা।শিরোনামে খুনের কিংবা ক্রাইমের গন্ধ থাকলেও পুরো সিনেমাতে এ দুটি জিনিস একেবারে উহ্য। শুধু এক ছেলের জীবনকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে গল্পটি। প্রথমে মূলত দেখানো হয়, এক পরিবার পিকনিকে আসে ঝাড়খন্ডের পাহাড়ে। সেখানে তাদের জীবনে ঘটে যায় বিভিন্ন ঘটনা। শুধু তার জীবনে কিছু নতুন করতে চাই, নিজের জন্য ফাঁকা জায়গা চাই, কিন্তু পারিপার্শ্বিক চাপে তা করে ওঠা হয় না। ভারতে যেসব আন্ডাররেটেড শক্তিশালী অভিনয়শিল্পী রয়েছে, তাদের অনেকেই এ সিনেমায় অভিনয় করেছেন। মুখ্যচরিত্রগুলোতে রয়েছেন কালকি কোচলিন, গুলশান দেবিয়াহ, তিলোত্তমা শর্মী, ভিকরান্ত, ওম পুরি প্রমুখ। গল্প প্রথমে এক ধাক্কা দিয়ে শুরু হলেও আস্তে আস্তে জাল বোনা শুরু করে নিজে থেকেই।

…গল্প প্রথমে এক
ধাক্কা দিয়ে শুরু হলেও
আস্তে আস্তে জাল বোনা
শুরু করে নিজে
থেকেই…

এবার আসা যাক টেকনিক্যাল বিষয়-আশয়ে। এই সিনেমার মূল অস্ত্র– অসাধারণ সব দৃশ্যায়ন। সিনেমাটোগ্রাফার শীর্ষ রায়ের গুনগান না গাইলেই নয়। অসাধারণ ইন্টেরিয়র লাইটিং। মনে হয়নি সিনেমাটি এখনকার সময়ে বানানো হয়েছে; বরং এ যেন ৭০ দশকেই বানানো। পাহাড়ের ফ্রেমগুলো চমৎকার। আর সিনেমাটির সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন সাগর দেসাই। ভিজুয়ালের সাথে মিউজিকের সিনক্রোনাইজেশন অতি সুন্দর। এজন্য কংকনা সেনকে অবশ্যই কৃতিত্ব দিতেই হবে।

একটি কথা বললে অনেকের কাছে হয়তো অত্যুক্তি মনে হতে পারে, তবু বলতে চাই, যখন আমি এই সিনেমা দেখছিলাম, আমার মনে হচ্ছিল শরদিন্দুর কোনো গল্প পড়ছি কিংবা সত্যজিতের সিনেমা দেখছি। স্টোরিটেলিং, ভিজুয়াল দেখে মনে হয়েছে, যেন দেখছি অরণ্যের দিনরাত্রির কোনো সমকালীন অ্যাডাপটেশন। রিয়েলি ইটস ট্রুলি অ্যা মাস্টারপিস!

বলছি না এটি বলিউড কিংবা ভারতের এ বছরের সেরা মুভি; তবে বলছি, এই সিনেমা মিস গেলে আসলে অনেক বড় একটি মিস হয়ে যাবে!

দ্য ডিজাস্টার আর্টিস্ট

দ্য ডিজাস্টার আর্টিস্ট-এর ডিরেক্টর– বিখ্যাত অভিনেতা জেমস ফ্র্যাঙ্কো। তার ডিরেক্টিং ক্যারিয়ারে এটা যে সেরা মুভি, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। গ্রেগ সেস্টারো ও টমি ওয়াইসুর মধ্যকার বন্ধুত্ব এবং ‘ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে সিনেমা’ দ্য রুম বানানোর কাহিনি নিয়েই তৈরি হয়েছে ছবির মূল গল্প।

সিনেমার স্ক্রিনপ্লে অ্যাডাপ্ট করা হয়েছে গ্রেগ সেস্টারো ও টম বিসেলের লেখা দ্য ডিজাস্টার আর্টিস্ট : মাই লাইফ ইনসাইড দ্য রুম, দ্য গ্রেটেস্ট ব্যাড মুভি এভার মেড বইটি অবলম্বনে। নাম দেখেই বোঝা যায়, গ্রেগ সেস্টারো সিনেমায় অভিনয়ের সময় কিংবা টমি ওয়াইসুর মতো  রহস্য-মানবের সাথে কীভাবে কাজ করেছেন– তার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এখানে।

সিনেমাটির গল্প শুরুর প্রেক্ষাপট ১৯৯০ সাল। গ্রেগ সেস্টারো একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী অভিনেতা, যার কিছু অদ্ভুত স্বপ্ন তার নতুন বন্ধু টমি ওয়াইসু পূরণ করে। একসঙ্গে, টমি আর গ্রেগ লস অ্যাঞ্জেলেসে আসে নিজেদের স্বপ্ন অর্থাৎ অভিনয়ে সফল হওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে। তাদের সে স্বপ্ন হতাশায় ডুবে যায় বিশেষত টমির অদ্ভুত আকৃতি, অদ্ভুত বাচনভঙ্গি ও ব্যক্তিত্বের কারণে চারপাশের প্রায় সবাই তাকে বিদ্রূপ করে বলে। গ্রেগের পরামর্শ নিয়ে, টমি নিজের সিনেমা তৈরি করতে অনুপ্রাণিত হয়। সেখানেই শুরু হয় বিভিন্ন ঘটনা। রহস্য-মানব টমির বাকি জীবনের জন্য সিনেমাটি দেখা অবশ্যই দরকার।

…টমির মতো
বাচনভঙ্গি
বের করা আসলেই
কঠিন…

সিনেমার টেকনিক্যাল দিকটি খুবই স্ট্যান্ডার্ড; তবে কেন যেন স্টেডিক্যামের কাজগুলো আমার কাছে খুবই শিশুতোষ বলে মনে হয়েছে! হয়তো দ্য রুম-এর ব্যাপারটা অ্যাডাপ্ট করার জন্যই হয়েছে এমন। সিনেমাটিতে টমির চরিত্রে অভিনয় করেছেন খোদ জেমস ফ্র্যাঙ্কো, এবং ডেভ ফ্র্যাঙ্কো করেছেন গ্রেগের চরিত্রে অভিনয়। সবার সাবলীল অভিনয় দেখার মতো। বিশেষ করে, জেমস ফ্র্যাঙ্কোর অভিনয় সত্যিই অসাধারণ; কেননা, টমির মতো বাচনভঙ্গি বের করা আসলেই কঠিন। তার ফলাফল হিসেবে জেমস পেয়ে গেছেন এবারের গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ড। এখন দেখা যাক, অস্কারে কী হয়! তবে সিনেমার গল্প বলার ধরনের জন্য জেমসের স্ট্যান্ডিং ওভিয়েশন প্রাপ্য।

দ্য রেড টার্টল

আমার এই লিস্টের একমাত্র অ্যানিমেটেড মুভি হলো– দ্য রেড টার্টল। এটির ডিরেকশন দিয়েছেন মিখাইল দুদক দু ভিত। সিনেমাটি  রিলিজ পেয়েছে স্টুডিও গিব্লি থেকে। নামটি চেনা লাগছে? এটিই জাপানের সেই বিখ্যাত স্টুডিও, যেখান থেকে বের হয়েছে স্পিরিটেড অ্যাওয়ে কিংবা প্রিন্সেস মনোনোকের মতো সিনেমা।যারা একটু কন্টেন্ট অ্যানিমেটেডের ফ্যান, তাদের জন্য এটি একটি মাস্ট ওয়াচ!

গল্পের শুরু হয় একটি জাহাজ ডুবে যাওয়া নাবিকের কাহিনি ঘিরে– যে অবিরাম বিশাল ঢেউয়ের বিরুদ্ধে লড়ে যায় একা একা। একা, দুর্ভিক্ষের কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য নির্ধারিত খাদ্য এবং তাজা জলের জন্য প্রস্তুতি, এবং ঘন বন দেখে উৎসাহিত হওয়ার পরে নাবিকটি একটি নৌকা তৈরি করে নেয়, আর এগিয়ে যায় বিস্তৃত সমুদ্রের দিকে। কিন্তু এক অস্পষ্ট প্রতিদ্বন্দ্বী তার পথে বাধা হয়ে থাকে। প্রতিটি দিন, ক্লান্ত মানুষটি কোনো প্রত্যাশা ছাড়াই, আরও উন্নত নৌকা তৈরির চেষ্টা করে যায়; কিন্তু সমুদ্রের বিস্ময়কর ঢেউ ও রহস্যময় দ্বীপটির একমাত্র লাল কচ্ছপ তাকে যেতে দেয় না অন্য কোথাও। এই নির্দয় শত্রুর সঙ্গে তার সম্পর্কের কাহিনি নিয়েই তৈরি এই সিনেমা।

…সমুদ্রের বিস্ময়কর
ঢেউ ও রহস্যময় দ্বীপটির
একমাত্র লাল কচ্ছপ
তাকে যেতে দেয় না
অন্য কোথাও…

এই সিনেমার সিগনেচার ব্যাপার হলো, স্টুডিও গিব্লির স্বাতন্ত্র। জাপানের বাইরের কোনো ডিরেক্টরকে দিয়ে এই স্টুডিওর বানানো প্রথম সিনেমা এটিই। মজার ব্যাপার হচ্ছে, মিখাইল দুদকের ডটার অ্যান্ড ফাদার শর্টফিল্মটি দেখার পর লিজেন্ডারি  ডিরেক্টর হায়াকো মিয়াজাকি তার সঙ্গে সিনেমা বানানোর আগ্রহ দেখান; কিন্তু এ কথা শোনার পর মিখাইল এটিকে স্রেফ ইয়ার্কি ভেবে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। পরে দুজনের সরাসরি দেখা হওয়ার পরেই কেবল বিশ্বাস করেন।

অ্যা গোস্ট স্টোরি

এ বছরে আমার দেখা সবচেয়ে পিস বা প্রশান্ত মুভি মনে হয়েছে অ্যা গোস্ট স্টোরিকে। জানি না কেন এই সিনেমার প্রত্যেকটি জিনিস আকর্ষণীয় মনে হয়েছে আমার কাছে! সিনেমাটি পরিচালনা করেছেন ডেভিড লোয়ারি। অভিনয় করেছেন ক্যাসি অ্যাফ্লেক, রুনি ম্যারা প্রমুখ।

সিনেমার নাম ভূতুরে হলেও সিনেমাতে ভয়ের কিছু নেই। সবচেয়ে যে জিনিসটা দেখার মতো, তা হলো, ভূতের ড্রেস। আমরা ভূতের নানা রকম মেকআপ কিংবা ভিএফেক্স রূপ দেখার পর ভূতের আদি চেহারা ভুলে গেছি! এই ভূতের সাথে মিল পাওয়া যাবে আমাদের আদিভূতের। সাদা একটা কাপড়, গোলগোল চোখ… এই ভূতকে তুলে ধরা হয়েছে অতি সাধারণভাবে।

…অবশেষে
উত্তরাধিকার, প্রেম, ক্ষতি

অস্তিত্বের অহংকারের এই একক অনুসন্ধানে,
স্ত্রীর সাথে পুনঃসংযোগ
করার চেষ্টা করার
জন্য ফিরে আসে
স্বামীটি…

গল্প শুরু হয় এক সুখী দম্পতির হাত ধরে, যারা নতুন বাসায় ওঠে। সেখান তারা মাঝে মধ্যে ভূতের উপদ্রব উপলব্ধি করে। পরে, স্বামী বাসা ছাড়তে না চাইলেও স্ত্রী চায়। হঠাৎ এক্সিডেন্টে স্বামী মারা গেলে কাহিনি বাঁক নেয়। অবশেষে উত্তরাধিকার, প্রেম, ক্ষতি ও অস্তিত্বের অহংকারের এই একক অনুসন্ধানে, স্ত্রীর সাথে পুনঃসংযোগ করার চেষ্টা করার জন্য ফিরে আসে স্বামীটি। এসে তার মতো অনেককেই দেখতে পায় সে। এরচেয়ে বেশি কিছু বললে সিনেমার মজাটা নষ্ট করা হবে বলে বলছি না! বাকিটা দেখে নিতে হবে।

তবে আমি আগেই মাফ চেয়ে নিচ্ছি তাদের কাছে থেকে, যাদের এই মুভি দেখে ভালো লাগবে না। এটা অনেক স্লো মুভি। অনেকের ভালো না-ই লাগতে পারে; তবে মারামারি আর ভায়োলেন্সের সিনে-দুনিয়া থেকে শান্তি পেতে চাইলে সিনেমাটি দেখা উচিত।

আই, টনিয়া

সিনেমাটি পরিচালনা করেছেন ক্রেগ গিলেস্পি। কাহিনি লিখেছেন স্টিভেন রজার্স। বায়োপিক ধরনের সিনেমা হলেও এটি আর-দশটি বায়োপিকের মতো আপনাকে প্রেরণা যোগাবে না; আর এটিই সবচেয়ে দেখার বিষয়। সিনেমাটি আমেরিকান আইস-স্কেটার টনিয়া হার্ডিংয়ের চরিত্র অবলম্বনে করা হয়েছে। তার অবাক জীবন আর অবাক করা বেড়ে ওঠার গল্পই ফোকাস করে এগিয়েছে এটি।

টনিয়া হার্ডিং সম্পর্কে মজার বিষয় হলো, চারপাশের সবাই তাকে কুৎসিত ভাবত, এবং রেডনেক বলে গালি দিতো। সিনেমার  প্রথমের দিককার ব্যাপার দেখে মনে হবে, এ একটি সিম্পল কমেডি, আর আজব আজব শটে ভরা। আই, টনিয়াতে যদি আপনারা চকচকে ব্যাপার খুঁজতে চান, পাবেন না। যদিও গল্পটি নিখুঁতভাবে মূলচরিত্র দেখানো থেকে দূরে নড়াচড়া না করিয়ে বরং সামগ্রিকতার দিকে নিয়ে যায়, তবে তা আশাব্যঞ্জক না করে আপনাকে উল্টো ব্যথা দিতে সদাপ্রস্তুত। এই সিনেমার আরেকটি মজার ব্যাপার হলো, টনিয়া প্রথম আমেরিকান মেয়ে, যে ট্রিপল এক্সেল নামের এক স্পেশাল মুভ দিতে পারে আইস স্কেটিংয়ে। কিন্তু অনেক কাহিনির পর সে স্কেটিং ছেড়ে বক্সিংয়ে ক্যারিয়ার গড়ে তোলে। তার এই তাক লাগানো জার্নি করেছে এই সিনেমাকে অলংকৃত।

…যদিও গল্পটি নিখুঁতভাবে
মূলচরিত্র দেখানো থেকে
দূরে নড়াচড়া না করিয়ে
বরং
সামগ্রিকতার দিকে নিয়ে যায়, তবে
তা আশাব্যঞ্জক না করে
আপনাকে
উল্টো ব্যথা দিতে
সদাপ্রস্তুত…

এই সিনেমাটির স্ক্রিনপ্লে অ্যাডাপ্ট করা হয়েছে টনিয়াকে নিয়ে করা এক ডকুমেন্টারি অবলম্বনে। তাই এখানেও ডকুমেন্টারির একটি সুস্পষ্ট ছাপ পড়ে আছে। এতে অভিনয় করেছেন সুইসাইড স্কোয়াড-এর হার্লি কুইন চরিত্রের অভিনেত্রী মার্গট রবি; তবে এখানে ফ্ললেস অভিনয় করার ফলে তাকে এখন সবাই প্রথম সারির অভিনেত্রী হিসেবেই মেনে নেবে। এছাড়াও অন্যান্য চরিত্রে রয়েছেন সেবাস্টিয়ান স্ট্যান, অ্যালিসন জ্যানারি প্রমুখ।

মার্গট রুবিকে অস্কারের জন্য আরও অপেক্ষা করতে হলেও, এবার সাপোর্টিং অভিনেত্রীর পুরস্কারটির জন্য অ্যালিসন জ্যানারির ওপর বাজি রাখছি আমি!

দ্য বিগাইল্ড

এই সিনেমাটি পরিচালনা করেছেন সোফিয়া কপোলা।  তিনি মাস্টার ডিরেক্টর ফ্র্যান্সিস ফোর্ড কপোলার কন্যা। দ্য বিগাইল্ড অসাধারণ গল্প ও সুন্দর ইন্টেন্সিভ মুডে তৈরি।

সিনেমার গল্পটি নেওয়া হয়েছে থমাস কালিন্যানের একই শিরোনামের বইটি থেকে। গল্পটি ১৮৬৪ সালের, যখন আমেরিকান গৃহযুদ্ধ চলছিল। ভার্জিনিয়ায় একটি মেয়েদের স্কুলে আহত এক ইউনিয়ন সৈনিকের অপ্রত্যাশিত আগমনের ফলে নিজেদের মধ্য যে ঈর্ষা ও বিশ্বাসঘাতকতা ঘটে– তার মিশ্রণ হলো দ্য বিগাইল্ড। তরুণ মার্থা ফার্নসওয়ার্থ যুবতীদের জন্য স্কুলে এখনও মাতৃতান্ত্রিক; একজন শিক্ষক ও স্প্যানিশ-ভার্জিনিয়ার পাঁচজন শিক্ষার্থীর সাথে দখল নিয়ে আছে। যখন মারাত্মক আহত কার্লাল্ড জন ম্যাকব্রিনিকে তারা তাদের স্কুলের বাইরে আবিষ্কার করে এবং সে হঠাৎ মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডায়মান হয়, তখন তার দুর্লভ ভারসাম্য বজায় থাকে; কেননা, দ্বিধাহীন হেডমাস্টার তাকে আঘাত থেকে নিরাময় করার সিদ্ধান্ত নেয়। অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি একটি নির্জন বোর্ডিং স্কুলের নারীদের মধ্যে এক অসংযত যৌন উত্তেজক উত্থান হিসাবে আবির্ভূত হয় সিনেমাটিতে। প্রতিদ্বন্দ্বিতার পর স্কুলের সবার একসাথে থাকার ব্যপারটি মুখ্য হয়ে ওঠে এ সিনেমায়।

…অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি
একটি নির্জন বোর্ডিং স্কুলের
নারীদের মধ্যে এক অসংযত
যৌন উত্তেজক উত্থান
হিসাবে আবির্ভূত হয়
সিনেমাটিতে…

অন্যরকম এই গল্পের মুখ্যচরিত্রে অভিনয় করেছেন নিকোল কিডম্যান, কার্সট্যান ডার্নস্ট, কলিন ফ্যারেল প্রমুখ। সিনেমাটগ্রাফি করেছেন ফিলিপ লা সর্ড; তার ফ্রেমিং ইন্টেন্স ক্যমেরা মুভমেন্ট… প্রতিটি জিনিসই প্রশংসার দাবিদার।

এছাড়াও অনেক সিনেমা রয়েছে, যার বর্ণনা দেওয়া হলো না; তবে নাম দেওয়া হলো, যেন সময়-সুযোগ পেলে দেখে নিতে পারেন।

আভা / সাদাফ ফরুগি
দ্য ফ্লোরিডা প্রজেক্ট / শন বেকার
দ্য কিনিং অব অ্যা সেক্রেড ডিয়ার / ইয়োর্গোস লান্থিমোস
কল মি বাই ইউর নেম / লুকা গাদাগনিনো
লেডি বার্ড / গ্রেটা গার্ভিগ
ফার্স্ট দে কিলড মাই ফাদার / অ্যাঞ্জেলিনা জোলি
দ্য ব্রেডউইনার / নোরা টুমে
দ্য স্কয়ার / রুবেন অস্টলান্ড
দ্য পোস্ট / স্টিভেন স্পিলবার্গ
ফ্যানটম থ্রেড / পল থমাস অ্যান্ডারসন
অ্যা ফ্যান্টাস্টিক ওম্যান / সেবাস্টিয়ান লিলিও
দ্য পট অ্যান্ড দ্য ওক / কিয়ারাস আনভারি

Print Friendly, PDF & Email
সিনে-কর্মী, বাংলাদেশ । জন্ম রাজশাহী । পড়াশোনা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, যোগাযোগ এবং সাংবাদিকতা বিভাগে । পাঠ নিচ্ছেন সিনেমাটোগ্রাফির; কাজ করছেন অ্যাসিস্ট্যান্ট সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে

১টি কমেন্ট

Leave a Reply to জয়া আহসান : অন্ধকার পর্দার আলো/ নূরুল আলম আতিক | ফিল্মফ্রি

Please enter your comment!
Please enter your name here